ট্রাভেল শব্দের উৎপত্তি আদি ফরাসি শব্দ ‘ট্রাভেইল’ থেকে। মেরিয়াম ওয়েবস্টার ডিকশনারি অনুযায়ী, ভ্রমণ শব্দের ব্যবহার শুরু হয় ১৪ শতকের দিকে। ভ্রমণলেখক মাইকেল ক্যাজুম লিখেছেন, ‘স্বাভাবিক ট্যুরিস্ট বা ভ্রমণকারী আর সত্যিকারের পুরো পৃথিবী চষে বেড়ানো ট্রাভেলার বা ভ্রমণকারীর মধ্যে একটা বড়সড়ো পার্থক্য আছে।’ সেটা বোঝা যায়, আসলে ভ্রমণগদ্য পড়েই। আর এই ভ্রমণগদ্যের মাধ্যমেই গড়ে উঠেছে ভ্রমণসাহিত্য। জনপ্রিয় কিছু ভ্রমণসাহিত্য পড়ে পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত ঘুরে আসার স্বাদ পাওয়া যেতে পারে। কল্পনায় ঘুরে আসা যায় অ্যামাজনের গহীন জঙ্গল, তারাভরা আকাশের নিচে সাহারা মরুভূমি, নীলগিরি-নীলাচলের আকাশচুম্বী পাহাড়-পর্বত।
সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভ্রমণ যেমন উপভোগ্য হয়ে উঠছে; তেমনই ভ্রমণসাহিত্যও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। প্রতিবছর বেশকিছু ভ্রমণকাহিনি প্রকাশিত হতে দেখা যায় বইমেলায়। বিক্রিও আশাব্যঞ্জক বলে দাবি করেছেন প্রকাশকরা। তারাও আগ্রহী ভ্রমণসাহিত্য প্রকাশ করতে। তবে মানসম্পন্ন পাণ্ডুলিপি পাওয়া কঠিন বলে মনে করেন তারা। এছাড়া দৈনিক বা ওয়েবগুলোতেও ভ্রমণকাহিনি চোখে পড়ে। তার পাঠকও আশাব্যাঞ্জক। কারণ যুগে যুগে কিছু ভ্রমণকাহিনি বিখ্যাত, জনপ্রিয় বা পাঠকপ্রিয়ও হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় সমকালে পাঠকপ্রিয় ভ্রমণলেখক হয়ে উঠেছেন লেখক ও সাংবাদিক উদয় হাকিম।
তার লেখা ভ্রমণকাহিনি প্রথম পড়ি অনলাইন পত্রিকায়। এরপর একে একে তিনটি বই হাতে আসে। এরমধ্যে একটি বই প্রকাশ হয় ২০১৭ সালে। বইটির নাম ‘সুন্দরী জেলেকন্যা ও রহস্যময় গুহা’। ভিয়েতনামের এক জেলেকন্যার উপকাহিনি স্থান পেয়েছে বইটিতে। এছাড়া ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়ার বালি ও মালদ্বীপের ওপর লেখা কয়েকটি ভ্রমণকাহিনি নিয়ে এ বই। বলতে গেলে সৌন্দর্যের সাবলীল বর্ণনা এটি। উদয় হাকিম গতানুগতিক ভ্রমণকাহিনি লিখতে চাননি। ভারী কথা আর ইতিহাস তুলে আনতে চাননি। তিনি গল্পের মতো করে কাহিনি বলার চেষ্টা করেছেন।
বইটিতে ১১টি শিরোনামে ভ্রমণের কাহিনি তুলে ধরা হয়েছে—
১. হ্যানয়, ভিয়েতনাম এবং বাংলাদেশ
২. হ্যানয় থেকে হা লং বে
৩. হা লং বে: যেসব কারণে অনন্য
৪. ‘নয়নে আমার বিধি কেন পলক দিয়াছে’
৫. সুন্দরী জেলেকন্যা, রহস্যময় গুহা
৬. ভিয়েতনামযুদ্ধ এবং ভাস্কর্যকথন
৭. বালি এবং বাতাসের গল্প
৮. বিষ্ণু রাম সীতা—সাগর পাহাড়ের মিতা
৯. তানহা লট ও নুসা দুয়া
১০. লালচে বালি, ফেনিল ঢেউ
১১. মালদ্বীপে ২৪ ঘণ্টা।
শিরোনাম পড়েই অনুমান করা যায় ভেতরের ঐশ্বর্য সম্পর্কে। কারণ ঝরঝরে গদ্য লেখায় পারদর্শী উদয় হাকিম। তার ভ্রমণগদ্য পাঠককে আকৃষ্ট করেছে বরাবরই। লেখার সঙ্গে প্রাসঙ্গিক ছবিও পাঠককে মুগ্ধ করে। বইটিতে ষাটটিরও বেশি ছবি স্থান পেয়েছে।
সাদা ফেনার মতো জলগুলো ঝলসে উঠছে। নৌকা বা জাহাজ সেখানে ভেড়া মুশকিল। পাথরে আটকে বা জোরে আঘাতে ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
সাবলীল ভঙ্গিতে গল্প বলে যান উদয় হাকিম। কোনো রাখঢাক নেই। বাহুল্য নেই বর্ণণায়। নেই ঘটনার ঘনঘটা। লেখকের ভাষায়—‘ভিয়েতনাম যাচ্ছি। কুয়ালালামপুর হয়ে হ্যানয়। এরপর হ্যানয় থেকে হা লং বে। একটা কাগজ ছিল সঙ্গে। ভিয়েতনাম ইমিগ্রেশনের চিঠি। আমাদের চারজনের নাম, পাসপোর্ট নম্বর, সিল-ছাপ্পর ছিল। হ্যানয় গেলে ভিসা স্ট্যাম্পিং হবে। যথারীতি আটকে গেলাম। আবার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার হস্তক্ষেপে পার পেলাম।’
