আহমদ ছফা (১৯৪৩-২০০১)। তার জন্ম চট্টগ্রামের গাছবাড়িয়ায়। কিন্তু জন্ম এলাকা থেকে একসময় তাকে আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রশ্নে, জীবিকার তাগিদে ঢাকায় আসতে হয়। ব্যস্ত ঢাকার বুকে অপরিচিত জগতে গড়ে তুলেছিলেন পরিচিতির এক নতুন জগত। মূলত ঢাকায় আসার মাধ্যমে তার চিন্তার বিকাশ শুরু হয়। এই চিন্তার বিকাশ শুধু নিজেকে নিয়ে নয়, নিজেকে প্রতিষ্ঠার জন্য নয়; চিন্তা অতীত নিয়ে, সমকাল নিয়ে, স্বকালের সামাজিক কাঠামো নিয়েও। তিনি কেবল এই চিন্তাতে সীমাবদ্ধ ছিলেন না, একটি মনমতো পরিবর্তনও চেয়েছিলেন। সাহিত্যের মাধ্যমে এই পরিবর্তনে আকাঙ্ক্ষাও প্রকাশ করেছেন। কেবল একক প্রচেষ্টা নয়, সাংগঠনিক প্রচেষ্টায়ও ছিলেন যুক্ত।
তৎকালীন এক চাষা পরিবার থেকে উঠে এলেও আহমদ ছফা ভেবেছেন সমাজের সবশ্রেণীর মানুষকে নিয়ে। ছফার ভাষায় তিনি উঠে এসেছিলেন এক বাঙালি মুসলমান পরিবার থেকে।
এই বাঙালি মুসলমান কারা, বাঙালি মুসলমানের স্বরূপই বা কী? এ নিয়ে নানাদর্শন নানা মতবাদ-মতভেদ থাকতে পারে। তবে বিষয়টির সুরাহা করেছেন ছফা নিজেই। বাঙালি মুসলমান সমাজের পরিচয়ে তিনি বলেছেন, ‘যারা বাঙালি এবং একইসঙ্গে মুসলমান, তারাই বাঙালি মুসলমান।’ (ছফা: ২০০৬: ৩৬)
আহমদ ছফা এ-ও বলেন, আমি নিজে জাতচাষা। অনেকে চাষার ছেলে আসল পরিচয় দেয় না। তাদের মনে করে জঞ্জাল। আমি মনে করি না। আমি দারিদ্র্যকে আমার অলঙ্কার মনে করি। (নাসির আলী মামুন ২০০২ : ১৭)
আহমদ ছফা প্রথমে ঢাকায় কোথায় থাকবেন তার নির্দিষ্ট কোনো গন্তব্য ছিল না। হোস্টেলে ওঠার আগে তিনি তার এক বন্ধুর বাসায় উঠেছিলেন। তিনি বলছেন, ‘প্রথমে উঠেছিলাম আমি, ঢাকায় যখন প্রথম আসি, আমার এক বন্ধু ছিল ঢাকাইয়া। স্বামীবাগে তার বাসায় দুইদিন ছিলাম। তারপর ইকবাল হলে, আবার এক বন্ধুর বাসায় চলে আসি। এখন সার্জেন্ট জহুরুল হক হল যেটা, পরে এসএম হলে যাইয়া লুকাইয়া রইছি আমার বন্ধু আবুল কাসেম ফজলুল হকের সঙ্গে।’ (সাক্ষাৎকার ২০০৯: ১৭)
ঢাকার জীবনে একের পর এক মানুষের সঙ্গে পরিচয় ঘটতে থাকে আহমদ ছফার। পরিচিত এই মানুষদের সঙ্গে ধরাবাধাহীন আড্ডা দিয়েছেন, সঙ্গতি-অসঙ্গতির কথা বলেছেন। পরিচিত এই মানুষের সঙ্গে বিনিময় করেছেন ভালো লাগা, না লাগার কথা। কেবল বন্ধুত্ব নয় যুক্তির প্রশ্নে কারও কারও সঙ্গে তার বৈরিতাও সৃষ্টি হয়েছিল। আহমদ ছফার স্মৃতিচারণ করে শামসুর রাহমান লিখেছেন, ‘একদা আমরা নর্থব্রুক হলের লাগোয়া মাঠের সবুজ ঘাসে শুয়ে-বসে প্রচুর আড্ডা দিয়েছি। শুধু চিনেবাদাম চিবিয়ে। আহমদ ছফা রোজই নতুন কোনো তরুণকে নিয়ে আসতেন।’ (স্মারকগ্রন্থ ২০০৩: ১৫)
নূরুল আনোয়ার লিখছেন, ‘প্রফেসর আবুল কাসেম ফজলুল হকের সঙ্গে ছফা কাকার যে আন্তরিকতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেটি তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বহাল ছিল। তাদের সম্পর্ক ছিল তুই- তোকারির। […] প্রফেসর আবুল কাসেম ফজলুল হককে কী পরিমাণ ভালোবাসতেন তার দৃষ্টান্ত খুঁজে পাই ছফা কাকার সাক্ষাৎকারে। তিনি বলেছেন, কাল তাঁর জন্মদিন। তাকে আমি একশ গোলাপ উপহার দেব।’ (ছফামৃত ২০১০: ৪৬)
‘তার এক বন্ধুও ছিলেন নেহাল আদেল। তার সঙ্গে ছফা কাকা রসিকতা করতেন। নেহাল সাহেব কিছুটা পাগলা কিসিমের লোক ছিলেন। ছফা কাকা তাকে যা বলতেন বিশ্বাস করতেন।
চেনাজানা মানুষের কাছে ধার দেনা করা ছাড়া তার কোনো গত্যন্তর ছিল না। এ ধার দেনা তিনি শোধ করতে পারতেন কি না বলা মুশকিল। কারণ পরিণত বয়সে তার এক লেখায় উল্লেখ পাওয়া যায়, ডক্টর সিরাজুল ইসলামের কাছ থেকে চল্লিশ টাকা, ওয়াহিদুল ভাইয়ের কাছ থেকে চল্লিশ টাকা ধার করেছিলাম। রোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর সাহেবও ছত্রিশ টাকা ধার দিয়েছিলেন। ওই টাকা শোধ করার মতো আবস্থা আমার কোনোদিন হয়নি এবং ভবিষ্যতে কোনোদিন সম্ভব নয়।’
