০১.
সমকামিতা কখনো বিকৃত যৌনতা ও বিকৃত মানসিকতার কারণে ঘটলেও যখন অপরিহার্যভাবে কোনো যুগল পরস্পরকে পছন্দ করে একসঙ্গে জীবনযাপনে প্রবৃত্ত হয়, তখন সেই অবস্থার জন্য ‘বিকৃত’ শব্দটি আর গ্রহণযোগ্য হতে পারে কি না, তা চিন্তার বিষয়। ধর্মীয় গ্রন্থাদিসহ লোক-সংস্কৃতি, লোক-পুরাণ, লোক-শ্রুতিতে আদিকাল থেকেই মানুষের সমাজে সমকাম যৌনাচারের উল্লেখ পাওয়া যায়, যা গোপনে হলেও হালে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্রান্তিলগ্নে যৌন অধিকার বিষয়টিও প্রকাশ্যে আলোর মুখ দেখে।
গত শতকের শেষের দিকে মানবাধিকারের ভিত্তিতে সমকামীরা যৌন-অধিকার আদায়ের জন্য রাস্তায় নেমেছেন। কোনো কোনো রাষ্ট্র তাদের বৈবাহিক মর্যাদায় জীবনযাপনেরও স্বীকৃতি দিয়েছে। মুসলমান অধ্যুষিত দেশগুলো ছাড়া বাকি দেশগুলোর সিংহভাগপ্রায় প্রতিটি দেশেই সমকামীদের অধিকার আদায়ের জন্য তারা সোচ্চার। বৈবাহিক মর্যাদায় জীবনযাপনের জন্য নীরবে-সরবে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। ইউরোপের কয়েকটি দেশ তাদের দাবি মেনে নিয়ে বিয়েকে বৈধ করে দিয়েছে। একইভাবে চিরবঞ্চিত, অবহেলিত ও নির্যাতিত হিজড়া সমাজও গত শতকের মাঝামাঝি থেকে অধিকার আদায়ের আন্দোলন শুরু করে। আর ওই শতকের শেষ দিকে এবং একুশ শতকের শুরুর দিকে পৃথিবীর অনেক রাষ্ট্রই তাদের তৃতীয় লিঙ্গের মর্যাদা দিয়ে সাধারণ মানুষের মতো বেঁচে থাকার জন্য স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে সমকামী জনগোষ্ঠী ও হিজড়া সমাজের মধ্যে শারীরিক বৈশিষ্ট্যের কারণেই দুটি সম্প্রদায় স্বতন্ত্র। এই চিরবঞ্চিত ও নির্যাতিত জনগোষ্ঠীকে এখন লেজবিয়ান, গে, দ্বি-যৌনাচারী ও রূপান্তরকামী জনগোষ্ঠীকে এলজিবিটি (Lesbian, Gay, Bisexual and Transgender) এক্রোনিমে প্রকাশ করা হয়ে থাকে। এই আন্দোলন ১৯৮৯ সালে শুরু হয়ে ১৯৯৯ সালে এসে থামে। মানব জীবন বা শরীর রহস্যঘেরা। এই রহস্যে আটকে থাকা আরও কিছু জনগোষ্ঠী লিঙ্গসংকট থেকে মুক্তির পেতে আন্দোলন করে যাচ্ছে।
উইকিপিডিয়ার তথ্যানুযায়ী বর্তমানে এই এক্রোনিমটি LGBTQIA এসে থেমেছে। আজকের আলোচনার প্রসঙ্গ এটি নয় বলে উপক্রমনিকার বয়ান এখানেই শেষ করতে হচ্ছে। আগ্রহী পাঠকরা ইচ্ছে করলে ইন্টারনেট থেকে এই বিষয়ে বিপুল তথ্য পাঠ করে তৃষ্ণা মিটাতে পারবেন। আজকের আলোচনায় অন্ধকার সুঁড়িপথের শেষ প্রান্তে গোপন খোপে বন্দি বঞ্চিত, নিগৃহীত, লাঞ্ছিত, সেই অন্ত্যজ জনগোষ্ঠীর যাপিত জীবন। তাদের যৌনাচার, সামাজিক মর্যাদা, লিঙ্গ সংকটের ওপর ভিত্তি করে বাংলা সাহিত্যে ইতোমধ্যে অনেক উপন্যাস রচিত হয়েছে; এসব উপন্যাসের মধ্যে স্বপ্নময় চক্রবর্তীর ‘হলদে গোলাপ’ নিয়ে কিছুটা আলোচনার পর একই জনগোষ্ঠীর ওপর রচিত আরও কয়েকটি উপন্যাস ও ডকুমেন্টারি কয়েকটি গ্রন্থের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবো।
০২.
‘হলদে গোলাপ’ (জানুয়ারি ২০১৫) উপন্যাসে ভারতীয় সমাজের প্রেক্ষাপটে এলজিবিটি জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত মানুষের চরিত্র ও তাদের সামাজিক অবস্থান, যৌনাচার, অন্তর্দহন, মনস্তাত্ত্বিক টানাপড়েন, ধর্মীয় আচার-অনাচারের একটি বৃহৎ ক্যানভাসে চিত্রিত হয়েছে। এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় বা প্রধান চরিত্র অনিকেত। পাঠকের মনে হতেই পারে, লেখক নিজেই অনিকেতের ভূমিকায় এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র দখল করে কাহিনি বর্ণনা করেছেন। কখনো উত্তম পুরুষে, কখনো নাম পুরুষের বর্ণনায় অনিকেত প্রধান চরিত্রের বিন্যস্ত হয়েছে। আবার উপন্যাসের কোথাও মনোলগের বর্ণনাও দৃষ্ট হয়েছে। অনিকেতকে লেখকের ছায়া হিসেবে বিভ্রম না হওয়ার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে, অনিকেত চরিত্রটি চিত্রিত হয়েছে ‘আকাশবাণী’র কর্মকর্তা হিসেবে। লেখক নিজেও আকাশবাণীতে দীর্ঘকাল কাজ করেছেন। অনেক লেখায় লেখকের অভিজ্ঞতার ছাপ পাওয়া যায়, যা হয়তো চাকরিসূত্রে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতারই ছাপ। পড়তেই পারে।
এই দীর্ঘ উপন্যাসটি নিয়ে কিছু লেখা দুরূহ। অসংখ্য এলজিবিটি চরিত্রের বিন্যাসের সঙ্গে সমাজের অন্যান্য অসংখ্য চরিত্রের সন্নিবেশে এটি শুধু দীর্ঘ উপন্যাসই নয়, এতে রয়েছে মনস্তাত্ত্বিক জটিল উপাদান, বহুমাত্রিক যৌনতার খোলামেলা বর্ণনা, চিকিৎসা বিজ্ঞানের তাত্ত্বিক আলোচনা, লিঙ্গ সংকটের সামাজিক ও মনস্তাত্তিক জটিল বর্ণনা ও বিশ্লেষণ, পুরাণের ঘটনা, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত জীবনের অর্থনৈতিক টানাপড়েন, সামাজিক সংস্কার ও রাষ্ট্রীয় আইনের বর্ণনা ও ব্যাখ্যা, সমকালের ঘটনার অনুপ্রবেশ, কবিতা ও শ্লোকের ছড়াছড়ি এবং সংশ্লিষ্ট সাহিত্যের সামান্য সংশ্লেষণ। অসংখ্য চরিত্রের এই উপন্যাসে অমনোযোগী ও অসচেতন পাঠক খেই হারালেও লেখক হয়তো সচেতনভাবেই চরিত্র সৃষ্টি করেছেন, কোথাও কোথাও প্রথিতযশা চরিত্রকেও মর্যাদা দিয়েছেন। প্রায় প্রতিটি পরিচ্ছদেই নতুন চরিত্রের সমাবেশ ঘটিয়েছেন। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অনিকেত এবং তার স্ত্রী সতী-সাধ্বী শুক্লা নক্ষত্রের মতো দীপ্তি ছড়িয়েছে। অনেক চরিত্র শুরু থেকে সৃষ্টি হলেও মাঝপথে থেমে গেছে এবং মাঝ পথ উঠে আসা কয়েকটি চরিত্র আবার শেষ পর্যন্ত উপন্যাসের লক্ষ্যে পৌঁছে সমাজের অন্ধকার খোড়ল থেকে বের হয়ে আসা সংস্কার ভেঙে একাকার করে দিয়েছে। এর মধ্যে দুটি চরিত্র ‘পরি’ ও ‘চয়ন’ (পরির প্রকৃত নাম পরিমল, সে বটম গে এবং চয়ন সে পরির বন্ধু, আপার গে) লেখক অত্যন্ত দরদ দিয়ে সৃষ্টি করেছেন যে, এই দুই চরিত্রকে অন্য অর্থে নায়ক-নায়িকাও বলা যায়। শেষ অধ্যায়ে চয়নের সঙ্গে পরি (পরিমলের) বিয়ের মাধ্যমে সমাজের প্রচলিত সংস্কার ভাঙার সানাই বেজে ওঠে। এক কথায় বলা যায়, সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে লোকচক্ষুর অন্তরালে সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে অস্বাভাবিক যৌনাচারের প্রায় সব দিকই উন্মোচিত হয়েছে এই গ্রন্থে।