তার স্থানের বর্ণনা এমন—
‘মালে’তে গাছপালা নেই বললেই চলে। এয়ারপোর্ট পুরোটা বৃক্ষহীন। হুলোমালে ঠিক বিপরীত। আছে নারকেল গাছ, রেইনট্রিসহ বড় বড় গাছ। সবুজ দ্বীপ। উত্তরপাশে কিছু জঙ্গলও আছে। পরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠছে জায়গাটি। মালে অনেকটাই এলোমেলো। তার তুলনায় এই দ্বীপ সাজানো-গোছানো। দূর থেকেই আকর্ষণ করে। অভিজাত এলাকা। আমাদের দেশের গুলশান বনানীর মতো।’
উদয় হাকিমের লেখায় ইতিহাস, ভূগোল, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি উঠে আসে সাবলীলভাবে। কয়েকটি উদাহরণ দিলে পাঠকের বুঝতে সহজ হবে। যেমন—
ইতিহাস: ভিয়েতনাম যুদ্ধে প্রয় ৬০ হাজার আমেরিকান সৈন্য মারা গেছে। পঙ্গু এবং আহত হয়েছে আরও সাড়ে তিন লাখ। যদিও ভিয়েতনামের লোক মারা গেছে প্রায় ২০ লাখ। (পৃষ্ঠা ৫৫)
ভূগোল: ভিয়েতনাম আমাদের চেয়ে প্রায় তিনগুণ বড়। লোকসংখ্যা ৯ কোটি। (পৃষ্ঠা ১৩)
ঐতিহ্য: অনেকটা পথ হেঁটে মন্দিরের প্রবেশপথে পৌঁছি। সেখানে সবাইকে আলগা একখণ্ড কাপড় দেওয়া হয়। সেটা কোমরে পেঁচিয়ে মন্দিরে প্রবেশ করতে হয়। (পৃষ্ঠা ৬৯)
সংস্কৃতি: শুরুতেই একদল লোক এসে গোল হয়ে বসে। ছা-ছা শব্দ করতে করতে তাদের প্রবেশ। বসেও কেবল ‘ছা ছা ছা ছা’ শব্দ করছে। এটা কেন? এটা হচ্ছে প্রাকৃতিক মিউজিক। (পৃষ্ঠা ৭৬)
অর্থনীতি: পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা দ্বীপ। এলাকা ভাগ করা। আবাসিক, হোটেল-রিসোর্ট, কমার্শিয়াল, শিল্প-কারখানা সবই আছে। (পৃষ্ঠা ১০০)
রাজনীতি: ১৯৭৮ সালে ক্ষমতায় আসেন মালদ্বীপের সবচেয়ে বেশি সময় রাজত্ব করা রাষ্ট্রপতি মামুন আব্দুল গাইয়ূম। নাসিরের সময় থেকেই রাজনৈতিক দলাদলি শুরু হয়। (পৃষ্ঠা ১০৯)
এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, বইটিতে এমন কোনো বিষয় নেই; যা উদয় হাকিম তুলে আনেননি। এই ভ্রমণকাহিনি পড়তে পড়তে পাঠক সব বিষয়ের স্পর্শ পাবেন। জানাশোনার পরিধি বাড়াতে পারবেন।
উদয় হাকিমের আরেকটি ভ্রমণকাহিনি ‘রহস্যময় আদম পাহাড়’ । বইটি পড়তে পড়তে যেন হারিয়ে যাচ্ছিলাম আদম পাহাড়ের আনাচেকানাচে। যেন পিছু পিছু হাঁটছিলাম লেখকের। ছুঁয়ে দেখছিলাম ঝরনার জল। পাথরের কাঠিন্য যেন আমাকেও শক্ত হতে সাহায্য করছে। বইয়ের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় তার জীবন্ত বর্ণনা, ভাষার সারল্য আমাকে মুগ্ধ করেছে। পাহাড়ি পথ, বয়ে চলা নদী, বৃষ্টির মতো ঝরনার শব্দ, পাহাড়ি শিশু, ক্রিকেট খেলা, দোকানপাট চোখের সামনে যেন জ্বলজ্বল করছে। একজন প্রকৃত লেখকের গুণ বা বৈশিষ্ট্য এমনই হওয়া দরকার।
বইটিকে লেখক আঠারো পরিচ্ছদে ভাগ করেছেন। প্রত্যেক পরিচ্ছদই মনে হবে স্বতন্ত্র। আবার শেষে গিয়ে একটি পূর্বোক্ত বা শেষোক্ত টান বা মিল খুঁজে পাবেন। তার নিষ্কণ্টক বর্ণনাভঙ্গি পাঠককে টেনে নিয়ে যাবে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা। সবশেষে গিয়ে হয়তো মনে হবে ‘শেষ হয়েও হলো না শেষ।’ যেমন—
১. আদম পাহাড়ে যাত্রা
২. অ্যাডামস পিকের পথে
৩. দুর্গম পাহাড়ে ওঠার আগে রেকি
৪. আদম কেন অ্যাডামস পিকে নেমেছিলেন?
