আশাপূর্ণা দেবী (৮ জানুয়ারি ১৯০৯—১৩ জুলাই ১৯৯৫) পরিশ্রমী জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক; যাঁকে নারীবাদী লেখক বললেও আমরা সে-রকম একচ্ছত্র বিশেষণে বিশেষায়িত না করে বরং একজন প্রথিতযশা সুসাহিত্যিক হিসেবেই অখ্যায়িত করতে চাই। তাঁর রচনার সম্ভারে রয়েছে দেড় হাজারের মতো গল্প এবং আড়াই শ’য়ের বেশি উপন্যাস। তাঁর রচনা সম্ভারে মজুদ রয়েছে গল্প, উপন্যাস ও শিশুতোষগল্প। এজন্য সাহিত্যিক বিভাজনে তাঁকে অনেকেই ঔপনাসিক, গল্পকার ও শিশুসাহিত্যিক হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এত বিভাজনের কী প্রয়োজন, তা বোধগম্য নয়; আমরা তাঁকে কথাসাহিত্যিক বা কথাশিল্পী হিসেবেই আখ্যায়িত করতে চাই।
সাহিত্যের এত বিশাল রচনাসামগ্রীর জন্য তিনি জ্ঞানপীঠ, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্মানিক ডক্টরেট ডিগ্রি, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রবীন্দ্র পুরস্কার এবং ভারত সরকারের সর্বোচ্চ সাহিত্য সম্মান সাহিত্য অকাদেমি ফেলোশিপ অর্জন করেন। উত্তর কলকাতায় এই মহীয়সীর জন্ম মাতুলালয়ে। বাবা হরেন্দ্রনাথ গুপ্ত ও মা সরলাসুন্দরী দেবী। গুপ্ত বংশের আদি বাস হুগলী জেলার বেগমপুরে। বাবা ছিলেন বাণিজ্যিক আর্টিস্ট এবং তখনকার পত্রিকায় ছবি আঁকতেন। ঠাকুরমা নিস্তারিনী দেবীর পাঁচ পুত্রের যৌথ পরিবারে তাঁর শৈশবের ছয় বছর পর্যন্ত কেটেছে। পরে আপার সার্কুলার রোডের বাবার নিজস্ব বাসায় বসবাস করেন। শৈশবের ছয় বছরের স্মৃতি তাঁর জীবনে দারুণ প্রভাব ফেলে। ঠাকুরমার কড়া শাসনের জন্য প্রথাগত শিক্ষা গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। তবে মা সরলাসুন্দরী ছিলেন একনিষ্ঠ সাহিত্য পাঠিকা এবং তৎকালের প্রসিদ্ধ গ্রন্থের বড় সংগ্রহ ছিল তাঁর বাসায় এবং মায়ের সাহিত্যপ্রীতি কন্যাদের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকায় অর্থাৎ কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়ার সুযোগ না পাওয়ায় আশাপূর্ণা দেবী নিজেদেও বাসভবনেই সকল প্রকার পাঠ্য ও অপাঠ্য বইয়ে মুখ গুঁজে থাকতেন এবং সাহিত্যের রস আস্বাদন করতেন। এ-রকম সাহিত্য পাঠেই তার মননে সাহিত্যের বীজ রোপিত ও অঙ্কুরিত হয় এবং সেটিই বাংলা সাহিত্যে মহীরূহ রূপ ধারণ করে। মাত্র পনেরো বছর বয়সে কালিদাশ গুপ্তের সঙ্গে বিয়ে হয়। তবে বিয়ে তাঁর সাহিত্য-সাধনার ক্ষতি করেনি বরং স্বামীর সহযোগিতায় তাঁর পথ সহজ ও প্রসারিত হয়। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন আটপৌরে সংসারী, মা, গৃহবধূ। বাংলা ভাষা ছাড়া আর দ্বিতীয় কোনো ভাষাও জানতেন না এবং পাশ্চাত্য-সাহিত্য সম্পর্কেও তাঁর কোনো ধারণা ছিল না। অল্প বয়সেই তিনি সাহিত্যের খ্যাতি কুড়াতে থাকেন যা জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চলে।
আশাপূর্ণ দেবীর বিপুল সাহিত্য সম্ভারে অনুপ্রবেশ করে আস্বাদন গ্রহণ করার সময় সাপেক্ষ; নিরেট ধৈর্যেরও প্রয়োজন। তাঁর লেখা নিয়ে আলোচনা করাও বেশ কষ্টসাধ্য; এজন্য তাঁর ট্রিলজি নিয়েই আলোচনা করে মহিয়সী কথাসাহিতিক্যের প্রতি সম্মান জানাতে চাই।
‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’ উপন্যাসে একটি পরিবারকে কেন্দ্র করে উপন্যাসটি রচিত হলেও কলকাতাকেন্দ্রিক তখনকার মেয়েদের বন্দিদশার একটি জীবন্ত দলিল হয়ে উঠেছে।
ট্রিলজি ইংরেজি শব্দ হলেও এটি বলতে গেলে, বাংলা ভাষার অন্যান্য বিদেশি শব্দের মতো বাংলায় প্রায় মিশে গেছে। ট্রিলজির আভিধানিক অর্থ ত্রয়ী হিসেবে অভিধানে পাওয়া যায়। ম্যাক্সিম গোর্কির তিন খণ্ডের লেখা আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থটিকে হায়াৎ মাহমুদ ত্রিপিটক নামকরণ করেছেন। যদিও ত্রিপিটক বৌদ্ধ ধর্মের নাম হিসেবেই আমরা জানি। ট্রিলজিকে ত্রয়ী বলা হলেও সাহিত্যের ক্ষেত্রে এর সামান্য ব্যাখ্যা বা আলোচনা করা দরকার। বিভিন্ন অভিধান ঘাঁটলে দেখা যায় ট্রিলজি বলতে পরপর তিনটি বিয়োগাত্মক নাটক বা তিনটি যুক্ত নাটককে বোঝানো হয়। কিন্তু এই ধারণা এখন কেবল নাটকের মধ্যে আটকে নেই বরং বর্তমান সময়ে উপন্যাসে ট্রিলজি শব্দটি বেশি আলোচিত; ব্যবহৃত শব্দ। দুই বাংলার বাংলা সাহিত্যের কমপক্ষে বিশটি ট্রিলজি রয়েছে এবং এগুলোর প্রায় সবগুলোই জনপ্রিয় এবং শ্রেষ্ঠ উপন্যাসের সারিতে মান্য করা হচ্ছে। বাংলাদেশের ট্রিলজিগুলো খুব বেশি আলোচিত না হলেও পশ্চিমবঙ্গের বেশ কয়েকটি ট্রিলজি জনপ্রিয়তার শীর্ষে এবং ভালো মানের সাহিত্যকর্ম হিসেবেও অনেকের কাছে স্বীকৃত।
এগুলোর মধ্যে শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’, সমরেশ মজুমদারের ‘উত্তারাধিকার’, ‘কালবেলা’, ‘কালপুরুষ’ ও ‘মৌষলকাল’ সবচেয়ে বেশি আলোচিত। সমরেশ মজুমদার পরপর তিনটি উপন্যাস ছাড়িয়ে চারটিকে সংযোজন করেছেন অনেক বছর পর। যাকে টেট্রালজি বলা হয়ে থাকে। বাংলা সাহিত্যে আর কোনো ট্রিলজি আছে কি না, তা আমাদের জানা নেই। এই শব্দটি খুব বেশি পরিচিতও নয়। বাংলাদেশে হুমায়ূন আহমেদের ‘মাতাল হাওয়া’, ‘মধ্যাহ্ন’ ও ‘জোছনা ও জননীর গল্প’কে কোনো কোনো সাহিত্যিক ট্রিলজি বললেও উপন্যাসগুলোর চরিত্রের পরম্পরা ও ধারাবাহিকতা দেখা যায় না। তাই এটিকে সময়ের ত্রয়ী উপন্যাস বা টাইম ট্রিলজি বলে আখ্যায়িত করেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘সেই সময়’, ‘প্রথম আলো’ ও ‘পূর্ব পশ্চিম’ তিনটি উপন্যাসকে অনেকেই টাইম ট্রিলজি হিসেবে বিবেচনা করেন। এই উপন্যাসগুলো চরিত্রের ধারাবাহিকতা তেমন নেই, যেমন আছে সমরেশ মজুমদারের ট্রিলজিতে।
শওকত আলীর ‘দক্ষিণায়নের দিন’, ‘কুলায় কালস্রোতে’ ও ‘পূর্বরাত্রি পূর্বদিন’। আবু জাফর শামসুদ্দীন লিখেছেন ‘ভাওয়ালগড়ের উপাখ্যান’, ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’ ও ‘সংকর সংকীর্তন’। এ-রকম তালিকায় বিশ জনের বেশি লেখকের নাম দেখতে পাওয়া যায়। যাই হোক, এত লেখকের সব ট্রিলজি এখানে উপস্থাপন করা সম্ভব নয়। বরং আজকের নির্দিষ্ট আলোচনায় ফোকাস করে আশাপূর্ণা দেবীর ট্রিলজির দিকে দৃষ্টি ফেরানো যাক।
আশাপূর্ণা দেবীর ট্রিলজিতে ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’, ‘সুবর্ণলতা’ ও ‘বকুলকথা’ তিনটি উপন্যাস অন্তর্ভুক্ত। তিনটিকে স্বতন্ত্র উপন্যাস হিসেবেও যদি কোনো পাঠক পাঠ করেন, তাহলেও কোথাও হোঁচট খাবেন বলে মনে হয় না। তিন খণ্ডে তিন নারীর চরিত্রে তিনটি প্রজন্মের ধারাবাহিকতায় রচিত পারিবারিক উপন্যাস হিসেবে প্রায় শত বছরের ঐতিহ্যগত অখণ্ড ভারতের কয়েকটি হিন্দু পরিবারের পারিবারিক মিথস্ক্রিয়া ও রসায়নে নির্মিত হয়েছে এই গুরুত্বপূর্ণ ও পাঠকপ্রিয় উপন্যাসটি। প্রথম খণ্ডে প্রথম প্রতিশ্রুতির নায়িকা সত্যবতী, দ্বিতীয় খণ্ডে সত্যবতীর মেয়ে সুবর্ণলতা এবং তৃতীয় খণ্ডে সুবর্ণলতার মেয়ে বকুল অর্থাৎ সত্যবতীর নাতনি যে বকুল অনামিকা ছদ্মনামে যশস্বী লেখিকা হিসেবে সমাজের বাস্তব চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন।
