আর্ট এবং কবিতার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন ঘটেছে সৃজনকৌশলের যাকে এক কথায় শৈলী বা স্টাইল বলা হয়ে থাকে। স্টাইলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থেকেছে যুগ এবং ইজমের নাম। প্রাগৈতিহাসিক যুগ, মধ্যযুগ, রেনেসাঁ, নিও-ক্লাসিসিজম, রোমান্টিসিজম, মডার্নিজম, পোস্ট মডার্নিজম, পোস্ট পোস্ট মডার্নিজম—এসব হচ্ছে বিশেষত শিল্পকলা বা আর্টের ভুবনের কালভিত্তিক ও ইজম ভিত্তিক বিভাজনরেখা। আবার এদের প্রতিটি ভাগের মধ্যে নানাবিধ উপ-বিভাগ রয়েছে। তেমনি এসব বিভাগের এক একটির রয়েছে অনেকগুলো উপ-বিভাগ। যেমন শুধু মডার্নিজমের মাঝেই আছে ২০/২২টি উপ-বিভাগ বা ইজম যার কয়েকটি হচ্ছে রিয়েলিজম, ইমপ্রেসনিজম, সিম্বলিজম, কিউবিজম, বিমূর্তশিল্প, স্যুররিয়ালিজম ইত্যাদি। আর্টের ক্ষেত্রে এগুলো সবচেয়ে বেশি প্রযোজ্য। অতঃপর কবিতা। কিন্তু ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক প্রভৃতি ক্ষেত্রেও শৈলীগত মতবাদসমূহের কিছু কিছু অনসৃত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ যে সৃজনকৌশল ব্যবহার করে গল্প রচেছেন, কিংবা সমারসেট মম অথবা ও হেনরী কিংবা শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, তা এখন আর অনুসৃত হয় না। তাঁদের ছোটগল্পের স্টাইল আর কমলকুমার মজুমদার অথবা হাসান আজিজুল হকের ছোটগল্পের স্টাইল এক নয়। কিন্তু সবচেয়ে বড় বিষয়টি হচ্ছে, সমসাময়িক কালের গল্পকারদের সৃষ্টিকৌশলও তারতম্যে সমৃদ্ধ।
যখন থেকে লেখাপড়া শুরু, বলা যায় তখন থেকেই ছোটগল্প পাঠ। তারই ধারাবাহিকতায় সহসায় পড়লাম ইশরাত তানিয়ার বেশকিছু ছোটগল্প। ইতোপূর্বে অনলাইন সাহিত্য পত্রিকায় তার দুএকটি ছোটগল্প চোখে পড়েছিল কিন্তু পড়া হয়ে ওঠেনি। রাতদিন কবিতাযাপন হয়তোবা তার প্রধান কারণ। তো সহসায় একুট বেশি মনোযোগ দিয়ে পড়ে সেই ঘাটতি পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছি। ইশরাত তানিয়ার ছোটগল্পগুলো পড়ে প্রথমেই মনে হয়েছে তার মধ্যে মেধা, পরিশ্রম, ব্যাপক পঠনপাঠন ও উদ্ভাবনী মনের সুসমন্বয় ঘটেছে। আর সাহস। সীমানা ছাড়ানো। তিনি ছোটগল্প লেখেন, কবিতাও। কিন্তু তার পড়শোনার ভূগোল সীমান্তহীন, সীমানাহীন। শহরকেন্দ্রিক জীবন তাকে দিয়েছে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত জীবনের অন্দরমহল ও বহিরাঙ্গ চেয়ে দেখার এবং পর্যবেক্ষণ করার পর্যাপ্ত সুযোগ। তিনি নিজেই উচ্চশিক্ষিত মানুষ এবং উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাদানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। প্রাগসর জীবনদৃষ্টি, সাহসী মানসিকতা এবং লেখালেখির দুর্মর আকাঙ্ক্ষা জ্ঞানের ভুবনে নিজেকে হালনাগাদ রাখা এবং নবায়ন করে নেয়ায় প্ররোচনা জুগিয়ে এসেছে তাকে।
উপমহাদেশেীয় বা এশীয় সভ্যতা ও জীবন-সংস্কৃতির প্রতি গভীর ভালোবাসা গল্পটি লেখার পেছনে অন্যতম প্রবল প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে বলে অনুমিত হয়।
সাধারণভাবে লেখকের কোনো জেন্ডার কেন্দ্রিকতা থাকার কথা নয়। কিন্তু জেন্ডার একটা বাস্তবতা। বাস্তবতাকে কে এড়াতে পারে? ইশরাত তানিয়া শারীরিক সত্যে একজন নারী। এটা তার মানসিকতারও অপিরহার্য অংশ। বিশ্বমানবগোষ্ঠীর অর্ধেক নারী। যে কোনো বিবেচনাতেই তারা পুরুষ সম্প্রদায় কর্তৃক শাসিত, শোষিত, নিপীড়িত ও বঞ্চিত। সত্যিকার অর্থে শিক্ষিত অথবা স্বশিক্ষিত নারীর চেতনায় বিষযটি পীড়া দিবেই, তার চেতনায় একটু আগুন জ্বালাতে চাইবেই; তিনি তা কখনো সচেতন সক্রিয়তায় তা উপলব্ধি করবেন, কখনো-বা তা তার অবচতেনে অস্বস্তি সৃষ্টি করবে। ইশরাত তানিয়া এসবই দেখেছেন, সবই বুঝেছেন, পুরুষতন্ত্র-পুঁজিবাদ এসবের অবসানও চান কিন্তু তিনি তার সৃজনশীলতাকে সেসবের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য যুদ্ধ করার তলোয়ারে অথবা ক্ষেপণাস্ত্রে পরিণত করেননি। তিনি নারীর মুক্তি চান কিন্তু প্রচলিত অর্থে নারীবাদের কর্মী হতে চাননি। হয়তোবা নারীবাদ শব্দটিও তার পছন্দ নয়। তার কেন্দ্রীয় চাওয়াটা হচ্ছে ভাবনা ও শৈলীর প্রাতিস্বিকতায় একজন শক্তিমান কথাসাহিত্যিক হওয়া। আবার তার চেতনায় পুরুষতন্ত্র পুঁজিবাদ এসব নিত্যসক্রিয়তায় বিষ-নিঃশ্বাস ছড়াতে থাকায় কোনো না কোনো ভাবে সেসব অনুপ্রবেশ করে ফেলে তার ছোটগল্পে। সেই অনুপ্রবেশের পদশব্দ কখনো শোনা যায়, কখনোবা তা সাইলেন্সার লাগানো। ‘দাফন অথবা দাহের কিছু আগে’ গল্পে পুরুষতন্ত্র প্রযোজিত পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা, সাম্প্রদায়িকতা, নারী নির্যাতন, দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির ছোবল, প্রেমের নামে অপ্রেম ইত্যাদি অনেকটাই স্পষ্ট কিন্তু ‘ঝিঁঝিপোকারা যা বলে থাকে’ গল্পটিতে প্রেমের নামে অপ্রেম, দেহসর্বস্ব সম্পর্ক ইত্যাদির উদ্ভাসন পরোক্ষ, সাংকেতিক এবং প্রতীকায়িত। ‘ধুলাবালি প্যাকেজ’ গল্পটির মধ্যে করোনা অতিমারিতে গার্মেন্টস মালিকদের কারও কারও সরকারি ইনসেনটিভের টাকায় নতুন বহুমূল্য বাড়ি ক্রয় এবং আরেকদিকে গার্মেন্ট শ্রমিকদের পরিবহণ ছাড়াই ধুলাবালির মধ্য দিয়ে হেঁটে কারখানামুখী পদযাত্রার ছবি তুলে ধরা হয়েছে। পুঁজিবাদ প্রযোজিত-পরিচালিত রাষ্ট্র কর্তৃক একদিকে গার্মেন্টস মালিকদের জন্য হাজার হাজার কোটি টাকার ইনসেনটিভ প্যাকেজ আর অন্য দিকে গরিব শ্রমিকদের জন্য ‘ধুলাবালির প্যাকেজ’- বিপরীতমুখী দুই ছবি একই ক্যানভাসে এঁকেছেন ইশরাত তানিয়া। কিন্তু প্রত্যক্ষভাবে কোনো পক্ষ নেননি। আবার ‘একরারনামা’, ‘অবনী বাড়ি নাই’ ‘ডি-ওয়ানের একজন’, ‘গল্পটা রবিবারেরও হতে পারত’ প্রভৃতি গল্প অনেকটাই বিজড়িত-না হওয়ার-মন নিয়ে লেখা। এসব গল্পে সামাজিক ভাবনা কিংবা কোনো মতবাদে ছোঁয়া নেই বললেই চলে।