তিনি লিখেছেন: অধ্যাপক নরেন বিশ্বাস আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথমদিকের বন্ধু। তার মুখের দাড়ি, চোখের চাহনি এবং বাচনভঙ্গির মধ্যে এমন কিছু ছিল, দেখেই আমি তার প্রতি আকৃষ্ট ছিলাম।’ (নূরুল ২০১০: ৪৮-৪৯)
আহমদ ছফার অন্য বন্ধু মোহাম্মদ আবু জাফর লিখেছেন, ‘তার কবি-মন, লেখক-মন ধীরে ধীরে প্রকাশিত হয়ে পড়লে সবার মধ্যে তার ব্যাপারে আগ্রহের সৃষ্টি হয়। একইসঙ্গে তার আর্থিক-অসঙ্গতির বিষয়টি সকলের মনকে বিশেষভাবে নাড়া দেয়। সব মিলিয়ে, তার সতীর্থাদের মধ্যে তার জন্য সৃষ্টি হয় একপ্রকার গ্রহণযোগ্যতা। সে আবার মজা করার জন্য অথবা চমক সৃষ্টি করার জন্য উল্টোপাল্টা কথা বলার ওস্তাদ ছিল। সে কারণে সে এসে পড়লে তার কথা শোনার একটা আগ্রহও জন্মেছিলো আমাদের অনেকের মধ্যে। তবে কেউ-কেউ যে তাকে এড়িয়ে চলতো না, এমনও নয়।’ (জাফর ২০০৩: ২৬)
এখন প্রশ্ন আসতেই পারে আহমদ ছফা কেন ঢাকায় এসেছিলেন? কী অভিপ্রায় ছিল তার? আহমদ ছফা পরিষ্কার করেছেন সেই অভিপ্রায়ের কথা। বলেছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। ভর্তি হওয়াটা উপলক্ষ্য, আসল লক্ষ্য লেখক হওয়া। পত্রিকা অফিসগুলো চষে বেড়াচ্ছি। সাহিত্য-সম্পাদক বরাবর খামের পর খাম পাঠাচ্ছি। কোনো মহাপুরুষদের অনুকম্পা আমার ভাগ্যে জুটেনি। তারও চাইতে কষ্টের কথা, বারবার আমার লেখা প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে। কারও কাছে দুঃখের কথা খুলে বলার উপায় নেই। সাহিত্য-সম্পাদক মহাশয়েরা আমার অত আদর আদর করে খুলে দেখুন না দেখুন চাই কি বাজে কাগজের ঝুঁড়িতে ছুড়ে দিন, এই অনাদর অবহেলা হবু লেখকের ললাট লিখন। কিন্তু সে জিনিসটি যদি অন্যে জেনে যায়, তাহলে নীরবে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার অগ্নিপরীক্ষাটি অন্য দশজনের হাসি ঠাট্টার খোরাক হয়ে দাঁড়াবে।’ ছফা রচনাখ- : ১৭৫)
‘আমি কোনো ব্যাপারে নিজেকে একেবারে আসল সাহসী বীর পুরুষ, এ দাবি করি না। আমি কিছুটা ক্ষ্যাপাটে, কিছুটা বোকা, কিছুটা ধূর্ত, কিছুটা স্বার্থপর, এরকম মানুষ। আমি নিজেকে কোনো মহাপুরুষ মনে করি না।’
৫৮ বছরের জীবনের ৬০ শতাংশ জীবনই ঢাকায় পার করেছেন আহমদ ছফার। এই ৫৮ বছরের জীবনকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রামের জীবন, ঢাকা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জীবন, এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং স্বাধীনতাযুদ্ধ এবং রাজনীতির জীবন। ব্যক্তিনির্ভর বা ব্যক্তিসম্পর্কের দুটো গুরুত্বপূর্ণ পর্ব আছে আহমদ ছফার। ব্যক্তি প্রথমজন প্রফেসর আবদুর রাজ্জাক এবং দ্বিতীয়জন শিল্পী এস এম সুলতান। এছাড়া শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটকেন্দ্রিক একটি জীবন রয়েছে আহমদ ছফার।
ছফা লিখেছেন, ‘আমার একটা অপরাধবোধ রয়েছে। প্রচলিত নিয়ম ভেঙে সুযোগ দেয়ার পরও আমার পক্ষে পিএইচডি করা সম্ভব হয়নি। একা একা যখন চিন্তা করি আমার মনে একটা অপরাধবোধ ঘনিয়ে আসে।…পিএইচডি শেষ করতে না পারার যে বাস্তব কারণ তার জন্য প্রফেসর আবদুর রাজ্জাককে আমি দায়ী মনে করি। (ছফা ২০০০ : ১৮৪)
বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে বাংলার রাজনীতি-অর্থনীতি, সামাজিক ইতিহাসের যে বিকাশ, পরিবর্তন, রূপান্তর, স্থায়ীত্ব; সে সব অনেক ঘটনার সাক্ষী আহমদ ছফা। লেখকের এই সাক্ষীরূপ বজায় থেকেছে একবিংশ শতাব্দীর প্রথম পর্যন্ত।
আহমদ ছফা দেখেছেন পূর্ব-বাংলার গর্জে ওঠা, দেখেছেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রসবযন্ত্রণা, দেখেছেন শিশু বাংলাদেশের বিকাশ, দেখেছেন কিশোর বাংলাদেশের বিপথগামিতা। দেখেছেন ভাষাভিত্তিক জাতীয় রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন ভঙ্গের বাস্তবতা। আহমদ ছফার জীবনের বারো আনাই ঢাকা শহরে কাটে।
