বিখণ্ডিত এই পৃথিবী, মানুষ ও চরাচরের আঘাতে উত্থিত মৃদুতম সচেতন অনুনয়ও এক এক সময় যেন থেমে যায়, একটি পৃথিবীর অন্ধকার ও স্তব্ধতায় একটি মোমের মত জ্বলে ওঠে হৃদয় এবং ধীরে ধীরে কবিতা জননের প্রতিভা ও আস্বাদ পাওয়া যায়। (জীবনানন্দ দাশ)
কেউ বলেন কিছুই হচ্ছে না, কেউ বলেন বন্ধ্যা সময় অতিক্রম করে চলেছি আমরা। কেউ ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিষয়ে নিশ্চিত করে না বলতে পারলেও কবিতা যে হচ্ছে না সে বিষয়ে স্থির নিশ্চয়তা দিচ্ছেন। আশার সমাধিতে বসে কেউ আবার আগামী দিনের স্বপ্ন-দুঃস্বপ্ন দেখেন। কিন্তু বাংলা কবিতার বহু বিস্তৃত ও বিশ্ববিশ্রুত বেলাভূমিতে দাঁড়িয়ে কেন এই দীর্ঘশ্বাস? শবরপা’র এই দেশে সহস্রাধিক বছরের সাহিত্য সাধনায় বিশ্বজয়ের একমাত্র শিরোপাটা যেখানে কবিতাতেই কৃত হয়েছে, বাংলা সাহিত্যের সবচাইতে শক্তিশালী সেই কবিতা বিষয়ে বোদ্ধা-পাঠকদের এহেন মূল্যায়ন, অধিকাংশ পাঠকের কবিতা পাঠ থেকে বিরত থাকা কিংবা বিব্রত থাকা, সত্যিই কি সাহিত্যের জন্যে দুঃসংবাদ নয়? কিন্তু কেন? কই, সাহিত্যের শাখা; নাটক, উপন্যাস, এমনকী কনিষ্ঠ সন্তান, প্রাতিষ্ঠানিক আধুনিকতার পরেই যার জন্ম, সেই ছোটগল্প সম্পর্কেও তো এমন একোদরী কথাবার্তা কেউ বলেন না। তাহলে ? তাহলে কি বঙ্গমায়ের চিরউর্বর কাব্য উদরে এই কবিতাবন্ধ্যাত্বের অনুযোগকে সত্য বলে মেনে নেব? না কি চিলের পেছনে না দৌড়ে একটু কানে হাত দিয়ে দেখার চেষ্টা করব? দ্বিতীয় সত্যের পেছনেই আমার আজকের অভিযাত্রা। সঙ্গে বিজ্ঞ পাঠক সম্প্রদায়।
এক.
দার্শনিক প্লেটো তাঁর রাজ্য থেকে কবিদের বিতাড়িত করতে চাইলেও তাঁর শিষ্য এরিস্টটলের হাতেই কবি ও কবিতার আবাসন তৈরির চাবি দিয়ে যান। সর্বগুরু এরিস্টটল সব ধরনের শিল্পকেই বলেন, জীবনের অনুকরণ। একমাত্র অনুকরণ সামর্থ্য জীব সবকিছুকেই অনুকরণ করতে চায়। এই অনুকরণ স্পৃহা থেকেই কবিতার জন্ম। কিন্তু কথাটির দ্বারা কবিতার কিঞ্চিদ্দৃশ্য চেহারাও ফুটে ওঠে না। এছাড়া গ্রিক সংস্কৃতির স্বর্ণযুগে কেবল কবিতা নয়, সাহিত্যের অন্যান্য শাখাও রূপায়িত হতো কাব্যিকতায়।
কবিতা কোনো সর্প কিংবা সিংহ নয়, যে পূর্বশ্রুত কোনো ধারণা থেকে মনের ভেতর একটা মূর্তি এঁকে রাখা যায় এবং বনের ভেতর মুহূর্তের দেখা কোনো বিশেষ জন্তুটাকেই নির্দেশ করে বলা যায়, এই সেই কালনাগ; ওই তো অরণ্যরাজ! আবার সাত অন্ধের হাতি দেখাও নয় যে, কেউ বলবে সাপের মতো, কেউ বলবে কুলার মতো, কিংবা কেউ কাছ থেকে হেঁটে যাওয়া হাতির কানের বাতাস খেয়ে বলবে, ঝড়ের মতো একটা ব্যাপার! বস্তুত, কবিতার চেহারা নির্ণয়ের পথ সন্দেহাতীতভাবেই দুর্গমতর বিষয়। তবু সে পথ অদ্যাবধি বহু পথিকের বিচিত্র কথকতায় গুঞ্জরিত। এবং তা অন্ধের হাতি দেখার মতো উদ্ভট অনুমাননির্ভর কিংবা ন্যাড়ার সিঁথি কাটবার শখের ন্যায় সাধ্যাতীত না হলেও চক্ষুষ্মানের চিত্ত-বৈচিত্রিক বিবরণের ঊর্ণাজালে সংজ্ঞাতীত হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রায়। কেননা, অভিন্ন না হওয়া সত্ত্বেও তাদের প্রায় সব সংজ্ঞাই কবিতা বিষয়ে সপ্রযুক্ত; কোনো না কোনোভাবে শিল্পস্বীকৃত। ওয়ার্ডসওয়ার্থ যখন বলেন, কবিতা হলো শক্তিশালী অনুভূতির স্বতঃস্ফূর্ত প্রবাহ, তখন কবিতার অনুভূতিগত দিকটি অনুভব্য হয়ে ওঠে। আবার, অপরিহার্য শব্দের অবশ্যাম্ভাবী বাণী বিন্যাসকে কবিতা বলে। এরকম কোলরিজীয় কথায় আমরা বুঝতে পারি, কবিতা তৈরিতে শব্দের গুরুত্ব অলঙ্ঘনীয়। অতএব, কবিতায় থাকে তীব্র ও সূক্ষ্ম অনুভূতি, যার প্রকাশ ঘটে অপরিহার্য শব্দের অবশ্যাম্ভাবী বিন্যাস দ্বারা। শব্দের এই অবশ্যাম্ভাবী বিন্যাস অর্থাৎ শব্দ ব্যবহারের যে বিশেষ গুণপনা তা-ই কবিতার শরীরে নতুন দ্যোতনার জন্ম দেয়। এই দ্যোতনা ভাষার দ্যোতনা, ভাবের দ্যোতনা। এবং এই দ্যোতনা বা ব্যঞ্জনাই কবিতার প্রাণ। কবির শ্রেষ্ঠতম কর্মই হলো কবিতার শরীরে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা।
কবিতার শরীরে প্রাণ প্রতিষ্ঠায় কবির ভূমিকাই প্রধান। যাকে বলা যায় কবির আমিসত্তা। কবি একজন দ্রষ্টা। জীবন ও জগৎ এবং অন্য যেকোনো বিষয় সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গিগত স্বাতন্ত্র্য ও অভিনবত্বই তাঁর আমিত্বকে অস্তিমান করে তোলে। অস্তিমান আমিত্বের প্ররোচণায় যে বক্তব্য বা প্রতিবেদন উপস্থাপিত হয় তা-ই বিষয়বস্তু।
একটি ক্ষুদ্র পিপীলিকা কিংবা প্রায় অদৃশ্য কোনো ধূলিকণা থেকে মহাবিশ্বের নক্ষত্ররাজিও কবিতার বিষয় হতে পারে। অর্থাৎ বৈষয়িক উদারতায় উঁচু-নিচু জাত্যাভিমানের বালাই নেই কবিতার। (অবশ্য বিশশতকপূর্ব বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে কথাটি এতটা অনায়াসপ্রযোজ্য নয়।) কবি নামক গৃহস্থের তাই সব গৃহেই চলে অনায়াস আনাগোনা। কবি এদিক থেকে সর্বজনীন এক মানুষ।
কিন্তু কবিতার উৎস যেহেতু কবির হৃদয় সেহেতু কবির ব্যক্তিক অনুভূতিই কবিতায় প্রাধান্য পায়। এই ব্যক্তিক অনুভূতি অর্থাৎ আমিত্বের আরম্ভ হিসেবে অনেকেই ১৮৫৭ সালে প্রকাশিত বোদলেয়ারের লে ফ্লুর দ্য মাল’কেই চিহ্নিত করেন। এবং এটাকেই মনে করেন বিশ্বকবিতায় আধুনিকতার আবাহনী সুর। একথা অস্বীকার করবার নয় যে উক্ত গ্রন্থে আমিসত্তার এক অনিরুদ্ধ অবস্থিতি ছিল এবং বোদলেয়ারের আবির্ভাবের পর টোটাল বিশ্ব কবিতায় বেপরোয়া এক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। কিন্তু এর আগে কি আধুনিক সাহিত্য কিংবা ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদী সাহিত্য ছিল না? অন্তত সাহিত্য সম্রাট শেক্সপীয়রের সাহিত্যকর্মকে আমরা কোন যুক্তিতে অনাধুনিক কলব? আধুনিকতার যে দু’টি প্রধান লক্ষণ মানবিকতা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ, তার তো বিশেষ অভাব নেই লে ফ্লুর দ্যা মালর তিনশ বছর আগের ম্যাকবেথ কিংবা হ্যামলেটর মতো সাহিত্য স্মারকে। আর ১৮৫৭র পরও লে ফ্লুর দ্য মাল’র স্পর্শ না পাওয়া বাংলা কবিতা? সে কি কেবল ইউরোপ প্রভাবিত তিরিশের চেতনায়? মধূসূদন দত্তের ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’ কিংবা ‘মেঘনাদ বধ কাব্যে’ কি ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদিতা ছিল না? আসলে আধুনিক বিষয়টাই বিতর্কিত। পিচ্ছিল একটা ব্যাপার। নিয়তই এর রূপ বদল হতে পারে। আজ যাকে আধুনিক বলছি আগামীতে তা-ই হয়ে যাবে পুরাতন। কিন্তু সে কথা আমাদের আলোচ্য নয়, আমাদের চাই কবির আমিত্বপ্রসূত জীবন জিজ্ঞাসা।