তার স্বামী নানা রকম কৌশল অবলম্বন করেও দীর্ঘদিন কাটানোর পর যখন দেখল মঞ্জুর শরীর আর জাগে না, তখন অন্য এক নারীর সঙ্গে অবৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে অন্যত্র থাকতে শুরু করে।
অনিকেতের পরিবারকে কেন্দ্র করেই নির্মিত হয়েছে উপন্যাসের কাহিনি। অনিকেত সব ঘটনার সঙ্গে রয়েছে। অনিকেত কলকাতার ‘আকাশবাণী’ রেডিও সেন্টারের কিশোর-কিশোরীর যৌনস্বাস্থ্য বা প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ক ‘সন্ধিক্ষণ’ নামে একটি অনুষ্ঠান পরিচালনা করার ফলে অসংখ্য চিঠির জবাব দিতে গিয়ে বিজ্ঞন বিষয়ক তথ্য সংগ্রহ করে। শুধু চিঠি নয়, অনেকেই অস্বাভাবিক বিশেষ করে মেয়েলি চালচলন, কথাবার্তা, অনুভূতি ও যৌনাচারের জন্য অনিকেতের সঙ্গে দেখা করতেও আসে। তাদের যৌনতার বাস্তব গল্প শোনায়। কোনো কোনো গল্প সমাজের দৃষ্টিতে অস্বাভাবিক মনে হলেও মানবিকতার আচ্ছাদনে উজ্জ্বল। এই অস্বাভাবিক বিষয়গুলো নিয়ে অনিকেতের কৌতূহল বাড়তে থাকার কারণে ক্রমান্বয়ে সমাজের সাধারণ মানুষের অন্তরালে সংঘটিত যৌনাচার ও শরীর বিদ্যার বিষয়গুলো সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ করতে থাকে। যেগুলো উপন্যাসের পরতে পরতে স্থান পেয়েছে। যেন আমেরিকান এক বিশাল বার্গারের পাউরুটির ভেতরে ঢুকানো অসংখ্য উপচার। এই অনুষ্ঠানেই সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী ও চিকিৎসকের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে সমকামিতার কারণ, লিঙ্গ সংকট, সামাজিক অবস্থা উপন্যাসের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। অনিকেতের স্ত্রী শুক্লা একজন টিপিক্যাল বাঙালি চরিত্রের সতী-সাধ্বী, নিপুণ সংসারী, স্বামী সোহাগী, শান্ত ও ভদ্র গোছের নারী। তারা নিঃসন্তান। নিঃসন্তান হওয়ায় প্রচ্ছন্ন মনোবেদনা থাকলেও তা প্রকট রূপ পায়নি বা শুক্লা বা অনিকেতের মধ্যে হাহাকার প্রকাশ পায়নি। তারা উভয়ই উদার প্রকৃতির এবং মানুষের বিপদে-আপদে অকুণ্ঠ চিত্তে দরদি হাত বাড়িয়ে দেয়।
অনিকেতের বাসার দীর্ঘকালের অসহায় হতদরিদ্র গৃহকর্মী দুলালের মা, দুলাল ও দুলালের ছেলে মন্টু উপন্যাসের অনেক অংশে ছড়িয়ে রয়েছে। ‘হলদে গোলাপ’ উপন্যাসে সমকামিতার মঞ্চে দুলালের (লিঙ্গ ও নাম পরিবর্তন করে দুলালী হয়) মাধ্যমে পর্দা উন্মোচিত হলেও পরবর্তী সময় অনিকেতের কিশোর বেলার পরিচিত মঞ্জু এবং তার ছেলে রূপান্তরকামী পরিমল (নাম পরিবর্তন করে ‘পরি’) দুলালের স্থান দখল করে তার লালিত জীবনের পূর্ণাঙ্গতার দিকে এগিয়ে যায়। মৃত্যুর হাত ধরে দুলাল চলে যায় মঞ্চের বাইরে এবং এর পরপরেই যেন বিষ্কম্ভকের কথনে দুলালের আরও কিছু ঘটনা বর্ণিত হয় উপন্যাসের মাঝামাঝিতে।
প্রাকৃতিকভাবেই দুলালের শারীরিক বৈশিষ্ট্যে নারীসুলভ আচরণ প্রকাশিত হয় বয়ঃসন্ধিকালে। সে যদিও বিয়ে করে এবং তার ঘরে একটি ছেলের (মন্টু) জন্মও হয়। কিন্তু এই ছেলে প্রকৃতপক্ষে দুলালের কি না, সে সন্দেহ থেকেই যায়। কারণ তার পুরুষাঙ্গ অপূর্ণ ও অপরিপুষ্ট ছিল বলে স্ত্রী সহবাসে উপযোগী ছিল কি না, সন্দেহ থেকে যায়। অনিকেতের কাছ থেকে টাকা নিয়ে দুলাল জীবিকার জন্য প্রথমে শাকসবজির ব্যবসা পাতলেও শেষে একটি বাইসাইকেল কিনে গ্রামে গ্রামে ঘুরে মেয়েদের সাজসজ্জার কমদামি জিনিসপত্র বিক্রির পেশায় নামে। এই পেশাতেই যেন সে খুঁজে পায় বিহঙ্গের মতো মুক্তির আনন্দ এবং তখনই দেখা হয় কয়েকজন হিজড়ার সঙ্গে। নিজের সংসারের মায়া কাটিয়ে ভিড়ে যায় হিজড়াদের থানে এবং পরিশেষে সংসারবিবাগী দুলাল ‘কোতি’ হয়ে অবাধ যৌনাচারে লিপ্ত হয়। এক সময় দুলালের এইচআইভি-এইডস ধরা পড়ে। হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করে। লিঙ্গারিত হয়ে দুলাল নিজে নতুন নাম ধারণ করে ‘দুলালী’। হাসপাতালে মৃত্যুর পর সৃষ্টি হয় নাম ও লিঙ্গ সংকটের চরম জটিলতা। তার জাতীয় পরিচয়পত্র, রেশনকার্ড ইত্যাদি সরকারি নথিপত্রে তার নাম দুলাল। কিন্তু হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে দুলালী নাম দিয়ে। শুধুই হাসপাতালে বিড়ম্বনা শেষ হলেও হতো; এই বিড়ম্বনা গড়ায় শশ্মান পর্যন্ত। সৎকারের বিধান অনুযায়ী পুরুষ ও নারীর মধ্যে পার্থক্য থাকায় পুরোহিত লাশ সৎকার করবেন না বলে জানিয়ে দেন। শেষ পর্যন্ত আকাশবাণীতে সাংবাদিকতার চাকরির মর্যাদার জোরে অনিকেত ঝামেলা মিটিয়ে লাশ সৎকারের ব্যবস্থা করে। এই চাকরির মর্যাদা দিয়ে অনিকেত আরও অনেক সমস্যার সমাধান করার ঘটনাও রয়েছে উপন্যাসে।