আহমদ ছফা নিজেই লিখেছেন ‘আমি একটা ইতিহাসের ভেতর থেকে উঠে এসেছি।’ প্রত্যেক মানুষ ইতিহাস থেকে বেরিয়ে আসেন, কেউ বেরিয়ে আসা সম্পর্কে সচেতন, কেউ নির্বিকার। আহমদ ছফা সচেতনভাবে উপলব্ধি করেছেন তিনি ইতিহাসের উৎপাদ। ইতিহাসের গতি সম্পর্কে যেহেতু তিনি সচেতন সে কারণে গতিমুখ নির্ধারণে ভূমিকা রাখার একটি প্রচেষ্টা তার সাহিত্য সংক্রান্ত কর্মকাণ্ডে লক্ষ করা যায়।
বিশ শতকের পাঁচের দশকের ও ছয়ের দশকে পাকিস্তানি আমলের রুদ্ধবাক পরিবেশে অনেক বামপন্থী চিন্তাধারার মানুষ মনে করতেন বিপ্লব ছাড়া মানুষের মুক্তির কোনো উপায় নেই। মুক্তির মূর্তমান দৃষ্টান্ত ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ও গণপ্রজাতন্ত্র চীন। পত্রিকায় বের হতো ভিয়েতনাম যুদ্ধের খবর। সুতরাং ভিয়েতনাম যে মানুষকে চীন-সোভিয়েতের বিপ্লবাত্মক পথের যৌক্তিকতার দিকে আকর্ষণ করিয়েছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ছফা স্কুলজীবন থেকেই বিপ্লবের দিকে ঝুঁকেছিলেন। সেই পথযাত্রায় তিনি আসহাবুদ্দিন, সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্ত, অজিত গুহ অনেকের সংস্পর্শে এসেছিলেন। (মনসুর ২০০৩ : ৫৪)
ইতিহাসের ধারাবাহিক ঘটনার সঙ্গে সরাসরি যোগসূত্র স্থাপন করতে শুরু করলেন তিনি। আহমদ ছফা যখন ঢাকায় আসেন তখনো পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম মাত্রায় পূর্ণ হয়ে ওঠেনি। জাতীয় মুক্তির চিন্তা-তখনো মানে ১৯৬২ সন নাগাদ-বিকাশের প্রথম পর্যায়। এই পর্যায়ে লোকে সচরাচর আবেগ বলে। তরুণ হৃদয়ে যে চিন্তার অধিষ্ঠান তাকে আমরা আবেগই বলি।
বেশিদিন যেতে না যেতেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের অগণতান্ত্রিক চেহারা বের হয়ে এলো। শুদ্ধ মুসলমান অভিধা দিয়ে পূর্ব-বাংলার নির্যাতিত মানুষগুলোকে বেশিদিন দাবিয়ে রাখা গেল না। জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের দুটি লক্ষ্য ধীরে ধীরে মূর্ত হয়ে ওঠে। চলমান অসহযোগ আন্দোলনের মধ্যেই ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দেন শেখ মুজিবুর রহমান। শেখ মুজিবুর রহমানের রেসকোর্সের ভাষণের পর ‘ঘরে ঘরে দুর্গ’ গড়ে ওঠে। পশ্চিম পাকিস্তানের যাঁতাকল থেকে বেরিয়ে আসতে চায় পূর্ব বাংলার মানুষ। তারা ‘ভাষাভিত্তিক জাতীয় রাষ্ট্র’ গঠনের সংগ্রামে অংশ নেয়। স্বাধীনতা অর্জনের আকাঙ্ক্ষা তীব্র থেকে তীব্র হতে শুরু করল।
আহমদ ছফা লিখেছেন, ‘ইতিহাসে কোনো কোনো সময় আসে যখন একেকটা মিনিটের ব্যাপ্তি, গভীরতা এবং ঘনত্ব হাজার বছরকে ছাড়িয়ে যায়। আমাদের জীবনে একাত্তর সাল সেরকম। একাত্তর সাল যারা দেখেছে, ঘটনাপ্রবাহের মধ্যদিয়ে যারা বড় হয়েছে, একাত্তর সালের মর্মবাণী মোহন সুন্দর বজ্রনিনাদে যাদের বুকে বেজেছে তারা ছাড়া অন্য কেউ একাত্তরের তাৎপর্য উপলব্ধি করবে পারবে আমার তেমন মনে হয় না।’ (ছফা ২০০০ : ১২০)
আহমদ ছফা নিছক সাহিত্যিক নয়, তিনি কেবল লেখার জন্য অবারিতভাবে লিখে চলেননি; তার কলম হয়েছে সমাজের বিদ্যমান অসঙ্গতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, বাধাহীন উচ্চারণে বর্ণনা করেছেন ‘নিরেট সত্য।’ যা কিছু লিখেছেন আহমদ ছফা দায়বোধ প্রকাশ করেছেন সমাজের প্রতি, সমাজের প্রতি। তিনি ছিলেন ‘ব্যক্তি ও লেখক সত্তায় এক’। মানে ‘ক্ষ্যাপাটে’
আহমদ ছফা বলেছেন, ‘সম্ভবত আমি লেখকদের মধ্যে প্রতিনিয়ত অন্যায়ের প্রতিবাদ করে বলেছি। আপস আমি করতে জানি না। আমার জন্মই হয়েছে ভয়ঙ্করভাবে বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা।’ (নাসির আলী মামুন ২০০২ : ২১)
আহমদ ছফা এও বলেছেন, ‘আমি কোনো ব্যাপারে নিজেকে একেবারে আসল সাহসী বীর পুরুষ, এ দাবি করি না। আমি কিছুটা ক্ষ্যাপাটে, কিছুটা বোকা, কিছুটা ধূর্ত, কিছুটা স্বার্থপর, এরকম মানুষ। আমি নিজেকে কোনো মহাপুরুষ মনে করি না।’ (নাসির আলী মামুন ২০০৪ : ৩৯)