প্রথম প্রতিশ্রুতি
আশাপূর্ণা দেবীর অন্তর্দৃষ্টি কতটা প্রখর তা এই ট্রিলজি পড়ার পর উপলব্ধি করা যায়। ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’র ভূমিকায় প্রকাশের কথা অনুযায়ী তিনি রেলস্টেশনে বইয়ের নাম ঠিক করে দেন পত্রিকায় লেখার জন্য। পরে তিনি উপন্যাসটি লেখা শুরু করেন। এখানেই শেষ কথা নয়, লেখাটির শুরুতেই তিনি যে ট্রিলজি লিখবেন এরই একটি চারাও রোপণ করে রেখেছেন শুরুতেই। এই দীর্ঘ উপন্যাসের এত চরিত্র নিয়ে ভাবনার দুয়ার তিনি যেভাবে খুলেছেন সেটি ট্রিলজি না পড়া পর্যন্ত বোঝার উপায় নেই যে, তিনি কত বড় মাপের, পরিশ্রমী ও ধৈর্যশীল লেখিক। উপন্যাসের শুরুটাই নাটকীয় এবং একটি আকর্ষণ তৈরি করেছেন এভাবে—‘সত্যবতীর গল্প আমার লেখা নয়। এ গল্প বকুলের খাতা থেকে নেওয়া। বকুল বলেছিল, একে গল্প বলতে চাও গল্প, সত্যি বলতে চাও সত্যি।’
কে এই বকুল? এ প্রশ্নের চূড়ান্ত সুরাহার জন্য পাঠ করতে হবে তৃতীয় খণ্ডটি যেটি বকুলকথা শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে। সুদীর্ঘ সময়ের ক্যানভাসে তিন প্রজন্মের কথা মাথায় রেখে প্রথমেই এই বাক্যটি নির্মাণ করা মানে রীতিমতো তাক লাগিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কিছু নয়। দ্বিতীয় খণ্ডে সত্যবতীর মেয়ে সুবর্ণলতা। সুবর্ণলতার মেয়ে বকুলের জন্ম হয় তারুণ্যে পা রাখে এবং বকুলের তরুণ বয়সে দ্বিতীয় খণ্ডটি শেষ হলেও বকুল কোনো গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হিসেবে চিত্রিত হয়নি। পরবর্তী খণ্ডে দেশ কাঁপানো যশস্বী লেখিকার হিসেবে প্রধান চরিত্র হতে পারে এমন উত্তাপও পাওয়া যায়নি। তৃতীয় খণ্ডে বকুল অনামিকা ছদ্মনামে প্রথিতযশা লেখিকা হয়ে স্বচ্ছ দর্পণে বিবর্তিত ও আধুনিক সমাজের প্রতিফলন ঘটান নিখুঁত ও পরিপূর্ণরূপে। এই যে খাতা বা ডায়েরি প্রথম খণ্ডে সামান্য আভাস পাওয়া গেলেও তৃতীয় খণ্ডেও ডায়েরির উল্লেখ পাওয়া যায়। দ্বিতীয় খণ্ডেও সুবর্ণলতা ডায়েরি লিখতেন এমন আভাস পাওয়া গেলেও তা খুব পরিষ্কার হয়ে পাঠকের কাছে ধরা দেয়নি। দীর্ঘ উপন্যাসের নাটকীয় শুরুটা সত্যি চমৎকার।
‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’ প্রকাশিত হয় বাংলা ১৩৭১ (ইংরেজি ১৯৬৪) সালে ফাল্গুন মাসে এবং ১৪২৪ (ইংরেজি ২০১৭) সালের বাহাত্তরতম মুদ্রণটি পাঠ করে এই ট্রিলজির আলোচনার প্রয়াস চালাচ্ছি। এই উপন্যাসের জন্য আশাপূর্ণা দেবি ১৩৭২ সালে রবীন্দ্র পুরস্কারে এবং ১৩৮৪ সালে জ্ঞানপীঠ পুরস্কার অর্জন করেন। অনেক বড় ক্যানভাসে ত্রিশের দশক থেকে উপন্যাসটির বয়ান শুরু হয় যখন এই উপমহাদেশে মেয়েদের লেখাপড়া করাকে পাপ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। পশ্চিমা বিশ্ব ছাড়া ধরে নেওয়া যেতে পারে যে, পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই মেয়েদের লেখাপড়াকে পাপ মনে করা হতো এবং তাদেরকে প্রাতিষ্ঠানি শিক্ষার কোনো সুযোগ দেওয়া হতো না। নারীদের নিগ্রহ, অবহেলা, শৃঙ্খলে আবদ্ধ রাখার এই সমাজের আচার-অনাচারকে ভেঙে দেওয়ার জন্য প্রথম প্রতিশ্রুতি একটি শক্তিশালী শাবল হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। একটি আলোচনা থেকে জানা যায় যে, এই ট্রিলজিটি লেখিকার আত্মজীবনী তাঁর জীবনের কথা বিধৃত হয়েছে। হয়তো পুরোপুরি সত্য না হলেও লেখিকার পারিবারিক জীবনের শৈশবের বর্ণনা থেকে যৌথ পরিবারের সন্ধান পাওয়া যায় এবং ঠাকুরমার কারণে তাঁদের লেখাপড়া হয়নি এবং বাল্যবিবাহের রেকর্ড অনুযায়ী তৎকালীন সমাজের চিত্র প্রথম প্রতিশ্রুতিতে প্রতিফলিত হয়েছে। খুব বেশি সময় আগে নয়; মাত্র এক শতাব্দী আগে পশ্চিমা দেশগুলো ছাড়া বাকি সব দেশের মেয়েদের লেখাপড়া ছিল নিষিদ্ধ। পাক-ভারত উপমহাদেশেও মেয়েদের লেখাপড়া কিংবা ঘর থেকে বাইরে যাওয়ার বিধিবিধান ছিল সত্যি ভয়াবহ। এই মূঢ়তার শৃঙ্খল ভেঙে শিক্ষার আলোয় আলোকিত হওয়ার জন্য এই উপমহাদেশে প্রথম হিন্দুরা এগিয়ে আসে এবং তারা ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হতে থাকে কিন্তু মুসলমানরা ইংরেজি ইহুদি-নাছারাদের ভাষা বলে ইংরেজি তথা স্কুল-কলেজের শিক্ষা গ্রহণ না করে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করে এবং পশ্চাৎপদের ধ্যান-ধারণা ভাঙতেও প্রায় একশ বছর চলে যায়। হিন্দু সম্প্রদায়ের মেয়েরা স্কুল কলেজে যাওয়া শুরু করলেও মুসলমান মেয়েরা আরো পরে আড়মোড় ভাঙে বেগম রোকেয়ার মাধ্যমে। তখনকার মানুষের বিশ্বাস ছিল ধর্মীয় গ্রন্থ ছাড়া অন্য বই পড়া মেয়েদের জন্য পাপ। ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’ উপন্যাসে একটি পরিবারকে কেন্দ্র করে উপন্যাসটি রচিত হলেও কলকাতাকেন্দ্রিক তখনকার মেয়েদের বন্দিদশার একটি জীবন্ত দলিল হয়ে উঠেছে। এটি শুধু উপন্যাসই নয় বরং বলা যায় এটি একটি সমাজচিত্র ও সমাজ বিবর্তনের সমাজবিজ্ঞান।
পদ্য ও বইপত্রের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে সত্যকে পরবর্তী সময় জ্ঞান বিকাশের ধারাকে অব্যাহত রাখতে পরিণত বয়সে স্কুলে পর্যন্ত নিয়েছেন। নিজে শিক্ষিকা হিসেবেও কাজ করেছেন।
‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’তে পঞ্চাশটি চরিত্রের মিথস্ক্রিয়া ঘটে এবং অধিকাংশ চরিত্রের সঙ্গেই পাঠক এক হয়ে যায়। চরিত্রগুলোর সঙ্গে পাঠকও ইনভলভড হয়ে তৎকালীন জীবনব্যবস্থার সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়। লেখক এমনই সুকৌশলে চরিত্র নির্মাণ করেছেন যে, ৪৮টি অধ্যায়ে ৫১০ পৃষ্ঠার উপন্যাসটি পাঠের সময়ে মনে হবে চরিত্রগুলোর মিথস্ক্রিয়া চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে ভাসছে।
সত্যবতী এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় ও প্রধান চরিত্র হলেও রামকালী একটি নাটকীয় অভিজাত প্রবল প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তিত্বও পাঠকের হৃদয়ে জায়গা করে নেয়। এই চরিত্রটি সৃষ্টি করতে গিয়ে লেখিকা ধর্মীয় গোঁড়ামিতে সূক্ষ্ম কিন্তু তীব্রভাবে আঘাত করেছেন যা হয়তো অসচেতন পাঠকের মনোযোগ এড়িয়ে গেলেও সচেতন পাঠকের মনোযোগ এড়াতে পারবে না। রামকালী অর্থাৎ সত্যবতীর বাবা যিনি তাঁর বাবা জয়কালীর খরমের ঘা খেয়ে অভিমান করে গৃহত্যাগ করেন। অভিযোগও ছিল গুরুতর। একদিন কি যেন অসুবিধায় পড়ে জয়কালী একদিনের জন্য সদ্য উপবীতধারী পুত্র রামকালীর উপর ভার দিয়েছিলেন গৃহদেবতা জনার্দনের পূজা-আরতির। মহোৎসাহে সে ভার রামকালী নিলেও ভ্রমবশত ফল-বাতাসা দিলেও জল না দেওয়ার অপরাধে রামকালীর পিসির নালিশে মহাভ্রমের জন্য বাবা জয়কালী খড়মপেটা করার জন্য উদ্যত হলে রামকালী কি না বলল জল দেবতা খেয়ে ফেলেছে। জল দেয়নি আবার দেবতা জল খেয়ে ফেলেছে—এই মিথ্যেও গুরুতর অপরাধে তাকে খরমপেটা করার পরই রামকালী বাড়ি থেকে উধাও। দূরান্তে মুকশুদাবাদে নবাব-বাড়ির কবরেজ নিঃসন্তান গোবিন্দ গুপ্তর বাড়িতে থেকে কবিরাজি বিদ্যার্জন করে এবং শেষে গোবিন্দ গুপ্তর দয়ায় বস্তা ভরে টাকা এবং গুপ্তর পালকি দিয়ে বাড়ি এলেও বাবার মুখ দেখতে পারেননি। একবার বাবা যদিও রামকালীর খোঁজ পেয়েছিলেন কিন্তু জাতের দোহাইয়ে নিজ সন্তানকে বাড়ি ফিরিয়ে আনার কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। এই রামকালীই সত্যবতীর বাবা যিনি এই উপন্যাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ, দায়িত্বশীল, অভিজাত, ধনাঢ্য, চৌকস, পরোপকারী ও ধর্মাচারী মহান চরিত্রে আবির্ভূত হন।
