দৃশ্যমান সত্যের সংস্পর্শে অভিজ্ঞতার পরোক্ষ অথবা প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় বিমূর্ত উপলব্ধিজনিত উত্তাপে হৃদয়ের হর্ষ-বেদনাকে মূর্ত করতেই চিত্রকল্পের সৃষ্টি। এটি কবিতার পৃথক কোনও অলঙ্কার নয়; বরং অনেক প্রতিষ্ঠিত অলঙ্কারকে ধারণ করেই তার অস্তিত্ব। সার্থক চিত্রকল্পের যেমন গুণ রয়েছে, তেমনই অসার্থক চিত্রকল্পের ব্যবহারে কাব্যে মালিন্য-ক্রটিও ধরা পড়ে। এর আলোকে বলে নেওয়া ভালো যে, আমিনুল ইসলামের কবিতার চিত্রকল্প নিয়ে আলোচনা করার মধুর বিড়ম্বনা হচ্ছে—বিচ্ছিন্নভাবে চিত্রকল্পের পাঠোদ্ধার সম্ভব হয় না। গুচ্ছগুচ্ছ চিত্রকল্পের সমন্বয়ে রচিত তার কবিতার প্রায় পুরোটাই উদ্ধার না-করে কোনও সিদ্ধান্তে আসা যায় না। কবিতার থিম সম্পর্কেও জানা যায় না।
চিত্রকল্পের বিচিত্র পৃথিবী আমিনুল ইসলামের কবিতা। প্রথম কাব্য ‘তন্ত্র থেকে দূরে’ থেকেই আমিনুল ইসলাম চিত্রকল্প সচেতন। উপমা, রূপক, উৎপ্রেক্ষা প্রভৃতি অলঙ্কার সহযোগে গড়ে উঠেছে তার কবিতা। বৈচিত্র্যময় চিত্রকল্প তার কবিতার উল্লেখযোগ্য ঐশ্বর্য।
মানবিক উৎসনির্ভর চিত্রকল্পে সমৃদ্ধ আমিনুল ইসলামের কবিতা। কবির কাব্যশিল্পদৃষ্টি এতটাই অন্তর্গত, অন্তরঙ্গ উষ্ণতায় সক্রিয় যে, গূঢ় বাস্তবতা তাতে মিশে গিয়ে কখনো গভীর আবেগে, কখনো বাস্তববোধে আপ্লুত হতে বাধ্য।
১.
এমন মোহন টান! সর্বনাশ জেনেও অভ্যস্ত চরণগুলি জড়ো হয়
সূর্যহীন আড্ডায়; ভ্রূকুটির চোখগুলো কী কথা যে আঁধারে রটায়—
গা ছোঁয়াছুঁয়ি তবু অযোগ্যযোগহেতু অনাবিষ্কৃত আজীবন;
নির্বিকার যুবকেরাও। মাছের চোখের মতো নক্ষত্রেরা চেয়ে থাকে
অন্ধকারে অন্ধকারভেদি। আর আসক্তির ধূম্রঢেউ থেকে থেকে
ঘোলা করে তরল আঁধার; এবং অসংলগ্ন হাত নাড়ে অলৌকিক
যুবতীর কাদা; ফলে স্বপ্নদুষ্ট রাত। আর বৃক্ষময় গ্রামগুলো
পড়ে থাকে অন্তরালে—লাউয়ের মাচানে বেঁধে বাউলের ফেলে-যাওয়া মন।
(আবাস: কুয়াশার বর্ণমালা)২.
ফাগুনে রাঙাবে না অথচ শ্রাবণে ভাসাবে;
ও আমার জন্মসখা নদী,
প্রাপ্তবয়স্ক পাঠশালায় এ ক্যামন ভালোবাসার ব্যাকরণ!