দুলাল রেখে যায় তার সন্তান মন্টু ও মাকে। স্ত্রী আগেই কোনো এক পুরুষের সঙ্গে ভেগে যায়। মন্টুর সামান্য ভিটেটুকু দখল নেওয়ার জন্য একদিন তার কাকা ইঁদুর মারা বিষয় খাওয়ায় কালো ডালের সঙ্গে মিশিয়ে। কোনোক্রমে বেঁচে যায় মন্টু এবং ফিরে আসে শুক্লার আশ্রয়ে। মন্টুও বয়ঃসন্ধিকালে এক রিকশাচালকের সঙ্গে যৌন কাজে লিপ্ত হওয়ার সময় শুক্লার হাতে ধরা পড়ে। পরে শুক্লা ও অনিকেতের ইচ্ছায় এই অচ্ছুতকে অনিকেতের মামাতো ভাই ও বন্ধু বিকাশের আশ্রয়ে পাঠিয়ে দেয়। শুক্লাকে মন্টু জেঠিমা বলে ডাকতো এবং আশাও করেছিল স্ত্রী-পুত্রহারা বিকাশ হয়তো মন্টুর সঙ্গে ছেলেসুলভ আচরণ করবে, লেখাপড়া করাবে, বাসার কাজকর্মও করবে। মন্টুর জীবনের ভবিষ্যতের একটা সুরাহা করবে। মন্টুকে স্কুলে ভর্তি করানো হয়, সে মাধ্যমিক পাসও করে, কিন্তু বিকাশ ছেলেসুলভ আচরণ না করে তাকে যৌনসঙ্গী বানিয়ে নেয়। মন্টুকে ব্যবহার করে বিকাশসহ তার আরও কয়েক বন্ধুর লিঙ্গ চোষার কাজে।
প্রসঙ্গত, বিকাশ-দম্পতিও নিঃসন্তান ছিল। তারা একটি ছেলেকে পোষ্য হিসেবে গ্রহণ করেছিল। বিকাশের সুপ্ত ইচ্ছে ছিল ছেলেটিকে খুব ভালো ক্রিকেটার বানাবে। এজন্য প্রয়োজনীয় টাকাকড়ি খরচ করেছে দুহাতে। দুর্ভাগ্য যে ছেলেটি সেরকম ভালো করতে না পারায় এবং উপর্যুপরি বিকাশের মানসিক নিপীড়নে একদিন সে আত্মহত্যা করে। এই আত্মহত্যাকে কেন্দ্র করে বিকাশের স্ত্রী তাকে ত্যাগ করে এবং বিকাশ খুবই এলেমেলো জীবনযাপন করতে শুরু করে। আহার-নিদ্রা অনিয়মের মধ্যে মদ্যপান হয়ে যায় নিয়ম এবং মদ্যপান করেই সারা দিন ঘরে পড়ে থাকে। নিঃসঙ্গ বিকাশের এই দুরাবস্থা কাটিয়ে তোলার জন্য মন্টু হয়তো কিছুটা সহায়ক হতে পারে ভেবে বিকাশের কাছে দেওয়া হয়েছিল মন্টুকে। সর্বশেষ পরিণতি, বিকাশের সামান্য কিছু টাকার জন্য বিকাশ ও মন্টু খুন হয় অজ্ঞাত লোকের হাতে।
কিশোরবেলার স্বপ্নের নায়িকা ষোড়শী মঞ্জুকে একদিন অনিকেত অপ্রত্যাশিতভাবে আকস্মিক এক ঘটনায় দেখতে পায় সত্তর বছর বয়সী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সৈনিক ক্যান্সার রোগী তার পিসেমশাইয়ের সঙ্গে সঙ্গমরত অবস্থায়। এই ঘটনার পর মঞ্জুকে খারাপ চরিত্রের মনে করে অনিকেত এক সন্ধ্যায় মঞ্জু তাকে ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করে। তখন থেকে দুজন দুজনের বিদ্বেষের অবস্থানে দাঁড়ায়।
বহুকাল পরে আকাশবাণীর অফিসে ‘সন্ধিক্ষণ’ অনুষ্ঠানের পরিচালকের কাছে মঞ্জুর ছেলে পরিমলের মেয়েলি আচরণের কথা বলতে এসে দুজনের নতুনভাবে পরিচয় ঘটে। মঞ্জুর সঙ্গে পিসেমশাইয়ের অযাচিত যৌনতার ব্যাখ্যা করেছিল মঞ্জু, যা পাঠককেও বিস্মিত করে। একটি পৌরানিক শ্লোকের প্রতি পিসেমশাইয়ের বিশ্বাস ছিল যে, ষোড়শী কোনো কন্যার সঙ্গে সঙ্গম করলে শরীর রোগমুক্ত হয় এবং যেহেতু তিনি ক্যান্সার রোগী ও মৃত্যু সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছেন, তাই তাকে কেবল মঞ্জুই বাঁচাতে পারে একবার সঙ্গম করে। ওই মুহূর্তে মঞ্জুও আবেগকাতর হয়ে একটি মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য তার অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারেনি। অবশ্যই ওই ঘটনার চারদিন পর পিসেমশাই মারা যায়। ঘটনাটি মঞ্জুর কাছে অযাচিত ছিল বলে সে অনেকটা ট্রমাটাইজড হয়ে পড়ে। বিয়ের পরেও সে ছিল ফ্রিজড, কোনো যৌনানুভূতি তার ছিল না বলে স্বামীর শরীরের সঙ্গে তার শরীর জাগতে পারতো না। তার স্বামী নানা রকম কৌশল অবলম্বন করেও দীর্ঘদিন কাটানোর পর যখন দেখল মঞ্জুর শরীর আর জাগে না, তখন অন্য এক নারীর সঙ্গে অবৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে অন্যত্র থাকতে শুরু করে।
একটি ট্রাভেল এজেন্সির সামান্য বেতনের চাকরিজীবী মঞ্জুর কাছে রয়ে যায় তার সন্তান পরিমল। কিন্তু পরিমল ছেলে হলেও তার শরীরে নারীত্বের প্রভাব থাকায় শৈশব থেকেই সে নিজেকে মেয়ে ভাবতে থাকে। মেয়েশিশুরা যে ধরনের আচরণ করে, পরিমল তার সবই করে। সে নিজেকে কখনোই ছেলে বা পুরুষ হিসেবে ভাবতে পারে না। নিজেই নাম পরিবর্তন করে ‘পরি’ নাম ধারণ করে। পরিমল ছেলে হয়েও মেয়েদের মতো সব করে, যা মঞ্জু মেনে নিতে পারে না। কেন একটি ছেলে হয়ে ক্রিকেট খেলবে না, মাঠে যাবে না, দৌড়ঝাঁপ দেবে না? কেন সে মেয়েদের মতো সাজে, ছেলেদের সঙ্গে মিশতে পছন্দ করে, মেয়েদের মতো রান্না করতে চায়? এসব দেখে একদিন ‘সন্ধিক্ষণ’ অনুষ্ঠানে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে মঞ্জু অনিকেতের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। অনেক বছর দেখা হওয়ার পর দুজনের মনের ভেতরে হারানো অতীতের কিছুটা আবেগও সঞ্চারিত হয়। পরিমলের জন্য খুব দুঃখ প্রকাশ করে মঞ্জু। প্রতিকার সম্পর্কে জানতে চায়। কিন্তু অনিকেত বললো, গোলাপ তো হলুদও হয়। নিজের সন্তানের ইচ্ছের বিরুদ্ধে যাওয়া ঠিক নয়। শরীর তো আর সে নিজে তৈরি করেনি। অনিকেতের কথায় ও বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে মঞ্জু পরিমলের আচরণ মেনে নেয়। পরিমল কবিতা লিখে, লেখাপড়ায় ভালো এবং শান্তশিষ্ট ভদ্র গোছের এক মানুষ ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে।
এখানে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার পাশাপাশি অন্তরাত্মার মানবিক ক্রন্দনও অনুরণিত হয় অন্তঃপ্রবাহে। ক্রমোজমের ব্যাখ্যা বিজ্ঞানমনস্ক পাঠককে খুব সহজেই আকৃষ্ট করবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