শৈশব থেকেই সত্যবতীর মধ্যে নেতৃত্বসুলভ ও বুদ্ধিমতীর গুণাবলি প্রকাশ পায়। সত্যবতীর বন্ধুদের নিয়ে চলাফেরা কিংবা গোসল করার সময় কিংবা দেবতুল পিতা রামকালীর সামনে কথা বলা বা বাড়ি ছেড়ে একা পাড়ায় যাওয়ার মতো সাহস তৎকালীন মেয়ে শিশুদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। রামকালীর ভাগ্নে জটা যখন তার স্ত্রীকে মারধর করল তখন স্ত্রী মরে গেছে এমন কথাই চাউর হয়ে গেলো গ্রামে। সত্যবতীই বাবাকে চিকিৎসার জন্য জটার বৌয়ের কাছে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়। যদিও জটার স্ত্রী মারা যায়নি তবু সে এমন অবস্থায় ভান ধরেছিল যে, তাকে তুলসিতলায় শুইয়ে মড়াকান্না শুরু করেছিল সত্যবতীর পিসি। যদিও রামকালী সাধারণ ভেষজ দিয়ে কবিরাজি করে তবু এলাকার মানুষের ধারণা ছিল রামকালী মৃত-মানুষকেও ভালো করতে পারে। এই বিশ্বাস মেয়ে সত্যবতীর মনেও জন্মেছিল।
রামকালীর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কোনো প্রমাণ না পাওয়া গেলেও তাঁর মননে কিছুটা আধুনিকতার আঁচ ছিল বলে ধারণা করা যেতে পারে। কিন্তু কর্মে আধুনিকতার কোনো প্রভাব পড়েনি। তিনি সামাজিক প্রথা-ঐতিহ্য-সংস্কার-কুসংস্কার ভাঙার কোরাসে যোগ দেননি বরং নিরেট সংস্কারের মধ্যেই ছিলেন। এর প্রমাণ পাওয়া যায় রাসুর বিয়ে এবং শেষ বয়সে সত্যবতীর বাড়িতে বেড়াতে আসার ঘটনায়। যৌথ পরিবার হলে তার নেতৃত্বসুলভ গুণাবলি এবং বেশি উপার্জনশীল ব্যক্তি হিসেবে পরিবারের একমাত্র ও প্রতাপশালী সিদ্ধান্তগ্রহণকারী ব্যক্তি হিসেবে তাকে দেখা যায়। তাঁর দাদা সংসারের সকল দায় রামকালীর উপর ছেড়ে দিয়েই নিষ্কর্মার মতো জীবনযাপন করেন। রামকালীর চরিত্রটি কোথাও কোথাও রহস্যময় করে তোলা হয়েছে। একবার পথে এক বরযাত্রীর সঙ্গে দেখা হয় পথে, তিনি ধারণা করেন যে বর খুব অল্প সময়ের মধ্যে মারা যাবে এবং বরকে বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য পরামর্শ দেন। যে মেয়েটির লগ্ন ঠিক করা আছে সেই লগ্ন যদি ভেঙে যায় তাহলে মেয়েটির জীবনে আর বিয়ে হবে না এটি সমাজের বিধান। তাই তিনি আপন ভ্রাতুষ্পুত্র বিবাহিত রাসুকে উঠোন থেকে তুলে নিয়ে সেই মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেন। এখানেও সনাতন ধর্মের ছোটখাটো অনেক নিয়ম মানা হয়নি মেয়েটিকে বাঁচানোর স্বার্থে। একটি মেয়েকে রক্ষা করা হলো বিবাহিত রাসুর সঙ্গে বিয়ে দিয়ে, কিন্তু রাসুর প্রথম স্ত্রীর কী হবে, সেটি ভাবা হয়নি? এই বিয়েও তখনকার পুরুষশাসিত সমাজ ব্যবস্থার এটি একটি দলিল। কারণ, বহুবিবাহ পুরুষের জন্য সামাজিক ও ধর্মীয়ভাবে বৈধ ছিল এবং বাল্যবিবাহ ছিল অবশ্য কর্তব্য বিষয়। ঔরসজাত কন্যাসন্তানের বুদ্ধি দেখে রামকালী অবাক হন এবং তাঁর আক্ষেপ হয় ও তুচ্ছজ্ঞান করে বলেন, ‘এত তলিয়ে ভাবে কী করে? আহা মেয়েমানুষ, তাই সবই বৃথা।…এই বুদ্ধিটা যদি নেড়ুর হতো।’ প্রসঙ্গত নেড়ু তার বড় ভাইয়ের শেষ কুড়ান্তি ছেলে।
কোনো উপন্যাসের চরিত্র নির্মাণের জন্য শুরুতে ছোট ছোট বিষয়ের গাঁথুনি দিয়ে পড়ে তা চূড়ায় তুলতে হয়। আশাপূর্ণা দেবীও অত্যন্ত কৌশলী ও উঁচুমানের লেখক বলে এই উপন্যাসের শুরুতেই সত্যবতীর শাণিত বুদ্ধির বীজ বপন করেছেন। জটার স্ত্রীকে শারীরিক নির্যাতনের প্রতিবাদ হিসেবে সত্যর পদ্য রচনা একাধারে তার প্রখর বুদ্ধিমত্তা এবং অন্যধারে প্রতিবাদের অস্ত্র হিসেবে পিসতুতো ভাইয়ের বিরুদ্ধে সমাজের মানুষকে ক্ষেপিয়ে তোলার অস্ত্র হাতে দিয়ে দিয়েছে। পদ্য ও বইপত্রের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে সত্যকে পরবর্তী সময় জ্ঞান বিকাশের ধারাকে অব্যাহত রাখতে পরিণত বয়সে স্কুলে পর্যন্ত নিয়েছেন। নিজে শিক্ষিকা হিসেবেও কাজ করেছেন।
এভাবেই নবকুমারের প্রতি প্রতিশোধের আগুন ঢেলে সত্যবতী গৃহত্যাগী হন এবং ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’ অর্থাৎ প্রথম খণ্ডের এখানে সমাপ্ত হয়।
তরুণ বয়সী নবকুমারের সঙ্গে শৈশবেই বিয়ে হয় সত্যবতীর যখন সে বিয়ের কিছুই বুঝে না। নবকুমারও বিয়ে বা সংসার বলতে কিছু বুঝে না। শ্বশুরকে দেখে লজ্জায় পালিয়ে যায় এমন ঘটনাও এখানে বিধৃত হয়েছে। এই উপন্যাসের সত্যবতী যেমন উল্লেখযোগ্য চরিত্র ঠিক তেমনি এলোকেশী সত্যবতীর শাশুড়িও উল্লেখযোগ্য চরিত্র। রামকালী যেমন ঋজু অভিজাত ও প্রবল প্রতাপশালী ব্যক্তিত্বের চরিত্রের মানুষ ঠিক তেমনি তাঁর বেয়াই সত্যবতীর শ্বশুর ঠিক বিপরীত মেনিমুখো দুশ্চরিত্রের স্ত্রৈণ প্রকৃতির মানুষ। সত্যর শাশুড়ি এলোকেশী যেমন প্রতাপশালী পরিবারের সকল সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী আধিপত্য বিস্তারকারী চরিত্র ঠিক বিপরীত চরিত্র সত্যর মা শালীন টিপিক্যাল বাঙালি অভিজাত গৃহিনীর চরিত্র রূপে দেখা যায়। সত্যর বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার হৃদয়ের লালন করা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী স্বর শাশুড়ির সঙ্গে টোকাটুকি লাগে। নবকুমার লেখাপড়া শিখেছে পাড়ার এক শিক্ষকের কাছে এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকা সত্ত্বেও সে ইংরেজদের অফিসে চাকরি করার সুযোগ পায়—সেই যুগ তো এমনই ছিল।
উপন্যাসে অনেক নাটকীয়তা আছে যেখানে লেখিকার মেধার স্বাক্ষর। সত্যবতীর যেদিন দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম হয় সেদিন তার মায়ের মৃত্যু হয়। আঁতুড়ঘরে খবর পেয়েও এলোকেশী সাবধান করে দিয়েছে যেন কান্নাকাটি না করে। কান্নাকাটি করলে নবজাতকের অমঙ্গল হতে পারে। মায়ের লাশ দেখা তো দূরের কথা প্রিয় মায়ের মৃত্যু-শোক নবজাতকের মুখের দিকে তাকিয়েই ভুলতে হয়।
পৃষ্ঠাজুড়ে চলে পারিবারিক টোকাটুকি যেখানে ক্যারামবোর্ডের খেলার স্ট্রাইকার একবার থাকে এলোকেশীর হাতে আরেক বার থাকে সত্যর কাছে। দীর্ঘ সংসার জীবনে একবার সত্যর কাছে এলোকেশী হেরে যান।
এলোকেশীর প্রচণ্ড বিরোধিতার পরও সন্তানাদি নিয়ে নবকুমারের সঙ্গে কলকাতায় পাড়ি জমায় সত্যর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী। এলেকোশী মেয়েদের শহরে থাকার ব্যাপারে ঘোর আপত্তি তুললেও সে আপত্তি ধোপে ঠেকেনি। সত্যবতী ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে নবকুমারের সঙ্গে কলকাতায় বসবাস শুরু করেন। সাংসারিক কাজ করেও নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য শিক্ষার প্রতি অত্যুগ্র বাসনায় তাড়িত হয়ে নবকুমারের শিক্ষক ভবতোষের সঙ্গে যোগসাজসে লেখাপড়া শিখেন। শুধু লেখাপড়া শিখেন না, মেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর জন্যও কাজ করেন।