ইশরাত তানিয়ার মূল শক্তিটা তার গল্প বুনন ও বলার ধরনে। তার গল্পের জমিনে ও প্রাণে পোস্ট ইমপ্রেসনিজম, কিউবিজম, সিম্বলিজম, পোস্ট মর্ডানিজম ইত্যাদির ছায়া ও ছোঁয়া আবিস্কার করা সম্ভব। কিন্তু তিনি কোনো ইজমকে অন্ধভাবে কিংবা হুবহু অনুসরণ করতে চাননি। অনেক ক্ষেত্রেই তিনি গল্পের মধ্যে প্রচলিত ধারার কোনো নিটোল গল্প বলতে চাননি। তিনি যাবিত জীবন, অনুভূত জীবন, প্রত্যাশিত জীবন প্রভৃতির খুচরো ও খণ্ড খণ্ড ছবি উপস্থাপন করেছেন নিস্পৃহ কথকের ভঙ্গিমায়। তিনি কোনো একরৈখিক জীবনের স্পষ্ট ছবি আঁকেননি; বলা যায়, চোখে দেখা, পঠনে জানা, কল্পনায় ও ভাবনায় পাওয়া জীবনের নানা অংশ খুচরো দৃশ্যে উপস্থাপন করেছেন। তিনি সময়ের রাস্তা থেকে হলুদ হয়ে ঝরে পড়া জীবন কুড়িয়েছেন, সবুজ পাতা নিয়ে হুমকিগ্রস্ত জীবনকে ছুঁয়ে দেখেছেন রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে;তিনি রাস্তার পাশে জমে ওঠা দুঃখ কুড়িয়েছেন, এলোমেলো হাওয়ায় উড়তে থাকা ভাবনা কুড়িয়েছেন। তিনি সেধরনের গল্পগুলোর সমাপ্তিতে কোনো সমাপ্তি রচেনি।
তার ‘মেলো ইয়েলো, শিউলিগাছ আর বারান্দা হচ্ছে’ গল্পটির কথাই ধরা যাক্। তার এই গল্পটি খোলা প্রান্তরের মতো। গল্পে একাধিক চরিত্র আছে, প্রকৃতি ও শহরের অনুষঙ্গ আছে, দাম্পত্য জীবনের ছবি আছে কিন্তু তিনি কোনোকিছুকেই ‘কেন্দ্রীয় চরিত্র’ বা ‘কেন্দ্রীয় বিষয়’ হিসেবে উপস্থাপন করার মতো প্রত্যক্ষ ভাষা ব্যবহার করেননি। গল্পটিতে তানিয়াকে কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে ধরা যায় কিন্তু আসলেই কি একটি মানবীয় চরিত্র চিত্রণ এই গল্পের মূল লক্ষ্য? না মনে হয়। বরং প্রযুক্তির সহায়তায় ফুলে ফেঁপে ওঠা পণ্য সংস্কৃতি, মানুষের দাম্পত্য জীবন থেকে আবেগ বা প্রেমের অপসৃয়মানতার ছবি, প্রকৃতির উদার সঙ্গ, ছায়া ও ছোঁয়া থেকে বঞ্চিত হওয়ার মানসিক যন্ত্রণা, নিত্য সম্প্রাসরাণশীল নির্মম নগরায়নের মুখে সংখ্যায় সংখ্যালঘু সংবেদনশীল মানুষের বেদনাদগ্ধ আশাহীন আশা এসবই গল্পটিকে বহুমাত্রিক অর্থব্যঞ্জনার সমৃদ্ধি দান করেছে।
দ্রুতগতির অপরিকল্পিত নগরায়ন আর পুঁজিবাদী পণ্যসংস্কৃতির ভয়াবহ সম্প্রসারণকে যথাযথভাবে ব্যঞ্জিত করতে তিনি গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ‘ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অব সলিট্যুড’ উপন্যাস থেকে প্রসঙ্গ এনে প্রতিতুলনা রচনা করেছেন। নগরজীবন নিয়ে রচিত গল্পের ছড়াছড়ির মাঝেও এই গল্পটি দ্রুত পরিবর্তনশীল নগরজীবনকে অবলোকনের শাণিত সূক্ষ্ণতায় এবং পর্যবেক্ষণ-অনুভবসমূহকে উপস্থাপনের অভিনব চারুতায় উজ্জ্বল বিশিষ্টতার দাবিদার। একথা বলতেই হয় যে, আলো-আঁধারি ভাষায় রচিত কাব্যিক উপসংহার গল্পটিকে অনন্য মহিমা দান করেছে: ‘রুটি-সবজি টেবিলে পড়ে থাকে। ফ্রিজ করতে মনে থাকে না। মধ্যরাতে আলো নিভে যাওয়া শহরের বারান্দায় কিছু হচ্ছে। তানিয়ার ঘুমলাগা চোখ দেখে একটা বারান্দাই হচ্ছে। ওল্ড স্পাইস, পরাগ, শশী ডাক্তার আর মার্কেজ নিজেদের ভাষায় কী যেন বলছে। ওদের হাতে লেমন ফ্লেভার্ড মেলো ইয়েলো। একশ বছরের নিঃসঙ্গতা ছড়িয়ে পড়ছে টুকরো টুকরো হয়ে।
নাগরিক বারন্দায় উথালপাথাল জোছনায় ভিজতে থাকে তানিয়া। সেখানে একিটা শিউলিগাছ সাদা ফুল ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাতের আবহে হলুদ টপ উড়ছে।’ আর পাঠকের নিজের মতো করে ভেবে নেয়ার অথবা প্রজেক্টেড বাস্তবতার সাথে নিজের কল্পনার সংযোজন ঘটানোর অঃনিশেষ স্পেস গল্পটিকে পাঠান্তে নিঃশেষে ফুরিয়ে না যাওয়ার ঐশ্বর্য দান করেছে।
‘অবনী বাড়ি নাই’ একটি অসাধারণ সুন্দর ছোটগল্প। রায়হান, পিয়া, দীপা ও অনন্যা অবনী। রায়হান একজন পুরুষ,বাকি তিনজন নারী। এটা প্রেমের গল্প নাকি প্রেমহীন ঘর-সংসারের, সেকথা ভাবতে গেলে ফয়সালা জোটে না। রায়হান একসময় ভালোবেসেছিল দীপাকে, অতঃপর অবনীকে। সে সংসার করে বিবাহিত স্ত্রী পিয়ার সাথে। বাস্তবে না এলেও তার চিন্ময় জীবনে কবি অনন্যা অবনীর গভীর উপস্থিতি জাদুময়তার ব্যঞ্জনায় ভরা। কিন্তু অবনী কোনোদিন রায়হানের প্রেমে পড়েছিল, এমন কথা গল্পে নেই। মনে মনে অবনীর প্রেমে পড়া রায়হান তার স্ত্রী পিয়াকে প্রচলিত অর্থে ফাঁকি না দিলেও তার মন পড়ে থাকে অবনীর কাছে। রায়হান-পিয়ার সংসারে অথবা রায়হানের বাস্তব জীবনে ‘অবনী নাই’ কিন্তু ভাবনাচালিত একতরফা প্রেমে ‘অবনী আছে’। অবনী নামক নারীর একতরফা প্রেমে পড়ে সে সবচেয়ে বেশি ঠকাচ্ছে নিজেকে। বিনা দোষে একধরনের প্রতারণার শিকার হচ্ছে সংসারী নারী পিয়া অথচ তা ভদ্র নিরীহ রায়হানের রাডারে ধরা পড়ছে না। তাদের দাম্পত্য জীবন ‘প্রেমহীন ভালোবাসাবাসি’-তে এসে ঠেকেছে এবং তা যে কোনো সময় ভেঙে গেলেও যেতে পারে যদিও গল্পকার অতদূর নিয়ে যেতে চাননি পাঠককে। বড়ই অদ্ভুত রায়হান নামক মানুষটির মন। বিজ্ঞানের হাজারো আবিস্কার, চিকিৎসা বিজ্ঞানের আকাশ ছোঁয়া সাফল্য, প্রযুক্তির সর্বগামী উপস্থিতি কোনোকিছুই মানবমনের সবখানি রহস্য উন্মোচন করতে পারেনি আজো। গল্পটির বড় ঐশ্বর্য হচ্ছে ভাবনার বহুমুখিনতার ইশারা। অবনীকে যদি নারী হিসেবে না দেখে প্রেমের প্রতীক ধরা হয়, তবে সত্যি সত্যি ‘অবনী বাড়ি নাই’। কারণ রায়হান-পিয়ার সংসারে প্রেম নেই। একসময় পিয়াও ধরতে পারে রায়হানের মনে তৃতীয় কারও অথবা কোনোকিছুর আগ্রাসী অস্তিত্বের বিষয়টি। তো রায়হান-পিয়ার দাম্পত্য সম্পর্কের পরিণতি কি? গল্পকার বলছেন এমন: ‘এপাশে দুটি মানুষ নাকি বিন্দু, পাশাপাশি শুয়ে গাঢ় অন্ধকারে তাকিয়ে…’। এই অন্ধকার কি অন্তহীন নাকি শেষপ্রান্তে আছে কোনো আলো ? পাঠক স্পষ্ট কিছুই দেখতে পায় না, কেবল রায়হান-পিয়ার ‘প্রেমহীন ভালোবাসাবাসির ঘর’ এর কথা ভাবতে ভাবতে তার ভাবনার ইউটিউবে বেজে ওঠে ভূপেন হাজারিকা গানের সেই কলি: ‘প্রেমহীন ভালোবাসা দেশে দেশে ভেঙেছে সুখের ঘর….’। রায়হানের অবনীমুগ্ধতা কি প্রেম? নাকি মোহ? এর আগে রায়হান দীপার প্রেমেও তো পড়েছিল দড়িছেড়া টান নিয়ে! প্রেম কি মৌসুমী রঙিন হাওয়া ? অবনীর সাথে বিয়ে-সংসার হলে কি রায়হান চিরমুগ্ধ চিরতৃপ্ত থাকতো অবনীতেই? এসব ভাবনার খোরাক আছে গল্পটিতে। পাঠকের কোনো লোকসান নেই।
