একজন কবির বিশ্বভ্রমণ অতিরিক্ত পাওনা, যা তার কবিতার পরিসরকে ক্রম-প্রসারিত করে। আর সেই কবি যদি সীমাতিরিক্তভাবে সংবেদনশীল হন, তাহলে অন্য বিশ্বের উপাদান তার কবিতাকে বহুস্তরিক এবং বহুরৈখিক করে তুলবেই। নিজভূমে অবস্থান করে বিশ্বায়ন ভাবনায় জারিত হওয়া আর প্রবাসে বা বিদেশভূমে দাঁড়িয়ে সেখানকার পরিসরে ও রসায়নে বিশ্বায়ন উদ্ভূত অবস্থাকে প্রত্যক্ষ করার মাত্রাগত প্রভেদ নিশ্চয়ই থাকবে। একজন সংবেদনশীল কবির সীমা ছাড়ানোর কর্মকাণ্ড চলতেই থাকে। নিজ সীমার ভেতরে অবস্থান করেও তিনি মানসিক পর্যটন চালিয়ে যান। একজন সংবেদনশীল কবির এ-থেকে অব্যাহতি নেই। পৃথিবীর যাবতীয় ফিজিক্যাল, নন-ফিজিক্যাল উপাদানের সঙ্গে তিনি যাপন করতে ভালোবাসেন। ভালোবাসেন একারণে যে সেইসব উপাদান তার নিত্যসঙ্গী হতে চেয়ে কবিতার উপকরণ প্রকরণে অবিচ্ছিন্ন ভূমিকা পালন করে। পালন করে আপাতভাবে দুভাবে—কবিতার চিত্রকল্প, প্রতীকায়ন, চিত্রায়ণ, বিমূর্তিকরণ, নির্মাণ আর দ্বিতীয়ত কবির মনোজগতের কল্পচিত্র সম্প্রসারণে। পরেরটির সঙ্গে আসঙ্গ হতে পারে কবির মহাজাগতিক চিন্তাসূত্রগুলো। অর্থাৎ প্রাকৃতিক ভৌগোলিক উপাদান, দেশ ও বিদেশের, কবির চিন্তাসূত্রগুলোকে রঙ মাখায়, মোডাস অপারেন্ডির পরিবর্তন বা রূপান্তর ঘটায় এবং কবির অনুভূতির সীমা ক্রমশ প্রসারিত হতে থাকে ভাষার ব্যঞ্জনায়।
কবির বিশ্বভ্রমণ কবিকে নতুন প্রতীকের উপমার ভাষা অর্পণ করে। অপর প্রকৃতি অপর মানবীয় আচরণ অপর পরিভাষা অপর আদান-প্রদান কবির মানবিক স্বভূমি আরো কর্ষণযোগ্য করে তোলে। এরপর কবি যে ফসল তোলেন, তার উপমা হয়তো সেই ফসলেই অবস্থিত। কবির কাজ খেলে যাওয়া, খেলার ভেতরে অন্য খেলার সংস্থাপন করে যাওয়া, কবির প্রাথমিক জীবন যখন কবিতায় দ্বিতীয় তৃতীয় চতুর্থ পঞ্চম এবম্বিধ যাপনে পরিণত হয়, বুঝতে হবে কবি খেলাটিকে জমিয়ে তুলতে চেয়েছেন। বিষয়কে জমিয়ে তোলাই কবির কাজ, বিষয়কে নতুন ভাষা দেওয়াই কবির অহং । বাংলাদেশের নয়ের দশকের কবি আমিনুল ইসলাম আনন্দ বেদনা প্রকৃতি ভালোবাসা যন্ত্রণা অত্যাচার সন্ত্রাস নাব্যতা ভৌমতা মৌলিকতা অমৌলিকতা ইত্যাদি যাবতীয় উপকরণকে কাব্যিক ভাষায় রূপান্তর করে চলেছেন নিজের মতো করে।
একজন সৃজনশীল কবির নাম আমিনুল ইসলাম। তার সৃজন সক্রিয়তা কোনো সীমা জানে না, প্রাকৃতিক দুর্যোগের চোখ রাঙানি মানে না, সামাজিক সন্ত্রাসের কৌণিক দৃষ্টি গ্রাহ্য করে না, আদৌ তিনি উদ্বিগ্ন নন কে তার কবিতার অবমূল্যায়ন ঘটালো কিনা। তার কাজ আবহমান কবিতা লিখে যাওয়া। তার কাজ সর্বদা সৃজনশীল হয়ে থাকা টানটান। পার্থিব দেনা-পাওনাগুলোর কবওয়েবের ভেতরে তিনি কখনো নিজেকে জড়িয়ে ফেলতে দেন না। তিনি তো অকপট উচ্চারণ করেছেন: ‘ভেঙে ফেলো সীমাবদ্ধতার সূত্র’। এই নামাঙ্কিত কবিতায় তিনি লিখলেন
তুমি তো জানোই যে আমি
এমনকি প্রবাদের লাড্ডুর জন্য
বিকিয়ে দিতে পারি আমার দিন
আমার রাত
শুধু পারি না সীমাবদ্ধতার পায়ে নোয়াতে’
(শেষ হেমন্তের জোছনা, কবিতাসমগ্র, পৃ: ৩০৪)’
এ রকম প্রত্যয়িত বাক তিনি বহতা রেখেছেন সমগ্র কাব্যে। তার খোঁজ নিরন্তর । প্রফেশনাল বেড়ি তার মনকে বরং জেদি করে তোলে শেকল ভাঙার গান তীব্র কণ্ঠে গেয়ে উঠতে। তিনি নেমে আসেন সরকারি পদের উচ্চতম চূড়া থেকে মাটিতে। নেমে সরাসরি চলে যান মহানন্দার কাছে, করোতোয়ার কাছে, চাঁপাইনবাবগঞ্জের গ্রামে গ্রামে। তিনি বেরিয়ে পড়েন ডালিমদানার খোঁজে, বেরিয়ে পড়েন সমুদ্রের জোয়ার ভাটায় মানুষের উদ্বেলিত হওয়া ব্যঞ্জনার ওঠানামা দেখতে, বেরিয়ে পড়েন ডলারের নেশার তাগিদে নয়, বেরিয়ে পড়েন বসন্ত বাতাসের একগুচ্ছ শুভকামনা আত্মস্থ করতে। তার এ যাত্রা কোনো ধর্মীয় ক্যারাভান নয়, রাজনৈতিক বা গোষ্ঠীগত ক্যারাভান নয়, তার এ যাত্রা বৈশ্বিক মানবীয় জগতের সঙ্গে সর্বদা সম্পৃক্ত। সেখানে তিনি মুক্ত, কোনো সম্প্রদায়গত ধর্মগত বাধা মানেন না। কবি প্রফেট নন, দার্শনিক নন, সমাজতাত্ত্বিক নন, দেশনেতা নন। কিন্তু এ সকল মানুষের হৃদয়ের মানবিক সারাৎসারটুকু কবি আত্মস্থ করতে জানেন কোনো সংস্কার ছাড়াই। তার পাশ দিয়ে পৃথিবীর কতো ঘটনা কতো মুহূর্ত চলে যাচ্ছে। কবি কতোটা নেবেন এই গতিসঙ্কুল পৃথিবীকে, সেটা তার ব্যাপার। কিন্তু তিনি লক্ষ্যকে (Seeing) সদা সচেতন রাখবেন, এই প্রত্যাশা নিজের কাছেও । এভাবেই তিনি, আমিনুল ইসলাম লিখে ফেলেন তার সৃজন ইচ্ছাকে—
আমি পাগলায় কান দিয়ে
শুনে নিচ্ছি আলকাপের নাভিশ্বাসের শব্দ
আমি সোমপুর বিহার বসে
শুনে নিচ্ছি ভিক্ষুদের সমবেত সামগান
আমি চলনবিলে বসে
শুনি নিচ্ছি সওদাগরের প্রণয়ীধূর গলা
আমি শুনে নিচ্ছি
সবুজ ঢেউয়ে বেজে ওঠা আবদুল আলীমের সুর
আমি দেখে নিচ্ছি
আকাশের আরশিতে পড়া লালন মনের ছায়া
(যাত্রা, পৃ: ১৮১/ কবিতাসমগ্র)
‘কবিতাসমগ্র’-এর ভূমিকায় আমিনুল ইসলাম লিখছেন—‘আমার কবিতায় জাতীয় ভূগোলের পাশাপাশি অথবা সংমিশ্রিত হয়ে উঠে এসেছে আন্তর্জাতিক ভূগোল, মিথ ও ইতিহাস। বাঙালি জাতির নৃতাত্ত্বিক উৎস সন্ধানের পাশাপাশি আমি তার আন্তর্জাতিক যোগসূত্রটিও খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করেছি। বিস্তৃত ভূগোলে শেকড়ের সন্ধান আমার অন্যতম কাব্য অন্বেষা ।’
