রবীন্দ্রনাথ বলেছেন—‘ভালো লেগেছে এই কথাটি ঠিক মতো বলতে পারাই যথার্থ সমালোচনা। এর বেশি কোন কথা নেই। পাণ্ডিত্য নয়, অনুভবের আলো ঠিকরে ভালো লেগেছে কথাটা বলবার মতো হয়, শোনবার মতো হয়।’ শুধু এই অনুভবের ওপর নির্ভর করে বলতে পারি, আমিনুল ইসলামের চারটি কাব্যগ্রন্থের (তন্ত্র থেকে দূরে, মহানন্দা এক সোনালী নদীর নাম/ শেষ হেমন্তের জোছনা/ কুয়াশার বর্ণমালা) পাঠ শেষে ‘ভালো লেগেছে’। আমিনুল ইসলামের কবিতা পড়তে গিয়ে আবু সায়ীদ আইয়ূবের একটি বক্তব্য মনে এসেছে বারবার—‘গদ্যের বক্তব্য পাঠক বুঝে ফেলবার সঙ্গে সঙ্গে সেই অর্থের বাহন যে ধ্বনিপুঞ্জ, তা নিয়ন্ত্রণ হয়ে পড়ে। যেন বক্তার তীর থেকে নদীর ওপারে শ্রোতার তীরে একটি রেলগাড়িকে পার করে দেওয়ার দরকার পড়েছিল বলে আলাদিনের জিন মুহূর্তের মধ্যে ঠিক মাপের একটি সাঁকো তৈরি করে ফেললো। তারপর রেলগাড়িটি যেই ওপারে নির্বিঘ্নে পৌছে গেল, অমনি সাঁকোটা হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।’ কিন্তু কবিতার ক্ষেত্রে তা হওয়ার নয়। অর্থ বোঝানোর পরও শব্দ ও তার ধ্বনি পাঠকের চৈতন্যে আবার নবজন্ম লাভ করে। সেখানে সাঁকোটা মিলিয়ে যায় না। বরং অপেক্ষায় থাকে। সেখানে তো শুধু যাওয়া নেই। সেখানে যাতায়াত। নিরন্তর যাওয়া আর ফিরে ফিরে আসা। আমিনুল ইসলামের পাঠ অভিজ্ঞতা এরকম :
প্রথম শীতের হাত; সেই হাতে রচিত আস্তানা।
তথাপি সংহার নয়, ফসলের পক্ষে ছিল গান।
উন্মুক্ত চলনবিল, বাতাসে ডানার ধ্বনি-
আর জলজুড়ে মুগ্ধতার ছবি: খুশি ফলে
ঈর্ষাতুর আলোরাও। আর ছায়ার পাশে
জমেছিল অকৃত কর্তব্য। প্রকৃতির জবাবদিহিতা?
কিন্তু কে নেবে ? বসন্ত করেনি ভুল।
অথচ এখন কোথায় পাখি! শূন্যবিলে
যতসব বিভ্রান্তির ছায়া; রৌদ্রের গায়ে রঙ।নিঃসঙ্গ দুহাতে পালক কুড়িযে রাখি।
ধূসর শিল্পীর হাতে গড়ে ওঠে যাদুঘর।
পুনঃপুন বিজ্ঞাপন কিউরেটের পদে;
তবু একমাত্র অ্যাপ্লিক্যান্ট—আমাদেরই দুখু বাঙাল ।(কুয়াশার বর্ণমালা: কুয়াশার বর্ণমালা)
তৃতীয় বিশ্বের কবিতার সঙ্গে একালখণ্ডের বাংলা কবিতার একটি আত্মিক মিল পাওয়া যায়। এই তুলনামূলক পাঠ বাংলা কবিতার বহুমাত্রিক চরিত্রকে বুঝতে সাহায্য করে।
