অন্তরের জিনিসকে বাহিরের, ভাবের জিনিসকে ভাষার, নিজের জিনিসকে বিশ্বমানবের এবং ক্ষণকালের জিনিসকে চিরকালের করিয়া তোলা সাহিত্যের কাজ।১
কবিতার ভাষা নিয়ে কবে থেকে আলোচনা শুরু হয়েছে তা নিশ্চিতভাবে কেউ বলতে পারে না। কবিতার প্রত্যেক আলোচক একটি যুগের স্বাক্ষর রেখে মাঝখান থেকে কিছু কথা বলতে পারেন মাত্র। কবিতার ভাষাই কবিতার শারীরকাঠামো, আর শারীরকাঠামোর ভেতরই থাকে এর প্রাণ। তবে দেহ আর প্রাণ মিলে জীবন্ত প্রাণীসত্তা হতে পারে, কিন্তু শিল্প হতে পারে না। কারণ, দেহ আর প্রাণ নিয়ে সকল প্রাণীর জৈবসত্তাই কালজুড়ে টিকে থাকে। এটাকে জীবাত্মাও বলা যায়। জীবাত্মার ঊর্ধ্বে উঠলেই মানবাত্মার দেখা মেলে। মানুষের মধ্যে ইতর-ভদ্র থেকে আরও ঊর্ধ্বে উঠতে পারলেই মহাত্মার দেখা মেলে, তারপরে মেলে পরমাত্মার সন্ধান। যাঁরা আত্মায় বিশ্বাস করতে পারেন না, তাঁরা জৈবসত্তা, মানবসত্তা, মহাসত্তা এবং পরমসত্তা হিসেবে বিষয়টি দেখতে পারেন। কবিতাও ভাষায় প্রকাশিত অনুভবের পরমাত্মা।
মানুষের উপমায় উপমিত করা যায় কবিতার সত্তাকে। দেহ পাওয়া গেলো, প্রাণ পাওয়া গেলো, এতে কি কবিতা হয়ে গেলো? না। আগের যুগে পাঁচালীকে কাব্য বলা হলেও এ যুগে কবিতা বলা যায় না। কবিতার ভেতরে প্যাঁচাল কিংবা আলাপ, বিলাপ, সংলাপ, প্রলাপ ইত্যাদি থাকতে পারে, কিন্তু এগুলোই কবিতা নয়। তাহলে কবিতা কী? এ প্রশ্নের উত্তর অনেক রকম আছে। কবিতা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশের নানাজন নানা কথা বলে গেছেন, লিখে গেছেন। বর্তমান রচনায় সে-সব কথা থেকে কিছু উক্তি তুলে ধরা হবে, সামান্য আলোচনাও করা হবে। এর বাইরে অজস্র উক্তি, সংজ্ঞা ও আলোচনা রয়ে গেছে এবং থাকবে। বর্তমান রচনার উদ্দেশ্য—পাঠকের চিন্তা জাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা, যেন পূর্বপঠিত ভাব, চিন্তা ও আলোচনাগুলো আরেকবার মনে পড়ে যায়। প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের বিশেষ করে গ্রিক ও রোমান সাহিত্যতাত্ত্বিক, ব্রিটিশ ও আমেরিকান ইংরেজি ভাষার কবি এবং প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃত ভাষার কাশ্মীরি আলঙ্কারিক ও বাঙালি কবি এবং কবিতাসংশ্লিষ্ট মনীষীদের মধ্যে কয়েকজনের উক্তি এখানে বাছাই করে নেওয়া হয়েছে। সচেতন পাঠক লক্ষ করবেন। কারণ সবারই জানা, পুরনো চিন্তা থেকেই নতুন চিন্তার উৎপত্তি এবং উৎসারণ। এখানে আলোচিত অনেকের উক্তি ও সংজ্ঞা আগের কারও না কারও চিন্তা ও কথার সঙ্গে মিলে যায়, এটাই সত্য এবং স্বাভাবিক।
আলোচনার সুবিধার জন্য বর্তমান রচনায় আলোচিত বিষয়কে তিনটি কালে ‘যুগবিভাগ’ করে নেওয়া হয়েছে। প্রাক-ঔপনিবেশিক যুগ, ব্রিটিশ-উপনিবেশিক যুগ এবং উত্তর-ঔপনিবেশিক যুগ। বর্তমান রচনায় স্বাধীন বাংলাদেশের কবিতার ভাষা নিয়েও আলোচনা করার ইচ্ছা থাকলেও পর্যাপ্ত বই-পুস্তক ও তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে না পারায় সে অংশটি আপাত বাদ দিতে হলো।
প্রথম অধ্যায়: প্রাক ঔপনিবেশিক যুগ
পুরনো যুগ থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত কয়েকজন কাব্যবিদের কথার ভেতর দিয়ে কবিতার ভাষা সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়ার চেষ্টা করা যায়।
ক. আরিস্ততল (৩৮৪—৩২২ খ্রি.পূ.) গ্রিক দার্শনিক। সমকালীন দর্শন ছাড়াও শিল্পসংস্কৃতি নিয়ে তিনি কালজয়ী কিছু গ্রন্থ রচনা করেছেন। তিনি বিখ্যাত পোয়েটিকস গ্রন্থে কবিতা, নাটক ইত্যাদির নানা দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন, নির্দেশনা প্রদান করেছেন। কবিতা সম্পর্কে বলেছেন, “কবির কাজ নয় যা ঘটেছে তার বিবরণ দেওয়া, কবির কাজ যা ঘটতে পারে, সম্ভাব্যতার বা অনিবার্যতার বিধি অনুযায়ী যা ঘটা সম্ভব, তার কথা বলা।” তাঁর এ ধারণাটি শুধু কবিতা নয়, সাহিত্যের অন্যান্য প্রকরণ প্রসঙ্গেও বিবেচ্য। কথাসাহিত্যেও প্রয়োগ করে থাকেন অনেকে। যেমন, গল্পপ্রসঙ্গে বলা যায় যা ঘটেছে সেটি গল্প নয় ঘটনা; গল্প হলো সম্ভাব্য ঘটনার কল্পরূপ।
গ্রন্থটির একবিংশ পরিচ্ছেদে আরিস্ততল কাব্যে ব্যবহৃত শব্দ নিয়ে নানা প্রকার আলোচনা করেছেন। প্রথমত শব্দকে সরল অর্থাৎ অর্থহীন উপাদানে গঠিত এবং দ্বৈত, যার একাংশ অর্থপূর্ণ এবং অপরাংশ অর্থহীন বলে ভাগ করেছেন। পরে শব্দকে অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে আট প্রকারে বিভক্ত করেছেন। এই বিভাজনটিও খুব গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, ‘শব্দমাত্রই হয় ১. প্রচলিত ২. অপ্রচলিত ৩. রূপক ৪. অলঙ্কার ৫. সদ্যপ্রবর্তিত ৬. সম্প্রসারিত ৭. সংকুচিত এবং ৮. অপরিবর্তিত।’২
বাংলা সাহিত্যের প্রথম দিকের নিদর্শন থেকে দেখা যায় মনের অজান্তেই বড়ু চণ্ডীদাস এই নিয়ম মেনে চলেছেন। তিনি প্রচলিত তদ্ভব শব্দ নিয়েছেন, অপ্রচলিত তৎসম শব্দ নিয়েছেন, রূপক-অলঙ্কার শব্দ নিয়েছেন, সদ্যপ্রবর্তিত কয়েকটি আরবি-ফারসি শব্দও গ্রহণ করেছেন। আসলে এটি একটি সর্বজনীন বিধান, না মেনে পারা যায় না। একজন জাপানি কবিকে প্রচলিত সমাজে প্রচলিত শব্দ হিরাগানা অক্ষরে, বিদেশাগত, সদ্যপ্রবর্তিত শব্দ কাতাকানা অক্ষরে এবং অপ্রচলিত প্রাচীন চীনা শব্দ কাঞ্জি অক্ষরে লিখতে হয়। উত্তর আফ্রিকার কবিদের এভাবে প্রচলিত আরবি শব্দের সঙ্গে অপ্রচলিত প্রাচীন শব্দ এবং সদ্যপ্রবর্তিত ইংরেজি, ফরাসি, স্প্যানিশ বা ইতালিয়ান ভাষার শব্দগ্রহণ করতে হয়। অদূর ভবিষ্যতেও আরিস্ততলের উক্তিটির যাথার্থ্য বজায় থাকবে।
খ. ডায়োজিনিয়াস লঙ্গিনুস (তৃতীয় শতক খ্রি. পূ.):
… কবিতা এবং সাহিত্যে প্রযুক্ত মহান রচনাশৈলীর কথা সাধারণভাবে বলতে গিয়ে আমাদের অবশ্যই বিবেচনা করে দেখতে হবে যে, কোনো কোনো রচনা কেবল নির্বিচারে প্রযুক্ত ব্যাপক অলঙ্করণের জন্যই মোটামুটি একটা ঐশ্বর্যের ভাব-দ্যোতনা বহন করে কিনা, এবং যখন এইগুলোকে ভাষাদেহ থেকে খুলে নেয়া হয়, তখন নিছক শব্দাড়ম্বরে পর্যবসিত হয় কি না—এমন রচনাংশকে প্রশংসা করার চেয়ে ঘৃণা করাই অধিকতর মহত্তের কাজ। …
যদি কোনো বুদ্ধিমান এবং ভালো পড়ুয়া লোক বেশ কয়েকবার ধৈর্য সহকারে রচনার পাঠ শুনতে পারেন, এবং তারপরও যদি তা মহান ঐশ্বর্যের দ্যোতনা নিয়ে পাঠকের আত্মাকে স্পর্শ না করে এবং তা যদি কেবল শব্দগুলো যে অর্থ-দ্যোতনা বহন করে—তার চেয়ে মনের ভাবনার উপযোগী অনেক বেশি জিনিস না দিতে পারে, পরন্তু দীর্ঘ যত্ন সহকারে পরীক্ষা করলে যা ক্রমশঃ বেশি করে নিজের আবেদনশীলতা হারিয়ে ফেলে, তাহলে তা কখনই সত্যিকারের সমুন্নত রচনার উদাহরণ হতে পারে না, যদি না তা একের অধিকবার শ্রুত হবার দাবি রাখতে পারে।৩
লঙ্গিনুস গ্রিক আলঙ্কারিক ও সাহিত্যতাত্ত্বিক। তিনি কবিতার ভাষা, বিষয় এবং চিন্তা ও কল্পনা নিয়ে ব্যাপক ও গভীর আলোচনা করে গেছেন। তিনি মনে করেন নিছক শব্দাড়ম্বরপূর্ণ কবিতার প্রশংসা করার চেয়ে ঘৃণা করা উচিত এবং সেটিকেই তিনি মহত্ত্বের কাজ বলে মনে করেন, এটি অত্যন্ত উগ্র মতবাদ বলে মনে হলেও সত্যিকার মহান সাহিত্যবিচার করার জন্য তাঁর এ মতটির গুরুত্ব রয়েছে। মহান ঐশ্বর্য নিয়ে পাঠকের কানের ভেতর দিয়ে প্রবেশ করে কোনো কাব্য যদি প্রচলিত শব্দার্থের দ্যোতনা ছাড়িয়ে মনের ভাবনার উপযোগী অনেক বেশি কিছু দিতে না পারে তাহলে সেটি তাঁর মনে সমুন্নত রচনা হতে পারে না। একের অধিকবার শ্রুত হওয়ার দাবি বলতে তিনি প্রজন্মক্রমে নতুন পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্যতার কথাই মূলত বলেছেন। লঙ্গিনুস আরেকটি বিষয় বলেছেন, সেটি হলো যত্ন সহকারে পরীক্ষা করা। সৃজনশীল সাহিত্যিক বা কবি সাধারণত কাব্য লিখিত হয়ে যাওয়া এবং প্রকাশ করার পরে বিচারকদের কাছে কোনোরকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভেতর দিয়ে যেতে চাইবনে না। কিন্তু লঙ্গিনুস সেটি পরীক্ষা করে দেখতে বলেছেন। বার বার পরীক্ষা করার পরেও যদি আবেদনশীলতা অক্ষুণ্ন থাকে, তাহলে সেটিকে তিনি কালজয়ী কাব্য হওয়ার উপযোগী বলে মনে করেন।
গ. হোরেস (৬৫—০৮ খ্রি. পূ.)