সত্যবতীর তিন ছেলে এক মেয়ের মা হয় এবং তাদের নিজের মতো করেই শিক্ষা-দীক্ষা ও মানুষ করার জন্য ব্যাপৃত হন। ছেলেদের মধ্যে যদিও ডমিন্যান্ট মনোভাব গড়ে উঠে কিন্তু সেগুলোকে উপন্যাসে বিস্তারিত আনা হয়নি। সত্যবতীর মনোযোগ পড়ে কন্যা সুবর্ণলতার দিকে। সুবর্ণকে নিজের আদর্শে যখন শিক্ষা-দীক্ষা, চিন্তা- চেতনায় বড় করার জন্য প্রয়াসী হন ঠিক তখনই তার চূড়ান্ত হেরে যাওয়ার পালা। সুবর্ণকে নিয়ে একদিন নবকুমার গ্রামের বাড়িতে যান বেড়াতে। সেখানেই আলাপ-আলোচনা করে নয় বছরের শিশু সুবর্ণকে বিয়ে দেয় এলোকেশীর প্ররোচনায়। এলেকোশী সত্যর কাছে বারবার হেরে গেলেও শেষবার সুবর্ণকে শিশু বয়সে সত্যকে না জানিয়েই বিয়ে দিয়ে প্রতিশোধ নেন। জয়ী হয় শাশুড়ি এলোকেশী হলেও বিজিত সত্যবতী সুবর্ণের বিয়ে মেনে নিতে পারেননি। এলোকেশীর সই মুক্তকেশীর ছেলের সঙ্গে পুতুল খেলার মতো সুবর্ণকে বিয়ে দেওয়া হয়। সংসার জীবনের প্রতি চরম বীতশ্রদ্ধ হয়ে সংসারে ফিরে না গিয়ে জনমের জন্য চলে যান কাশীতে। এভাবেই নবকুমারের প্রতি প্রতিশোধের আগুন ঢেলে সত্যবতী গৃহত্যাগী হন এবং ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’ অর্থাৎ প্রথম খণ্ডের এখানে সমাপ্ত হয়।
সুবর্ণলতা
কালকে অতিক্রম করে মহাকালের করতলের উষ্ণতায় থাকার মতো চরিত্র হলো সুবর্ণলতা। ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’ পর্বে লেখিকার সব কথা শেষ হয়নি, হয়নি সমাজের বিবর্তনের ধারা। প্রথম খণ্ডে যদি উপন্যাস শেষ হয় তাহলে নারী জাগরণের যে সূচনা হয়েছে তা থেমে যায়। পাঠককুল অতৃপ্ত থাকেন, বুকের ভেতরে হাহাকার তৈরি হয়। অবশ্যই সাহিত্যের জন্য এ-রকম অতৃপ্ত থাকাটা স্বাভাবিক হলেও তৃপ্তি ও প্রশান্তির জায়গাও চায় পাঠককুল। আশাপূর্ণা দেবী এই খণ্ডে সুবর্ণলতার চরিত্রের মাধ্যমে স্বাধীনতাপূর্ব অখণ্ড ভারতের সমাজের যে ছবি এঁকেছেন তা কেবল সাহিত্যের মধ্যেই পড়ে না; বরং সমাজবিজ্ঞানের উঠোনেও গড়ায়। লেখিকা নিজেও ভূমিকায় লিখেছেন, ‘‘আপাতদৃষ্টিতে ‘সুবর্ণলতা’ একটি জীবনকাহিনী, কিন্তু সেইটুকুই এই গ্রন্থের শেষ কথা নয়। সুবর্ণলতা একটি বিশেষ কালের আলেখ্য। যে কাল সদ্যবিগত, যে কাল হয়তো বা আজও সমাজের এখানে সেখানে তার ছায়া ফেলে রেখেছে। ‘সুবর্ণলতা’ সেই বন্ধন-জর্জরিত কালের মুক্তকামী আত্মার যন্ত্রণার প্রতীক।
আর একটি কথা আবশ্যক। আমার ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’ গ্রন্থের সঙ্গে এর একটি যোগসূত্র আছে। সেই যোগসূত্র কাহিনীর প্রয়োজনে নয়, একটি ‘ভাব’কে পরবর্তী কালের ভাবধারার সঙ্গে যুক্ত করার প্রয়োজনে।
সমাজবিজ্ঞানরা লিখে রাখেন সমাজ বিবর্তনের ইতিহাস, আমি একটি কাহিনীর মধ্যে সেই বিবর্তনের একটি রেখাঙ্কনের চেষ্ট করেছি মাত্র।”
টিলজির এই উপন্যাসটি দুটি পর্বে বিভক্ত। প্রথম পর্বে ছাব্বিশটি এবং দ্বিতীয় পর্বে একত্রিশটি পরিচ্ছদে বিভক্ত হয়ে ৪৩৮ পৃষ্ঠায় শেষ হয়। প্রথম পর্বে সুবর্ণের যৌথ পরিবারের যাপিত জীবন এবং দ্বিতীয় পর্বে একক পরিবারের যাপিত জীবনের আখ্যান লিপিবদ্ধ হয়। এই খণ্ডে স্বদেশী আন্দোলনের সামান্য উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে এবং সুবর্ণলতাও এই স্বদেশী আন্দোলনে শরিক হলেও গুরুত্বপূর্ণ কোনো ভূমিকায় দেখা যায়নি। তবে কোনো সন তারিখ না দিয়ে লেখিকা একটি সত্যিকারের কল্পকাহিনীই তৈরি করেছেন। দীর্ঘ উপন্যাসের সময় বিবেচনায় সারা পৃথিবী বাদই দিলাম, এই উপমহাদেশেও ব্যাপক রাজনৈতিক পরিবর্তন হলেও এটিকে পারিবারিক গণ্ডির মধ্যেই লেখক রেখেছেন এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রেখেছেন।
তবে মায়ের গৃহত্যাগের বদনামের বোঝা মাথায় নিয়ে সংসার শুরু করলেও এই কথা চলতে থাকে দীর্ঘদিন।
সুবর্ণলতার বিয়ে হয় একটি বড় যৌথ পরিবারে যেমনটি হয়েছিল তার মা সত্যবতীর। কিন্তু সত্যবতী এক সময় যৌথ পরিবারের গণ্ডি ছেড়ে নবকুমারকে নিয়ে কলকাতায় এসে পড়েন। সুবর্ণলতার বিয়ে হয় কলকাতা শহরের দর্জিপাড়ার একটি বড় যৌথপরিবারে। সত্যবতী অনেক যুক্তিবাদী হলেও সুবর্ণলতার মধ্যে তেমনভাবে যুক্তিবাদী চরিত্র গড়ে ওঠেনি। বরং একরোখা ও কিছুটা খামখেয়ালিপনা স্বভাবের হন। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্পষ্টভাষী সুবর্ণর যৌক্তিক কথা হলেও সেসব কথা শাশুড়ি মুক্তকেশী কিংবা ভাজরা সহজে গ্রহণ করতেন না। শাশুড়ি-বউয়ের মধ্যে টোকাটুকি প্রায় সবসময়ই লেগে থাকত। মুক্তকেশীর চার ছেলে আর চার মেয়ের সংসারে সুবর্ণর বিয়ে হয় দ্বিতীয় ছেলে প্রবোধের সঙ্গে। বিরাট সংসারের দায়ভার যেন সবর্ণর উপরই ন্যস্ত হয়। কলকাতার বাসায় দক্ষিণের বারান্দা, বিরাট সংসারের সঙ্গে মানিয়ে চলা, স্বামীর প্রেম লাভ ইত্যাদি সবকিছুই কিশোরী সুবর্ণকে সামাল দিতে হয়। কিন্তু মা সত্যবতী যে স্বপ্নের বীজ বুনে দিয়েছিল শিশু বয়সে সেই বৈরী সংসারে কেবল সন্তান উৎপাদন আর সন্তান লালনের প্রতি অন্য জা-ভাজদের মতো আত্মোৎসর্গ করেনি। শাশুড়ির সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে যাওয়া যেন নিত্যদিনের ঘটনা। মুক্তকেশী সংসারের কাজকর্ম সেরে সুখী শাশুড়ির মতো পাড়া বেড়ানো আর পুজো-অর্চনাতেই ব্যস্ত থাকেন। আর যতটুকু সময় পান ততটুকু যেন সুবর্ণর সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ করেন। চুন থেকে পান খসতেই সুবর্ণর দিকে তাক করা হতো বিরোধের তীর। একটি নয় বছরের শিশুকে নিয়ে মা স্বপ্ন দেখতেন, তাকে সেভাবে তৈরি করার জন্য কাজও করছিলেন কিন্তু সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি বরং বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয় এবং একটি বড় সংসারের দায় নিয়ে পিতৃমাতৃর সোহাগ আদর ছাড়া স্বামী-শাশুড়ির মন খুশি করে চলতে হয়। কতটুকু সম্ভব একটি শিশুর পক্ষে? সুবর্ণর বিয়ের দৃশ্যটি কল্পনা করলে মনে হয় সেই দাসপ্রথার মতো। সুবর্ণর বিয়ে পর শ্বশুর বাড়িতে একটি মাত্র মানুষই ছিল যার কাছ থেকে সহানুভূতি পেত সুবর্ণর বড় ননদ।
পাঠক করা যাক কিছু অংশ—“সেই ছোট্ট বেলায় বেগুনী বেনারসী মোড়া সুবর্ণ যখন কাঁদতে কাঁদতে এদের বাড়িতে এসে দুধে-আলতার পাথরে পা দিয়ে দাঁড়িয়ে হঠাৎ ডুকরে উঠে বলেছিল, ‘আমাকে তোমরা ছেড়ে দাও গো, তোমাদের পায়ে পড়ি।’ তখন চারদিক থেকে ছি-ছিক্কারের অগ্নিবাণে সুবর্ণ তো প্রায় ভস্ম হতে বসেছিল, মুক্তকেশী তো এই মারে কি সেই মারে, সেই দুঃসময়ে ওই বড় ননদই রক্ষা করেছিল তাকে। বলেছিল, তোমরা সব কী গো! দুধের বাছা একটা, আর ভেতরের ঘটনাও জেনেছ সবাই, ওর প্রাণটার দিকে তাকাচ্ছ না?’’