মঞ্জুর সঙ্গে অনিকেতের নতুন করে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তারা বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। একদিন কালিঘাটে পরিমল ও তার একসঙ্গী অপ্রত্যাশিতভাবেই দেখে ফেলে অনিকেতের সঙ্গে মঞ্জুকে। কিন্তু পরিমল মায়ের ব্যাপারে নিরাসক্ত মনোভাব পোষণ করে সরাসরি বলে দেয়, তুমি তোমার মতো থাকো। যা ইচ্ছে করো। আর আমি থাকি আমার মতো। আমার কাজেও নাক গলিয়ো না। মঞ্জুর সঙ্গে অনিকেতের সম্পর্ক যৌনতার দিকে গড়ায়। একদিন একটি হোটেল কক্ষে তারা মিলিত হয়। এখানেই ঘটে এক ভিন্ন ঘটনা। মঞ্জুর শরীর যখন জেগে ওঠে, তখন সে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে। অনিকেতকে অনেক অনুরোধ ও জোরাজুরি করে পায়ুসঙ্গম করতে বাধ্য করায়। অনিকেতের ইচ্ছের বিরুদ্ধে এই ঘটনা ঘটায় মঞ্জু অত্যন্ত আবেগকাতর হয়ে বলে, আমার পরিমল কেমন কষ্ট করে, তা বোঝার জন্যই আমি তোমাকে এভাবে করতে অনুরোধ করলাম। আহা! ছেলেটা কত কষ্ট পায়। এই ঘটনা থেকে অনিকেত বিজ্ঞানের যুক্তি খুঁজতে থাকে। যুক্তি খুঁজতে থাকে ভারতীয় ধর্ষণ আইনের ৩৭৭ ধারার। এই যৌনতার সঙ্গে ঝাড়খণ্ডের আদিবাসীদের এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পৌরাণিক কাহিনির মাধ্যমে অনিকেত জানতে পারে নারীর জননাঙ্গের মাধ্যমেই কেবল সতীত্ব নষ্ট হয়। পায়ুসঙ্গমে কিংবা পায়ুপথে নারী ধর্ষিত হলে সতীত্ব বজায় থাকে। অনিকেতের চিন্তার জগতে দুটি জানালা খুলে যায়; মঞ্জু কি পায়ুকামী এবং এজন্য কি পরিমলও সেই ধারার জিন বহন করছে? না কি সে সতীত্ব বজায় রাখার জন্য পায়ুসঙ্গমে প্রবৃত্ত হলো। মঞ্জুর সঙ্গে অনিকেতের প্রেমের গভীরতা বাড়তে থাকলেও দৈহিক মিলনের পরবর্তী পর্যায়ে আর কোনো বিবরণ পাওয়া যায়নি। এরপর তাদের সম্পর্ক চলতে থাকে গোপনে গোপনে।
অনিকেত বদলি হয়ে যায় ঝাড়খণ্ডে। সেখানে গিয়ে অনিকেত দুলালের জীবনীকে একটি উপন্যাস লিখতে শুরু করে। এই উপন্যাসের কাহিনিমূলে হিজড়া গুরুর সান্নিধ্য লাভ করে, হিজড়াদের দলে দুলালের লিঙ্গ কর্তনের ঘটনা এবং লিঙ্গান্তরের হিজড়াদের আচার-অনুষ্ঠানসহ লিঙ্গান্তরের পর পাঁচ রকমের কাঠের পুরুষাঙ্গ দিয়ে প্র্যাকটিস করার কাহিনি ‘হলদে গোলাপ’ উপন্যাসে বিধৃত হয়। কিন্তু অনিকেত এখানে দুলারের ঘটনা বিশদে বর্ণনা করে উপন্যাস সৃষ্টি করতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত আর এগোয়নি। হয়তো উপন্যাসের ভেতর উপন্যাস—এ-রকমভাবে উপস্থাপন করা লেখকের একটি কৌশলও হতে পারে। কারণ, দুলালের জীবনের কিছু অংশ যা কোতিদের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, সেটি বাদ পড়েছিল—সেটুকু বর্ণনার জন্য হয়তো লেখক নতুন কৌশল অবলম্বন করেছেন।
পরিমল আর পরিমল থাকেনি। সে হয়ে যায় ‘পরি’। তার মধ্যে মেয়েলি আচরণ আরও পরিস্ফুটিত হয়। সে প্রকাশ্যেই নিজেকে মেয়ে দাবি করে। সঙ্গী খুঁজে বেড়ায়। সঙ্গী হিসেবে পেয়ে যায় চয়নকে। চয়ন শিক্ষিত ছেলে এবং আপার গে। সে মেয়েদের সঙ্গে সঙ্গম করে আনন্দ পায় না। চয়নের চাকরি হলেই বিয়ে করবে এমন প্রতিশ্রুতি সে পরিকে দিয়েছে। পরির জামাকাপড়ও মেয়েদের স্টাইলে তৈরি করে এবং বাইরে গেলেও এরকম পোশাকও পরে। ‘প্রবর্তক’ পত্রিকা যৌন-প্রান্তিক মানুষের জীবনের নানা সমস্যা লিখে যেগুলো পরি খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ে। সে লেখাপড়াতেও ভালো করে, কবিতানুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করে, পত্রপত্রিকায় লেখা পাঠায় এবং ছাপাও হয়। শেষাবধি প্রাইভেট ইনস্টিটিউটে ফ্যাশন ডিজাইনে লেখাপড়া করার জন্য মনোস্থির করলেও সমস্যা সৃষ্টি হয় টাকার। চয়নেরও সামর্থ্য নেই যে পরিকে টাকা দিয়ে সাহায্য করবে। সে খুব ভালো ছাত্র নয়, লেখাপড়া শেষ করে প্যারা টিচার হিসেবে একটি হাই স্কুলে কাজ করে। চয়নের চাকরি হলেই পরিকে বিয়ে করবে এমন কথাও পাকা হয়ে থাকে।
ঘটনার মোড় ঘুরে যায় মঞ্জুর আকস্মিক ঝাড়খণ্ডে অনিকেতের বাসায় বেড়াতে যাওয়াকে কেন্দ্র করে। ঝাড়খণ্ডে অনিকেত একা থাকে এবং শুক্লা কলকাতায়। ঝাড়খণ্ডে অনিকেতের বাসায় মঞ্জুর আগমনে দুজনই জলো প্রেমে হাবুডুবু খাওয়ার পরের দিন শুক্লাও অনিকেতকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য তাকে না জানিয়েই সেখানে গিয়ে হাজির। বাসায় মঞ্জুকে যে হালে দেখে তাতে শুক্লা আর স্থির থাকতে পারেনি, স্ট্রোক করে এবং কিছুদিন হাসপাতালে থাকার পর ডান হাত প্যারালাইজড হয়ে বাসায় ফেরে। শুক্লার নিবিড় চিকিৎসার কারণ দেখিয়ে ঝাড়খণ্ড থেকে অনিকেত কলকাতায় ফিরে আসে। চিকিৎসা চলতে থাকে।
শুক্লার স্ট্রোকের জন্য মঞ্জুই দায়ী। প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য মানসিকভাবে তৈরি হয়। ব্যাংকের কিছু টাকা, ইন্স্যুরেন্স এবং কিছু গয়নাপত্র বিক্রি করে, যেন পরি পায়, তার সব ব্যবস্থা নিখুঁতভাবে করে অনিকেতকে একটি চিঠি লিখে সে ট্রেনের নিচে আত্মহুতি দেয়। আত্মহত্যা করলে ইন্স্যুরেন্সের টাকা পাওয়া যাবে না, তাই যেন তার মৃত্যু দুর্ঘটনা হয়েছে, তার জন্য সব প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করে যায় মঞ্জু। শুধু অনিকেতই জানলো মঞ্জু আত্মহত্যা করেছে, আর কেউ নয়। ফ্যাশন ডিজাইনে ভর্তি হওয়ার জন্য পরির টাকার ব্যবস্থা হলো মায়ের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে।
কিন্তু ফ্যাশন ডিজাইনে পড়ার খরচ চালানো, কম্পিউটার ও ক্যামেরা কেনার টাকা কোথায় পাওয়া যায়? শিকস্তি তার ক্লাসমেটই বুদ্ধি বাতলে দেয় পরিকে টাকার বিনিময়ে যৌনকাজ করার জন্য। চাকরির পিছনে না ঘুরে রোজগারে জন্য এসকট বা জিগালো হিসেবে কাজ করার জন্য চয়নকেও রাজি করাতে বলে। শিকস্তি নিজেও মাসে কয়েক বার যৌনকাজ করে তার লেখাপড়ার টাকা রোজগার করে। বাবার কাছ থেকে টাকা আনে না এ-কথা অকপটে স্বীকার করে সে। চয়নকে জানিয়েই হোটেলে খদ্দেরদের সঙ্গে যৌনকাজ করে কম্পিউটার ও ক্যামেরা কেনার টাকা সংগ্রহ করে পরি। তবে চয়ন এসকট বা জিগালো হিসেবে কাজ করে না।