আহমদ ছফা গণতন্ত্রকামী মানুষ ছিলেন। তিনি যেকোনো মানুষের কথা গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনতেন এবং অকপট বলে দিতেন তার মনোভাব। বিদ্যমান রাজনৈতিক শাসনপ্রণালি দেখে তিনি অভিপ্রায় জানিয়েছিলেন গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তি রক্ষায়। ১৯৭৫ সালের নির্বাচনে ভোট কারচুপির অভিযোগ ওঠে মাগুরায়। মাগুরা থেকে সে সময়ে এই অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। আহমদ ছফা গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তি রক্ষায় উদ্যোগী হয়েছিলেন। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ত্রাস বিরোধী কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে মানববন্ধনও করেছিলেন। তিনি জনসমাজ নামে একটি রাজনৈতিক দলও গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন।
ছফার স্মৃতিচারণ করে আহমেদ কামাল লিখেছেন, ‘ছফা ভাইয়ের এর সঙ্গে বন্ধুত্ব গাঢ়তর হলো দেশে যখন একদলীয় শাসন জারি হলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গুটিকয়েক শিক্ষক সেদিন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যত চাপই আসুক বাকশালে যোগ দেওয়া যাবে না। যে গণতন্ত্রের জন্যে মুক্তিযুদ্ধ সে গণতন্ত্রকে নসাৎ করার ষড়যন্ত্রের সঙ্গে আমাদের কোনো সহযোগিতা থাকবে না। ছফা ভাই শিক্ষক ছিলেন না ফলে তার ওপর এতটা চাপ ছিল না যতটা ছিল আমাদের ওপর। কিন্তু ছফা ভাই সাহস যোগালেন।’ (কামাল ২০০৩: ৬৬)
আহমদ ছফা ঢাকাতেই ‘বাংলা-জার্মান সম্প্রীতি’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন তৈরিতে মনোযোগী হয়েছিলেন। ১৮ ডিসেম্বর ১৯৯০ এ আনুষ্ঠানিকভাবে সংগঠনটি জন্মলাভ করে। সংগঠনটি গঠনে তার প্রধান সহযোগী ছিলেন জার্মান নাগরিক ফাদার ক্লাউস বুয়েলে। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আহমদ ছফা। সংগঠনের চেয়ারম্যান হন আজিজুল হক। ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন ড. আনিসুজ্জামান। ১৯৯১ সালে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানলে উপকূলীয় অঞ্চলে ব্যাপক জানমালের ক্ষতি হয়। দুর্গত এলাকায় এই সংস্থাটির মাধ্যমে ত্রাণকার্য পরিচালনা করা হয়। বিশেষ করে দুর্গত এলাকার মানুষদেও জন্য যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করে সংগঠনটি। টাঙ্গাইলে মজলুল জননেতা মরহুম মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী প্রতিষ্ঠিত ‘সন্তোষ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে’ এক ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নিয়েছিল এই সংগঠনটি। এখানে মহিলাদের কাজের বিরাট সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। ৯১ সালে বাংলা জার্মান সম্প্রীতির প্রতিনিধি হয়ে তিনি জার্মানিতে গিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল অর্থ সংগ্রহ করা। তিনি এ যাত্রায় প্রায় দুই কোটি টাকার তহবিল জোগাড় করেন। সেটি ঘূর্ণিঝড় বিধ্বস্ত এলাকায় ব্যয় করা হয়েছিল।
এরপর ছাত্রসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় স্কুলটি সরিয়ে বাংলামোটরে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পাশের বাড়িতে স্থানান্তরকরা হয়। এমাজউদ্দিন আহমদ, নাজিমউদ্দীন মোস্তান প্রমুখকে নিয়ে নতুন সমাজ ট্রাস্ট গঠন করেন।
চুরানব্বই সালে জার্মান কন্সাল জেনারেলে আর্থিক সহায়তায় মিরান্দা প্রকাশন থেকে ফাউস্ট-এর অনুবাদের একটি সংস্করণ বের হয়েছিল। ৯৬ সালে জার্মান বাংলা সম্প্রীতি থেকে আহমদ ছফা বের হয়ে আসেন। তার দাবি, ষড়যন্ত্র করে তাকে এ সংগঠন থেকে বের করে দেওয়া হয়। আহমদ ছফা এক সাক্ষাতকারে বলেছেন, ওই দেশটির সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল, এতে লুকানোর কোনোকিছু আছে বলে মনে করি না।