তোমরা তোমাদের শব্দ ব্যবহারে সতর্ক এবং কৌশলী হলে রচনার উৎকর্ষ (আসলে ঔৎকর্ষ) দেখাতে পারবে। পছন্দসই শব্দ প্রয়োগের মুন্সিয়ানা পরিচিত শব্দের নতুন অর্থ সৃষ্টি করতে পারে। যদি এমন হয় দুর্বোধ্য বিষয় আলোচনার জন্য নতুন পরিভাষা উদ্ভাবন করতে হচ্ছে, তাহলে তোমাদের নতুন শব্দ তৈরিরও সুযোগ এসে যাবে, যা রোমীয় পূর্বপুরুষদের কাছে ছিলো অজ্ঞাত এবং যতক্ষণ তোমরা যোগ্যতায় বা বিচক্ষণতার সাথে এ কাজ করবে, ততক্ষণ এ কাজে কেউ আপত্তি করবে না।৪
হোরেস বর্তমান আলোচনায় সাহিত্যতাত্ত্বিকের মধ্যে রোমান সভ্যতার একমাত্র নিদর্শন। মানবসভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারাবাহিকতায় গ্রিক সভ্যতার পরে রোমান সভ্যতার উত্থান ঘটে। সভ্যতা মানে নতুন ধর্ম, দর্শন, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতিসহ ব্যাপক কিছু। কাজেই পুরনো গ্রিক সভ্যতার কাব্যরীতি যে রোমান সভ্যতায় অবিকল প্রচলিত থাকবে, তা নয়। হোরেস তাঁর কাব্যতত্ত্বে নতুন সভ্যতার জন্য কিছু কাব্যাদর্শ রেখে গেছেন। ওপরের উক্তিটিতে দেখা যায়, তিনি কাব্যে ব্যবহার্য ভাষার শব্দ নিয়ে কথা বলেছেন। পছন্দসই শব্দপ্রয়োগের মুন্সিয়ানার মাধ্যমে তিনি কবিতায় নতুন অর্থ তৈরি করা কথা বলেছেন। নবগঠিত সভ্যতায় সমাজে প্রচলিত কিন্তু দুর্বোধ্য বিষয় আলোচনার জন্য তিনি নতুন পরিভাষা সৃষ্টি করে নেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন, এভাবেই তো যুগে যুগে নতুন সভ্যতা সমৃদ্ধ হয়। পূর্বপুরুষদের কাছে অজ্ঞাত কিন্তু নতুন যুগের পাঠকের রুচি অথবা প্রায়োজন অনুসারে যদি নতুন শব্দ সৃষ্টি করা যায়, আর তা যদি আপন যোগ্যতা ও কবির বিচক্ষণতায় প্রয়োগ করা যায়, তাহলে পাঠকশ্রেণী থেকে আপত্তি উঠবে না বলে তিনি মনে করেন।
ঘ. আচার্য আনন্দবর্ধন (নবম—দশম শতাব্দী):
যস্মিন্নস্তি ন বস্তু কিঞ্চন মনঃপ্রহ্লাদি সালংকৃতি
ব্যুৎপুন্নৈ রচিতং চ নৈব বচর্নৈবক্রোক্তিশূন্যং চ যৎ।
কাব্যং তদ্ ধ্বনিনা সমন্বিতমিতি প্রীত্যা প্রশংসঞ্জড়ো
নো বিদ্মোহ ভিদধাতি কিং সুমতিনা পৃষ্টঃ স্বরূপং ধ্বনেঃ॥
অর্থাৎ, “যে কবিতায় সুষমাময় মনোরম বস্তু কিছু নেই, চতুর বচনবিন্যাসে যা রচিত নয় এবং যার অলঙ্কারহীন, জড়বুদ্ধি লোকেরা গতানুগতিকের প্রীতিতে তাকেই ধ্বনিযুক্ত কাব্য বলে প্রশংসা করে। কিন্তু বুদ্ধিমান লোকের কাছে ধ্বনির স্বরূপ কেউ ব্যাখ্যা করেছে, এ তা জানা যায় না।” আনন্দবর্ধন কবিতায় মনোরম বস্তু অর্থাৎ সুখপাঠ্য শব্দ, রচনারীতিতে শব্দমালার সুবিন্যাস, যথোপযুক্ত অলঙ্কার না থাকাকে কবিতার দুর্বলতা বলে মনে করেন। জড়বুদ্ধির লোকেরা যেগুলোকে কাব্য বলে মনে করে, তা যে সত্যিকারের উন্নত কবিতা নয় তা তিনি বুঝিয়ে দিতে চান। সাধারণ পাঠক ও গতানুগতিক নিম্নরুচির শ্রোতারা শুধু কানে শুনেই কবিতার স্বাদ পেতে চায়, ইন্দ্রিয়াতীত কোনো বিশেষ ভাব ও আনন্দ তাদের মনে জাগে না; তারা নিম্নমানের কবিতার প্রশংসা করেই তৃপ্তি পায়। আসলে ধ্বনির স্বরূপ জেনে কবিতার ভেতরে প্রবেশ করে গভীরভাবে কবিতার স্বাদ অনুধাবন করা তো তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। এখানে অতুলচন্দ্র গুপ্ত গতানুগতিকতার প্রীতিকে ‘ফ্যাশানের খাতিরে’ বলে ব্যাখ্যা করেছেন।৫
ঙ. অভিনব গুপ্ত (দশম শতাব্দী):
শব্দার্থশাসনজ্ঞানমাত্রেণৈব ব বেদ্যতে।
বেদ্যতে স হি কাব্যার্থত্ত্বজ্ঞৈরেব কেবলম॥
অর্থাৎ, “কাব্যের যা সার অর্থ, কেবল শব্দার্থের জ্ঞানে তার জ্ঞান হয় না, একমাত্র কাব্যার্থতত্ত্বজ্ঞেরাই সে অর্থ জানতে পারেন।” এক শতাব্দী আগে এবং পরে আনন্দবর্ধন ও অভিনব গুপ্তের আবির্ভাব হলেও তাঁরা সমকালীন ছিলেন নাকি ক্রমকালীন ছিলেন তা জানা যায় না। তবে সে কালে দুজনে ছিলেন দুই বিপরীত মতাদর্শের। অভিনব গুপ্ত তো এখানে স্পষ্টভাবেই বলেছেন কবিতা শুধু শব্দের প্রচলিত অর্থের ওপর নির্ভরশীল নয়। একমাত্র কাব্যার্থতত্ত্বজ্ঞ বলতে তিনি সম্ভবত সত্যিকারের কাব্যরসামোদীকে বুঝিয়েছেন। যাঁরা উন্নত কবিতার পাঠক, কবিতায় ব্যবহৃত শব্দের গভীরে প্রবেশ করে নতুন অর্থ, কবির ইঙ্গিতময় নতুন ব্যঞ্জনাগুলো ধরতে পারে, অভিনব গুপ্তের মতে তাঁদের পক্ষেই কাব্যের সারবস্তু অনুধাবন করা সম্ভব।৬
এখানে উল্লেখ্য যে আচার্য আনন্দবর্ধন এবং অভিনব গুপ্ত দুজনেই কাশ্মীরের লোক। তাঁদের মধ্যে একটি ব্যাপারে বৈপরীত্য ছিল। সেটি হলো আনন্দবর্ধন ছিলেন ‘ধ্বনিবাদ’-এর প্রবর্তক। তিনি তাঁর মতবাদটি সম্পূর্ণ করেন ধ্বন্যালোক গ্রন্থের বৃত্তি অংশে। একাদশ শতাব্দীতে তিনি ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। তাঁর পরে আবির্ভূত হন অভিনব গুপ্ত; তিনি ছিলেন ‘রসবাদে’র প্রবক্তা। তাঁকে রসবাদের আচার্যদের মধ্যে সর্বপ্রধান বলে বিবেচনা করা হয়। প্রাচীন সাহিত্যতত্ত্বের বাদ-বিসম্বাদ নিয়ে বর্তমান আলোচনা নয়, সেটি অন্য বিষয়। বর্তমান রচনায় শুধু সামান্য উদ্ধৃতি থেকে ধারণ করার চেষ্টা করা হয়েছে কবিতার ভাষাপ্রসঙ্গে। উদ্ধৃত পদ্যাংশ থেকে বোঝা যায় আনন্দবর্ধনের মতে, কবিতার ভাষা হতে হবে অলঙ্কার দ্বারা সুন্দর, সুষমাময়, মনোরম এবং বচনবিন্যাসে থাকতে হবে বুদ্ধির পরিচয়। আর অভিনব গুপ্তের মতে কবিতার সারবস্তু শব্দার্থের জ্ঞানে হয় না। শব্দের প্রচলিত অর্থের বাইরে আরও অনেক রকম অর্থ থাকে, সেসব অর্থসম্পর্কে ধারণা না থাকলে কবিতার রস আস্বাদন করা যায় না। প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যের মহাতাত্ত্বিক এই দুজনের কথা এখানে আনা সেযুগের সাহিত্য আলোচনা করার জন্য নয়, বর্তমান যুগের পাঠকের কাছে শুধু কবিতার ভাষা নিয়ে পুরনো তাত্ত্বিকদের ধারণাটি প্রকাশ করার জন্য।
দ্বিতীয় অধ্যায়: ঔপনিবেশিক যুগ
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগেই ইংরেজি সাহিত্যের স্বর্ণযুগ। এশিয়া-আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে ব্রিটিশসহ ইউরোপের প্রধান জাতিগুলো দেশদখল, ভাষা ও ধর্মবিস্তার ও সংস্কৃতি চাপিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে ইউরোপীয় সভ্যতা সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। এ সময়ই ইংরেজি আধুনিক কবিতার বিকাশ ঘটে। ব্রিটিশদের শাসনব্যবস্থা সুদৃঢ় করার জন্য গৃহীত যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে লন্ডন থেকে ইংরেজি সাহিত্যের বই-পুস্তক ও পত্র-পত্রিকা নানা মহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। এভাবে লন্ডনের ঢেউ সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে, ইংরেজি সাহিত্যের প্রভাবও নানা দেশের সাহিত্যের ওপর ছায়াপাত ঘটায়।
এ সময়ের কয়েকজন ইংরেজিভাষী কবি বিশ্বের অনেক দেশের কবিতায় প্রভাব বিস্তার ঘটান। তাঁদের মধ্যে যদি প্রধান পাঁচ জনকে বিশেষভাবে প্রভাবশালীহিসাবে চিহ্নিত করা যায়, তাহলে তাঁদেরকে উনিশ শতকের ইংরেজি সাহিত্যের পঞ্চপাণ্ডব বলা যেতে পারে। তাঁরা হলেন, উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ (১৭৭০—১৮৫০), স্যামুয়েল টেইলর কোলরিজ (১৭৭২—১৮৩৪), লর্ড গর্ডন বায়রন (১৭৮৮—১৮২৪), পার্সি বিশি শেলি (১৭৯২—১৮২২) ও জন কিটস (১৭৯৫—১৮২১)। বাংলা সাহিত্যে উনিশ শতক থেকেই তাঁদের প্রভাব পড়তে শুরু করে। বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে শক্তিশালী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও (১৮৬১—১৯৪১) তাঁদের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। এ সময়ের কয়েকজন কবির উক্তি থেকে আধুনিক যুগের কবিতার ভাষা সম্পর্কে ধারণা নেওয়া সাহিত্যের আলোচনার জন্যই প্রয়োজনীয়।
ক. উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ (১৭৭০—১৮৫০):
Poetry is the sponteneous overflwo of powerfull feelings; it takes its origin from emotion recollected tranquility.৭ ওয়ার্ডসওয়ার্থ মূলত প্রকৃতির কবি; সহজ, সরল ও সাধারণ ভাষায় তিনি কবিতা লিখতেন। কোনোরকম কৃত্রিম কাব্যভাষা তিনি ব্যবহার করতে চাইতেন না, সমকালীন কবিরা যা করতেন। তিনি বলতেন যে, তিনি সাধারণ মানুষের প্রচলিত ভাষায় লিখতে চান, যে ভাষা A selecton of the language really used by men| এস.টি কোলরিজের সাথে যৌথভাবে প্রকাশিত লিরিক্যাল ব্যালাডের ভূমিকায় তিনি এ ধরনের ভাষা ব্যবহার করার ইচ্ছাটি তত্ত্বহিসাবেই প্রকাশ করেছিলেন। তবে তাঁর সারা জীবনের কাব্যকর্ম যাচাই-বাছাই করলে দেখা যায় তিনি সেই সাধারণ মানুষের ভাষার ভেতর থেকেই একটি ভিন্ন কাব্যভাষা নির্মাণ করে নিয়েছেন। ভারতের ইংরেজি সাহিত্যের প্রখ্যাত অধ্যাপক ড. এস. সেন জানান সে কথা। তিনি ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতার ভাষাপ্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে জানান যে, কবি তাঁর থিয়োরির মধ্যে থাকতে পারেননি। তিনি বলেছেন,
In actual practice, whenever Wordworth tried to imitate the simplicity of rustic speech, he produced some of his worst effects. In some of his poems he cultivates symplicity of diction no doubt, as he does in his Solitery Reaper. But even in that poem the diction is touched with imagination so that we have suggestive lines. The diction of Immortality Ode and Tintern Abbey is not simlpe, and does not come anywhere the language of prose. In his practice Wordsworth did not follow the theory he enunciated. His poetic instinct saved him from that blunder. However, it must be admitted that, on the whole, Wordsworth is more simple in diction and more sparing in the use of imegery than the other romantic poets.৮
খ. স্যামুয়েল টেইলর কোলরিজ (১৭৭২—১৮৩৪)
I wish our clever young poets would remember my homely definations of prose and poetry; that is prose; words in their best order; -poetry; the best words in the best order.
কোলরিজের উক্তিটি বহুল আলোচিত হলেও তাঁর কবিতা সম্পর্কিত ভাবনা এ বাক্যের বাইরেও প্রসারিত। কোলরিজ মনে করতেন কবির সচেতনতাবোধ কাছের ও দূরের, নিত্য ও অনিত্যের, বিশেষ ও নির্বিশেষের, বাস্তব ও অবাস্তবের. ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ও ইন্দ্রিয়াতীত বা অতিন্দ্রিয়ের, বিশ্বাস্য ও অবিশ্বাস্যের, তথ্য ও সত্যের, ক্ষণকাল ও চিরকালের বাস্তব ও আদর্শের ভাব বা বস্তুসত্তাকে প্রত্যক্ষ করে রূপের মধ্য দিয়ে পাঠকের মনে অনুরূপ ভাব-ব্যঞ্জনা করতে পারে। বিশ্বজগতের রূপবৈচিত্র্য অনন্ত ঈশ্বরের চিত্তবিক্ষেপ মাত্র—যিনি অরূপ, তিনি রূপে আপনাকে বিলসিত করে দিয়েছেন। কবিও সেই অপূর্ব বিচিত্র সৃষ্টির ঐশ্বরিক মহিমা স্বকীয় চিত্তের আলোকে প্রস্ফুট করে তোলেন।৯ কোলরিজ আসলে বেস্ট ওয়ার্ডস এবং বেস্ট অর্ডার বলতে কী বুঝিয়েছেন, সেটিই একজন কবির কাছে গুরুত্বপূর্ণ। সর্বোৎকৃষ্ট শব্দসম্ভার সর্বোত্তম বিন্যাসের মাধ্যমেই কবিতা প্রকাশিত হয়। ইংরেজি বাক্যের শেষের ছোট বাক্যাংশটিতে তিনি অল্প কথায় অনেক গভীর অনুভব প্রকাশ করেছেন। এই সর্বোত্তম-সর্বোৎকৃষ্টবোধটি সম্পূর্ণই আপেক্ষিক-উপলব্ধিনির্ভর। কোনো ছকবাঁধা বা প্রচলিত মানদণ্ডে পরিমাপ করা যায় না। তবে উপলব্ধির জগতে তো একটা ঐক্যবোধ থাকে।
গ. অ্যাডগার অ্যালান পো (১৮০৯—৪৯)
Poetry is the rhythmical creation of beauty in words.১০
অ্যাডগার অ্যালান পো আমেরিকান কবি ও কথাসাহিত্যিক। তাঁর প্রভাব বাংলা ভাষার কবি জীবনানন্দ দাশও এড়াতে পারেননি, তাঁর To Helen কবিতার স্পষ্ট প্রভাব দেখা যায় জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ (১৯৪২) কবিতায়। পো-এর উক্তিটিতে ছন্দ, সৌন্দর্য এবং শব্দ—এ তিনটি বিষয়ে গুরুত্ব পেয়েছে। কবিতায় ছন্দের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে এ যুগে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন, কিন্তু সুন্দর শব্দের সম্ভারকেই কি তিনি কবিতা বলে মেনে নিতে পারবেন? সমকালীন কবি ও কবিতার পাঠকদের জন্য রচিত হলেও কথাটি কিন্তু চিরকাল ধরে চলমান। কারণ, প্রথাগত ছন্দ মেনে না লিখলেও কবিতায় ব্যবহৃত শব্দে এক ধরনের গোপন ছন্দ কিন্তু থাকেই। সেটা অনেক সময় চোখে পড়া যায় না, কানে শোনা যায় না, কিন্তু অনুভব করা যায়।
ঘ. মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-৭৩)
কে কবি—কবে কে মোরে? ঘটকালি করি
শবদে শবদে বিয়া দেই যেই জন,
শোভে কি অক্ষয় শোভা যশের রতন?