গল্পকার হিসেবে ইশরাত তানিয়ার শক্তিমত্তার মূলে আছে পৃথিবী ও মানুষ সম্পর্কে ব্যাপক, গভীর ও নিবিড় পঠন পাঠন এবং দৃশ্যমান বিষয়গুলো সূক্ষ্ণভাবে পর্যবেক্ষণ ও অনুধাবন করা। এই পাঠনপাঠন ও পর্যবেক্ষণ- অনুধাবন গল্প বলার সময় তাকে জুতসই ও নিজস্ব ভাষা তৈরীতে সহায়তা করে। তিনি ‘ময়নামতি ( সেটেরিস প্যারিবাস)’ নামক ছোটগল্পে বৌদ্ধসভ্যতার নানাছবি উপস্থাপন করেছেন ভাবনার লম্বা ক্যানভাস বিছিয়ে। গল্পটি প্রকৃতির দিক থেকে মহাকাব্যিক। গল্পের ভাষা কথক ও শ্রোতার আশ্রয় নিয়েছে সফলভাবেই। মহাকাব্যিক গভীরতা ও ব্যাপ্তির এতবড় বিষয় নিয়ে ইতোপূর্বে কোনো ছোটগল্প লেখা হয়েছে কি না আমার জানা নেই। রবীন্দ্রনাথের ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ কোনোভাবেই এই শ্রেণিতে পড়ে না। গল্পের প্রজ্ঞা পারমিতা একটি অসাধারণ সুন্দর চরিত্র। দাম্পত্য জীবন বিমুখ বৌদ্ধ ভিক্ষুদেরও তার প্রেমে পড়ার কথা। পড়েনিকো? গল্পের শেষে টীকা ও তথ্যসূত্র একটি নতুন সংযোজন; তবে তিনি তা না দিলেও পারতেন। এই গল্পে তানিয়ার গল্প বলার অভিনব শৈলীর পাশাপাশি ফুটে উঠেছে তার মনের বিশালতাও। বিভাজিত মন নিয়ে এমন গল্প লেখা যায় না।
ইশরাত তানিয়ার আরেকটি দুর্দান্ত সুন্দর গল্প হচ্ছে ‘গজ্ঞা ঠাকুরের সুগন্ধি’। শিল্পকলার ইতিহাসে আধুনিক পর্বের একজন বিশ্ববিখ্যাত পোস্ট ইমপ্রেসনিস্ট চিত্রকর পল গগাঁ। ফরাসী নাগরিক। তিনি একধরনের বিদ্রোহী চিত্রকর ছিলেন। আধুনিক সভ্যতার মেকি, অসততা, কৃত্রিমতা ও হৃদয়হীনতার বিপক্ষে অসন্তোষ্ট ও সংক্ষুব্ধচিত্ত তিনি চিত্রশিল্পে আদিবাসী মানুষের সহজ সরল সত্যনিষ্ঠ জীবন-ছবি এবং তাদের সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি এঁকেছিলেন। সেজন্য তিনি প্যারিস ছেড়ে পলিনেশিয়ার তাহিতি দ্বীপে গিয়ে সেখানকার আদিম সমাজের মাঝে বসবাস শুরু করেন, তাদের জীবন-সংস্কৃতি রপ্ত করেন এবং ছবি আঁকেন সেসব অনুসরণপূর্বক। ‘বেদিং তাহিতিয়ানস’, ‘হোয়াট উই আর ডুয়িং’, ‘তাহিতিয়ান ইউমেন’, ‘গার্ল উইথ ফ্রুট ডিশ’, ‘স্পিরিট অব ডেড ওয়াচিং’ ইত্যাদি তাঁর বিখ্যাত ছবি। তাঁর ‘স্পিরিট অব ডেড ওয়াচিং’ চিত্রকর্মটি দেখে নারী মনে হয়, পুরুষও মনে হয়। তাঁকে তথাকথিত সভ্য শিল্পসমালোচকগণের নির্মম নেতিবাচক সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। কিন্তু তিনি তার আদর্শের জন্য লড়াই করেন এবং লড়াই করতে করতে অসহায় অবস্থায় মারা যান। এই পল গগাঁর জীবন ও শিল্পাদর্শনকে ভাবনায় নিয়ে তানিয়া রচনা করেছেন ‘গজ্ঞা ঠাকুরের সুগন্ধি’ নামের গল্পটি। তিনি গগাঁর নাম একটু পরিবর্তন করেছেন, পরিবর্তন করে দিয়েছেন গল্পের ভূগোল। পলিনেশিয়ার তাহিতি দ্বীপের পরিবর্তে তাকে নিয়ে এসেছেন বাংলাদেশের ময়মনসিংহ অঞ্চলের মৈমনসিংহ গীতিকার ভূগোল দীঘলহাটি গ্রামে। এখানকার আদিবাসী নরনারীর সঙ্গে বসবাস শুরু করতে থাকে গজ্ঞা। খাতির হয় ভূমিপুত্রদের সাথে। সুনালি, মানকে, চান্দমা প্রমুখ আদিবাসী নরনারী তাকে আদিবাসের জীবন ও সংস্কৃতি সম্পর্কে অবগত ও অনুরক্ত করে তোলে। সে সেখানে থেকে যায়, আঁকতে থাকে সত্যনিষ্ঠ ছবি একের পর এক। তানিয়া উপসংহার টেনেছেন: ‘আহ! সভ্য মানুষের শেষ চিহ্নগুলো গজ্ঞার গা থেকে মুছে যাচ্ছে। একটা মোটা ডাল দুজনের কাঁধে। অরণ্য থেকে ফিরে যাচ্ছে গজ্ঞা। সম্পূর্ণ অন্য মানুষ হয়ে। চারপাশে কী অপূর্ব সুঘ্রাণ! ক্লান্ত দেহ জুড়িয়ে যায় সেই গন্ধে। সূর্য ডোবার আগেই কুঁড়েতে ফিরে আসে দুজন।
ভোরের আকাশ ঈষৎ রক্তিমাভ। কাঠ খোদাই করছে গজ্ঞা। মৃদু হাসি ঠোঁটে। প্রতিবার ছুরি চালানোর পর বুকভরে শ্বাস নেয় সে। হাওয়ায় ভাসছে আনন্দ সুঘ্রাণ…’ এটা গল্পই নয় কেবল, ইউরো-মার্কিনী প্রযোজনায় চালিত মেকি আধুনিক সভ্যতার বিরুদ্ধে তানিয়ার এক ধরনের বিদ্রোহ। একইসঙ্গে প্রচলিত গল্প রচনার বিপরীতে দাঁড়িয়ে গল্প রচনা। তিনি গভীরভাবে বিশ্বাস জাগানিয়া ভাষায় ও আকর্ষণে অবিশ্বাস্য বিষয়ে গল্প রচনা করেছেন। গল্পটি পড়ার সময় তাই একবারও এটিকে কল্পকাহিনী কিংবা গাঁজাখুরী আষাঢ়ে গল্প মনে হয় না। গল্পটিকে সত্য বলে বিশ্বাস করতে প্রবল প্ররোচনা ও গভীর ইচ্ছা জাগে মনে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সুলতান, নভেরা, আরজ আলী মাতবর-দের জীবন-কর্ম নিয়ে অনেক আগেই ভিন্ন ভিন্ন উপন্যাস লিখেছেন প্রখ্যাত কথাশিল্পী হাসনাত আবদুল হাই। তবে সেসব উপন্যাস হচ্ছে সত্য ঘটনা বা বাস্তবের রূপান্তর। কিন্তু ইশরাত তানিয়ার ‘গজ্ঞা ঠাকুরের সুগন্ধি’ হচ্ছে অবাস্তবকে বাস্তব করে তোলা, কল্পনাকে সত্যে উন্নীতকরণ। এটা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। কিন্তু তানিয়া ঈর্ষণীয় সাফল্যে উৎরে গেছেন। এক্ষেত্রে তাকে সফল সহায়তা দিয়েছে বিষয়বস্তু সম্পর্কে সূক্ষ্ণ জ্ঞান এবং সেই জ্ঞানকে উপভোগ্যতায় উপস্থাপনের কাব্যগন্ধী ভাষা। ছেটো ছোট বাক্য। প্রতিটি বাক্য এক একটি চিত্রকল্প। উদাহরণস্বরূপ একটা ছোট অংশ উদ্ধৃত করা যায়: ‘ফরাসি নান্দনিকতায় সুনালিকে সুশ্রী বলা যায় না কিন্তু গজ্ঞার চোখে সে সুন্দর। রাফায়েলীয় ঐকতানের সুরে তার শরীরের বাঁকা রেখাগুলো মিলে গেছে। ওই মুখ চোখ ঠোঁট যেন ভাস্করের হাতে গড়া। যে ভাস্কর জানে কীভাবে চলমান রেখায় আনন্দ আর যন্ত্রণাকে ধারণ করা যায়। সুনালির বিশাল দুটো চোখের ভাষা পড়তে ভয় লাগে গজ্ঞার। ওই চোখের ভেতর সে দেখতে পায় গভীর বিষাদ আর আনন্দের মহাজাগতিক উৎস। ছবি আঁকতে আঁকতে থরথর করে কেঁপে ওঠে সে। মগ্নচৈতন্যে তলিয়ে যায়। স্কেচ করতে থাকে সমাচ্ছন্ন হয়ে। ক্রমশ সুনালির মুখাবয়ব জাগে কাগজের গায়ে।’ উপমহাদেশেীয় বা এশীয় সভ্যতা ও জীবন-সংস্কৃতির প্রতি গভীর ভালোবাসা গল্পটি লেখার পেছনে অন্যতম প্রবল প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে বলে অনুমিত হয়।
‘আনীলার রক্তিমাভ মুখের ওপর মোরশেদের মুখ। দু’হাতে ওর গালদুটো আলতো করে চেপে ধরে আনীলা। কার ওপাঠানো স্ক্রিনশটে সে দেখেছিলো মোরশেদের উত্থিত শিশ্ন। মদের আবেগে নেশাগ্রস্ত বিভ্রমে স্মিতহাসি ঠোঁটে নিয়ে যেন স্বগতোক্তিই করে—নাজিয়াকে তুমি চেনো?