কোনো যুগেই কোনো কবিতা কাব্যতত্ত্বের ভিত্তিতে রচিত হয়নি। এই কালখণ্ডের কবিতার ক্ষেত্রেও সেই একই কথা চলে। তবু সময় থেকে সময়ের কবিতা আলাদা করে চেনা যায়। সময় থেকে সময়ের কবিতা আলাদা বৈশিষ্ট্য পায়। বিশেষ বিশেষ বৈশিষ্ট্য বা যুগধর্ম সৃষ্টিশীল মনকে আলোড়িত করায় যে কবিতা অঞ্চলের উদ্ভব ঘটিয়েছে, তাই এ কালখণ্ডের কবিতা। এ সব কবিতা পাঠে তাত্ত্বিক বা আলোচকরা বিশেষ বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলোকে চিহ্নিত করেন। এ সব বৈশিষ্ট্যের সবই একটি কবিতায় বা টেকস্টে উপস্থিত থাকে না। একটা বৈশিষ্ট্য বা একসঙ্গে কয়েকটি বৈশিষ্ট্য একটি টেকস্টে উপস্থিত থাকে। বৈশিষ্ট্যগুলো অনেকার্থে একটি দরজা বা জানালা বা গোবাক্ষের মতো। যা দিয়ে টেকস্টে ঢোকা যায় বা দৃষ্টি প্রক্ষালন করা যায়। এই বৈশিষ্ট্যগুলোর প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো:
১. গভীর প্রকৃতি মুখীনতা
২. পরম্পরাহীনতা
৩. শিল্পীর ব্যক্তিক অনুপস্থিতি
৪. বৃত্ত বা বলয়কে ভেঙ্গে ছড়িয়ে পড়ার বাসনা বা কেন্দ্র অস্বীকার
সমকালীন কবি হিসেবে আমিনুল ইসলামের কবিতায়ও আমরা বৈশিষ্ট্যগুলোর উপস্থিতির দেখা পাই গভীরভাবে।
প্রতিটি মানুষ দিনের আলো উজ্জ্বলতায় মনে এক প্রকারর প্রসন্নতা অবচেতন বা চেতনভাবে অনুভব করে। আবার বৃষ্টির দিনে অনুভব করে এক ধরনের বিষণ্নতা—এক প্রকার বিরহবোধ। মনে হয় কী যেন নেই,কী যেন হারিয়েছি। কবি কালিদাস দেড় হাজার বছর আগেও এ জাতীয় বিরহকাতরতা অনুভব করেছিলেন। তাঁর অনুভূতিতেই সম্ভবত উপমহাদেশের সাহিত্যে প্রথম ধরা পড়ে এই চেতনাবোধ। তিনিই ব্যক্ত করেছিলেন, ‘এমন বাদল দিনে প্রিয়ার কণ্ঠলগ্ন থাকলেও এক প্রকার বিরহবোধ জাগে। অন্তরের গভীরে যা আনন্দ হরণ করে।’ প্রকৃতি ও ঋতু সৃষ্টিশীল মানুষের মনে এমনভাবেই প্রভাব বিস্তার করে। কবি আমিনুল ইসলামও প্রকৃতির এই আলো আঁধারির দোদুল্যমানতা মেঘ রোদ্দুর গ্রীষ্ম শীত কুয়াশা দ্বারা প্রভাবিত হন। তবে তিনি তার প্রকাশ ঘটান তাঁর কবিতায় অন্যদের চেয়ে আলাদাভাবে। ইতিহাস ও সমকালীনতাকে যুক্ত করে স্বকীয় উপস্থাপনায়:
মাঘ শেষ না হতে বাতাসের চোখে লাল শামিয়ানা
পাগলপারা—বাগানের ঘরে ঘরে ডাক দিয়ে যায়:
‘ওঠো! তোমার আর একেলা ঘুমিয়ে থাকা নয়!’ও শিমুল! এভাবে আর কত!