৫. মধ্যরাতে অচেনা পাহাড়ে
৬. শেষরাতে পাহাড় চূড়ায়
৭. সামিট করার মুহূর্তে ব্যাড লাক!
৮. আদম পাহাড়ে যেতে হবে পূর্ণিমা রাতে!
৯. আদমের পায়ের ছাপ নিয়ে ভ্রান্তিবিলাস!
১০. চোখের সামনে উদ্ভাসিত অ্যাডামস পিক!
১১. নামার পথ কখন শেষ হবে?
১২. নেশার ঘোরে নামছিলাম
১৩. ফিরে ফিরে দেখছিলাম অপরূপ অ্যাডামস পিক
১৪. রহস্যেঘেরা অ্যাডামস ব্রিজ
১৫. ওনাবাতুনা- পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সমুদ্রসৈকত
১৬. ওনাবাতুনা- পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সমুদ্রসৈকত-২
১৭. গল ফোর্ট: শ্রীলঙ্কার আকর্ষণের কেন্দ্রস্থল
১৮. গল ফোর্ট : ঐতিহাসিক ব্যতিক্রমী দুর্গ।
অর্থাৎ এসব শিরোনাম দেখেই পড়তে যেন লোভ হয়। একবার পড়া শুরু করলে শেষ না করে আর উঠতে মন চাইবে না। বলতে গেলে, দৃষ্টিশক্তি তো সবারই আছে। তবে দেখে এমন নিখুত বর্ণনা করার শক্তি সবার নেই। ফলে ‘রহস্যময় আদম পাহাড়’ সারাজীবন ভ্রমণপিপাসুদের তৃষ্ণা মেটাবে।
আদম পাহাড় কী? লেখক বলেছেন, ‘আদম পাহাড়। অ্যাডামস পিক। আদম (আ.)-কে যেখানে নামানো হয়েছিল সেটাই অ্যাডামস পিক। শ্রীলঙ্কার ওই পাহাড়টি এখন রীতিমতো বিখ্যাত জায়গা।’ আদম পাহাড়ে নাকি আদমের পায়ের ছাপ রয়েছে। সেই পায়ের ছাপ দেখতেই হয়তো মানুষ এত কষ্ট করে যায় সেখানে। এছাড়া পাশেই আছে আদম সেতু। যে সেতু দিয়ে পার হয়েছিলেন আদম (আ.)। মূলত আদম পাহাড় শ্রীলঙ্কার মাঝামাঝি একটি জায়গা।
লেখকের ভাষায়, ‘রাজধানী কলম্বো থেকে অ্যাডামস পিকের দূরত্ব প্রায় ১৫০ কিলোমিটার। চারদিকে পাহাড় ঘেরা, পর্বতশ্রেণি বলা চলে। আদমের পায়ের ছাপ দেখার জন্যই অ্যাডামস পিক বা আদম পাহাড়ের চূড়ায় যান সবাই।’ এখন প্রশ্ন হতে পারে, আদমের পায়ের ছাপ কেমন? এ প্রশ্নেরও জবাব পাওয়া যায় এভাবে, ‘এটি আসলে পাথরের উপর এক ধরনের অঙ্কন! কঠিন শিলার উপর আবছা কিছু দাগ। লোকজন সেটাকে পায়ের ছাপ মনে করেন। ওই ছাপটি অনেক বড়। দৈর্ঘ্য ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি (কেউ বলে ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি), প্রস্থে ২ ফুট ৬ ইঞ্চি। আদম (আ.) নাকি ৬০ গজ লম্বা ছিলেন। অর্থাৎ ১৮০ ফুট। কেউ অবশ্য বলেন ৬০ ফুট লম্বা ছিলেন।’
তবে, আদম পাহাড়ের ইতিহাস নিয়ে নানা রকম ঘোলাটে তথ্য রয়েছে। কোনটা ঠিক, বোঝার উপায় নেই। বলা হয়, ১৮৫১ সালে আরবের সোলায়মান নামে এক পর্যটকের চোখে এ পদচিহ্ন প্রথম ধরা পড়ে। তবে ১৫০৫ সালে পর্তুগিজ এক পর্যটক এ চূড়ার নাম দেন ‘পিকুডি অব আদম’। অর্থাৎ ‘আদম চূড়া’। তার আগে স্থানীয় ভাষায় এর নাম ছিল ‘সামান্থাকুটা’। যার অর্থ ‘ভোরের উদীয়মান সূর্য’। ওই উঁচু জায়গা থেকে সবার আগে সূর্য দেখা যায় বলে এমনটা বলা হয়। কিংবা সূর্য সবার আগে শ্রীলঙ্কায় এ পাহাড়কে সাক্ষাৎ দেয়—এ জন্যই হয়তো এ রকম নামকরণ হতে পারে।
আসলে আদম পাহাড় নিয়ে বিভিন্ন ধর্মের ভিন্ন ভিন্ন বর্ণনা রয়েছে। সব বিষয়েই লেখক আলোকপাত করেছেন। বইটি পড়ে মনে হচ্ছে, আদম পাহাড় ভ্রমণ ছাড়াও এর প্রকৃত ইতিহাস জানতে লেখককে অনেক পড়তে হয়েছে। বিভিন্ন ধর্মের বৃত্তান্তও তার আয়ত্তে আনতে হয়েছে। ভ্রমণ করতে করতে লেখক নিজেও কিছু প্রশ্ন করেছেন। যার সমাধান হয়তো কেউ দিতে পারবে না। এমনকী লেখক তো নয়ই। ধর্মীয় সেসব অমীমাংসিত বিষয় নিয়ে আলোচনার চেয়ে শ্রীলঙ্কার এ অঞ্চলের প্রকৃতি, বাতাস, জল, পাথর, বানর বা হনুমান নিয়ে আলোচনা করাই শ্রেয়। লেখক মূলত সেটাই করেছেন। ভ্রমণকাহিনিকে ভ্রমণের মতোই উপস্থাপন করেছেন।