(নদী-চার: শেষ হেমন্তের জোছনা)
মূলত চিত্রকল্প যে কত নিবিড় এবং বিষয়লগ্ন হতে পারে, ‘মূলত চিত্রকল্প যে কত নিবিড় এবং বিষয়লগ্ন হতে পারে, ‘আবাস’ ও ‘নদী-চার’ কবিতা দু’টি তার উজ্জ্বল প্রমাণ। দৃষ্টিভঙ্গির অভিনবত্ব, দেখছেন যে, তার গ্রামগুলো আর বৃক্ষময় থাকছে না, একতারার সুরে আর বাউল গেয়ে ওঠে না অমৃত সুধার মতো সুরসমৃদ্ধ গান। অন্যদিকে আবার নদীও বিমাতাসুলভ আচরণে তিক্ত করে তুলেছেন কবির মন।
মানুষ হাজারো প্রচেষ্টায় খুলে চলেছে প্রকৃতির রহস্যো জট। কিন্তু তাইবা কতটুকু? আজও বিশ্ব রয়ে গেছে অপার রহস্যে। মানুষের আজকের জানা ভুল প্রমাণিত হয়ে যাচ্ছে পরের দিন। তাই ব্যক্তিমানুষের ও একইসঙ্গে মানবগোষ্ঠীর সীমিত সাফল্যের পাশে ব্যর্থতাও কম নয়। বিজ্ঞানের এই চরম উন্নতির যুগেও মানুষ রহস্যময়ী প্রকৃতির কাছে মুগ্ধ শিশু বই কিছু নয়।
প্রাপ্তবয়স্ক প্রেমিকের সাজ পরে তার কাছে যাই
আর ঘুম থেকে জেগে উঠে দেখি:
উদার স্তনের নিচে মুখ দিয়ে শুয়ে আছি আমি দুধের শিশু!
(সে এক অদ্ভুত ব্যর্থতা: জলচিঠি নীলস্বপ্নের দুয়ার)
অতিপ্রাকৃত, ভারী শব্দ, তরলীকৃত চিত্রকল্পের পরিবর্তে তার কবিতায় খুঁজে পাওয়া যায় মূর্ত ও মৌলিক শব্দচিত্র। কবি শব্দ নিয়ে খুব বেশি নিরীক্ষা না করলেও মালার্মের অমোঘ উক্তি ভুলে যাননি— ‘শব্দই ব্রহ্ম’। ক্লাসিকধর্মী বিভিন্ন চিত্রকল্পের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাই শব্দের অবাক সুষমায়।
আমার ডানে মৃত্যু—আমি তাকে খাচ্ছি
আমার বামে মৃত্যু—আমি তাকে খাচ্ছি
আমার মাথার ওপর মৃত্যু—আমি তাকে খাচ্ছি
আমার পায়ের কাছে মৃত্যু—আমি তাকেও খাচ্ছি।
(মৃত্যুভক্ষণ: স্বপ্নের হালখাতা)
মৃত্যু একটি চিরায়ত বিষয়। কবি ব্যক্তিগতভাবে মৃত্যুচিন্তা নিয়ে চিরায়ত সুধাসম্ভোগের প্রস্তুতিপর্ব পার করছেন। আর তাতেই মূর্ত হয়ে উঠছে কবির চিত্রময়তার প্রতিচ্ছবি।
এস টি কোলরিজ বলে গেছেন—‘একজন কবির ক্ষমতা, প্রতিভা ও শ্রেষ্ঠত্ব বিচারের মাপকাঠি হলো, তিনি কতদূর অভিঘাত সৃষ্টিকারী চিত্রকল্প নির্মাণ করতে পারেন, তার ভিত্তি।’ বিষয়টি কবির শক্তিময়তার ওপর নির্ভরশীল। আমিনুল ইসলাম সে ব্যাপারে আমাদের নিরাশ করেননি। তার ‘শেষ হেমন্তের জোছনা’ কাব্যের ‘বৃষ্টির বন্ধুত্ব’, ‘মিউজিয়াম’, ‘পাখি সমাচার’ কবিতায় সাধারণ অর্থাৎ নিরাভরণ চিত্রকল্পের সন্ধান পাওয়া যায়।
উড়তে তো মানা নেই; প্রত্নযুগ খুঁড়ে আদি পাখিকুলের ডানায়
মেলেনি কোনো যতিচিহ্নের ছাপ-জানা গেল উত্তরাধুনিক এক
পাখিবিশারদের অভিসন্দর্ভে।
(পাখি সমাচার: শেষ হেমন্তের জোছনা)
প্রকৃতি সঙ্গীতময়। সেখানেও বসে সুরের জলসা। জীববৈচিত্র্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি সাঙ্গীতিক ঐক্যসূত্রে গ্রথিত। প্রকৃতির বাইরের রূপটি খালিচোখে দেখা যায়। কিন্তু ভেতরের রূপটি দেখতে হলে থাকা চাই অন্তর্দৃষ্টিময় কবিমন। প্রকৃতির গভীর নিবিড় রূপ এঁকেছেন কবি সবুজ চিত্রকল্পে—
সুন্দরবনের শ্যামা গায় শোনো সহজিয়া গান
অর্পণগাছিয়া জলে বেজে ওঠে সুরের সঙ্গম
রয়েল বেঙ্গল বাঘ সেই সুরে পেতে আছে কান
সুরের সভায় এক তন্দ্রাচ্ছন্ন মোগলে আজম!