কথাশিল্পী হিসেবে ইশরাত তানিয়া প্রাতিস্বিকতার পরিচয় দিয়েছেন তার বহু ছোটগল্পে। ‘ঝিঁঝি পোকারা যা বলে থাকে’ শিরোনামের গল্পটির বিষয় ভাবনা, উপস্থাপনা কৌশল এবং ব্যবহৃত ভাষা এককথায় সাহসী ও অনন্য। গল্পটি মোটামুটি গোছানো। একজন উচ্চশিক্ষিত বিবাহিত নারীর দাম্পত্য জীবনের বঞ্চনা, স্বামী নামক পুরুষপ্রাণীর ঈর্ষাপরায়ণতা ও বহুগামিতাজনিত অবিশ্বস্ততা এবং দাম্পত্যসুখ থেকে বঞ্চিত নারীর শারীরিক-মানসিক চাহিদার জন্য জ্যেষ্ঠ সহকর্মীপ্রায় অন্য একজন পুরুষের সাথে গোপনে বছরে দুএকবার মিলিত হওয়া এসবের ছবি ফুটে উঠেছে গল্পের জমিনে। তার সাথে উঠে এসেছে সংসারে নারীর গভীর ব্যক্তিত্ব ও আর্থ-সামাজিক প্রতিষ্ঠাকে সহ্য করতে না পারার মতো স্বামী-পুরুষের হীনমন্যতা ইত্যাদির ছাপ। গল্পটিতে তানিয়া দ্বিধাহীনভাবে ব্যবহার করেছেন যৌনতা সংশ্লিষ্ট শব্দ ও দৃশ্যাবলি। গল্পটি একারণে আরও ভয়ংকর যে, গল্পের নারী আনীলার জীবনে আবির্ভূত স্বামী রিয়াদ এবং বঞ্চনাকালের প্রেমিকরূপী পুরুষ মোরশেদ উভয়েই চরিত্রের দিক থেকে শরীরস্বর্বস্ব, সাধারণত যাদের লম্পট স্বভাবের লোক বলা হয়ে থাকে। তারা বহুগামী এবং স্বাভাবিকভাবেই কোনো নারীর প্রতিই বিশ্বস্ত নয়। তো পুরুষরা স্বামী হিসেবে, প্রেমিক হিসেবে, বন্ধু হিসেবে, সহকর্মী হিসেবে কী চায় নারীর কাছ থেকে, কেন তারা নারীকে কাছে ডাকে এসবের অর্থ অজানা নারী আনীলার কাছে। ফলে পুরুষের সবকিছুরই মধ্যে পুরুষ ঝিঁঝিপোকার শরীরসর্বস্ব বিরক্তিকর ডাকের মধ্যে তুলনা খুঁজে পায় আনীলা। গল্পের উপসংহারটুকু ভয়ংকর পরাবাস্তবতার বা অতিবাস্তবতার দৃশ্য রচনা করেছে যেখানে কথিত প্রেমিক পুরুষ মোরশেদের যৌন আদরে খসে খসে পড়েছে শারীরিক সুখহীন দাম্পত্যে হাঁপিয়ে ওঠা আনীলার স্তন, নাভি, সবকিছু। মোরশেদের প্রেমপরিচয়জ্ঞাপক যৌন আদর বিষাক্ততার ব্যঞ্জনায় যৌন মিলনের মধ্য দিয়ে আনীলাকে রক্তাক্ত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়ে গল্প শেষ হয়েছে। দাম্পত্য জীবনে পুরুষের বহুগামিতাজনিত কারণে সৃষ্ট যৌনসুখবঞ্চনা এবং প্রেমিকরূপী পুরুষের প্রেমহীন যৌনতা নারীর অনুভূতিতে কতটা গভীর রক্তাক্ত ক্ষত সৃষ্টি করে যা পুরুষরা বোঝে না, বঝুতে চায় না, সেসব কথা তুলে ধরেছেন গল্পকার। নারীর প্রতি শ্রদ্ধাহীন প্রেমরিক্ত অবিশ্বস্ত লম্পট পুরুষের প্রতি নারীর ঘৃণা কতটা প্রবল ও গভীর এবং প্রতিবাদের ভাষা কতটা ধারালো হতে পারে তার ভয়ংকর উদাহরণ এই গল্পের উপসংহারটুকু। যদিও উদ্ধৃতিটি একটু দীর্ঘ হবে, তবু এখানে তুলে দিতে চাই উপসংহার অংশটি: ‘আনীলার রক্তিমাভ মুখের ওপর মোরশেদের মুখ। দু’হাতে ওর গালদুটো আলতো করে চেপে ধরে আনীলা। কার ওপাঠানো স্ক্রিনশটে সে দেখেছিলো মোরশেদের উত্থিত শিশ্ন। মদের আবেগে নেশাগ্রস্ত বিভ্রমে স্মিতহাসি ঠোঁটে নিয়ে যেন স্বগতোক্তিই করে—নাজিয়াকে তুমি চেনো?
আমার অস্ত্র ছিল এই দেহ।’ তারপরের বর্ণনা: ‘কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে প্রিন্ছা। যেন সাইদকে উদ্দেশ্য করে না, নিজেকেই জিজ্ঞেস করে- এখনও কি ভালোবাসো?”