আদম পাহাড়ে উঠতে হয় রাতের অন্ধকারে। তাই শুরু করতে হয় মাঝরাত থেকে। কারণ উঠতে উঠতে ভোরের সূর্যোদয় দেখা যায়। প্রায় ঘণ্টা তিনেকের বেশি সময় লাগে উঠতে। তবে ওপরে ওঠা মোটেও সহজ কাজ নয়। শারীরিক এবং মানসিক শক্তি দরকার। কারণ রাতের অন্ধকারে ঘন জঙ্গল, গাছপালা- সব মিলিয়ে অজানা একটা পরিবেশ। তবে রাতের বেলা কোন ভয়ঙ্কর জীবজন্তু চোখে পড়ে না এখানে। তাছাড়া ভয়ঙ্কর কিছু নেইও মনে হয়। তবে শান্তশিষ্ট কিছু বানর আছে। তারা উঁচু ভূমিতে নয়; থাকে লোকালয়ে। যেখানে সহজে খাবার পাওয়া যায়। বলে রাখা ভালো, এসব দেখতে আদম পাহাড় ভ্রমণে লেখকের সঙ্গী ছিলেন তার সহকর্মী ফিরোজ আলম আর মিলটন আহমেদ। তাদের সঙ্গও লেখককে উজ্জীবিত করেছে। কেননা একা একা ভ্রমণ কখনো মজার হয় না। সেটা পাহাড়ে ওঠা-নামা সম্পর্কে লেখকের বর্ণনাতেই অনুমান করা যায়। লেখক বলেন, ‘ওঠার সময় যেমন কষ্টে বুক ফেঁটে যাচ্ছিলো, নামার সময় তার বিপরীত। মাধ্যাকর্ষণ শক্তি ঠেলে ঠেলে নামাচ্ছিলো। যেন সেই দৌড়!’
বইটি পড়তে পড়তে মনে হলো—উদয় হাকিমের বর্ণনা পাহাড়ি ঝরনার মতোই কলকল করে এগিয়ে যায়। ঝরনার জলের মতোই স্বচ্ছ ও টলটলে। লেখকের বর্ণনা ঠিক এ রকম, ‘গাড়ি যাচ্ছিল পূর্ব-দক্ষিণ কোণে। যতই ভেতরে যাচ্ছিলাম ততই জঙ্গল আরো গভীর হচ্ছিল। ধীরে ধীরে টিলা থেকে পাহাড়ে প্রবেশ করছিলাম। দুপাশে ঘন অরণ্য। আবার কখনো এক পাশে পাহাড়, আরেক পাশে খাঁদ। ধীরে ধীরে জনমানবের চিহ্ন কমে আসছিল। রাস্তায় ছিল বিপজ্জনক বাঁক। রাস্তার পাশ দিয়ে নেমে যাচ্ছিল ঝর্ণা। জলের কূলকূল ধ্বনি, পাখির ডাক, ঘণ অরণ্য- সব মিলিয়ে দারুণ অ্যাডভেঞ্চার।’ কোনো কিছুই যেন তার চোখ এড়ায় না। কোনো শব্দই যেন দুর্বোধ্য নয়। ভ্রমণকাহিনি যেন এভাবেই লিখতে হয়। তা কাহিনি বর্ণনায়, শব্দচয়নে, বাক্যগঠনে, উপমা প্রয়োগে যথাযথভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন।
বইটিতে আদম পাহাড় ছাড়াও শ্রীলঙ্কার ঐতিহাসিক ব্যতিক্রমী দুর্গ ‘গল ফোর্ট’ ও পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সমুদ্রসৈকত ‘ওনাবাতুনা’র বর্ণনা রয়েছে। গল দুর্গ সম্পর্কে লেখক বলেছেন, ‘শ্রীলঙ্কার গল দুর্গ সেই তুলনায় অন্যরকম। সেখানে জমিদার বা রাজাবাদশাহ কেউ থাকতেন না। দখলদারদের একজন প্রতিনিধি থাকতেন। সে-ও বাণিজ্য প্রতিনিধি। একভাগে স্থল থাকায় উত্তর দিকটা কিছুটা বেশি সুরক্ষিত ছিল। যাতে স্থল হামলা সহজেই মোকাবিলা করা যায়। এছাড়া তিন দিকে জল থাকায় পাহারা দিতে সুবিধে হতো। খালি চোখে অথবা দূরবিনে সব দৃশ্যমান হতো।’ ইতিহাসে বর্ণিত অন্যসব দুর্গের চেয়ে এটি বিভিন্ন কারণেই ব্যতিক্রম। তা হয়তো বইটি পড়লেই বুঝতে পারবেন। এছাড়া ওনাবাতুনা সম্পর্কে লেখক জানান, ‘অন্য সমুদ্রসৈকতের চেয়ে এর কিছুটা আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে। দূরে দেখা যাচ্ছিলো বিশাল পাথরের খন্ড। সেখানে ঢেউগুলো বাড়ি খাচ্ছে। সাদা ফেনার মতো জলগুলো ঝলসে উঠছে। নৌকা বা জাহাজ সেখানে ভেড়া মুশকিল। পাথরে আটকে বা জোরে আঘাতে ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই হালকা স্পিডবোট চলে বেশি।’ ফলে এ কথা স্পষ্ট যে, বিশ্বজুড়ে এই আলাদা বৈশিষ্ট্যের জন্যই খ্যাতি আছে ওনাবাতুনা সমুদ্রসৈকতের।
