অনেকের মুখেই শোনা যায়, ইদানিং ভালো প্রবন্ধ চোখে পড়ছে না। কেউ আসলে প্রবন্ধ লিখছেন না। প্রাবন্ধিকরা লিখছেন কবি-লেখকের স্তুতিবাক্য। কোনো দিক-নির্দেশনা নেই। সম্পর্কচর্চা শুরু হয়েছে যেন সাহিত্যকে ঘিরে। ফলে নতুন যারা সাহিত্যচর্চা করতে আসছেন, তারাও সম্পর্কচর্চায় জড়িয়ে পড়ছেন। একজন কবি চাইলে শক্তিশালী প্রাবন্ধিক হয়ে উঠতে পারেন। যা আমরা আগেও দেখেছি। তবে এখনকার কবিদের যেন অনীহা প্রবন্ধ লেখায়। কবির সংখ্যা বেড়েছে, বেড়েছে ঔপন্যাসিক ও গল্পকারও। কিন্তু বাড়েনি প্রাবন্ধিকের সংখ্যা। একজন গল্পকার, নাট্যকার ও ঔপন্যাসিকও চেষ্টা করলে ভালো প্রাবন্ধিক হতে পারেন। এসব না হওয়ার ফলে বর্তমানে মানসম্মত কথাশিল্পীর বড়ই অভাব।
আমরা জানি, উনিশ শতকে বাংলা সাহিত্যে একটি নতুন শাখার উদ্ভব হলো, যাকে আমরা প্রবন্ধ সাহিত্য বলি। এ প্রবন্ধ রচিত হয় গদ্যে। প্রবন্ধের ভিত্তি মানুষের চিন্তা, মনন ও তত্ত্ব। তথ্য ও যুক্তির সাহায্যে মননজাত কোনো বিষয়ের প্রতিষ্ঠা দান করাই প্রবন্ধের লক্ষ্য। কিন্তু প্রবন্ধের সেই লক্ষ্য কি অর্জিত হচ্ছে? যদি না হয়, তা হলে কেন হচ্ছে না—সে বিষয়ে কি কেউ ভেবে দেখেছেন? ভাবেননি। আর ভাববেন কি না, তা-ও গবেষণার ব্যাপার।
বাংলা সাহিত্যে এখনো বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, কাজী আব্দুল ওদুদ, বুদ্ধদেব বসু, সৈয়দ আলী আহসান, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদের লেখা প্রবন্ধই পাঠযোগ্য। সাহিত্যের ধারা, বাঁকবদল কিংবা গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে নতুন কোনো প্রবন্ধ চোখে পড়ছে না। দৈনিকের সাহিত্যপাতা, ওয়েবম্যাগ, লিটল ম্যাগ, কিংবা অনলাইন পোর্টালে চোখ রাখলেও আশানুরূপ প্রবন্ধ খুঁজে পাওয়া যাবে না। যদিও এখন দৈনিকের পাতা কমে এসেছে। কেউ কেউ একপাতায় কাজ করছেন। লিটলম্যাগ হিমশিম খাচ্ছে বিভিন্ন কারণে। ওয়েবম্যাগ যতটা বিপ্লবের কথা বলে; ততটা অগ্রসর এখনো হতে পারেনি।
নিজের অনুভূতিকে পাঠকের অনুভূতি ও সংবেদনশীলতার সঙ্গে সংযুক্ত করতে চান। এ জাতীয় প্রবন্ধে লেখকের ব্যক্তিসত্তার আত্মপ্রকাশ ঘটে। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ ও ‘লোক রহস্য’, রবীন্দ্রনাথের ‘বিচিত্র প্রবন্ধ’ এ রচনার অন্তর্ভুক্ত।
আমরা কেউই এ কথা তো অস্বীকার করতে পারি না যে, বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যে সাধারণত জ্ঞান, বিজ্ঞান, ধর্ম, দর্শন, ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, সাহিত্য, শিল্প ইত্যাদি চিন্তামূলক ও তত্ত্বমূলক বিষয় গদ্যাকারে প্রকাশিত হয়। এ সমস্ত লেখার পেছনে থাকে যুক্তি। কোনো চিন্তাগ্রাহ্য বিষয়কে লেখক যখন যুক্তির সাহায্যে প্রতিষ্ঠা করতে চান, তখনই তা প্রবন্ধ হয়ে ওঠে। এ সময়ের কতজন প্রাবন্ধিক আছেন, যারা কি না যুক্তি, চিন্তা, তত্ত্বকে প্রাধান্য দেন? যারা এসবের গুরুত্ব দেন, তারা নমস্য। বেশিরভাগই সংবাদের মতো বিবরণসর্বস্ব গদ্য প্রকাশ করে থাকেন। যাতে থাকে না নিজের চিন্তার লেশ, থাকে না কোনো গ্রহণযোগ্য যুক্তির রেশ। ফলে এসব গদ্য পড়ে মানুষও পায় না মুক্তি। মূলত এসব লেখা পৃষ্ঠা ভরানোর জন্য যথেষ্ট হলেও কোনো সিদ্ধান্তে আসার ক্ষেত্রে কাজে লাগে না।