কবির আমিত্বের যে অনুভূতি, তা অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও তীব্র। অনুভূতির তীব্রতাই কবিকে কল্পলোকের কানু বানিয়ে দেয়। কল্পনা সুন্দরী যার হৃদয়পদ্মে সাধের সিংহাসন পাতেন, অস্তগামী সূর্যরাগের ন্যায় যিনি সোনালি কিরণ দান করেন ভাবের সংসারে; অরণ্যের কুসুম যার ইচ্ছাবলে সুরভি বিলায়; মরুদ্যানের উৎসমুখ যার আশ্রয়ে ঝরনার ছলাৎছলে নেচে ওঠে; তিনিই কবি। কল্পনার এই অকল্পনীয় শক্তি যার আছে তিনিইতো বলতে পারেন,
আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ
চুনি উঠল রাঙা হয়ে।
আমি চোখ মেললুম আকাশে
জ্বলে উঠল আলো
পূবে মশ্চিমে।
গোলাপের দিকে চেয়ে বললুম, ‘সুন্দর’
সুন্দর হল সে।
কবির চেতনার রঙে উত্তীর্ণ এই অপরিসীম শক্তিকেই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, অলৌকিক আনন্দ। অলৌকিক আনন্দের বোঝাবাহক কবি তাঁর সত্তায় প্রকাশের বেদনা অনুভব করেন। এই বেদনা যত গভীর হয়, তীব্রতর হয়; প্রকাশ ততই উজ্জ্বল হয়, উপভোগ্য হয়। রবীন্দ্রনাথের ভাষাতেই বলতে হয়,
অলৌকিক আনন্দের ভার
বিধাতা যাহারে দেন, তার বক্ষে বেদনা অপার
তার নিত্য জাগরণ অগ্নিসম দেবতার দান
ঊর্ধ্ব শিখা জ্বালি চিত্তে অহোরাত্র দগ্ধ করে প্রাণ।
অহোরাত্র দগ্ধমান চিত্তের যে প্রকাশ তা ব্যক্তিক বলেই অভিনব। কিন্তু অভিনবত্বই অলঙ্ঘ্য উদ্দেশ্য নয় কবিতার। অদ্ভূত অভিনবত্ব আর উটের পিঠে পিচঢালা পথ, দুটোই অর্থহীন। অর্থাৎ কবির আমিত্ব অপরিহার্য হলেও আমিত্বের আত্মবিবরে অবগুণ্ঠিত থাকা ক্ষতিকর। এই অবগুণ্ঠমান আমিত্ব আত্মঅহমের সাহায্যে ইদমের তৃপ্তি ঘটাতে প্রাণান্ত প্রয়াসী হয়। ইদমের তৃপ্তি মানেই অহমের তৃপ্তি।। ইদম মানুষের মূর্তিমান কামনা-বাসনার নগ্ন প্রতিচ্ছবি। নিজের পরিতৃপ্তিতে নৈতিকতার বিসর্জন দ্যায় সে। জ্ঞানের গুহাচারী হয়। আত্ম অনুমোদনই তার একমাত্র সনদ হয়ে দাঁড়ায়। অর্থাৎ আধুনিকতার অগ্রগমণ নয়, প্রকৃতপক্ষে আদিমতার অশ্লীলজীবনে পশ্চাদপসারণ করে সে। এটাই ব্যক্তিক আমিত্বের চিত্তবিকার। ব্যক্তিক চিত্তবিকার কখনই কবির অনুভূতিকে নৈব্যক্তিক রূপ দিতে পারে না। অর্থাৎ জীবনে জীবন যোগ করতে সে অক্ষম। ফলে গানের পসরা সাজানো তার ব্যর্থ পণ্যে পরিণত হয়। কবিতা হয় গজদন্তমিনারবাসী কবির আত্মমৈথুনমাত্র। মিনারবাসী হওয়ার পেছনে আত্মমৈথুনতার পথে আরও একটা বিষয়ের সহজাত ভূমিকা আছে। সে হলো স্মৃতি। স্মৃতি দু’ধরনের হতে পারে। নিয়ন্ত্রিত স্মৃতি ও অনিয়ন্ত্রিত স্মৃতি। একটি চেতনাপ্রসূত, অন্যটি অবচেতন মনের। দ্বিতীয়টিকে আবার সুরেন্দ্রনাথ দাশ কথিত প্রমুষ্টতত্ত্বাক স্মৃতিও বলা যায়। প্রমুষ্টতত্ত্বাক স্মৃতি বলতে সেই স্মৃতিকে বুঝায় যেখানে স্মরণ আছে অথচ কী স্মরণ হলো তার বোধ নেই। ধরুন, বিকেলের এই উদোম হাওয়ায় ওঘরের ছাদে বসা ওই মেয়েটাকে দেখে আমার মনে পড়ছে কবেকার দেখা কোনো এক এলাচুলের কিশোরীর কথা। আর একটা অব্যক্ত অনুভূতি কেঁদে ফিরছে ভেতরে ভেতরে। একেই বলা যায় প্রমুষ্টতত্ত্বাক স্মৃতি। স্মৃতি কবির অভিজ্ঞতারই অংশ। এবং এ অর্থে প্রমুষ্টতত্ত্বাক স্মৃতি কবির অমূর্ত অভিজ্ঞতা।
স্মৃতি ছাড়াও কবির আমিসত্তার সম্পূর্ণীকরণে সাহায্য করে আর একটা উপাদান। কবির তুমি সত্তা। কবিতার তুমি সত্তা। এই তুমি কবির প্রিয়জন বা প্রেমিকা, কল্পিত কোনো ঈশ্বর বা অলৌকিক সত্তা, স্বদেশ কিংবা অন্য যেকোনো কিছুই হতে পারে। কবির আমিসত্তার আকাক্সক্ষা পূরণে এই তুমি কখনও প্রেম চেতনায়, কখনও সৌন্দর্য সাধনায়, কখনওবা আত্মসমর্পণে কাজ করে। কবি যখন বলেন, আমার পরাণ যাহা চায় তুমি তাই তখন আমরা বুঝতে পারি, এই স্বীকৃতি কোনো প্রেমিক/প্রেমিকার উদ্দেশ্যে। কিন্তু যখন বলেন, আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণ ধূলার তলে। সকল অহঙ্কার হে আমার ডুবাও চোখের জলে। তখন স্পষ্টতই তা হয়ে ওঠে কোনো অলৌকিক সত্তার কাছে আত্মসমর্পণ। আবার যখন শুনি আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি তখন একই তুমি হয়ে ওঠে স্বদেশভূমি। কবিতার এই তুমি সত্তা কবিতাকে দ্বিমাত্রিকতা দান করে। কবির চেতনার রঙে রঞ্জিত এই তুমি আসলে কবির আমিরই একটা অংশ। এই তুমি সত্তা স্থান-কাল-পাত্র ভেদে এত বেশি পরিবর্তনশীল যে কবি নিজেও এর চলন সম্পর্কে অনবহিত থাকেন না অনেক সময়। যেমন, প্রেমিক তার প্রেমিকার উদ্দেশ্যে কিংবা প্রেমিকা তার প্রেমিকের উদ্দেশ্যে বলছে, তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা/ তুমি আমার সাধের সাধনা/ আমি আপন মনের মাধুরী মিশায়ে তোমারে করেছি রচনা, তুমি আমারই। এই কথাটাই অপর একজন বলতে পারে যাকে সে স্রষ্টা ভাবে সেই অলৌকিক সত্তাকে উদ্দেশ্য করে। এতে তুমি সত্তার অপলাপ হয় না, বরং একই তুমি দিয়ে ভালোবাসা ও পূজা দুটোই সাধিত হয়।