কাঞ্চনজঙ্ঘাসহ হিমালয়ের নিকটবর্তী কিছু চূড়া দেখা যায় এই লুপ থেকে। বাতাসিয়া লুপ এবং ঘুম রেল স্টেশন এখন ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের অংশ। আর ঘুম মনেস্ট্রি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয়।
আর ঠিক এভাবেই যেন ক্রিকেট টুর্নামেন্ট, শ্রীলঙ্কা সফর, আদম পাহাড়, আদম সেতু, দুর্গ ও সৈকত—সব কিছুই মোহনীয় হয়ে ওঠে উদয় হাকিমের কলমের জাদুতে। তাই তো ‘রহস্যময় আদম পাহাড়’ বাংলা ভ্রমণসাহিত্যের অমূল্য সম্পদ হয়ে থাকবে। কারণ উদয় হাকিম লেখক-সাংবাদিক-করপোরেট ব্যক্তিত্ব। ভ্রমণ তার নেশা। পাশাপাশি ভ্রমণকালে ছবি তুলে রাখা, ভ্রমণ শেষে লেখার মাধমে পাঠকের সামনে তুলে ধরা তার মহতি উদ্যোগ। এ উদ্যোগেও তিনি সফল। তার একেকটি ভ্রমণকাহিনি হয়ে ওঠে একেকটি ভ্রমণ উপন্যাস। কাহিনি বর্ণনা, শব্দচয়ন, বাক্যগঠন, ইতিহাস-ঐতিহ্য বর্ণনা মিলেমিশে একটি অসাধারণ চিত্রকল্প ফুটে ওঠে পাঠকের সামনে।
তার এবারের ভ্রমণ কাহিনি দার্জিলিং ও কালিম্পং নিয়ে। যেগুলো প্রতিবেশী দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দুটি শহর। শহর দুটির অজানা অনেক গল্প নিয়ে লেখা ‘দার্জিলিঙে বৃষ্টি, কালিম্পঙে রোদ’। বইটি চৌদ্দটি পর্বে বিন্যস্ত। এগুলো হলো:
১. সড়ক পথে ঢাকা থেকে শিলিগুড়ি
২. পৌঁছলাম স্বপ্নের দার্জিলিং
৩. দার্জিলিংয়ের পিস প্যাগোডা, রক গার্ডেন
৪. দার্জিলিংয়ের চা বাগান আর জুলজিক্যাল পার্ক
৫. দার্জিলিংয়ের আইনক্স
৬. দার্জিলিং: অদম্য ক্ষমতার অধিকারী, বজ্রপাতের শহর
৭. বাতাসিয়া লুপ
৮. ঐতিহাসিক ঘুম রেল স্টেশন
৯. লামাহাট্টা এবং ত্রিবেণী
১০. কালিম্পং-এর পাইন ভিউ ক্যাকটাস নার্সারি
১১. কালিম্পং: জীবন খুঁজে পাবি ছুটে ছুটে আয়
১২. কালিম্পং-এ কাঞ্চনজঙ্ঘা
১৩. রবীন্দ্রনাথ এবং গৌরীপুর হাউজ
১৪. তিস্তা দর্শন।
উদয় হাকিমের এই বইয়ে ভ্রমণের শুরুতেই উঠে এসেছে তার ছেলেবেলার গল্প। লেখক বলেন, ‘শুনতাম ব্রিটিশ আমলে ইংরেজরা দার্জিলিংয়ে থাকতে পছন্দ করতেন। ইংল্যান্ডের আবহাওয়ার সঙ্গে এর অনেকটা মিল আছে। ঠাণ্ডা, এই রোদ, এই বৃষ্টি। চা বাগান। ছায়া গাছ। শান্ত সুবোধ পাহাড়ি জনপদ। সুখী, সমৃদ্ধ নির্ভেজাল জীবনযাপন। সহজ সরল মানুষ। ছিমছাম নিরাপদ জনপদ।’
সেসব শুনে শুনেই লেখকের মনের মধ্যে একটা দুর্নিবার ইচ্ছা জাগে-দার্জিলিংয়ে যাবেন। অবেশেষে সেই সুযোগও আসে। আসলে মানুষ তার স্বপ্নের চেয়েও বড়। ছেলেবেলার সেইসব স্বপ্ন অবশেষে ধরা দিলো হাতের মুঠোয়। আর সেই সুযোগ করে দিলো কর্পোরেট ক্রিকেটে ওয়ালটন অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়ে। এর আগের বছর চ্যাম্পিয়ন হয়ে পুরো টিম গিয়েছিল ভুটান। এবার চ্যাম্পিয়ন হয়ে দার্জিলিং।
এবার উদয় হাকিমের সফরসঙ্গী শাকিল, আলভি, ফিরোজ আলম, নুরুল আফসার চৌধুরী, এস এম জাহিদ হাসান, মামুন, মিল্টন, জাহিদ আলম, মিজান, সোহাগ, সাহেল, জনি সাইফুলসহ ১৫ জন। কিছুসময় ড্রাইভার মদুল সওদাগর, যিনি ভারতীয় মুসলমান। তার পূর্বপুরুষ বাংলাদেশের। চাচারা এখনো বাংলাদেশে থাকেন। এছাড়া স্থানীয় গাইড পার্থ বাসনেত। তাদের ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে দার্জিলিং ও কালিম্পংয়ের কাহিনি।
ভ্রমণকাহিনিতে তিনি প্রাসঙ্গিক অনেক গল্প তুলে ধরেছেন। যা কাহিনির মজা আরও বাড়িয়ে তোলে। পাশাপাশি স্থানের ইতিহাস-ঐতিহ্য, ভূগোল-অর্থনীতি; কোনোটাই বাদ পড়ে না। কখনো কখনো তুলনামূলক আলোচনাও পাঠককে অনেক কিছু জানতে সহায়তা করে। লেখক যেভাবে বলেন, ‘দার্জিলিং নামটা শুনলেই সবার আগে আসে চায়ের কথা। চা বাগানের কথা। চোখ বুঁজে দেখতে পাই বিস্তীর্ণ চা বাগান। ছায়া গাছ। শান্ত শীতল প্রকৃতি।’