তারপরও একুশ শতকে যারাই প্রবন্ধ লিখছেন বা লেখার চেষ্টা করছেন তাদের একটু স্মরণ করতেই হয়। তাদের তালিকা খুব বেশি দীর্ঘও নয়। তারা হলেন—কাজী মহম্মদ আশরাফ, মোহাম্মদ নূরুল হক, মামুন রশীদ, রাকিবুল রকি, মঈন শেখ, কুমার দীপ, রঞ্জনা বিশ্বাস, জান্নাতুল যূথী, আজিজ কাজল, মোজাফফর হোসেন, ফজলুল হক তুহিন, ফারুক সুমন, কবীর আলমগীর, মোহাম্মদ আজম, আর কে রনি, শাফিক আফতাব, বীরেন মুখার্জী, রাহেল রাজিব, আঁখি সিদ্দিকা, অনু ইসলাম, ইলিয়াস বাবর, নির্ঝর নৈঃশব্দ্য, মিজান রহমান, চন্দন আনোয়ার, এমরান কবির, আফরোজা সোমা, আহমেদ ফিরোজ, তুষার প্রসূন, আঁখি হক, আদনান সৈয়দ প্রমুখ। তালিকা আরও দীর্ঘ হতে পারে। কেউ বাদ পড়লে রুষ্ট না হয়ে তথ্য দিয়ে সাহায্য করলে বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্য উপকৃত হবে।
এবার আসি মূল কথায়, আমরা প্রবন্ধকে দুভাগে ভাগ করেছি–
১. তন্ময় বা বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধ
২. মন্ময় বা ভাবনিষ্ঠ প্রবন্ধ
তন্ময় বা বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধে লেখক নিরাসক্তভাবে বিষয়ের ওপর কর্তৃত্ব স্থাপন করে যুক্তিশৃঙ্খলার মাধ্যমে গভীরভাবে বিষয় বিশ্লেষণ করবেন। চিন্তাশীল অনুসন্ধানী পাঠক এ জাতীয় প্রবন্ধের অনুরাগী। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বাঙ্গালা ভাষা’ বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধের অন্তর্ভুক্ত। এ ছাড়াও বঙ্কিমচন্দ্রের ‘প্রবন্ধপুস্তক’, জ্যোতিরিন্দ্র নাথের ‘প্রবন্ধমাধুরী’, রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের ‘নানা প্রবন্ধ’, কাজী মোতাহের হোসেনের ‘সংস্কৃতি কথা’ প্রভৃতি তন্ময় বা বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধ।
মন্ময় বা ভাবনিষ্ঠ প্রবন্ধকে ব্যক্তি প্রবন্ধ হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়। এ ধরনের প্রবন্ধে বিষয় অপেক্ষা লেখক পাঠককেই বেশি গুরুত্ব দেন। নিজের অনুভূতিকে পাঠকের অনুভূতি ও সংবেদনশীলতার সঙ্গে সংযুক্ত করতে চান। এ জাতীয় প্রবন্ধে লেখকের ব্যক্তিসত্তার আত্মপ্রকাশ ঘটে। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ ও ‘লোক রহস্য’, রবীন্দ্রনাথের ‘বিচিত্র প্রবন্ধ’ এ রচনার অন্তর্ভুক্ত।