আহমদ ছফা শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটের একটি অফিসও ভাড়া করেছিলেন। এখান থেকে তিনি পত্রিকা করতেন। নাম দিয়েছিলেন ‘উত্থানপর্ব।’ পাশেই তিনি গরির বাচ্চাদের একটি স্কুলও খুলেছিলেন। আহমদ ছফার বিশ্বাস ছিল সমাজের মূল ধারার সঙ্গে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের সমান্তরাল পদযাত্রা না হলে কিছুতেই উন্নয়নের-অধিকারের সমান সুযোগ তৈরি হবে না। কিন্তু রাষ্ট্রের যে নজর এই সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের দেওয়ার কথা সেটি উপেক্ষিত থেকেই যান। আহমদ ছফা ঢাকার এই পথশিশু, বস্তির শিশুদের জোগাড় করেছিলেন স্কুলের প্রয়োজনে। শুধু তিনি একা নয়, এর সঙ্গে ছিলেন নাজিমউদ্দীন মোস্তান নামে এক সাংবাদিকও।
বিকেলে ছফা শাহবাগে বসতেন। বিবিধ বন্ধু এবং চাকরিহীন ও চাকরি আছে এমন তরুণ কবি-কথাসাহিত্যিকরা তখন তার কাছে আসতেন। শাহবাগের আড্ডা শেষে প্রায়ই সে আড্ডার কেউ কেউ ছফার সঙ্গে বাসা পর্যন্ত এগিয়ে দিতেন তাকে।
১৯৮০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংলগ্ন কাঁটাবন বস্তিতে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য ‘শিল্পী সুলতান কর্ম ও শিক্ষাকেন্ত্র’ নামে ওই স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন। আন্তন ম্যাকা রেঙ্কোর ‘ রোড টু লাইফ’ বইটি পাঠ করে তিনি এই বিদ্যাপীঠ প্রতিষ্ঠায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। এই স্কুল সম্পর্কে ছফা কাকা ‘পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ’ উপন্যাসে মোটামুটি একই ধারণা দিয়েছেন।
কিভাবে স্কুলটি প্রতিষ্ঠার চিন্তাটি মাথায় এসেছিল সে সম্পর্কে লিখেছেন, ‘‘আমি আন্তন ম্যাকারেঙ্কোর ‘রোড টু লাইফ বইটি পড়ি। ম্যাকারেঙ্কো রুশ শিক্ষাবিদ। তিনি বিপ্লবোত্তর রাশিয়ার টোকাই ভবঘুরে এবং অনাথ এতিমদের শিক্ষা দেওয়ার একটি সুন্দর পদ্ধতি উদ্ধাবন করেছিলেন। এই বইটা সেই অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে লিখেছেন। বইটা পাঠ বরার পর আমার শিরায় শিরায় চঞ্চলতা খেলে যেতে লাগল। জীবনের আরও এক সম্প্রসারিত রূপ প্রত্যক্ষ করে ধমনীতে রক্ত উজানে চলতে আরম্ভ করল।
ভাঙাচোরা মানুষের শিশুর মধ্যেও মহামানবের অঙ্কুর রয়েছে। মানুষ মাত্রই অমৃতের পুত্র একথা আগে কখনও এমনভাবে অনুভব করিনি। একটা বিপরীত প্রতিক্রিয়াও হল। আমার চারপাশে এত শিশু। এত অযত্ন, অবহেলার মধ্য তাদের জীবন কাটাতে হচ্ছে, এতদিন তাদের নিয়ে ভাববার অবকাশও হয়নি। একটা অপরাধবোধ পাথরের মতো মনের ভেতর চেপে রইল। আমি এই শিশুদের প্রতি আমার কতর্ব্য পালন করতে পারিনি। আমার মনুষ্যজন্ম বিফল হয়ে যাচ্ছে। এই শিশুদের জন্য কী করতে পারি, এই চিন্তার মধ্যে এতটা মগ্ন হয়ে গিয়েছিলাম যে, আমি ক্ষেতের চারাগাছগুলোর প্রতি যত্ন করার কথা ভুলে গিয়েছিলাম।
একদিন এরইমধ্যে মোস্তান এলেন। আমি তাঁকে বইটি পড়তে দিলাম। পরের দিন ভোর না হতেই দুয়ারে ঠকঠকানি শুনলাম। দরজা খুলে দেখি মোস্তান। তার চুলগুলো উস্কখুস্ক। বুঝলাম বাসি মুখেই তিনি চলে এসেছেন। চেয়ার বসতেই বললেন, সারারাত জেগে বইটা শেষ করেই আপনার কাছে ছুটে এলাম। আবেগে তার কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে আসছে, চোখের পাতা কাঁপছে। আমি আল্লাহতায়ালে ধন্যবাদ দিলাম। একজন মানুষ আমি পেয়ে গেলাম যিনি আমার ভাবনায় ভাবিত। এ তো এক সৌভাগ্যের ব্যাপার।’ (ছফা খ- ২, পৃ. ৪৫)