বিরোধিতায় নাকি বিহ্বলতায় কী যেন পিছলে ভেতরে চলে যায়। আনীলার স্তনে হাত রাখতেই দুটো স্তন খুলে আসে শরীর থেকে। বিছানা থেকে গড়িয়ে মেঝেতে পড়ে ঘুরতেথাকে লাটিমের মতো। জিভ ছোঁয়াতেই নাভি খসে পড়ে লাফিয়ে নেমে যায়। ব্যথার গভীর কালো জল থেকে আনীলা প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীর মতো নিজের রক্তাক্ত বিকালাঙ্গ শরীরটাকে বালিশে চাদরে টেনে হিঁচড়ে মোরশেদের শরীরে উঠে আসে। শেষ শক্তিটুকু দিয়ে পুরুষদণ্ড গেঁথে দেয় যোনিতে। তখনই অসংখ্য ঝিঁঝিপোকা মোরশেদেরে হাড় মজ্জা মগজ ফুঁড়ে উড়ে যায়। দৃশ্যপটে মোরশেদ ক্রমাগত আবছা হয়ে আসে।
অঢেল রক্তে ডুবে যেতে যেতে আনীলা মৃত্যূর আচ্ছন্নতায় দেখে নোনা রক্তঘামের প্রবাহ। হতে পারে সেটা নিজেরই জন্মরক্ত। সেই গুরুভার তরল মহাস্রোতে ভেসে যাচ্ছে নিস্ফল নীলাভ স্ফুলিঙ্গ। লালের ঔজ্জ্বল্যে হিম নিবুনিবু…’। সাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গনের তৎপর ও স্মার্ট পুরুষদের পক্ষেও এই গল্প উপভোগ করা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। ভোগবাদী পুরুষতন্ত্র ছুরির শাণিত সূক্ষতায় ক্রিয়াশীল সাহিত্য-সংস্কৃতির আঙিনায় সবচেয়ে বেশি। একথা জেনেও ইশরাত তানিয়া এমন গল্প রচেছেন। এটি একটি ভয়ংকর সুন্দর ছোটগল্প। তানিয়াকে দুঃসাহসী কথাসাত্যিক বললেও সেটা অতিশোয়োক্তি হবে না।
ইশরাত তানিয়া খুঁটে খুঁটে দেখেছেন জীবনের খুটিনাটি। তিনি জীবনের মহাসড়ক দেখেছেন ডিএসএলআর ক্যামেরা লাগিয়ে চোখে, দেখেছেন সরু অলিগলি চোরের টর্চলাইট নিয়ে হাতে। তিনি আসলে জীবনশিল্পী। তবে তার অসাধারণত্ব হচ্ছে গভীরভাবে জীবনমুখী শিল্পী হয়েও তিনি শিল্পকলার শৈলী বা নান্দনিক সৌকর্যকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন সবসময়। তার ‘একটি শব্দের পোস্ট রিয়েলিটি’, ‘ইশতেহার ও অলপ্পেয়ে’, ‘একরারনামা’, ‘মোহাম্মদপুর যেভাবে নির্লিপ্ত’, ‘আপাত অব্যক্তিগত’, ‘গল্পটি পরিবারেরও হতে পারত’ প্রভৃতি গল্পে জীবনের কথাই উঠে এসেছে। আবার ছোটগল্পের শৈলীর দিকটিও বজায় থেকেছে। ‘একটি শব্দের পোস্ট রিয়েলিটি’ গল্পটির মাঝে রবীন্দ্রনাথের ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ নামক বিখ্যাত গল্পের ছায়া আবিস্কার করা যায়। এই গল্পে বাস্তবতা ও পরাবাস্তবতা মিলে রচনা করেছে একধরনের অতিবাস্তবতা। গল্পের গোলাপি, হারুন, পটল, মিন্টু বাবুর্চি, প্রতিটি চরিত্রই জীবন্ত ও বাস্তব। কিন্তু ভেতরের ব্যঞ্জনায় এটি ক্ষুধিত পাষাণের কপি নয়। গল্পটির কেন্দ্রীয় চরিত্র একটি অসনাক্ত ঝুমুর ঝুমর শব্দ এবং তার সঙ্গী কয়েকটি উষ্ণশ্বাস বা দীর্ঘশ্বাস। শব্দটির উৎস নিয়ে নানা ধরনের অনুমান করা যায়, নানাদিকে সিদ্ধান্ত যেতে পারে। আগে রাজাবাদশারা হেরেমখানায় রেখে নারীদের নিয়ে ফুর্তি করতো; এখন করে ক্ষমতাবান-বিত্তবান পুরুষসহ সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনের গডফাদার পুরুষরাও। গল্পটি যেন বলতে চায়, নারীর আড়ালের কান্না এখনও থামেনি, আজও বহমান সেই কান্না একটু আধটু রূপ পাল্টিয়ে। পুরুষতন্ত্র রয়ে গেছে ভিন্নরূপে, নারীর আড়ালের কান্নাও রয়ে গেছে আড়ালের ধরন পাল্টিয়ে। পুরুষতন্ত্র আজও নাচিয়ে চলেছে নারীকে ভোগের দরবারে বাণিজ্যের পণ্য ও ভোগ্যপণ্য করে। কিন্তু এসব ওপেন সিক্রেট সামনে আসে না। সংকেতমাখা উপসংহারে বলা হয়েছে, ‘‘চার্জ লাইট বসার ঘরে সেন্টার টেবিলের ওপর রাখে হারুন। বড়ো বড়ো ছায়া খেলে দেয়ালে আর মেঝেতে। এমন অন্ধকারে শব্দের উৎস খোঁজ করা যায় না। বিদ্যুৎ আসার অপেক্ষায় সবাই বসে থাকে।’’ এই অন্ধকার প্রতীকী। এই অপেক্ষা অন্তহীন।
একরাত অন্ধকার ফুরোতে না ফুরোতে রঙিন আলোর পায়ে চলে আসে নতুন কোনো অন্ধকার। ভিন্নবেশী। ছদ্মবেশী। আসলে পুরুষতন্ত্র প্রযোজিত ছলচাতুরীর রঙিন অন্ধকার ঢেকে রাখে, ঢেকে আছে সবকিছু। গল্পটির তাৎপর্য এখানেই যে ক্ষুধিত পাষাণ যুগের সম্রাটরা আজ না থাকলেও নানা ছলচাতুরীতে নারীকে শোষণকারী, নিপীড়নকারী ও দাবিয়ে রাখা পুরুষতন্ত্র রয়ে গেছে। এ বিষয়ে উপযুক্ত অবস্থানের নারীদের এবং নারীর প্রতি সহানুভূতিশীল পুরুষদের সক্রিয়ভাবে সচেতন হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা হচ্ছে গল্পটির সৃষ্টিকারুকাজ ও পরিবেশনা কৌশল যা পাঠককে টেনে নিয়ে যায় রহস্য আবিস্কারের নেশায়।
ইশরাত তানিয়ার ‘বীজপুরুষ’ গল্পটি পড় পড়তে পড়তে মাঝপথে বিরক্ত হয়ে উঠছিলাম এই ভেবে যে এখনও আমাদের গল্পকারগণ দেশটাকে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর লালসালুর দেশ ভেবে চলেছে। দেশে কত পরিবর্তন। প্রতিটি গ্রামে পৌঁছে গেছে বিদ্যুৎ ও পাকা রাস্তা। তার সাখে সেলফোন আর ইন্টারনেট। গ্রামের মানুষ এখন তো সর্দিকাশি হলেও এমবিবিএস ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়। কত প্রতারণার ছবি দেখে—বড় কিংবা ছোট স্ক্রিনে। মানুষ তো আর আগের মতো বোকা নেই। কিন্তু গল্পটির শেষাংশের বর্ণনার জাদুময়তা মনকে ভরে দেয় মোহনীয় মুগ্ধতায়, অনির্বচনীয় বিস্ময়ে। অনেকটা সাদামাটা গ্রামীণ পরিবেশের কথাবার্তা দিয়ে গল্পের শুরু এবং চলতে থাকা কিন্তু উপসংহারের কাছাকাছি এসে তা মোড় নিয়েছে প্রকাশ, আড়াল, রহস্যময়তা, কল্পলোক ও অতিবাস্তবতার রাজ্যে যেখানে পাঠকের কল্পনার অনিঃশেষ অবকাশ সৃষ্টি হয়েছে। সন্তানহীনা নিলুফার, গ্রামবাসীর অনেকেরে কাছে রহস্যমানব পরপুরুষ কারিগর এবং কারিগরের কাঠের বাক্স। কারিগরের কাঠের বাক্সটি বাহ্যিকভাবে জাদুর বাক্সের ভূমিকা পালন করলেও সন্তানহীনা নিলুফারের সন্তানবাসনা এবং দুজনের শরীরী ক্ষুধাকে গল্পকার ভিড়িয়েছেন এমন এক মোড়ে যেখানে মানুষের চরিত্রের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে মন এবং শরীর। পুরুষতান্ত্রিক সমাজমানসিকতার নিরিখে গল্পটির ‘বীজপুরুষ’ নামকরণটি অপূর্বসুন্দর ও গভীর ব্যঞ্জনাময়। কারিগরকে ঘৃণা করতেও সাড়া জাগে না মনে। সমাজের বিজ্ঞানবিরোধী পুরুষতান্ত্রিকতা, নারীর অসহায়ত্ব, কুসংস্কার এসব একপাশে ফেলে রেখে ঘটনার বিবরণ স্রোতের মতো টেনে নিয়ে যায় পাঠককে এবং মোহনায় পৌছানোর পর জোয়ার, জোছনা, স্রোত ও ঢেউয়ের খেলা দেখতে দেখতে মুগ্ধতায় ও বিস্ময়ে হারিয়ে যায় যাত্রাশুরুর কথা। এটি একটি উৎকৃষ্ট মানের সৃষ্টি।