আগেই বলেছি কবি সর্বজনীন মানুষ। অতএব, জীবনের সমগ্রতায় তিনি বিশ্বাসী। আমি’র নার্সিসিজমে নিমর্জিত না থেকে জীবনের একটা অখ- আবেগে তিনি উৎসাহী হয়ে ওঠেন। নিজের আবেগ অনুভূতিকে অন্যের হৃদয়ে অনুগমণ করিয়ে দেন। এভাবেই কবির ব্যক্তিক অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা যখন অধিকাংশের অনুভূতি ও অভিজ্ঞতার সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায় তখনই তা হয়ে ওঠে শ্রেষ্ঠ কবিতা। অর্থাৎ কবিতার উৎস যেহেতু কবির হৃদয় সেহেতু কবিতাকে অবশ্যই পাঠকের হৃদয়ে স্থান করে নিতে হবে। না হলে আপনার মুদ্রাদোষে আলাদা হতে থাকা কবির পক্ষে আত্মবিবরে হাবুডুবু খাওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না। আত্ম অনুভবকে অপরের হৃদয়ে স্থান করিয়ে নেওয়াই কবিতার জীবন সম্পৃক্তি। জীবন সম্পৃক্তি কবিতার অন্যতম গুণ হলেও এ বিষয়েও আছে আসক্তির সীমাবদ্ধতা। সমাজ ও জীবন, জীবনের জটিলতা, অসীম সমস্যাখচিত পৃথিবীর খণ্ডিত ও অখণ্ডিত সৌন্দর্যবোধসহ সব জৈবিক বিষয়ই কবিতায় থাকতে পারে। কিন্তু এমনভাবে থাকবে না, যা তার কাব্যিক মূল্যবোধকে কমিয়ে দ্যায়। অর্থাৎ অন্য কোনো রচনায় যা পাওয়া যায় (লোকশিক্ষা বিষয়ক প্রবন্ধ/ কথিকা ইত্যাদি) তা-ই কবিতায় স্থিত হলে প্রকৃত প্রস্তাবে তা আর কবিতা থাকে না কবিতার আকারে হয়ে ওঠে কথিকা (গদ্য কিংবা পদ্য) কিংবা কথিকার চেয়ে মডার্ন কোনো মতবাদী পদ্যমাত্র। কাজেই চিন্তা ও সিদ্ধান্ত, প্রশ্ন ও মতবাদ প্রকৃত কবিতার ভিতর সুন্দরীর কটাক্ষের পিছনে শিরা উপশিরা ও বক্তের কণিকার মতো লুকিয়ে থাকে যেন। (জীবনানন্দ দাশ)। হ্যাঁ, লুকিয়ে থাকে কিন্তু নিবিষ্ট পাঠকের পক্ষে তা উদ্ধার করতে অসুবিধা হয় না খুব একটা। এবং এই উদ্ধারের পথ পরিক্রমায় পাঠক কবিতা থেকে অভূতপুর্ব আনন্দ আস্বাদন করে (বেদনাও হতে পারে)। এর জন্যে প্রয়োজন কবির আবেগ ও আসক্তির সংযমবোধ। অর্থাৎ যে আবেগ থেকে কবিতার জন্ম তা যেমন ব্যাক্তিবিবরে নিমজ্জিত হবে না, তেমনি সার্বিক জীবনের কথা বলতে গিয়ে সেই জীবনের সংযমহীন স্বেচ্ছাসেবকও হবে না। এ প্রসঙ্গে বাংলা সাহিত্যের সবচাইতে অসংযমী কবি নজরুলের নাম করা যেতে পারে। যুগের জটিলতায় মানবিকতার মহান আবেগ বুকে নিয় বাংলা কবিতায় যে অদৃষ্টপূর্বতার সুর তিনি বাজালেন তার আস্বাদনে অগণিত পাঠক পতঙ্গের মতো আত্মদান করতে এলো কবিতার আগুনে, মানবিকতার মহাআগুনে। এবং সময়ের প্রেক্ষাপটে তার প্রয়োজনও ছিল। কিন্তু প্রখর প্রতিভা ও সূক্ষ্মতর অনুভূতি সত্ত্বেও বিশুদ্ধ শিল্পচর্চা খুব একটা হয়ে উঠল না তাঁর পক্ষে। অবশ্য সময়ের অসহিষ্ণু সন্তান নজরুলের কবিতা তাঁর সময়ের অনিবার্য দাবি পূরণ করেও সময়োত্তীর্ণ হয়েছে একথা অস্বীকার করবার নয়।
এখানে এসে যায় কবিতার সময় প্রসঙ্গ। আসলে সব শিল্পীই সময়ের সর্পিল সাহচর্যে তার জীবনকে সাজান। সাজাতে হয়। কাল তাঁকে ছাড়ে না। এবং সত্যিকারের শিল্পী কখনই তাঁর কালকে অস্বীকার করতে পারেন না। তাই কবিতার ভেতর দিয়ে যে জীবন উঠে আসে তা শুধু জীবন নয়, জীবনের আকারে সময়কেও বন্দি রাখার দলিল। এবং কবির যে বিশ্বাস, যে দর্শন কবিতায় দৃশ্যায়িত হয়, তা তাঁর সময়ের সারাৎসার হিসেবেই বিবেচ্য। কবির বৈষয়িক বৈচিত্র্যকে অর্থবহ করে তোলে কবির সময়। মহাবিশ্বের ইশারালোক থেকে উৎসারিত সময়চেতনা অপরিহার্য সত্যের মতো সঙ্গতি সাধন করে কবি ও কবিতা, এবং কবির জীবনবোধের মধ্যে। কবিতায় উৎসারিত সময়কে কবি যখন সাময়িক সময়ের দর্পণরূপে তুলে ধরেন এবং পাঠককে; যেকোনো সময়ের পাঠককে তার সময় ও সমাজ সম্পর্কে অবহিত করতে সমর্থ হন, তখন তা কালোত্তীর্ণ হয়ে ওঠে। এবং হয়ে উঠতে চায় মহাকালের সঙ্গে মহাজীবনের মিলনমঞ্চ। অতএব, সাময়িক সময় ও মহাসময়ের সুচারু রূপায়ণ প্রকৃত কবিতার শাশ্বত সত্তার অংশ।
সময় ও জীবনের দর্পণ হিসেবে কবিতা যে সত্তা বা সত্যকে প্রতিষ্ঠা করে বা করতে চায় তা কাব্যিক সত্য। কাব্যিক সত্য জীবনের সরাসরি রূপায়ণ নয়। অর্থাৎ ঘটে যা তা সব সত্য নয় কবির মনোভূমি যা প্রকাশ করে তা রামচন্দ্রের জন্মস্থান অযোদ্ধা নাম ঐতিহাসিক সত্যের সঙ্গে নাও মিলতে পারে। মিলতে হবে এরকম কোনো কথাও নেই; কবি যা লেখেন সেটাই বড় হয়ে ওঠে। সত্য হয়ে ওঠে।
কবিতা ও জীবন এক হয়েও, এখানেই হয়ে যায় আলাদা। জীবনের অসংলগ্নতা ও অপূর্ণতা কবির সৃজনীকল্পনার সাহায্যে পূর্ণতা পায় কবিতা শরীরে। ফলে সাধারণ জীবন থেকে স্বতন্ত্র, এক নতুন জীবন গড়ে ওঠে কবিতার রাজ্যে। এ প্রসঙ্গে জীবনানন্দ দাশের উক্তিই প্রণিধানযোগ্য হয়ে ওঠে, পৃথিবীর সমস্ত জল ছেড়ে দিয়ে যদি এক নতুন জলের কল্পনা করা যায় কিংবা পৃথিবীর সমস্ত দীপ ছেড়ে দিয়ে যদি এক নতুন প্রদীপের কল্পনা করা যায় তাহলে পৃথিবীর এই দিন রাত্রি মানুষ ও তার আকাক্সক্ষা এবং সৃষ্টির সমস্ত ধুলো কঙ্কাল সমস্ত নক্ষত্র ছেড়ে দিয়ে এক নতুন ব্যবহারের কল্পনা করা যেতে পারে যা কাব্য; অথচ জীবনের সঙ্গে যার গোপনীয় সুড়ঙ্গলালিত সম্পূর্ণ সম্বন্ধ : সম্বন্ধের ধূসরতা ও নূতনতা। (কবিতার কথা)
আসলে কবিতার পাঠ হচ্ছে এক স্বতন্ত্র রসাস্বাদন। জীবনের জটিলতা যেখানে এক শিল্পিত সৌন্দর্য লাভ করেছে। এ রকমভাবেও বলা যা, জীবন এক জটিল শহর, এর মধ্যে কবিতা মানুষ নির্মিত লেক; খোলা হাওয়ার জন্যে কি একটা বিকেল বেলার বিশ্রামের জন্যে মানুষ এখানে আসবেই’। (আব্দুল মান্নান সৈয়দ/ করতলে মহাদেশ)। কবিতা এক প্রকারের আনন্দ। না, আনন্দ নয় শুধু; আনন্দ ও বেদনার যৌথিক উৎসারণ। উৎসারিত সৌন্দর্য। শহরের লেক যেমন শহরের মানুষেরই বিকেল বেলাকার বিশ্রাম স্থান, কবিতাও তেমনি বিশেষ শ্রেণীর পাঠকের জন্যে, যারা প্রকৃত কবির উপলব্ধিকে অন্তরে ধারণ করতে পারেন বা পারার চেষ্টা করেন। কবিতা উপলব্ধির জিনিস। কবিতার ক্ষেত্রে সবাই তাই পাঠক নয়, কেউ কেউ পাঠক। এবং একথা প্রমাণিত যে, প্রকৃত কবিতার পাঠক সংখ্যা সীমিত। কারণ প্রকৃত কবিতা; যা মহৎমানে উত্তীর্ণ, তা আস্বাদনের জন্যে পাঠককে তৈরি হতে হয়। এবং পরিশীলিত পাঠক ও কবি একই অনুভবে অথবা ভিন্ন অনুভবে অভিন্ন প্রণয়োপলব্ধিতে আনন্দাভিভূত কিংবা বিরহযূথে বেদনাহত হন। অবশ্য পাঠকপ্রিয় নয় এমন সব কবিতাই যেমন মানোত্তীর্ণ নয়, তেমনি মানোত্তীর্ণ সব কবিতাই যে পাঠকহৃদয়ের ব্যাপক সমর্থন বঞ্চিত থাকবে একথা কিন্তু সত্য নয়। বৈষ্ণব পদাবলী থেকে শুরু করে মধুসূদন-রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-জীবনানন্দ-সুকান্ত-শামসুর প্রমুখ প্রকৃত কবির অনেক কবিতা রয়েছে যা একই সঙ্গে মানোত্তীর্ণ ও পাঠকপ্রিয়। অর্থাৎ পাঠকপ্রিয়তা কবিতার অবিসংবাদিত মানদণ্ড নয়, একথা যেমন সত্য, তেমনি একথাও সত্য পাঠকের প্রিয় হয়ে উঠবার বা পাঠকের কথা ভেবেই কবিতা লেখেন না কবি। কবিতা লেখেন নিতান্ত নিজের শৈল্পিক অনুভূতিকে প্রাধান্য দিয়ে। সুতরাং পাঠকের প্রিয় হয়ে ওঠা কবিতার জন্যে একটি প্রাপ্তি হলেও প্রধান প্রাপ্তি নয়; একমাত্র তো নয়ই।
দুই.
