কবিতা কী—এ বিষয়ে বোদ্ধা মহলে আলোচনা হয়েছে বিস্তর। রবীন্দ্রনাথের অভিজ্ঞানে ‘কবিতা বলে না কবিতা বাজে’। কবিতার এই বাজনার সুর শোনার জন্য কান থাকা চাই। অর্থাৎ কবিতা সরাসরি বলে না। কিন্তু কবিতা-ও বলে। বলতে চায়। কবিতার এই বলা তার বাজনার মধ্যেই, যা সংবেদনশীল পাঠকের বোধ পাঠ করে নিতে পারে সহজেই। কবি বীরেন মুখার্জী কবিতাকে অনেকটাই রবীন্দ্রনাথের সেই বাজনার মতো করেই দেখেন। কবিতার প্রতি বীরেনের এই দৃষ্টি অন্তর্ভেদী। কবিতার বাজনায় যে মূর্ছনা, তাতে তিনি খুঁজে পান এক নান্দনিক ইশারাভাষা। তিনি এই ইশারাভাষার আরাধনাতেই নিরন্তর এক মগ্ন ঋষি।
কবিতা সরাসরি বলে না বলেই কবিতা শিল্প। সরাসরি বলতে গেলে তাতে কবিতা আর ধারণ করে না নান্দনিকতা। নান্দনিকতার নির্যাসে কবিতাকে সিক্ত করিয়ে এনে তারপর তা পরিবেশন করা হয়। আর এই কারণেই কবি বীরেন মুখার্জীর অভিজ্ঞানে কবিতা এক ইশারাভাষা। কবি ও পাঠক উভয়ের জন্যেই। ইশারাভাষার এই নান্দনিক সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়েই তিনি আত্মমগ্ন থেকেছেন কবিতার ব্রতে, শিল্পের আরাধনায়। বাংলা কবিতার যে ক্রমবিবর্তন তা কোন কোন ক্ষেত্রে যেমন বরণ করেছে উৎকর্ষ তেমনি কোন কোন ক্ষেত্রে হয়ে উঠেছে আরোপিত বোঝার মতো। কবিতার এই ভাঙ্গাগড়া, পরীক্ষণ-পর্যবেক্ষণের কালে কবি বীরেন মুখার্জী এক আপন পথের পরাণ-পথিক যিনি নিবিষ্ট থেকেছেন সৃজনের ইশারায়। কবিতা তিনি নির্মাণ করেননি, কবিতা তার কাছে ধরা দিয়েছে সৃষ্টির জগৎ হতে। কবিতার সেই ইশারাকেই তিনি মূর্ত করেছেন বাজনার সুর পেয়ে।
কবিতার আশ্রমে কবি বীরেন মুখার্জী নিরলস এক পূজারি। কবিতা যখনই ধরা দিতে চেয়েছে ইশারায় তিনি তখনই তা ধরেছেন অবয়বে। কবিতার সেই অবয়বগুলো সাদাকালোয় মূর্ত হয়ে উঠেছে মলাটবন্দী হয়ে। একে একে ‘উদ্ভ্রান্ত সময়’ (১৯৯৮, কলকাতা), ‘প্রণয়ের চিহ্নপর্ব’ (২০০৯), ‘প্লানচেট ভোর কিংবা মাতাল বাতাস’ (২০০১), ‘নৈঃশব্দ্যের ঘ্রাণ’ (২০১২), ‘পালকের ঐশ্বর্য’ (২০১৩), ‘মৌনতা’ (২০১৩), ‘জলের কারুকাজ’ (২০১৪), ‘হেমন্তের অর্কেস্ট্রা’ (২০১৬), ‘গুচ্ছঘাসের অন্ধকার’ (২০১৭), জতুগৃহের ভস্ম (২০১৮) এর তৈরি হয়েছে অবয়ব। নব্বইয়ে কবিজন্ম পাওয়া কবির কাব্যগ্রন্থ সংখ্যাই বলে দেয়, আরোপিত সৃষ্টির অশিল্প পথ কবির আরাধ্য নয়। কবিতার ইশারা না পেলে তিনি তার অবয়ব ফুটিয়ে তোলার পক্ষপাতী ছিলেন না। তার হাতে কবিতার জন্ম হয়নি, তার মননে কবিতার অধিষ্ঠান হয়েছে। তাই তিনি কর্মী কবি নন, তিনি পূজারী কবি। তিনি কবিতার মর্জিতে পথে চলেছেন, নিজের মর্জিত কবিতাকে পথে চালিত করেন নি।
কবি বীরেন মুখার্জীর কবিতায় বিষয় বৈচিত্র্য ব্যাপক বিস্তৃত। তার কাব্যগ্রন্থগুলোর নামকরণেই তা সহজে অনুমেয়। তার কবিতায় উঠে এসেছে দেশপ্রেম, শেকড়ের টান, সোঁদা মাটির গন্ধ, নিসর্গ ও নারী, প্রেম ও প্রকৃতি, সময়ের অস্থিরতা, বিশ্বরাজনীতির জটিল চক্র, পুরাণ ও মিথ, ইতিহাস ও ঐতিহ্য, প্রযুক্তি ও উত্তরাধুনিকতা, চিকিৎসা বিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিজ্ঞান, আদিভৌতিকতা ও পরাবাস্তবতা সকলি। কবিতার দেহে প্রস্ফুটিত হয়েছে সহজাত সৌন্দর্য। আরোপিত বক্তব্য না চাপিয়ে সহজাত পরিক্রমায় তার কবিতাগুলো র্ত র্ত করে এগিয়ে গেছে ধ্রুপদী শিল্পের পথে। কবিতার ভাষায় বিকশিত ছিলো সকল শোভন। আমদানী করা অশ্লীলতা কিংবা অহেতুক খিস্তি-খেউড় নয়, শিল্পের প্রমিত পথে কবিতা পেয়েছে তার আপন-নিবাস।