এখন কেউ যদি লেখকের স্তুতিবাক্যকে মন্ময় বা ভাবনিষ্ঠ প্রবন্ধ বলে চালিয়ে দিতে চান, তাহলে অবাক হবো না। কারণ প্রকৃত প্রস্তাবে সমালোচনা হজম করার মতো শক্তিও কবি-লেখককে অর্জন করতে হয়। কবি-লেখকের দুর্বলতা বা খামতিকে কোনো প্রাবন্ধিক তুলে আনলে, তা সহজেই গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়। পদভারে বা পদমর্যাদায় আবিষ্ট কোনো লেখক তার লেখার খামতি অন্য কারও মুখে শুনতে চান না। সাহিত্য সমাজে তাতে তার ব্যক্তিত্বকে ক্ষুণ্ন করতে পারে বলে হীনম্মন্যতায় ভুগতে থাকেন। আবার প্রাবন্ধিক নামধারী কিছু চাটুকার নিজ স্বার্থ উদ্ধারে মরিয়া হয়ে স্তুতিবাক্যকে প্রবন্ধ বলে চালিয়ে দিতেও কুণ্ঠিত হন না।
এই প্রবন্ধে প্রাবন্ধিক হিসেবে যাদের নাম উল্লেখ করেছি, তারা নিজেরা সচেতন এবং সচেতন ভাবেই প্রবন্ধ রচনার দিকে মনোনিবেশ করেন। তাদের প্রত্যেকের প্রাবন্ধিক হয়ে ওঠার পেছনে কোনো না কোনো সম্পাদকের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ হাত রয়েছে।
এ ছাড়াও প্রবন্ধু দু’ধরনের হতে পারে—ভাবগম্ভীর ও লঘু। লঘু রচনা কখনোই ভাবগম্ভীর রচনার মতো হবে না। এমনকি প্রবন্ধে তুলনামূলক বিচার করতে সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য বিশ্লেষণ করতে হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক প্রবন্ধে এসবের উপস্থিতি নেই বললেই চলে। সব মিলিয়ে এ সময়ের প্রবন্ধের মূল আলোচ্য বিষয়ের চেয়ে অপ্রাসঙ্গিক বিষয় প্রকট হয়ে ওঠে। কবি-লেখকের কাহিনি বিন্যাস, চরিত্র নির্মাণ, শিল্পরূপ, ভাষাশৈলী, ছন্দজ্ঞান, অলঙ্কার সম্পর্কে ধারণা, রচনাশৈলীর চেয়ে তার ব্যক্তিগত ক্ষমতা, পদ-পদবী, কতবার বিদেশ ভ্রমণ করেছেন, কয়টি বিয়ে করেছেন, সন্তান কতজন—এসব বিষয়ই মুখ্য হয়ে ওঠে। আলোচিত লেখকও এসবেই বাহবা দিতে থাকেন। ফলে নিজের লেখার ঘাটতি সম্পর্কে তার কখনোই জানার সুযোগ হয় না। একটা জীবন আবর্জনা লিখে তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে তুলেতে পরলোক গমন করেন। যে কারণে মৃত্যুর পরের দিনই কেউ আর তার লেখা সম্পর্কে আলোচনা করেন না। করার আগ্রহও তৈরি হয় না। এমনকি ক্ষমতাবান ওই কবি-লেখক অবসরে গেলে তাকে আর মূল্যায়ন করা হয় না। যতটা করা হতো তার জীবদ্দশায় বা ক্ষমতারোহণকালে।
এতক্ষণ প্রবন্ধ বিষয়ে যে কথাগুলো বলেছি, তাতে অনেকেই রুষ্ট হবেন। তার জন্য কিছু সহজ সমাধানও জরুরি বলে মনে করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে আমাদের প্রবন্ধ লেখার সময় চিন্তা, মনন ও তত্ত্বকেই প্রাধান্য দিতে হবে। প্রবন্ধকে হতে হবে মস্তিষ্ক প্রসূত রচনা। এখানে তথ্য, তত্ত্ব, যুক্তি, তর্ক, সিদ্ধান্ত হবে প্রধান উপকরণ। এ ছাড়া আমরা শুধু সাহিত্য নিয়েই নিয়মিত প্রবন্ধ লিখে যাচ্ছি। তাও ব্যক্তির সাহিত্য নিয়ে আলোচনা। সময় বা প্রেক্ষাপট এখানে অনুপস্থিত। ফলে প্রবন্ধ সাহিত্যে জ্ঞান, বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, সমাজ, রাজনীতি, ধর্ম প্রভৃতি বিষয়সমূহ উপেক্ষিত হয়ে থাকে। এর যে কোনো বিষয় সম্পর্কেই লেখকের চিন্তাগ্রাহ্য তত্ত্বকে কেন্দ্র করে সফল প্রবন্ধ তৈরি হয়ে উঠতে পারে। কবি-সাহিত্যিককেও হতে হবে জ্ঞান, বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, সমাজ, রাজনীতি, ধর্মসচেতন। যুগে যুগে যেকোনো বিপ্লবে প্রাবন্ধিকের ভূমিকাও অনস্বীকার্য। কথাটি ভুলে গেলে চলবে না।