সেই কবি মোর মতে, কল্পনাসুন্দরী
যার মনঃ কমলেতে পাতেন আসন,
অস্তগামি-ভানু-প্রভা সদৃশ বিতরি
ভাবের সংসারে তার সুবর্ণ-কিরণ।
আনন্দ, আক্ষেপ, ক্রোধ, যার আজ্ঞা মানে;
অরণ্যে কুসুম ফোটে যার ইচ্ছা-বলে;
নন্দন কানন হতে সে সুজন আনে
পারিজাত কুসুমের রস্য পরিমল;
মরু-ভূমে-তুষ্ট হয়ে যাহার ধেয়ানে
বহে জলবতী নদী মৃদু করকলে!১১
মাইকেল মধুসূদন শুধু ইংরেজি সাহিত্যের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন না, বহুভাষী বিচিত্র রুচির পাঠক হওয়ার কারণে তিনি ইউরোপের অনেকগুলো সমকালীন এবং ধ্রুপদী ভাষার সাহিত্যের পাঠক ছিলেন। তবে তিনি ইংরেজি সাহিত্যের জন মিলটনের কাব্যরুচিতে আগ্রহী ছিলেন বলে তাঁরই ভাষারীতি অনুসরণ করে বাংলা ভাষায় অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তন ঘটান। এ ছন্দের ব্যাপক চর্চা করেন ও বিস্তৃতি ঘটান। তিনি গদ্যে কোনো সাহিত্যপ্রবন্ধ-নিবন্ধ ইত্যাদি রচনা করেছিলেন বলে এখন পর্যন্ত পাওয়া যায় না। তবে একটি সনেট কবিতায় তাঁর কাব্যভাষারীতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। কবিতাটির নাম ‘কবি’। এর অষ্টকের প্রথম চতুষ্কে একটি প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে দ্বিতীয় চতুষ্কে কবির সংজ্ঞা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। পরে ষটকে আরও বিস্তারিতভাবে বলার চেষ্টা করেছেন। প্রথমেই মধুসূদন প্রশ্ন রেখেছেন পাঠকের কাছে কে তাকে কবি বলবে? তিনি শব্দের সঙ্গে শব্দের বিয়া দেন, ঘটকালি করেন। তাঁর মধ্যে যশের রত্নের অক্ষয় শোভা পায়? দ্বিতীয় চতুষ্কের শুরুতেই বলেছেন, “আমার মতে সেই কবি”—এরপরে সত্যিকারের কবির বৈশিষ্ট্যগুলো বর্ণনা করেছেন। কয়েকটি বিষিয় তিনি এখানে উল্লেখ করেছেন। প্রথমত, কল্পনার কথা, মনের কল্পনয় যিনি পদ্মের ওপর আসন পাতেন। দ্বিতীয়ত, ভাবের কথা। অস্তগামী সূর্যের মতো ভাব যিনি চতুর্দিকে প্রকাশ করেন। তৃতীয়ত, মানসিক ক্ষমতার কথা। আনন্দ, আক্ষেপ, ক্রোধ ইত্যাদি রিপু যাঁর আদেশ মেনে চলে। চতুর্থত, ইচ্ছাশক্তির কথা। যাঁর ইচ্ছাশক্তিতে অরণ্যে কুসুম ফোটে, নন্দন কানন হতে সে সুজন আনে। পঞ্চমত, সৃষ্টিশীলতার কথা। যাঁর ভাষাশক্তিতে মরু-ভূমে-তুষ্ট হয়, মরুর বুকে জলবতী নদী মৃদু কলকল রবে প্রবাহিত হয়।
কবির সংজ্ঞায়নের মধ্য দিয়েই কবির কাজ এবং করণীয়গুলো উঠে এসেছে। শতাধিক বছর পরেও মধুসূদনের এই উক্তিকে অনেক কবি এবং কাব্য সমালোচক নিজের বলে ঘোষণা করে থাকেন। সচেতন পাঠক এই রচনাতেই সেটা লক্ষ্য করে থাকবেন।
ঙ. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১—১৯৪১):
রবীন্দ্রনাথ ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে কবিতা লিখেছেন, কবিতার বিভিন্ন ভাষ্য, আলোচনা-সমালোচনামূলক প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখে নানাভাবে কবিতাসম্পর্কিত ধারণাগুলো প্রকাশ করেছেন। শুধু তাঁর উদ্ধৃতি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেই ভারী ভারী বই লিখে ফেলা সম্ভব। প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক নানাভাবে সেসব গ্রন্থ রচনা করা হয়েছেও, তাঁর বিশাল রচনাবলি থেকে বর্তমান আলোচনায় সামান্য কথাই উদ্ধৃত করা হচ্ছে।
উনিশ শতকে, তরুণ বয়সেই রবীন্দ্রনাথ কবিতা, গান ও সাহিত্যের অন্যান্য শাখায় বিচরণ শুরু করেন, পাশাপাশি শিল্প ও সাহিত্যবিষয়ক চিন্তাভাবনাগুলো প্রবন্ধাকারে ও চিঠিপত্রের ভাষায় লিখতে শুরু করেন। সাহিত্যবিষয়ক অনেক গ্রন্থ থেকে বর্তমান রচনার উপযোগী একটি বা দুটি উদ্ধৃতি খুঁজে বের করা খুব কঠিন কাজ ছিল। তাঁর প্রধান কয়েকটি সাহিত্যবিষয়ক প্রবন্ধগ্রন্থ হলো: বিবিধ প্রসঙ্গ (১৮৮৩), আলোচনা (১৮৮৫), সমালোচনা (১৮৮৮), পঞ্চভূত (১৮৯৭), বিচিত্র প্রবন্ধ (১৯০৭), প্রাচীন সাহিত্য (১৯০৭), লোকসাহিত্য (১৯০৭), সাহিত্য (১৯০৭), আধুনিক সাহিত্য (১৯০৭), সাহিত্যের পথে (১৯৩৮) এবং মৃত্যুর পরে প্রকাশিত সাহিত্যের স্বরূপ (১৯৪৩) ইত্যাদি। কবিতার ভাষা সম্পর্কে তাঁর চিন্তাধারাটি সহজে বোঝা যেতে পারে:
আমি যাহা বিশ্বাস করিতেছি তোমাকে তাহাই বিশ্বাস করানো, আর আমি যাহা অনুভব করিতেছি তোমাকে তাহাই অনুভব করানো—এ দুইটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ব্যাপার। আমি বিশ্বাস করিতেছি একটি গোলাপ সুগোল, আমি তাহার চারিদিক মাপিয়া-জুকিয়া তোমাকে বিশ্বাস করাইতে পারি যে গোলাপ সুগোল—আর, আমি অনুভব করাইতে পারি না যে গোলাপ সুন্দর। তখন কবিতার সাহায্য অবলম্বন করিতে হয়। গোলাপের সৌন্দর্য আমি যে উপভোগ করিতেছি তাহা এমন করিয়া প্রকাশ করিতে হয়, যাহাতে তোমার মনেও সে সৌন্দর্যভাবের উদ্রেক হয়। এইরূপ প্রকাশ করাকেই বলে কবিতা।
রবীন্দ্রনাথ মনে করেন মানুষ সচরাচর যে ভাষায় কথা বলে তা হলো যুক্তির ভাষা। তিনি নানা উপমা-উদাহরণ দিয়ে বলতে চান সে ভাষা মূলত কাজের ভাষা। এগুলো বিশ্বাস করানোর ভাষা, প্রমাণ করানোর ভাষা, বর্ণনা করার ভাষা। সচরাচর দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহারের জন্য রয়েছে তাঁর মতে প্রচলিত ভাষা অর্থাৎ গদ্যভাষা। কিন্তু উদ্রেক করানোর জন্য ভিন্ন ভাষার প্রয়োজন। তিনি বিশ্বাসের বিপরীতে উদ্রেক শব্দটি ব্যবহার করে জানান যে, যুক্তির গদ্য ভাষা মানুষকে বিশ্বাস করায়, আর কবিতার ভাষা মানুষকে উদ্রেক করে। তিনি বিশ্বাসের শিকড়ের স্থান ধরে নিয়েছেন মাথায়, আর উদ্রেকের শিকড়ের স্থান ধরে নিয়েছেন হৃদয়ে। যুক্তির ভাষা ও কবিতার ভাষার পার্থক্য নির্ণয় করতে গিয়ে অনেক উদাহরণ দিয়ে অনেক কথা বলেছেন।১২
এ রচনার প্রায় অর্ধ শতাব্দী কেটে গেলে বয়সের সাথে সঙ্গতি রেখে রবীন্দ্রনাথের জীবন, দর্শন, সমাজ সংস্কৃতি, সাহিত্য ইত্যাদি নানা বিষয়েই তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটে । কবিতা সম্পর্কেও তাঁর মতে সামান্য পরিবর্তনের কথা শেষের দিকের কোনো কোনো রচনায় স্বীকার করেছেন তিনি। কিন্তু কবিতার ভাষা সম্পর্কে শেষের দিকের একটি মন্তব্য এখানে উদ্ধৃত করা যায়:
কবিতা যে ভাষা ব্যবহার করে সেই ভাষার প্রত্যেক শব্দটির আভিধাননির্দিষ্ট অর্থ আছে। সেই বিশেষ অর্থেই শব্দসীমা। এই সীমাকে ছাড়িয়ে শব্দের ভিতর দিয়েই তো সত্যের অসীমতাকে প্রকাশ করতে হবে। তাই কত ইশারা, কত কৌশল, কত ভঙ্গি।১৩
মাত্র চারটি ছোট বাক্যের এইটুকু কথায় পরিণত বয়সের রবীন্দ্রনাথ কবিতার ভাষা নিয়ে যে বিষয়টি ব্যক্ত করেছেন তার মধ্যে কিছু কথা তো সেই ধ্রুপদী কাব্যতত্ত্বের মধ্যে পাওয়া যায়, কিন্তু শেষের বাক্যটি, ক্রিয়াপদহীন এই বাক্যটি যেন অনন্তের পথে ধাবমান একটি সম্ভাবনা। সেই সম্ভাবনার সূত্র ধরে আজ পর্যন্ত বাংলা কবিতার ভাষায় নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে, নতুন নতুন ইশারা দেখা যাচ্ছে, কত কৌশল আবিষ্কৃত হচ্ছে, কত ভঙ্গির প্রয়োগ হচ্ছে!