পূজারী কবির কবিজন্ম নব্বইয়ের গর্ভে হলেও তার গৃহীজন্ম এক অগ্নিঝরা সময়ে যখন আসন্ন জন্ম-বেদনায় কাঁদছে একটি দেশ সেই উত্তাল দিনগুলোয়। ঊনসত্তরের চার মার্চ তাই নিছক কোন জন্ম নয়, এ’ যেন কবিতার ব্রতে পূজারীর দীক্ষা লাভের উন্মেষকাল। অহিভূষণের সত্যিকারের ভূষণ, প্রমিলার আশীষে পৃথিবীর কোলে হামাগুড়ি দেয়া কবি তাই বলতে পারেন অকপটে ‘বন্ধনের ভ্রমণ থেকে খুঁজে নিতে চেয়েছি বর্ণাঢ্য আগামীর ডানা’ (গুচ্ছঘাসের অন্ধকার)।
কবিতার ইশারায় কবি বীরেন মুখার্জী জীবনের নিগুঢ় দর্শনে অভিজ্ঞানলব্ধ এক সন্ত পরিব্রাজক। অন্তর্জলি চাঁদের পরিহাস ভেঙ্গে তিনি নৈঃশব্দ্যের ঘ্রাণে খুঁজে পান বোধিসত্ত্বকে। অর্থাৎ কবি জীবনের শিক্ষায় পেয়ে যান সত্যের বোধি। আর এই সত্যের বোধিতেই কবির অভিজ্ঞান হয় চতুরার্যসত্যে। কবি তখন অনায়াসে বলতে পারেন মহাকারুণিক গৌতমের অভিধর্মে দীক্ষা পেয়ে- ‘অনিত্য এই পৃথিবীতে দুঃখই সত্য/ আর্যসত্যে চিরস্থায়ী আত্মা বলেও কিছু নেই’ (চতুরার্যসত্য’/ গুচ্ছঘাসের অন্ধকার)। পরন্তু বোধিপ্রাপ্ত কবি নির্মোহভাবে জীবনকে সংজ্ঞায়িত করতে পারেন অতুলনীয় প্রজ্ঞায়।
‘বোধির কিয়দংশ আছে বলেই
মায়াময় জ্যোস্নায় হাসে জগৎ-সংসার।
মানুষ মাত্রই হাওয়ার সঙ্গী
জীবন যেন এক সমঝোতা স্মারক।’
(অপরিণামদর্শী হাওয়া)
জীবনের বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক কবি ঋদ্ধ হয়েছেন প্রতিনিয়ত জৈবনিক শিক্ষায়। তাই তার কলমে বারবার ফুটে উঠেছে জীবনের অভীক্ষা। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, ‘যে জীবন পেরিয়ে এসেছি একদিন অনূদিত হবে তার ভাষা’ (সবুজের স্বরলিপি)। জীবনকে নিজের চিন্তনে প্রতিনিয়ত নির্মাণ করেন বলেই কবি বীরেন মুখার্জী একসময় বলে ফেলতে পারেন অবলীলায়- ‘রাতই জীবনের শ্রেষ্ঠ জুয়াড়ি’ (এলোমেলো রাত)। জীবনের এই জুয়ায় ‘চারিপাশে মহাবৃত্ত, শূন্য, হাহাকার’ (মহাশূন্য)। যে নৈকট্য নিয়ে কবি জীবনের পথে পরিব্রাজক সেই ‘নৈকট্য মিথ্যা জানে না’ (ব্যক্তিগত ভ্রমণ)। জীবনের পথে ব্যক্তিগত ভ্রমণে বের হওয়া কবি বার বার নিজেকে নবায়ন করতে চেষ্টা করেন। কারণ তিনি জেনেছেন- ‘নিজেকে নবায়ন করতে বয়স এবং ঋতুও সাংঘর্ষিক নয়’ (নবায়ন)। নিজের নবায়ন সেতো মনের কাছে। আর মন তো জানেই, ‘আমরা বিশ্বাসে বাঁচি, বেড়ে উঠি নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে’। নিঃশ্বাসে বেড়ে উঠতে গিয়ে কবি খুঁজে নেন জীবনের পথ আর তখনই তার অভিজ্ঞান হয়- ‘সব পথই বিস্তৃত হয় পথের তাগিদে’ (চিহ্ন)। জীবনের পথ বড় রহস্যময় তার প্রতিটি বাঁকে বাঁকে লুকিয়ে আছে সকল গোপন যেমনটি ‘প্রতিটি সন্ধ্যের ভেতর সসম্ভ্রমে ডুবে আছে আত্মকথা।’