তার প্রতিটি কবিতা গ্রন্থেই রয়েছে বিস্তৃত ভূগোলে শেকড়ের সন্ধান। তার প্রথম প্রকাশিত কবিতার বই- ‘তন্ত্র থেকে দূরে’ প্রকাশকাল ২০০২ সাল। এরপর থেকে একের পর এক প্রকাশিত হয়েছে ১-২ বছর অন্তর- মহানন্দা এক সোনালি নদীর নাম, শেষ হেমন্তের জোছনা, কুয়াশার বর্ণমালা, পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি, স্বপ্নের হালখাতা, প্রেমসমগ্র, জলচিঠি নীলস্বপ্নের দুয়ার, শরতের ট্রেন শ্রাবণের লাগেজ, জোছনার রাত বেদনার বেহালা। ২০১৫ সালে প্রকাশিত হয়েছিল ‘আমার ভালোবাসা তোমার সেভিংস অ্যাকাউন্ট’।
আমিনুল ইসলামের কবিতার বইয়ের নামকরণগুলিকে সৌন্দর্যায়িত নামকরণ বলতেই হবে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই সৃজনশীল ব্যঞ্জনা পাঠককে আকর্ষণ করে । শুধু একটি নামকরণ কবিতার বীজটিকে ধারণ করে আছে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে মাত্র নামকরণটিই একটি পরমাণু কবিতার কাজ করে। এরকম কিছু নামকরণ হয়তো যেকোনো পাঠককে আকর্ষণ করবে—মেয়রের রাজ্যে আজ মশাদের মিলিটারী রুল, পৃ: ১৪৫। আমাদের গ্রামখানি ভাঙা গণতন্ত্র, পৃ: ২৩৮। রাখো তোমার হোমিওপ্যাথ কাব্যতত্ত্ব, পৃ: ৩৫৫। গন্তব্য একটি ভুল ঠিকানার নাম, পৃ: ১১৩। ফুটবল মাঠে পরাবাস্তব খেলা, পৃ: ১১২। নির্দলীয় ভালোবাসা, পৃ: ২৭৫। আকাশের ঠিকানায় লেখা চিঠি, পৃ: ২৭২। তোমাকে আড়াল করে তোমার কুয়াশা, পৃ: ৩৪৪। ডায়াগনোসিস আফটার অপারেশন, পৃ: ১৯৩। নিষিদ্ধ বিশেষণ জড়িয়ে ধরেছে বুক, পৃ: ১৯২। তোমার চালাকিগুলো কালোবেড়ালের পা, পৃ: ২০০। পাতিয়ে রাখা দ্বন্দ্ব, পৃ: ১৮৩। মহানন্দা এক সোনালি নদীর নাম, পৃ: ৩৬৩। একেবারে নিজস্ব কিছু সৌন্দর্যায়িত জোড়শব্দ নির্মাণ করে নিয়েছেন তিনি- কুটুমপাখিদিন, কুয়াশাপ্রিণ্ট, মাছিতন্ত্র, পাখিবিদ্যা, ছায়াবাজি, আনন্দদায়কেষু রূপসীবিতান, ফসলতন্ত্র, অন্ধআড্ডা, জবাবদিহিতা, প্রিয়াভিজ্ঞতা, পাসপোর্টস্থ, অ্যাসেম্বলকৃত ইত্যাদি। কবির স্বাতন্ত্র্য চিহ্নিত করে এধরনের নির্মাণকুশলতা। আমরা জানি যে নাটকে মাস্ক এবং সলিলকি অন্তর্ভুক্ত করা হয় কখনো কখনো যা নাটককে অন্য মাত্রা দেয়, দর্শক শ্রোতার অনুভূতিকে চাঙ্গা রাখে । আমি কবিতার কারুকাজে সর্বদা গুরুত্ব দিয়ে এসেছি। ভাষায় পান (Pun) ব্যবহার করে , শব্দকে এলোমেলো সাজিয়ে বা দুটি শব্দের সহযোগে নতুন একটা কয়েনেজ তৈরি করে কবিতার অন্তর্গঠন ও বহির্গঠনে ভিন্ন স্বাদ আনা যায়। এটা একধরনের নিরীক্ষাও বটে। আমিনুল ইসলাম নিজের মতো করে সেই নিরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছেন।
কবি আত্মবিশ্বাসী যে একজন গাজীর দেশের মেয়ে কখনো সোনার বাংলার মেয়ে হয়ে উঠবে না। এবং সেই গাজীর দেশের মেয়ের প্রতি প্রেম ভাবনায় কবি নিজেও গাজীর দেশের বলিষ্ঠ পুরুষের পৌরুষের অধিকারী হতে পারেন। এই বোধ তার কবিতার আধার। এই বোধ তার স্মৃতিকে শুভকামনায় ভরিয়ে রাখে।
একজন আপাদমস্তক সংবেদনশীল কবি আমিনুল ইসলাম। তার সংবেদনশীলতা স্বতঃস্ফূর্ত স্বাভাবিক প্রাঞ্জল। যেন তিনি সংবেদনশীলতা লালন করছেন, সংবেদনশীলতাকে দিচ্ছেন বেদুইন জীবন, দিচ্ছেন জল-বাতাস আর গীতিধর্মিতা। মানবীয় উপাদান যাকিছু, সবই জড়িয়ে আছে কবি আমিনুলের সংবেদনশীলতায়। কিভাবে নির্মিত হয় তার সংবেদনশীলতা? সেখানে কি কোনো চাপানো প্রযুক্তি থাকে? থাকে কি উত্তর-ঔপনিবেশিকতা আক্রান্ত দেশের আকণ্ঠ প্রতিযোগিতা?
আমিনুলের সংবেদনশীলতার উৎস প্রধানত তার প্রাকৃতিকতায় পূর্ণ স্বদেশভূমি, স্বদেশের নদ-নদী পাহাড়, গ্রামীণ জীবন, তার স্মৃতিকাতরতা, তার পরিবার পরিজন, মেঘভরা আসমান, স্বদেশের ইতিহাস, নৃতত্ত্ব, মনস্তত্ব। সংবেদনশীলতাই তার কাব্যজীবন পরিচালনা করে। তিনি সদা চঞ্চল অস্থির। আরো বেশি বেশি সংশ্লিষ্ট হতে চান বাংলাদেশের জলে মাটি বাতাস ও আকাশের সঙ্গে যা তাঁকে হয়তো অনেক সময় অবসেসড করে রাখে। অন্য দেশের পথে প্রান্তরে জনপদে পদচারণার সময় একটা দ্বিধাময়তা কাজ করে, সেই দ্বিধা অন্যদেশের প্রশাসনিক নিয়মানুবর্তিতার কঠোরতার কারণে। প্রাকৃত অপ্রাকৃত জীবনের রসাস্বাদনে সেখানে বিজড়িত থাকে কিছু প্রটোকল। স্বভূমিতে প্রকৃতির সঙ্গে যে নিবিড়তায় কবি পৌঁছে যান, অন্যদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে তা হয়তো সম্ভব হয়ে ওঠে না। তিনি উপলব্ধি করেন কিছু নিয়ন্ত্রণ। কিন্তু স্বদেশের বেলায় আপনত্বই প্রধান বলে তিনি ছুঁয়ে যেতে পারেন যেকোনো পরিসর নির্দ্বিধায়, স্বাধীনতায়। তার প্রাঞ্জলতা সেখানে কারো সঙ্গে কমপ্রোমাইজ করে না—
এই হাত দিয়ে আমি ছুঁয়েছি অনেক
অনেক রাতের তারা
এই হাত দিয়ে আমি বেঁধেছি অনেক
অনেক নদীর ঢেউ
এই হাত দিয়ে আমি ছেনেছি অনেক
অনেক আকাশ নীল
এই হাত দিয়ে আমি খুলেছি অনেক
অনেক মেঘের খাম’
(ব্যর্থতার চাবি স্বর্গের দুয়ার, কবিতাসমগ্র,পৃ: ১০৬)
স্বভূমি বাংলাদেশের জন্য কান্না, বেদনা, ক্ষোভ, ভালোবাসা, আনন্দ, উচ্ছ্বাস, উদ্বেগ, ভ্রমণ চঞ্চলতা, নদ-নদীর প্রবহমান ঐশ্বর্য, চলনবিলের প্রগাঢ়তা, বিরহকাতরতা, আতিথ্যপরায়ণতা, পর্যটন প্রবণতা, ঐকান্তিক হৃদয়ের বাঁধভাঙা আবেগ, প্রতিবাদ, পর্যবেক্ষণ নিবিড়তায় অস্তিত্ব চেতনা থেকে শুরু করে প্রক্ষোভমূলক মানসিক প্যারামিটারগুলিকে উজাড় করে দিয়েছেন আমিনুল ইসলাম, তার কবিতায়। এরকম কিছু পংক্তি যা পৃষ্ঠা খোলামাত্রই আলো ফেলে পাঠকের চোখেমুখে-
১.
আরেক জোছনায়
যমুনাকে পথে রেখে পাশ্ববর্তী জনপদে যায় পদ্মা
সেখানে মেঘনার সাথে দেখা, বাতাসের প্ররোচনায়
বুকের আঁচল উড়ে গেলে,
মেঘনার হাতে হাত রাখে পদ্মা…
মোহনায় জমে ওঠে নতুন জলমাতৃক সংসার
(নদীর গল্প, কবিতাসমগ্র, পৃষ্ঠা: ২৮৩)২.