চ. প্রমথ চৌধুরী (১৮৬৮—১৯৪৬):
রবীন্দ্রযুগের আরেকজন সাহিত্যচিন্তাবিদ, নানা কারণেই যাঁর চিন্তার শরণাপন্ন হতেই হয়, না হয়ে পারা যায় না, তিনি প্রমথ চৌধুরী। তিনি ১৯০২ সালে ‘ভারতী’ পত্রিকায় প্রথম চলিত গদ্যরীতিতে প্রবন্ধ রচনা করে নতুন ধারা সৃষ্টি করেন। বাংলা সাহিত্যের ভাষাচিন্তায় তিনি চিরস্মরণীয়, কারণ মাসিক ‘সবুজপত্র’ (১৩২১) পত্রিকার মাধ্যমে তিনি বাংলা চলিত ভাষার প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথসহ সমকালীন ভাষাসংস্কারমুক্ত লেখকগণ তাঁর পত্রিকায় চলিত ভাষা চর্চা করে বাংলা ভাষারীতির এ ধারাটি সমৃদ্ধ করেন। সাহিত্যবিষয়ে তিনি কয়েকটি প্রবন্ধগ্রন্থ রচনা করেছেন, যেমন, তেল-নুন লকড়ী (১৯০৬), বীরবলের হালখাতা (১৯১৬), নানা কথা (১৯১৯), আমাদের শিক্ষা (১৯২০), রায়তের কথা (১৯২৬) ও নানাচর্চা (১৯৩২) ইত্যাদি।
প্রমথ চৌধুরী সংস্কৃত আলঙ্কারিকদের কাছ থেকে পাওয়া প্রচলিত সংজ্ঞা ‘কাব্য রসাত্মক বাক্য’কে বেশি গুরুত্ব দিয়ে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করে নিয়েছেন। দুই-চার কথায় কাব্যের সমস্ত গুণের বর্ণনা করা অসম্ভব বলেই তিনি এই প্রচলিত সংজ্ঞাটি গ্রহণ করেছেন। তিনি মনে করেন ‘রসাত্মক বাক্য’ কথাটির মধ্যে রস, আত্মা ও বাক্যের পৃথক আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। তাঁর মতে বাক্যের দুটি অংশ রয়েছে। প্রথম অংশে আছে অর্থ, দ্বিতীয় অংশে আছে শব্দ। প্রথম অংশটি মানসেন্দ্রিয়গ্রাহ্য আর পরেরটি শ্রবণেন্দ্রিয়গ্রাহ্য। মানুষ যে শব্দ শুনে অন্তরে অর্থগ্রহণ করে তা-ই বাক্য। বাক্যের বিষয় মানুষের মনোভাব। বাক্যের উদ্দেশ্য প্রকাশ করা, আর সে উদ্দেশ্যসাধনের উপায় হলো শব্দ। বাক্য রসাত্মক হতে হলে তাঁর মতে, প্রথমত ভাব রসাত্মক হতে হবে, দ্বিতীয়ত শব্দ রসাত্মক হতে হবে। তৃতীয়ত, বাক্যটি এমনভাবে প্রকাশ করতে হবে, যাতে রসাত্মক ভাব শব্দের সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে মিশে যেতে পারে। যে ভাব মনে সুন্দর ভাবের উদ্রেক করে, পাঠকের হৃদয় বিশুদ্ধ আনন্দে পরিপ্লুত করে তাকেই তিনি রসাত্মক ভাব বলেছেন।
প্রমথ চৌধুরীও নানা উপমা-উদাহরণে সাজিয়ে নিজের মত প্রকাশ করেছেন। এর সারকথা বোঝার মতো একটি উদ্ধৃতি পাওয়া গেলো:
আমি ভাষা ও ভাব পৃথক করিয়া আলোচনা করিয়াছি, কিন্তু বাস্তবিক কবির নিকট ভাষা ও ভাবের ভিতর কোনো প্রভেদ নাই। কবিতার ভাষা ও ভাব পরস্পরের উপর পরস্পর সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করে। ভাব মন্দ হইলে কবিতার ভাষা কখনোই সুন্দর হইতে পারে না, এবং ভাষা কদর্য হইলে ভাবও সম্পূর্ণরূপে কবিত্বপূর্ণ হাইতে পারে না। কবিতার ভাষা ভাবের দেহস্বরূপ, কিছুতেই তাহা ভাব হইতে পৃথক করিতে পারা যায় না। … যে অন্তর্নিহিত শক্তি দ্বারা কবিতায় ভাব ও ভাষা সম্পূর্ণ একীকরণ সম্পন্ন হয় তাহাই কবিতার আত্মা।১৪
তৃতীয় অধ্যায়: উত্তর ঔপনিবেশিক যুগ
রবীন্দ্রপরবর্তী বলে পরিচিত ত্রিশের কবিদের মধ্যে সবাই কম-বেশি প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখে তাঁদের সমকালীন কাব্যরীতি ও আদর্শের পক্ষে নিজস্ব মত প্রকাশ করেছেন। এ যুগের কবি নন এমন কবিতার আলোচক-সমালোচকেরও গভীর চিন্তা ও বিদগ্ধ ভাবনার পুনরুক্তি সময়ের দাবি অনুসারে এখানে আলোচ্য এবং উল্লেখযোগ্য, যেমন আবু সয়ীদ আইয়ুব।
ক. জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯—১৯৫৪):
রবীন্দ্রপরবর্তী যুগে আবির্ভূত এ কবি মৃত্যুর অর্ধ শতাব্দী পরে কবিহিসাবে জনপ্রিয়তায় রবীন্দ্রনাথের কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র জীবনানন্দ দাশ সমকালীন ইংরেজি কবিতার পাঠক ছিলেন, সমালোচকও ছিলেন। বাংলা সাহিত্যে তাঁর অবস্থান সম্পর্কে তিনি প্রবল আত্মবিশ্বাসী ছিলেন বলে ধারণা করা যায় তাঁর বিভিন্ন গদ্যে। কবিতা নিয়ে তিনি আলোচনা-সমালোচনা লিখেছেন। তাঁর কবিতাবিষয়ক প্রকাশিত ভাবনার মধ্য থেকে একটি কথা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে।
কবিতার মানে পাঠকসমাজে নির্বিশেষে বিমুক্ত করতে গিয়ে যে যুগে ও দেশে আমি রয়েছি সেখানকার মানুষের মুখের ভাষায় কবিতা লিখব—এরকম বা যে কোনোরকম সংকল্পে কবিতা উতরায় না, সংকল্পের সঙ্গে কবিতার কোনো সংস্রব নেই বলেই নয়, সংস্রব রয়েছে; সার্থক কবিতা হয়তো মুখের ভাষায়ই ফুটে উঠবে, কিংবা ঠিক মুখের ভাষা নয় এমনি কোনো ভাষায়, কিন্তু কোনো বিশেষ বাগরীতিতে বা অর্থে ফুটে লেখা উচিত—এই সংকল্পের ভিতর থেকে নয়।১৫
জীবনানন্দ দাশ মনে করেন, কবিতার ভাষা সংকল্প থেকে আসবে না, কবিতার প্রকল্প থেকে আসবে। তাঁর আবির্ভাবকালে প্রমথ চৌধুরীর “সাহিত্যের ভাষা হবে মুখের ভাষার কাছাকাছি” কথাটি প্রচলিত ছিল। তাছাড়া ইংরেজি রোমান্টিক কবিদের, বিশেষ করে ওয়ার্ডসওয়ার্থের ভাষারীতির কথা অনেকেই বলতেন। সেসব ভাষারীতি ও প্রথা সম্পর্কে জীবনানন্দ নিজের মতটি প্রকাশ করেছেন। তিনি বাঙালি সাধারণ মানুষের প্রতিদিনের শব্দ ও আটপৌরে শব্দ দিয়ে নিজের কবিতার ভাষা নির্মাণ করে নিয়েছেন। প্রচলিত বিশেষ্য, বিশেষণ, অব্যয় এবং সাধুরীতির সর্বনাম ও ক্রিয়াপদ দিয়ে নিজের ভাষা তৈরি করেছেন। অলঙ্কারের মধ্যে তিনি উপমাকেই বেশি প্রয়োজনীয় বলে মনে করতেন, একারণে ‘উপমাই কবিত্ব’ কথাটি তিনি লিখে গেছেন। ওয়ার্ডসওয়ার্থ যেখানে ব্যর্থ হয়েছেন, জীবনানন্দ সেখানে সফল হয়েছেন। শুধু কবিতা রচনাই নয়, কবিতার নানা দিক নিয়ে তিনি কিছু প্রবন্ধ রচনা করেছেন। কবিতার কথা (১৯৫৬) একমাত্র প্রকাশিত গ্রন্থ হলেও এ গ্রন্থের বাইরে তাঁর অনেক প্রবন্ধ রয়েছে, সেগুলো তাঁর চিন্তা প্রকাশ করেছে।
খ. অমিয় চক্রবর্তী (১৯০১—৮৬):
অমিয় চক্রবর্তী রবীন্দ্রপরবর্তী আধুনিক কবিদের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় সবচেয়ে বেশি শিক্ষিত ছিলেন, সম্ভবত এন্টার্কটিকা ছাড়া আর প্রায় সমস্ত মহাদেশে জীবনের অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় ধরে ভ্রমণ ও পেশাগত কারণে বিচরণ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত সাচিবিক দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে এবং ভ্রমণসঙ্গীহিসাবে মহাদেশ ভ্রমণ করে জীবিত বড় কবিদের সান্নিধ্যলাভ শুরু করেছেন। পরে এশিয়া-ইউরোপ ও অন্য মহাদেশের প্রধান কবিদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ, আলাপ-আলোচনা ও পত্রবিনিময়ের মাধ্যমে সাহিত্যচিন্তাকে সমৃদ্ধ করেছেন। তিনি মাত্র একটি প্রবন্ধগ্রন্থ সাম্প্রতিক (১৩৭০) লিখলেও সেটি নানা কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। সেখান থেকে একটি কথা এখানে উদ্ধৃত করা হলো।
কাব্যের ক্ষেত্রে ভাবও শিল্পীত হয়ে দেখা দেয়, নয়তো তার প্রকাশ হয়নি। যা প্রকাশিত হয়েছে তাই নিয়ে বিচার। ভাষা ও ছন্দের শরীরে সমগ্র কাব্যের প্রকাশ। … ছন্দ আশ্চর্য হবার উপায় নেই যদি তার মধ্য দিয়ে কাব্যের আশ্চর্য ভাব ছন্দিত না হয়ে থাকে; ভাবের তরঙ্গেই ছন্দ।১৬
অমিয় চক্রবর্তীর কবিতার ভাষা সহজ নয়। তিনি কবিতার মধ্যে প্রচলিত শব্দের সাথে ব্যাকরণবহির্ভূত ও নিয়ম ভাঙা অনেক শব্দ দিয়ে নিজস্ব কাব্যভাষা নির্মাণ করেছেন। মাঝে মাঝে কবিতার মধ্যে বিশুদ্ধ সংস্কৃত শব্দ এমনকি পূর্ণাঙ্গ বাক্যও ব্যবহার করেছেন। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ভাষার অনেক স্থাননাম তাঁর কবিতায় চকচক করে জ্বলে। একই কবিতায় বিচিত্র ছন্দের প্রয়োগ তাঁর কবিতা পাঠ করার ক্ষেত্রে দুরূহতা সৃষ্টি করে।
অমিয় চক্রবর্তী ভাব ও ছন্দের ভেতর দিয়ে ভাষার প্রকাশ ঘটাতে চান। তিনি মনে করেন এ তিনটি কবিতার শরীর। ভাব ও ভাষার প্রকাশ নিয়ে সেকালে একটি পুরনো মত ছিল, সকল মানুষই কবি। ভাষার মধ্য দিয়ে ভাব প্রকাশ না পেলেও অপ্রকাশিত থাকে অনেকের ভাব। তাঁদের নীরব কবি বলা হতো। রবীন্দ্রনাথ এ বিষয়ে তরুণ বয়সে (১৮৮৫ সালের দিকে) নীরব কবি ও অশিক্ষিত কবি (রবীন্দ্র-রচনাবলী-পঞ্চদশ খণ্ডে তা গ্রন্থিত হয়েছে) নামের একটি প্রবন্ধে সমাজে প্রচলিত যুক্তিগুলো খণ্ডন করে নিজস্ব মত প্রকাশ করেছিলেন। সেই পুরনো মতকে নতুন নানা বিষয় ও মতের সহায়তায় নতুন রূপ দিয়ে কেউ কেউ আবার প্রচলন করতে চেষ্টা করেছেন হয়তো, অমিয় চক্রবর্তী সে কথার পিঠেই উদ্ধৃত কথাটি বলেছেন। কবিতায় ছন্দ থাকবে কিন্তু ভাষা থাকবে দুর্বল, আবার বলা হবে এর ভেতরে গভীর ভাব লুকিয়ে আছে—এ ধরনের কথা তাঁর কাছে বিশ্বাসযোগ্য নয়, গ্রহণযোগ্যও নয়।
আরেকটি উদ্ধৃতি থেকে তাঁর কাব্যভাষাচিন্তার স্বরূপটি ধরা যায়:
কাব্যের প্রসাধনে বাক্যসাধনার দুরূহ চরম দাবিকে মেনে নিতে হবে। কথাকে অত্যন্ত গভীরে বাজিয়ে নিলে তার ধ্বনি স্পষ্ট হয়। শুধু কানে শোনা ধ্বনি নয়, বাক্যে অগণ্য সূক্ষ্ম শ্রুতি—তার Overtone—মনে ধারণ করা চাই। এর জন্যে চাই শিল্পের জ্ঞান এবং ধ্যান—যাকে বলা যায় শিল্পাগ্রহ—সংসর্গের নিবিড় আসঙ্গে ভরা বাক্যের শব্দ শুনতে হবে। তালের মেট্রনমে তা ধরা পড়ে না, অনিবিড় ঝংকারে তা চাপা পড়ে, ললিত লঘু বাক্যে তাকে হারাই। আধুনিক বাংলা কবিতায় যেন অনুপ্রেরণা এবং অভ্যাস দুয়ের গূঢ়ত্ব আমরা না ভুলি, কথার আওয়াজ হারিয়ে কেবলমাত্র কথার শব্দ গেঁথে কবিতা লেখায় নিবৃত্ত হই। এই ক্ষেত্র রচনার চপল ইচ্ছা-চাতুর্য আমাদের শত্রু; রচনায় বিরতির ধর্ম্য আমরা ভুলতে বসেছি। দ্রুত চলতি কালের যোগ্য তরল বাক্যের আদান-প্রদানে কাব্য তৈরি হয় না। মগজে বিরল বাক্যের ঘনস্তর জমা হয়ে ওঠবার সময় থাকা চাই, যেখানে অবচেতনার জমিতে কথা নূতন হয়ে দেখা দেয়।