কবিতার অঙ্গগঠন অর্থাৎ শারীরিক দৃশ্যমানতা নির্ভর করে বেশ কয়েকটি অনুষঙ্গের ওপর। শব্দ-ভাষা-ছন্দ-সুর, চিত্রকল্প ও অন্যান্য অলঙ্কার কবিতার অনিবার্য অনুষঙ্গ। কবির উপলব্ধি এই অনুষঙ্গাদি দ্বারা শিল্পিত তথা নান্দনিক রূপ পায়। আনুষঙ্গিক সীমাবদ্ধতার মাঝেই কবি অসীমের সন্ধান করেন। শব্দের মাঝে শব্দাতীত, ভাষার মাঝে ভাষাতীত, অলঙ্কারের মাঝে অলঙ্কারাতীত কোনো দ্যোতনা বা ব্যঞ্জনা প্রণোদিত করে দেন। কবিতার সঙ্গে কবির সম্পর্ক ছায়া ও কায়ার মতো, জন্ম ও মৃত্যুর মতো সত্য। কবির ভেতরে ও বাইরে, চেতনে ও অবচেতনে যে প্রক্রিয়া নিয়ত সঞ্চরণশীল তার উপলব্ধির চৌকাঠে নির্মিত হয় কবিতার কাঠামো, যেখানে ঐন্দ্রজালিক সৌন্দর্য সাধনার মাধ্যমে কবি তার গন্তব্যে পৌঁছে যান।
কবিতার ক্ষেত্রে ভাষা আগে না শব্দ আগে এ বিতর্কে আমি শব্দকেই এগিয়ে রাখতে চাই। কেননা, আহরিত শব্দের সুবিন্যস্ত বিন্যাসেই নির্মিত হয় কবিতার ভাষা। এ অর্থে কবি শব্দনির্মাতা (শব্দপাপী নয়!)। এ নির্মাণ কবির অস্তিত্বগত আনন্দ-বেদনা ও অভিজ্ঞতার অবিমিশ্র অনুবাদ। এই অনুবাদ বিন্যস্ত হয় তাঁর প্রিয় ও প্রয়োজনীয় শব্দে। আনন্দের রঙ যেমন উজ্জ্বল (বেদনার রঙও উজ্জ্বল হতে পারে), তেমনি কবির আরাধ্য শব্দে কবিতার রঙও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। শব্দের শহর হাতড়ে কবি যখন তাঁর আরাধ্য শব্দের সন্ধান পান, তখন এক অনিন্দ্য শিহরণ অনুভূত হয় তাঁর কবিসত্তায়। এভাবে আহরিত শব্দসমূহের সঙ্গীতোপম স্বরলৈপিক বিন্যাসেই নান্দনিকতার পথে এগিয়ে যায় কবিতা। এক একটি শব্দবিন্যাস অর্থে-আঙ্গিকে, প্রকরণে-স্বীকরণে, উপমা-উৎপেক্ষায় অপূর্ব বুননের নৈপুণ্যে এক ঝলক খুশির মতো শিরা-উপশিরায় অনুরণিত হয়। এবং তা অর্থ উপলব্ধিতে যথার্থ পরিণতি পায় ।
কবিতা নির্মিতির নেপথ্যে শব্দ প্রতীক হিসেবে কাজ করে। অর্থাৎ শব্দের অর্থে শুধু অর্থ থাকে না, শব্দের প্রতীকে অন্য অর্থের ইঙ্গিত বহন করে। এটাই শব্দের ব্যঞ্জনার্থ। ব্যঞ্জনার্থের বিনির্মাণেই বিশেষ তাৎপর্যময় হয়ে ওঠে কবিতার ভাষা। বস্তুত, নির্বাচিত শব্দের নির্বিকল্প বিন্যাসই যথার্থ কাব্যভাষার জন্ম দেয়।
কবিতা একজন কবির আনন্দ-বেদনা প্রেম-অপ্রেমের ফসল, যেখানে অপরিসীম বেদনার বিষে কবি নীলকণ্ঠী। আবেগ, মেধা, শ্রম, প্রজ্ঞা এবং অভিজ্ঞতার সামগ্রিক উপলব্ধি ধারণ করতে তিনি প্রয়াসী। এই প্রয়াসের প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজন হয় ভাষার। এই ভাষা জীবনের ভাষা, মানুষের ভাষা হয়েও কবিতার ভাষা তাই কবির স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। কবির পরানের গহীন ভেতর থেকে উৎসারিত ভাষাই সু-আস্বাদনীয় কাব্যভাষা। কিন্তু ভাষাও যেহেতু প্রতীক তাই কবিতার ভাষা যা বলে, তার চেয়ে বেশি এবং স্বতন্ত্র কিছু ধরে নিতে হয়। এটাই ভাষার দ্যোতনা। এই দ্যোতনা বা ব্যঞ্জনাই কাব্যভাষাকে কিছুটা রহস্যময় ও ঐন্দ্রজালিক করে তোলে। বস্তুত, কবিতা এমন এক ধরণের সাহিত্যিক প্রতিবেদন যা পাঠকের সামনে সুনির্দিষ্ট বা অনির্দিষ্ট প্রস্তাবসমূহ উপস্থাপন, প্রতিস্থাপন বা পরা উপস্থাপন করে, যেগুলো মূল প্রস্তাব কিংবা বিপ্রতীপ প্রস্তাবও হতে পারে। যে কোনো সাহিত্যিক প্রতিবেদনই আসলে প্রস্তাবসমূহ, যাকে আমরা চিন্তাসূত্র নামে অভিহিত করতে পারি। চিন্তাসূত্র এমন একটি ধারণা বা প্রত্যয় যা ব্যক্ত, উচ্চারিত, ধ্বনিত বা অঙ্কিত অংশের সাথে অব্যক্ত, অনুচ্চারিত, অধ্বনিত বা অনঙ্কিত বক্তব্যগুচ্ছ পাঠ ও অনুধাবনের দাবি উপস্থাপন করে। (রহমান হেনরী/ কবিতা ভাবনা ভাষারীতি ও বিবিধ প্রসঙ্গ)। অর্থাৎ কবিতা মূলত সেই চিন্তাসূত্র যা ব্যক্ত ও ধ্বনিত প্রতিবেদনের চেয়ে বরং অব্যক্ত ও অধ্বনিত প্রতিবেদন পাঠেই পাঠককে প্রতিনিবিষ্ট করে। এবং নৈঃশব্দ ও নীরবতার পাঠ গ্রহণে অনুপ্রাণিত করে। কাজেই কবিতার মূল বক্তব্য উদ্ধার পাঠকের জন্যে আবশ্যিক নয়, উক্ত চিন্তাসূত্রটি উদ্ধার করে কবিতায় উৎসারিত কবির উপলব্ধ দর্শনকে আবিষ্কার করাই আসল কথা। অতএব, কবিতার ক্ষেত্রে প্রকাশিত ভাষার চেয়ে অপ্রকাশিত ভাষাই অনেকক্ষেত্রে শক্তিশালী।
কবিতার ভাষা গদ্য ও পদ্য উভয় রীতিতেই হতে পারে। এমনকি কথ্যরীতিতেও কোনো বারণ নেই। রবীন্দ্রনাথ বলেন, কাব্যের লক্ষ্য হৃদয় জয় করা- পদ্যের ঘোড়ায় চড়েই হোক, আর গদ্যে পা চালিয়েই হোক। (কাব্য ও ছন্দ/ সাহিত্যের স্বরূপ) হৃদয় জয়ের জন্যে প্রয়োজন যথার্থ কাব্যরস। কাব্যরসের ঘনত্বই কবিতার ভাবকে গভীর করে তোলে। এই ভাবের আবেগে ভাষায় এক প্রকার বিহ্বলতা জন্মে। ইহা সহজ সত্য, কাব্যে তাহার ব্যতিক্রম হইলে কাব্যের ব্যাঘাত হয়। (রবীন্দ্রানাথ/ কাব্য ; স্পষ্ট এবং অস্পষ্ট/ সাহিত্য) কিন্তু এই ভাবের গভীরতা অনেক সময় কাব্যকে আপত দুর্বোধ্যতার দিকে ঠেলে দেয়। অনেকেই অভিযোগ তোলেন অস্পষ্টতার। অথট অস্পষ্টতাও যে অনেক সময় অনিবার্য হয়ে পড়ে কবিতার জন্যে সে কথাটা তারা জানেন না। এই মুহূর্তে আমার মাথার উপরে যে সিলিং ফ্যানটা ঘুরছে, তাকে থামিয়ে দিয়ে একটা ছবি আঁকলে (বা তুললে) পাখাগুলোর অবয়ব স্পষ্ট হয়ে উঠবে। কিন্তু ঘূর্ণায়মান অবস্থাটাকেই যদি আঁকতে চাই তবে একটু অস্পষ্টতার আশ্রয় নিতে হবে। তিনটি ডানার ঘূর্ণিতে যে দৃশ্যের সৃষ্টি হচ্ছে, একটা অস্পষ্ট বা ধোঁয়াশার সাহায্যেই তা রূপায়িত করা সম্ভব। পাখার ওই আপাত অস্পষ্টতা এখানে একটা গতি সৌন্দর্যের ইঙ্গিত দিচ্ছে। বিদ্যাপতি যখন বলেন, ‘জনম অবধি হম রূপ নেহারনু, নয়ন ন তিরপিত ভেল/লাখ লাখ যুগ হিয়ে হিয়ে রাখনু তবু হিয়ে জুড়ন ন গেল।’ তখন শুধু অস্পষ্টই মনে হয় না, মনে হতে পারে অজ্ঞ কবির অসম্বন্ধ প্রলাপও। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলে এর অতলান্তিক সৌন্দর্যের সন্ধান পাওয়া যায়। অনুভব করা যায়, প্রেম এখানে ক্ষণকাল পেরিয়ে চিরকাল, সীমা পেরিয়ে অসীমের পানে যাত্রা করেছে। এবং এটাও অগম্য থাকে না যে, অন্য কোনও উপায়েই এমন আবেদন সৃষ্টিকারী সৌন্দর্য উদ্ভাবন সম্ভব ছিল না। অবশ্য আধুনিক সাহিত্য ডাডাইজম, সুররিয়্যালিজম, এক্সপ্রেশনিজম প্রভৃতি ইজমের প্রভাবে সচেতনভাবেই দুর্বোধ্যতর রূপ নিয়েছে। ভাষা বিষয়ে আপাতত শেষ কথা হলো ভাষা যেহেতু ভাবের বাহন, ভাব যেহেতু কবিতার প্রাণ, সেহেতু ভাষার ভাষিক বা বিভাষিক নৈপুণ্য কবিতার অন্যতম গুণ।