আমাদের মনে রাখা উচিত, একজন প্রাবন্ধিকের বৈশিষ্ট্য কী হওয়া জরুরি। কেননা যিনি প্রবন্ধ রচনা করছেন, তাকে বুঝতে হবে তন্ময় প্রবন্ধের ক্ষেত্রে যুক্তিনিষ্ঠা ও ভাবনার নির্দিষ্ট শৃঙ্খলা থাকতে হবে। এতে তত্ত্ব ও তথ্যের লক্ষণীয় প্রাধান্য থাকতে হবে। তার ব্যক্তিগত আবেগ-অনুভূতির চেয়ে বস্তুনিষ্ঠা বেশি প্রাধান্য পাওয়া উচিত। এমনকি প্রবন্ধের বিষয় সম্পর্কে প্রবন্ধকারের থাকবে নিঃস্পৃহতা ও নিরপেক্ষতা। বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধ রচনার সময় লেখকের ভাষা ব্যবহারে সতর্কতার মাধ্যমে প্রবন্ধের বক্তব্য উল্লেখিত হবে। তবে মন্ময় প্রবন্ধের ক্ষেত্রে যুক্তি ও মননশীলতার পরিবর্তে হৃদয় আবেগেরই প্রাধান্য থাকতে হবে। প্রবন্ধের বিষয়বস্তু ভাবরসে জারিত হয়ে পাঠকের হৃদয়কে স্পর্শ করবে। সরস, মর্মস্পর্শী, আত্মকেন্দ্রিক ভঙ্গিতে পাঠকদের কাছে টেনে নেবেন। বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধকারের মতো মন্ময় প্রাবন্ধিক সোচ্চার বা উদ্দেশ্যতাড়িত নন বরং আত্মমগ্ন ও কিছুটা রহস্যময়। মন্ময় প্রবন্ধ মূলত ব্যক্তিগত নৈর্ব্যক্তিক নয়। তাই ভাষার ব্যবহারে প্রবন্ধকার অনেক বেশি স্বাধীনতা পাবেন এবং পাঠকের সঙ্গে আন্তরিক বিনিময় গড়ে তুলতে পারেন।
প্রবন্ধকে সার্থক করে তোলার দায়িত্ব লেখককেই নিতে হবে। তাই একটি প্রবন্ধ রচনার আগেই লেখককে কিছু প্রস্তুতি নিতে হয়। যে কাজগুলো আগেই নিজেকে স্থির করে নিতে হয়। যেমন—
১. যে বিষয়ে প্রবন্ধ রচনা করবেন, তা স্থির করুন
২. লেখার উপকরণ ও তথ্য প্রস্তুত করুন
৩. সূচনায় বিষয়বস্তুর আভাস দিন
৪. মূল বক্তব্যে পক্ষে-বিপক্ষে অভিমত দিন
৫. একটি গ্রহণযোগ্য উপসংহার তৈরি করুন
৬. সহজ-সরল ভাষায় সংক্ষেপ বা ছোট অনুচ্ছেদ রাখুন
৭. গুরুত্বপূর্ণ অনুচ্ছেদগুলো রচনার শুরুতে লিখুন
৮. বিষয়ভিত্তিক যুক্তি-তথ্যের প্রতিফলন ঘটান
৯. পরস্পরবিরোধী যুক্তি ও ভাব রাখবেন না
১০. সাধু ও চলিত ভাষায় মিশ্রণ রাখবেন না
১১. প্রবন্ধের বিষয় যেন খুব বড় বা খুব ছোট না হয়।
বিষয়গুলোর দিকে দৃষ্টি দিলে প্রবন্ধটি সার্থক ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। প্রাবন্ধিকের লক্ষ্য থাকা উচিত সব ধরনের পাঠকের প্রতি। একজনকে সন্তুষ্ট না করে তিনি পুরো পাঠকসমাজকে উপকৃত করতে পারেন। তা হলেই তিনি প্রাবন্ধিক হিসেবে নমস্য হয়ে উঠবেন। আগামী প্রজন্মকেও প্রবন্ধ রচনায় দিকনির্দেশনা দিতে পারবেন।