দার্জিলিং সম্পর্কে বলতে গিয়ে লেখক আরও বলেছেন, ‘এটুকু অন্তত বুঝলাম, দার্জিলিং মোটেও সমতল কোনো শহর নয়। বিশাল পাহাড়ের গায়ে শত শত বাড়ি ঘর।’ অন্যত্র বলেছেন, ‘রাতের দার্জিলিং! সত্যিই অপরূপ! দেখেছিলাম আগের রাতে। মিরিকের দূর পাহাড় থেকে। যেন আঁধার রাতে হাজারো জোনাকির নাচন। আরও কাছ থেকে মনে হয়েছিল পাহাড়ের গায়ে আলোর দেয়ালী। সে এক অন্যরকম সৌন্দর্য। দূর থেকে শুধু উপভোগ করা যায়। তার কোনো ভাষা নেই। অবর্ণনীয়।’
দিনের শেষে তিনি ভ্রমণকাহিনি লিখে রাখেন। তাই তো তার ভ্রমণকাহিনি পড়লে এমন কোনো প্রশ্ন নেই, যার উত্তর আপনি খুঁজে পাবেন না। কখনো কখনো দারুণ রসিকতাও করেন। মজার মজার অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন। তিনি জানান, দার্জিলিং ভ্রমণ করবেন অথচ চা বাগানে যাবেন না! তা তো হয় না! তাই তো চা কেনার অভিজ্ঞতা জানালেন এভাবে, ‘কেজি দুয়েক চা নিলাম। আমার কেনা দেখে যেন হামলে পড়লো হুজুগে বাঙালি। টিমের প্রায় সবাই চা কেনা শুরু করলেন। দোকানি মেপে, প্যাকেট করে কুলিয়ে উঠতে পারছিল না। অবশেষে দোকানের প্রায় সব চা শেষ। দোকানি খুশি বেশ!’
পাশাপাশি তারা দেখলেন শিলিগুড়ি, রক গার্ডেন, জুলজিক্যাল পার্ক, হিমালয়ান মাউেন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট, তেনজিং রক, সেন্ট জুসেফ স্কুল, চা বাগান, লামাহাট্টা, ত্রিবেণী, ক্যাকটাস নার্সারি, কাঞ্চনজঙ্ঘা,গৌরীপুর হাউজ ও তিস্তা। আসা-যাওয়ার পথে দেখলেন অনেক কিছু। এরমধ্যে বাগানের ধার থেকে চা কেনাটা ছিল লেখকের জন্য স্পেশাল। এছাড়া সিনেমা দেখার স্মৃতিও কম সুখকর নয়। সিনেমার কাহিনিও বর্ণনা করেছেন লেখক। মৃত্যুবরণ না করেও কিভাবে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করা যায়, সেটাই সিনেমার উপজীব্য।
জেনে রাখা ভালো বা অনেকেরই হয়তো জানা, তারপরও বলতে হয়, দার্জিলিং শব্দটি এসেছে সংস্কৃত থেকে। যার অর্থ দুর্জয় লিঙ্গ। হিমালয় সংলগ্ন এই দার্জিলিংকে তুলনা করা হয়েছে অদম্য ক্ষমতার অধিকারী শিবের সঙ্গে। যে হিমালয় শাসন করে। এটি একটি মনোরম শৈল শহর। যা চায়ের জন্য বিখ্যাত। তবে বাতাসিয়া লুপ, ঘুম রেল স্টেশন, ঘুম মনেস্ট্রি জায়গাগুলোও চমৎকার। বাতাসিয়া লুপ থেকে আশপাশের পাহাড় মনোমুগ্ধকর। পাহাড়ের গায়ে লেগে থাকে পেঁজা তুলার মতো সাদা মেঘ। কাঞ্চনজঙ্ঘাসহ হিমালয়ের নিকটবর্তী কিছু চূড়া দেখা যায় এই লুপ থেকে। বাতাসিয়া লুপ এবং ঘুম রেল স্টেশন এখন ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের অংশ। আর ঘুম মনেস্ট্রি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয়।
এ প্রসঙ্গে লেখক বলেন, ‘ঘুম রেল স্টেশনটি দার্জিলিং শহরের কেন্দ্র থেকে ৭ কিলোমিটার দূরে। যদিও এখন এটি শহরের অংশই হয়ে গেছে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা ৭৪০৭ ফুট। ঘুম ভারতের উচ্চতম রেলস্টেশন। এ লাইন কিন্তু টয় ট্রেন লাইন। দার্জিলিং হিমালয়ান রেল কর্তৃপক্ষ (ডিএইচআর) এই ট্রেন পরিচালনা করছে। ১৯৯৯ সালে দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়েকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষণা করেছে ইউনেস্কো। ১৮৭৯ থেকে ১৮৮১ সালের মধ্যে এই রেলপথ নির্মাণ করা হয়। এর দৈর্ঘ্য ৮৬ কিলোমিটার। দুই জেলা দার্জিলিং এবং জলপাইগুড়ির মধ্যে যাতায়াত করে এই ট্রেন। এটি দুই ফুট ন্যারো গেজ রেল পরিষেবা। আজও ওই ট্রেন বাষ্পচালিত ইঞ্জিনে চলে। তবে দার্জিলিংয়ে মেল ট্রেনের জন্য ডিজেল চালিত ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়।’