সভ্যতার বীজ নিয়ে শিখিয়েছো
ফাল্গুন এলে প্রেয়সীর সিঁথি এবং প্রয়োজনে রাজপথ
কিভাবে রাঙাতে হয়; আমরা মেনেও নিয়েছি।
তাই তো ফাগুন এলে আমার বোন পলাশের মালা গাঁথে,
এবং আমি আমার যুবতীর খোঁপায় দিই প্রস্ফুটিত লাল;
আর উদাস দুপুরে খুঁজে ফিরি
আমাদের অস্ট্রিক আত্মীয়ের পদচিহ্ন—
যে তার যুবতীকে নিয়ে
বরেন্দ্রীর শিমুলচিহ্নিত ইতিহাসের রাঙাপ্রান্তরে লুকিয়ে আছে।
(শিমুলচিহ্নিত ভালোবাসা: শেষ হেমন্তের জোছনা)
আমরা আমাদের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের অশনি সংকেত শুনতে পাচ্ছি। প্রকৃতিবোধ বা প্রকৃতচেতনা এখনো সর্ব শ্রেণীর মানুষের কাছে পৌঁছেনি। কারণ তারা মানসিকভাবেই প্রকৃতি বিচ্ছন্ন। বিপন্নতা ও অস্তিত্ব সংকট সম্পর্কে এখনও ওয়াকিবহল নয়। কিংবা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। আমাদের মিডিয়াও সঠিকভাবে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ। কিন্তু ইতোমধ্যেই প্রকৃতির এই বিপর্যস্ততায় উদ্বিগ্ন এসময় থেকে এগিয়ে থাকা মানুষেরা, কবি ও শিল্পীরা। তারাই মনে করতে পারেন ‘বৃক্ষরোপণ’ ছেলে মেয়ের বিবাহ অনুষ্ঠান থেকে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। প্রকৃতি চেতনার, প্রকৃতি পোষণার এই চৈতন্যবোধ আমাদের সংস্কৃতির মধ্যেই ছিল। নানান ব্রতকথা এর প্রমাণ। আজ আমাদের প্রকৃতির ক্ষয়িষ্ণুতার মধ্যেএসে প্রকৃতিমুখীনতার এখন জীবনের একটা দায়। তারই প্রকাশ ঘটেছে এ সময়ে নানা প্রকৃতি আন্দোলনে, লেখালেখিতে। এই প্রকৃতি দেখার মধ্যেই টোটালিটিকে স্পর্শ করার চেষ্টা:
একদিন আকাশের ডাক শুনেছিলো বলে
সবুজ বৃক্ষেরা ডানা মেলেছিলো
আর সমবেত সংগীতে বেড়েছিলো
পাখনার বেগ;
ফলে মৃত্তিকার সংসারে জেগেছিলো মায়া।একদিন মেঘেদের চুমু খেয়ে
ভালোবাসা শিখেছিলো মৃত্তিকা-দুহিতা;
একদিন অতীত ভবিষ্যৎ হতে চেয়েছিলো বলে
বর্তমান হাঁটতে শিখেছিলো।
আজ নেই ডাক, চুমু কিম্বা স্বপ্নিল প্রচ্ছদ
তাই বৃক্ষেরা জড়ভরত, নদীও গায় না বৃষ্টিসংগীত।
(একদিন: শেষ হেমন্তের জোছনা)
আমির আধিক্য পাঠকের শিল্পরস গ্রহণে সমস্যার সৃষ্টি করে কিনা তা একটু ভাবার বিষয়। সরাসরি শিল্পী নিজের উপস্থিতি, নিজের বিশ্বাস বা দর্শনের আলোয় আলোকিত অথবা মতবাদ প্রচারের হাতিয়ার হয়ে শিল্পকর্মটি অনেকের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে পারে। কবিও তো একজন ব্যক্তি মানুষ। একক ব্যক্তির নিজস্ব আদর্শ বা বিশ্বাস সব মানুষের পক্ষে গ্রহণীয় নাও হতে পারে। শিল্প সাহিত্যে আনন্দের একটা আসন থাকে। সরাসরি একক ব্যক্তির মত বিশ্বাস বা আনন্দ পাঠকের আনন্দ নাও হতে পারে। এ থেকে শিল্পে উপস্থাপিত হয় (Absence) অনুপস্থিতি।
