ঝাঁঝালো শব্দগুচ্ছ, রাগ, ঘৃণা আর অস্থিরতার যে তকমা এঁটে আছে ষাটের দশকের বাংলাদেশের কবিতার গায়ে—তা যেন শুধুই কয়েকটি বিশেষণ,এতে সত্যের ছিটেফোঁটা নেই—বাক্যগুলো অনায়াসে বলা যায় আসাদ চৌধুরীর (জন্ম: ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৩) কবিতা সম্পর্কে। একটি দশকের মূল প্রবণতা, যাকে আশ্রয় করে চিহ্নিত হন, গৌরবান্বিত হন অন্যরা, সেই পথ অবলীলায় ফেলে এসে আসাদ চৌধুরী নতুন পথের সন্ধান করেছেন। হতাশা, অবক্ষয় আর জীবনসংঘাতকে পরিপূর্ণ করে প্রকাশের বেদনায় নীলকণ্ঠ হয়ে তিনি ব্যক্তির অনুভূতিপুঞ্জকে নিজের মতো সাজিয়ে তুলেছেন। ফলে তিনি গতানুগতিকতার ভেতর থেকে সচেতনভাবেই বাইরে আসার দৃষ্টান্ত হয়ে নিজের সময়-পর্বে চিহ্নিত হয়েছেন। একমুখী প্রচলের মধ্য থেকে বেরিয়ে, তবে তাকে অস্বীকার করে নয়, বরং আত্মস্থ করে স্বতন্ত্রভাবে ব্যবহারের মধ্য দিয়ে আসাদ চৌধুরী ষাটের দশকের কবিতায় নিজেকে প্রকাশ করেছেন। বিরোধিতা এবং অস্বীকার যাকে কেন্দ্র করে শিল্প হয়ে ওঠার বিস্তৃত জগতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন এ সময়-পর্বের কবিরা, তাদের সেই শৃঙ্খল ভাঙার মধ্য থেকেই, আসাদ চৌধুরী স্বতঃসিদ্ধ বৈশিষ্ট্যে আত্মপ্রকাশের জায়গা করে নিয়েছেন। তাই তার কবিতায় অধঃপতিত জীবন ও অবক্ষয়ের ঢেউ থাকলেও, তাতে নেই বিশৃঙ্খলা, নেই আকৃতিহীন অনাস্বাদিত জীবনবোধ। তিনি মধ্যবিত্ত মানসিকতার হাওয়াকে ধরেই অন্তর্গত টানাপড়েনের মধ্য থেকে কবিতাকে নিজের জায়গায় দাঁড় করাতে চেয়েছেন। ফলে পুরো ষাটের দশকের আবহেই বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠেছে তার কবিতা। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘তবক দেওয়া পান’ প্রকাশ পায় ১৯৭৫ সালের ডিসেম্বরে। প্রথম কাব্যগ্রন্থেই পাঠক আবিষ্কার করেন এক নতুন কিন্তু স্বাভাবিক স্বর। যে স্বরের মধ্য দিয়ে বাস্তব জগতের রূপ তার বৈপরীত্যময় চালচিত্র নিয়েই বহুবিস্তৃত অর্থের দ্যোতনা হাজির করে।
গোলাপের মধ্যে যাব।
বাড়ালাম হাত
ফিরে এলো রক্তাক্ত আঙুল।
সাপিনীর কারুকার্য
নগ্ন নতজানু
চরাচরে আবেগ বিলায়।
আমার অধরে শুধু
দাঁতের আঘাত।চাঁদের ভেতরে খাদ্য
আমাকে কেবল
নিয়ে যায়
নিঅনের কাছে
হায় দেহ, শুধুই শরীর
বিদ্যুৎবিহীন।
(আত্মজীবনী: ১)