শুরু হয়ে গেল স্কুলের কাজ। স্কুলঘর তো ছিল না তাই মাঠে বসে বাচ্চাদের পড়ানো হতো। বাচ্চারা ছিল ছড়ানো ছিটানো। কেউ কেউ রাস্তায় ঘুরে বেড়াত। কেউ কেউ ফাই-ফরমাশ খাটত। কেউ কেউ নিউ মার্কেটে মিনতির কাজ করত। কেউ কেউ পুলিশের খাবার নিয়ে যেত। কেউ কেউ ফেরি করে বেড়াত। এ সকল বাচ্চাদের এক জায়গায় আনা চাট্টিখানি কথা নয়। নাজিম উদ্দীন মোস্তান মূলত বাচ্চাদের পড়াতেন। তাকে সাহায্য করতেন মইনুর রেজা, আবু বকর সিদ্দিন ফণি। কিন্তু তাদের পাঠদান করা সহজ ছিল না। ছফার ভাষায়, মোষের শিং থেকে দুধ বের করা যত সহজ, ওসব বাচ্চাদের কাছ থেকে পড়া আদায় করা তত সহজ ছিল না।
স্কুল ঘর বানালেন। স্কুলটির খরচ চালানোর জন্য ইসলামের দৃষ্টিতে বাংলাদেশ বক্তৃতা লিখে তিনি ১০ হাজার টাকা সম্মানী পান। এরপর সেই টাকা দিয়ে স্কুল। স্কুলটিতে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হতো। কিন্তু উদ্যোগটি বেশিদিন স্থায়ী হয়। চুরাশি সালের শেষ দিকে কাটাবনে বস্তি উচ্ছেদের সময় স্কুলটির একই পরিণতি ভোগ করতে হয়। তাছাড়া সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন স্কুলটিকে সন্দেহের চোখে দেখছিল। সরকারের অসহযোগিতার কারণে একটি ভালো উদ্যোগ অল্পদিনের ব্যবধানে বন্ধ হয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল।
১৯৯৬ সালে তিনি আরেকটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। আজিজ মার্কেটের দোতলায়। শাহবাগের আড্ডার জায়গা হয়ে গেল স্কুল। আশেপাশের ছেলেমেয়েদের ধরে এনে বসিয়ে দিতেন। অল্প কয়েকদিনের মধ্যে শুরু হয়ে গেল স্কুল। স্কুলের নাম রাখা হয়েছিল শিল্পী সুলতান পাঠশালা। মেঝেতে হোগলা বিছিয়ে বসতে দেওয়া হতো। তারপর মোড়ার ওপর বইখাতা সরবরাহ করা হতো। যারা শিক্ষক ছিলেন তারা বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। শিক্ষকদের বেতন দেওয়া হতো না। তারা ছিলেন স্বেচ্ছাসেবী।
এরপর ছাত্রসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় স্কুলটি সরিয়ে বাংলামোটরে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পাশের বাড়িতে স্থানান্তরকরা হয়। এমাজউদ্দিন আহমদ, নাজিমউদ্দীন মোস্তান প্রমুখকে নিয়ে নতুন সমাজ ট্রাস্ট গঠন করেন।
সবার জন্য শিক্ষার সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার প্রয়াসের পাশাপাশি আহমদ ছফার চিন্তা ছিল সমাজের কাঙ্ক্ষিত বিপ্লব নিশ্চিত করা। গণকণ্ঠ বন্ধ হয়ে গেলে তিনি সাপ্তাহিক উত্তরণ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এবং পাশাপাশি সম্ভাবনা মুদ্রায়ন নামে একটি প্রেসও বসানো হয়। তাছাড়া ‘সম্ভাবনা’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা বের করার সুযোগও হয়েছিল এখান থেকে। আহমদ ছফার ভাইয়ের ছেল নূরুল আনোয়ার লিখেছেন, ‘গণকণ্ঠ এর মাধ্যমে ছফা কাকা বিপ্লব ঘটাতে চেয়েছিলেন। প্রায় দশ বছর তিনি এ পত্রিকার সঙ্গে কাটিয়েছেন। এই দশটি বছরকে তিনি তার জীবনের বিপ্লবের বছর হিসেবে উল্লেখ করতেন। এর পেছনে তিনি অনেক শ্রম সাধনা করেছেন। অর্থ সংগ্রহের জন্য নানাজনের কাছে ধন্না দিয়েছেন। কোথাও কাজ হয়েছে কোথাও হয়নি। (নূরুল ২০১০: ৯৬)
যারা আমাদের সমবয়সী তারা জানে দেশে স্বাধীন হওয়ার পর ঢাকা শহর থেকে বস্তি তুলে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। নিরাশ্রয় বিপন্ন মানুষে সে কী কষ্ট, সে কী হাহাকার! আমাদের যখন পথে নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল তখন ছফা ভাই আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন, কিন্তু এই হাজার হাজার লাখ-লাখ মানুষের জন্য তিনি কী করবেন? সেই যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে তিনি ‘বস্তি উজাড়’ নামে বিশাল কবিতা নিয়ে আমাদের বাসায় হাজির। প্যান্ট খানিকটা গুটানো, খালি পায়ে আমাদের বাসার ভেতরে হাঁটতে হাঁটতে তিনি কবিতাটি আওড়াতে লাগলেন। […] মানুষের আবেগ অত্যন্ত বিচিত্র ব্যাপার, কে কিভাবে ব্যবহার করবে যেন বুঝতে পারে না, আমরা যেন সেটা লুকিয়েই রাখতে চাই, কিন্তু ছফা ভাইয়ের মাঝে সেটা নিয়ে কোনো লুকোছাপা ছিল না-নিজের আবেগটুকু প্রকাশ করতে কোনো দ্বিধা করতেন না। যখন রাগ হওয়ার কথা রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে যেতেন, যখন খুশি হওয়ার কথা আনন্দের শিশুর মতো উদ্বেলিত হতেন, আবার যখন দুঃখ পেতেন হাউমাউ করে কেঁদে ফেলতেন।’ (স্মারক ২০১০: ১২১)