এরকম Absence কে আমরা লক্ষ করব প্রাচীনকালে লিখিত কিছু শিল্পকর্মেও। ব্যাসদেব বাল্মীকি প্রমুখ পুরনো দিনের কবিগণ তাদের রচনায় Absence -এর উপস্থাপন করেছেন। তাদের রচনায় বোঝার উপায় নেই তারা কোন মতবাদ বা ধারণায় বিশ্বাসী।
কবিতায় এজাতীয় Absence-ধর্মী কিছু কবিতা আমরা দেখতে পাই কবি আমিনুল ইসলামের কাব্য গ্রন্থগুলোয়। তার কবিতায় এই Absence ধর্মিতা এসেছে অনেক ক্ষেত্রেই আখ্যানধর্মিতার মধ্য দিয়ে। এজাতীয় কবিতাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: ‘কবি ঘোড়া ও রাজকন্যার গল্প’ কবিতাটি তিনি মার্শাল ম্যাকলুহামের ‘গ্লোবাল ভিলেজ’ থেকে বিশ্বায়ন সম্পর্কিত যে ধারণার উৎপত্তি তার আলোকেই রচনা করেছেন। বিশ্বায়নের ভালো-মন্দ দুটো দিকই রয়েছে। Globalization বা বিশ্বায়নের দাপটে আমাদের পরিবেশ—প্রকৃতি সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য ও ঐতিহ্য যে আজ হুমকির মুখে, তাই আখ্যানের আশ্রয়ে তিনি চিত্ররূপ দিতে প্রয়াস চালিয়েছেন। কার্ল মার্ক্স বলেছেন, ‘যখন সূর্য ডুবে যায়, পতঙ্গ তখন আলোক বর্তিকা খোঁজে।’ আমিনুল ইসলামের কবিতার নিবিড় পাঠে তা অনুভব করব:
গৌড়-রাজার একটি ঘোড়া ছিল: জওয়ান,বলিষ্ঠ ও দীর্ঘদেহী;
আর ছিল শব্দ নিয়ে খেলায় জাগলারের মতো পারঙ্গম এক কবি;
রাজা তাকেও বাগানবাড়ির এক কোণে রাজাশ্রয় দিয়েছিলেন।
ছোলা খৈল আর সবুজঘাস ঘোড়াটিকে শৌর্যবীর্যের উপমায়
ভরে তুলেছিল; আর তার কাছে অবারিত ছিল রাজকন্যার যাতায়াত।
ঘোড়াটির কেশরদোলানো হ্রেষাধ্বনি প্রেমিকের আহ্বানের হাওয়ায়ী
প্রজ্ঞাপনের সমতুল ছিল; সবুজমাঠের বাতাস ফেঁড়ে তার দূরন্ত
ছুটে চলা যৌনাত্মক ব্যঞ্জনায় ভরে তুলতো দু’পাশ। মনে হতোপৃথিবীর অঙ্গ ভেদ করে ছন্দেতালে ছুটে চলেছে দুরন্ত বাৎস্যায়ন;
দু’পাশের গুল্মলতা ঝড়ের বেতবনের মতো হেলে পড়ছে তেজস্বিত
রোমাঞ্চের ধাক্কায়। অভিভূত রাজকন্যা নিজেকে পৃথিবী ভেবে
উজানসুখে পুলকিত হয়ে উঠতো গোপনে। ঘোড়াটি ঘর্মাক্ত গা
চাটতে চাটতে হাঁপাতে থাকলে রাজকন্যা হাত বুলিয়ে দিতো পিঠে।নিভৃতচারী কবির ব্যতিক্রমী দিনযাপনও একদিন রাজকন্যাকে