আসাদ চৌধুরী কি পলায়নবাদী? ভুলে থাকতে চেয়েছেন সময়, অন্ধকার থেকে পালিয়ে থাকতে চেয়েছেন? সমকালকে অস্বীকার করতে চেয়েছেন? এমন প্রশ্নের বিপরীতে বরং আসাদ চৌধুরীর কবিতা স্পষ্ট করে—তিনি জীবন ও শিল্পচেতনার সমন্বয় খুঁজেছেন। তিনি নিরাসক্ত নন,তবে তার আসক্তি প্রমাণের জন্য তিনি ঝাঁ চকচকে, রাগী শব্দ ব্যবহার করেননি। তিনি শিল্প বিনির্মাণের প্রশ্নে মনোযোগ দিয়েছেন মননশীলতার দিকে। সেখানে উচ্চকিত এবং জোরালো ভাবের ব্যবহার নিশ্চিত করলেও বর্ণনার প্রশ্নে তিনি ধীর-স্থির। সেই স্থিরতা কিন্তু তার আবেগ,তার প্রকাশকে বাঁধতে পারেনি বরং সেই স্থিরতার ভেতর দিয়েই তিনি নিজের বলিষ্ঠ অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন। যা তাকে দিয়েছে ধ্যানীর মগ্নতা। তাকে দিয়েছে ভেতর থেকে দেখা ও উপলব্ধির স্থিরতা। ফলে আসাদ চৌধুরী সময়ের মধ্যে থেকেই সময়কে আত্মস্থ করে চেতনাস্রোতকে প্রবাহিত করতে সক্ষম হয়েছেন। যেন তার কবিতা অবদমিত ইচ্ছার কাছে হেরে না গিয়ে সময়কে বিবৃত করেছে। তার কবিতা,তার শব্দ পাঠককে বিব্রত করে না, কাছে টানে। সেই টানার মধ্য দিয়ে সমাজজীবনের এবং ব্যক্তিমানসের অন্তর্বেদনার ছবি আঁকেন তিনি। যেখানে শব্দের নিজস্ব গতির বাইরে এসে তার শব্দরা খেয়ালি মনের বর্ণনায় মেতে ওঠে।
আশ্রয় না-দিলেও আশা দিয়েছিলে
এ-কথাটি কেমন ক’রে চেপে রাখি?
লক্ষ লক্ষ মালঞ্চের ঝড় বুকে পুরে
শূন্য হাতেই তোমার কাছে আসা।
হায়, তোমরা তো কেবল এর ভুল ব্যাখ্যাই শিখেছো এতদিন।
হে আমার ক্লান্তিহীন যাত্রার স্টেশন,
তোমার সন্ধ্যাপ্রদীপে শুধু আমারই আঙুল পোড়ে কেন?
যদি আলোই না হয়,
কেন প্রদীপ মিছিমিছি আসাদের মতো জ্বলবে?
(যদি আলোই না হয়)
আসাদ চৌধুরী সকল অবরুদ্ধতার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে ব্যক্তিমনের সন্ধান করেছেন। সেই সন্ধানের ভেতর থেকে উঠে এসেছে অস্তিত্বসমস্যা, আত্মসংকট এবং আত্মভ্রমণের যন্ত্রণা। তিনি দৃশ্যের প্রতীকায়নের চেয়ে তার বিশ্লেষণের দিকে মনোযোগ দিয়েছেন। সমাজ ও সময়কে মূল্যায়ণের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছেন তার বৈপরীত্য। ফলে তার একই কবিতার বহুকৌণিক ব্যাখ্যা এবং দ্যোতনা যেমন স্পষ্ট তেমনিভাবে তার সত্য আবিস্কারের নেশাও দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়ে ওঠে। শহরকেন্দ্রিক জীবন, যেখানে মানিয়ে নেয়া, খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য প্রতিনিয়ত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ফুটে উঠতে থাকে বিচ্ছিন্নতাবোধ, যা মানুষকে করে তোলে স্মৃতিকাতর, আবেগায়িত। মানুষ ফেলে আসা সময়, গ্রাম যাকে যে ধারণ করে বুকের নিভৃতে তার জন্য বিপন্ন বোধ করে, সেই নৈঃসঙ্গ, সেই সংকটায়িত জীবনের দিকে, বা বিচ্ছিন্নতাবোধকে আসাদ চৌধুরী সঙ্গী করেন না। তিনি নৈরাশ্য বা সংশয়কে অতিক্রম করে সচেতনভাবেই হয়ে ওঠেন জীবনের গুণগ্রাহী।