মুক্তকেশীর রুদ্রচক্ষুর শাসন-ত্রাসনের বাড়ির সবাই থাকত তটস্থ। কোনো মানুষই মুক্তকেশীর মুখের উপর ন্যায্য কথা বলার ছিল সাহস করত না, সাহস করত কেবল সুবর্ণ। তবে মায়ের গৃহত্যাগের বদনামের বোঝা মাথায় নিয়ে সংসার শুরু করলেও এই কথা চলতে থাকে দীর্ঘদিন।
প্রবোধও মায়ের একান্ত ভক্ত হিসেবে স্ত্রীকে কটু কথা কিংবা বড় তালের মতো খোঁপা ধরে জোরে-সোরে নাড়া দিতেও কুণ্ঠিত হতেন না। পরে অবশ্যই কিশোরী স্ত্রীকে ভুলিয়েভালিয়ে বশে নিয়ে আসতে পারত। সুবর্ণর অকপট কথা, স্বাধীনচেতা মনোভাব ও আচরণের জন্য প্রবোধ শারীরিকভাবেও নির্যাতন করতেন। এত বড় পরিবারে এত সদস্যদের মধ্যে সুবর্ণই ব্যতিক্রম স্বাধীনচেতা এবং প্রাগ্রসর মননের ও মুক্ত চিন্তার অধিকারিনী মায়ের কথায় প্রবোধের নির্যাতনের সীমাও মাঝে মাঝে ছাড়িয়ে যেত। কিন্তু সেটি কত কাল? সুবর্ণকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে ভুল বার্তায়, পরাজয়ের গ্লানিতে, আদর্শের কাছে হেরে যাওয়ার মাঠে কত দিন বশে রাখা যায়। সুবর্ণর বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার মধ্যে মায়ের বপিত বীজ থেকে অঙ্কুর, অঙ্কুর থেকে বিটপ, বিটপ থেকে মহীরূহে পরিণত হতে থাকে, সময়ের ঐক্যতানে ভেতরের সত্তায় বাজতে থাকে মুক্ত বাতাসের সুর, প্রগতির উত্তাপে উদীপ্ত হয়ে দীপ্রতায় নারীর প্রকৃত মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে থাকে।
সুবর্ণর বয়স বাড়তে থাকে এবং সেই সঙ্গে উপন্যাসের কলেবর বাড়তে থাকে। অথবা উপন্যাস এগিয়ে যায়, সেই সঙ্গে চরিত্রগুলোর বয়স বাড়তে থাকে। সুবর্ণর পরিবারের সদস্য সংখ্যা বাড়ে। চার ছেলে ও চার মেয়ের মা হন। কিন্তু সুবর্ণর মন যতটা সংসারে থাকে ঠিক ততটাই থাকে তার লেখাপড়ার দিকে। নিজেও পদ্য লিখেন এবং পদ্যর প্রতি গভীরভাবে অনুরাগী হয়ে ওঠে, লিখেন ডায়েরী। মনের ভেতরে গেঁথে থাকে বই পড়ার স্বপ্ন। একদিন ননদ সুবালার বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে স্বদেশী আন্দোলনের কর্মী অম্বিকার সঙ্গে পরিচয় হয়। অম্বিকা কবিতা লিখে এবং প্রচুর বইপত্রের মালিক ও পড়–য়া। তাঁর সঙ্গে পরিচিত হয়ে বইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ হয়, পদ্যর প্রতি আসক্তি জাগে। ঘটনাটি নাটকীয়ভাবে লেখিকা ঘটিয়েছেন ওখানে প্রবোধকে উপস্থিত করে। সন্দেহপ্রবণ প্রবোধ স্ত্রীকে খুঁজে পায় অম্বিকার বাড়িতে এবং বড় বিশ্রি কাণ্ড ঘটে। সুবর্ণকে সেখানেই নির্যাতন করেন স্বামী প্রবোধ।
সুবর্ণলতা এই ভাসুরের সন্ধান পেয়ে নিজের স্মৃতিকথা মূলক একটি পুস্তিকা ছাপানোর জন্য সেখানে একদিন গিয়ে উপস্থিত। জগু ঠাকুর এই স্মৃতিকথা দেখে পাগলপ্রায় এবং নিজের খরচেই পাঁচশ কপি প্রকাশ করে একদিন সুবর্ণর বাড়িতে পাঠিয়ে দেন।
এমন নানা রকম শারীরিক নির্যাতনের বর্ণনা উপন্যাসে রয়েছে। কিন্তু এরপরও সুবর্ণ হেরে যাওয়ার মেয়ে নন। সত্যবতীর মেয়ে হয়ে কীভাবে হেরে যাবেন?
সুবর্ণ মায়ের মতোই প্রতিবাদী হয়ে ওঠে এবং স্বামীর সংসারে নির্যাতন সইতে না পেরে একবার শাশুড়িই তাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। বলেন, ‘মানুষের রক্ত যদি তোর গায়ে থাকে তো ও বৌকে লাথি মেরে মের ফেল পেবো। আর যদি জন্তু-জানোয়ার হোস তো পরিবারকে মাথায় করে ভেন্ন হয়ে যা। নষ্ট মেয়েমানুষ নিয়ে ঘর করতে মুক্ত-বামনী পারবে না।’
সত্যি সত্যি সুবর্ণকে বাপের বাড়িতে দিয়ে আসা হয়। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস যে বাপের বাড়িতে একবেলা আহারও জুটেনি। বাবা নবকুমার সঙ্গে সঙ্গে তাকে শ্বশুর বাড়িতে ফিরিয়ে দিয়ে যান। এই বাবার বাড়িমুখো সুবর্ণ আর কোনোদিন হননি।
কিন্তু ধীরে ধীরে সুবর্ণ নিজের অবস্থান তৈরি করেন এবং এক সময় দর্জিপাড়া ছেড়ে প্রথমে ভাড়া বাসায়, পরে নিজের বাড়ি নির্মাণ করেন। তাঁর স্বপ্নের দক্ষিণের বারান্দা মোহও পূর্ণ হয়।
কিন্তু সুবর্ণ কি জয়ী বা হয়েছেন? নিজ গৃহে নিজের ছেলেরাই সুবর্ণর কথা শুনেছে? পারুলকে স্কুলে ভর্তি করাতে গিয়ে প্রথমে স্বামীর তিরস্কার এবং পরে ছেলেদের তিরস্কার আর বিদ্রূপের কাছে হার মেনে পারুলের স্কুলে পড়াই হয়নি। নিষ্পৃহ বকুল বেড়ে উঠেছে অনেকটা মা ও নানির ধাতে। পারুলও সাহিত্য ভালোবাসত এবং কবিতা লিখত। বকুল লেখাপড়ার পাশাপাশি সাহিত্যের প্রতি অনুরাগী হয়ে ওঠে।
লেখিকা এখানেই বকুলকে নির্মাণ করেন অত্যন্ত সচেতন ও সতর্কতার সঙ্গে যা পরবর্তী ‘বকুলকথা’ খণ্ডে প্রধান চরিত্রের আখ্যান হয়ে ওঠে। বকুল শেষ পর্যন্ত স্কুলে পড়ার সুযোগ পায় সুবর্ণলতার আগ্রহ ও জেদের কারণে। পারুলের মধ্যে কাব্যপ্রতিভা ছিল এবং মাঝে মাঝে লুকিয়ে পদ্য লিখত। এই খবর কেবল বকুলই রাখত।
বৃহৎ ক্যানভাসের সামান্য অংশ জুড়ে থাকলেও জগু ঠাকুর যিনি প্রবোধের মামাত ভাই একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে আবির্ভূত হন। মেয়েলি স্বভাবে জগু ঠাকুরের একটি প্রেস ছিল। সুবর্ণলতা এই ভাসুরের সন্ধান পেয়ে নিজের স্মৃতিকথা মূলক একটি পুস্তিকা ছাপানোর জন্য সেখানে একদিন গিয়ে উপস্থিত। জগু ঠাকুর এই স্মৃতিকথা দেখে পাগলপ্রায় এবং নিজের খরচেই পাঁচশ কপি প্রকাশ করে একদিন সুবর্ণর বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। জগু ঠাকুরের উৎসাহের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়—‘এই যে তোমাদের মা’র বই হয়ে গেছে। নাও এখন বন্ধুবান্ধবকে বিলোও। সার্থক মা তোদের, লোকের কাছে বলতে কইতে মুখ উজ্জ্বল। ছাপাখানার লোকেরা তো শুনে তাজ্জব।’ বলা বাহুল্য বকুল এর বিন্দু-বিসর্গও বুঝতে পারে না।
এই পুস্তিকাটি বাড়িতে প্রবোধ ও ছেলেদের হাতে পৌঁছলে শুরু হয় হাসাহাসি আর বিদ্রূপের জোয়ার। যেমন ছেলেরা তেমন প্রবোধ। হয়তো বকুলই মায়ের এই কাজের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়েছে। বকুলের প্রেমের আভাসও মিলে এখানে যদিও সেটি পরে টেকেনি।’
শেষ অধ্যায়ের আগের অধ্যায়ে সুবর্ণলতার মৃত্যুর দৃশ্য এমনভাবে বর্ণিত হয়েছে যে পাঠক এখানে এসে জমে যায়। মানুষের জীবনের ধারাবাহিকতা তো এমনই হয়। দুরন্ত শৈশব কৈশোর থেকে বয়স বাড়ে আর ধীরে ধীরে বার্ধক্যের কোলে গড়ায়। এক সময় মৃত্যুর কোলে সব শান্ত হয়। সেই নয় বছরের সুবর্ণকে নিয়ে পাঠক পাঠ শুরু করলেও উপন্যাসের শেষে এসে বৃদ্ধা মৃত্যুশয্যায় এক নারীর প্রতি মানুষের ভালোবাসা আর শ্রদ্ধার্ঘ দেখে পাঠক স্তম্ভিত হয়। কিন্তু এখানেও নারীর পরাধীনতার নমুনা দেখতে পাওয়া যায়। বড় মেয়ে চাঁপা মৃত্যুযাত্রী মাকে দেখতে আসতে পারেনি পারিবারিক ঝামেলার কারণে। ছেলেরা দূর দূরান্ত থেকে এসেছে বটে কিন্তু মায়ের শেষকৃত্যের খরচের ব্যাপারেও উদারতা কিংবা মাতৃভক্তির নমুনা দেখা যায় না। তবে শেষ পর্যন্ত তারাও মায়ের প্রতি যতটুকু ভক্তি দেখানোর দেখিয়েছে।