অমিয় চক্রবর্তী আরও মনে করেন, সাধু ভাষা যখন আধুনিক বাংলার যথার্থই অসাধু এবং অচল, তখন দুয়ের মিশ্রণে বিশেষ সাবধান হওয়া দরকার। তিনি অতি মিষ্টত্বে দুষ্ট ‘কবিত্বপূর্ণ’ বাক্যের ব্যবহার বাদ দিতে চান। যা মুখে বলা হয় না তা কলমে লেখা যাবে না, কেউ যদি এমন প্রতিজ্ঞা করে অমিয় চক্রবর্তীর মতে সেই প্রতিজ্ঞার মূল্য আছে। তাঁর মতে, কবিতায় জায়গার অভাবে নানা অভিসন্ধির শরণাপন্ন হতে হয়, কিন্তু সংহতির অসতর্ক বাক্যের ব্যবহার রক্ষা হয় না, শেষ পর্যন্ত বাধা পায়। তিনি ভাষার ব্যবহারে সূক্ষ্ম চেতনার অভাবকে শিল্পচেতনারই অভাব বলে মনে করেন। তিনি আরও বলেছেন, “অত্যন্ত গদ্যভাব এবং ভারী কথার সিমেন্ট-করা পদ আধুনিক কাব্যের আরেক সমস্যা।” তিনি মনে করেন, মনে রাখা উচিত বাংলা কবিতায় এই মাথাভারী মস্ত কথার দৌরাত্ম্য সংস্কৃত ভাষার দুর্ব্যবহার হয়ে দেখা দিলেও এই মাননিক প্রতিক্রিয়া নকল সংস্কৃত এবং নকল পশ্চিমী। তাঁর এ উক্তির উদ্দেশ্য সুধীন্দ্রনাথের কাব্যভাষা বলেই মনে হয়।১৭
গ. সুধীন্দ্রনাথ দত্ত (১৯০১—৬০)
কবি ঘটকের মতো, পাত্র-পাত্রীর মিলনেই তার উপকারিতার শেষ।…
দৈনন্দিন ভাষা আর কাব্যের ভাষা বস্তুতই বিভিন্ন, বৈধ মতেই বিভিন্ন। এ প্রভেদ গদ্যের ও পদ্যের স্বভাবগত, গদ্যের অবলম্বন বিজ্ঞান, কাব্যের অন্বিষ্ট প্রজ্ঞান। তাই গদ্য চলে যুক্তির সঙ্গে পা মিলিয়ে, আর কাব্য নাচে ভাবের তালে তালে; গদ্য চায় আমাদের স্বীকৃতি, আর কাব্য খোঁজে আমাদের নিষ্ঠা; রেখার পরে রেখা টেনে অবিশ্রান্ত গদ্য যে ছবি আঁকে, গোটা কয়েক বিন্দুর বিন্যাসে কাব্যের যাদু সেই ছবিকেই ফুটিয়ে তোলে, আমাদের অনুকম্পার পটে। কাব্যের এই মরমী ব্রতে সিদ্ধি আসে প্রতীকের সাহায্যে। শব্দ মাত্রেরই দুটো দিক আছে; একটা অর্থের দিক, অন্যটা তার রসপ্রতিপত্তির দিক। গদ্যের সঙ্গে শব্দের সম্পর্ক ওই প্রথম দিকটার খাতিরে; গদ্যে শব্দগুলো চিন্তার অধার। কিন্তু কাব্য শব্দের শরণ নেয় ওই দ্বিতীয় গুণের লোভে; কাব্যের শব্দ আবেগবাহী।১৮
বহুভাষী সুধীন্দ্রনাথ দত্ত বাংলা ভাষা ছাড়াও প্রাচীন সংস্কৃত এবং আধুনিক ইংরেজি, ফরাসি এবং জার্মান ভাষার সমকালীন সাহিত্য সম্পর্কে গভীর অনুরাগী ছিলেন বলে সমকালীন বিশ্বের প্রধান কবি ও কবিতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখতেন। স্বগত (১৩৪৫) এবং কুলায় ও কালপুরুষ (১৬৪) দুটি প্রবন্ধগ্রন্থের প্রবন্ধগুলোতে সেগুলো তিনি প্রকাশ করেছেন। পরিচয় পত্রিকা সম্পাদনার মাধ্যমে তিনি নিজের এবং সতীর্থদের ভাব, চিন্তা ও রুচির বিকাশ ঘটানোর সুযোগ লাভ করেন।
ওপরে উদ্ধৃত সুধীন্দ্রনাথের কথাগুলোর সবটুকুই তাঁর না। এখানে মধুসূদনের কথা আছে, রবীন্দ্রনাথের কথা আছে, হয়তো পশ্চিমের কোনো কবি বা মনীষী—বিশেষ করে ফরাসি কবির মতও লুকিয়ে থাকতে পারে। তিনি দৈনন্দিন ভাষা থেকে কবিতার ভাষাকে ভিন্নরকম দেখতে চান। এর কারণহিসাবে তিনি গদ্য আর পদ্যের পার্থক্যের দিকটি সামনে আনতে চান। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত কবিতায় অপ্রচলিত শব্দ, আভিধানিক শব্দ এবং পুরনো সংস্কৃত শব্দ ব্যবহার করে নিজস্বতা সৃষ্টি করেছেন; তাঁর কবিতা দেখলেই বোঝা যায়। যদিও তিনি ছোটবেলা দিল্লি বা কাশীতে হিন্দিভাষী অঞ্চলে ছিলেন, পরবর্তী জীবনে ইংরেজি, ফরাসি ও জার্মানসহ অনেক ভাষা জানতেন এবং সেসব ভাষায় নিয়মিত পড়াশোনা করতেন, সেসব ভাষার কবিতা বাংলায় অনুবাদও করেছেন কিন্তু নিজের কবিতার ভাষায় পারতপক্ষে বিদেশি শব্দ ব্যবহার করেন নাই।
ঘ. আবু সয়ীদ আইয়ুব (১৯০৬-৮২)
সাধারণ অভিজ্ঞতার জগতের ভাষার সমাজ-প্রদত্ত আভিধানিক নির্দেশকে বিলুপ্ত ক’রে ভালেরি, এলিয়ট, য়েটস প্রভৃতি তাদের কাব্যলোকের চারিদিকে একটি অখণ্ড শূন্যতা রচনা করেছেন।১৯
আবু সয়ীদ আইয়ুব অন্যত্র আরও বলেন, “কবিতার ময়ূরপঙ্খী নায়ে যে শৌখিন ভাষা ভেসে বেড়ায় তার সঙ্গে অর্থের মালপত্র থাকলে নৌকাসুদ্ধ ভরাডুবির আশঙ্কা।”
জাঁ পল সার্ত্র এর উদ্ধৃতি দিয়ে আইয়ুব আরও বলেন,
কাব্যের অর্থমাত্রই অনর্থকারী। গদ্যের ভাষা স্বচ্ছ কাচের মতো, নিজেকে দৃষ্টিগোচর না করে আমাদের দৃষ্টিকে এগিয়ে দেয় ওপারের বস্তুগুলির দিকে। কবিতার ভাষা কিন্তু নিজেকেই চোখের সামনে তুলে ধরে, দৃষ্টিকে আটকে রাখে ঐ কারুকার্য-খচিত কাচের মধ্যে, কাব্যেতর কিছু দেখতে দেওয়া তার আত্মাবমাননার সামিল।২০
আবু সয়ীদ আইয়ুব কবি না হলেও তিনি কবিতার খুব কাছাকাছি অবস্থিত লোক ছিলেন। তিরিশি কবিদের মধ্যে প্রায় সবার সাথেই তাঁর ঘনিষ্টতা ছিল। তিনি রবীন্দ্রনাথের কবিতার মধ্যে আধুনিকতা গভীরভাবে অনুসন্ধান করতে গিয়ে উর্দুভাষা ছেড়ে বাংলাভাষায় প্রবন্ধ লিখতে থাকেন। কবিতার ভাষা নিয়ে দুটি প্রবন্ধ থেকে দুটি উদ্ধৃতি ওপরে রাখা হলো। প্রথমটিতে সমকালের কলকাতার বড় কবিদের মধ্যে প্রভাববিস্তারকারী ইউরোপের বড় কবিদের ভাষা নিয়ে একবাক্যে একটি কথায় জানিয়েছেন, সমাজপ্রদত্ত অর্থ ছেড়ে নতুন অর্থের জন্য একটি শূন্যতা সৃষ্টি করেছেন। পরের অনুচ্ছেদে জানান, কবিতার মধ্যে অর্থ খুঁজতে যাওয়া অর্থহীনতা। বাংলা কবিতার ধারাবাহিক বিকাশে দেখা যায় অনেক বছর পরে সেই অর্থহীনতার তত্ত্বটি অনেক কবির অন্বিষ্ট এবং আরাধ্য হয়ে উঠেছে। এটি অনাকাক্সিক্ষত, অভাবিতপূর্ব কোনো নতুন কিছু নয়, বাংলা কবিতার ভাষাচিন্তার মধ্যে আগে থেকেই ছিল।
ঙ. বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-৭৪)
বুদ্ধদেব বসু রবীন্দ্রনাথের পরে বহুমাত্রিক বহুলপ্রজ লেখক। সৃজনশীল কবিতা, গল্প, উপন্যাস, ছড়া, নাটক, ভ্রমণকাহিনি ও মননশীল প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনা করে বাংলা সাহিত্যে নতুন মাত্রা দেন। প্রথম জীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় কলকাতার নবযুগের পতাকাবাহী প্রগতিশীল সাহিত্যপত্রিকা কল্লোল (১৯২৩)-এর লেখক হয়ে ওঠেন। পরে তিনি ঢাকা থেকে প্রগতি (১৯২৭) পত্রিকা সম্পাদনা করেন এবং পরে দীর্ঘকাল ধরে কবিতা (১৩৪২) পত্রিকা সম্পাদনা করে আধুনিক বাংলা কবিতা চর্চায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। তিনি সংস্কৃত, ইংরেজি, ফরাসি ও জার্মান ভাষা থেকে সরাসরি এবং অন্য ভাষা থেকে এসব ভাষার মাধ্যমে নানা কবির কবিতা অনুবাদ করেন। বাংলা এবং ইংরেজি ভাষায় কবিতা বিষয়ে তাঁর প্রবন্ধের সংখ্যাই বেশি। তাঁর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধগ্রন্থের নাম এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন। হঠাৎ আলোর ঝলকানি (১৯৩৫), উত্তর তিরিশ (১৯৪৫), কালের পুতুল (১৯৪৬), সাহিত্যচর্চা (১৯৫৪), সঙ্গ নিঃসঙ্গতা ও রবীন্দ্রনাথ (১৯৬৩), স্বদেশ ও সংস্কৃতি (১৯৫৭), কবি রবীন্দ্রনাথ (১৯৬৬), An Acre of Green Grass (1948) Tagore: A Portrait of Poet (1962) এবং মৃত্যুর পরে প্রকাশিত মহাভারতের কথা (১৯৭৫) ইত্যাদি।
আধুনিক বাংলা কবিতাবিষয়ে বুদ্ধদেব বসুর মতামত খুবই গুরুত্বপূর্ণ, এজন্য কেউ কেউ তাঁকে এ কাজের প্রধান পুরোহিত বলে থাকেন। কেউ কেউ জীবনানন্দ দাশসহ তিরিশি কবিদেরকে সম্মিলিতভাবে আদিম দেবতা বলে অভিহিত করে থাকেন, তবে পুরোহিততন্ত্র থেকে হোক, দৈববিশ্বাস থেকে হোক অথবা আধুনিক শিল্পবোধ ও শিল্পচেতনা থেকে হোক বুদ্ধদেব বসুর কবিতাবিষয়ক প্রবন্ধগুলো এবং কবিতাবিষয়ে করা নানা মন্তব্যধারী চিঠিপত্রগুলো মূল্যবান সম্পদ। তাঁর বেশিরভাগ কবিতাবিষয়ক প্রবন্ধ ব্যক্তিকেন্দ্রিক, নানা কবির কবিতা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা ও মন্তব্য রয়েছে সেখানে। শুধু কবিতার ভাষা নিয়ে রচনা সামান্য, তবে তাঁর এসব রচনা থেকে সন্ধান করে নিচের প্রথম ছোট উদ্ধৃতিটি প্রতিনিধিমূলক উক্তিহিসাবে গ্রহণ করা হলো।
ভিন্ন বস্তুর সঙ্গে তুলনা বা সমীকরণ ছাড়া বর্ণনার কোনো উপায় আছে কিনা, আর যে কোনো কবিতার কতখানি ছবি থাকে, আর কবি যদি জ্ঞানের ভাষায় কথা বলতে যান তাহলে তিনি আর কবি থাকেন কতটুকু?২১
এখানে বুদ্ধদেব বসু জ্ঞানের ভাষায় কবিতা রচনাকে অর্থহীন কাজ বলে মনে করেছেন। আধুনিক কবিতার ভাষা সম্পর্কে এখানে একটা ইঙ্গিত পাওয়া যায়। উপমা, উপমান ও উপমিতের সমীকরণ নিয়ে কবিতায় সেগুলোর প্রয়োজনীয়তার কথা এখানে আছে। তবে আধুনিক কবিতার ভাষা নিয়ে তাঁর আরেকটি সহজ কথা এখানে উল্লেখ করা যায়,
সকলেই জানেন যে সাধারণ জীবনের ব্যবহারিক ভাষা আর সাহিত্যের ভাষা এক নয়, আবার গদ্যের ভাষা আর কাব্যের ভাষাতেও পার্থক্য আছে। গদ্যকাব্যের সার্থকতা স্বীকার করি, তবু এ-কথাও সত্য যে কাব্যের প্রধান বাহন ভাষার সেই সুনিয়ন্ত্রিত বেগবিকশিত ভঙ্গি, যার নাম ছন্দ। প্রথমেই মেনে নিতে হবে যে ছন্দ জিনিশটা কৃত্রিম নয়, মিল অনুপ্রাসাদি আনুষঙ্গিক অলংকার নিয়ে শুধুমাত্র একটা কৌশলও নয়, কাব্যের প্রাণের সঙ্গে তার অবিচ্ছেদ্য সংযোগ। কোনো-একটা আবেগ দিয়ে বলতে গেলে ছন্দ এসে পড়ে স্বভাবেরই অনতিক্রম্য প্রভাবে; আবেগের আঘাতে ভাষা যে স্বতই ছন্দে তরঙ্গিত হ’য়ে ওঠে, তার প্রমাণ রত্নাকর দস্যুর কাহিনীতে শুধু নয়, সাহিত্যের ইতিহাসেও আছে।২২
এ আলোচনায় বুদ্ধদেব বসুকে কবিতার ভাষার জন্য ছন্দকে একটি অনস্বীকার্য এবং অনিবার্য বিষয় বলে গ্রহণ করতে দেখা গেছে। এখানকার বক্তব্য একেবারে পানির মতো পরিষ্কার। এখানে তাঁর বক্তব্য অ্যাডগার অ্যালান পো-এর মতের কাছাকাছি দেখা যাচ্ছে।
চ. বিষ্ণু দে (১৯০৯-৮২)
কালাতীত পারয়িত্রী প্রতিভাই শুধু সর্বযুগের কবিদের সাধারণ সম্পদ। ভাষামার্গ, কথ্য ও লেখ্য ভাষার প্রতি পক্ষপাত, প্রত্যক্ষ প্রয়োগ, শ্রোতাদের গুণাগুণ ইত্যাদি সবই পরিবর্তনশীল রুচির প্রতিনিধি। কবির মুক্তি অবশ্য সত্য ভাষণেই, বন্ধু-বান্ধবকে আনন্দপ্রদানেই, কিন্তু সে সত্যের রূপ আর সে সে বন্ধুদের কুলশীল নির্ণয়ের ভার সমাজের এবং অংশত হয়তো কবির জীবনযাত্রার উপরে। যখন কবির প্রত্যক্ষপ্রজ্ঞার জগৎ সমাজচৈতন্যের অখণ্ডতায় মোটামুটি পাঠকের জগতে সাযুজ্য লাভ করে, তখন কবি বহুর এক হয়, তার ভাষা হয় সরল, মুখের ভাষার পাশঘেঁষা, রুচির প্রগতি হয় বাঁধাসাধা। ছিন্নভিন্ন সমাজে কবি হয়ে ওঠে কবিবিশেষ, তার ভাষা হয় বিশেষজ্ঞের, তাকে অস্থির হয়ে বেড়াতে হয় চৌষট্টি সতীতীর্থে।২৩