তাই একুশ শতকের প্রবন্ধচর্চার অন্তরায় হিসেবে অনেক কিছুই উঠে আসতে পারে। এরমধ্যে অন্যতম হতে পারে বিজ্ঞ সম্পাদকের অভাব। একুশ শতকে যারা সম্পাদনা করছেন, তাদেরও প্রবন্ধ সম্পর্কে ব্যুৎপত্তি অর্জন করতে হবে। বেশিরভাগ প্রবন্ধই যেন মন্ময় বা ভাবনিষ্ঠ না হয়ে যায়। সম্পাদকের নির্দেশনাও প্রাবন্ধিককে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারে। এ ছাড়া বেশি বেশি পড়তে হবে। তথ্য ও তত্ত্বের জন্য বেশি বেশি পড়ার কোনো বিকল্প নেই। লেখকের পাণ্ডিত্য এমনিতেই তৈরি হয় না। নিরলস চর্চা আর অধ্যাবসায় বড় একটি ভূমিকা রাখে। এই প্রবন্ধে প্রাবন্ধিক হিসেবে যাদের নাম উল্লেখ করেছি, তারা নিজেরা সচেতন এবং সচেতন ভাবেই প্রবন্ধ রচনার দিকে মনোনিবেশ করেন। তাদের প্রত্যেকের প্রাবন্ধিক হয়ে ওঠার পেছনে কোনো না কোনো সম্পাদকের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ হাত রয়েছে। অনেকেই জন্মগতভাবে মেধাবী হয়ে থাকেন। আবার অনেকেই চর্চাগতভাবে মেধা অন্বেষণ করতে থাকেন। যে যেভাবেই মেধাবী হোন না কেন, মেধার স্বাক্ষর রাখাই এখানে মুখ্য।
তাই আমাদের উচিত, আগে প্রবন্ধের ধরন, কৌশল ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানা। নিজের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাকে শানিত করতে না পারলে তো বুদ্ধিজীবী হওয়া যায় না। বুদ্ধিজীবী হতে চাইলে, ভালো প্রাবন্ধিক হতে চাইলে আরও আন্তরিক হতে হবে। আরও বেশি পড়াশোনা করতে হবে।
শুরুতেই যেসব অভিযোগের কথা বলেছিলাম, সে বিষয়ে চিন্তার সময় এসেছে। ভালো প্রবন্ধ সৃষ্টি না হওয়ার কারণ উদঘাটন করতে হবে আগে। আমাদের প্রবন্ধ একুশ শতকে এসে যে অবস্থানে আছে, সেখান থেকে উত্তরণের জন্য নিজেদেরই যত্নশীল হতে হবে। কবি-লেখকের স্তুতিবাক্যও যেন মন্ময় প্রবন্ধ হয়ে উঠতে পারে; সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। সাময়িক সম্পর্ক বা স্বার্থের জন্য ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে উৎকৃষ্ট প্রবন্ধ থেকে বঞ্চিত করা মোটেই যৌক্তিক নয়। তাতে আগামী প্রজন্ম ঘোর অন্ধকারে পতিত হবে। কেননা একুশ শতকে এসেও আমরা একশ বছর আগের রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-জীবনানন্দের প্রসঙ্গ টেনে আনি। কিন্তু একশ বছর পরে আমাদের প্রসঙ্গ কিভাবে আলোচিত হবে, যদি আমরাই কোনো উপাদান রেখে যেতে না পরি।
একুশ শতকের কোনো কোনো প্রবন্ধ উদ্ধৃতিসর্বস্ব। সেখানে প্রাবন্ধিকের কোনো বক্তব্য থাকে না। কবিতার আলোচনায় ‘কবি বলেছেন’ লিখে লিখে পাঁচ-সাত লাইন করে কবিতা জুড়ে দিয়ে অহেতুক দীর্ঘ করছেন। না আছে বিশ্লেষণ, না আছে তত্ত্ব। এক শ্রেণির অলস প্রাবন্ধিক আছেন, যারা পূর্ববর্তী কয়েকজন লেখকের বক্তব্য কপি করে একটি প্রবন্ধরূপ দাঁড় করিয়ে নিজের নাম যুক্ত করে দেন। এই সংকলক টাইপ প্রাবন্ধিকরা রাতারাতি বইও করে ফেলছেন। বিষয়কেন্দ্রিক প্রাবন্ধিকরা ‘শরতের সাহিত্য’, ‘কবিতায় বর্ষা’, ‘উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধ’ নামে বিষয়ভিত্তিক প্রবন্ধ লেখেন। যেখানে না থাকে গবেষণা, না থাকে নিজের বক্তব্য।