এই কথা যদিও নাটক নভেলকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর জন্য বরং সমাজের দুর্মূর্খ মানুষের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রকাশ করার জন্য লেখিকা সচেতনভাবেই বিভিন্ন সংলাপে প্রকাশ করেছেন।
শেষ অধ্যায়ে মুহ্যমান বকুল মায়ের কোনো লেখা পাওয়া যায় কি না হন্যে হয়ে খোঁজে। শেষ পর্যন্ত জগু ঠাকুরের প্রেসেও হানা দেয়। কিন্তু ততদিনে জগু ঠাকুরের প্রেস লাটে উঠে। সেখানেও মায়ের লেখার কোনো চিহ্নও পায়নি। ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ফিরে আসে বাসায়। এখানেই শেষ হয় সুবর্ণলতা।
লেখক বলছেন, ‘হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে বুঝি সেই দাঁত-খিঁচানো ঘরটার উদ্দেশ্যে মনে মনে একটা প্রণাম জানিয়ে মনে মনেই বলে, মা, মাগো! তোমার পুড়ে যাওয়া, হারিয়ে যাওয়া লেখা, না-লেখা সব আমি খুঁজে বার করবো, সব কথা আমি নতুন করে লিখবো। দিনের আলোর পৃথিবীকে জানিয়ে যাবো অন্ধকারের বোবা যন্ত্রণার ইতিহাস।
বকুলকথা
ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও কঠিন চার দেওয়ালে বন্দি থেকে সুবর্ণলতা পারেননি তাঁর চার কন্যাকে নিজের মতো তৈরি করতে। লেখাপড়ার প্রতি অদম্য ইচ্ছে ও প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও বাবা ও ভাইদের অবহেলা ও মেয়েদের লেখাপড়াকে তুচ্ছজ্ঞানমূলক নিগ্রহের কারণে পারুলও এক সময় হাল ছেড়ে দিয়ে জেদ করে লেখাপড়ার প্রতি বীততৃষ্ণা প্রকাশ করে। কিন্তু তার মধ্যে কাব্য-প্রতিভা ছিল। অগোচরে কবিতা লিখত। ‘এখানে বাতাস’ নামের ছন্দোবদ্ধ কবিতাটিই তার জাজ¦ল্যমান প্রমাণ। চারপুত্র আর চার কন্যার মধ্যে ব্যতিক্রম কেবল বকুল। বকুল নিজের মতো করে নিজেকে তৈরি করে সাহিত্যচর্চা এবং পূর্ণ লেখালেখিতে মনোযোগ দেন অনামিকা দেবী নামে। সংসার জীবনের মায়াতেও তিনি বন্দি হননি। চার দেওয়াল তাঁকে আটকিয়ে রাখতে পারেনি। তিনিই হয়ে উঠেন দেশের যশস্বী লেখিকা, পরিণত হন দেশের একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হিসেবে। এই চরিত্রের মধ্যে কি আমরা আশাপূর্ণার দেবীর ছায়া দেখতে পাই—কে জানে। লেখকের লেখায় ব্যক্তিগত জীবনের ছাপ পড়ে, এখানে লেখিকার জীবনের ছাপ পড়াটা অস্বাভাবিক নয়। একটি প্রবন্ধে এমন আভাসও মিলে।
ট্রিলজির প্রতিটি খণ্ডে পারিবারিক গল্পই নির্মিত হয়েছে। ব্যতিক্রম কেবল বকুলের একাকী যশস্বী লেখক জীবনের কথা প্রস্থিত হয়েছে বিভিন্ন আঙ্গিকে। একজন যশস্বী লেখক যে সমাজের অনেক দায় বহন করেন এবং সমাজের মানুষ তার কাছ থেকে অনেক কিছু আশা করে তার স্বরূপ বোঝা যায় তৃতীয় খণ্ডে তথা বকুলকথায়। তবে সমাজের দায়ের পাশাপাশি লেখকের লেখা নিয়ে বাণিজ্যিক বিষয়ও উঠে এসেছে।
পারুলের সংসার হলেও অন্য দশজন বাঙালি গিন্নির মতো তিনি নিজেকে মানাতে পারেননি যেমনটি মানিয়েছেন চাঁপা ও চন্দন। তারা ঘরকন্না ও স্বামী-সংসার নিয়ে নির্ঝঞ্ঝাট বাঙালি গৃহিণী হয়ে দিনাতিপাত করেন। একাকী নিঃসঙ্গ জীবনযাপনের গল্প নির্মিত হয়েছে পারুলকে নিয়ে। তিনি গঙ্গাধারে একটি বাড়িতে থাকেন, সাহিত্যচর্চা তথা কবিতা লিখে সময় কাটান। সন্তান থাকে দূরের কর্মক্ষেত্রে। স্বপ্নময়ী পারুল বকুলের মতো দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ মানুষ না হলেও খুব হতাশার কথা রচিত হয়নি তাঁর জীবনকে কেন্দ্র করে। তবে তিনি যে সময়কে ধরে এগিয়ে গেছেন তা তার কবিতায় কিছুটা হয়তো ধরা পড়েছে। না-হয় বকুল হয়তো বর্তমান সময়ের অনেকের মতো বলতে পারত না তোমার কবিতা বুঝি না। একথা সত্য যে, আধুনিক কবিতার ছাঁচ তৈরি হওয়ার পর থেকে কবিতার ঘাড়ে বদনামের বোঝাটি উঠে গেছে। কবিতা দুর্বোধ্য একথা তখন থেকেই উচ্চারিত হয়ে আসছে যা এই যুগের মানুষের মুখেও শোনা যায়। নাটক নভেল মেয়েদের সৃষ্টিছাড়া করে এই বদনাম ট্রিলজির তিনটি খণ্ডেই পরোক্ষভাবে বলা হয়েছে। এই কথা যদিও নাটক নভেলকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর জন্য বরং সমাজের দুর্মূর্খ মানুষের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রকাশ করার জন্য লেখিকা সচেতনভাবেই বিভিন্ন সংলাপে প্রকাশ করেছেন।
স্ত্রীকে নির্যাতন ও মেয়েদের শিক্ষার বিরোধিতা করলেও স্ত্রী বিয়োগের পর বকুল যাকে কি না সৃষ্টিছাড়া মেয়ে হিসেবেই বলা হয়ে থাকে তাকে কিঞ্চিৎ খাতির করে নিজের বাড়িতে একটু ঠাঁই করে দিয়েছেন বাবা প্রবোধচন্দ্র। তরুণী বকুলের জন্য তাঁর বাবা ও দাদারা অনেকটা দায়সারা ছিলেন এবং এ কারণেই তার বিয়ে হয়নি। বকুল যে চিরকুমারী থাকবেন তা নয়। নির্মলের সঙ্গে দীর্ঘদিনের প্রেমও করেছেন। কিন্তু মেয়ের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেওয়ার পরও মেনিমুখো নির্মল তার জেঠিমায়ের তীব্র শাসনের মুখে বকুলকে বিয়ে করার সাহস দেখাতে পারেনি। নির্মলের মা বকুলকে পছন্দ করতেন, বিশেষ করে তার পদ্য লেখার জন্য। বিয়ের কার্ডও বকুলের পদ্য দিয়ে মুদ্রিত হয় এবং বকুল বুকে পাষাণ বেঁধে অন্য দশটি মেয়ের মতো বিয়ের কাজকর্ম করেছে নির্মলের মা ও জেঠিমার কথায়।
শম্পার চরিত্র সৃষ্টিতে তার পরিবারের সঙ্গে কোনো মিথস্ক্রিয়া উপন্যাসে বিস্তৃত হয়নি। কেন হয়নি তা রহস্যজনক।
এখানে এসে লেখক বর্ণনা করছেন, ‘‘অনামিকার আমলে প্রবোধচন্দ্রের মতো রক্ষণশীল ব্রাহ্মণের ঘরে বিয়ে না হয়ে পড়ে থাকা মেয়ের দৃষ্ঠান্ত প্রায় অবিশ্বাস্য, তবু এহেন বিশ্বাস্য ঘটনাটি ঘটেও ছিল। ঘটেছিল নেহাৎই ঘটনাচক্রে। না, কোনো উল্লেখযোগ্য কারণে নয়, স্রেফ ঘটনাচক্রেই।
নামের আগে চন্দ্রবিন্দু হয়ে যাওয়া সেই প্রবোধচন্দ্রের রাশ খুব ভারী না হলেও গোঁয়ার্তুমি ছিল প্রবল, তিন-তিনটে মেয়ের যথাবয়সে যথারীতি বিয়ে দৌড়ে এসে ছোট মেয়ের বেলায় তিনি যে হের গেলেন, সেটা মেয়ের জেদে অথবা তার ‘চিরকুমারী’ থাকবার বায়নায় নয়, নিতান্তই নিজের আলস্যবশত।”
তবে বাবা প্রবোধচন্দ্র হয়তো বকুলের প্রতি দয়াকাতর হয়ে অথবা অপরাধবোধ থেকে বকুলকে নিজের বাড়ির একটি ঘর ও ছাদ উইল করে দিয়ে যায়। এটিই হালে স্বস্তির কথা—‘মৃত্যুকালে প্রবোধচন্দ্র তাঁর পুরনো বাড়ির নবনির্মিত তিনতলার ঘর বারান্দা ছাদ ইত্যাদি কেনই যে তাঁর বিরক্তিভাজন হাড়জ্বালানী ছোট মেয়ের নামে উইল কওে দিয়ে গিয়েছিলেন, সেই এক রহস্য। তবে দিয়েছিলেন তাঁর পুত্রদেও চমকিত বিচলিত ও গোত্রান্তরিতা কন্যাদের ঈর্ষিত করে।’
স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ের আধুনিক কলকাতার যাপিত জীবনের চালচিত্র নিখুঁতভাবে ফুটে উঠেছে বকুলকথায়। মেয়েরা চারদেয়ালের বন্দি জীবন থেকে বেরিয়ে এসে মুক্ত বাতাসে নিশ্বাস নিতে পারছে, কোথাও যাওয়ার বাধা নেই, মত প্রকাশের পরাধীনতা নেই, মেয়েদের শিক্ষার ক্ষেত্রে যে প্রাচীর ছিল তারও কোনো অস্থিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। পরিবর্তনশীল শহর জীবনের অফুরন্ত বৈচিত্র্য ও প্রাণপ্রাচুর্য এ খণ্ডে উৎকীর্ণ হয়েছে।