কৌতূহলী করে তুলে। প্রাণিত কবি আকাশে ভাসমান গাঙের
ওড়না এবং দিগন্তে রচিত মহাদৃশ্যের বর্ণনায় অপরূপ আখমাড়াই
কলের মতো হয়ে উঠলে ঘোড়াটিকে সেখানে নিয়ে যাওয়ার
ভাবনায় পেয়ে বসতো রাজকন্যাকে। কিন্তু সময়ছিদ্রকারী গতি
নিয়েও ঘোড়াটি সেখানে পৌঁছুতে পারেনি কোনোদিন।অধিকন্তু, কবি গোধূলির আকাশটা নামিয়ে রাজকন্যার হাতে
দিলে সোলেমানী তখতে চড়ে উধাও হয়ে যেতো তার মন।
আর ইথারের ঢেউ থেকে ছন্দ ও সুর ছেনে রাজকন্যার কথায়
জুড়ে দিতেই তা সংগীত হয়ে উঠতো; অন্ধকারের নির্জন
শয়নকক্ষেও রাজকন্যার কণ্ঠে এসে ভিড় জমাতো কোকিল-
শ্যামা-দোয়েল। ঘোড়াটি এসব আঁচ করতে পেরে চিঁহি চিঁহি
ডাকের ফ্রিকোয়েন্সি বাড়িয়ে নিঃসৃত আরকে আদ্র করে তুলতো
রাতের বাতাস; সে বাতাস উন্মুক্ত বাতায়নের প্রশ্রয়ে ছুঁয়ে ফেলতো
আসক্ত জাগরণের শরীর; কখনো বা সে ডাক রাজকন্যার
সোলেমানী তখ্ত ছুঁয়ে গতিমন্থরতা এনে দিতো তার গায়ে।একসময় অঘোষিত প্রতিযোগিতা নীরব দ্বন্দ্বে রূপান্তরিত হলে
নিগূঢ় সিদ্ধান্ত অনিবার্য হয়ে ওঠে। ব্যতিহার বহুব্রীহিতে আক্রান্ত
রাজকন্যা অদৃশ্য জ্যেতিষীর গোপন পরামর্শে কোয়ান্টাম-
মেথডের আশ্রয় নেন; জ্যোতিষীকে ধন্যবাদ; কিছুদিন যেতেই
কবির শব্দ-ছন্দ-সুর নিয়ে যে জাগলারি, তার গাণিতিক অসারতা
এবং বিপরীত পক্ষের প্রমত্ত আনন্দদায়কেষু সম্ভাবনা স্পষ্ট
হয়ে ওঠে ধ্যানরত দৃষ্টির আলো-আঁধারিতে।তথাপি রাজকন্যা রাজকীয় ঐতিহ্যের প্রতি প্রকাশ্য অসম্মান
প্রদর্শনে বিরত থাকেন। উপসংহার রঙের একটি পাঞ্জাবী-
কবি তাতে নিজহাতে নক্ষত্রের বোতাম লাগিয়ে জড়িয়ে নেন গায়ে;
অতঃপর দিগন্তমুখি হাঁটতে হাঁটতে বিকেলের রোদের মতো
মিলিয়ে যান উদ্ভাসিত নদীর মোহনায়। এই নিয়ে কারো
মাথা ব্যথা কিংবা কৌতূহল ছিল না; এখনো নেই। এদিকে
ব্যাচেলর ঘোড়াটিকে বিশ্বায়ন প্রযোজিত শপিং মলে
মাঝে মাঝে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী সংগ্রহে ব্যস্ত হতে দেখা যায়।
(ঘোড়া ও রাজকন্যার গল্প: শেষ হেমন্তে জোছনা)
শিল্পে যুক্তি কাঠামো একটি স্বকৃত ব্যাপার। একটি নির্দিষ্ট বিষয়কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে কবিতা। তাই যুক্তির পরম্পরা যে অনিবার্য যুক্তি সিঁড়ি বেয়ে একটি কবিতা পৌঁছে যায় স্থির সিদ্ধান্তে।পাঠকও যুক্তির দড়ি ধরে বারবার পৌঁছতে পারেন তার গন্তব্য বিন্দুতে। পরিকল্পিত ও উপযুক্ত টাইটেল থেকেই কবি ও পাঠকের ভাবনাতন্ত্র তৈরি হয়। এখানে প্রস্থান চলাচল ও গন্তব্য সুনির্দিষ্ট। কিন্তু শিল্প সৃষ্টি পূর্ব প্রতিশ্রুতিই হলো নতুন দিকে উন্মোচন। এই দিক উন্মোচন নানাভাবে হতে পারে। একেকটি কবিতায় তা একেক রকম। একেকজন কবির হাতে তাও তার স্বাতন্ত্র্য নিয়ে।