কবি বীরেন মুখার্জী এক আশাবাদী কবি। তাঁর অভিজ্ঞানও তাই আশাবাদী। আশায় ভেসে তিনি বলেন অবলীলায়- ‘বিবর্ণতা পরিবর্তনের সংস্কার’। পরিবর্তনের সংস্কার নিয়ে ভাবতে ভাবতে কবির চিন্তার বিষয় একসময় হয়ে উঠে ‘মানুষ’। মানুষকে নিয়ে কবির চিন্তা শতস্রোতে বহুগামী। কখনো তার কাছে ‘মানুষ ভীষণ পরজীবী’ (চিত্রকল্প), কখনো ‘মানুষই প্রকৃত যাযাবর, শরীরী পাঠে’ (সময়ের মৌন পাঠ)। কখনো মানুষ নিয়ে ভাবতে গিয়ে কবি ভেবেছেন ঈশ্বরকেও। তাই ‘পাঠকক্ষ হতে ভেসে আসা কণ্ঠস্বরগুলো ঈশ্বরের’ তা’ অনুধাবন করেও তিনি পুনশ্চঃ বলেন, ‘মানুষ এবং ঈশ্বরের দ্বান্দ্বিক সত্তায় মুখোশের বালিহাঁস’ (ভুল জ্যোৎস্না)। কবিতা যতই নির্মাণের ঋদ্ধতায় পৌঁছেছে ততই কবির মনে হয়েছে ‘মানুষের জন্মপাপ শিকড় প্রসারী’। আর এই কারণেই ‘মানুষ ফুরিয়ে যাবে একদিন মুদ্রাদোষে ভেসে’। তবুও মানুষ নিয়ে কবির অভিজ্ঞান ফুরোবার নয়। অবশেষে কবি শোনান তার মোক্ষম আর্যবাণী ‘জেনেছি মানুষ এক অনন্ত ট্রেনের যাত্রী/ বয়ে চলে সারাক্ষণ নদীর স্রোতের মতো’ (মোহ)। মানুষ নিয়ে ভাবতে ভাবতে কবির অভিজ্ঞানে ভিড় করে সমকাল বাস্তবতা। তিনি বুঝতে পারেন, ‘স্বপ্ন আর বাস্তবের ব্যবধান বহুযোজন’ (স্বপ্নের অনুধ্যান)। তাই অস্থির সমকাল পাঠ করে তিনি বলতে পারেন- ‘সময়ের গ্রীবা জুড়ে সম্ভাবনার কঙ্কাল হাসে’।
অস্থির সমকালে সম্ভাবনারা মরে কঙ্কাল হলেও ‘সময় কখনো ফেরে না শেকড়ে/ বাস্তুচ্যুত প্রেম যেমন ফেরেনি কোন কালে-/ বিগত আর্তনাদে’ (শেষ চিহ্ন সরিয়ে ফেলার আগে)। তবু কবি লিখে যান আশার স্বপ্নগাথা, ‘স্বপ্নমুখর জীবন জুড়ে জলের কাব্য সাজাই/ নিসর্গ ক্লান্তিহীন ফোটায় জীবনের বনসাই’ (শ্রাবণঘন ভাবনা)। এক সময় আশার সেই স্বপ্নগাথায় ফুটে উঠে জোর, কবিকে শুনতে পাই বলতে ‘পল্লবের বাসনা ধরে রাখে সূর্যরাণী বৃক্ষ’ (পালকের ঐশ্বর্য)। কবির প্রতিশ্রুত আশা বোধের মন্থন ঘটায় পাঠকের পরাণে। পাঠক তখন আপন মনে বলতে পারে, ‘বোধে বাসা বাঁধে বোধ, অনিবার্য শিল্পের ফসল’ (মনমন্দির, শিল্পকলা)। কবির মনে মেতে ওঠা বোধ তাই ধীরে ধীরে জাগ্রত হয় আপন গৌরবে। তখন আর পরমের সাথে ক্ষুদ্রকবির ব্যবধান থাকে না বিস্তর। দূরত্ব অধিক হলেও মনের দিক থেকে ব্যবধান ঘুচে গেছে সব। আর এ’ কারণেই কবি বলেন- ‘দূরত্বে মজেছে দেহ নৈকট্যের ঘানি টানা মিছে’ (পালকের ঐশ্বর্য)। সংসার অভিজ্ঞানী কবি ক্রমশঃ পরমের প্রেমে সিক্ত হতে হতে মোহহীন হয়ে উঠে একদিন। আপন মার্গলাভের ব্যাকুল পরাণে বলে উঠে বিমুক্তির আনন্দে—
‘ঈশ্বর জানে কামধ্যানে খসে পড়ে
স্নানশেষে জমানো রকমারি মোহফল।’
(মোহহীন শব্দের শব)
জীবন, মানুষ, ঈশ্বর ও সময় নিয়ে অভিজ্ঞানঋদ্ধ কবি একসময় আত্মবিশ্লেষণে মগ্ন হয়ে পড়েন। তিনি সক্রেটিসের ‘নো দাইসেলফ’ কিংবা উপনিষদের ‘আত্মানং বিদ্ধি’ তে নিমগ্ন থেকে একসময় বলে উঠেন নিজেকে নিয়ে- ‘বিন্দুবাদী মানুষ আমি’ (তুলাদ-)।