বৃটিশদের হাত থেকে স্বাধীনতা লাভের সময়ের ভূগোল ভাগের ঘটনা এবং তার আগে ও পরে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক হানাহানির ওপর ভিত্তি করে রচিত ‘জুনাই বিবির অভিযোজন’ গল্পটি একটি সুন্দর সৃষ্টি। এ হচ্ছে পুরোনো বিষয়কে নতুন ভাবনায় ও নব আঙ্গিকে উপস্থাপন। কিন্তু নতুন বোতলে পুরাতন মদ নয়। দেশভাগ নিয়ে বহু ছোটগল্প ও উপন্যাস আছে। বহু লেখকের। বিশেষত সা’দাত হোসেন মান্টোর গল্পগুলোর কথা ভোলার উপায় নেই। আসলে বিষয় তো প্রায় ক্ষেত্রেই পুরোনোই থাকে। সাহিত্যের ক্ষেত্রে গঠনশৈলী বা আঙ্গিকটাই অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ‘জুনাই বিবির অভিযোজন’ গল্পে পরিবেশিত ঘটনাসমূহ আমাদের মনে ঢেউ তোলে তবে গল্পে দেশবিভাগকবলিত নির্দোষ মানুষগুলোর মানসিক টানাপাড়েন ও হৃদয়িক রক্তক্ষরণ সবচেয়ে বেশি নাড়া দেয়। গল্পের প্রধান চরিত্র জয়নব বিবি ওরফে জুনাই এক শক্তিশালী চরিত্র। হিন্দু সমীর এবং মুসলমান জুনাই বিবির মধ্যকার মানসিক টান ও টানাপেড়েন এবং বেদনাদীর্ণ উপসংহার বহুদিনের অভিন্ন ভূগোলকে কাটাছেঁড়ার চেয়েও বেশি নির্মমতা, করুণতা ও সমব্যথা ধারণ করেছে। মাটির ভূগোলে রক্তপাত ঘটেছে, তারচেয়েও বেশি হয়েছে ভালোবাসার রক্তক্ষরণ। দেশভাগ সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক বিভাজন, ধর্মীয় সংঘাত, অর্থনৈতিক লোকসান ইত্যাদিকে ছাপিয়ে নরনারীর হৃদয়ের রক্তক্ষরণ ও প্রতিকারহীন অসহায়ত্ব পাঠকের মনে আরও এক কারবালার –অনুভূতি সৃস্টি করতে চেয়েছে। বিশেষত গল্পের মূল চরিত্র হিসেবে বিবেচিত হওয়ার দাবিদার জয়নব বিবি ওরফে জুনাইয়ের বেশ কিছু উক্তি মগজে ও স্মরণে ঠাঁই করে নিতে চায় আর্ত-আকুলতায়।
‘মদ এক স্বর্ণাভ শিশির’ অবশ্যই একটি উল্লেখযোগ্য গল্প। পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে একটা আশার জোয়ার নিয়ে এসেছিল সমাজতন্ত্র বা কমিউনিজম। তার ঢেউ এসে লেগেছিল বাঙালির চেতনাতেও। কিন্তু তা প্রত্যাশিত মাত্রায় ও সাফল্যে সম্প্রসারিত হওয়ার আগেই ভেঙে পড়েছে। হতাশা ছড়িয়েছে কোটি কোটি মানুষের মনে। তথাপি আশাহীন আশা পুষে রেখেছে আজো কিছু মানুষ। “আশাহীন শ্রান্ত আশা / টানিয়া রেখেছে এক বিষাদ-কুয়াশা বিশ্বময়।’’—আহা রবীন্দ্রনাথ! তেমনি আশাহীন শ্রান্ত আশায় পথচলা একজন নাম না জানা মানুষের জীবনাভিজ্ঞতার কাব্যিক বয়ান গল্পটি। কথকের জবানে একটানে বলে যাওয়া।
আঙ্গিকটা সাম্প্রতিক সময়ে বেশ অনুসৃত। এই গল্পে বহু মানুষ তার নিজের রাজনৈতিক জীবন, শিক্ষাজীবন ও একান্ত জীবনের ছবি দেখতে পাবেন। ফলে গল্পটি ভালো বাসবেন। একথা নিয়ে দাঁতাল বিতর্ক করার লোকের অভাব নেই জেনেও বলতে হয়, হাসান আজিজুল হক প্রমুখদের অনেক গল্প শুধু সমাজতান্ত্রিক ভাবনার কারণে প্রাপ্যের অধিক সমাদর লাভ করেছিল। তো যারা সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিপক্ষে তাদের কাছে এই গল্পের আবেদন উল্লেখযোগ্য নাও হতে পারে। তবে গল্পটি শৈলীর দিক থেকে সবসময় গুরুত্ব পেতে পারে বলে আমার ধারণা। স্মার্ট ভাষা। অল্প শব্দে ছোটছোট বাক্য। চিত্রকল্প। প্রকাশের চেয়ে আড়াল ও ইঙ্গিতের অধিক ব্যঞ্জনা। পাঠকের জন্য ভেবে নেয়ার বা কল্পনা করার মতো প্রচুর স্পেস। নাতিদীর্ঘ আয়তন। উপসংহারে একটা আশাবাদের অস্পস্ট ইঙ্গিত। বাহ্যিকভাবে অসফল অথচ আদর্শে অটল এবং বিপরীত জোয়ারের মুখেও নিঃশেষে হাল ছেড়ে না দেওয়া একটি জীবনের ইঙ্গিতময় কাহিনীর আকর্ষণীয় পরিবেশনা। সব মিলিয়ে একটি গল্পময় কবিতা। ওয়েলডান।
বাংলাদেশের মতো প্রথাশাসিত মানসিকতার দেশে ‘ফাকআপ নাইটস’ কোনো গল্পের নাম হতে পারে? কোন্ সাহিত্য সম্পাদক ছাপতে যাবেন এমন নামের ছোটগল্প? গল্পকার হিসেবে ইশরাত তানিয়ার অন্যতম শক্তি হচ্ছে বেড়া ডিঙানো সাহস এবং আধুনিক নগরজীবনের উঁচুতলার উচ্চবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত মানুষের যাপিত জীবন সম্পর্কে গভীর নিবিড় ও সূক্ষ্ণ জ্ঞান। তিনি সেসব জীবনে ব্যবহৃত প্রতিটি উপকরণের নাম ও ব্যবহার সম্পর্কে নিবিড় জ্ঞান ও হালনাগাদ তথ্য রাখেন। ‘ফাকআপ নাইটস’ গল্পে উচ্চমধ্যবিত্ত সমাজের দুজন উচ্চশিক্ষিত নর-নারীর দাম্পত্য জীবনের টানাপোড়েন ও খরা নিয়ে কথা বলেছেন তিনি। সে-জীবনকে ফুটিয়ে তুলতে জুতসই প্রতিতুলনায় এনেছেন টেলিভিশনে প্রচারিত নিউইয়র্কের ‘ফাকআপ নাইটস’ শো ধারাবাহিকের প্রসঙ্গ। তানিয়ার গল্প থেকে অনেকবেশি শেখাও যায়। ‘ফাকআপ নাইটস’ গল্পটির ভাষা চিত্রকল্পময়, উপমাসমৃদ্ধ, সাংকেতিক এবং একইসঙ্গে প্রকাশ ও আড়ালের ঐশ্বর্যে সচ্ছল ও সমৃদ্ধ। গল্পটির ভাষা, বুনন ও বুনট আধুনিক কবিতার চেয়েও ঘনবদ্ধতায় ও স্পেসের বৈপরীত্বে নিবিড়। বাংলাদেশের শহরকেন্দ্রিক উচ্চবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত সমাজ কি প্রেমহীন ও আকর্ষণশূন্য সংসারপনার দখলে চলে যাচ্ছে চোখের আড়ালে? বিবাহিত দাম্পত্যজীবন কি হাঁপিয়ে উঠছে অল্পদিনের যাপনেই? ইশরাত তানিয়ার নগরভিত্তিক অনেক গল্পই সমাজবিজ্ঞানের লোকেদের আগ্রহের বিষয় হয়ে উঠতে পারে।
‘প্রিনছা খেঁ ও চন্দ্রকলা’ নানাকারণে একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ গল্প। উনিশ সত্তর সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, পাকিস্তানী সেনাদের বর্বরতাতাড়িত ধ্বংসযজ্ঞ, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাণপণ লড়াই এবং স্বাধীনা-উত্তর বাংলাদেশ, এতকিছুকে ধারণ করা হয়েছে এই ছোটগল্পে। বলা যেতে পারে এটি একটি অলিখিত উপন্যাসের ছোটগল্পায়ন। প্রায় অসম্ভব একটি কাজ। সম্ভব হয়েছে ইশরাত তানিয়ার ভাবনার দুরন্ততা ও সাহসী শৈল্পিক দক্ষতায়। ঝালকাঠির একটি ক্যাম্পে ৪২ জন পাকসেনার অবস্থান এবং সেনাদের হাতে বন্দী রাখাইন যুবতী প্রিনছা খেঁর বিষমাখানো খাবার খেয়ে একসাথে সবার অচেতন হয়ে পড়া এবং তার মধ্যে ১৪ জনের তাৎক্ষণিক মৃত্যু, এই বর্ণনার মধ্যে একটু অবিশ্বাসের উপকরণ তো আবিস্কার করাই যায়। বিশেষত তাদের সংখ্যাটি ব্যাপারটি। যুদ্ধচলাকালে একটি ক্যাম্পের আধুনিক সমরকৌশলে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অতজন সেনাসদস্য একসাখে খাদ্যগ্রহণে বসার কথা নয়। আবার এটা বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে অসম্ভবও নয়। কিন্তু গল্পটির উজ্জ্বলতম দিকটি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধে নারীদের অবদানকে যথার্থ মূল্যে তুলে ধরা, উপজাতীয় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অবদানকে উপস্থাপন এবং যুদ্ধ ও প্রেমের সহাবস্থান চিহ্নিতকরণ। গল্পকারের দক্ষতা শিখরস্পর্র্শীয় মহিমা লাভ করেছে যুদ্ধশেষে দুটি ভিন্ন ধর্মীয় গোত্রের যুবক-যুবতী, প্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা সাইদ এবং প্রেমিকা মুক্তিযোদ্ধা প্রিনছা খেঁর মুখোমুখি দেখা হওয়া এবং তা ফয়সালাহীনতায় সমাপ্ত হয়ে যাওয়া তাদের সেই সাক্ষাতের মধ্য দিয়ে। প্রচলিত অর্থে পাকসেনাদের দ্বারা গণধর্ষিত প্রিনছা খেঁ বলেছিল: – ‘আমি যুদ্ধ করেছি, সাইদ। তোমার হাতে ছিল রিকয়েললেস রাইফেল। আমার অস্ত্র ছিল এই দেহ।’ তারপরের বর্ণনা: ‘কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে প্রিন্ছা। যেন সাইদকে উদ্দেশ্য করে না, নিজেকেই জিজ্ঞেস করে- এখনও কি ভালোবাসো?”