ফ্যাশন ডিজাইনে লেখাপড়া শেষ করে সে একটি ফার্মে ভালো চাকরি পায়। কিন্তু চাকরি পাওয়ার পরেই তার মধ্যে নারীত্ব আরও বেশি জাগ্রত হয়। অনেক টাকা খরচ করে দোতলা (আর্টিফিশিয়াল স্তন লাগায়) তৈরি করে। একতলা (আর্টিফিশিয়াল যোনি) পরে সংযোজন করবে। শুক্লার আবদারে পরি ও চয়নের বিয়ে হয় অনিকেতের বাসায়। এই বিয়ের মধ্য দিয়ে প্রচলিত সংস্কারের প্রাচীর ভাঙার সানাই যেন বাজতে থাকে পাঠকের মনে।
কিন্তু উপন্যাসের কাহিনি এত সাদামাটা নির্মাণ করেননি লেখক স্বপ্নময় চক্রবর্তী। রয়েল সাইজের ছয়শ পৃষ্ঠার (সাধারণ বুক সাইজে হয়তো আটশ’ পৃষ্ঠা হবে) ঠাসাঠাসি তথ্যের ভাণ্ডার থেকে উপন্যাসের কাহিনি ছেঁকে বের করতে হয় পাঠককে। এলজিবিটি সংশ্লিষ্ট কোন তথ্যটি বাদ পড়েছে সেটিই চিন্তার বিষয়। সমকামীদের যৌনতার আচরণ এমন হওয়ার পেছনে তিনি দায়ী করেছেন ক্রমোজনের ব্যতিক্রমকে। মানবদেহে 46xx সম্পূর্ণ নারী ও 46xy সম্পূর্ণ পুরুষ হয়। যখন কোনো মানুষের শরীরে কোনো কারণে ক্রমোজমের পার্থক্য ঘটে, তখনই অস্বাভাবিক যৌনচার ঘটে। যাকে বিকৃত যৌনাচারের মানুষ হিসেবে তাকে লাঞ্চিত করা হয়। এরপর সমকামী পুরুষরা এস্ট্রোজেন ট্যাবলেট খায় এবং নারীরা এড্রোজেন ট্যাবলেট গ্রহণ করে, তাদের মধ্যে লুকায়িত প্রকৃত সত্তাকে প্রকাশ করার জন্য প্রবৃত্ত হয়।
অনেক পুরুষের অণ্ডকোষ পেটের মধ্যে লুকায়িত থাকার ফলে তাদের লিঙ্গ সেভাবে বড় হয় না। এজন্যও তাকে দায়ী করে যদি লাঞ্ছনা করা হয়, তাও অমানবিক। এরপর লিঙ্গান্তর হওয়া কিংবা লিঙ্গ কর্তনের বর্ণনাও তিনি করেছেন। ব্যবহার করেছেন অসংখ্য ডাক্তারি পরিভাষা, যা সাধারণ মানুষের অজানা। তৃপ্তি নামের লেজবিয়ানের যৌনাচার এবং এক নারীকে ধর্ষণের দায়ে মামলা হওয়ার কাহিনির মধ্য দিয়ে লেজবিয়ানের শারীরিক গঠনের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও লেখক দিয়েছেন। এখানে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার পাশাপাশি অন্তরাত্মার মানবিক ক্রন্দনও অনুরণিত হয় অন্তঃপ্রবাহে। ক্রমোজমের ব্যাখ্যা বিজ্ঞানমনস্ক পাঠককে খুব সহজেই আকৃষ্ট করবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
‘হলদে গোলাপ’ উপন্যাসটি যেন সাহিত্যের ক্যানভাসে নয়; এটি ময়নাতদন্তের টেবিলে এলজিবিটি দলের সদস্যদের শুইয়ে ছুরি-কাঁচি, ফরসেপ দিয়ে টেনে আনা দেহের ভেতরের সত্তাকে মাইক্রোস্কোপের নিচে রাখার গল্প, যে মাইক্রোস্কোপের আতশ কাচের ভেতর দিয়ে আমরা দেখতে পাই মানব ও অ-মানব শরীরের এনাটমি। দেখতে পাই ক্রোমোজম, জিন ও হরমোনসহ জৈব রসায়নের অন্তঃলীলা। অন্তর্দহন।
এই উপন্যাসে লেখক সংযোজন করেছেন অনেক কবিতা-প্রার্থনাসংগীত। বাদ পড়েনি বাংলাদেশের কবি তসলিমা নাসরিনের কবিতাংশ এবং স্ট্যালিনের নামও। বিভিন্ন সাহিত্যিকের বইয়ের নাম বিশেষ করে সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ‘মায়ামৃদঙ্গ’ দুই-তিন বার উল্লেখ করেছেন, যদিও ওই বইয়ে কী আছে, তার উল্লেখ নেই। তিলোত্তমা মজুমদারের ‘চাঁদের গায়ে চাঁদ’ উপন্যাসের শুধু নাম এসেছে। ‘ফায়ার’ আলোচিত লেজবিয়ানিজমের সিনেমার নামও উল্লেখ করেছেন। হুমায়ূন আহমদের ‘ঘেটুপুত্র কমলা’র বর্ণনার জন্য তিনি ছাড় দিয়েছেন একটি প্যারা। এক প্যারায় দেড়শ বছর আগের ভাটি এলাকার কিশোরদের সঙ্গে ধনিক শ্রেণির মানুষের বর্ষাকালের বিকৃত যৌনাচারের বর্ণনা করা হয়। ‘কোতি’, ‘পারিক’, ‘ধুরানি’, ‘ঝলক’ ইত্যাদি প্রান্তিক সমকামী ও হিজড়াদের পরিভাষা কি বাদ পড়েছে? না কি বাদ পড়েছে লিঙ্গান্তরের পরে গুরুদীক্ষা লাভের পর কোতিদের নিলামের ঘটনা? না, বাদ পড়েনি। উপন্যাসটি লেখার সময়সীমার মধ্যে পৃথিবীতে ঘটে যাওয়ার ঘটনা; যেমন, সুমাত্রার সুনামি, ইরানের দশজন সমকামীর ফাঁসি, নেদারল্যান্ডসের সমকামীদের স্বীকৃতি, ভারতের হাইকোর্টের রায়ে আইনের সংশোধন কি বাদ পড়েছে? না, তাও বাদ পড়েনি। ঋতুপর্ণ ঘোষ কিংবা সোমনাথের মতো বিখ্যাত ব্যক্তির নাম কি বাদ পড়েছে? না। তাহলে কী বাদ পড়েছে? কী যে বাদ পড়েছে, তাই আমাদের অজানা রয়ে গেলো।
সনাতন ধর্মের গ্রন্থাবলি থেকে, বিশেষ করে মহাভারতের অনেক উদ্ধৃতিও লক্ষণীয় বিষয়। ইসলাম ধর্মেরও কিছু বিষয় উপন্যাসটিতে স্থান পেয়েছে। তবে হিজরত থেকে হিজড়া শব্দটি এসেছে এই ব্যাপারে পাঠকের মনে সংশয় সৃষ্টি করতে পারে।
তবে ‘হলদে গোলাপে’র মতো এক্সক্লুসিভ এলজিবিটির দায়িত্ব নিতে পারেনি ‘মায়ামৃদঙ্গ’। বাংলা সাহিত্যে এক্সক্লুসিভ সমকামী বা এলজিবিটি জনগোষ্ঠীর জীবনীভিত্তিক কয়েকটি উপন্যাস আমাদের সংগ্রহ করা ও পড়ার সুযোগ হয়েছে। তিলোত্তমা মজুমদারের ‘চাঁদের গায়ে চাঁদ’ লেজবিয়ান চরিত্রের পাশাপাশি একটি চরিত্র গে-এর চিত্রিত হলেও সেটি শেষ পর্যন্ত জন্মগতভাবে গে-এর সহজাত যে বৈশিষ্ট্য সেগুলো সেভাবে পরিপুষ্ট হয়ে ওঠেনি।