বিধাতাকে লক্ষ করে রাজাকারদের অভিশাপ দিতেন
গ্রামের বৃদ্ধ এবং নারীরা
ঢিলে লাথি মেরে আমি ছুঁড়ে দিতাম
আমার ঘৃণার গ্রেনেড
সেই প্রথম ঘৃণা নামক অনুভূতির সাথে
নিবিড় পরিচয় ঘটে আমার
কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার জন্য
সেসব যথেষ্ট ছিলনা বলে আমি মুক্তিযোদ্ধা হতে পারিনি
(আমার মুক্তিযোদ্ধা হতে পারা না পারার গল্প, কবিতাসমগ্রপৃ: ১৬৪ কবিতাসমগ্র)৩.
এই সেই সোনা মসজিদ- আমাদের পূর্বজনদের প্রেম ও ঘামের সাক্ষী…
এইখানে স্বর্গীয় ছায়ায় শুয়ে একাত্তরের তিতুমীর- যাকে
ভালোবেসে বরণ করে নিতে আন্ধাসা আর পানি হাতে
প্রস্তুত ছিল শহরের যুবক-যুবতী
(পথ বেঁধে দিলো বন্ধনহীন গ্রন্থি, কবিতাসমগ্র পৃ: ২৪৪)৪.
‘কথায় কথায় আমরা এসে গেছি পাহাড়পুর, পাহাড় নেই
পর্বত নেই, আছে শুধু পাহাড়সমান অতীতে সোনালি গৌরব
এখানে এলে ঘাড় হতে নেমে যায় বোঝা,
যখন দিনের আসনে অন্ধকারের পা,
তখন এখানেই জ্বলে উঠেছিল নাক্ষত্রিক দীপের মশাল
(পথ বেঁধে দিলো বন্ধনহীন গ্রন্থি, কবিতাসমগ্রপৃ: ২৪৫)৫.
যতোবারই আমি আমার পুরুষাঙ্গে হাত দিয়ে দাঁড়াই –
ততোবারই পিঠে আমার পুরোনো দেয়ালের স্পর্শ লাগে –
পুরোনো দেয়ালের স্পর্শ
(পুরোনো দেয়ালের স্পর্শ, কবিতাসমগ্র পৃ: ১৫৬)৬.
‘আর যদি ধেয়ে আসা পদ্মা পার হয়ে চলে যাও চরে
চর নারায়ণপুর, পাকা অথবা ভূতের দিয়াড়
সেখানের কিষাণীরা ভাবীর আদরে খাওয়াবে তোমাকে
পোড়াবেগুনের ভর্তা আর আমের
আচারের চাটনি দিয়ে মাসকলাইয়ের রুটি,
(ঢাকার মেয়ে চন্দনাকে, কবিতাসমগ্র, পৃ: ১০৯)৭.
‘টিকলীচর আজ একটি হারিয়ে যাওয়া অস্তিত্ব
আশিয়া খাতুন আজ একটি হারিয়ে যাওয়া নাম’
(মুক্তিযুদ্ধের কান্না, কবিতাসমগ্র পৃ: ৯৫)৮.
‘আমার যৌবনের যাবতীয় আবাদযোগ্য জমি হাতছাড়া হয়ে
গেছে মিছিলপ্রেমী পরবর্তী প্রজন্মের একদল কৃষকের কাছে
… …
পুরোনো জানালায় ইন্দ্রধনুর রঙ মেখে
ভালোবাসা ডাকে আজো জুয়াড়ি গলায়’
(ভালোবাসা ডাকে আজো জুয়াড়ি গলায়, কবিতাসমগ্রপৃ: ২৮০)৯.
‘মৃত্যু ভক্ষণ করতে করতে
মৃত্যুময় হয়ে উঠেছে এই শরীর’
(মৃত্যুভক্ষণ, কবিতাসমগ্রপৃ: ১৮৫)১০.
দুঃখ আবার জাল ফেলেছে আমাদের অস্তিত্বের গোড়ায়
এখন তার কতো নতুন নাম-নতুন সাজ
দুঃখকে ধরতে গেলে ভেলকি দেখিয়ে সে কেটে পড়ে
আমরা তার খসে পড়া-লেজ নিয়ে লিখি জ্ঞানাদ্র থিসিস’
(চেনা-অচেনা, কবিতাসমগ্র, পৃ: ১৮২)
স্বদেশ চেতনার কবিতা এই কথাটা বললে, কেমন যেন গোলা গোলা লাগে একবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকের শেষে। কবি আমিনুল ইসলাম পাখির চোখ নিয়ে দেখেছেন স্বদেশের খুঁটিনাটি। এই কারণে তার কবিতা সালোক সংশ্লেষমূলক, তার কবিতা নান্দনিকতায় পূর্ণ। স্বভূমির কান্নাজড়ানো অত্যাচারী শাসকের ইতিহাসের পৃষ্ঠায় বারবার ফিরে যান আবেগ জড়ানো কণ্ঠে। শাসকের পা-চাটা রাজাকারের হিংস্র বাহিনী রাতের অন্ধকারে ঘর থেকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে প্রতিবাদী স্বজনদের। জয়-বাংলা স্লোগানে মেতে ওঠা স্বাধীনতাকামী যুবকের দল লাশ হয়ে ভেসে গেছে পদ্মা-মেঘনা-যমুনায়। স্বভূমির এই ঐতিহাসিক বাস্তবতা কবির চোখ এড়িয়ে যায়নি। কবির চোখ এড়িয়ে যায় না নদীপ্রাণ চাষীদের দ্বন্দ্ব বিচ্ছেদ বিভেদ যার ফলশ্রুতিতে শক্রর প্রতীক হয়ে আসা কুমির সোনালি শস্যের ক্ষেত ছারখার করে দিয়ে যায়। আমিনুলের বেশির ভাগ কবিতাই যেন প্রেমদগ্ধ বেদনাদগ্ধ সামাজিক সংকটরূপের মানসিক সংকটরূপের এক একটি ক্যানভাস। সহজ সরল আবেগবিধৃত ক্যানভাস। আবেগকে তিনি তরল করেননি, আবেগকে তিনি মূল্যই দিয়েছেন জীবনকে নিংড়ে দেখার কারণে। হ্যাঁ, স্বীকার করতেই হবে, তার কবিতা বিবৃতিময়, বিবৃতিকে ব্যবহার করেছেন কবিতার ভাষামাধ্যম হিসেবে এবং সেই বিবৃতি যদি হয়ে উঠতো খবরের কাগজের বিবৃতি, তাহলে হয়তো কবিতায় হয়ে ওঠার ব্যাপারে পদে পদে বিড়ম্বনা সৃষ্টি করতো, বিবৃতির ভেতরে কবিতার গুণ থেকে তিনি বিচ্যূত হননি।
‘যতোবার হাত বাড়াই
শিহরিত আলোটুকু ঘিরে
চারপাশ হতে জমে আসে গোলমেলে কুয়াশা’
(কবির জন্মদিন, কবিতাসমগ্র, পৃ:৯৯)
এই বিবৃতির ভেতরে রয়েছে কাব্যময় হৃদয়ের আবেগঘন হতাশাবোধ। হতাশাবোধকে ক্যানভাসের যোগ্য শিল্প করে তুলেছেন আমিনুল ইসলাম। আমিনুলের অন্তরে বাস করে একজন কবিতাময় সমাজতাত্ত্বিক, একজন রোমান্টিক বাস্তববাদী, একজন সমঝোতাহীন কবিতাসৈনিক যিনি সামাজিক সংস্কৃতিকে দেখেন উত্তর আধুনিক চোখে। তার ঘনীভূত চোখের প্রতিবাদ তৃতীয় বিশ্বের মানুষের বেদনা ভারাক্রান্ত অবস্থা দেখে। উত্তর ঔপনিবেশিকতার যাবতীয় দুর্দশা মুছে যায়নি তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির ওপর থেকে। সন্ত্রাস থেকে বলাৎকার, ধর্মীয় বিভেদ থেকে জাতপাত কেন্দ্রিক সাম্প্রদায়িক আচরণ, নারীর ওপর পুরুষতন্ত্রের ধারাবাহিক শারীরিক-মানসিক নিপীড়ন থেকে শুরু করে শিশু পাচার, নারী পাচার, প্রতিবাদী কণ্ঠকে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে নিঃশেষ করে দেওয়া, সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার কারণে সর্বদা আতঙ্ক ভয় সন্দেহে আষ্টেপৃষ্ঠে থাকা জীবনের শেকলপরা চলাফেরা উত্তর-ঔপনিবেশিকতার ফল। কিন্তু কবি একজন নিয়মিত রঙ বদলানো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নন, তার কণ্ঠে জনগণের দুর্দশায় কুমীরের কান্নার মতো ভানেভরা বাক্যের ঝড় বয়ে যায় না। কবি কি তাহলে সন্ন্যাসী? না, তাও নন। একজন চিরকালীন নাটকবাজ নন তিনি। চারদিকে হতাশা, ক্ষোভ, সন্ত্রাস, মানসিক যন্ত্রণা লক্ষ্য করে, মানুষের এমনকি নিকট আত্মীয়ের, নিকট-বন্ধুর বিভেদমূলক আচরণ লক্ষ্য করে, সৎ সমঝোতাহীন উচ্চারণ করে যাওয়া তাঁকে পেয়ে বসে—
সত্তার গভীরে বারুদের গন্ধে টের পাই
আমার শেকড় সংশ্লিষ্টতায় যে মাটিজল
তা কোনো এক উত্তাল অতীতে পুড়েছিলো
পোড়ামাটি নীতির লোভী বর্বর অনলে
অগ্নিদিনের কথা উঠলে এখনও আমার
পিতার চোখ টর্চলাইটের মতো জ্বলে উঠে
আছড়ে পড়ে জমে ওঠা আঁধারের গায়ে
… …
আমার ও মৃত্তিকার মাঝে এতটুকু ফাঁক নেই
অথচ এই নিয়ে বিশারদের হাতেও ধুলো ওড়ে