এই দায়িত্ববোধটুকু না থাকলেও তানিয়া গল্পকার হিসেবে সাফল্য অর্জন করতে পারতেন কিন্তু তার মহত লেখক হয়ে গড়ে ওঠার সম্ভাবনা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যেতো।
সাইদের তরফ থেকে কোনো উচ্চারণ শোনা যায়নি হ্যাঁ কিংবা না। কেবল নিবু নিবু হয়ে আসা চাঁদের আলোয় আকাশে বাতাসে জলে জঙ্গলে ছড়িয়ে গিয়েছিল সেই জিজ্ঞাসা সাক্ষীহীন উত্তরহীনতায় অথবা শব্দহীন সংকেতের করুণতায়। পাঠ করা যায় সমৃদ্ধ কবিতার অনিঃশেষ আলো-আঁধারিমাখা উপসংহারটুকু : ‘ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে আসে চাঁদের আলো। উঠানের ওপর দুজনের অবয়ব, জংলা, গাছগাছালী, এমন কি ধানী জমি পেরিয়ে যতদূর দেখা যায়, সমস্তই দূরে সরে যায়। ক্রমশ অস্পষ্ট দুটো মুখ মিশে যায় ভোর রাতের অন্ধকারে।
চারদিক শব্দহীন। উত্তরের অপেক্ষায় থাকা প্যাঁচার চোখ হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে ততক্ষণে…’।
উপসংহারের এই অন্ধকারমাখা নীরবতা এক মহাজিজ্ঞাসা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এটি একটি অন্তহীন জিজ্ঞাসা। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসেও নারীর অবদান হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে জলে-ভাসা-পদ্মের বেদনার ব্যঞ্জনায়। বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনে, স্বাধীকার আন্দোলনে, গণ-অভ্যুত্থানে এবং মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান অমূল্যায়িত এবং প্রায় অস্বীকৃত রয়ে গেছে আজও। যেসব নারী প্রত্যক্ষভাবে মারণাস্ত্র হাতে নিয়ে যুদ্ধ করার সুযোগ পানিনি কিন্তু প্রিনছা খেঁর মতো শরীরকে অস্ত্র বানিয়ে যুদ্ধ করেছেন, তারা মুক্তিযোদ্ধা সনদ লাভ তো দূরের কথা, নিজেদের নামের সাথে মুক্তিযোদ্ধা শব্দটিও ব্যবহারের সুযোগ বা অধিকার পাননি।। তারা ‘বীরাঙ্গনা’ মানে ‘ধর্ষিতা’। অসচেতনতায় হোক অথবা অনিচ্ছায়, স্বাধীনতা-উত্তর দেশ তাদের প্রত্যাশিত শ্রদ্ধায় ও ভালোবাসায় গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছে। প্রিনছা খেঁ একজন নয়, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে এভাবে শরীরের অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ করা অথবা রাইফেল-গ্রেনেড নিয়ে যুদ্ধ করতে গিয়ে পাকসেনাদের হাতে ধৃত ও নির্যাতিত অসংখ্য বীর নারীকে পরবর্তীতে দ্বিগুণ হতাশায় নিমজ্জিত হতে হয়েছে পুরুষতন্ত্র পরিচালিত রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার, স্বামী, প্রেমিক, সহপাঠী, বন্ধু কর্তৃক প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ নির্মমতায় অবরণ্যে বরিত হয়ে যা ইশরাত তানিয়ার ‘প্রিনছা খেঁ ও চন্দ্রকলা’ গল্পটি প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যঞ্জনায় ধারণ করেছে বেদনার্ত বোবার চোখের ভাষায়। তবে আবারও বলতে ইচ্ছে করছে, আস্ত একটি উপন্যাসকে মহাকাব্যিক গভীরতায় ও শৈল্পিক ব্যঞ্জনায় ধারণ করেছেন তানিয়া এই ছোটগল্পে, এটা তার শক্তিমত্তার সোনালি স্বাক্ষর।
ইশরাত তানিয়ার অনেক গল্প পড়ে মনে হয়েছে, তিনি সরস্বতীর দর্জির গজফিতা নিয়ে গল্প বানাননি কিংবা কুমোরের মাপ হাতে নিয়ে গড়ে তুলেননি, তিনি গল্পকে ছড়িয়ে দিয়েছেন। এই করতে গিয়ে তিনি অনেক সময় গল্পের কেন্দ্রকে মুছে দিয়েছেন; সবকিছু পরিধি, সবকিছু ব্যাসার্ধ হয়ে উঠেছে। কখনো সেসব হয়ে উঠেছে বিন্দুর সমাহার অথবা বহুকেন্দ্রিক রাষ্ট্রের বিস্তারিত ভূগোল। এককেন্দ্রিক বাংলাদেশে রাজধানী ঢাকাই সব। কিন্তু বহুকেন্দ্রিক ভারতে একই সঙ্গে দিল্লী, মুম্বাই, কলকাতা, মাদ্রাজ, লক্ষ্ণৌ, চেন্নাই, তিরুভান্তাপুরম এবং এমন আরও অনেক কেন্দ্র। তানিয়ার অনেক গল্পে এত বিচিত্র ধরনের অনুষঙ্গ আছে যে সেসবের কোনটি যে গল্পের কেন্দ্রীয় বিষয় তা নিয়ে ধাঁধায় পড়তে হয়। আবার প্রতিটি অনুষঙ্গ উপস্থাপিত হয়েছে চিত্রকল্পময়তার ঐশ্বর্যে ও সৌকর্যে। পাঠকের চোখ কিংবা মন এড়িয়ে যেত পারে না কোনো অনুষঙ্গই। বরং মাঝে মাঝে আটকে যায় এখানে কিংবা ওখানে। মাঝেমাঝে ফিরে যায় পুনঃপাঠে, পুনঃদর্শনে। মনোযোগ সহকারে পাঠের পর পাঠক থিতু হয় কোনো একটি অনুষঙ্গে যাকে তার কেন্দ্র বলে মনে হয়। সেভাবেই পঠিত গল্পটির একটা সারাংশ রচিত হয়ে ওঠে পাঠাভিজ্ঞ মনে। কাজী নজরুল ইসলামের খুবই বিখ্যাত একটি গানের স্থায়ী এমন: ‘আকাশে আজ ছড়িয়ে দিলাম প্রিয় / আমার কথার ফুল গো/ আমার গানের মালা গো / কুড়িয়ে তুমি নিও/…. আমার আঁখি-পাতায় নাই দেখিলে আমার আঁখিজল / আমার কণ্ঠের সুর অশ্রুভারে করে টলমল।’ ইশরাত তানিয়ার অনেক গল্পও তেমনিভাবে ছড়ানো ছিটানো। প্রথম পাঠে সহজ প্রত্যক্ষতায় ধরা পড়ে না অনেককিছুই; পাঠককে তার সংবেদনশীল অনুসন্ধিৎসা দিয়ে সেসব খুঁজে নিতে হয়, ছুঁয়ে দেখতে হয়, গন্ধ শুঁকে দেখতে হয়। নজরুল যেমনটি বলেছেন চোখের পাতায় যে-চোখের-জলের দেখা মেলে না, সেই উষ্ণ অশ্রু ধরে আছে কণ্ঠের সুর— যা ‘অশ্রুভারে টলমল’। উদাহরণস্বরূপ বলতে হয়, ইশরাত তানিয়ার ‘যার যা কিছু অথবা ধুলোমাখা ব্যক্তিগত চাঁদ’, ‘ইশতেহার ও অলপ্পেয়ে’, ‘একটি শব্দের পোস্ট রিয়েলিটি’ ‘ডি-ওয়ানের একজন’ ‘ধুলোবালি প্যাকেজ’, ‘মেলো ইয়েলো, শিউলিগাছ আর বারান্দা হচ্ছে’, ‘গল্পটা রবিবারেরও হতে পারত’, ‘মদ এক স্বর্ণাভ শিশির’, .. প্রভৃতি গল্পের ভেতর সাজানো গোছানো বা ঠাস বুননের কোনো গল্প পাওয়া চোখে পড়ে না। কিন্তু নিবিড়ভাবে পাঠ করলে গল্প বের হয়ে আসে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, তার ছড়ানো ছিটানো চেহারার গল্পগুলোতেও আশ্চর্য আড়াল আাছে আবার ছোট আকৃতির ঘনবদ্ধ গল্পগুলোও ধারণ করেছে বিস্তারের স্পেস ও ব্যঞ্জনা। ‘যার যা কিছু আছে অথবা ব্যক্তিগত ধুলোমাখা চাঁদ’ গল্পটি সহজ ভঙিতে প্রান্তরের প্রাণে লেখা কিন্তু ছোট ছোট ঘটনা ও দৃশ্যের আড়ালে রয়ে গেছে মূল কথাটি যা খুঁজে বের করার পর নামকরণের তাৎপর্য বাঙ্ময় হয়ে ওঠে। সেভাবেই খুঁজে দেখতে হয় ছোটাকৃতির ‘গল্পটা রবিবারেরও হতে পারত’ শীর্ষক ছোটগল্পটির নামকরণের নিবিড় ব্যঞ্জনা।
ইশরাত তানিয়ার বিরুদ্ধে একবার অভিযোগের আঙুল উঠিয়ে ফেলেছিলাম: তার গল্পে কেন এত এত বিদেশী শব্দ, বিশেষত ইংরেজি? বায়ান্নোর রক্তাক্ত সংগ্রামের ঘ্রাণমাখা বাংলা ভাষা কি এতই গরিব? উদাহরণস্বরূপ তার ‘ফাকআপ নাইটস’ গল্পটি আসতে পারে। ভেবে দেখেছি তার ব্যবহৃত বিদেশী ও প্রযুক্তিগত শব্দগুলোর বাংলা প্রতিশব্দ জোরাজুরি করে বানানো সম্ভব হয়তোবা কিন্তু সেসব ব্যবহার করতে গেলে শব্দে-বাক্যে-বর্ণনায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, ঘটনা সময় ও পরিবেশের ছবি যথাযথভাবে ফুটে উঠবে না। উচ্চবিত্ত বা উচ্চমধ্যবিত্ত সমাজের হালফিল ছবি এই যে সেখানে পশ্চিমা সংস্কৃতি ও অভ্যাস অনুসরণ ও অনুকরণ করা হচ্ছে। তাদের জীবনাচার তুলে ধরার ক্ষেত্রে তাদের মুখে হরহামেশাই উচ্চারিত বিদেশী ও প্রযুক্তিগত শব্দই ব্যবহার করতে হবে। তানিয়া সেকাজটিই করেছেন। হয়তোবা কোথাও একটুআধুটু বেশি করে ফেলেছেন। তাতে করেও সাহিত্যের মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাওয়ার কথা নয়। আবার তার পক্ষ নিয়ে একথাও বলা যায়, যেখানে বিদেশী ও প্রযুক্তি শব্দের ব্যবহার আবশ্যক নয়, সেখানে তিনি জোর করে ব্যবহার করেননি। যেমন তার ‘গল্পটা রবিবারেরও হতে পারত’ অথবা ‘আপাত অব্যক্তিগত’ গল্পে বিদেশী শব্দের ব্যবহার নেই বললেই চলে। আবার ‘চুতমারানির পোলারা চুদতেও পারে না’ এমন বাক্য দিয়ে গল্প শুরু করা এক ধরনের স্ট্যানবাজি বলে মনে খটকা জাগলেও গল্পের সবটুকু পড়ার পর আপাত অশ্লীল বাক্যটিকে গল্পের জুতসই শুরু হিসেব মেনে নেয় মন। তানিয়া প্রমিত বাংলা, আঞ্চলিক বাংলা, কথ্য বাংলা, বাংলাভাষার মধ্যে ঢুকে পড়া বিদেশী ও প্রযুক্তিগত শব্দ ও পরিভাষা প্রভৃতি আয়ত্বে এনেছেন। গল্প লেখার সময় তাই তিনি সাবলীলভাবে এসব ব্যবহার করতে পারেন তার সচ্ছল ভাণ্ডার থেকে। তানিয়ার গল্প ভালো লাগার প্রধান করাণটি হচ্ছে- গল্পগুলোর প্রাণ আছে। তার প্রায় প্রতিটি গল্পই মেধা, বুদ্ধি ও পরিকল্পনার ফসল কিন্তু সে ফসল শুষ্ক নয়, খটখটে নয়, সজীব, প্রাণরসে ভরা –কখনো সবুজ কখনো সোনালি। গল্পগুলোতে বুদ্ধি ও আবেগের চমৎকার সংশ্লেষ ঘটেছে। সাধারণত পরিকল্পনা করে লেখা ‘নির্মাণ’ হয় কিন্তু তানিয়ার গল্পগুলো প্রাণরসের সচ্ছলতায় সৃষ্টি হয়ে উঠেছে। প্রযুক্তিশাসিত নাগরিক পরিবেশের অনুষঙ্গ নিয়ে সবুজ প্রাণের গল্প রচনা সত্যিই আনন্দের ব্যাপার।
গল্প রচয়িতা হিসেবে ইশরাত তানিয়ার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে তিনি জেন্ডার বিভাজনে একজন নারী, ফলে নারী লেখক; কিন্তু তার লেখার মধ্যে প্রচলিত অর্থের নারীবাদ বিষয়টি অনুপস্থিত। তিনি নারীবাদী লেখক হিসেবে পরিচিতি পেতে আগ্রহী নন বলেই তার গল্প বলার ঢঙ বলে। অথচ তিনি গভীরভাবে নিবিড়ভাবে এবং শাণিতভাবে পুরুষতন্ত্রবিরোধী। নারী জাতির প্রতি তার মমত্ববোধ হালকা নয়, অগভীর নয়।
পূর্ণভাবে সাংসারিক নারী, কর্মজীবী নারী, দাম্পত্যজীবনে অংশগ্রহণকারী নারী, প্রেম জড়িত নারী, বাধ্য হয়ে দেহ-ব্যবসায়-জড়িত নারী ইত্যকার বহু শ্রেণির নারীর মনোবেদনা, ভালো লাগা মন্দ লাগা, চিন্ময় পিপাসা, শারীরিক চাহিদা, বঞ্চনাজনিত মনোবেদনা, ভালোবাসা, গুরুত্ব ও মর্যাদা প্রভৃতি বিষয়ে তাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মানসিক প্রতিক্রিয়া খুবই সূক্ষতার সাথে গল্পের মধ্যে গুঁজে দিয়েছেন তিনি। তার গল্পের নারী চরিত্রগুলো মমত্ববোধের আলোয় মানবীয় মহিমা লাভ করেছে। তিনি নারীর প্রতি নির্বিচার পক্ষপাত নেয়ার মতো স্থূল অভিমত দেননি কিংবা তার চরিত্রগুলোর মুখ দিয়ে তেমন কথা প্রকাশ করেননি। কিন্তু তাদের প্রতি সমর্থন ও ভালোবাসা অন্তঃসলিলা ব্যঞ্জনায় প্রবহমান থেকেছে গল্পের শরীরে, প্রাণেও। তানিয়া নারী না হলে তার পক্ষে কি ‘প্রিনছা খেঁ ও চন্দ্রকলা’ গল্পটি লেখা সম্ভব হতো? মনে হয় হতো না। ‘আপাত অব্যক্তিগত’ গল্পের লায়লাকে সৃষ্টি করার মাঝেও তার নারীমনের নিবিড় বেদনামাখা দরদের ছোঁয়া ও ছায়া আছে। এই দায়িত্ববোধটুকু না থাকলেও তানিয়া গল্পকার হিসেবে সাফল্য অর্জন করতে পারতেন কিন্তু তার মহত লেখক হয়ে গড়ে ওঠার সম্ভাবনা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যেতো।