কবিতার ব্যাপারে ছন্দ অলঙ্কার ও অন্যান্য অনুষাঙ্গির কথা নতুন করে কী আর বলা! ছন্দ এক প্রকার গতিনান্দনিকতা। মিল, মাত্রা, পঙ্ক্তি ও চরণ বিন্যাস এই গতির পরিমাপকমাত্র। বলাবাহুল্য এই পরিমাপকের নির্দিষ্টতা দিয়ে কবিতাকে সব সময় মাপা যায় না। এবং এগুলো ছাড়াও কাব্যসৌন্দর্য গতিপ্রাপ্ত হতে পারে। জীবন যেখানে ছন্দহীন ; বেদনা বিহ্বলতায় ওষ্ঠাগতপ্রায়, সেখানে কবির ভিজ্ঞতা আট-ছয় আট-ছয় জাতীয় শৃঙ্খলায় আবদ্ধ থাকতে পারে না। তবু ছন্দের মধ্যে যে বেগ আছে সেই বেগের অভিঘাতে রসগর্ভ বাক্য সহজে হৃদয়ের ভেতরে প্রবেশ করে, মনকে দুলিয়ে তোলে, একথা স্বীকার করতে হবে। (রবীন্দ্রনাথ/ কাব্য ও ছন্দ)। বস্তুত, কবিতার শরীরে যে ধ্বনি তরঙ্গের সৃষ্টি হয় তার শ্রুতি সুন্দরতায় ছন্দের একটা বিশেষতম ভূমিকা আছে। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত কবি প্রতিভার একমাত্র অভিজ্ঞানপত্র বলতে ছন্দ স্বাচ্ছন্দ্যকেই নির্দেশ করেছিলেন। কেননা, কব্যিক মূল্য নির্ণয় যেহেতু মহাকালের অধীন, সেহেতু সমসাময়িক কাব্য জিজ্ঞাসার নির্বিকল্প মানদ- হিসেবে ছন্দবিচারকেই বড়ো করে দেখেছিলেন তিনি। সুতরাং যিনি কবিতা লিখবেন, ছন্দ তাকে জানতে হবে। ছন্দ জেনেই তাকে নতুন ছন্দ কিংবা প্রয়োজনে ছন্দহীনতার দিকে হাঁটতে হবে। যদিও এখনকার অধিকাংশ তরুণ কিংবা কতিপয় তরুণোত্তর কবির কাছে ছন্দ জানা অপেক্ষা ছন্দভাঙ্গা ; অথবা ছন্দ-টন্দর তোয়াক্কা না করে কবিতার নামে শব্দজট প্রকাশের বিষয়টাই বড় হয়ে উঠেছে বলে মনে হয়।
আর অলঙ্কার তো শব্দের সহধর্মিণী, যে কিনা উপমা অনুপ্রাসাদির দ্বারা ভাষার মধ্যে ব্যঞ্জনা বা রসসৃষ্টিতে সহযোগিতা করে। তাই বলে, কাব্যমগ্রাহ্যমলংকারাৎ সমর্থন যোগ্য নয়। কেননা, অলঙ্কার ছড়াই উৎকৃষ্ট কবিতা রচিত হতে পারে। যেমন পারে একটা নিরাভরণ নারীও সৌন্দর্যের প্রতিমূর্তি হতে। এবং অলঙ্কারও কখনও কখনও কবিতার সাথে কবির কিংবা কবিতার সাথে পাঠকের মিলনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
কবিতায় ব্যবহৃত শব্দ, ভাষা ও অলঙ্কারগুচ্ছ দ্বারা কবি পাঠকের মনে এক বা একাধিক চিত্র অঙ্কন করেন। যাকে আমরা চিত্রকল্প বলি। চিত্রের সঙ্গে কল্পনার মিশ্রণে তৃতীয় কোনো চিত্রময়তায় পৌঁছানোর মাধ্যমই চিত্রকল্প। কবির মনশ্চক্ষে ভেসে ওঠে বলে কবিতার সাথে রয়েছে এর আত্মিক সম্পর্ক। একটি স্তবক কিংবা পুরো কবিতাটাই একটি অখ- চিত্রের জন্ম দিতে পারে, আবার একটিমাত্র পঙক্তিই কখনওবা পারে সম্পূর্ণ একটি চিত্রকল্পের প্রতিনিধিত্ব করতে। লক্ষ্যভেদী চিত্রকল্প নির্মাণে এবং কাব্যের ব্যঞ্জনা সৃষ্টিতে আরও একটা বিষয়ের বিশেষ ভূমিকা আছে, তা হলো মিথ বা পূরাণ। মিথ মূলত অতীত জীবনবীক্ষারই আদিরূপ। আপাত অলৌকিক হলেও কবিতার শরীরে সে লৌকিকতার, বাস্তবতার প্রতীকায়ন করে। মিথের মাধ্যমে কবি পাঠককে পশ্চাদগামী করেন না কিংবা অলৌকিকতার ইন্দ্রজালে আচ্ছাদিত করেন না, বরং পিছনের বিষয়কে সামনে এনে বর্তমানকে বুঝতে সহযোগিতা করেন। প্রকৃত প্রস্তাবে কবিতা স্মৃতিতান্ত্রিক শিল্পও বটে। মিথ হচ্ছে সেই স্মৃতিবীক্ষার আকর, যার সম্বন্ধসূত্র মানবযাত্রার ইতিহাসে ও সাংস্কৃতিক বয়নক্রিয়ার ভেতরে নিহিত।
ছন্দভেদে কবিতার শরীরের পরিবর্তন হয়, একথা সকলেরই জানা, কিন্তু নাম বা বিষয়ভেদে এমনকি কবির ইচ্ছার তারতম্যের কারণেও কখনও কখনও কাটামোগত ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। ফ্রান্সের কবি গিওম এ্যাপোলিনেয়ার প্রথম মহাযুদ্ধের সৈনিক থাকাকালে পোস্টকার্ডে কিছু কবিতা লিখে পাঠিয়েছিলেন তাঁর বন্ধুদের কাছে। নকশা করা কবিতা। ১৯১৮ সালে প্রকাশিত তাঁর ক্যালিগ্রাম কাব্যে ঠোঁট, হৃদয়, মুকুট, চশমা প্রভৃতি বিচিত্র আঙ্গিকের কবিতা স্থান পায়। বাংলা কবিতায় এর দু’একটা নজির আছে বৈকি। এমনিতেই কবিতা শব্দ দিয়ে ছবি আঁকে। এবং কবিও যে কবিতা লিখতে লিখতে ছবি অঙ্কনের অনুপ্রেরণা পান, তার উদাহরণ শেষ জীবনের রবীন্দ্রনাথ।
তিন
কবিতার বিষয় কিংবা আঙ্গিক নিয়ে যতই আলোচনা কবি না কেন, কবিতাকে আলোকিত হতে হবে। পাঠককে নতুন ও আনন্দদায়ক কিংবা অনুভূতির অভিনবত্বের ছোঁয়া দিতে হবে। এরিস্টটল বলেছেন, সকল সুকুমার কলার ন্যায় কাব্যেরও উদ্দেশ্য ভাব-সমুত্থিত আনন্দ, বিশুদ্ধ এবং ঊর্ধ্বভূমির আনন্দ সৃষ্টি করা। এই আনন্দই কাব্যের সৌন্দর্য। সৌন্দর্য মানেই নান্দনিকতা। আমাদের জীবনের যাপিত বা যাপিত বৈচিত্রের ন্যায় চিন্তা-চেতনায়ও রয়েছে বিরাট বৈসাদৃশ্য। কবিমনের সূক্ষতর অনুভবে, বিশেষ পরিবেশে যে ভাবনার উদয় হয়, কতিপয় সাধারণ শব্দ সহযোগেই তা অপরের অন্তরে স্রোতায়িত না-ও হতে পারে। তাই অপরের মনের কাছে ব্যাখ্যানের বেলা শব্দ বা বাক্যের অর্থোপলব্ধির জন্য লক্ষণা, ব্যঞ্জনা, ধ্বনি, বাসনালোক, আবার অনুমান, কল্পনা কত প্রকার শক্তির আশ্রয় নিতে হয়ে। (ড. সুধীর কুমার দাশগুপ্ত/ কাব্যলোক)। এই শক্তির বিকাশে একজন কবির সহচর হয়ে ওঠে উপমা-উৎপ্রেক্ষা, চিত্রকল্প, শব্দ, ছন্দ এবং ইতিহাস-ঐতিহ্য ও পুরাণসহ কালচেতনার অপরাপর অনুষঙ্গসমূহ। এবং এই সমস্ত অনুষঙ্গসহযোগেই নির্মিত হয় কবিপ্রতিভার নন্দনতাত্ত্বিক কাব্যকাঠামো।
চার.