আধুনিক ভাষার প্রয়োগ উপন্যাসটিকে ভিন্ন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। বাংলা ভাষায় রচিত হলেও ইংরেজি, হিন্দি, সংস্কৃত, আঞ্চলিক ভাষা এমনকি ফরাসি ভাষা থেকেও কয়েকটি শব্দের প্রয়োগ লক্ষ করা যায় যা প্রাসঙ্গিক। যৌন বিষয়ক প্রমিত শব্দ ছাড়াও প্রান্তিক মানুষের কথ্য ভাষাও ব্যবহার করতে তিনি কুণ্ঠিত হননি। সাধু পাঠকের কাছে হয়তো উপন্যাসটি পড়তে খাপছাড়া বা বিতৃষ্ণা বা বিরক্ত লাগতে পারে, কিন্তু যে জনগোষ্ঠী এই উপন্যাসের চরিত্র তাদের জন্য জুতসই ভাষাই তিনি ব্যবহার করেছেন। বর্তমানের ছেলেপুলেরা ‘ব্যাপক’ ও ‘ভীবৎস’ শব্দ দুটি বেশ ব্যবহার করে তাও কি লেখকের দৃষ্টি এড়াতে পারতো না? হয়তো পারতো। ধারাবাহিকতায় নির্দিষ্টি জনগোষ্ঠীর ভাষাকে লেখক অত্যন্ত সাহসিকতা ও সংস্কার ভেঙে উপস্থাপন করেছেন, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। সবকিছু ছাপিয়ে যৌন-প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মানব-দলিল বললে অত্যুক্তি হবে না।
উপন্যাসের তুলাদণ্ডে এটি কোনো মাপের উপন্যাস তা সমালোচক বিচার করবেন। দু-একজন বিদগ্ধ সমালোচক এটিকে অনেক পরিশ্রম ও গবেষণার তথ্য-ভণ্ডার উল্লেখ করে প্রশংসা করলেও ‘কাঁচা উপন্যাস’ ও ‘তরল উপন্যাস’ আখ্যায়িত করেছেন। উপন্যাসের কাহিনি বিন্যাস, ভাষার ব্যবহার ও কাঠামোর দৃঢ়তা বিবেচনা করে হয়তো কারও কারও এমন মনে হতে পারে। আধুনিক সাহিত্যের দীর্ঘ উপন্যাস পড়ে পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটারও আশঙ্কা কম নয়। তবে গ্রন্থটির ভাষা গতিশীল হওয়াতে সে-রকম আশঙ্কা থেকে কিছুটা মুক্ত থাকা যায়।
যৌনতায় অনেক পুরুষ বিভিন্ন রকম হিংস্র ও বিকৃত আচরণ করে। কৃষ্ণা দত্ত হিংস্র ও বিকৃত যৌনাচরণের গবেষণালব্ধ একটি গ্রন্থ লিখেছেন ‘লাল বাতির নীল পরিরা’ নামে। আনন্দ বাজার, কলকাতা থেকে এই গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে। কত ধরনের বিকৃত যৌনচার মানুষ করতে পারে তার একটি উৎকৃষ্ট দলিল এই বইটি পড়লে সাধারণ মানুষকে স্তম্ভিত হতে হয়। একটি হিংস্রতার রূপ ‘হলদে গোলাপ’ উপন্যাসেও দেখা যায় যখন টাকা রোজগারের জন্য হোটেলে যেতো পরি। কিছু পুরুষ তার কষ্ট ও চিৎকার খুব উপভোগ করতো এবং বলতো, আরও জোরে চিৎকার করো। এই জগতে কোন পুরুষ সাধু? পরির বুকে স্তন সংযোজন করার পর তার অফিসের প্রধান গর্গ বাবু তার জন্য হীরের নাকফুল উপহার দিয়ে পরিকে অভিনন্দন জানায় এবং পরির সিলিকনের কৃত্রিম স্তন দেখার জন্য সে ব্যাকুল হয়ে অনুরোধ করতে থাকলে পরি বুকের কাপড় খুলে দেখায়। দেখানো পর্যন্ত শান্ত থাকলেও হয়তো কৌতূহলী মানুষকে মানবীয় মানুষ বলা যেতো। কিন্তু তারপরের দাবি একটু স্পর্শ এবং স্পর্শ থেকে মর্দন করে নতুন ট্রান্সপ্লান্ট করা ব্রেস্টকে বিধ্বস্ত করেছে, যা পরির ভয়াবহ ক্ষতি করে। ডা. বলেছেন, তাকে নতুন করে আবারও স্তন লাগাতে হবে। সভ্য মানুষটির পর্দার আড়ালে অবাঞ্ছিত ধর্ষণের মতো কাজটি করে কামুক পুরুষ সমাজের চিত্রটিই প্রকাশ করেছে।
০৩.
নির্দিষ্ট বিষয় বা ঘটনা বা ইতিহাস বা জনগোষ্ঠী বা এলাকা নিয়ে রচিত সাহিত্যের ইতিহাস অনুসন্ধান করা লেখক সমাজের কৌতূহল লক্ষ করা যায়। হিজড়া সমাজ, গে বা লেজবিয়ান জনগোষ্ঠী নিয়ে কে কী লিখেছেন সাহিত্যিকরা আগে যাচাই করেন। গে জনগোষ্ঠী বা তাদের প্রতিনিধি নিয়ে লেখা উপন্যাস-গল্প কে আগে লিখেছেন, তা নিয়েও অনেকের কৌতূহল রয়ে গেছে। প্রথম কে লিখেছেন? সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ অনেকটা মীমাংসা করে দিয়েছেন, তাঁর ‘মায়ামৃদঙ্গ’ উপন্যাসের ভূমিকায়। বলেছেন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘বৈতালিক’ (১৯৫৫) প্রথম এবং ‘মায়ামৃদঙ্গ’ দ্বিতীয় (প্রথম সংস্করণ ১৯৭২ সালে এবং দ্বিতীয় সংস্করণ ২০০৪ সালে প্রকাশিত)। তবে এই অন্ত্যজ জনগোষ্ঠী বা তাদের প্রতিনিধি নিয়ে ছোট গল্প বা নাটক কেউ লিখেছেন কি না, জানা নেই। আমাদের দৃষ্টিতে সাহিত্য ও উপন্যাসের তুলাদণ্ডে ‘মায়াদৃগঙ্গ’ একটি উল্লেখযোগ্য উপন্যাস হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। রাঢ় অঞ্চলের এই উপন্যাসের সমৃদ্ধ ভাষার বুনন, কাহিনি বিন্যাস এবং চরিত্র চিত্রণে লেখকের দরদ, প্রজ্ঞা এবং নৈপুণ্যের ছাপ পাওয়া যায়। আকর্ষণীয় ও চুম্বকীয় ভাষা এবং কাহিনি বুননে নিঃসন্দেহে সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ একজন প্রাজ্ঞ কুশীলব, জীবনদর্শনের গভীরের অনুসন্ধানী নান্দনিক ও খান্দানি লেখক। এই উপন্যাসেও মানব জীবনের অন্তর্যন্ত্রণা ও সাহিত্য-শিল্পের খানদান মর্যাদার সঙ্গে বজায় রেখেছেন। ‘মায়ামৃদঙ্গ’ লোকনাট্য দলে অভিনেতা ‘সুবর্ণ’ মেয়েও নয়, ছেলেও নয়, আবার হিজড়াও নয়, সে এক মায়া। সুবর্ণের পুরুষের শরীরে নারীত্বের বিরাজ, মহামায়ায় আকৃষ্ট করে পুরুষকে। যেমনটি আমরা দেখেছি ‘পরিমল’ বাহ্যিক পুরুষ রূপের ভেতরে ‘পরি’ নারী সত্তার অবস্থান, ঠিক তেমনই। তার শরীর কেবল মহামায়া ও মায়ামৃদঙ্গ।
তবে ‘হলদে গোলাপে’র মতো এক্সক্লুসিভ এলজিবিটির দায়িত্ব নিতে পারেনি ‘মায়ামৃদঙ্গ’। বাংলা সাহিত্যে এক্সক্লুসিভ সমকামী বা এলজিবিটি জনগোষ্ঠীর জীবনীভিত্তিক কয়েকটি উপন্যাস আমাদের সংগ্রহ করা ও পড়ার সুযোগ হয়েছে। তিলোত্তমা মজুমদারের ‘চাঁদের গায়ে চাঁদ’ লেজবিয়ান চরিত্রের পাশাপাশি একটি চরিত্র গে-এর চিত্রিত হলেও সেটি শেষ পর্যন্ত জন্মগতভাবে গে-এর সহজাত যে বৈশিষ্ট্য সেগুলো সেভাবে পরিপুষ্ট হয়ে ওঠেনি। ফলে এই উপন্যাসে লেজবিয়ানের দাপট থাকলেও গে চরিত্রের তেমন দাপট লক্ষ করা যায়নি।