আসাদ চৌধুরীর কবিতা বিবৃতিময় না। তিনি অল্প কথায়, সীমিত শব্দের বন্ধনে ভাবকে মুক্তি দেন। অতীত এবং ভবিষ্যতের মাঝে দাঁড়িয়ে সেতুবন্ধনের সূত্র খোঁজেন। সেইসঙ্গে তিনি রবীন্দ্রপ্রভাবকে স্বীকার করে, আত্মস্থ করে ব্যক্তিত্ববোধকে নির্মাণ করেন। ত্রিশের দশকের বাংলা কবিতার স্ফুরণ ঘটেছিল রবীন্দ্রবিরোধিতার মধ্য দিয়ে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং তার প্রভাবকে অস্বীকার করে কাব্য রচনার মধ্য দিয়ে কবিতাকে আধুনিকতার ফ্রেমে ফেলার স্বেচ্ছা-উদ্যোগের ধারা পরবর্তীকালেও চলে আসে। ষাটের দশকের যে অস্থির সময়-পর্ব,রাজনৈতিক এবং সামাজিক সংঘাতের মধ্যে দিয়ে একটি নতুন স্বপ্নের আশায় মানুষ নৈরাশ্য, দ্বন্দ্ব এবং সংশয়ের মধ্য থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজছে। যখন নিজেকে প্রকাশের, আত্মবিবৃতির মধ্য দিয়ে মানুষ মুক্তি দিতে চাইছে ভাবনাকে। সেই জটিল সময়াবর্তের ভেতর রবীন্দ্রনাথকে আত্মস্থ করে রাবীন্দ্রিক শব্দপুঞ্জকে ক্রিয়াশীল রেখে শুরু থেকেই আসাদ চৌধুরী নিজেকে ব্যতিক্রম করে তুলতে চেয়েছেন। তাই তার কবিতায় ব্যবহৃত শব্দে, উপমায়, বর্ণনায় বারে বারে ঘুরে আসে রাবীন্দ্রিক আবহ। যেখানে উজ্জীবিত হওয়ার মতো উপাদান যেমন রয়েছে,তেমনি রয়েছে কবির চেতনার মুক্তি অন্বেষাও।
আসাদ চৌধুরী সম্ভাবনার কথা বলেন, আশাবাদী হতে শেখান, অনুসন্ধানী হতে উৎসাহী করে তোলেন তার পাঠককে। তবে তিনি এড়িয়ে যাওয়ার মন্ত্রণা দেন না, বরং তার পরিণতিকে প্রকাশ করেন। ফলে তার কবিতা একান্তভাবে ব্যক্তিআশ্রয়ী হয়ে পড়ে না। ব্যক্তির বিবর্তনকে প্রাধান্য দিলেও তার কবিতায় মানুষের চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে মানুষের বস্তুগত অবস্থান।
আসাদ চৌধুরী ষাটের দশকের সময়-পর্বে লিখতে শুরু করে কবিতাই লিখেছেন। কবিতার আড়ালে অন্য কোন উদ্দেশ্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাননি। সুদীর্ঘ কাব্যসাধনার ভেতর দিয়ে তিনি শিল্পের যে জটিল বিশ্বের দিকে নিজেকে উন্মোচনের প্রয়াস পেয়েছেন ষাটের দশকের বাংলা কবিতার পটভূমিতে তা কুসমাস্তীর্ণ না। শিল্প-মীমাংসার প্রশ্নে শেষ কথা নেই। তবে হৃদয়বৃত্তির যে সংবেদনশীলতার ভেতর দিয়ে আসাদ চৌধুরী নিজেকে প্রকাশের এবং ক্রমবিকাশের পথে এগিয়েছেন তার আন্তরিক প্রচেষ্টা বিবেচনায় রেখেই পাঠক তার প্রতি মনোযোগী। কারণ সময়ের প্রভাব বলয় থেকে বেরিয়ে ব্যক্তি এবং সমাজের অস্তিত্বসংকটের প্রশ্নকে পাশ কাটিয়ে যখন বাকপরিবর্তনের প্রেরণাকে ধারণ করেন কবি, তখন তা স্বকালের জন্য যেমন তেমনি উত্তরকালেও আদরীয়।