প্রবন্ধের শুরু করেছিলাম সাম্প্রতিক কবিতা সম্পর্কিত কটূক্তি দিয়ে। সেখান থেকেই শুরু করব পুনর্যাত্রা।
প্রতিরাতেই লিখিত হচ্ছে নতুন কবিতা, প্রাতেই নিত্য-নতুন কবিতা হাতে নিয়ে হাজির হচ্ছেন নতুন কবি। নতুনের কেউ কেউ মিডিয়ার আলো পেয়ে পৌঁছেও যাচ্ছেন পাঠক কিংবা পাঠকরূপী কবিতাচর্চাকারির কাছে। কেউ আবার নিজে নিজে কিংবা নিজেরই প্রতিরূপ অপর কবিযশঃপ্রার্থীর দ্বারা শংসিতও হচ্ছেন! হাজার বছরের নির্মাণ-পুননির্মাণের পথ ধরে বাংলা কবিতার আজকের এই মিশ্রাবস্থা কবিতার জন্য কতটুকু সুসংবাদ? না। তেমন কোনো সুসংসবাদ দিতে পারছেন না আমাদের কবিতার মানুষেরা। সত্যিকার অর্থেই গত কয়েক দশকে বাংলা কবিতা আমিত্বের আত্মরোমন্থনে রোমাঞ্চিত হতে চেয়েছে। কবি যা লিখছেন তা যেন শুধু কবিরই ব্যক্তিঅনুভূতির অলজ্জ মঞ্চায়ন। পাঠক সেখানে অসহায় দর্শক । এবং অসহায়ত্বের অসহ্য বোঝা বইতে না পেরে সরে গেছেন কবিতার পাঠ থেকে। প্রবীণ কবি ও কবিতাবোদ্ধা তো বটেই, অনেক নবীণোত্তর কবিও বর্তমান কবিতা নিয়ে ব্যক্ত করেছেন তীব্র ক্ষেদোক্তি। অযোগ্য নবীণের আগমনকে অভিসম্পাৎ করেছেন কেউ কেউ। কেউ আবার বিদ্রুপ করেছেন কবিতাকে রপ্তানি করার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী বরাবর। স্বাধীন বাংলাদেশে আবির্ভূত অন্যতম কবি ও কবিতার নিবিড় পাঠক আবু হাসান শাহরিয়ার তাঁর একটি কবিতায় অকবিদের উদ্দেশ্যেই লিখেছেন, ‘ নিসর্গকে ছুঁয়েছে কুয়াশা । বাতাস তাকায় ঘোর / ছানি পড়া চোখে । / দৃশ্যাবলী পলাতক। আপাদমস্তক কুয়াশা বিস্তার / আগাছার দিন ।/ বেপথুরা ঢুকে পড়ে কুয়াশা গহ্বরে । / খানাখন্দে নামে। / উল্লসিত হয়। / উল্লসিত হয়। উল্লসিত সমুদ্রমন্থনে। সমুদ্র কোথায় ! চোরাবালি। / অমোঘ পতন ।/ এখন দিন পতনে লীন। কুয়াশা ছানিচোখে ।’ [ বৃক্ষ নয় ভিখিরি আর কাঙাল নয় কবি / একলব্যের পুনরুত্থান ।] একই সময়ের আরেক কবি অসীম কুমার দাস তো ইন্ডিয়া, ইংল্যান্ড আমেরিকা সবখানেই কবিতার আকাল অনুভব করে বলেছেন, ‘গডের অস্তিত্ব সম্পর্কে আমি শিওর না, কিন্তু কবিতা যে হচ্ছেনা সে সম্পর্কে আমি শিওর।’ (চিহ্ন সাক্ষাৎকার )। অসীম সাহার কথাটা একটু বাড়াবাড়ি মনে হলেও গত কয়েক দশকে মিডিয়া আর মামাবাজদের দৌরাত্ম্যে অগণিত অকবির আবির্ভাব ঘটেছে বাংলাদেশে। আশির দশকের স্বৈরাচারী কাব্যসংস্কৃতিতে ক্ষিপ্ত হয়ে মোহাম্মদ রফিক লিখেছিলেন “খোলা কবিতা”….‘সব শালা কবি হবে ; পিঁপড়ে গোঁ ধরেছে উড়বেই। / বন থেকে দাঁতাল শুয়োর রাজাসনে বসবেই,’। লিখবেনইতো। যে দেশে পুরুষের পয়সা হলে পরিচিতি চায় [ মেয়েরা মূলত মার্কেটে যায়] ; পরিচিতির প্রয়োজনে প্রথমে সে সমাজের এখানে সেখানে নাক গলায়; হঠাৎ নেতা বনে গিয়ে নির্বাচনে দাঁড়ায়; গোপন গুহ্যপথে টাকা কামায় ; রিক্সার চালক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সকলেই যে দেশে মূল্যবোধ বেচে খায় [খান] ; পকেটে পয়সা আর মিডিয়ায় ঢুলিমামা থাকলে যে দেশে কবি কিংবা কালচারের যে কোনো রাজ্যেরই হিরো হওয়া যায় ; সাধুশূন্যপ্রায় সে দেশের কবিতা সম্পর্কে এহেন উক্তি অত্যুক্তি নয় মোটেও।
বাংলাদেশের গত দু-তিন দশকের কবিতাকে কয়েকটি প্রধান প্রবণতায় চিহ্নিত করার চেষ্টা করা যেতে পারে। যেমন-
ক. মুক্তিযৌদ্ধিক মূল্যবোধ ও মূল্যহীনতার চিত্র-প্রতিচিত্র ;
খ. রাজনৈতিক অরাজকতার কবিতায়ন চেষ্টা
গ. আত্মরোমান্থনপ্রিয়তা ও সমাজ বিচ্ছিন্নতার নেশা
ঘ. সমকালীন সামাজিক অসঙ্গতির ছবি
ঙ. ইতিহাস-ঐতিহ্য ও লোকচেতনার আলোকে ভবিষৎ চেতনা
চ. জৈবনিক জটিলতার অযুহাতে প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে ভাষা ও বাচন ভঙ্গিতে দুর্বোধ্যতা
আনয়ন
ছ. অধ্যাত্মতত্ত্বের নতুন কাব্যিক রূপায়ণ চেষ্টা ও বিজ্ঞান মনস্কতা
জ. শেষ দশকে এসেও ঈষৎ তিরিশি অনুকৃতি ও অনুকৃতি থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা
ঝ. উত্তর আধুনিকতা, পোস্ট-মর্ডানিজম, আধুনিকোত্তরবাদ ও অন্যান্য তাত্ত্বিক বাড়াবাড়ি
ঞ. শব্দ, ভাষা, ছন্দ এবং অন্যান্য আঙ্গিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা কিংবা নিরীক্ষার নামে কারও কারও নৈরাজ্যকর প্রচেষ্টা
সত্তর পরবর্তী সাহিত্য সাধনায় সর্ববিস্তারী কাঁচামাল হিসেবে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতিদ্বন্দ্বী নেই।
উনিশ শতকের প্রথমেই রঙ্গলাল লিখেছিলেন,‘স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে, কে বাঁচিতে চায় ?’ আর বিশ শতকের শেষার্ধের শামসুর রাহমান ঘোষণা করলেন, ‘পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে জ্বলন্ত / ঘোষণার প্রতিধ্বনি তুলে, / নতুন নিশান উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগি¦দিক / এই বাংলায় / তোমাকে আসতেই হবে, হে স্বাধীনতা।’[তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা / বন্দী শিবির থেকে] । বস্তুত, বাঙালির ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম এই ঘটনা স্বাধীনতা পরবর্তী সমাজ ও সাংস্কৃতিক জীবনে যে প্রভাব ফেলেছে তা বহুগ্রাসী। সাতচল্লিশের দ্বৈজাতিক স্পন্নভঙ্গের পর [ওই স্বপ্ন ছিলো একটা বিশেষ শ্রেণীর স্বার্থবাদিতা দ্বারা প্রোরোচিত] বায়ান্নতেই পুনর্যুদ্ধের প্রত্যক্ষতা। এরপর চুয়ান্ন, একষট্টি, ছেষট্টি ও উনসত্তর পেরিয়ে যুদ্ধই একমাত্র উদ্ধার নামক একাত্তরের সে মহা-ইতিহাস সবার জানা। অতএব,অনুল্লেখ্য। সমস্ত পাকিস্তান আমলে ক্ষণে ক্ষণে উথলে ওঠা এবং যুদ্ধের নয় মাস অবরুদ্ধ থাকা যে স্বদেশপ্রেমি শিল্প আবেগ তা একাত্তরের ষোলই ডিসেম্বর পরবর্তী সময়ে প্রচণ্ড বিজয়োল্লাসে পরিণত হয়। এই বিজয়ের মধ্যে ছিলো বেদনার রক্তরাগ। বেদনা মধুর হয়ে যাওয়া সেই দিনে পঞ্চাশের, ষাটের এবং সত্তরের দশকের কবিকুল যা লিখলেন তার অনেকটাই খাঁচা ছাড়া পাখির সীমাহীন উচ্ছ্বাস, যার মানসিক মূল্য অমূল্য হলেও শিল্পমূল্য অত্যল্প বলেই অনেকে মনে করেন। মধ্যসত্তর পর্যন্ত এই উচ্ছ্বাস ছিলো শাসনহীন এবং শ্লোগান নির্ভর। এসময় ‘মুক্তিযুদ্ধের বাহ্যিক রক্তক্ষরণ ও সন্ত্রাস অভিক্ষেপকেই বড়ো করে দেখলেন অধিকাংশ কবি। এর ভেতরকার চিরন্তনী সংগ্রামের দিক হলো উপেক্ষিত।… স্লোগানচারিতা ও সরাসরি রাজনৈতিক ভাষ্য ব্যতীত জনগণের কাছে পৌঁছানোর আর কোনো উপায় নেই ধরে নিয়ে অনেক যথার্থ ও গভীর কবি ধরলেন সস্তা গণ-কবিতার পথ।….কবিতার কারুকার্যময় দরোজা উপেক্ষা করে নেমে গেলেন গৌন কবিদের সমতলে।’ [বাংলাদেশের কবিতাঃঅন্তরঙ্গ অবলোকন /খোন্দকার আশরাফ হোসেন] । খোন্দকার আশরাফ হোসেনের এ মন্তব্যই সর্বৈব সত্য না হলেও প্রবীণ-নবীণ,প্রধান অপ্রধান প্রায় সকল কবিই যে তখন এ প্রবণতার শিকার হয়েছিলেন তা বলাই যায়।