কবিশ্রেষ্ঠ গান শোনান নগদের, নাট্যকারের কাছে
মুখ খুলে অপবাদে বিদ্ধ আমি আপদমস্তক
শিল্পকলার উঠানে বনসাইয়ের পাশঘেঁষে
তরুণ সংস্কৃতিকর্মী আর আমার নিজের চোখ
বাহান্নর রক্তাক্ত উঠোন ঘেঁষে
দূরান্ধের মতো আটকে আছে সাতচল্লিশে’
(শেকড় ছুঁয়ে, কবিতাসমগ্র পৃ: ৩২৩)
নস্টালজিয়া অবলম্বিত কবি। তা যেমন জাগিয়ে তোলে বহু সুখকর ছবি, তেমনি পদ্মার ভাঙনে ও গ্রাসে চলে যাওয়া বহু প্রিয় অঞ্চলের দুঃখ ধাবিত করে কবিকে
‘গোড়ানাশা পদ্মা, তোমার জল বিশ্বায়ন
সিঁদুর মোছার মতো ভাসিয়ে নিয়েছে সব
পুটু সরকারের আলকাপের মঞ্চ
সাফু চাচার পুঁথিপাঠের আসর
ম্যাড়া তলার বিল, গোঠের রাখাল
সামশুলের ষোলরইশ্যার মাঠ…
(পদ্মার পাড়ে বসে, কবিতাসমগ্র, পৃ: ৩২৫)
সামাজিক সংকট কবি আমিনুল ইসলামের মাথার ওপর দিয়ে চলে যায় না। সামাজিক সংকট মানসিক সংকট ডেকে আনে। মানসিক সংকট নতুন সামাজিক সংকটের জন্ম দেয়। সামাজিক-মানসিক বিভ্রান্তিতে কবিমন অস্থির। ফলে তার সংবেদনশীল প্রতিক্রিয়া স্পষ্ট, বিমূর্ত নয়। কবি ক্লান্তিহীন বলে চলেন অথবা নির্দেশাত্মক ভাষা ব্যবহার করেন সামাজিক রাষ্ট্রিক মানসিক ভারসাম্যহীনতা নিরাপত্তাহীনতা লক্ষ্য করে। হৃদয়ে হৃদয়খানি রাখার কথা ছিল। সেটা আর হলো না। মরমে লাগানো হয়েছে কলাপসিবল গেট এবং সেই গেটে রাতদিন মস্ত এক তালা ঝুলিয়ে রাখা আছে। মন আর সমাজ একাকার হয়ে আছে তার কবিতায়। যে হৃদয় নিয়ে তিনি যাপন করতে চান, সেটা অন্যদের কাছে গ্রহণীয় নয়, অপাংক্তেয়। কবিতা লেখার শুরুর দিনগুলোতে এই উপলব্ধি হয়েছিল তার স্পষ্টভাবে।‘ঝামেলা’ নামাঙ্কিত কবিতায় সেটাই লিখে ফেললেন দ্বিধাহীনভাবে
‘হৃদয় নিয়েই যতো ঝামেলা আমার
ঘরে রাখতে গেলে জায়গা মেলে না
ভাঙা কুলো এসে টানাটানি বাধায়
বাজারে চলে না, মুদি বলে
তামার টাকা হলেও না হয়
সেরদরে নেওয়া যেতে বাপু
এ তোমার বাপদাদার আমলের
জিনিস—অচল, কেউ নেবে না’
( তন্ত্র থেকে দূরে, কবিতাসমগ্র, পৃ: ৩৬৯)
হতাশা, ক্ষোভ, মানসিক যন্ত্রণা প্রবল হয়ে ওঠে মানুষের বিভেদমূলক আচরণ লক্ষ্য করে। কবি কি সত্যিই মাটির কাছাকাছি আছেন, প্রশ্ন তোলেন পণ্ডিতজন, বিশারদেরা। সামাজিক স্খলন যেমন আনপড় নিম্নবর্গের মধ্যে, তেমনি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত উচ্চবিত্ত এমকি সংস্কৃতি জগতের উচ্চাঙ্গে বসে থাকা স্বঘোষিত বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে। এসব কথার মধ্যে দিয়ে বলতে চাইছি আমিনুল ইসলামের কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে সচেতন বিশ্বনাগরিকতার মনন, যে মননবিশ্ব উন্মুক্ত কৌতূহলে পর্যবেক্ষণ করে যায় মনের ও প্রবণতার মাইক্রো লেভেলের খুঁটিনাটিগুলোকে। ফলত তার অস্তিত্বের অবস্থানটি কোথায় তা স্পষ্ট করে ফেলেন কবি আমিনুল। অস্তিত্বের টানাপোড়েনের খেলা চলতে থাকে তার কবিতায়। অবসানবাদী অস্তিত্বের যতোরকম সংকটাপন্ন চেহারা আছে, নিজেকে কখনো সেসবের সঙ্গে তুলনা করে ফেলেন । সিলেবাস কেঁপে ওঠে তার। তার ‘শৃঙ্খলিত কোকিলের গান’ কবিতাটি আসলে তৃতীয় বিশ্বের এক সংবেদনশীল নাগরিকের অস্তিত্বের প্রতিবিম্বায়ন। স্বদেশের বিকৃতি তাঁকে শুধু জ্বালা-যন্ত্রণা দিয়েছে এমন নয়, তাঁকে দিয়েছে অনেক উষ্ণশ্বাসের শব্দ। বাংলাদেশের জলবাতাস তার অস্তিত্বের মজ্জায় মজ্জায় লিপিত হয়ে আছে। তার প্রায় প্রতিটি গ্রন্থেই আমি লক্ষ্য করেছি বাংলাদেশের জন্য তার গভীর থেকে উঠে আসা কান্না, তার হার্দিক ভালোবাসা দেশের প্রতিটি জনপদের জন্য। মুক্তিযুদ্ধের কথায় কাব্যায়ন ঘটাতে গিয়ে তিনি অশ্রুসজল হয়ে পড়েন যেন। মুক্তিযুদ্ধের গানের আকুতি তার কবিতায় পরতে পরতে লক্ষ্য করি। মাতৃভূমির চিত্রায়নে তিনি সমঝোতাহীন, অপার ভালোবাসার দৃষ্টি দিয়ে লিখে যাচ্ছেন সোনার বাংলার প্রকৃতি। ‘ভোরের হাওয়ায় ভাসে বাংলাদেশ’ কবিতাটির কিছু পংক্তি উল্লেখ করা যাক
আমনের ক্ষেতে আঁচল উড়িয়ে
ভোরের হাওয়ায় ভাসে বাংলাদেশ
আত্রাইয়ের জল এসে আলতো হাত ধুয়ে দেয় তার প্রত্নরাঙা পা
( মহানন্দা এক সোনালি নদীর নাম, কবিতাসমগ্র, পৃ: ৩২৭)
পাঠক লক্ষ্য করবেন, কবি আমিনুল ইসলামের ভূগোল চেতনা, ভূগোল সম্পর্কিত সন্ধান কবিতায় অমূল্য জায়গা করে নিয়েছে। তার ‘পথ বেধে দিলো বন্ধনহীন গ্রন্থি’ কবিতাটি ট্রাভেলগ টেক্সটের আদরায় লেখা। কবিতাটি আটটি ক্যানটোয় সম্প্রসারিত করে লেখা। তিনি তিন সংখ্যক ক্যানটোয় লিখেছেন ‘আজ নাটোর মানে কবিদের বনলতা সেনময় প্রিয় তীর্থভূমি পাঠক লক্ষ্য করুন ‘সেনময়’ শব্দটি। আজকের কবিতার সোনোরিটি এভাবেই তৈরি হচ্ছে কবিদের আনন্দময় সন্ধানে। চার সংখ্যক ক্যানটোয় লিখছেন
‘কথায় কথায় আমরা এসে গেছি পাহাড়পুর। পাহাড় নেই
পর্বত নেই, আছে শুধু পাহাড়সমান অতীতের সোনালি গৌরব
এখানে এলে ঘাড় হতে নেমে যায় বোঝা; যখন দিনের আসনে
অন্ধকারের পা, তখন এখানেই জ্বলে উঠেছিল নাক্ষত্রিক দীপের মশাল…’
(পখ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি, কবিতাসমগ্র, পৃ: ২৪৫)
আমরা চলে যাই তার ‘শরতের ট্রেন শ্রাবণের লাগেজ’ কবিতাগ্রন্থে। সেখানে ‘ঢাকার মেয়ে চন্দনাকে’ কবিতায় লিখছেন
‘আমি বলছি নবাবগঞ্জের কথা
না চন্দনা, রাজধানীর হস্তক্ষেপে অতিষ্ঠ ঢাকার নবাবগঞ্জ নয়
দেশের পশ্চিমে-ইতিহাসের সোনালি অধ্যায়ের পাতা জুড়ে
জ্বলজ্বল করে জ্বলতে থাকা-চাঁপাইনবাবগঞ্জের কথা বলছি আমি।’
( শরতের ট্রেন শ্রাবণের লাগেজ, কবিতাসমগ্র, পৃ: ১০৮)
‘কপোতাক্ষ: সে এক হাফ সাঁতারের স্মৃতি’ কবিতায়
‘জন্মের পর যে ডাক শুনেছি
নবজাতকের কানে—তা ছিল পদ্মানদীর এক সাহসী মাঝির গলা’
(জোছনার রাত বেদনার বেহালা, কবিতাসমগ্র, পৃ: ৭০)