বিষ্ণু দে’র কবিতা দুর্বোধ্য এবং দুরূহ, এ অভিযোগ রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে অনেকেই করে গেছেন। ওপরের আলোচনায় তাঁর যে ধরনের কবিতার ভাষাচিন্তা দেখা যায়, সাক্ষাৎ হয়, সেখানে তাঁর উপস্থিতি চোখে পড়ে না। বামপন্থী রাজনীতির কবিহিসাবে তাঁর রচনা গণমানুষের কাছে সহজবোধ্য হওয়া উচিত ছিল, এমন কথা আক্ষেপ করে জীবিত অবস্থায় অনেকেই তাঁর বিরাগভাজন হয়েছেন। সে অনুযোগ ক্রমান্বয়ে অভিযোগে রূপান্তরিত হয়েছিল এবং সর্বশেষে তা শত্রুতায় পরিণত হয়েছে। তাঁর “যখন কবির প্রত্যক্ষপ্রজ্ঞার জগৎ সমাজচৈতন্যের অখণ্ডতায় মোটামুটি পাঠকের জগতে সাযুজ্য লাভ করে, তখন কবি বহুর এক হয়, তার ভাষা হয় সরল, মুখের ভাষার পাশঘেঁষা, রুচির প্রগতি হয় বাঁধাসাধা”—এ বাক্য যদি কোনো রকম গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে, তাহলে তো তাঁর নিজের ভাষাই সরল, মুখের ভাষার পাশঘেঁষা হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু তা হয় নাই। এসব বিষয় নিয়ে ভবানী সেন বিষ্ণু দে’র কবিতার তীব্র সমালোচনা করে এক প্রবন্ধ লেখেন, সেখানে স্পষ্ট করে ভবানী সেন উল্লেখ করেন,
বিষ্ণুবাবু একজন দক্ষ কলাকৌশলবিদ কিন্তু মার্কসিস্ট নন। তাঁর কলাকৌশল মার্কসবাদকেই হত্যা করে। কিন্তু এ কথা মনে করলে ভুল হবে যে, বিষ্ণু বাবুর গলদ শুধু কলাকৌশলেই। কলাকৌশল তাঁর ভাবধারাকেও বিকৃত করে দিয়েছে, অথবা তাঁর ভাবধারারই প্রকৃত প্রতিচ্ছবি হল তাঁর কলাকৌশল। তাঁর কবিতায় সমাজতন্ত্র, জনগণ, ধর্মঘট, তেভাগা—এসব সত্যকার মানুষের সত্যকার সংগ্রাম নয়, এসব হচ্ছে কতকগুলি আধ্যাত্মিক আইডিয়া, উপকথার লালকমল আর নীলকমলের মত প্রহেলিকা, মনের একটা আলোড়ন, ভাবের একটা রঙীন নেশা।২৪
বিষ্ণু দে’র কবিতার ভাষা ও কলাকৌশল নিয়ে সমকালে শুধু ভবানী সেনই নন, প্রদ্যোৎ গুহসহ আরও অনেকে তাঁকে আক্রমণ করেচিলেন। বিষ্ণু দে সেসবের উত্তরও দিয়েছিলেন, তিনি তিরিশের অন্যতম প্রধান কবি, নানা কারণেই কবিতা রচনার পাশাপাশি তাঁকে প্রবন্ধ লিখতে হয়েছে। তাঁর প্রবন্ধগ্রন্থের সংখ্যা কাব্যগ্রন্থের সংখ্যার চেয়ে বেশি। নিচের উক্তিটিতেও বিষ্ণু দে’কে সহজ এবং সরল কাব্যভাষার পক্ষে থাকার ইঙ্গিত দেয়, যদিও প্রথম দিকের বিষ্ণু দে’র কবিতা আর অন্তিম পর্বের কবিতার ভাষায় অনেক পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। শেষের দিকে তিনি কবিতার ভাষাকে অনেক সহজ করে নিয়েছিলেন, কিন্তু ক্ষমাহীন সমালোচনা তাঁর সম্পর্কে ছিলই।
সাধারণ জীবনে যদি সাহিত্যের ভিত্তি গাঁথতে হয়, তাহলে যে বাংলা কবিতার নিতান্তই কবিজনোচিত ও উন্মার্গ সৌখীন চাল ত্যজ্য, সে বিষয় কারো সন্দেহ নেই। এবং যতদিন না গদ্য ও পদ্যের পাশাপাশি থাকবার ব্যবস্থা বাংলা কবিতায় হচ্ছে, ততদিন সামাজিক জীবনের অলিগলিতে বাংলা কবিতার যাতায়াত রুদ্ধ।২৫
এ কথায় ইংরেজ কবি ডব্লিউ এইচ অডেনের মতের ছায়াপাত ঘটেছে। বাংলা সাহিত্যের একজন মৌলিক এবং প্রধান কবিহিসাবে তাঁর কাব্যভাষা যেমনই হোক তিনি ক্ষমা পেতে পারেন। বর্তমান রচনায় তাঁর কবিতার আলোচনা হচ্ছে নাম কাব্যভাষা সম্পর্কে তাঁর অভিমত নিয়ে কথা হচ্ছে।
চতুর্থ অধ্যায়: উত্তর ঔপনিবেশিক যুগ
ক. সৈয়দ আলী আহসান (১৯২২—২০০২):
চল্লিশের দশকে আবির্ভূত কবি সৈয়দ আলী আহসান শুরুতে প্রথানুগ কবিতা রচনা করে বিপুল সময়, প্রায় দুই দশক কাল নষ্ট করার পরে দেশি-বিদেশি আধুনিক কবিদের সংস্পর্শ ও সান্নিধ্য লাভ করার পরে আধুনিক ধারার কবিতা রচনা করতে শুরু করেন। তিনি বাংলাদেশের কবিদের মধ্যে অমিয় চক্রবর্তীর মতো বিদেশ সফর ও বিদেশি কবিদের প্রত্যক্ষ সাক্ষাতের মাধ্যমে কবিতার গঠন ও ভাষা পরিবর্তন করার সুযোগ লাভ করেন। পরে কবিতা রচনা ছাড়াও কবিতাবিষয়ক অনেক প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনা করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি প্রবন্ধগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে: কবি মধুসূদন (১৯৫৭), কবিতার কথা (১৯৬৪), কবিতার কথা ও অন্যান্য বিবেচনা (১৯৭০), আধুনিক বাংলা কবিতা: শব্দের অনুষঙ্গে (১৯৭০), রবীন্দ্রনাথ: কাব্যবিচারের ভূমিকা (১৯৭৪), মধুসূদন: কবিকৃতি ও কবিতাদর্শ (১৭৭৫), সতত স্বাগত (১৯৮৩), শিল্পবোধ ও শিল্পচৈতন্য (১৯৮৩), কবিতার রূপকল্প (১৯৮৫) ইত্যাদি। নিচের উদ্ধৃতি থেকে তাঁর কবিতার ভাষা সম্পর্কিত একাট ধারণা লাভ করা যায়।
কবিতায় শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে নির্বাচনের প্রশ্নটা প্রথমে আসে, তারপরে উচ্চারণগত ধ্বনির বিশিষ্ট এবং অবশেষে শব্দের অর্থবহন কোরবার ক্ষমতা। কবিতা যখন আমরা পাঠ করি তখন সংগে সংগেই এ বিশিষ্টতাগুলো আমাদের কাছে ধরা পড়ে না, কিন্তু বিশ্লেষণে অগ্রসর হলেই আমরা কবির শব্দ ব্যবহারের তাৎপর্য সম্পর্কে ক্রমশঃ অবহিত হই।…
আধুনিক কবিরা কবিতাকে শব্দের সম্ভাবনা নির্ণয়ের একটি বিশেষ পদ্ধতি হিসেবে গণ্য করেন। অর্থাৎ একটি ভাষায় ববহৃত শব্দ-সামগ্রী অর্থপ্রকাশের দিক থেকে কতটা সক্ষম কবি কবিতা রচনার সময় তার পরীক্ষা করে থাকেন। …
আধুনিক কবিদের কাছে কোন বস্তু বা বিষয়ের নিজস্ব মূল্য বা গুরুত্ব নেই। আমাদের প্রতিদিনের ব্যবহারের সামগ্রী যখন কোন মূল্য পায় তখন সে তার ব্যবহারের তাৎপর্যের কারণেই মূল্য পায়।২৬
খ. নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী (১৯২৪—২০১৮):
টেরাকোটা যেমন নিতান্ত নিরেট একতাল মাটির ভিতর থেকে, প্রায় দৈব বলে, বার করে আনে আশ্চর্য সব পুতুল কিংবা প্রতিমা, সেও (কবি) তেমনি আপাত-নির্বোধ কতগুলি শব্দের ভিতর থেকে আশ্চর্য সব আনন্দ ও যন্ত্রণাকে তৈরি করে তুলতে পারে। শব্দকে সে করুণ কিংবা আনন্দিত গানের মতো বাজাতে পারে। শব্দকে সে শায়কের মতো নিক্ষেপ করতে পারে, যা এর পরিচিত আর কেউ পারে না। চল্লিশের দশকে আবির্ভূত কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী শক্তিমান তিরিশি কবিদের প্রভাব এড়িয়ে নতুন কাব্যভাষা নির্মাণ করার চেষ্টা করেছেন তাঁর কবিতায়। সেখানে তিনি কতটা সফল হয়েছেন, সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। তিনি কবিতা রচনা করার পাশাপাশি কবিতা নিয়ে অনেক গদ্যও রচনা করেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য একটি গদ্যগ্রন্থের নাম, কবিতার ক্লাস, কবিতার কি ও কেন, নীরবিন্দু, কবিতার দিকে ও অন্যান্য রচনা (১৯৯২), গদ্যসমগ্র-১ ও ২ ইত্যাদি। কবিতার ভাষা প্রসঙ্গে তিনি ওপরের কথাগুলো প্রকাশ করেছেন, এছাড়া তিনি আরও বলেন,
… কবিতার যাবতীয় উপাদান আমাদের চতুর্দিকেই ছড়িয়ে আছে। দরকার শুধু চিত্তের ঈষৎ বেদনা অথবা চক্ষুতে ঈষৎ কৌতুক নিয়ে তাদের দিকে তাকানো। দরকার শুধু তাৎক্ষণিক অর্থের অতিরিক্ত কোনো অর্থ তাদের মধ্যে খুঁজে নেওয়া। আমি কি কোনো নতুন ফুল, কিংবা নতুন পাখি, কিংবা নতুন মানুষ কাউকে দেখাতে পারি? তা নিশ্চয় পারি না। কিন্তু চেষ্টা করতে পারি পুরনো ফুল, পুরনো পাখি আর পুরনো মানুষকেই অন্য চেহারায় দেখতে। চেষ্টা করতে পারি তাদের অস্তিত্ব, আন্দোলন ও উন্মোচনের একটি তাৎপর্য খুঁজে নিতে।২৭
এখানে দেখা যাচ্ছে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী কবিতা রচনা ও ভাষা সৃষ্টির সাথে সাথে দৃষ্টিকেও অনিবার্য, অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং অনস্বীকার্য বিষয়রূপে দেখেছেন। কবি তাঁর শব্দাবলির সুবিন্যাস্ত প্রকাশের মাধ্যমে নতুন কিছু সৃষ্টি করতে পারেন। আগে যা ছিল না, তা বানিয়ে দেখাতে পারেন। এখানে দরকার হলো ভাষার শক্তি। মধুসূদনের কথাগুলো এ প্রসঙ্গে পাঠকের মনে না পড়ে পারবে না।
গ. হাসান হাফিজুর রহমান (১৯৩২—১৯৮৩)
হাসান হাফিজুর রহমান পঞ্চাশের দশকে আবির্ভূত প্রতিভাবান কবি হলেও তিনি জনপ্রিয় ধারার লেখক ছিলেন না, তবে প্রভাবশালী ব্যক্তিহিসাবে সমকালে সুপরিচিত ছিলেন। তিনি আধুনিক কবি ও কবিতা (১৯৬৫) নামে যে গ্রন্থটি রচনা করেন, সেটি একটি মাইলফলক হয়ে আছে। সাহিত্যবিষয়ে এছাড়াও তিনি কয়েকটি প্রবন্ধগ্রন্থ রচনা করেছেন। যেমন, সাহিত্যপ্রসঙ্গ (১৯৭৩), আলোকিত গহ্বর (১৯৭৭) ইত্যাদি। এছাড়াও তাঁর কিছু প্রবন্ধ গ্রন্থাকারে অগ্রন্থিত ও অপ্রকাশিত রয়েছে, সেখানে আধুনিক কবিতা নিয়ে নিজস্ব মত তিনি প্রকাশ করে গেছেন। তাঁর মতে,
কবিতার ভাষা প্রত্যেক কবিতার জন্যই যেন স্বতন্ত্রভাবে জন্মলাভ করে। বিশেষ কবিতার জন্য অস্থিমজ্জায় মিশে এক অখণ্ড ব্যঞ্জনায় তা অবিভাজ্য হয়ে যায়। তার পুনরাবৃত্তি চলে না, বা এক কবিতার খণ্ডাংশ দিয়ে অন্য কবিতাও গড়ে তোলা যায় না। সমঅর্থপূর্ণ ভাষা গদ্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায়। কিন্তু দুটি সার্থক কবিতায় একই ভাষা কেউ আবিষ্কার করতে পারবেন না। এমনকি একজন কবি নিজেই নিজের ব্যবহৃত ভাষার পুনরাবৃত্তি করেন না।
এখানে হাসান হাফিজুর রহমান কবিতার ভাষায় নতুনত্বের ধারণা ব্যক্ত করেছেন। প্রতিটি কবিতার ভাষায় তিনি নতুনত্ব দেখতে আগ্রহী। তবে তাঁর সময়ের “সাম্প্রতিক কবিতার ভাষার আদল, প্রয়োগবিধি, রুচিবিন্যাস, শব্দব্যবহার ইত্যাদি বিভিন্ন কবির হাতে পড়েও খুব কাছাকাছি, পরস্পরের হাত ধরে যেন সজ্জিত”—তাঁর কাছে মনে হয়, এ যেন একই কামারশালায় তৈরি। একক সৃষ্টির মহিমায় তা স্বতন্ত্র ও উজ্জ্বল নয়, যেন যৌথ ব্যবহারের রক্ষিত উপাদান। এর কারণহিসাবে তিনি মনে করেন, সাম্প্রতিক কবিদের অনুপ্রেরণার উৎস এক, আহরণের স্টক-টাও তাই সমগোত্রীয়। প্রায়ই তারা নিজস্ববোধে ধারণা ও চেতনায় এবং আত্মনিরীক্ষায় পৃথিবীর পথিক নন বলে তাঁদের উত্তেজনাটা ধার করা, অভিজ্ঞতার কাঠামোটাও চলতি হাওয়ার তপ্ত খোলা থেকে তুলে নেওয়া। ফলে, মুখের ভাষা আগে থেকেই রপ্ত। গণ্ডিটা ক্ষুদ্র বলে পরিশ্রমটাও এতে একেবারেই সংক্ষিপ্ত। তিনি মনে করেন, এতে লাভ বোধকরি এতটুকুই যে, কবি ও কবিতার সংখ্যা মৎস্যডিম্বের মতো অগণন হতে আর কোনো বাধাই থাকে না।২৮