অন্যদিকে মুক্তিযৌদ্ধিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের চিত্রও দুর্লক্ষ্য নয় এ সময়কার কবিতায়। পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে যখন ‘যুদ্ধ হত্যা লুণ্ঠনের উল্লাসের মুখে’ পুনরায় ‘জাতির পতাকাকে খামচে ধরেছে সেই পুরনো শকুন’ তখন পূর্ব উল্লসিত কবিমন অনেকটা স্তিমিত হয়ে গেলো নিরাপত্তার শঙ্কায়। এই আশংকা আশির দশকেও কার্যকর থাকলো। এরপর আবার অনুকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি হলে নব্বই দশকের শেষার্ধে মুক্তিযুদ্ধের মুল্যবোধের বিনির্মিতি সম্ভাবনায় উচ্চকিত হলেন অনেকেই। মূল্যবোধহীনতাও কম হলো না। তবু আজো আমাদের কবিতায় (সমগ্র বাংলাদেশি সাহিত্যেই ) মুক্তিযুদ্ধ একটা পরম কৌম্য বিষয়। বর্তমানের তরুণ কবিদের কারও কারও হাতে মুক্তিযৌদ্ধিক মূল্যবোধ অনেকটা সংযত ও সুষমিত।
রাজনৈতিক অরাজকতা বাংলাদেশের কাব্যাঙ্গনে একটা বহুচর্চিত বিষয়। পাকিস্তান আমলেই রাজনীতি আমাদের কবিতায় অনিবার্য অনুসঙ্গ হয়ে ওঠে। আর স্বাধীনতার উত্তর জীবনের নেতাদের ভণ্ডামি, আত্ম-প্রতারণা আর সত্যমূল্যের সার্বিক অবমুল্যায়ন ধ্বনিত হয়েছে শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী, আল মাহমুদ, রফিক আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ, মোহাম্মদ রফিক প্রমুখের কবিতায়। শামসুর রাহমান বললেন, কারুকে বিশ্বাস নেই বাস্তবিক।’ কেননা ‘এখন প্রতিটি ঘরে / মিথ্যা দিব্যি পা তুলে রয়েছে বসে; প্রহরে প্রহরে / পাল্টাচ্ছে জামা জুতো।’ আর সদ্য আবির্ভূত আবুল হাসান অবিংসবাদী উচ্চারণ করলেন, গোলাপ ফুটছে তাও রাজনীতি, গোলাপ ঝরছে তাও রাজনীতি! / মানুষ জন্মাচ্ছে তাও রাজনীতি, মানুষ মরছে তাও রাজনীতি! ( অসভ্য দর্শন / রাজা যায় রাজা আসে )। মূলত, ‘মধ্য সত্তরের পর থেকে সমকালীন রাজনীতিই হল বাংলা কবিতার প্রধান বিষয়।’ (একুশের প্রবন্ধ ৮৮ / মুহাম্মদ নুরুল হুদা) পুরো আশির দশক জুড়ে রাজনীতি ছিল কবিতার অনিবার্য অনুষঙ্গ। স্বৈরাচারী রাজার অরাজনৈতিকত নৈরাজ্য কবিতার শরীরে পুনরায় স্লোগান ধর্মিতার প্রতিস্থাপন করে। নূর হোসেন, শাহজাহান সিরাজের রক্তে রঙিন হয় কবিতার রাজপথ। নব্বই এর পরবর্তী পেটি গণতন্ত্র বাংলাদেশের কবিতাকে কিছুটা স্বস্তি দিলেও মানবিক মূল্যবোধের সত্যাচারী কবি কখনই নীতিহীন রাজনীতিকে বিনা বাক্যে মেনে নিতে পারেন না। রাজনীতি তাই আজও আমাদের কবিতাকে আলোকিত-অনালোকিত এমন সীমানায় পরিচালিত করে চলেছে নিয়তই।
আধুনিকতার নামে আমাদের কবিতায় যে ব্যক্তি আমি’র প্রবেশ ঘঠেছিল গত শতকের তৃতীয় দশকে; প্রায় গোটা শতক জুড়েই চলেছে তার জাঁকজমক প্রতিপত্তি। কবিতা ব্যক্তিক অনুভূতির প্রকাশ হিসেবে পথ চলতে গিয়ে আজও কবির আত্মরোমন্থন প্রবণতাকে সীমাহীন প্রশ্রয় দিয়ে চলেছে। কবি ও কবিতার আত্মবিনাশের পথে এটাও একটা পাথেয় হয়ে উঠতে পারে। গুন্টার গ্রাস হয়তো একেই বলেছিলেন ‘ক্ষয়িষ্ণু বাস্তবতা’। আবার রোমান্টিকতা পরিহারের নামে বুদ্ধদেব বসুরা এলিয়ট স্পেনসারদের কাছ থেকে যা আমাদানি করলেন অধিকাংশের কাছেই তা অসুস্থ অনুভূতিজাত মনে হলো। কবিতা শুধু কবিদেরই পাঠ্য হয়ে রইলো। স্বাধীনতা পরবর্তী কবিতা ব্যক্তিক আমিত্বের সীমা পার হলো ঠিকই কিন্তু শিল্পমানে হলো নাজুকতর। এবং সামরিক শাসনামালে তা আবার আত্মরোমন্থনে পরিণত হলো। আশির দশকের শেষের দিকে কতিপয় তরুণের হাতে কবিতার আমি’র নার্সিসিজম থেকে বের হতে শুরু করলো পুনরায়।
আমিত্বের স্বেচ্ছাচারিতা থেকেই জন্ম নেয় সমাজ বিচ্ছিন্নতা। কবি সমাজেরই মানুষ হয়েও ব্যক্তিবাদিতার কারণেই কখনো কখনো সমাজ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। স্বাধীন বাংলাদেদেশে সমাজবিচ্ছিন্নতার নিন্দনীয় সাহিত্য সাধনার রূপ মধ্য সত্তর থেকেই। এখনো অনেক নবীন-প্রবীণ কবিই তাদের ব্যক্তিসর্বস্বতা দ্বারা দ্বীপান্তরী হয়ে চলেছেন। না। সকলেই আমি’র নার্সিসিজমে আক্রান্ত হয়ে দ্বীপান্তরী হননি। সত্যিকারের শিল্পী তার সমাজ ও সময়কে কখনোই অস্বীকার করতে পারেন না।
আধুনিক কবিতার বৈচিত্র্যিক ব্যবহারে সমাজজীবন কখনো কখনো হোঁচট খেলেও বৃহত্তর শিল্পী সমাজই থাকতে চেয়েছেন সমাজমনস্ক। কেননা, সমাজের বাসিন্দা হিসেবে সমাজকে সম্পূর্ণ থোড়াই কেয়ার করা যেমন কোনো কাজের কথা নয়, তেমনি সম্ভবও নয়। স্ব-কাল ও স্ব-সমাজের প্রচল ও প্রতিষ্ঠিত চিত্র-প্রতিচিত্রসমূহ তুলে ধরার নিরলস ও নিরবিচ্ছিন্ন প্রচেষ্টায় লিপ্ত থাকাই তাই কবি কিংবা যেকোনো শিল্পীরই প্রধান দায়। সমাজের সমস্ত নেতিচিত্রের ভেতর দিয়েও সামাজিক অগ্রগতির ইতিবাচক দিকনির্দেশনার একটা বার্তা পাঠানো সমাজসচেতনতারই পরিচায়ক। ইতিহাস ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার নিয়ে অনুরূপ সামাজিক (রাজনৈতিকও বটে) দায়বদ্ধতা থেকেই স্বাধীন বাংলাদেশের কবিতায় আবির্ভূত হয়েছিল আহসান হাবীবের ‘বিদীর্ণ দর্পণে মুখ’, শামসুর রাহমানের ‘দুঃসময়ের মুখোমুখি’, ‘বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে’, ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’ প্রভৃতি ; আলমাহমুদের ‘সোনালী কাবিন’ ; ওমর আলীর ‘ এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি’, সৈয়দ শামসুল হকের ‘ পরানের গহিন ভেতর’; ‘মানুষ তোমার বিক্ষত দিন’ ; শহীদ কাদরীর ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’ ; সিকদার আমিনুল হকের ‘সতত ডানার মানুষ’; মোহাম্মদ রফিকের ‘ খোলা কবিতা’ ; রফিক আজাদের ‘হাতুিড়র নিচে জীবন’, ‘পরিকীর্ণ পানশালা আমার স্বদেশ’; মুহম্মদ নূরুল হূদার ‘আমরা তামাটে জাতি’ ; নির্মলেন্দু গুণের ‘চাষাভুষার কাব্য’, ‘দুঃখ করোনা বাঁচো’; আবুল হাসানের ‘যে তুমি হরণ করো’, ‘পৃথক পালঙ্ক’; হুমায়ুন আজাদের ‘সবকিছু নষ্টদের অধিকারে চলে যাবে’; রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ‘মানুষের মানচিত্র’; দাউদ হায়দারের ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’ ; অসীম কুমার দাসের ‘ঝঞ্ঝা ও পুনরুত্থান’ এবং আবু হাসান শাহরিয়ারের ‘একলব্যের পুনরুত্থান’ প্রভৃতি কাব্যগুলো।