কেবল এতটুকু নয়, আরও একটু এগিয়ে গিয়ে বলেন- ‘অবেলার মানুষ আমি, ভীষণ অন্তর্গত’ (ছদ্মদম্পতি)। এই অন্তর্গত মানুষটিই আবার ভুল গলিতে হেঁটে অহর্নিশ মজে থাকে মূঢ় দেহজীবী হয়ে। একসময় আত্মজিজ্ঞাসায় কবি নিজেকে করেন জর্জরিত। বলে উঠেন অনন্ত বিস্ময়ে- ‘ভোগসভার পৃথিবীতে কে আমি (বিলাপ)?’ পরক্ষণে নিজেই তার উত্তর দেন- ‘পলিকাদায় গেয়ে উঠি মৃত্তিকার সন্তান’। মৃত্তিকালগ্ন কবি একসময় নিজেকে চিনতে পেরে বলে উঠেন দৃপ্ত কণ্ঠে, ‘আমিও কালের স্র্রোতে বয়ে চলা আখেন আটেন/ এসেছি রাঙাতে সমকাল- করতলে দীপ্ত সূর্য এঁকে (আখেন আটেন)। কোন কোন সময় কবি নিজের সম্পর্কে হয়ে পড়েন হতাশ। ম্লান-মৃদু স্বরে তখন শোনা যায়, তিনি বলছেন— ‘আজকাল ঘুমের মধ্যে রচনা করি, চিতার চৌকাঠ’ (চিতার চৌকাঠ)। আবার পরক্ষণে একরাশ রহস্য মেখে নিজেকে পরিচয় করিয়ে দেন এক মায়া জগতের মানুষ রূপে- ‘আমি সমুদ্র সন্ন্যাসী, অন্তর্মুখী মায়া পোট্রেট’। চতুরার্য সত্যের দীক্ষা পাওয়া কবি মাঝে মাঝে জাগতিক আসবাক্রান্ত হয়ে বলেন- ‘বহুবর্ণিল তৃষ্ণার ঠোঁট ছুঁয়ে, পান করি মায়া (বহুবর্ণ তৃষ্ণার ঠোঁট)। আসবের ঘোরে একদিন কবিকে বলতেই হয়- ‘কোথায় জীবন? ভ্রমণ শেষে একই বিন্দুতে ফেরা’।
কবি বীরেন মুখার্জীর কবিতায় একদিকে যেমন ফুটে উঠেছে স্বদেশপ্রেম (পৃথিবীর উর্বরতম এ মাটি আমার- পবিত্র স্বাধীন ভূমি- ‘পউষের কবিতা’) তেমনি অন্যদিকে ফুটে উঠেছে মহাকালিক পরিব্রাজন- যখন কবি বলেন, ‘অনেক পথ হাঁটা হলো, গৃহ থেকে সন্ন্যাস/ সৌর কক্ষ ছুঁয়ে মহাকালের মাঠ’ (দৃশ্যপট)। কবি একদিকে ‘সবুজের স্বরলিপি’ কবিতায় ফুটিয়ে তোলেন সময়ের দর্শন (যদিও সময় একটি ধারণামাত্র- বয়ে যায়, মুছে ফেলা যায় না জীবন থেকে) আবার অন্যদিকে তিনিই আধ্যাত্মিক প্রজ্ঞায় পরিশীলিতভাবে বলেন- ‘বোধের পরাগ উড়িয়েছি বহুকাল প্রমিত আলোর সন্ধানে,/ এখন নির্বাণ কাল- উড়ে যাবো, রেখে যাবো মুঠো মুঠো ধানের চাতাল’। কবি কখনও উদ্ভিদপ্রেমে মজে বলেন ‘পউষের দিনে ও রাতে গাছেদের সংলাপ শীতার্ত/ তাদেরও প্রয়োজন বিন্যস্ত চাদরের ওম/ তা না হলে মিথ্যে হয়ে যায় বসুর থিওরি’ (শীতঘুম তোমার বারান্দায়), আবার কখনও জ্যোতির্বিজ্ঞানী হয়ে জিজ্ঞাসা করেন- ‘পৃথিবীর কক্ষপথে জ্বালাতে পারো অচেনা আলো?’
কবি বীরেন মুখার্জী এক পলিলগ্ন প্রাণ যিনি যান্ত্রিক সভ্যতার আগ্রাসনে আর্তনাদ করে বলে উঠেন- ‘জানি এ শহর পাখিনীড় নয়/ খড়কুটো সরিয়ে বাড়ে কংক্রীট মুগ্ধতা’। তাই সঙ্গত কারণেই তার কবিতায় শেকড়ের টানে উঠে আসে ইতিহাস। ‘জল জ্যোৎ¯œার পদাবলি’ তে কবি শেকড়ের কথা বলে ফেলেন অকপটে-
‘স্বপ্নের মায়াবী ভেলা- আমাদের কৈবর্ত জীবন
পূর্ব পুরুষের প্রত্ম-উঠোনে শুকিয়ে গেছে প্রণয় সাঁতার।’
কবি কেবল এ’টুকুতেই স্থির নন। তিনি আরও দৃঢ়কণ্ঠে বলে চলেন-
‘ভালোবাসা দিতে চাই আমিও মৃত্তিকালগ্ন প্রাণ
মমতার তৃণ-ভূমে দ্রোহের পরাগ উড়িয়ে দিয়েছি তাই
জন্ম সাধ শূন্য করে বাতাসের গায়ে।’
কবির শেকড় বড় গভীরে পোঁতা। আপন শেকড়ে ফেরার প্রত্যয়ে তিনি প্রতিনিয়ত নস্টালজিক হয়ে উঠেন-
‘প্রতিদিন ভেঙে যাচ্ছে দৃশ্যপট দ্যাখো
নাগরিক ধ্যানে
দৃশ্য ভেঙে নাড়িতে টান ওঠে, ডাকে প্রত্নদুপুর।’
(দৃশ্যত দীর্ঘ প্রজ্ঞাপনে ফেরা)