ঘ. সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় (১৯৩৪—২০১২)
বহুমাত্রিক এবং জনপ্রিয় লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সাহিত্যের নানা শাখায় বিচরণ করে সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছেন। কবিহিসাবে তিনি যেমন জনপ্রিয়, ঔপন্যাসিকহিসাবেও। তাঁর কবি ও কবিতাবিষয়ক গদ্য রচনার মধ্যে রয়েছে কবিতার জন্ম ও অন্যান্য (১৯৯১), ছবির দেশে কবিতার দেশে, আমার জীবনানন্দ আবিষ্কার ও অন্যান্য, সনাতন পাঠকের চিন্তা, অর্ধেক জীবন, বরণীয় মানুষ: স্মরণীয় বিচার, ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গ, আমি কি বাঙালি ইত্যাদি। নিচের উদ্ধৃতিতে অকপট স্বভাবের স্পষ্টভাষী সুনীলের মানসিক অবস্থা বোঝা যায়।
কবিতার কিছু লাইনের মানে থাকে, কিছু লাইনের কোনোই মানে থাকে না। প্রতি লাইনের ব্যাখ্যার ইচ্ছে মূঢ়তা ও অসঙ্গত প্রয়াস মাত্র। লিখতে লিখতে কবির কাছে এমন দুচারটি শব্দ বা লাইন এসে যায়, যেগুলি আপাতত পারম্পর্যহীন বা আগের লাইনের সঙ্গে অর্থের যোগাযোগ রক্ষা করে না, কিন্তু লিখে ফেলে—এক ধরনের সবল বাসনায়, কবি সেগুলি আর কাটতে চান না, ‘কাটব না, যা হয় হোক’, এই ধরনের একটা মনোভাব আসে। কিন্তু পাঠক অসহায়, তার পক্ষে কবি কোথায়—কোথায় এমন কৌতুক করেছেন, বোঝা অসম্ভব, সুতরাং প্রতিটি শব্দ ও লাইনের মানে বা প্রয়োজন খুঁজতে গিয়ে হিমসিম খায়, অনেক সময় সেইজন্যই কবিতাটি নিরর্থক হয়ে যায়। কারণ, এ-কথা নিশ্চিত, ঐ ধূসর, রহস্যময়ভাবে আগত শব্দ বা বাক্যবন্ধই একটি কবিতার মূল কবিতা।২৯
সুনীল এখানে যে কথাটি স্পষ্টভাবে স্বীকার করেছেন সেটি হলো আকস্মিকতা। যাঁরা কবিতা লেখেন তাঁরা জানেন, কবিতায় আকস্মিকতার একটি ব্যাপার আছে, কিছু শব্দ, পদ পঙ্ক্তি আকস্মিকভাবে, অর্থহীন সৌন্দর্য নিয়ে চলে আসে। আর সেটি লেখক অর্থহীন জেনেও কেটে ফেলেন না, বাদ দিতে চান না, মায়া লাগে। একটি উপমা, একটি চিত্রকল্প, একটি রূপক বা একটি উৎপ্রেক্ষাই একজন কবির যোগ্যতা ও সৃষ্টিশীল ক্ষমতা প্রকাশ করতে পারে, একারণেই গভীর মমতা থাকে ঐ কাব্যসম্পদের টুকরাটির প্রতি। কবি সেটি ভুল জেনেও বাদ দিতে চান না, রবীন্দ্রনাথ যেমন ব্যাকরণে ভুল হয়েছে জেনেও সঞ্চয়িতার নামটি রেখে দিয়েছেন। আর সেই কাব্যসম্পদের টুকরাগুলোই কবিতার মূল কবিতা হয়ে ওঠে। সুনীল মমতার পরিবর্তে সবল বাসনার কথা লিখেছেন।
চ. আবু হেনা মোস্তফা কামাল (১৯৩৬—৮৯)
আবু হেনা মোস্তফা কামাল পঞ্চাশের দশকে আবির্ভূত একজন কবি হলেও তিনি কবিতা-আলোচক হিসাবে বেশি পরিচিত। কবিতার চেয়ে তাঁর রচিত গান এবং গজল বেশি জনপ্রিয়। এসব সৃজনশীল রচনার পাশাপাশি তিনি কবিতাবিষয়ক গদ্য লিখেছেন। তাঁর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধগ্রন্থের নাম হলো: শিল্পীর রূপান্তর (১৯৭৫), কথা ও কবিতা (১৯৮১), The Bengali Press and Literary Writing (1977), কথাসমগ্র (২০০০) ইত্যাদি।
কবিতার শরীরে সঙ্কেত ও প্রতীকের যে লীলা তা কখনোই দুর্বিশ্লেষ্য নয়। এইসব আপাত জটিলতার নেপথ্যে কবিতার মর্মে কাজ করে সমাজ, দেশ ও কাল। …
হাজার মতবাদের টানা পোড়েনের অস্তিত্ব মেনে নিয়েও এ কথা স্বীকার করতেই হয় যে কবিতার বিষয়-আশয় খুব বেশি বদলায় না। প্রতিক্রিয়া ও অভিব্যক্তির ভিন্নতা দেখেই আমরা দু’জন কবিকে পৃথক বলে চিনতে পারি।৩০
রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ইশারা, ভঙ্গি আর কৌশলের কথা, আবু হেনা মোস্তফা কামাল বলেছেন কবিতার শরীরের সংকেত এবং লীলার কথা। কবিতার শরীর হলো ভাষা, সেখানেই তো থাকে সংকেত আর প্রতীক, আর সেটাই হলো লীলাক্ষেত্র। কবিতার বিষয়বস্তু নিয়ে যত মতবাদই চালু থাকুক, কবিতার ভাষাই তো প্রতিক্রিয়া ও অভিব্যক্তি প্রকাশের বাহন। আর কবিতার ভাষা দিয়েই তো দুজন কবিকে পৃথক করে চেনা যায়। আবু হেনা মোস্তফা কামাল এসব সংকেত, প্রতীক এবং লীলার পেছনের কথাও বলেছেন। তিনি মনে করেন, সেখানে থাকে সমাজ, দেশ ও কালের বিশাল ভূমিকা। এ বিষয়টি তিনি উল্লেখ করে পাঠককে স্মরণ করিয়ে দেন যে, এক কালের বাস্তবতা, আরেক কালে পুরাণ বা মিথ হয়ে কবিতায় আসে। মধ্যযুগের বৈষ্ণব পদাবলী ছিল সমকালীন প্রসঙ্গ, কিন্তু বর্তমানে রাধা বা কৃষ্ণ কবিতায় আসেন মিথ হয়ে, নতুন অর্থের ইশারাবাহী পুরাণ হয়ে। এখানেই বোঝা যায় সমাজ, দেশ ও কালের প্রভাব ও পরিবর্তনের ধারা।
ছ. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান (১৩৪৩ বঙ্গাব্দ/১৯৩৬—২০০৮):
মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান পঞ্চাশের দশকে আবির্ভূত কবি, কিন্তু তিনি প্রাবন্ধিক, গবেষক ও গীতিকার হিসাবে সুপরিচিত। তাঁর প্রবন্ধগ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে: আধুনিক বাংলা কাহিনীকাব্যে হিন্দু-মুসলমান জীবন ও চিত্র (১৯৬২), আধুনিক বাংলা সাহিত্য (১৯৬৫), আধুনিক বাংলা কাব্যে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক (১৯৭০), বাংলাসাহিত্যে বাঙালী ব্যক্তিত্ব (১৯৭৪), সাহিত্যে উচ্চতর গবেষণা (১৯৭৮), সাময়িকপত্রে সাহিত্যচিন্তা: সওগাত (১৯৮১), রবীন্দ্রচেতনা (১৯৮৪), আধুনিক বাংলা কবিতা: প্রাসঙ্গিকতা ও পরিপ্রেক্ষিত (১৯৮৫), মধুসূদন (১৯৯৩), নজরুলচেতনা (১৯৯৬) ইত্যাদি। তিনি কবিতার ভাষা নিয়ে নিচের উক্তিতে যা বলেছেন, আগে তা একবার পড়ে নেওয়া যাক,
শেষ পর্যন্ত কবির উৎকর্ষ শব্দবাহিত এবং ব্যবহার্য প্রতিটি শব্দের রয়েছে ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিগত ইতিহাস। কবির শব্দ তাই শুধু আভিধানিক নয়, আভিধানিক এবং অভিধান-অতিক্রান্ত —যার মধ্যে বিধৃত প্রযুক্ত শব্দের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিগত ইতিহাস। তাই ভাষাই কবিতা নয়, ভাষা কবিতার উপাদান, যেখান থেকে কবি আর সমালোচক যান দুই বিপরীত দিকে। সমালোচক থাকেন অভিধানে বন্দী, আর কবি আনেন অর্থান্তর, জাগিয়ে তোলেন ব্যঞ্জনা—অজানিত বহু গভীর তলের।৩১
মোহম্মাদ মনিরুজ্জামানের এ উক্তিতে কার্ল স্যাপিরোর (১৯১৩থ২০০০) চিন্তার প্রভাব রয়েছে। তবে কথাটি তিনি আত্মস্থ করে আত্মগতভাবেই প্রকাশ করেছেন। তিনি মধুসূদনের মতোই মনে করেন, কবি ঘটকালির কাজ করেন। তবে সব বিয়ে সুখের হয় না, সফল হয় না। তবে যখন হয় তার মূল্য হয় অমূল্য। মধুসূদনের এক দশক পরে স্তেফান (১৮৪২থ৯৮) মালার্মে এবং তিন দশক পরে পল ভালেরি (১৮৭১থ১৯৪৫) কবিতায় শব্দসচেতনতার গুরুত্বের কথা বলেছেন। ঐ সূত্রেই তাঁরা উপলব্ধি করেন শব্দের সীমা, যে সীমার কথা আগের যুগে অনেকেই বলে গেছেন, বলেছেন রবীন্দ্রনাথও। ঐ উপলব্ধি থেকেই ফরাসি কবিরা প্রতীকবাদী আন্দোলন গড়ে তোলেন বলে মনে করেন মনিরুজ্জামান।
জ. উৎপলকুমার বসু (১৯৩৭—২০১৫)
আমরা যে বাংলাভাষায় কথা বলি বা লিখি তা মোটামুটি রবীন্দ্রনাথেরই তৈরী। আমাদের বাক্যগঠন, বানানরীতি, শব্দবিচার সবই ঐ ছাব্বিশখণ্ড থেকে তৈরী হয়েছে। এবং আমি বা আপনি এটা যতো না ভালো জানি, প্রতিষ্ঠান জানে আরো ভালোভাবে। সুতরাং আমাদের শাসনের জন্য, আমাদের সর্বস্ব গ্রাস করার জন্য ঐ ভাষাই ব্যবহৃত হচ্ছে। ঐ ভাষায় ‘আত্মার স্বাধীনতা’ ঘোষণা করা যায় না এবং ‘আত্মার স্বাধীনতা’ ঘোষণা যদি কবিতা হয়, তবে ঐ ভাষায় আজ আর কবিতা লেখাও চলে না। অর্থাৎ ‘বাংলা ভাষা’তেই কবিতা লেখা অসম্ভব। …
সুতরাং আমাদের নির্মমভাবে, এক নতুন ভাষা তৈরী করা দরকার। আমাদের প্রচলিত বাক্যরীতি, শব্দব্যবহার সমস্তই বর্জন করে এক অভিনব গদ্য তৈরি করা দরকার যা দিয়ে নাটক, কবিতা, গল্প সবই লেখা চলে। এর জন্য আমাদের খুঁজে বের করতে হবে গ্রামের শব্দ, লৌকিক বাক্যরীতি, আসামী উড়িয়া বিহারী বাক্যরীতি—আমাদের যে নতুন ভাষা তৈরী হবে তা হল ঐ বিভিন্ন ভাষা পদ্ধতির সমন্বয়। আমরা ত্রাণ করতে পারি একমাত্র ঐ নতুন ভাষা দিয়ে।৩২
বর্তমান সময়ের বাংলাদেশের বাংলা কবিতায় সবচেয়ে বেশি প্রভাব লক্ষ্য করা যায় উৎপলকুমার বসুর কাব্যভাষার। জেনে কিংবা না জেনে, বুঝে এবং না বুঝে অনেকেই তাঁর কবিতার ভাষা অন্ধের মতো অনুসরণ করছেন। এই অনুসরণের পেছনে নিশ্চয়ই সময় এবং সমাজের কোনো প্রভাব আছে। অনেক বছর ধরে এখানে শামসুর রাহমান আর আল মাহমুদের কবিতার ভাষা নির্বিচারে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এই একঘেয়েমি দূর করার জন্য, নতুন কোনো বাঁকে যাত্রা শুরু করার জন্যই উৎপলকুমার বসুর অনুসরণ। প্রথম দিকে তিনি হয়তো প্রভাবশালী ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন শান্ত ও নিরীহ এবং নির্বিরোধী ধরনের কবি।
ওপরের উক্তিতে দেখা যায়, তিনি অনেক সাহসী কথা উচ্চারণ করেছেন। তিনি মনে করেন রবীন্দ্রনাথের হাতে গড়া বাংলা ভাষা রীতি পরিত্যাগ করে নতুন ভাষারীতি গড়ে তোলা প্রয়োজন, তাঁর এ কথার প্রতিধ্বিনি বাংলাদেশের অনেকের মুখে শোনা যায়। আশির দশকে আবির্ভূত ফরিদ কবির, ব্রাত্য রাইসু, মাসুদ খান (১৯৬৯—) প্রমুখ উৎপলকুমার বসুর ভক্ত এবং অনুরাগী এবং তাঁদের কাউকে কাউকে উৎপলকুমার বসুর কাব্যভাষারীতির অনুসারীও বলা হয়; তবে উৎপলকুমার বসুর মতো ভাষাবিপ্লবী খুব কমই দেখা যায়।
ঝ. আবদুল মান্নান সৈয়দ (১৯৪৩—২০১২)
আবদুল মান্নান সৈয়দ ষাটের দশকের উজ্জ্বল নক্ষত্র। সাহিত্যের নানা শাখায় সফল ও স্বচ্ছন্দ বিচরণে তিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন। বাংলা কবিতায় নতুন মাত্রা যোগ করেছিলেন পরাবাস্তব কবিতা রচনার মাধ্যমে। তাঁর কয়েকটি প্রবন্ধগ্রন্থের নাম হলো: শুদ্ধতম কবি (১৯৭০), জীবনানন্দ দাশের কবিতা (১৯৭৪), নজরুল ইসলাম: কবি ও কবিতা (১৯৭৭), দশ দিগন্তের দ্রষ্টা (১৯৮০), বেগম রোকেয়া (১৯৮৩), আমার বিশ্বাস (১৯৮৪), সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ (১৯৮৬), নজরুল ইসলাম: কালজ কালোত্তর (১৯৮৭), পুনর্বিবেচনা (১৯৯০), দরোজার পর দরোজা (১৯৯১), ফররুখ আহমদ: জীবন ও সাহিত্য (১৯৯৩), বিবেচনা ও পুনর্বিবেচনা (১৯৯৪) ইত্যাদি। আধুনিক কবিতার ভাষা সম্পর্কে তিনি বলেন,