আহমদ ছফা ঢাকার শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে কথা বলেছেন। নিজের ভ্রাতুষ্পুত্র নূরুল আনোয়ারকে লেখক বলেছেন, ‘তোমাকে ঢাকা আনতে আরও কিছুদিন প্রয়োজন। তার আগে একটা প্রেস বসাতে চাই এবং একখানা বাসা ভাড়া করতে চাই। মনে রাখবে, প্রতি বিষয়ে অন্তত ষাট মার্ক পাওয়ার জ্ঞান অর্জন করতে না পারলে কোনো লাভ হবে না।’ (রচনাবলী ২০১৭: ২৫১)
আহমদ ছফা ঢাকার জীবন নিয়ে ভেবেছেন, ঢাকার মানুষ নিয়ে ভেবেছেন। ভেবেছেন শত্রু-মিত্রকে নিয়েও। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে লেখালেখি করেছেন। সংগঠন করেছেন, চিন্তা করেছেন সমাজকাঠামো পরিবর্তন নিয়ে। ফলে অনিবার্যভাবে তাকে ব্যস্ত হয়ে পড়তে হয় নানা কাজ, নানা চিন্তায়। এছাড়া ছিল তো জীবিকার তাগিদও।
তিনি ঢাকার জীবনের সঙ্গে গ্রামীণ অর্থনীতির কাঠামোয় বয়ে চলা সমাজকে তুলনামূলক বিচার করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘নিজের ভেতর নতুনভাবে জন্ম নিতে হবে। কাদার মধ্যে ডুবে আছ। যেখানে আছো চারপাশে অধিকাংশ মানুষের আবর্জনা। প্রাণপণ শক্তিকে লড়াই করে ওই জায়গায় থেকে বেরিয়ে আসতে চেষ্টা না কর ওই জায়গাতেই পচতে হবে। আমি চেষ্টা করছি তোমাকে বের করে নিয়ে আসার। কিন্তু তুমি যদি ওই জায়গায় পড়ে থাকতে চাও তাহলে ভুগতেও হবে তোমাকে। (রচনাবলী ২০১৭: ২৫৫)
তিনি লিখেছেন, ‘উনিশ শ আশি সালের আগস্ট মাসের দিকে হবে। টিপু সুলতান রোডে দৈনিক গণকণ্ঠ পত্রিকার অফিসে গিয়ে নিশ্চিত হলাম পত্রিকাটি মরতে যাচ্ছে। আমার বুক ফেটে কান্না আসছিল। এত চেষ্টা চরিত্র, এত পরিশ্রম সব বৃথা যাচ্ছে। কতজনের কাছে ভিক্ষা করলাম। দেশি, বিদেশি কত মানুষের দুয়ারে টাকার জন্য ধন্না দিলাম। যা হওয়ার কথা ছিল তা হতে যাচ্ছে। আগামীকাল থেকে মেহনতি জনগণের মুখপত্রটি মুখ বুজে আত্মহত্যা করবে।’ (ছফা খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৫)
গণকণ্ঠ পত্রিকা বন্ধ গয়ে গেলে তিনি উত্তরণ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা ছাপানোর পুনঃউদ্যোগ নেন। একটানা কয়বছর চলার পর উত্তরণ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। অর্থকড়ির টানাটানি ছিল এর প্রধানকারণ।
‘এরপর যখন ঢাকায় যাই, আজিজ মার্কেটের ওই দোতলার ঘরে দেখা করে আসি তার সঙ্গে। অনেক সময়ই দেখি ওই ছোট ঘরটির কাঠের বেঞ্চে ক্লান্ত হয়ে শুয়ে আছেন। ডাক দিতেই ধড়ফড় করে উঠে বসেন। তারপরই সেই পুরনো ছফা। ছেদহীন কর্থাবার্তাম আপ্যায়ন, জোর দিয়ে বলা তার প্রসন্নতা-অপ্রসন্নতা।’ (অরুণ ২০১০, ৬৭)
১৯৮২ সালে বইমেলায় তরুণ লেখক ও সংস্কৃতিকর্মীদের নিয়ে গঠিত লেখক-সংগ্রাম পরিষদের মাধ্যমে বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষের গণবিরোধী কার্যক্রমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কর্মসূচি পালন করেন। একুশের সকালে একাডেমির নির্ধারিত মঞ্চের পরিবর্তে বটতলায় মুক্তিযুদ্ধের আত্মাশীর্ষক বাংলা-জার্মান সম্প্রীতি উদ্যোগ। ৯০ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। ৯৬ সালে বেরিয়ে আসেন। ৯১ সালে অর্থ সংগ্রহ করতে গিয়েছিলেন। দুই কোটি টাকার তহবিল। যেটি দুর্গত মানুষের সাহায্যে ব্যয় করেছিলেন।