কবি তার প্রত্ন শৈশবে ফিরে যেতে চেয়ে কোন কোন দিন আত্মক্ষরণের গল্প বলে উঠেন, ‘বৃষ্টির গন্ধ হেঁটে এলে বুকের বারান্দায়,/ জৈষ্ঠ্যের মধুযন্ত্রণা ভুলে,/ নিদ্রাহীন রাতে লিখে রাখি বৃষ্টির এপিক (বৃষ্টির এপিক)!’ কিন্তু তার এই বৃষ্টির এপিক বুঝবে কে? কবি জানেন, ‘যে বোঝে তার কাছে তৃপ্ত হয় সব আরাধনা’ (সন্দিগ্ধ বর্ষায় ভাঙে জলকেলি)। তবুও যুগের বাণিজ্য-বাতাস গায়ে মেখে সময়ের ক্রীতদাস মানুষ সংসারের প্রত্মমুদ্রায় মজে থাকে।
মাটির প্রতি, মর্ত্যরে প্রতি কবির যেমন প্রগাঢ় অনুরাগ তেমনি কবির অতল অনুরাগ মিথের প্রতিও। কবির কবিতায় বিভিন্নভাবে হরেকরকম মিথের জন্ম হয়েছে নির্জলা প্রাসঙ্গিকতায়। তার কবিতায় আমরা পাই, ‘চাঁদ ও দেবীর স্নানে বিষণ্ন ময়ূর (মগ্নতা), ঘুমের মধ্যে হেঁটে আসা সাদা ঘোড়া (চিতার চৌকাঠ), মেঘের আবহে উড়ানো অশ্রুর কলঙ্ক, মমির শরীরে হেঁটে ঘুরে আসা পথ (প্রকৃতি প্রেম), বৃক্ষগন্ধা নদী, হরপ্পার লিপি, মৌন বাতাস, মেঘের ঘুড়ি, সাবিত্রী সন্ধ্যা, প্রজ্ঞাবাহী নদী- ইত্যাদি মিথের ছড়াছড়ি। মিথের পাশাপাশি তার কবিতায় পুরাণ ও পৌরাণিক বিষয় স্থান পেয়েছে কবিতার আহ্বানে। দ্বিধান্বিত আর্যবর্তে পা-বের শৌর্য, উদগ্রীব কর্ণ কিংবা মুখোমুখি দ্রোণাচার্য কবিতায় আসন পেয়েছেন পরম মমতায়। বাদ পড়েননি জলের সারল্য নিয়ে ডেকে যাওয়া পরাশর কিংবা পাশাচক্রে শকুনির অভেদ্য চোখ। কবি নিজেকে সংসারের চক্রব্যুহে ব্যর্থ এক অভিমন্যু হিসেবে দেখেন যার কল্পনায় এখনও অগৌরবে রাত নামে আর্যাকবর্তের শূন্য উঠোনে।
কবি যেমন মিথ ও পুরাণে অনুরাগী তেমনি পরাবাস্তবতায়ও সিদ্ধহস্ত। তাই তার কাছে আমরা শুনি- ‘চিৎকারের অ্যাপ্রোন থেকে উঠে আসে শোকার্ত স্বর’। পরাবাস্তবতায় বিমুগ্ধ কবির নিজস্ব বয়ানে আমরা পাই- ‘তার অনালোকিত জ্যেষ্ঠ জানালায় চোখ রেখে/ পান করি বাতাসের তরল কলরব’ (ভেঙ্গে যায় প্রিয় মুখের প্রতিচ্ছবি)। ‘কুয়াশার কারফিউ’তে ‘ব্যক্তিগত ভ্রমণে ঝুলে থাকা কালোত্তীর্ণ চাঁদ’ দেখে কবির মনে হয়- ‘সময়টা মঙ্গলের চাঁদ, রাতের বৌ-ঝি’ (সন্ধ্যায় ঘরে ফেরে একান্ত সারস)। আর এভাবেই তার কাছে একদিন আবিষ্কৃত হয় ‘শূন্যে উড়ছে কবিতার ট্রেন’। পরাবাস্তববাদী কবি কখনও কখনও যান্ত্রিক জীবনের যাতনায় বিলাপ করে চলেন—
‘প্রেম আছে, ভালোবাসা আছে- যান্ত্রিক নারী তবু
হতাশায় গিলে খায় বুকের মানচিত্র।’
(সংসার)সংসারের নির্মম বাস্তবতা কবিকেও উতলা করে তোলে। তাই তার কবিতায় ফুটে উঠে ক্ষোভ—
‘ক্ষুধা নেই জেনেও ডেকে তোলে ভাতের টেবিল
রুচি নেই জেনেও
রুটির প্রলেপে বাড়ে বিশুদ্ধ মাখন
অথচ, হা-ভাত ঘরে
প্রতিদিন ঘেমে ওঠে অনাহারী অজস্র শিশুর মুখ।’
(শিরোনামহীন)
বৈষম্য আর বঞ্চনার এই ধারাপাতে ধীরে ধীরে জাগ্রত হয় কবির অন্তদৃষ্টির অবভাসন। কবি তখন হয়ে উঠেন মার্গ-কথক। ভারীতত্ত্ব তার কলমে বের হয়ে আসে মার্গবাণী হয়ে—
‘একবুক তরঙ্গের ওপারে শুয়ে আছে দগ্ধ নদী
তীরে তার ভূমিলগ্ন প্রাণের আকার’।
(শিলাঅস্থি)
অতঃপর কবির প্রজ্ঞালোচন দেখতে পায়—
‘একদিন দংশনের গর্ভ থেকে জন্ম নেবে স্বপ্নকুসুম!