নতুন চরিত্র হিসেবে যোগ হয়েছে বকুলের ছোড়দার (মানু) মেয়ে কলেজ পড়ুয়া অতিশয় স্মার্ট শম্পা। শম্পা বকুলের নেওটা বলা চলে এবং পিসি যেন তার একমাত্র প্রিয় ও বিশ্বস্ত বন্ধু যাকে সব কথা অকপটে বলা যায়। পিসিও শম্পার সব কথা শুনেন কিন্তু কোনো শাসনত্রাসনের কথা বলেন না। পরিণামে কলেজ পড়–য়া মেয়েটি ‘ছেলেশিকারী’ রূপে অনেকের মাথায় গোলমাল করে দিয়ে ঘোল খাওয়ায় কিন্তু কাউকেই প্রেমিক হিসেবে গ্রহণ করেনি। মেয়েটি এমন ছেলেশিকারী হলেও তার মধ্যে কোথায় যেন নিষ্পাপ সততা রয়েছে বলে বকুল উপলব্ধি করেন। এজন্য তাকে ছেলেদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার খেলা না করার জন্য শাসন করতে গিয়েও থেমে যান। তার প্রতি জন্মায় বকুলের অগাধ বিশ্বাস।
শেষ পর্যন্ত কলেজপড়ুয়া অত্যন্ত স্মার্ট আধুনিকা শম্পা এমন এক ছেলেকে পছন্দ করে যে কারখানার শ্রমিক, দেখতে ‘কাফ্রি ক্রীতদাসের’ মতো কিম্ভূতকিমকার। তার নাম সত্যবান হলেও শারীরিক কাঠামো ও গায়ের রঙের কারণে শম্পা জাম্বুবান বলে ডাকে। নিজেও অকপটে সত্যবানের বর্ণনা দিয়ে মজা করে। সত্যবান শম্পাকে উঁচু শ্রেণির মানুষ হিসেবে সমূহ সমীহ করে এবং প্রথম দিকে ম্যাডাম বলেও সম্বোধন করে। সে কারখানার শ্রমিক, প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়াও নেই, নিজেকে শম্পার যোগ্য মনে না করে বারবার শম্পাকে প্রত্যাখ্যান করতে চেয়েছে কিন্তু শম্পা তাকে সাঁড়াশি দিয়ে ধরেছে যেন শম্পার বাহুমূল থেকে মুক্ত হওয়ার কোনো উপায় থাকে না। একদিন শম্পা সত্যবানকে নিয়ে উধাও হয়ে গিয়ে বড় পিসি পারুলের বাসায় আশ্রয় নেয়। তখন সত্যবান ছিল খুব অসুস্থ। স্মার্ট শম্পার কথাবার্তার ধরনও চমৎকার যার কথায় বড় পিসিও রাগ করতে পারেন না। সত্যবানকে চিকিৎসা করে ভালো করলে একদিন সে কারখানায় যাওয়ার পর শ্রমিকদের আন্দোলনের সময় পায়ে বোমার আঘাত লাগে। অসুস্থ সত্যবানকে নিয়ে শম্পা আবার উধাও হয়ে বস্তিতে এবং সেখানেই তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয় আরেক বস্তিবাসীর সহায়তায়। বোমার আঘাতে তার পায়ের অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে পরিণামে হাঁটু পর্যন্ত দুই পা কেটে ফেলতে হয়েছে। পরিবারের কারোর দিকে না তাকিয়ে, কারও সিদ্ধান্ত না নিয়ে নিজের সিদ্ধান্তেই তাকেই বিয়ে করে বস্তিতে থাকতে শুরু করে। এমন সৃষ্টিছাড়া সিদ্ধান্তের জন্য শম্পার পরিবার দুশ্চিন্তায় ও মনোকষ্টে বিধ্বস্ত হয় এবং সমাজে মুখ দেখানোর উপায় থাকে না। শম্পা পরিবারের কাউকে গ্রাহ্য করেনি তার কোনো কাজের জন্য। শম্পার চরিত্র সৃষ্টিতে তার পরিবারের সঙ্গে কোনো মিথস্ক্রিয়া উপন্যাসে বিস্তৃত হয়নি। কেন হয়নি তা রহস্যজনক।
এই চরিত্রটির এমন দুঃসাহসিক প্রেম এবং ঘরছাড়া হয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে সমাজের বিয়ের প্রথা ভেঙে চুরমার করে দেওয়ার অভিলিপ্সা লেখিকার ছিল কি না বোঝা মুশকিল। স্বভাবতই এটি একটি বিরল ম্যাচিং ঘটনা, এই ঘটনায় আবেগীয় গভীর প্রেমের কোনো আস্ফালনও উন্মোচিত হয়নি এবং কোনো কারণে শম্পা কারো প্রতি প্রতিশোধ স্পৃহা নিয়েও এই ঘটনা ঘটায়নি। খুব স্বভাবসুলভভাবে ঘটনাটি ঘটিয়েছে। এই প্রেম ছিল একান্তই শম্পার একতরফা। সে তার খামখেয়ালিপনার মধ্য দিয়ে জীবনের এই কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ঘরছাড়া হয় এবং বস্তিতে থেকে সত্যবানের জীবনের ভার ঘাড়ে নিয়ে জীবন-সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। উপন্যাস পাঠে পাঠকের মনে আসতে পারে হয়তো বিয়ে প্রথার বিরুদ্ধেও লেখিকা শম্পাকে তৈরি করেছেন যা একটি বাক্যেও এমন ধারণার মৃদু তাপ পাওয়া যায়—‘হয়তো বহু পুরনো, বহু ব্যবহৃত ওই বিয়ে প্রথাটাই থাকবে না পৃথিবীতে।’
তিনি নারীর স্বাধীনতা চেয়েছেন কিন্তু স্বেচ্ছাচারিতা চাননি। তাঁর চিন্তা ও সমাজ বাস্তবতার দুটি ধারা পরস্পর মুখোমুখি হয়ে মনের ভেতরে নতুন সংকটের তৈরি করে। এমনকি আধুনিক আঁটসাঁটো পোশাকও যে তাঁর পছন্দ নয় এজন্য তাঁর আক্ষেপের দীর্ঘশ্বাস শোনা যায়।
প্রথম প্রতিশ্রুতিতে নবকুমারের মাস্টার ভবতোষ, বন্ধু নিতাই; সুবর্ণলতায় জগু ঠাকুর এবং বকুল কথায় বকুলের প্রেমিক নির্মলের স্ত্রী মাধুরী বৌ, সনৎকাকা ও নমিতা ছোট চরিত্র হলেও মনে দাগ কাটার মতো। সনৎকাকা একজন প্রগতিশীল উদার ব্যক্তি এবং শিল্প-সাহিত্যের বড় সমঝদার। নমিতা গৃহবধূর চরিত্রটি আকস্মিক সৃষ্টি হয়েছে যে চরিত্রের মাধ্যমে নারী নির্যাতনের প্রতিবাদ করতে গিয়ে স্বামীকে ত্যাগ করে শহরে চলে আসে এবং পর্যায়ক্রমে অভিনয়ের দিকে ঝুঁকে। তবে শেষ পর্যন্ত তার চরিত্র স্খলনের ইঙ্গিতও পাওয়া যায়। ভবতোষ, নিতাই, জগু ঠাকুর ও সনৎকাকা আদর্শিক চরিত্রের প্রতিভূ যারা মানুষকে কেবল উদার মনে বিলিয়ে দিতে পারেন এবং প্রগতিশীল মানসিকতার মানুষগুলো সমাজের কল্যাণের জন্য ব্রতী।
প্রথম প্রতিশ্রুতি ও সুবর্ণলতার শেষ পৃষ্ঠায় পাঠকের দীর্ঘশ্বাস যেমন ঘনায়িত হয় ঠিক তেমন ঘনায়িত দীর্ঘশ্বাস সৃষ্টি হয় না বকুলকথায়। বরং এই খণ্ডে পাঠকের হৃদয়ে আক্ষেপের ঝংকার উঠতে পারে অথবা একটি সংগ্রামী মেয়ের জন্য বুকে সাহস সঞ্চারিত হতে পারে—‘শম্পা খেটে খেটে রোগা হয়ে যাওয়া মুখে মহোৎসাহের আলো মেখে বলে, ‘আমার নতুন সংসার দেখতে গেলে না পিসি? যা গুছিয়েছি দেখে মোহিত হয়ে যাবে। দক্ষিণের বারান্দায় বেতের মোড়া পেতে ছেড়েছি। আর তোমার জাম্বুবানকে তো প্রায় মানুষ করে তুলছি। চাকাগাড়ি চড়িয়েই একবার সেজপিসির কাছে নিয় যাবো ঠিক করেছি।’
আশাপূর্ণা দেবীর এই ট্রিলজটি একটি সেরা কাজ হিসেবেই এখন পর্যন্ত সাহিত্যবোদ্ধাদের কাছে আলোচিত ও পরিচিত। উপন্যাস নির্মাণেও রয়েছে সূক্ষ্ম স্বাতন্ত্র্য। তিনি উপন্যাসটির কাহিনি বর্ণনা করেছেন অনেকটা গল্প বলার ঢঙে অর্থাৎ বড়রা যেমন ছোটদের গল্প বলে শোনান ঠিক তেমনি কোথাও কোথাও মনে হয়। প্রায় শত বছরের ক্যানভাসে নির্মিত উপন্যাসে অসংখ্য চরিত্রের মধ্য থেকে তিনি কেবল গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রগুলোই চিত্রিত করে ঘটনাবন্দি করেছেন। অনেক উপন্যাসে যেমন—মানিক বন্দোপাধ্যায়ের কিংবা বিভূতিভূষণের উপন্যাসে পরিবেশের ডিটেইল বর্ণনা পাওয়া যায় এখানে তেমনটি পাওয়া যায় না। চরিত্রচিত্রণেও তিনি খুব সতর্ক ছিলেন। যেমন- সত্যবতীর শুধু একটি সন্তানের জন্মের কথা জানা যায়, সুবর্ণলতার কখন কোন সন্তান হয়েছে কোনোভাবেই জানা যায়নি। এমনকি এত বড় সংসারের কখন ছেলে বা মেয়ের বিয়ে হয়েছে তারও কোথাও উল্লেখ নেই। তিনি সচেতনভাবেই এগুলো এড়িয়ে গিয়ে তিনটি চরিত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ও নাটকীয় ঘটনা রঞ্জিত করেছেন। তবে মেনে নিতে হবে যে, সন্তানদের উপস্থিতি মাঝে মাঝে পাওয়া গেছে এবং স্বীকার করতে হবে যে, সবার চরিত্র নিয়ে যদি তিনি নাড়াচাড়া করতেন তাহলে হয়তো এটি এতো দীর্ঘ হতো যে পাঠকের পড়ার উপযুক্ত থাকত না ও ধৈর্যও থাকত। এদিক থেকে উপন্যাস নির্মাণের কৌশলের জন্য লেখিকা প্রশংসার্হ।