কবিতার ভাষা নিশ্চয় আমাদের দিনানুদিনের ভাষার অনুসরণে সৃজিত হবে হবে না। এমনকি সাহিত্যিক গদ্যভাষাও কি আমাদের প্রতিদিনের ব্যবহৃত ভাষার চেয়ে আলাদা নির্মাণ।৩৩
আবদুল মান্নান সৈয়দ প্রচুর প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন, কবিতা নিয়ে তাঁর রচনার পরিমাণ কম না। তবে তাঁর সেসব গদ্যের বাক্য ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও ব্যক্তিকবির সৃষ্টিকর্মের অনুসারী। এ কারণে কবিতার ভাষাবিষয়ক তাঁর ভাবনা অনেক সুলভ হলেও, সর্বজনীন কথা খুঁজে পাওয়া সমস্যা। ওপরের উক্তিতে দেখা যায়, তিনি কবিতার ভাষাকে দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহারিক ভাষা থেকে একেবারে পৃথকভাবে দেখতে আগ্রহী; সে ভাষা অবশ্যই ছন্দোবদ্ধ হতে হবে। তিনি ছন্দের ব্যাপারে খুবই উৎসাহী, তাঁর সকল কাব্যালোচনার মধ্যে বেশির ভাগ স্থানজুড়ে থাকে ছন্দালোচনা ও ছন্দ-বিশ্লেষণ।
ঞ. হুমায়ুন আজাদ (১৯৪৭—২০০৪)
হুমায়ুন আজাদও বহুমাত্রিক লেখক। তাঁর সাহিত্যবিষয়ক উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধগ্রলোর মধ্যে কয়েকটি: রবীন্দ্রপ্রবন্ধ: রাষ্ট্র ও সমাজচিন্তা (১৯৭৩), শামসুর রাহমান: নিঃসঙ্গ শেরপা (১৯৮৩), শিল্পকলার বিমানবিকীকরণ ও অন্যান্য প্রবন্ধ (১৯৮৮), ভাষা আন্দোলন: সাহিত্যিক পটভূমি (১৯৯০), প্রতিক্রিয়াশীলতার দীর্ঘ ছায়ার নিচে (১৯৯২), নিবিড় নিলীমা (১৯৯২), মাতাল তরণী (১৯৯২), নরকে অনন্ত ঋতু (১৯৯২), সীমাবদ্ধতার সূত্র (১৯৯৩), আমার অবিশ্বাস (১৯৯৭) ইত্যাদি। কবিতার ভাষা নিয়ে তিনি বলেন,
কবিতার জন্য পূর্বনির্ধারিত কোনো বিষয় নেই, নেই কোনো পূর্ব-নির্ধারিত শব্দ, বাক্য বা ভাষারীতি। সবকিছুই বিষয়বস্তু হ’তে পারে কবিতার, এবং যে-কোনো ভাষারীতি বিষয়বস্তুকে রূপান্তরিত করতে পারে কবিতায়। কিন্তু এক পরম মুহূর্তে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হ’তে হয় ভাষা ও বিষয়বস্তুকে, ওই সম্পর্ক বিবাহের চেয়েও অনেক আন্তরিক ও অবিচ্ছেদ্য। যে কোনো কিছুই সুন্দর কবিতার জন্যে, কারণ বিষয়ের নিজস্ব সৌন্দর্য রচনাংশে কবিতা করে না, বরং কবিতায় পরিণত হয়ে বিষয় সুন্দর হয়ে ওঠে।৩৪
ওপরের উদ্ধৃতিতে দেখা যায় হুমায়ুন আজাদ যা বলেছেন, সেখানে নতুন কথা কম। এখানে মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ এবং জাঁ পল সার্ত্র দ্বারা প্রভাবিত আবু সয়ীদ আইয়ুবের মতের মিল আছে, প্রভাব থাকাও সম্ভব। তবে হুমায়ুন আজাদের লেখার ভঙ্গি সরল। ভাষা আকর্ষণীয়। তিনি আলোচ্যবিষয়ে ওর্তেগা ঈ গাসেতের চিন্তাদ্বারা প্রভাবিত। আবু সয়ীদ আইয়ুব জানালার কাচের যে উদাহরণটি ব্যবহার করেছেন, সেটি হুমায়ুন আজাদ করেছেন গাসেতের মাধ্যমে প্রাপ্ত হয়ে। পুরনোকে আত্মস্থ করেই মানুষ আত্মগত উপলব্ধি প্রকাশ করে, তিনিও তাই করেছেন। তাঁর শেষের বাক্য—“যে কোনো কিছুই সুন্দর কবিতার জন্যে, কারণ বিষয়ের নিজস্ব সৌন্দর্য রচনাংশে কবিতা করে না, বরং কবিতায় পরিণত হয়ে বিষয় সুন্দর হয়ে ওঠে”—কথাটি মাইকেলি অনুভব প্রকাশ করলেও নতুন যুগের পাঠকের কাছে বিষয়টি আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। সত্যিই ফুল কিংবা নিসর্গ কবিতাকে সুন্দর করতে পারে না, কবিতার ভাষাই ফুলকে সুন্দরভাবে, নিসর্গকে সুন্দরভাবে সৃষ্টি করতে পারে।
চতুর্থ অধ্যায়: শেষ কথার অশেষ ধারণা
কবিতার ভাষা নিয়ে ওপরের আলোচনা থেকে যে ধারণাগুলো পাওয়া গেল: কবিতার ভাষা অন্য ভাষা থেকে ভিন্ন, অর্থকে অভিধান ও সমাজ থেকে অতিক্রান্ত হতে হবে, গদ্যভাষার কাছাকাছি হওয়া ভালো, ছন্দোময় হতে হবে ইত্যাদি। এগুলো পৃথিবীর সবদেশেই মান্য রীতি। বাংলা সাহিত্যের প্রধান প্রধান কবিদের কবিতা এবং বাংলাদেশের কবিতাবিচার ও বিশ্লেষণের জন্য ওপরে আলোচ্য চিন্তার প্রয়োগ কতটুকু সফল হয়েছে তা করা এ রচনার পরবর্তী পদক্ষেপ হতে পারত। বর্তমান রচনায় তা সম্ভব হচ্ছে না, একটি সিরিজ রচনার মাধ্যমে সেটি করা সম্ভব। সামাজিক বিবর্তনের সাথে সাথে কবিতার ভাষার পরিবর্তন ও বিবর্তন, দেশকালে কবিতার ভাষার পার্থক্যও কবির ব্যক্তিরুচির সাথে আলোচ্য বিষয়। আগামী কোনো রচনায় সেসব আলোচনা হতে পারে।
তথ্যসূত্র
১. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সাহিত্যের বিচারক, ‘সাহিত্য’, রবীন্দ্ররচনাবলী-চতুর্থ খণ্ড, ঐতিহ্য, ঢাকা, দ্বিতীয় সংষ্করণ জুন, ২০০৪, পৃষ্ঠা-৬৫৪।
২. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী (অনূদিত) ‘এ্যারিস্টটলের কাব্যতত্ত্ব’, গ্লোব লাইব্রেরী প্রা. লিমিটেড, ঢাকা, তৃতীয় মুদ্রণ সেপ্টেম্বর ২০০০, একবিংশ পরিচ্ছেদ, পৃষ্ঠা-৫৯।
৩. সুনীলকুমার মুখোপাধ্যায় (অনূদিত), ‘লঙ্গিনুসের সাহিত্যতত্ত্ব’, পড়ুয়া, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৭, পৃষ্ঠা ২০-২৪।
৪. বদিউর রহমান (অনূদিত), ‘হোরেসের কাব্যতত্ত্ব’, বইপত্র, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০০৩, পৃষ্ঠা-৩৪।
৫. অতুলচন্দ্র গুপ্ত, ‘কাব্যজিজ্ঞাসা’, কালিগঙ্গা পাবলিশার্স, ঢাকা, জুন ১৯৬৯, পৃষ্ঠা-১৯।
৬. তদেব, পৃষ্ঠা-১৪।
৭. 33 Quotes By On Poetry: htttp://www. writerswrite.com.za
৮. Dr. S. Sen, William Wordworth Selected Poems, Friends’ Book Corner, Dhaka, New Enlerge Edition 2008, page 12.
৯. শ্রীশচন্দ্র দাস, কবিতা, ‘সাহিত্য সন্দর্শন’, সুচয়নী পাবলিশার্স, ঢাকা, নতুন সংশোধিত সংস্করণ, জুলাই ২০১৪, পৃষ্ঠা-৩৩।
১০. 33 Quotes By On Poetry: htttp://www. writerswrite.com.za
১১. মাইকেল মধুসূদন দত্ত, কবি, চতুর্দশপদী কবিতাবলী, ‘মধুসূদন-দীনবন্ধু রচনাবলী’, তুলি- কলম প্রকাশনী কলকাতা, মে, ১৯৮৭, পৃষ্ঠা ১৬২।
১২. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সংগীত ও কবিতা, ‘সমালোচনা’, রবীন্দ্র-রচনাবলী পঞ্চদশ খণ্ড, ঐতিহ্য, ঢাকা, তৃতীয় সংস্করণ, মার্চ-২০০৬, পৃষ্ঠা ৮০—৮১।
১৩. তদেব, পৃষ্ঠা ৪৬৫।
১৪. প্রমথ চৌধুরী, জয়দেব, ‘প্রবন্ধসংগ্রহ’, সুচয়নী পাবলিশার্স, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০১২, পৃষ্ঠা ১৯—২১।
১৫. জীবনানন্দ দাশ, মাত্রাচেতনা, ‘প্রবন্ধসমগ্র’ (দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত), গতিধারা, ঢাকা, ২০০০, পৃষ্ঠা-৩৬।
১৬. অমিয় চক্রবর্তী, কাব্যের টেকনিক, ‘সাম্প্রতিক’, নাভানা কলকাতা, বৈশাখ ১৩৬৭, পৃষ্ঠা ১৮ ও ১৯।
১৭. তদেব, পৃষ্ঠা ১৫৫।
১৮. সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, কাব্যের মুক্তি, ‘স্বগত’, ভারতী ভবন, কলিকাতা, প্রথম সংস্করণ ১৩৪৫, পৃষ্ঠা-২৫ ও ২৮।
১৯. আবু সয়ীদ আইয়ুব, ভূমিকা: আধুনিক বাংলা কবিতা, ‘পথের শেষ কোথায়’, দে’জ কলকাতা, দ্বিতীয় সংস্করণ, জুন ১৯৮০, পৃষ্ঠা-৮২।
২০. আবু সয়ীদ আইয়ুব, কবিতার ভাষা, ‘আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ’, দে’জ দ্বিতীয় সংস্করণ, মার্চ ১৯৭১, পৃষ্ঠা-১৯৬।
২১. বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশ-এর স্মরণে, ‘কালের পুতুল’, নিউ এজ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, নিউ এজ সংস্করণ, জানুয়ারি, ১৯৫৯, পৃষ্ঠা-৫২।
২২. বুদ্ধদেব বসু, বাংলা ছন্দ, ‘সাহিত্যচর্চা’, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, তৃতীয় সংস্করণ ১৯৯৬, পৃষ্ঠা-৬৭।
২৩. বিষ্ণু দে, হালকা কবিতা, ‘রুচি ও প্রগতি’, (প্রকাশনা ও তারিখ অজ্ঞাত-পৃষ্ঠা ছেঁড়া) পৃষ্ঠা-৯০।
২৪. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, বিষ্ণু দে: নব জগতের নির্মাণে, ‘আধুনিক বাংলা কবিতা প্রাসঙ্গিকতা ও পরিপ্রেক্ষিত’, প্রতীতি প্রকাশন, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০০০, পৃষ্ঠা-১২০।
২৫. বিষ্ণু দে, গদ্য কবিতা, ‘রুচি ও প্রগতি’, ঈগল পাবলিশার্স, কলকাতা, (প্রকাশনা ও তারিখ অজ্ঞাত-পৃষ্ঠা ছেঁড়া), পৃষ্ঠা-৯৫।
২৬. সৈয়দ আলী আহসান, আধুনিক বাংলা কবিতা: ভূমিকা, ‘আধুনিক বাংলা কবিতা: শব্দের অনুষঙ্গে’, শিল্পতরু প্রকাশনী ঢাকা, প্রকাশকাল ১৯৯৩, পৃষ্ঠা ৮, ১২ ও ১৩]
২৭. নীরন্দ্রেনাথ চক্রবর্তী, কবিতার দিকে, ‘কবিতার দিকে ও অন্যান্য রচনা’, পুনশ্চ কলকাতা, অক্টোবর ১৯৯২, পৃষ্ঠা-১৭ ও ২০।
২৮. হাসান হাফিজুর রহমান, সাম্প্রতিক কবিতা: কতিপয় প্রবণতা ও সঙ্কট, ‘আধুনিক কবি ও কবিতা’, সময় প্রকাশন ঢাকা, আগস্ট ২০০০, পৃষ্ঠা-৩৭।
২৯. সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, “সুন্দর: শঙ্খ ঘোষ”, ‘কবিতার জন্ম ও অন্যান্য’, প্যাপিরাস কলকাতা, দ্বিতীয় সংস্করণ সেপ্টেম্বর ১৯৯১, পৃষ্ঠা-১৯।
৩০. আবু হেনা মোস্তফা কামাল, বাংলাদেশের কবিতা: দুই, ‘কথা ও কবিতা’, মুক্তধারা ঢাকা, প্রথম প্রকাশ মার্চ ১৯৮১, পৃষ্ঠা-১৩৮ ও ১৪০।
৩১. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, আধুনিক কবিতা: প্রাসঙ্গিকতা ও পরিপ্রেক্ষিত, আধুনিক বাংলা কবিতা: প্রসঙ্গিকতা ও পরিপ্রেক্ষিত, প্রতীতি প্রকাশন, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০০০, পৃষ্ঠা-৭—৮।
৩২. জহির হাসান, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে লিখা উৎপলের চিঠি, ‘বিম্ব যেটুকু দেখা যায়, উৎপলকুমার বসুর কবিতা লৌকিক মায়ার আঁতুরঘর ও গূঢ় সংকেতলিপি যত’, বৈভব ঢাকা, প্রথম বৈভব সংস্করণ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, পৃষ্ঠা-১১৩—১১৪।
৩৩. আবদুল মান্নান সৈয়দ, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, ‘বিবেচনা-পুনর্বিবেচনা’, বাংলা একাডেমী, জুন ১৯৯৪, পৃষ্ঠা-২৭।
৩৪. হুমায়ুন আজাদ, কবিতা কি ও কেনো, ‘শিল্পকলার বিমানবিকীকরণ ও অন্যান্য প্রবন্ধ’, ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড ঢাকা, প্রথম প্রকাশ ১৯৮৮, পৃষ্ঠা-৬২।