কবিতাই আমিনুল ইসলামের প্রধানতম সাধনা। সারাদিন কবিতার আনন্দে ডুবে থাকা মানব জীবনের অস্তিত্বের আত্মপ্রকৃতি, বর্ণময় নাবিকবিদ্যা অভিব্যক্ত হয়েছে তার কবিতায়। তাঁকে আমরা মান্যতা দিচ্ছি এই বলে যে তিনি একজন প্রলিফিক লেখক। তার কবিতায় ভরা ভ্রাম্যমানতা। যা কিছু অর্জন, তার অনেকটাই মাঠে ময়দানে। নাব্যতায়, জীবনের ট্রান্সপারেন্ট প্রবহমানতায়। বিশ্ব জীবন দর্শনের এক সামগ্রিক পাঠশালা হয়ে উঠেছে তার লেখন বিশ্ব। যেখানে জড়, অজড়, ভূগোল, ইতিহাস, রাজনীতি, মনস্তত্ত্ব এবং সকল প্রকার মানবীয় তত্ত্ব প্রবাহিত হয়ে চলেছে একই স্রোত-আকুলতায়। এভাবেই নদীকে করে তুলেছেন তিনি আত্মার আত্মীয়। মহানন্দার জলের আরশিতে বিম্বিত মহাজীবনের জলছবি দেখতে পান তিনি। আলোড়িত ক্ষীণতোয়া মহানন্দায় স্টিমারের অন্য যাত্রীদের মতো তিনি দেখতে পান ‘একচিলতে সিক্ত নান্দনিকতা’। তার নদীমাতৃক কবিতায় বারবার ফিরে আসে প্রাচীন বাংলার অথবা প্রকৃতি আবৃত বাংলার আবহমান চিত্র যে চিত্রের মধ্যে দিয়ে বয়ে যায় কবির প্রিয় নদী মহানন্দা, যাকে তিনি বলেছেন, ‘মহানন্দা এক সোনালি নদীর নাম’। মহানন্দার সঙ্গে একান্ত যাপনে কবি স্মৃতিভারাতুর হয়ে ওঠেন। বিষাদে ভরে ওঠে তার মন, কারণ নদী বিধৌত প্রাচীন বাংলার অনেক সংস্কৃতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে অথবা প্রযুক্তি সভ্যতার চাপে কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। তবু আজো বেঁচে আছে নদীর বুকে বিশুদ্ধ অক্সিজেন। সেই অক্সিজেন, তিনি প্রত্যাশা করছেন, যদি কিছুটা নিয়ে যাওয়া যেতো তার দেশের রুগ্ন রাজধানী ঢাকায়। নদীর বহুরূপ দেখেছেন তিনি। তিনি যেমন নদীর ভাঙন প্রক্রিয়ায় ভেসে যাওয়া গ্রাম দেখেছেন, তেমনি নদীর সৌন্দর্যের রূপে যেন বিমোহিত হয়ে গেছেন। নদীর কারণেই তার ক্ষোভ অভিমান বেদনা প্রকাশ করেছেন, আবার নদীর কাছে তার প্রার্থনা ও আবেদন মূর্ত হয়ে উঠেছে। নদীর প্রতি এভাবে প্রকাশিত হয়েছে তার অভিমান:
‘ফাগুনে রাঙাবে না অথচ শ্রাবণে ভাসাবে
ও আমার জন্মসখা নদী,
প্রাপ্ত বয়স্ক পাঠশালায় এ ক্যামন ভালোবাসার ব্যাকরণ!
(নদী-চার, শেষ হেমন্তের জোছনা, কবিতাসমগ্রপৃ: ২৮৬)
কলের গান শোনা বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য। সেই ঐতিহ্যের কাছে কবি ফিরে যেতে চান নদীর গল্পে। নদীর কথা নদীর গানে কবি আমিনুলের কোনো ক্লান্তি নেই, বিরক্তি নেই, সময়ের নির্দিষ্টতা নেই। ‘শেষ হেমন্তের জোছনা’ গ্রন্থে ‘নদী-এক’ কবিতায় লিখছেন-
দূষিত কোলাহল ভেদ করে আল মাহমুদের তিতাসের মতো
নদীটি আমাকে কলের গান শুনিয়ে যায়;
তাই ঘুমের অগভীরতা নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা ছিল না’
( কবিতাসমগ্র, পৃ: ২৮৪)
কী অসাধারণ অভিব্যক্তি আমি খুঁজে পাই তার ‘নদীর গল্প’-এ, ‘মেঘনা-যমুনার মাঝে কী কথা হয়েছিল, তা জানে শুধু ইলিশ-নৌকার মাঝিরা’
নদীকে কখনো মানবসত্তা রূপ হিসাবে দেখেছেন কবি। নদীর পার্সোনিফিকেশন। মানব রূপের নামগোত্রের মতো নদীরও থাকতে পারে সে রকম কিছু চিহ্নিতকরণ। কিন্তু নদী সেই চিহ্নিতকরণকে উপভোগ করেও স্পষ্ট করে তার একক নদীসত্তাকেই প্রায়োগিক রাখতে চায়। নদী, তার আত্মকথায় এভাবেই বিবৃত করে তার পরিচয়
‘আমি শ্রাবণের গঙ্গা নই
আমি ভাদরের মেঘনা নই
আষাঢ়ের যমুনাও নই আমি
হতে পারি আমি ইছামতী
হয়তো হতে পারি পুনর্ভবা
অথবা বাঙালীও হতে পারি
সত্য যে আমি একটি নদী’
(একটি নদীর আত্মকথা, কবিতাসমগ্র, পৃ: ২৪২)
যখন নদীকে কেউ ‘বাঙালী’ হিসাবে চিহিৃত করে, তার ভেতরে নিশ্চয়ই কোনো জাতিসত্তার স্বার্থ কাজ করে না, বরং সেই জাতিসত্তার ঐতিহ্য সংস্কৃতি ও জীবন ধারা নদীর সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে যায়। একটি জায়গায় কবি নিজেকে উত্তর-আধুনিক বলেছেন। সম্ভবতঃ নদীর প্রবহমানতায় জীবনের প্রবহমানতায় কবির আসঙ্গ উপস্থিতি তাঁকে দিয়ে এই উচ্চারণ করিয়ে নিয়েছে। গভীর বেদনার সঙ্গে তিনি দেখেছেন পদ্মার জলে পদ্মার ভাঙনে ভেসে গেছে কতো ঘর কতো স্বপ্ন। পদ্মার পাড়ে বসে মনে পড়ে যায় সেইসব বেদনার ইতিহাস। উত্তর-আধুনিক কবি হয়েও তার সহজ-সরল নদী আসক্ততা শরীর-মনে শিহরণ ঘটায়। তিনি ভাবতে থাকেন পদ্মার হাঙর গ্রাসে চলে গেছে –‘গুমানির কবিগানে মুখরিত পৌষ মেলার রাধাকান্তপুর’।
বিভিন্ন রকম মানসিকতায় আমি আমিনুল ইসলামের কবিতা পাঠ করেছি। কখনো কখনো মনে হয়েছে তার কবিতা আসলে মুক্ত লিখন (Open Text)। কখনো মনে হয়েছে তিনি ঐতিহ্যের দিকেই ঝুঁকেছেন বেশি। কখনো মনে হয়েছে ছন্দময় পদ্য তার হৃদয়কে গ্রাস করতে চাইছে। কখনো মনে হয়েছে অতি বিবৃতি কবিতার সারধর্মকে অবসাদে ভরিয়ে তুলছে। মনে হয়েছে, তিনি তো একজন পরিব্রাজক, পদ্যের আর কবিতার বৈপরীত্যের স্থানটুকু অস্বীকার করে তাদের ভিতরকার আনন্দটুকুই ধারণ করতে চান। পদ্যে এবং কবিতায় উভয় পর্যটনে সামঞ্জস্য রাখতে চান। ফলে অন্ত্যমিল তার কাছে কোনোভাবেই বর্জনীয় নয়। যেমন অন্ত্যমিলের প্রবল তাড়না ছাড়াই টানটান মহাপয়ারও তার কাছে বর্জনীয় নয়। অন্তমিলে এবং টানটান গদ্যবিন্যাসে, অন্যান্য উপকরণের মতে ভালোবাসা নামক প্রক্ষোভটিও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে আছে। আমিনুল ইসলামের কবিতার বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে ভালোবাসার সুখ-দুঃখ, ভালোবাসার ব্যঞ্জনা, লাঞ্ছণা, ভালোবাসার উত্থান-পতন, ভালোবাসার ডিসটরশন, ভালোবাসার ওপর পুঁজি সভ্যতার খবরদারী এবং ভালোবাসাকে বিকৃত পণ্য করে তোলা। ভালোবাসা বিষয়ে বারবার অভিব্যক্ত হয়েছে কবি আমিনুলের বিরহকাতর বিদ্রোহকাতর মানবীয় প্রকৃতি। যৌনসন্ত্রাস কবলিত দেশে দেশান্তরে, রাজনৈতিক আধিপত্যবাদী সন্ত্রাস পরিসরে কবির উচ্ছ্বাস ক্ষোভ হতাশা বিরক্তি প্রকাশিত হওয়ার পাশাপাশি ভালোবাসার জগতে তার ভিন্নভিন্ন অবস্থান, ভিন্নভিন্ন প্রতিক্রিয়া। কোথাও তার প্রেয়সী এখন আর তার প্রেয়সী নয়। অথবা প্রেয়সী বলে যাকে প্রত্যাশা করেছিলেন, তিনি ধনকুবেরের অর্থে মজে গিয়ে দেহসর্বস্ব পার্থিবতায় উল্লসিত হয়ে আছেন। প্রেম ভালোবাসা সম্পর্কে গভীর নেতিবাচক অভিজ্ঞতার বোধ উঠে এসেছে কবি আমিনুল ইসলামের কবিতায়। প্রেমিকাও যে ওয়াইল্ড বিস্ট হতে পারে এমনতর অবস্থার মুখোমুখি হই এমনতর পংক্তিতে–
‘কাঁচা আবেগে একবার এক সহপাঠিনীর হাতে
হৃদয়টা দিয়ে কী বিপদে পড়েছিলাম
আধুনিকার খেয়ালি নখের আঁচড়–লাল নীল পীতাভ।’
(ঝামেলা, তন্ত্র থেকে দূরে, কবিতাসমগ্র, পৃ: ৩৬৯))