এই সময়ের কবিতাচর্চাকারিদের অধিকাংশই ছোট-বড় সাহিত্যকাগজের সম্পাদক কিংবা সংকলক হয়ে দিব্যি কবি কবি জাবর কাটছেন আর নানারকমের ঢেকুর তুলছেন। ছন্দকে না জেনেই ছন্দহীন পঙ্ক্তি রচনার প্রয়াস চালাচ্ছেন ; উপমা-চিত্রকল্পের মতো অতি প্রয়োজনীয় উপাদানগুলোকে থোড়াই কেয়ার করছেন। অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও এলোমেলো শব্দবিন্যাসের মাধ্যমে অস্বচ্ছ বাকচাতুর্যকেই কবিতা বলে চালিয়ে দিচ্ছেন। যা কিছু পুরাতন, সবই বর্জনীয় ভেবে আজগুবি নতুনত্বের নামে কেউ কেউ শেকড়হীন হয়ে পড়ছেন। সবচাইতে বড় কথা, এঁদের নিজস্ব দলবদ্ধতা আছে, যার বাইরের কাউকে কবি হিসেবে মেনে নেওয়া তো দূরের কথা, সুযোগ পেলে একদল অন্যদলকে আচ্ছামতো শাসিয়ে দেন কাগজে-কলমে। আর হ্যাঁ, এরা নিজেদের পছন্দের কবিদলকে নিয়ে এক বা একাধিক দশকী সংকলন বের করে ফেলেছেন ইতোমধ্যে। এই একদশকেই যে কতো কবি আবির্ভূত এদেশে তার কোনো নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান নেই। পয়সা আর প্রযুক্তির সাহচর্যে এরা সকলেই কবি হওয়ার রেসে অবতীর্ণ আজ। কিন্তু দু-চারজন ছাড়া অধিকাংশেরই কবিতাই হয়তো কাব্যরসিক, এমনকি সাধারণ পাঠকের থালায় পরিবেশনের যোগ্য নয়।
প্রচলিত বিশ্বাস ও সংস্কারের বুকে আঘাত হেনে নতুন কিছু বলতে গিয়ে নেতিবাদ প্রচার করেছেন অনেক কবিই।
কবিতার বৈষয়িক কথা অনেক হলো। কিন্তু গত বিশ বছরে বাংলা কবিতা বিষয়ে নয়, আঙ্গিকেই পরিবর্তিত হয়েছে সবচাইতে বেশি। কবি কালের সন্তান। কবিতা কবির কালিক উপলব্ধিতে ঋব্ধ। আধুনিক কালের উদ্ভাসন ও উৎকর্ষ হয়েছে ধনতন্ত্রের ঔরসে। ধনতন্ত্রের ভিত্তি টেকনোলজি। আধুনিক সাহিত্য টেকনোলজি যুগের সাহিত্য। অতএব, তা টেকনিক প্রধান। কবিতা তো অপ্রতিদ্বন্দ্বী ! ধনতান্ত্রিক ব্যক্তি স্বাতন্ত্রীকদের মতোই আঙ্গিক স্বাতন্ত্র্য নিয়ে আজকের কবিরা ক্লান্তিহীন প্রতিযোগীতার অবতীর্ণ।
এমনিতে ছন্দ-অলঙ্কার বা নিয়মের বাইরে থেকে আমাদের কবিরা। তাদের শব্দ চয়ন ভাষা নির্মাণ পঙ্ক্তি ও চরণ বিন্যাস এতই বৈচিত্রিক যে পাঠকের মন বলে উঠতে পারে- ‘কবিতা বুঝি কপোতাক্ষের চর ! মানুষ গরু শিয়াল সারস যে -ই হাটুক না কেন পায়ের ছাপটা ঠিক ঠিকই উঠবে!’ বৈদেশিক শব্দ , বৈজ্ঞানিক ভাষা, গাণিতিক সূত্র , বৈনির্মাণিক মন কবিতার চেহারাটাই পাল্টে দিয়েছে। তাও যদি আধুনিক ঘড়ির মত বিচিত্র চেহারাতেও কবিতা তার আসল কথাটা বলে দিতে পারতো! তাও নয়। বরং বেশিরভাগ পাঠকই কবিতার শরীরী মডেলিং দেখে শিউরে ওঠে, রাতের বেলা ভূতের ছবি দেখার নেয় পৃষ্ঠাটা চেপে দেয়। অন্যদিকে কতিপয় অজানা শব্দ, না শোনা ভাষা, না দেখা শরীর ইত্যাদির বৌদ্ধিক প্রয়োগে কবিতাকে জটিলতর করে চলেছেন কেউ কেউ। তাদের বক্তব্য, জীবন আজ জটিল হয়ে উঠেছে, হয়েছে ছন্দহীন, তাই কবিতা হচ্ছে জটিল ছন্দছাড়া [ছন্নছাড়া আর কি!]। একথায় যুক্তি আছে, কিন্তু মুক্তি আছে কতটুকু? আমাদের জীবন তো এত জটিল হয়ে ওঠেনি, যে প্রতি ভোরে প্রত্যেকেরই প্রাণ আহারের অনুসন্ধানে ওষ্ঠাগত প্রায় ; অতএব উদরপূর্তিতে আহারের বিকল্প কিছু খুঁজতে হবে ! কিংবা প্রতিদিনই অগণিত পুরুষ তো যুদ্ধাহত নয় যে সন্তান উৎপাদনে পুরুষের পরিবর্তে অন্য কিছু ভাবতে হবে! তাছাড়া জীবন যদি জটিল হয়েই থাকে [এমনিতে মানুষের জীবন যথেষ্ট জটিল] তাহলে সেই জটিলতার জাতক মানুষ, কবিতার কাছে আসবে কেন? কবিতা যদি তাকে আরও বেশি কষ্ট দেয়? এর পিছনেও আছে সেই পুরানো যুক্তি- কবিতা সকলের জন্য নয়!
মানলাম। কিন্তু কবিতা যাদের জন্যে লেখা, তারা কারা ? সাহিত্য পাতার সম্পাদক, কবির কিছু সুহৃদ আর কবি হওয়ার জন্যে হন্যে হয়ে ওঠো ক’জন তরুণ! এই কি কবিতার শেষ গন্তব্য ? না, তাও নয়। কবি এরকমভাবে তার গন্তব্য নির্দেশ করেন না। করতে পারেন না। তার দায়িত্ব লেখা। কিন্তু এখানেও কথা থেকে যায়। কবি কি তবে স্বেচ্ছাচারী? সামাজের প্রতি তার কোনো দায় নেই? অবশ্যই আছে। আর আছে বলেই কোনো প্রকৃত কবি পারেন না আঙ্গিকসর্বস্ব হতে। অতএব এই আঙ্গিকসর্বস্বতাকে বিসর্জন দিতে হবে। না হলে কবিতা লেখা হয়ে উঠবে স্রেফ মিস্তিরিগিরি।
তিন.
একুশ শতকে বিজ্ঞানের বিস্ময়কর গতিতে সভ্যতার যতায়াত যেখানে অনির্দেশ্য, অপরিণাম্য, বত্রিশখণ্ড এনসাইক্লোপিডিয়া যেখানে আবদ্ধ হয়েছে একটি মাত্র সিডিতে, সফটওয়ারের সভাসদরা যেখানে সহস্র গ্রন্থের সহজপাঠ প্রতিলিপিত করে ফেলছেন একটি ল্যাপটপের পকেটে, একটিমাত্র ক্লিকেই যেখানে সমগ্র পৃথিবীই হাজির হচ্ছে আমাদের সামনে, সেখানে এই শতকের দ্বিতীয় দশকেই যে কবিতার কী চেহারা দাঁড়াবে কে জানে? কবিতা কি পারবে মানুষের মনোজগতের সামান্য অংশীদার হতে ? জানি না। উত্তর দেবে সময়! আমরা শুধু এটুকুই আশা করতে পারি সাহিত্যের এই অতি ঋদ্ধ মাধ্যমটির মানুষেরা ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও অন্যান্য প্রতিকূলতার চ্যালেঞ্জটা নেবেন বা নেওয়ার চেষ্টা করবেন। প্রযুক্তির বিরোধিতা নয়, প্রযুক্তির সহযোগিতা নিয়েই এগিয়ে যাবেন। জানিয়ে দেবেন তাদের অভিনবত্বের বার্তা। এইসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে গিয়েই একুশ শতকের কবিতা হবে অনেক বেশি সুক্ষ্ম ও বিজ্ঞান চেতনাঋদ্ধ। মহাজাগতিক উপাদানে কবিতায় আসবে নতুন মাত্রা, মানবমুখিতায় কবিতা হয়ে উঠবে যথার্থ অর্থে বিশ্বপল্লীর শিল্প উৎস। পুঁজিবাদী আন্তর্জাতিকতার শিল্প নির্মিতির পরিবর্তে একুশ শতকের কবিরা মানবমুক্তির বাসনায় আন্তরিক হয়ে উঠবেন। পাঠককে আবার ফিরিয়ে আনবেন কবিতার পাতায়।