বাংলাদেশে এক্সক্লুসিভ যৌন-প্রান্তিক (হিজড়ে) জনগোষ্ঠী নিয়ে বিপ্লব দাসই মনে হয় প্রথম ‘কিমপুরুষ’ নামে একটি দুঃসাহসিক উপন্যাস লিখেছেন। সমাজের মানবদলিল এই গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাসটি প্রথম মুদ্রণের পর আর মুদ্রিত হয়নি। সাহিত্যবিষয়ক গবেষণার জন্য হলেও উপন্যাসটি অন্তত বাজারে থাকা দরকার ছিল। নাসিমা আনিসও হিজড়া জনগোষ্ঠীকে নিয়ে লিখেছেন ‘মোহিনীর থান (২০০৭)’ নামে একটি নাতিদীর্ঘ উপন্যাস। এই উপন্যাসটি ভালো মানের বিবেচনায় স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য। সেই যোগ্যতার অবশ্যই প্রমাণও মিলেছে। আজকের কাগজ পাণ্ডুলিপি পুরস্কার তিনি লাভ করেছেন এই উপন্যাসের মাধ্যমে। তবে মনে হয়, উল্লেখযোগ্য এই উপন্যাসটিও বাজারে নেই।
আল মাহমুদের ‘পুরুষ সুন্দর’ নাতিদীর্ঘ উপন্যাসে মেস জীবনের তিন নারী চরিত্রের মধ্যে লেজবিয়ান আচরণ উন্মোচিত হয় হালকা কিন্তু বিদঘুটেভাবে। একটি দৃশ্যে এক নারীর যোনির ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দেওয়ার মতো বীভৎস্য ঘটনা পাঠককে ভাবিত করে। একটা বয়সে অনেক নারী ও পুরুষ অবৈধ ও বিকৃত যৌনাচারে লিপ্ত হয়, বিভিন্ন উপায়ে যৌনতৃপ্তি লাভ করে। এ-রকমই তিন নারীর মধ্যে সাময়িক যৌন-সুখের চিত্র চিত্রিত হয়েছে। নারী চরিত্রের মধ্যে যেরূপ যৌনাচার প্রকাশিত হয়েছে, তাতে লেজবিয়ান চরিত্রের বায়োজলিক্যাল যেসব বৈশিষ্ট্য থাকে, তার কোনো কিছুই উল্লেখ নেই হেতু এই উপন্যাসের চরিত্রগুলোকে লেজবিয়ান বলা দুরস্ত নয়। হুমায়ূন আহমেদের ‘ঘেটুপুত্র কমলা’ সিনেমার কাহিনিতে মূলত হাওর অঞ্চলের ধনিক শ্রেণি কিছু মানুষের বিকৃত যৌন লালসার ঘটনা চিত্রিত হয়েছে। বর্তমান লেখকের ‘ঘাটুগান’ একটি প্রবন্ধে অসমর্থিত সূত্রের সমকামিতার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ২০১৯ সালে প্রকাশিত তাশরিক হাবিবের ‘ঝড়ের আগে ও পরে’ উপন্যাসেও বিমূর্ত শিল্পাচ্ছাদনে পুরুষের সমকামিতা ইমেজ পাওয়া যায়। তবে এই উপন্যাসের বিমূর্ত শিল্পের ভেতর থেকে যৌনতার ইমেজ দৃশ্যমান করতে কিংবা পাঠকের কল্পনার জগতে কতটা বিস্তার ঘটাতে পারবে, তা অবশ্যই জিজ্ঞাস্য। এই উপন্যাসের ভাষা উচ্চ মানের, কাহিনির বিন্যাস অনেকটা স্পাইরালের মতো প্যাঁচানো। ফলে সাধারণ পাঠকের কাছে গে চরিত্রটি উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পারে না বলে বিশ্বাস। এ-রকম যৌনতা মূলত বিকৃত মানসিকতারই ইতিবৃত্ত হলেও সমাজের বাস্তব ঘটনা তা বলার অবকাশ থাকে না। হলদে গোলাপে পরিষ্কার ভাষায় উল্লেখ রয়েছে একসঙ্গে সঙ্ঘবদ্ধভাবে বসবাসকারীদের মধ্যে সমকামিতা ঘটে থাকে। এমনকি সেনাবাহিনির ব্যারাকেও এই ঘটনা ঘটে তা উল্লেখ করতে লেখক কুণ্ঠাবোধ করেননি।
মনে রাখা দরকার যে, শরীর সৃষ্টিতে তাদের কোনো হাত নেই। সৃষ্টির রহস্যের কারণেই তাদের এমন আচরণ ঘটে থাকে। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান উন্নত হওয়াতে তাদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থাও করা যেতে পারে। একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে অনুভূত হয়—তাদের অন্তর্দহনের উত্তাপ মানবিক মানুষকে স্পর্শ করে।
বর্তমান লেখক ‘প্রান্তিকী’ পুরুষ সমকামী এবং ‘কুহলীকুহক’ নারী সমকামীদের নিয়ে দুটি উপন্যাস লিখেছেন। প্রান্তিকী ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়েছিল ২০০১ সালে এবং এর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৮ সালে। ‘প্রান্তিকী’ ও ‘কুহলীকুহক’ উপন্যাস দুটিও বাজারে নেই। প্রান্তিকী উপন্যাসটিতে ‘প্রান্তিক’ বা অন্ত্যজ কয়েকটি সমকামী চরিত্র নিয়ে রচিত হলেও দু-একটি হিজড়ে চরিত্র অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশে হিজড়ে ও সমাজের অন্তরালে লুকিয়ে থাকা গে জনগোষ্ঠীর পরিভাষা অনুসৃত হয়েছে এই গ্রন্থে। এদের বঞ্চিত ও লাঞ্ছিত জীবনের চিত্ররূপ প্রান্তিকীতে উপস্থাপিত হয়েছে। হলদে গোলাপে যেমন তাদের জনগোষ্ঠীর মধ্য থেকে কেউ দুলালীর লিঙ্গ কর্তন করে ঠিক তেমনই বাংলাদেশেও লিঙ্গ কর্তনের ঘটনা ঘটে অত্যন্ত গোপনে এবং অবৈজ্ঞানিক উপায়ে। যারা লিঙ্গ কর্তন করে, তাদের বাংলাদেশে বলা হয় ‘কাটিয়াল’। প্রান্তিকীও গবেষণাধর্মী ক্ষুদ্র পরিসরের একটি উপন্যাস। এই উপন্যাসে জামাল তার পারিকের (প্রেমিক) প্রতি এত গভীর প্রেমে পড়ে যে সে লিঙ্গারিত হতে বাধ্য হয় এবং সে মারা যায়। জামালের লিঙ্গান্তরের ঘটনাটি একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় উপন্যাসে উৎকীর্ণ হয়েছে, যা নিয়মিত শিউরে ওঠার মতো মর্মান্তিক ও নিষ্ঠুর ঘটনা। উপন্যাসটি শেষ হয় কেন্দ্রীয় চরিত্র সুমনের দীর্ঘশ্বাসের মধ্য দিয়ে। চারটি লেজবিয়ান চরিত্রকে উপজীব্য করে ২৪০ পৃষ্ঠার ‘কুহেলীকুহক’ উপন্যাসটি ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয় ২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসে। দুটি উপন্যাসের আলোচনা খোলামেলা নয়; বরং বলা যায় রেখে ঢেকে প্রতীকাশ্রয়ে করা হয়েছে।
সাইফুল বাতেন টিটো ‘বিষফোঁড়া’ নামে বিকৃত ও নির্যাতনমূলক সমকামী যৌনাচারের একটি উপন্যাস লিখেছেন, ‘জংশন’ প্রকাশনী থেকে ২০২০ সালে প্রকাশিত হয়। কওমি মাদ্রাসার হোস্টেল জীবনকে উপজীব্য করে এই উপন্যাসটি বাস্তব ঘটনার প্রেক্ষাপটে রচিত বলে লেখক দাবি করেন। এই উপন্যাসে সত্যিকার অর্থে, গে-সম্প্রদায়ের বায়োলজিক্যাল ত্রুটি অর্থাৎ ক্রোমোজমের ত্রুটি এবং ত্রুটিপূর্ণ হরমোন নিঃসরণের কারণে তাদের ভিন্নতর শারীরিক গঠন ও যৌনাচার তাদের জন্য অনিবার্য হয়ে পড়ে, এই উপন্যাসের চরিত্রে তা উন্মোচিত হয়নি। যেমনটি উন্মোচিত হয়েছে ‘হলদে গোলাপে’। এই উপন্যাসে বস্তুত বিকৃত যৌনাচারই চিত্রিত হয়েছে। উপন্যাসটি কয়েক মাস বাজারে ছিল, তারপর সরকার এটিকে বাজেয়াপ্ত করে। এই শতকের শুরুর দশকে বাংলাদেশে ‘শিখণ্ডি’ নামে একটি মঞ্চনাটক লিখিত ও মঞ্চস্থ করেছে একটি নাট্যদল। এই নাটকটিতে মূলত হিজড়াদের যাপিত জীবন, সমাজের অবহেলা ও লাঞ্ছনা, পাথরদেয়াল ঘেরা নির্বাসিত জীবনের অন্তর্দহনের করুণ কাহিনি নির্মিত হয়েছে।