(সুন্দরবনের সুরসভায়: কুয়াশার বর্ণমালা)
কবিমাত্রই ইন্দ্রিয়বেদী। অধিকাংশ কবিই দৃশ্যরূপময় চিত্রকল্প নির্মাণ করেন। মিল্টন ছিলেন দৃশ্যরূপে সমৃদ্ধ। আর আমাদের রবীন্দ্রনাথের তো জুড়িই নেই। শেক্সপিয়ার ও জীবনানন্দ ইন্দ্রিয় প্রধান কবি ছিলেন। আমিনুল ইসলাম দৃশ্যরূপে সমৃদ্ধ একথা হলফ করেই বলা যায়। সচেতনভাবে ইন্দ্রিয়প্রধান হিসেবে চর্চা করে যাচ্ছেন তিনি। ইন্দ্রিয়ভারাতুর একটি চিত্রকল্পের পাঠ উদ্ধার করছি:
সাত সাগরের বুক কী করে ধারণ করো সাড়ে তিনহাতে,
বুঝি না তা;
চোখের চাওয়ায় কী করে প্রভাত আনো সূর্যহীন দেশে,
আর তোমার ব্যঞ্জনে কী করে মাতাল হয় রুচির সেবক,
বুঝি না তা;
(মুকুটহীনা: তন্ত্র থেকে দূরে)
নারী সবারই আকাঙ্ক্ষিতা, নারীর স্বরূপ নির্ধারণে যাননি কবি; তবে প্রেমের পথেও পা বাড়াতে ভুল করেননি। পরস্পর বৈরি একটি কাব্যসত্তা দিয়ে কবি তার চিত্রল প্রতিবেদন পেশ করছেন—যা ইন্দ্রিয়পুঞ্জকে উদ্দীপ্ত করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি,ইন্দ্রিয়ের ভেতর দিয়ে প্রবেশ করেছে সর্বজনীন চেতনায়।
বিদেশি মিথ কিংবা বিশ্বের বিভন্ন দেশের ঐতিহ্যিক আবহ ও মিথোলোজিক্যাল টার্ম তার কবিতায় স্বতঃস্ফূর্তভাবেই উপস্থাপিত হয়েছে কোনও রাখঢাক ছাড়াই।
গুয়ান্তোনামোয় থির সূর্যহীন রাতে
সভ্যতা কঁকিয়ে ওঠে বর্বর আঁধারে
শৃঙ্খলিত আর্তনাদ বিপন্ন ভাষাতে
বেজে ওঠে বাদুড়ের বিস্মিত রাডারে।
(আঁধারের জানালায়: স্বপ্নের হালখাতা)
মানুষ একসময় ছিল শুধুই হৃদয়বান প্রাণী। তারপরে সে হয়েছে রাজনৈতিক ও সামাজিক জীব। আর এখন সে রূপান্তরিত হয়েছে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক জীবে। ধনদৌলত ছাড়া তার কাছে অন্য কোনো কিছুর মূল্য থাকছে না। ফলে খসে পড়ছে পুরনো যাবতীয় বিশ্বাসের ভিত। আজ পৃথিবীতে যত যুদ্ধ, তার পেছনে মূলত অর্থনৈতিক লোভ ও বাণিজ্যিক আগ্রাসন। ডারউইনের বিবর্তনবাদ আজ ইতিহাসে আলোর মুখ দেখতে শুরু করেছে। তাই কবির উচ্চারণ:
বাণিজ্যবায়ুতে আজ উদ্বেলিত জোয়ার—ভেসে যায় পৃথিবী,
ঢেউয়ের তাণ্ডবে উথালপাথাল নূহের কিস্তি, ছিঁড়ে যায় পাল;
(ভালোবাসার আকাশে নাই কাঁটাতারের বেড়া: জলচিঠি নীল স্বপ্নের দুয়ার)
বর্তমান বিশ্বে প্রেমের স্থান দখল করে নিচ্ছে সেক্সের ব্যবসা। অর্থের মোহে মানুষ বিসর্জন দিচ্ছে তার হৃদয়ের সুন্দরকে। আর এটা নিয়ে ব্যবসা করছে এক শ্রেণীর বেনিয়া পুরুষ। তাদের চতুর হাতে নারীরা সেক্সপণ্য হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে শিল্পসাহিত্যে সর্বত্র বিস্তৃত হয়ে পড়েছে এই ব্যবসা। একে আবার দূরভিসন্ধিমূলকভাবে প্রশংসিত ও পুরস্কৃত করা হচ্ছে। উদ্বেল কবির অন্তর্চক্ষু আটকে আছে সেই ঘনশ্যাম দেশে, যে দেশে—
বলরুমে নেচে যায় টপলেস রাই
কী-বোর্ড-এ ঘনশ্যাম হাইলি ইস্মার্ট
ওয়েলডান!— মাঝপথে শুনে এই রায়
খসে পড়ে উত্তেজিত মিনি ইস্কাট।
(প্রেমের দুনিয়া সাবেকি চোখে:স্বপ্নের হালখাতা)
বিশ্বায়ন ধনীদেশগুলোর জন্য যতটা সুবিধা এনে দিয়েছে, গরিব ও দুর্বল দেশড়ুলোর জন্য ততটাই প্রতিকূলতা। চলছে মুক্ত অর্থনীতি ও অবাধ সংস্কৃতির জোয়ার। চলছে মিডিয়ার প্রবল অধিপত্য। ধনীদেশগুলোর মিডিয়া দখল করে নিয়েছে প্রচার ও প্রচারণার জগৎ। প্রতিযোগিতায় পেরে উঠছে না গরিব দেশগুলো। এসব দেশের নিজস্ব সংস্কৃতির সম্পদগুলো হারিয়ে যেতে বসেছে।
অলখ জোয়ারে ভাসে থই থই ভাপা পিঠা দিন;
স্মৃতিচারী পাকুড়ের পলাতকা সুরেলা দুপুর;
দাদুর দুচোখ ছোঁয়া পশমি গোধুলি; স্বপ্নমাখা
পরীদের ডানাঘঁষা বসন্তের রাত, ভাসে সেও।
প্লাবিত পুকুরের ঢেউলাগা পদ্মফুলসম
বিশ্বাসের রঙমাখা আমাদের স্বপ্ন থোকা থোকা
ঘুরে ঘুরে ভাসে দ্যাখো, তটঘেঁষা ঘোলা জলাবর্তে!
আর যতো ঝাঁকবদ্ধ প্রাণ অদ্ভুত মাছের মতো
ভেসে যায় স্রোতানুগ; প্রশ্নগুলো ভেসেছে আগেই!