তিনি তার কবিতা বিষয়ক ভাবনায় বলেন, ‘যে ভালোবাসা সম্পূর্ণরূপে প্রকাশিত হয় না মুখের কথায় বা প্রেমপত্রে অথবা ইনবক্স মেসেজে, তা পূর্ণ প্রকাশ লাভ করে কবিতায়- ভাব ও ব্যঞ্জনার সম্মিলিত সহযোগিতায়’। আমিনুল ইসলামের কবিতায় পরকীয়া প্রেমের মাধুর্য প্রকাশিত হয়েছে এবং তদ্ভব বেদনাকেও তিনি মিশিয়ে দিয়েছেন কাব্যের কারিগরিতে । বঙ্গীয় বিহঙ্গ হয়ে পৃথিবীর বহুদেশে তার পাড়ি দেওয়ার ইনটারভেলগুলিতে হয়তো তিনি বহু নারীর সংস্পর্শে এসে পড়েছেন। নির্মিত হয়েছে হার্দিক আবেশের কার্যকারিতা এবং তা কখনো পরকীয়ারূপ ধারণ করেছে। কিন্তু স্বল্প-সময়ের ভালোবাসা বা পরকীয়াপনা কবির কাছে অমূল্য সম্পদ, অমূল্য উপকরণ কবিতার। তিনি নিবেদিত সত্তা হয়ে ওঠেন সেই ভালোবাসার আকর্ষণে। ‘তোমাকে দেখার সাধ’ (পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি, কবিতাসমগ্রপৃ: ২১৮) স্বর্গীয়রূপ ধারণ করে তার কবিতায়:
—শুধু বিশেষণমাখা একটি মুখচ্ছবি পাসপোর্টস্থ
ভিসার মতো জেগে আছে এ বুকে; সে ছবি দেখবে না তুমি
অথবা অন্যকেউ- এমনকি ইমিপ্রেশন বিভাগের লোকেরাও
— —-
হয়তোবা পরকিয়া কোনো সাঁঝ বা ভিসাহীন রাত টুরিস্ট হয়ে
ঢুকে পড়লে হৃদয়ে অথবা ঢাকার কোনো কাব্যের আসরে
হিকমতের কবিতা পড়তে গিয়ে মনে পড়ে যাবে তোমাকে
জেগে উঠবে তোমাকে দেখার সাধ- তখন কি স্বর্গচ্যুত আদমের
মতো ছটফট করবো, আমি?’
ভালোবাসা সম্পর্কে কবির কাছে অন্তিম কোনো উত্তর নেই। দেশে বিদেশে যেখানেই অবস্থান করেন, শুধু ভালোবাসার গান গেয়ে যাওয়াই তার কাজ। ভালোবাসা তার কাছে রাঙা পৃথিবীর প্রভাতসংগীত। ভালোবাসার কারণেই ‘আবদুল জব্বারকে কণ্ঠে এনে /আমি নীল দরিয়ার গান গাইলাম’।
আমিনুলের ভালোবাসা প্রাণীবাচক অপ্রাণীবাচক সকলের প্রতি। যদিও মনে হয় না অপ্রাণীবাচক বলে তিনি কোনো কিছুকে চিহ্নিত করেন। নিজের দেশের রুগ্ন রাজধানী ছেড়ে কুয়াকাটায় সমুদ্রতীরে ভোরের পরিবেশে গেয়ে উঠতে পেরেছেন ভালোবাসার গান:
‘ভোরের সোনালি সূর্য, ইথারের নেটওয়ার্ক
আর জোয়ারে দুলে ওঠা সমুদ্রকে শুনিয়ে
গেয়ে উঠলাম রাঙা পৃথিবীর প্রভাত-সংগীত
ভালোবাসি… ভালোবাসি… ভালোবাসি…
(ভোরের কুয়াকাটায়, পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি, কবিতাসমগ্র, পৃ: ২১৪)
বকুলবৃক্ষকে বান্ধবী মনে করেন কবি। শীতের হিমানী যেন শীতের গার্লফেন্ড। বান্ধবী বকুল বৃক্ষকে বলেন—
‘তোমার বেহুলা বেহুলা মন
অতিবেগুনী রোদের পায়ে তুমি রচেছো গুচ্ছগুচ্ছ ছায়া
(বকুল আমার বান্ধবীর নাম, কবিতাসমগ্র, পৃ: ১৫০)
তার কবিতায় প্রেম স্বদেশ মানে না, বিদেশ মানে না। কোনো সীমারেখা মানে না । একজন তুর্কী নারীকে দেখে তার যৌবনের প্রমত্ত প্রবাহ জেগে ওঠে। তিনি কল্পনা করেন, সেই তুর্কী নারীর বহু ব্যবহৃত ঠোঁটে তার বঙ্গীয় ঠোঁট দিয়ে ওয়াটার কালার এমবোস কিস এঁকে দিতে পারেন। আমিনুলের প্রেম বিষয়ক এই দুঃসাহসিক ভাবনা কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে। কবি আত্মবিশ্বাসী যে একজন গাজীর দেশের মেয়ে কখনো সোনার বাংলার মেয়ে হয়ে উঠবে না। এবং সেই গাজীর দেশের মেয়ের প্রতি প্রেম ভাবনায় কবি নিজেও গাজীর দেশের বলিষ্ঠ পুরুষের পৌরুষের অধিকারী হতে পারেন। এই বোধ তার কবিতার আধার। এই বোধ তার স্মৃতিকে শুভকামনায় ভরিয়ে রাখে।
তার মতে, উৎকৃষ্ট কবিতা আবেদনে-অর্থময়তায় সৌন্দর্যে বহুমাত্রিক ও বহুরৈখিক আকর্ষণ ধারণ করে রাখে। তার মতে, উৎকৃষ্ট কবিতার প্রতিটি শব্দের শব্দার্থ জানা, অথচ অনেক শব্দ মিলে ধারণ করে ভিন্ন অর্থ, পরিহাস, ব্যঞ্জনা, তীর্যকতা, বহুমাত্রিকতা। তিনি মনে করেন, প্রকৃত কবিকে ভূগোলের ক্ষুদ্র চৌহদ্দিতে অথবা কোনো একটি বিশেষ ধর্মের বৃত্তে কিংবা বিশেষ কালের সংকীর্ণ গণ্ডিতে আটকে রাখা যায় না।
কবি আমিনুল ইসলামের কবিতা পড়তে পড়তে দেখছি এক একটি বিষয় ধরে ধরে তার কবিতা আলোচনার দাবি রাখে। বিষয়গুলোকে এভাবে সাজাতে পারি। পরের প্রজন্মের কেউ হয়তো কখনো প্রয়োজন মনে করলে এই বিষয়গুলোর ওপর পৃথক পৃথকভাবে আলোকপাত করতে পারেন নিজের মতো করে:
১.প্রেম-বিরহ এবং তৎবিষয়ক হৃদয়ের অস্থিরতা; ২. স্বদেশ, মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা অনুরাগ; ৩.সামাজিক বৈষম্য তথা সংকট; ৪.মানসিক সংকট;৫.সমাজতাত্ত্বিক ও মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি ; ৬.মৃত্যু চেতনা;৭.স্মৃতিসত্তা; ৮.অস্তিত্ব চেতনা; ৯.প্রান্তিকতা;১০. উত্তর-ঔপনিবেশিকতাবাদ; ১১.বিশ্বায়ন; ১২.পরিবেশ চেতনা;১৩.দুঃস্বপ্ন; ১৪.অন্ধকার;১৫.নদীমাতৃক দেশের কথা;১৬. নিসর্গচেতনা; ১৭.মুক্তিযুদ্ধ; ১৮.নারীর ওপর পুঁজিবাদের আধিপত্য;১৯.রোমান্টিক মনন; ২০.পরিযায়ী প্রবণতা; এবং ২১. স্বজন-কাতরতা ইত্যাদি।
আমি কথা বলছিলাম আমিনুলের ভালোবাসার বিশ্ব প্রসঙ্গে। আরো একটি বিষয় আমার গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে তা হলো তার কবিতার গঠন প্রকৃতির বিন্যাস যা কখনো অন্ত্যমিল সহকারে এবং কখনো টানটান গদ্য ভাষায়। ‘আমার ভালোবাসা তোমার সেভিংস অ্যাকাউন্ট’ -এই নামকরণেই প্রথম চমক লাগবে পাঠকের মনে। এটি যেমন একটি কবিতার বইয়ের নাম তেমনি ওই গ্রন্থের মূল থিম কবিতা এটাই। সমগ্র কবিতাটি প্রেমিকার কাছে এক আবেদন, যে প্রেমিকা এখন অন্যের যৌনবন্ধনে। তো সে এমনই প্রেমিকা যে মাত্রই সেভিংস অ্যাকাউন্ট বোঝে, অর্থপ্রাবল্য বোঝে এই অসুস্থ পুঁজিকেন্দ্রিক প্রতিযোগিতার বাজারে, সে ভালোবাসার কোয়ান্টাম বোঝে না, ভালোবাসার ইলেকট্রন-প্রোটন বোঝে না। রবার্ট ব্রাউনিং-এর The Last Ride Together এর উপেক্ষিত প্রেমিকের মতো আমিনুলের করুণ আবেদন। Robert Browning লিখেছিলেন
I said,—Then, Dearest, since `tis so,
Since now at length my fate I know,
Since nothing all my avails,
Since all, my life seemed meant for, fails,
Since this was written and needs must be
———————————–
My whole-heart rises up to bless
Your name in pide and thankfulness
Take back the hope you gave,—I claim
Only the memory of the same.