(স্বপ্নকুসুম)
মার্গপথের সাধক কবির কাছে জীবন এক রেল। তাই তার কাছে মনে হয়, ‘ট্রেন চলে গেলে ছিঁড়ে যায় ফেরিওয়ালা-জীবন।’ পার্থিব প্রেম-বিরহ ছুঁয়ে যায় কবি বীরেন মুখার্জীকেও। তাই প্রেমে-অপ্রেমে কবিকেও বিচলিত হয়ে বলতে শোনো যায়-
‘অনুরাগ যতটুকু পোড়ায়
তার অধিক জ্বলেছি শ্রাবণে
কিছু ছিলো ঐশ্বর্যকাতর
বাকিটুকু সন্তার চুম্বনে।’
প্রেমে অবিশ্বাস, সংসারের ক্লেদ কবিকে কাতর করে গভীরভাবে। কবি ক্ষরণের লাভাস্রোতে রচনা করে চলেন স্বাগত সংলাপ-
‘প্রতিরাতে ঘুমুতে যাওয়ার আগে একপ্রস্থ সঞ্চয়ী মুখ
অনুচ্চারে ডাকি তাই; যার সঙ্গে গাণিতিক কোনো
স্পর্শ নেই, অথচ রাতের পৃষ্ঠা জুড়ে
সে বাজায় অন্যগ্রহে- হেমন্তের গোপন অর্কেস্ট্রা।’
কবিতা কবির মনের যেমন প্রচ্ছদপট, তেমনি মনের মুকুরও বটে। এই মনের মুকুরেই প্রতিফলিত হয় কবির সমস্ত প্রিয়তা। কবির প্রিয় প্রকৃতি নদী ও বৃক্ষ, কবির প্রিয় বাহন ট্রেন, কবির প্রিয় শব্দ হামা ও কাক্সক্ষা, কবির প্রিয় রাগ ভীমপলশ্রী, প্রিয় চেতনাপুরুষ বোধিসত্ত্ব ও যীশু, প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাস, প্রিয় ঋতু হেমন্ত এবং প্রিয় নারী ‘চারু’। এরা প্রত্যেকেই কোন না কোন ভাবে কবিতায় উঁকি দিয়ে গেছে, প্রকট হয়েছে এবং অনুরণিত হয়েছে বারংবার। পুরাণের চেয়ে মিথে কবির আগ্রহ অধিক। বাতাসের চেয়ে মৃত্তিকার টান কবির নাড়ির উপরে অধিক। সাহিত্যের অলি-গলি ঘুরে বেড়ানো কবির প্রিয় বিষয় বিজ্ঞান। তাই বার বার তার কবিতায় মূর্ত হয়ে উঠে জগদীশ চন্দ্র বসু ও উদ্ভিদ প্রেম, জ্যোতির্বিজ্ঞান, আলোকবিজ্ঞান ও পদার্থবিজ্ঞান। আধুনিক প্রাযুক্তিক ভাষা কবিও রপ্ত করেছেন সময়ের প্রয়োজনে। তিনি কবিতায় বলেছেন প্রযুক্তিকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে-
‘আমাদের হাইব্রিড চোখ, ডিজিটাল ক্লিক-এ
দ্রুত সেইভ করে বাদামী রোদে পোড়া
পোস্ট-ইমেজ।’
(ডেটলাইন : ২৯ জানুয়ারি ২০১০)
প্রযুক্তিভাষা রপ্ত করার পাশাপাশি কবিতায় তিনি হাজির হয়েছেন উত্তরাধুনিক বিষয়-বৈচিত্র্য নিয়ে। তার উত্তরাধুনিকতা কবিতার অবয়বে বিচরণ করে মুঠোফোন-সভ্যতা হয়ে-
‘যুবতী চাঁদে হেঁটে বর্ণবহু পাখিদের এলিয়েন চোখ
উল্টো পরাণে ঢুকে পড়ে ভাতের দরজায়
উড়াল নক্ষত্রবায়ু নিঃসঙ্গ পালক গুঁজে রাখে জ্যোৎস্নাপাতায়
আকাশ দেবতা এমএমএস পাঠায় পঞ্চভূতে।’
পৃথিবীর ধূলিলগ্ন কবি ‘নিসর্গের পরমায়ু পাঠ’ শেষে বের হয়ে পড়েন ‘পৃথিবী পরিক্রমা’য়। পরিক্রমণ করতে করতে অবশেষে একদিন তিনি ব্যক্ত করেন অর্জিত অভিজ্ঞান-
‘নিসর্গ সম্ভোগলোভে বহুকাল বেঁচে আছি মনুষ্যজাত
পথ হাঁটছি পাপের পৃথিবীতে ছায়াহীন কঙ্কাল
এখানে পাপের গর্ভ হতে উঠে আসা পাপ
রঙিন জোয়ারে হাসে।’
পৃথিবী পরিক্রমণে বের হওয়া কবি সবুজের আলপথে যেতে যেতে হয়ে উঠেন স্মৃতিভারাতুর। স্মৃতির সেই আলপথে পা রেখে কবিকে বলতে শুনি ‘নিত্য যাজম’ এ’-
‘শীত এলে পরাণের মাঠে
হলুদ সম্ভ্রম বিছিয়ে ডাকে দাঁড়িয়াবাঁধা দিন।’
মাঠভরা হলুদ সর্ষের ক্ষেতে হিমের সকাল কবিকে নিমিষে বানিয়ে দেয় প্রকৃতিপ্রেমিক। কবি তখন আপন মনেই বলে উঠেন-
‘নিসর্গ পান করা আমি এক হেমন্ত পথিক’। হলুদের আঁচলে সবুজ আল ধরে হাঁটতে হাঁটতে তখন কবির নতুন অভিজ্ঞান হয়- ‘সময় ও স্টেশন দুটোই জাগতিক’ (প্রাচীন আখ্যান)। কবিতার জন্ম-সাক্ষী কবি। তিনি জানেন কবিতার জন্মবৃত্ত। কেবল কবিই জানেন-