গবেষণাধর্মী প্রবন্ধের অবস্থা আরও নাজুক। বিভিন্ন জায়গা থেকে উদ্ধৃতি নিয়ে নিয়ে জড়ো করেন। অনেক গবেষণাপত্রের বিরুদ্ধে নকলেরও অভিযোগ ওঠে। ডিগ্রিধারী গবেষকরা এক বিষয়ই বিভিন্ন শিরোনামে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশ করেন। তারা একজনের লেখা ‘রবীন্দ্রকাব্যে বর্ষাবন্দনা’ অনুকরণ-অনুসরণ করেই নিজেও লিখছেন একই বিষয়ে প্রবন্ধ। তাতে ভিন্ন কিছু বা নতুনত্ব আনার চেষ্টা করছেন না। ফলে এ সবই চর্বিতচর্বণ বলে মনে হয়। নতুন চিন্তা বা নতুন তত্ত্ব যদি সামনে না আসে, তবে এখনো ‘রবীন্দ্রনাথের নারী’, ‘নজরুলের প্রেম’ বিষয়ক প্রবন্ধে আটকে থাকতে হবে। এবং সেটাই হচ্ছে।
এই পশ্চাদপদ চিন্তা প্রবন্ধ সাহিত্যকে শানিত করতে পারবে না। সেই উনিশ শতকের ধ্যান-ধারণায় বন্দি হয়ে থাকতে হবে। সমকালীন সাহিত্যচিন্তা প্রখর আর বুদ্ধিদীপ্ত না হলে মানুষ আহাম্মকের কাছ থেকে জ্ঞান আহরণ করবে। একুশ শতকে যারা প্রবন্ধচর্চা করছেন, উল্লেখিত ক’জন বাদে বেশিরভাগেরই প্রবন্ধ, নিবন্ধ, কলাম, মুক্তগদ্য কোনো উপকারে এসেছে কি না আমার জানা নেই। কেননা প্রাবন্ধিকরা পথ দেখাবেন। তবে একই পথ বার বার দেখাবেন না। তারা নতুন পথ আবিষ্কার করবেন। তা না হলে তাদের সব আয়োজনই বৃথা হয়ে যাবে।
তবে এ কথাও সত্য যে, যেখানে হতাশা আছে; সেখানেও আশার আলো উঁকি দেয় মাঝে মাঝে। প্রবন্ধের পাঠক কম হলেও বোদ্ধা পাঠক বেশি। পত্রিকার সম্পাদকীয় পাতায় মাঝে মাঝে সে আলোর ঝলকানি লক্ষ করা যায়। উল্লিখিত ক’জন ছাড়াও একুশ শতকে প্রবন্ধ লিখছেন একঝাঁক প্রতিশ্রুতিশীল লেখক। প্রবীণের পাশাপাশি নবীনরাও দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ইস্যুতে লিখছেন। অভিমত বা অভিমতধর্মী সেসব লেখার মাঝেও শক্তিশালী প্রবন্ধ দেখতে পাওয়া যায়।
এখানেও বেশিরভাগ লেখক সংবাদসর্বস্ব বিবরণে গদ্য সাজান। তাতেও থাকে না কোনো সমাধান বা পরামর্শ। কলাম হয়ে ওঠে সংবাদসর্বস্ব। অর্থাৎ একই ইস্যুর সংবাদ সংকলন মাত্র। ফলে যথাযথ কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কোনো দিকনির্দেশনা পান না কিংবা বুদ্ধিভিত্তিক সমাধানে যেতে পারেন না। তাই আমাদের উচিত, আগে প্রবন্ধের ধরন, কৌশল ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানা। নিজের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাকে শানিত করতে না পারলে তো বুদ্ধিজীবী হওয়া যায় না। বুদ্ধিজীবী হতে চাইলে, ভালো প্রাবন্ধিক হতে চাইলে আরও আন্তরিক হতে হবে। আরও বেশি পড়াশোনা করতে হবে। একুশ শতকের এই হতাশার মাঝেই আশার আলো ফুটুক। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একুশ শতকের প্রবন্ধকে আকর হিসেবে আঁকড়ে ধরুক। প্রবন্ধ সাহিত্যের উত্তরণে বিষয়টি সবাই ভেবে দেখবেন।