(স্রোত: মহানন্দা এক সোনালি নদীর নাম)
চিত্রকল্পেই থাকে কবির সৃজনীশক্তির প্রকাশ।আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৃহৎ চিত্রকল্পের অনেক উদাহরণ লিপিবদ্ধ আছে। বৃহৎ চিত্রকল্প বলতে আমরা (Sublime) অর্থাৎ উন্নত অথবা মহৎ সুরকে প্রাধান্য দিতে বুঝি। রূপক অর্থে এর অর্থ আরও ব্যাপক বলে ধরে নিতে পারি। একটা উদাহরণ উপস্থাপন করছি:
পাড়বাঁধা জলাশয়ে সাঁতার শিখেছ
কি করে বুঝবে তুমি
কী বিচিত্র হতে পারে তটিনীর গতি!
নদী কি মানবে ওই
ঢেউবৈরী গ্রন্থিময় ফতোয়া তোমার?
তারচেয়ে সেই ভালো সুনির্মিত খাল কিংবা
ছিমছাম লেক বেছে নাও!
(দিশা: কুয়াশার বর্ণমালা)
কবি এখানে শিল্পের প্রতি কমিটমেন্ট বিহীন ব্যক্তিদের উদ্দেশ্যে রূপকঅর্থে মহৎ ভাবনা দাঁড় করিয়েছেন। এছাড়াও কবির ‘পথ বেধে দিলো বন্ধনহীন গ্রন্থি’ কবিতায় আমরা যে ইমেজ পাই, তা বৃহৎ চিত্রকল্পকে ধারণ করে। এখানে আমাদের অতীত ঐতিহ্যের স্মরণ যেমন স্বতঃস্ফূর্তভাবে উঠে এসেছে, তেমনই এসেছে বর্তমান প্রাপ্তির হিসেবও। ভবিষ্যতের পথ-নির্দেশনাও উল্লেখ রয়েছে, যা সত্যিই মহাকাব্যিক।
চরম বাস্তববাদী কবি হিসেবে আমিনুল ইসলামের কবিতায় যুগচেতনা এক অবশ্যম্ভাবী শর্ত। বাস্তবাদী চিত্রকল্পে কবি আরও স্বতঃসিদ্ধ। কঠিন বাস্তবতাকে কবি চিত্রকল্পে আরোপ করে থাকেন সময়ের ধারাপাত মেনেই।
শিশুকাল প্রত্যাবর্তনযোগ্য নয়,
সার্চে ক্লিক করেও পাওয়া যাবে না মুছে যাওয়া দিন;
তবু মার্বেল খেলা দুপুর দ্বন্দ্বসূত্রে
উদ্ভাসিত করে তোলে অ্যাডাল্ট স্বপ্নের রাত।
(উৎসর্গ: প্রেমসমগ্র)
কবি জানেন, শিশুকাল প্রত্যাবর্তনযোগ্য নয়। তবু Nostalgia আক্রান্ত হয়েও কবি সুখস্মৃতি বর্ণনা করে আত্মতৃপ্তি পেতে চান।
কবিতায় পরাবাস্তবতা অনন্য এক বিষয়। পরাবাস্তব চিত্রকল্পে কবি মগ্নচৈতন্যের গভীর থেকে, অবচেতনের ভাষা থেকে চিত্রকল্প নির্মাণ করেন। কবি আমিনুলও পরাবাস্তবতার প্রতিনিধিত্ব করেছেন বেশ ভালো করেই।
মিথ্যাবাদী রাখালের চোখে দিবানিদ্রা
সে ফাঁকে বাঘ ঢুকেছে আমাদের পাড়ায়
ডোরাকাটা গাঁয়ে লেখা—নরখাদক নই।
আমরা তাকে ছাগল দিচ্ছি; গরু দিচ্ছি;
আমাদের কুচ পরওয়া নেহি। ও’পাড়ার
কুকুর-শেয়ালের ভয় র’লো না আর;
গরীবের সংসারে বাবা তুমিই তো নারায়ণ!