ঘুমের আশেপাশেই বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন স্পট রয়েছে। সেগুলো হলো: মিরিক, সান্দাকফু (নেপাল সীমান্তবর্তী) ও বিজনবাড়ি ইত্যাদি। এছাড়া, লেখকের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলতে হয়, দার্জিলিংয়ের পাশের এই জায়গাটি, লামাহাট্টা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। ভ্রমণপিপাসু কোনো মানুষেরই ক্ষমতা নেই এমন সৌন্দর্যকে এড়িয়ে যাওয়ার। এখানকার একটি বিষয় লক্ষণীয়। রাস্তার পাশে রঙিন কাপড়ের অসংখ্য নিশান। এখানে কৃপা লাভই মূল উদ্দেশ্য। কিছুটা দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টাও ছিলো। বলা হয়ে থাকে, এইসব রঙিন কাপড়ের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া বাতাস মানুষের মনকে শুদ্ধ করে, সুন্দর এবং পবিত্র ভাবের উদ্রেক করে। মন্দির, সেতু বা বিভিন্ন স্থাপনার পাশেও এ ধরনের প্রার্থনা পতাকা দেখা যায়।
এখানেই তার লেখার মুন্সিয়ানা। পাঠককে ধরে রাখার অপার ক্ষমতা রয়েছে উদয় হাকিমের। পড়তে শুরু করলে শেষ না করা পর্যন্ত পাঠক নিবৃত্ত হবেন না।
ত্রিবেণী জায়গাটি পড়েছে কালিম্পংয়ের মধ্যে। পশ্চিম থেকে এটিকে কালিম্পংয়ের প্রবেশদ্বার বলা চলে। একদিকে সিকিম থেকে এসেছে তিস্তা। অন্যদিক থেকে গভীর বন পেরিয়ে স্বচ্ছ জল নিয়ে এসেছে রাঙ্গিত। কাঞ্চনজঙ্ঘার নিচের কাবরু পর্বতের একটি গেইসার বা উষ্ণ প্রস্রবন থেকে রাঙ্গিতের উৎপত্তি। এরা ত্রিবেণীতে মিলিত হয়ে ভাটিতে বয়ে গেছে তিস্তা নামে। সবুজে মোড়া রহস্যময় ঘন বন। তার ফাঁক গলে সুউচ্চ পাহাড়ের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসা যুগল স্রোতস্বীনি এখানে আলিঙ্গন করেছে। তারপর বয়ে গেছে হাজারো মাঠ পেরিয়ে।
হিন্দু পূরাণ মতে, ত্রিবেণী হচ্ছে পবিত্র তিন নদীর সঙ্গমস্থল বা মিলনস্থল। ওই নদীর পূণ্য ধারায় তারা স্নান করে পবিত্র হন। নদী তিনটি হচ্ছে: গঙ্গা, যমুনা ও স্বরস্বতী। ভারতের উত্তর প্রদেশের এলাহাবাদে ওই তিন নদীর মিলনস্থলটি একটি তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে। হিন্দু তীর্থযাত্রীরা সেখানে গিয়ে পুণ্যস্নান করেন। তির্থযাত্রীদের ধারণা, তিন নদীর ওই পবিত্র ধারায় স্নান করলে পাপমুক্তি ঘটে।
কালিম্পংয়ের চারপাশেই বিশাল বিশাল পাহাড়। মনে হয় আকাশে হেলান দিয়ে আছে। অফুরন্ত সবুজের মাঝে বাড়ি-ঘর। এখানে প্রাণ আছে, শান্তি আছে। বুক ভরে নিশ্বাস নেওয়া যায়। জীবনকে উপলব্ধি করা যায়। জীবনের সার্থকতা খুঁজে পাওয়া যায়। ভ্রমণপিপাসুদের এমন জায়গাই পছন্দ। কোলাহল নেই। আবার জনমানবহীনও নয়।
লেখক বলেন, ‘কালিম্পং শব্দের অর্থ হচ্ছে, যে শৈলশিরায় মানুষ খেলা করে। এটি লেপচা শব্দ। লেপচা নেপালি ভাষা। তার মানে কালিম্পং অর্থ পাহাড়ের মাথায় খেলা করা। আগে সেখানে আদিবাসীদের মধ্যে গ্রীষ্মকালে ক্রীড়ানুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। বিশেষ করে বৃটিশ আমলে শত্রুদের (ব্রিটিশ দখলকারী) কবল থেকে দেশ রক্ষার কৌশল হিসেবে শক্তিচর্চার একটি উপায় হিসেবে ওই ক্রীড়ানুষ্ঠান হতো। কারণ তখন বলে কয়ে সরকারের বিরোধিতা করা সম্ভব ছিল না। প্রকাশ্যে শক্তির চর্চাও ছিল না।’