‘দীর্ঘ সঙ্গমের পর হাতে উঠে আসে
অক্ষরের চাঁদ।’
(সঙ্গমক্লান্ত কবিতারা দূরদর্শী চাঁদ)
কবিতার জন্মরসায়নের অতুলনীয় শিল্পী কবি বীরেন মুখার্জী। তার কবিতায় শব্দরা থাকে মাধুরী রাঙা, মার্জিত দ্যোতনা নিয়ে বক্তব্যে যথাধার মেখে। ব্যবহার শৈলীর কারণে তার কবিতায় প্রাণতা, আত্মজ সন্ধ্যায়, শব্দের মৌনাস্ত্র, জিপসী সন্ধ্যা কিংবা বিকেলগুচ্ছকে মনে হয় নূতন শব্দের মূর্চ্ছনায় বিনিন্দিত। নান্দনিক ভাষাশৈলীর কারণেই কবি বীরেন মুখার্জী তার কবিতায় ‘বোধন বাতাস’, ‘চোখের দীঘি’, ‘অন্তউড়ি মেঘ’ কিংবা ‘শব্দের অহম’ নিয়ে হাজির হন পাঠকের পাতে।
কখনো কখনো মনে হয় কবি এক নান্দনিক উপমা শিল্পী। কবিতার দেহে উপমার জরি দিয়ে তিনি রচনা করেন অনবদ্য নকশীকাঁথা। তার কবিতার নির্ঝরে অবগাহন করে আমরা জানতে পাই, দেহ তার কাছে এক দহের মতো যাতে ডুবে তিনি খোঁজেন মেঘদূত। ‘চোখের ফেনিল সৈকতে’, ‘মাছ রাঙা সন্ধ্যায়’ তিনি খুঁজে পান আকাশের কোলে ‘ঘুমন্ত সূর্য’কে। ‘আদিবাসী রোদ’ মেখে তার কবিতা সবুজ স্বপ্ন-চোখ মেলে ছড়িয়ে পড়ে ‘লাউফুল ফোটা শীতের তরুণ উঠোন’ এ। ‘নিভাঁজ দুপুর’ এ কবি ‘ধ্যানমগ্ন বাল্মিকী জীবন’ পেয়ে হয়ে উঠেন ‘শব্দব্রহ্ম’। ‘বাল্মিকী সন্ধ্যার আবীর’ মেখে ‘মাটিমুখী জ্যোৎস্নার ঘ্রাণ’ নিয়ে কবি ভোরে মেলে ধরেন ‘কুয়াশাপেখম’। ‘মধ্যযামে লোভের করাতকলে’ কবির কাছে এক প্রলয়ঙ্করী প্রলোভন। কবি বীরেন মুখার্জীর উপমারা ‘পাতার সনেট’ হয়ে ‘পাতাল অভিমান’ রূপে বাজতে থাকে অবিরল। ঘ্রাণ যে প্রজননের বিশিষ্টতা পায় কিংবা ঘাসও লাজুকতা ধারণ করে তা আমরা জানতে পারি কবি বীরেন মুখার্জীর উপমা অধ্যয়নে। ‘বুকের আঙুর’ হতে ‘বেদনার মদ’ নিয়ে তিনি ‘সভ্যতার পানগৃহে’ বসে পড়েন ‘প্লাবন সন্ধ্যায়’। এরই মাঝে ‘বিন্দুবাদী দেহ’ নিয়ে ভাবেন প্রগাঢ় দর্শনে। কবির উপমায় ফুটে উঠে জলঘড়ি হৃদয়, লাউডগা ফণা, স্বপ্নভূক মানুষ, পরিযায়ী পাখিতীর্থ, যুবতী নিদ্রা আর শ্যামল বিষাদ। ‘আত্মক্ষয়ের বিবর্ণ উঠোন’ এ’ বসে তিনি শোনেন ‘বহুজাতিক বাদ্য’। এরই মাঝে এসে উপনীত হয় ‘গতিময় আলোক ট্রেন’। ‘মেঘের সাম্পান’ এ’ চড়ে ‘বেহুলা জীবন’ নিয়ে কবি ‘বাঁকসিদ্ধি নদী’ পথে এসে উপনীত হন ‘পুষ্পল অরণ্যে’। এই দীর্ঘ যাত্রায় কবির উপমাগুলো হয়ে উঠে শিল্প, হয়ে উঠে কবিতার রত্মঝালর।
কবিতায় অনুপম চিত্রকল্পের কারিগর কবি বীরেন মুখার্জী। কবিতার অঙ্গে অঙ্গে চিত্রকল্পের মূর্ত পরিস্ফূটন তার কবিতাকে করে তুলেছে চিত্ররূপময়। কবি যখন বলেন, ‘ঝরণার জলে গোধূলির লালস্রোত’ (দৃশ্যপট), তখন আমরা চোখের সামনে গোধূলির আবির রাঙা জলের কল্লোল বাজতে দেখি। আবার পরমুহূর্তেই আমরা ভয় পেয়ে আঁতকে উঠি কবি যখন আয়ুরেখাকে জীবন্ত করে বলেন, ‘তালুতে শুয়ে থাকা আয়ুরেখা যেন এক অন্ধ অজগর’ (ইচ্ছেপত্র)। কবির অপরূপ সৃজনশীলতায় ‘জলের নূপুরে বাজে সম্ভ্রান্ত রোদ’ (পালকের ঐশ্বর্য) আর ফুটে উঠে ‘চোখের খামারে শাদা ভোর’। ‘সূর্যবেহালা শুনে শুনে গড়িয়ে যায় হিরণ্যদুপুর’- এই চরণের নান্দনিকতায় মনের মধ্যে জেগে উঠে অঙ্গীকার ‘এবার বুনে দেবো জলের বীজ মেঘের উঠোনে।’ কখনো কখনো চিত্রকল্পেরা অধীর আগ্রহে উড়ে উড়ে জলজ্যোৎস্না’ হয়ে ‘চোখের কলসে ভরে রাখে জীবনের তাপ’ (জলজ্যোৎস্নার পদাবলি)। উদাস দুপুরে কবি যখন লিখে চলেন- ‘মেঘের জিপার খুলে উঁকি দিলে ভেজা দুপুর’ (মায়াদৃশ্যে জেগে উঠে ফের) তখন আর বলতে হয় না কিছুই। চোখের সামনেই দেখতে পাই দুষ্টু বালক অতি চাপ সহ্য না করতে পেরে বর্ষণমুখর মেঘের মতো যত্রতত্র জিপার খুলে নিজে হাল্কা হয়। দুপুরের বর্ষণে এমন সুন্দর চিত্রকল্প সত্যিই বিরল।