(কুটুম: কুয়াশার বর্ণমালা)
প্রত্যেক প্রধান কবির চিত্রকল্পেই অভিনবত্ব অপরিহার্য। কারণ কাব্যশিল্প প্রতিনিয়তই অভিনবত্বপ্রয়াসী, যদিও নিষ্প্রাণ অভিনবত্ব মূল্যহীন। অবিরাম অভিনবত্বপিয়াসী আমিনুল ইসলামের কবিতায় বিচিত্র ভাবনার সব চিত্রকল্পের সমষ্টিরূপ দেখা যায় শব্দের অর্থদ্যোতনাময় ব্যঞ্জনায়। একটি সমষ্টিগত অথচ গুচ্ছ চিত্রকল্পের উদাহরণ উপস্থাপন করা যাক:
দৃশ্যত বিশুদ্ধ ভদ্রলোক তিনি; জুমআর মসজিদে সালাম দিয়েই
জোড়হাতে প্রণাম দেন হরিমন্দিরে; আহা আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতা!
থানার নোটবুক তো মুরগিচোরের দখলে, কেরামিন-কাতেবিনের
গোপন ডায়েরি ছাড়া কোথাও মেলবে না তার মূল আমলের বয়ান।
(হাওলাদার ভাই: জলচিঠি নীলস্বপ্নের দুয়ার)
বিভিন্ন চিত্রকল্পের সমাহার ঘটিয়েছেন কবি বিভিন্ন ভাবনাবলয় থেকে। সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় কাকে বলে (!), এই কবির এই কবিতাটি অনেকটা পথনির্দেশক হতে পারে বিশ্ববাসীর। কবি এখানেই সনাতনী ধারণা তথা কূপমণ্ডূকতার পথ পরিহার করে সর্বজনীন হয়ে ওঠার শাশ্বতপন্থা অবলম্বন করেছেন। তাতেই কবি সার্থক।
নানাবিধ প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মানবসৃষ্ট প্রতিকূলতা সত্ত্বেও এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। স্বাধীনতার পর আমাদের কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েকগুণ। খেলাধুলা, সঙ্গীত, সাহিত্য প্রভৃতি ক্ষেত্রেও এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। কোনো হতাশা নয়। কবির চোখে একটি উজ্জ্বল বাংলাদেশের স্বপ্নময় ছবি। যে দেশের প্রথিতযশা পুরাণ, ইতিহাস ও দর্শন চিত্রকল্পে ছত্রান্তরে উন্মীলিত।
নিমের ডালে দাঁত মেজে বলিহার হাউজে হাসছে দু’জন সিপাহী
করোনেশন হলের মাথাছুঁয়ে ফুটেছে নতুন আভা
সেদিকে তাকিয়ে উজ্জ্বল ঘুমভাঙা এক কিশোরের চোখ।
শরৎ ছুঁতে চায় হেমন্ত; আমনের ক্ষেতে আঁচল উড়িয়ে
ভোরের হাওয়ায় ভাসে বাংলাদেশ
আত্রাইয়ের জল এসে আলতো হাতে ধুয়ে দেয় তার প্রত্নরাঙা পা।
(ভোরের হাওয়ায় ভাসে বাংলাদেশ: মহানন্দা এক সোনালি নদীর নাম)
একটি সূক্ষ্ম কল্পনা আবশ্যিকভাবেই জীবন সম্পৃক্ত। কল্পনার চিত্রকে ভাষায় জীবন্ত ও বাস্তব করে তোলার প্রয়োজনে কবি শব্দের- সমৃদ্ধবন্ধনে আবদ্ধ হন। পক্ষান্তরে অলীক কল্পনার (fancy) স্থির ও সুনির্দিষ্ট বিষয় নেই।
কবি ব্যক্তিত্ব্যের মগ্ন স্মৃতিচৈতন্যেরই একটি অন্তর্গূঢ় রূপ হচ্ছে চিত্রকল্প। চিত্রকল্পের সার্থক প্রয়োগ আমরা দেখতে পাই আমিনুল ইসলামের কাব্যবিভায়। আধুনিক ও সপ্রতিভ এই অলঙ্কার কবি আমিনুল ইসলামকে বৈচিত্র্যে-মৌলিকতায় করে তুলেছে অনন্য।