তবে তিব্বতি ভাষায় কালিম শব্দের অর্থ রাজার মন্ত্রী। আর পং শব্দের অর্থ ক্ষমতার কেন্দ্র। তাহলে জায়গাটির নামের অর্থ বেশ রাজকীয়। ক্ষমতার কেন্দ্র যে মন্ত্রীদের হাতে। তিব্বতি ভাষায় এরকম অর্থ হওয়ার নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। সে যা-ই হোক, মূলত কালিম্পং বিখ্যাত আবহাওয়ার কারণে। শীতল মনোরম পরিবেশ সবাইকে আকর্ষণ করে। ব্রিটিশরা দার্জিলিংয়ের বিকল্প শৈল শহর গড়তে গিয়ে কালিম্পংয়ের শ্রীবৃদ্ধিতে মনোনিবেশ করেছিলেন। একসময় এটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক কেন্দ্রে পরিণত হয়। পশুলোম, উল, খাদ্যশস্য আমদানি-রপ্তানি হতো এখানে। যে কারণে নেপাল থেকে অনেক লোক ওই অঞ্চলে চলে আসে। এতে বাণিজ্য প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে এলাকার লোকসংখ্যা বেড়ে যায়। তিব্বত থেকে ব্যবসায়ীরা জেলেপালা পাস দিয়ে এ অঞ্চলে আসতেন। তখন তাদের যাওয়া-আসার পথে কুপুপ, জুলুক, আরিতার, পেডং এসব জায়গা ছোট ছোট ব্যবসা কেন্দ্রে পরিণত হয়।
এরপর আসি গৌরিপুর হাউজ প্রসঙ্গে। জানা যায়, অনেক বিখ্যাত মানুষ গৌরীপুর হাউজের আতিথ্য নিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ কালিম্পং গেলে সেখানেই থাকতেন। সাদা দোতলা বাংলো বাড়ি। পাশ্চাত্য মিশ্র রীতিতে তৈরি। এখনো পাহাড়ের ওপর ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। নিঃসীম শূন্যতা, অনাবিল আকাশ, প্রকৃতির নিটোল মায়া; সবই টানে প্রকৃতিপ্রেমীদের। তবে বাড়িটি এখন জীর্ণশীর্ণ। ঠিক যেন পোড়ো বাড়ি। এখন বাড়িটির অবস্থা যা-ই হোক না কেন, এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। বাঙালির কাছে রবীন্দ্রনাথ অনেক বড় কিছু। তার স্মৃতিমাখা জায়গাটি সংরক্ষণের দাবি রাখে।
সবশেষে জানবো তিস্তা দর্শনের গল্প। লেখক বলেন, ‘তিস্তা নিয়ে বলতে গেলে দিস্তায় দিস্তায় কাগজ শেষ হয়ে যাবে। ত্রি সেরাতা বা তিন প্রবাহ থেকে নামটি এসেছে। তিনটি প্রধান শৃঙ্গ থেকে নেমে আসা তিনটি ধারা যুক্ত হয়েছে তিস্তায়। সিকিমে এর উৎপত্তি। অবশ্যই হিমালয় থেকে।’ তবে ইতিহাসে জানা যায়, তিস্তার উৎস উত্তর সিকিমের হিমালয় পর্বতমালার ১৭ হাজার ৮৮৭ ফুট উচ্চতায়। কেউ বলে চিতামু হ্রদ থেকে, আবার কেউ বলে সোলামো নামের একটা হ্রদ থেকে তিস্তার শুরু। হতে পারে আঞ্চলিক ভাষায় ওই দুই নামেই ডাকা হয় হ্রদটিকে। হ্রদটি শেসচেনের কাছে ডোংখা গিরিপথের উত্তরে অবস্থিত।
গল্প, রোমান্স, আবেগ মিশ্রিত ভ্রমণকাহিনিটি তিনি শেষ করেছেন এভাবে, ‘ভোরবেলা টেকনিক্যাল এসে নামলাম। ড্রাইভার ব্যাগ নিয়ে প্রাইভেট কারে তুললো। কিন্তু তুমুল বৃষ্টি। ক’দিন আগে দার্জিলিংয়ে যে বৃষ্টি হচ্ছিলো, সেটি বাতাসে ভেসে ভেসে বাংলাদেশে এসে ঝরছিলো। সাগর কিম্বা হিমালয়ের জল বাংলায় এসে পড়ছিলো। দার্জিলিঙে বৃষ্টি কালিম্পঙে রোদ। আবার বাংলাদেশে বৃষ্টি! প্রকৃতি এমনই।’ এখানেই তার লেখার মুন্সিয়ানা। পাঠককে ধরে রাখার অপার ক্ষমতা রয়েছে উদয় হাকিমের। পড়তে শুরু করলে শেষ না করা পর্যন্ত পাঠক নিবৃত্ত হবেন না।
কারও ঘুরতে যাওয়ার সাধ্য না থাকলেও বইগুলো পড়ে যেন কল্পনায় ঘুরে আসতে পারেন। যেমনটি আমি অনুভব করছি। পড়তে পড়তে আমিও ঘুরে এসেছি অনেক দেশ। পাঠক হিসেবে আমার সার্থকতা এখানেই। লেখক হিসেবেও সার্থক উদয় হাকিম।
আরও পড়ুন: সাম্প্রতিক সাহিত্য