কবি আমিনুল ইসলাম লিখলেন সেই আবেগ অভিমানকেই, আজকের পরিসরে:
`আমার ভালোবাসা ধরে রাখো সুহৃদা
যেভাবে আনন্দ ধরে রাখে অননুমোদিত প্রথম চুম্বনের স্মৃতি
যেভাবে ব্রা ধরে রাখে পালিয়ে যেতে বসা যৌবনের ঢেউ
যেভাবে নদী রাখে নতুন বন্যায় গর্ভবতী হওয়ার সম্ভাবনা ’
(আমার ভালোবাসা তোমার সেভিংস অ্যাকাউন্ট, কবিতাসমগ্র,পৃ: ৫৮)
উপেক্ষিত প্রেমিক কবি, জোয়ানা নাম্নী প্রেমিকা আজ চলে গেছে সেই ব্যক্তির কাছে দেহসর্বস্বতাই যার প্রধান অবলম্বন। অথচ কবি যৌনতার উদ্যাম নগ্নতার কাজ কিছুই করতে পারেননি। তিনি চেয়েছিলেন বঙ্গোপসাগরের হেমন্তিক হাওয়ারর মতো প্লেটনিক ভালোবাসা। তিনি পোস্টমর্ডান পরিসরের ভালোবাসার প্রকৃতি অনুধাবন করতে ব্যর্থ। কবি আমিনুল ইসলামের কাব্যে ভালোবাসা সম্পর্কে বহুরৈখিক চেতনা, বহুরৈখিক মনস্তাত্ত্বিক আলোড়ন নিবেদিত হয়েছে। একচেটিয়া পুঁজি উদ্ভাবিত সন্ত্রাস কিভাবে ভালোবাসার টুঁটি টিপে ধরে তা প্রকাশিত হয়েছে কবি আমিনুলের ‘ভালোবেসে কী হবে’, কবিতায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মদদে কোথাও কোথাও সন্ত্রাসবাদীরা ভালোবাসাকে উপড়ে ফেলতে চায়। কবির সন্ত্রাসগ্রস্ত শিহরণ এবং একই সঙ্গে প্রতিবাদ, বিদ্রুপ ঘনীভূত হয়ে আছে ওই কবিতায়:– ‘আমি সেই প্রেমিক যে প্রেয়সীর ঠোঁটে চুমু খেয়ে ব্রাশ ফায়ারে লুটিয়ে দিতে পারে কচি প্রাণের বাগান;/ আমি সেই প্রেমিক যে ভালোবাসার ইউনিফরম পরে শুধু টাকার জন্য করতে পারে কোল্ডব্লাডেড সেভেন মার্ডার/… একচোখ নিয়ে একচোখা ভালোবাসা বাড়িয়ে চলেছে প্রেমের-নেকটাই পরা-নেকড়েদের দাঁতাল-সাফল্যের সাম্রাজ্য… (পৃ: ৩১ কবিতাসমগ্র) টানা গদ্যে লেখা এই কবিতায় পাই ভালোবাসাকে জড়িয়ে ফেলা সন্ত্রাসের বীভৎস রূপ। ‘ভালোবাসা নিতে পারি’( কবিতাসমগ্র, পৃ: ৫২) কবিতায় কবি ভালোবাসাকে সিগনিফাইড করছেন এভাবে—
‘ভালোবাসা কোনো ডিপ্লম্যাটিক বার্গেনিং নয়
কনট্রাক্ট ফার্মিংও নয়
যে ভালোবাসা নিতে পারে
তার জন্য কোনো ইন্দিরা-মুজিব চুক্তির দরকার নেই’।
এভাবে সিগনিফাই করা হলেও ভালোবাসা বিষয়ে কবির কোনো সীমারেখা টানা নেই, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেই। ভালোবাসা ছাড়া তিনি বাঁচতে পারেন না বলেই প্রেম বিষয়ক অভিমান তাঁকে তীব্র পংক্তি রচনা করতে বাধ্য করে:
‘প্রতিকূল বাণিজ্য ভারসাম্যের এই বাজারে
প্রেমের কবিতা মানে তহসিল অফিসের নিলামের মাল
প্রেমের কবিতা মানে শ্যালো-ইঞ্জিনের দাপটে উধাও
মহানন্দার পাল তোলা নাও, ধুলু মাঝির স্রোতে ভেসে যাওয়া গলা’
(প্রেমের কবিতা পাঠ, কবিতাসমগ্র, পৃ: ৩৩৩.)আমিনুল ইসলামের কবিতায় নিসর্গ ও নিসর্গচেতনা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘তন্ত্র থেকে দূরে’-র অন্তিম কবিতা ‘তবু প্রেম তবু ঘরবাঁধা’ যেখানে লিখেছিলেন এই শতাব্দীর শুরুতেই- ‘আমার কণ্ঠে বাঁধা আবহমান নিসর্গের সুর’। প্যারোল বা মৌখিক স্বরে নিসর্গের ভাষা প্রকৃতিকে তিনি অস্তিত্ববাদীর ভাবনায় তুলে এনেছেন কবিতায়। আজো এর ব্যত্যয় ঘটেনি। নিসর্গচেতনা তার কবিতার প্রাণ। ঐ গ্রন্থের ‘শীত’ কবিতায় তিনি লিখেছেন ‘শীত এলে নাকি প্রকৃতির পথে পা বাড়ায় বসন্ত’ । আমাদের মনে পড়ে যায় শেলী Ode to West Wind কবিতার বিখ্যাত পংক্তি If Winter comes, Can Spring be far behind ? বসন্ত এলে কখনো কারো বিলাপে ভরে উঠতে পারে মন। কবি সাধারণের থেকে আলাদা হয়েও প্রাক্ষভিক চেতনায় কখনো তাদেরই মতো। একটি ছন্দবদ্ধ উচ্চারণে এ রকমই বিলাপ:
‘ফাল্গুন যায় ফাল্গুন সর্ব-অঙ্গ বেকার
তোমার মনে পাটগ্রামের বসন্ত কুহেলী
কে ঠেকাবে খরাদাহ নষ্টঘামের উজাড়
শতফুলে তার আগে কি ফলবে না চৈতালি?’