‘আহমদ ছফা রাজনীতিবিদ ছিলেন না; কিন্তু রাজনৈতিক, সামাজিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন এবং এ সকল বিষয়ে তার লেখাও আছে যতেষ্ট। লেখাগুলো গভীর চিন্তাপ্রসূত। আহমদ ছফাকে একজন সাধারণ মাপের সাহিত্যিক মনে করা খুবই ভুল হবে। তার লেখার পরিধি বিস্তৃত ও বহুমুখী। গল্প-উপন্যাস প্রবন্ধ, কবিতা এমন কোনো দিক নেই, যেখানে তিনি হাত দেননি এবং প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই তিনি রেখে গেছেন অসাধারণ প্রতিভার স্বাক্ষর।’ (রনো ২০১০: ৫০)
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে যখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গণহত্যা চালায় ছফা ভাই ছিলেন তোপখানা রোডে লেখক শিবিরের অফিসে। সেখানেই ছিল ছফা ভাইয়ের দিন ও রাতের আশ্রয়। ২৭ মার্চ কারফিউ শিথিল ছিল, ছফা ভাই নাকি সেই অফিস-চত্বরে দাড়িয়ে পাকিন্তানিদের বিরুদ্ধে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। পরে বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর তাকে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যান।’ ( সোহরাব ২০১০: ১৪৮)
লেখালেখির মাধ্যমে নিরন্তর তাকে সুবিধাবাদ, লুটপাট, সাম্প্রদায়িকতা, সন্ত্রাস সামাজিক ও রাষ্ট্রিক অনাচার এবং অবিচার, দলবাজি, পরিবেশ দূষণ ইত্যাদির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে হয়েছে। কখনও কখনও তাকে প্রাণনাশের হুমকিও এসেছে। কিন্তু তার কর্তব্যে এবং সিদ্ধান্তে বিন্দুমাত্র বিচলিত হননি। লেখক জীবনের প্রায় মধ্যপর্ব থেকে বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয়ের সংকট ও তার আত্মবিকাশের শর্তাদি নিয়ে ভাবনাচিন্তার পারিচয় ক্রমে তার লেখায় প্রকট হয়ে উঠতে থাকে। এ নিয়ে অনেকেই তাকে ভুল বুঝেছেন। এমনকি তাকে সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন বলে চিত্রিত করবার চেষ্টাও হয়েছে।
আহমদ ছফা ঢাকার জীবন নিয়ে ভেবেছেন, ঢাকার মানুষ নিয়ে ভেবেছেন। ভেবেছেন শত্রু-মিত্রকে নিয়েও। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে লেখালেখি করেছেন। সংগঠন করেছেন, চিন্তা করেছেন সমাজকাঠামো পরিবর্তন নিয়ে। ফলে অনিবার্যভাবে তাকে ব্যস্ত হয়ে পড়তে হয় নানা কাজ, নানা চিন্তায়। এছাড়া ছিল তো জীবিকার তাগিদও।
আহমদ ছফা তার ভ্রাতুষ্পুত্রের কাছে চিঠিতে লিখেছেন, ‘আমার অত্যন্ত ব্যস্তজীবন যাপন করতে হয়। আমার যে কি পরিশ্রম হয়, তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। মাঝে মাঝে মনে হয় দুশ্চিন্তায় মারাই যাব। মরতে দুঃখ নেই, কিন্তু তোমাদের কাউকেকিছু করতে পারলাম না সেটাই দুঃখ। অথচ আল্লাহ জানে আমি চেষ্টার ত্রুটি করিনি। কেউ আমাকে বোঝেনি, আমি কি চাই। ’
এখন প্রশ্ন হলো আহমদ ছফার এই আক্ষেপ কি সত্য? না কি তাকে এই প্রজন্ম বুঝতে শুরু করেছে, তার চিন্তা লালন করতে শুরু করেছে। আহমদ চিন্তার জগতে, ভাবনার জগতে আহমদ ছফা নিশ্চয় অনিবার্য নাম হয়ে উঠেছে।
তথ্যসূত্র
১। আহমদ ছফার সময়, নাসির আলী মামুন, শ্রাবণ প্রকাশনী, চতুর্থ সংস্করণ ২০১৩
২। আহমদ ছফা, বাঙালি মুসলমানের মন, ঢাকা ২০০৬
৩। ছফার সাক্ষাৎকার সমগ্র, নূরুল আনোয়ার সম্পাদিত, খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি, ঢাকা
৪। আহমদ ছফা স্মারকগ্রন্থ, মোরশেদ শফিউল হাসান ও সোহরাব হাসান সম্পাদিত, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০১৩
৫। ছফামৃত, নূরুল আনোয়ার, খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি, প্রকাশ: ২০১০ ঢাকা
৬। আমাদের সাফা, মোহাম্মদ আবু জাফর, ছফা স্মারকগ্রন্থ
৭। হায়দর আকবর খান রনো, শিল্পী ও মানুষ আহমদ ছফা, ছফা স্মারকগ্রন্থ
৮। আহমেদ কামাল, আহমদ ছফা: একটি নক্ষত্র নিভে গেল, ছফা স্মারকগ্রন্থ
৯। আহমদ ছফা এবং বাংলা একাডেমী পুরস্কার, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, ছফা স্মারকগ্রন্থ
১০। আমাদের ছফা ভাই, সোহরাব হাসান, স্মারকগ্রন্থ