বীরেন মুখার্জীর কবিতায় মাঝে মাঝে দাপটে ঘুরে বেড়ায় জীবনানন্দ দাস আর তার হেমন্তের রোদ। যদিও কবির প্রিয় জীবনানন্দ, তবুও দিনশেষে, পাঠশেষে জীবনানন্দের সেই বিচরণ আর খুঁজে পাওয় যায় না। বীরেন যখন বলে চলেন, ‘শুয়ে আছি কার্তিকের নগ্ন মাঠে- বিমুঢ়, বিস্ময়!’ তখন জীবনানন্দ নিশ্চয়ই মুখ টিপে হাসেন। সেই মুখটিপা হাসি আর অট্টহাস্যে পরিণত হয়নি কবি বীরেন মুখার্জীর কাব্যভাষার স্বকীয়তায়। স্বকীয়তায় ঋদ্ধ বলেই জীবনানন্দকে আশীর্বাণী রূপে ধারণ করেও কবি আলাদা উচ্চারণে বলতে পারেন- ‘তোর পাখিটি বোঝে, নীরবতা মানে সোমত্ত কবিতা’ (প্রস্থানের চিত্রকল্প)।
কখনো কখনো বোধের অতীত কাব্যকথা বীরেনের কবিতা যা সহজে ধরা দেয় না পাঠকের মনে। অতি সচেতনতার কারণে কবিতায় মনে হয় আপাত এক দুর্বোধ্যতার পর্দা তৈরি হয়। তবে নিরন্তর পাঠে এই পর্দা দেওয়াল হয়ে উঠতে পারে না বরং স্বচ্ছ নিরাপদ আবরকরূপে সংরক্ষণ করে পাঠকের প্রকৃত অভিরুচি। দু’একটি কবিতায় পরিহারযোগ্য বিদেশী শব্দের আরোপিত প্রয়োগ কবিতাকে হাল্কা করে তুলেছে। তারই নমুনা পাই একটি চরণে যখন কবি বলেন, ‘স্বেচ্ছা বিদায়ের পর ফিরে আসা পতঙ্গ সংসারে স্বরবর্ণের নামতা পড়া ডিফিকাল্ট নয়।’ একটি শব্দ, ‘ডিফিকাল্ট’ এর ব্যবহার কবিতাটির স্বাভাবিকতায় অস্বাভাবিক ভার চাপিয়ে দিয়েছে বলেই মনে হয়।
কবি বীরেন মুখার্জীর সবচেয়ে শক্তিমান দিক তার ইশারাভাষা। কবিতার দেহে ইশারাভাষার প্রয়োগ তার কবিতাকে করে তুলেছে শিল্পিত ও ব্যঞ্জনাময়। কবি যখন ‘স্বপ্ন কুসুম’ এ বলেন, ‘ফুলের বোঁটা থেকে খসে পড়ে রক্তবীজ’ তখন আর আমাদের ভাবতে হয় না অতকিছু। কবির একটুখানি ইশারাতেই আমরা পেয়ে যাই কবিতার মূল বক্তব্যকে। তেমনি অন্য একটি ইশারা ভাষাতে আমরা পাই—
‘যৌবনে উদ্ধত মানুষ-
গোধূলিনৃত্যের দৃশ্যকল্পে দাঁড়িয়ে
শীতকেও মাঝেমধ্যে সন্দেহের চোখে দেখে।’
(একটি শীত সন্দেহের কবিতা)
কবির এই উচ্চারণে- জীবনের নিগুঢ় রহস্য ইশারায়িত হয়ে উঠে নান্দনিক ইঙ্গিতে। সমকালীন উগ্রবাদের উল্লম্ফনে কবি চিন্তিত হয়ে উঠেন ভীষণ। চারিদিকে খুনোখুনি আর রক্তের ছড়াছড়িতে জেগে উঠে কবির ইশারাভাষা। কবি তখন অনিবার্যভাবেই বলেন উঠেন- ‘মুক্তমঞ্চে হোলি খেলে সরীসৃপের দল।’ প্রাণিজগতে সত্যিকারের সরীসৃপের চেয়ে মনুষ্যরূপী সরীসৃপ অতিভয়ঙ্কর। আর এদের ভয়েই স্বাভাবিক পৃথিবী কুঞ্চিত হয়ে আসে আপন বলয় ছেড়ে।
কবি বীরেন মুখার্জী এক অনন্য শব্দশিল্পী। নিরন্তর শব্দ বুনে বুনে তিনি আরাধনা করেন কবিতার। তার কবিতার ভাষাশৈলী যেমন একান্ত নিজস্ব তেমনি প্রতিটি কবিতার ভেতরেই বাস করে এক একটি গল্প, এক একটি থিম। রুচিঋদ্ধ শব্দ চয়ন, নূতন শব্দ নির্মাণ-কৌশল এবং সভ্য মানুষের উপযোগী কাব্যভাষায় কবি বীরেন মুখার্জী এক অপ্রতিম কবি। বিচিত্র উপমার জনক, বহুবর্ণিল চিত্রকল্পের স্রষ্টা কবি বীরেন মুখার্জী এক স্বপ্নবান কবি যিনি স্বপ্ন দেখেন এক সাম্যবাদী পৃথিবীর, অসাম্প্রদায়িক সমৃদ্ধির। তাই ইশারাভাষার বরপুত্র কবি নিজের বর্ণপরিচয়ে, বিশ্বাস-বিভেদে বারবার প্রবঞ্চিত হয়ে উচ্চারণ করতে বাধ্য হন—
‘বর্ণক্রম ভেঙে এখানে এসেছি
ভাঙছি এখনও
ভেঙে ভেঙে অবনত দাঁড়িয়েছি
সময়ের কাছে।
(আত্মজৈবনিক)