(হায় বসন্ত, কবিতাসমগ্র, পৃ: ২৫২)
‘শীতের কাছে লেখা পত্র’ (কবিতাসমগ্র, পৃ: ৭৪) কবিতায় তিনি লিখেছেন
‘সুজলা মাটির কোষে উষ্ণতার উৎপাত
ফলে নদীবাসী হয়েও আমরা নদীকে
তার বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনায় চিনতে শিখিনি।’
‘ভোরের কুয়াকাটায়’ (কবিতাসমগ্র, পৃ: ২১২) কবিতায় অস্থির চিত্তে কবির সামুদ্রিক প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ এবং সেই প্রকৃতির মধ্যেই যেন আত্মমগ্ন হয়ে যাওয়া। করতোয়া নদীকে উপমা করে তিনি লিখতে পারেন: ‘আমাদের স্বপ্নগুলো স্বচ্ছতোয়া, (খুলে দাও মন, কবিতাসমগ্র পৃ: ২১২) এর আগে আমি উল্লেখ করেছি ‘স্বপ্নের হালখাতা’ গ্রন্থের ‘যাত্রা’ কবিতাটি যেখানে প্রকৃতির সান্নিধ্যে কবির নিজস্ব এক মানসিক পরমা নির্মিত হচ্ছে যা দূষণ পৃথিবী থেকে দূরে। কবি তখন উপেক্ষা করতে পারেন মোটর বাইকের হর্ন, স্পীডবোটের উল্লাস, বিজ্ঞাপনের হাসি। ‘মহাবিশ্ব’(কবিতাসমগ্র, পৃ: ২৩) কবিতায় কী অসাধারণ হার্দিক বিভাসা ‘আমার তো কোনো শূন্যতাই নেই; সবখানেই থইথই জল’। মনে পড়ে যায় কোলরিজের বিখ্যাত কবিতা ‘রাইম অব দ্য অ্যানসিয়েন্ট মেরিনার’ এর সেই পংক্তি Water, Water everywhere—-, যদিও পরিপ্রেক্ষিতটা সম্পূর্ণ আলাদা। প্রথম গ্রন্থে যে নিসর্গ চেতনা জায়মান ছিল, তাকে তিনি আজো লালন করেন। ‘ভালোবাসা অথবা মহাবিশ্ব’ কবিতায় সেই নৈসর্গিক যাপনের কথা
‘মেঘনার গেট বন্ধ হলে যমুনার বাড়ি যাওয়া
যমুনা শুকালে আছে কর্ণফুলির চাতাল
আর পিপাসা উদাসী হলে যমুনারা যাবে
কুয়াশার শামিয়ানা টাঙানো সমুদ্রের বাড়ি
সমুদ্র নিজেই এক মহাবিশ্ব—যেখানে
একঘাটে জল খায়-পিপাসা ও জল, জল ও পিপাসা।’
(আমার ভালোবাসা তোমার সেভিংস অ্যাকাউন্ট, কবিতাসমগ্র,পৃ: ৩৪,)
কী অসাধারণ উচ্চারণ ও অবলোকন ‘চাষাবাদের ব্যাকরণ শস্যের শিল্পীদের হৃদয়ে’ (কবিতাসমগ্র, পৃ: ১৮৯)। আর কবি যখন নিসর্গের সত্তার ভিতরে সন্ত্রাস ও বারুদ দেখেন, তার নার্ভ সিস্টেমে কী ভয়ানক তোলপাড় হয়ে যেতে পারে, সেটা সকলেই কল্পনা করে নিতে পারি।
আমরা কবিতার বিভিন্ন রকম ফর্ম দেখেছি। কোয়াট্রেন, সনেট, এপিক, ব্যালাড, কাপলেট, আখ্যানমূলক কবিতা, এলিজি গীতি কবিতা ইত্যাদি। তেমনি কবিতার গঠন, বিগঠন, বিনির্মিত গঠন, ছোট কবিতা, অণু কবিতা ইত্যাদি নানান পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়ে গেছে। কবি আমিনুল ইসলাম কবিতার গঠন প্রকৃতি নিয়ে নিরন্তর ভেবেছেন তার প্রমাণ তার প্রতিটি কবিতার বইতে পাওয়া যাচ্ছে। কখনো টানা গদ্যে, কখনো প্রবহমান মহাপয়ার, কখনো দীর্ঘ পংক্তি, কখনো মাত্র ২-৩-৪ শব্দের পংক্তি, কখনো দীর্ঘ আকারের মধ্যে পংক্তির বহুতর বিন্যাস, কখনো একটি স্বল্প আকারের পংক্তির নিচে বড়ো আকারের পংক্তি এবং সেটাকেই বজায় রাখতে রাখতে হঠাৎ সেই বিন্যাসকে ভেঙে একই কবিতায় অন্য গঠন বিন্যাস তৈরি করা আমিনুলের কবিতার গঠনবিন্যাসের বৈশিষ্ট্য। একদম টানটান আবেগহীন গদ্য ভাষার পাশাপাশি অন্ত্যমিল ছন্দ-বিন্যাসে চলে আসা আবেগলিপ্ত ভাষায়।
কবি আমিনুল ইসলাম শূন্য এবং শূন্য পরবর্র্তী দশকে বাংলাদেশে কবিতার যে নতুন ভাষা, বিষয়-উত্তীর্ণ হওয়া কবিতা বা তীব্র নিরীক্ষার কারণে বিমূর্তিকরণ, সে-সবের সঙ্গে সরাসরি অন্তর্ভুক্ত হতে চাননি। ঐতিহ্যের নিয়মনিষ্ঠতাকেই তিনি প্রাধান্য দিয়েছেন শিল্প দক্ষতাকে বজায় রেখেই। অতিরিক্ত পরীক্ষা নিরীক্ষার দিকে ঝোঁক দেননি। আবহমান কবিতার প্রেক্ষাপটে নিজের অবস্থানটি স্পষ্ট করতে চেয়েছেন তিনি। ফল্গুধারার মতো জীবনানন্দীয় এবং নজরুলীয় চেতনা তার কবিতায় কোনো ঋদ্ধ পাঠক খুঁজে পেতে পারেন। কোথাও কোথাও এ রকমও মনে হয়েছে যে, তিনি নির্দিষ্ট বিষয়গত আধারটিকে সম্পূর্ণ উজাড় করে দিতে চাইছেন। অর্থাৎ তিনি যেন পুরোটাই বলে ফেলতে চান। পাঠককে বিষয় বহির্ভূত জগতে নিয়ে যাওয়াটা যেন তার পছন্দ নয়। পাঠককে তিনি সমস্তটাই দিয়ে দিতে চান। উত্তর আধুনিকতাকে তিনি নিজের মতো করে সাজিয়ে নিয়েছেন। এ ব্যাপারে তিনি ইউরোপীয় বা পশ্চিমবঙ্গীয় পোস্ট-মডার্নিটির সন্দর্ভ গ্রহণ করেননি। তিনি ভাষাবিহারী হয়েও আমেরিকান বা ইউরোপিয়ান ভাষা-কবিতার বয়ান অনুসরণ করেননি। প্রত্যেক স্বাধীন রাষ্ট্রের সংস্কৃতির নিজস্ব ভৌগোলিক এবং সংস্কৃতির নিজস্ব আলো বাতাস আমরা লক্ষ করেছি। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের বাংলা কবিতার স্বাতন্ত্র্য আছে যে স্বাতন্ত্র্য কবি আমিনুল মনেপ্রাণে বজায় রাখতে চান বলে মনে হয়। তবে মহাবিশ্বের সবকিছুর সঙ্গে জড়িয়ে থাকার নেশা পেয়ে বসেছে কবি আমিনুল ইসলামরে। এবং সেটা ব্যক্ত হয়েছে প্রত্যক্ষভাবে তার কবিতায়।
আমিনুল ইসলামের ‘মহাবিশ্ব’কবিতাটি (কবিতাসমগ্র,পৃ:২৩) পাঠের পর প্রথমেই বিস্মিত হই, কারণ তিনি কবিতাটি উৎসর্গ করেছেন পৃথিবী রঙের এক মানবীকে, উৎসর্গ, এই শব্দটা ব্যবহার না করেও। তার কবিতাসমগ্র পড়তে পড়তে মনে হয়েছে, এক মহাকাব্য পড়ছি, যদিও সেটি মহাকাব্যের আখ্যানমূলক ধারাবাহিকতায় রচিত নয়। তা আজকের পরিস্থিতি পরিসরে ভাঙ্গা-ভাঙ্গা, টুকরো টুকরো অসম্পৃক্ত এপিসোড। ফ্রাগমেন্টেড। তার এক একটা কবিতার বই এক একটা জীবনের অধ্যায়। নতুন অভিজ্ঞতায় জারিত নতুন বোধের উন্মোচন, অথচ মৌলিক। এপিসোড বলতে ন্যারেটিভ নয়। বিচ্ছিন্ন ঘটনাবস্থাকে কাব্যিক ভাষায় ও চেতনায় একসূত্রে বেঁধে বিপুল হারমোনি নির্মাণ। তিনি লিখতে চেয়েছেন অভেদের কথা, অভেদের সন্ধান। তিনি তার অনুসন্ধানী চোখটিকে সর্বদা নিবদ্ধ রেখেছেন অর্থময়তার প্রতি। তার মতে, উৎকৃষ্ট কবিতা আবেদনে-অর্থময়তায় সৌন্দর্যে বহুমাত্রিক ও বহুরৈখিক আকর্ষণ ধারণ করে রাখে। তার মতে, উৎকৃষ্ট কবিতার প্রতিটি শব্দের শব্দার্থ জানা, অথচ অনেক শব্দ মিলে ধারণ করে ভিন্ন অর্থ, পরিহাস, ব্যঞ্জনা, তীর্যকতা, বহুমাত্রিকতা। তিনি মনে করেন, প্রকৃত কবিকে ভূগোলের ক্ষুদ্র চৌহদ্দিতে অথবা কোনো একটি বিশেষ ধর্মের বৃত্তে কিংবা বিশেষ কালের সংকীর্ণ গণ্ডিতে আটকে রাখা যায় না।