আগেইে বলেছি, প্রায় শতবর্ষের ক্যানভাসে নির্মিত উপন্যাসে তিনি কালের প্রবাহ উন্মোচন করেছেন জীন থেকে জীবনরহস্য বা জিনোম সিকোয়েন্স উন্মোচনের মতো। তদানীন্তন সমাজে নারীর দুর্দশা ও যৌথ পরিবারের যে রসায়ন ও মিথস্ক্রিয়া হয় সেগুলোর নিখুঁত বর্ণনা পাঠককে মুগ্ধ করে। শরৎসাহিত্যে একই সময়ের নারী সমাজের দুঃখ দুর্দশার চরিত্র পেলেও আমরা সত্যবতী, সুবর্ণলতা এবং বকুলের মতো প্রতিবাদী, অগ্রসর চিন্তক ও আশাবাদী স্বপ্নদ্রষ্টা নারীর চরিত্র খুব একটা দেখি না। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নারীদের ঘর থেকে বের না হওয়া এবং লেখাপড়া করা নিন্দনীয় বিষয়গুলোর ভেঙ্গেচুরে একাকার করা হয়েছে এই ট্রিলজিতে। অন্যদিকে যৌথ পরিবারের প্রথাও ভেঙে চুরমার করে ছোট্ট পরিবারের (সিঙ্গেল ফ্যামিলি) গড়ার বিবর্তন সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে।
একটি সত্য এখানে বিমূর্তভাবে লক্ষ্যণীয় যে, নারীরা চারদেওয়ালে বন্দি থেকে নির্যাতিত ও অনগ্রসর খেটে খাওয়া মানুষের জীবনের গল্প উপন্যাসে প্রতিষ্ঠিত হলেও তিনটি উপন্যাসেই আদতে নারীর চৈতন্য, ক্ষমতা, স্বেচ্ছাচারিতা ও দাপুটে একক সিদ্ধান্তগ্রহীনকারী হিসেবে দেখতে পাই। রামকালীর পরিবারে তিনি প্রবল প্রতাপশালী ও দাপুটে পুরুষ হলেও সত্যবতীর স্বামীর পরিবারে এলোকেশীই একক সিদ্ধান্তের অধিকারিনী ছিলেন। সত্যবতীর স্বামী ও সন্তান সবাই ছিল তার কাছে থাকত তটস্থ। শেষ পর্যন্ত সত্যবতীই এলোকেশীর রাহুগ্রাস থেকে মুক্ত হয়ে নিজের মতো করে সংসার নির্মাণের দিকে মন দেন। যদিও নবকুমার পৌরুষ্য দেখানোর জন্য সত্যবতীর কোনো কোনো সিদ্ধান্ত মানতেন না কিন্তু পারিবারিক অনেক সিদ্ধান্তই মেনে চলতেন এবং তবে সূক্ষ্ম বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করলে বলা যায় সত্যবতীর নির্দেশনাতেই সংসার পরিচালিত হতো। সুবর্ণলতার বিয়েটাও হয়েছিল এলোকেশীর সিদ্ধান্তে যা একজন দোর্দণ্ড প্রতাপের নারীর ভূমিকা প্রমাণ করে। অনুরূপভাবে মুক্তকেশী অর্থাৎ সুবর্ণলতা শাশুড়িও এলোকেশীর মতোই পরিবারের নিয়ন্ত্রক ছিলেন এবং ছেলেরা বা ছেলের বৌরা তাঁর কথার অবাধ্য হওয়ার সাহস দেখাত না। মাঝে মাঝে স্পষ্টভাষী ও একগুঁয়ে প্রকৃতির সুবর্ণলতা শাশুড়ির কথা মানতে পারত না বলে তাকে একদিন বাড়ি থেকে বাপের বাড়িতেও রেখে এসেছিল মুক্তকেশীর কথায়। কিন্তু বাপের বাড়িতে এক বেলা আহারও জুটেনি সুবর্ণলতার, ফিরে আসতে হলো স্বামীর বাড়িতে। এই ঘটনা কেবল সুবর্ণর জন্য নিন্দা ও জঘন্য অপমানের ছিল না, তার বাবা নবকুমারের জন্যও ছিল। সুবর্ণলতার দুঃখ হলো সে কোনো দিন বাপ বা ভাইয়ের কাছে কোনো কিছুর জন্যই আশ্রয় পায়নি। শেষ পর্যন্ত সুবর্ণলতা স্বামী প্রবোধকুমারকে নিয়ে পৃথক হয়ে প্রথমে ভাড়া বাসায় এবং পড়ে নিজের বাড়ি নির্মাণ করেন। এখানেও সুবর্ণলতার সিদ্ধান্তই ছিল গুরুত্বপূর্ণ। বকুলকথায় কয়েকটি মূল চরিত্রের মধ্যে বকুল, পারুল, শম্পা এরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ সিদ্ধান্তে জীবন যাপন করতেন। আরেকটি প্রতাপশালী নারী চরিত্র হলো নির্মলের জেঠিমা। ওই যৌথ পরিবারের সকল সিদ্ধান্ত নিতেন তিনি এবং চুন থেকে পান খসার উপায় ছিল না। এ-কারণেই নির্মল বকুলকে গভীরভাবে ভালোবেসেও জেঠিমার কথার অবাধ্য হতে না পেরে বুকলকে বিয়ে করতে পারেনি। বকুলকথা উপন্যাসে সময়ের হালে পালের বাতাসে বকুল নিজেও হতাশ হন। তিনি নারীর স্বাধীনতা চেয়েছেন কিন্তু স্বেচ্ছাচারিতা চাননি। তাঁর চিন্তা ও সমাজ বাস্তবতার দুটি ধারা পরস্পর মুখোমুখি হয়ে মনের ভেতরে নতুন সংকটের তৈরি করে। এমনকি আধুনিক আঁটসাঁটো পোশাকও যে তাঁর পছন্দ নয় এজন্য তাঁর আক্ষেপের দীর্ঘশ্বাস শোনা যায়।
আশাপূর্ণা দেবীর সত্যবতী ট্রিলজির এই শেষ খণ্ডে এই প্রশ্ন বড় হয়ে উঠেছে—স্বাধীনতা ও স্বেচ্ছাচার: এই দুইটির সীমারেখা কোথায়? সে সীমারেখার অন্বেষাই বকুলকথা উপন্যাসের মূল উপজীব্য।
গত শতাব্দী ছিল মূলত পৃথিবীর পরিবর্তনের বিপ্লবের শতাব্দী। রুশ বিপ্লব, জার্মান বিপ্লব, হাঙ্গেরিয়ান বিপ্লব, আগস্ট বিপ্লব (ভিয়েতনাম), প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ, ভারতের স্বাধীনতা, চীন বিপ্লব, কিউবান বিপ্লব ইত্যাদি বিপ্লবগুলো পৃথিবীর সব দেশের মানুষেরই চোখ-কান খুলতে থাকে। তারা নিজেদের অধিকার সচেতন হয় এবং অর্থনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেদের তৈরি না করলে পরিবর্তিত পৃথিবীতে টিকে থাকার প্রশ্নে মানুষের বন্দিদশা থেকে মুক্ত হতে শুরু করে। বন্দিত্ব থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য নারী সমাজও তাদের দেওয়াল ভাঙতে থাকে এবং স্বাধীনভাবে পুরুষের মতো সমান অধিকার নিয়ে বাঁচার আন্দোলনে যোগ দেয়। ফলশ্রুতিতে, তাদের শিক্ষার অধিকার সম্প্রসারিত হয়। বকুলকথা উপন্যাসে সে সময়কে পৃষ্ঠাবন্দি করা হয়েছে সেটি উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়। সুবর্ণলতায় স্বদেশি আন্দোলনের আভাস থাকলেও ভারতের স্বাধীনতা বা সেই সময়ের কোনো আভাস এই ট্রিলজিতে উৎকীর্ণ হয়নি। তবে আখ্যান বিশ্লেষণ করলে স্পষ্টতই বোঝা যায় এটি স্বাধীন ভারতের পটভূমিতে রচিত।
আশাপূর্ণা দেবীর ট্রিলজির একটি সংক্ষিপ্ত উপস্থাপন করলেও অনেক কথা না-বলা থেকে গেছে। শেষে এসে মনে হলো বিদগ্ধ এই লেখিকার কথা দিয়েই হয়তো না-বলা কথার কিছুটা তৃষ্ণা নিবারণ হতে পারে। এ-কারণেই আলোচনা শেষ করার পূর্বে বকুলকথা খণ্ডের ফ্ল্যাপের লেখাটি পাঠক সমীপে পেশ করছি—‘যখন আমাদের সমাজে অন্তঃপুর ছিল অবহেলিত, যখন সেখানকার প্রাণীরা পুরোপুরি আস্ত মানুরে সম্মান কখনো পেত না, তখন সামান্য কটি মেয়ে এগিয়ে এসে প্রতিবাদ করে, সমাজের শৃঙ্খল ভেঙে মুক্ত পৃথিবীর আলো এনে দেবার সুযোগ করে দেয় অন্তঃপুরে। সত্যবতী ছিল সেই সামান্য কজন মেয়ের অন্যতম। সত্যবতীর মেয়ে সবর্ণলতা সত্যবতীর মতো তেন না পেলেও নীরবে সেই নারীমুক্তিরই আকাঙ্ক্ষাকে লালিত করে গেছে। সেই আকাঙ্ক্ষার লালিত ফলবতী হয়েছে সুবর্ণলতার মেয়ে বকুলের জীবনে, যে যশস্বী লেখিকা হয়েছে অনামিকা দেবী নামে। কিন্তু বকুল তথা অনামিকা কি তার সমাজের নূতন রূপে মা ও দিদিমার সাধানয় সাফল্য দেখতে পাচ্ছে? না দেখছে শেকল-ছেঁড়ার এক ভয়াবহ উন্মাদনায় নারী-প্রগতির নামে চলছে স্বেচ্ছাচার। এই জিজ্ঞাসাই বকুল না অনামিকা দেবীকে বারে বারে উন্মনা করে তুলছে। আশাপূর্ণা দেবীর সত্যবতী ট্রিলজির এই শেষ খণ্ডে এই প্রশ্ন বড় হয়ে উঠেছে—স্বাধীনতা ও স্বেচ্ছাচার: এই দুইটির সীমারেখা কোথায়? সে সীমারেখার অন্বেষাই বকুলকথা উপন্যাসের মূল উপজীব্য।’