হিজড়া সমাজ নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতে বেশ কিছু ডকুমেন্টারি গ্রন্থ রচিত হয়েছে। তন্মধ্যে উল্লেখয্যেগ্য, অজয় মজুমদার ও নিলয় বসুর ‘ভারতের হিজড়ে সমাজ’, নীহার মজুমদারের ‘হিজড়ে সমাজ-মানবিক অনুসন্ধান’। যৌনকর্মী নিয়ে রচিত সুবোধ দাসের ‘চলমান যৌনকর্মী’ (প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড)। শিবতোষ ঘোষের যৌনদাসীদের নিয়ে একটি দুঃসাহসিক ডকুমেন্টারি উপন্যাস ‘রক্ষিতাপুর’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এসব গ্রন্থে উন্মোচিত হয়েছে সমাজের ফাঁক-ফোঁকরে লুকিয়ে থাকা মানুষের অমানবিক মর্মন্তুদ আর্তনাদ। অভিজিৎ রায়ের ‘সমকামিতা: একটি বৈজ্ঞানিক এবং সমাজ-মনস্তাত্তিক অনুসন্ধান’ নামে একটি গবেষণা গ্রন্থ শুদ্ধস্বর থেকে ২০১০ সালে প্রকাশিত হয়েছিল এবং এর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল ২০১২ সালে। এই গ্রন্থটি বিজ্ঞানমনস্ক মানুষকে সহজেই আকৃষ্ট করতে পারে। লেখক এই গ্রন্থে সমকামিতার শরীরবৃত্তীয় বৈজ্ঞানিক কারণগুলো ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিভিন্ন গবেষণার ফল বিশ্লেষণ করেছেন।
ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নারী-পুরুষের বৈধ যৌনাচার ব্যতিত বাকি সব যৌনাচারই পাপ হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু এলজিবিটি দলের সদস্যরা যে আচরণ করে তা নেহায়তই শরীরবৃত্তীয় কারণে। এই গ্রন্থগুলো পড়লে মনে হয় আমাদের চারপাশে বসবাসরত প্রান্তিক মানুষের আর্তনাদের স্রোতে ভেসে যায় বহুত্ববাদ, মানবিক মূল্যবোধ, মানবাধিকারের তথাকথিত চাকচিক্য ফেস্টুন-ব্যানার।
লেখকরা সমাজের রাডার এবং তাদের অন্তর্দৃষ্টির রাডারে সমাজের গোপন কিংবা প্রকাশ্যে সংঘটিত ঘটনা ধরা পড়ে। প্রাচীন সাহিত্যে সমাজের অভিজাত শ্রেণির মানুষের ভূমিকা চিত্রিত হলেও সময়ের বিবর্তনে অন্ত্যজ জনগোষ্ঠী সাহিত্যের মঞ্চে দাপুটে ভূমিকায় সিদ্ধি লাভ করে। ফলে, আধুনিক সাহিত্যে মানুষের জীবনের কথা অকপটভাবে বিধৃত হচ্ছে। লরন্সের ‘লেডিজ চ্যাটার্জির লাভার’ ১৯২৮ সালে প্রকাশিত হলেও সেই উপন্যাস অশ্লীলতা ও পরকীয়া প্রেমের জন্য নিন্দিত এবং নিষিদ্ধ। তবু ১৯৬০ সালে সেটি প্রকাশ্যে আলোর মুখ দেখে এবং মানুষ এই উপন্যাসকে গ্রহণ করেছে।
সমরেশ বসুর ‘প্রজাপতি’ অশ্লীলতার দায়ে নিন্দিত ও নিষিদ্ধ হয়েও পরে কয়েক বছর মামলা মোকদ্দমার বইটি উন্মুক্ত হয়। সময় মানুষের চিন্তা-চেতনা, দৃষ্টিভঙ্গি এবং আধুনিকতা গ্রহণ করার মানসিকতা থেকে হয়তো সাহিত্যে বিধি-নিষেধ শিথিল হয়েছে। হারুকি মোরাকামির ‘নরওয়েজিয়ান উড’ কিংবা কেইনের ‘দ্য ভেজেটেরিয়ান’ উপন্যাসে কিন্তু যৌনতা বা অশ্লীলতা কম নয়। বাংলা সাহিত্যে হুমায়ুন আজাদের ‘ছাপান্ন হাজার বর্গমাইল’ এবং মনি হায়দারের ‘সুবর্ণ সর্বনাশ’ উপন্যাস দুটিতে অশ্লীল শব্দের অনেক ব্যবহার থাকলেও এগুলো সে অর্থে নিন্দিত হয়নি। আধুনিক সাহিত্যে চরিত্র নির্মাণের জন্য অত্যাবশ্যকীয় প্রপস ও কস্টিউমের মতোই চরিত্রের ঘনিষ্ট আচরণ এবং প্রেক্ষাপট বিবেচনায় সংলাপ অনেক সময় পাঠকের কাছে অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত হয়। তবে, প্রকৃত চরিত্র নির্মাণ করতে গেলে বাস্তবতার আলোকে অশ্লীলতা অগ্রহণযোগ্য হওয়ার উপায় কী? ‘ন ডরাই’ সিনেমায় ‘ছুদানির ফোয়া’ শব্দ দুটি কতবার এসেছে তা বলাই মুশকিল। কিন্তু এই শব্দ বা শব্দগুচ্ছ যে ওই চরিত্রগুলোর মুখের কথা, তাদের বুলি। এই সংলাপ ছাড়া ওই চরিত্রগুলো সত্যিকার অর্থেই বিকশিত হতো কি না, যথেষ্ট সন্দেহ থেকে যায়। লেখকরা সত্যকে উদঘাটন করেন, তারা বাস্তবতাকে চিত্রিত করেন শব্দের ক্যানভাসে।
হিজড়া ও সমকামী পুরুষ ও নারীদের প্রতি সমাজের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি এখন পর্যন্ত অত্যন্ত নেতিবাচক এবং তারা সমাজের স্বাভাবিক মানুষ কর্তৃক নিন্দিত, নির্যাতিত ও বঞ্চিত। দুই দশক আগেও আমাদের সমাজের মানুষের এ-রকম নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধীদের প্রতিও ছিল। তাদের প্রতি ছিল অবহেলা, লাঞ্ছনা, নির্যাতন এবং ঘৃণা। শুধু সমাজের কেন, নিজ পরিবার থেকেও মানবিক আচরণ তারা পেত কি না, সন্দেহ থেকে যায়। কিন্তু এই মনোভাবের অনেক পরিবর্তন হয়েছে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি এবং প্রতিবন্ধীদের শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থার মাধ্যমে। আমাদের বিশ্বাস এলজিবিটি সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতি সমাজের যে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে সেই ট্যাবুও দূর করা জরুরি। তাদের জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত শিক্ষা ও কর্মসংস্থান। মনে রাখা দরকার যে, শরীর সৃষ্টিতে তাদের কোনো হাত নেই। সৃষ্টির রহস্যের কারণেই তাদের এমন আচরণ ঘটে থাকে। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান উন্নত হওয়াতে তাদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থাও করা যেতে পারে। একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে অনুভূত হয়—তাদের অন্তর্দহনের উত্তাপ মানবিক মানুষকে স্পর্শ করে।