বায়ুস্পর্শে পর্ণমোচীর পাতায় হলদে শিহরণ;
নন্দিনীর কোমরে হাত দিতে দেখি:
নদী নেই,
পার্কের খালে ঘুরে মরে স্রোতেলা অস্তিত্ব;
হয়তোবা মৌসুমও এসে যায় মেনোপজে!আর শ্যামলীকে চাঁদকানা করবে-
এমত প্রকল্পে
উত্তরের হাওয়া ওড়ায় লাল ইটের গুঁড়ো।
তবু এই ঘোরলাগা সন্ধ্যায়
জোছনা কুড়োবো বলে
‘সীমাবদ্ধ জলে সীমিত সবুজে’
মাইক্রো-ক্রেডিটের মতো মন বিছিয়েছি।
(শেষ হেমন্তের জোছনা)
কবিতাটি পাঠে বোঝা যায় অনেকাংশে এখানে যুক্তিচাপকে অগ্রাহ্য করা হয়েছে। বিজ্ঞানী পাউলিং কথিত যুক্তিফাটল বা লজিক্যাল লেফট এইসব কবিতায় অর্থহীন নয়। প্রচলিত অর্থ ইপ্সাকে অতিক্রম করে কবিতা এখানে প্রবেশ করেছে অনন্ত অর্থ ঐশ্বর্যের পরিসরে। ‘শেষ হেমন্তের জোছনা’ এখানে অসংলগ্নতার মধ্যে খোঁজা হয়েছে অর্থময়তাকে, বিশৃঙ্খলতার মধ্যে শৃঙ্খলাকে। যা এক আশাবাদ—‘সীমাবদ্ধ জলে সীমিত সবুজে/ মাইক্রো-ক্রেডিটের মতো মন বিছিয়েছি।’ তিনটি পূর্ণ বিরতিচিহ্ন বা দাঁড়ি দিয়ে শেষ হয়েছে। লক্ষণীয় এই তিন বিরামচিহ্নবদ্ধ পঙ্ক্তি যদি ওপর নিচে এনে সাজাই তাতেও কবিতা অর্থহীন হয়ে পড়ে না। আমরা অবশ্যই ধারণা রাখি কবি কখনো তার কবিতার শরীরে এ জাতীয় ব্যভিচার কামনা করেন না। কিন্তু এ রকম একটি বৈশিষ্ট্য যে এ কবিতা ধারণ করে আছে তা বাস্তব।
লেখকের পরিমাপ করা উচিত তাঁর পরিণত বয়সের লেখা দিয়ে। তার গ্রন্থ থেকে গ্রন্থে উৎরে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় তিনি কতখানি স্বতন্ত্র ও সফল। তাতে বোঝা যায়, তাঁর ধারাবাহিকতা কেমন ছিল। সময়ের সঙ্গে নিজেকে পরিবর্তন করতে পারে না এক সময স্মৃতি ও পরে বিস্মৃত হয়ে পরে কবি ও কবিতা আর যারা টিকে যান তারা সুনাম ভাঙ্গিয়ে পুরনো বিষয়েরই পুনরাবৃত্তি করে চলেন, লেখার গ্রাফ উর্ধ্বগামী হওয়ার বদলে নিম্নগামী হয়ে পড়ে। অনেকের ক্ষেত্রে এ অভিযোগ চললেও অনেকের ক্ষেত্রে তা চলে না। কবি আমিনুলের প্রথম গ্রন্থের যে স্ফুলিঙ্গের দেখা পাই ‘মহানন্দা এক সোনালি নদীর নাম’-এ তা শিখা এবং ‘শেষ হেমন্তের জোছনা’ কিংবা ‘কুয়াশার বর্ণমালা’য় তা কুণ্ডুলির মতো প্রজ্জ্বলিত হয়ে ওঠে।
আমিনুল ইসলামের মধ্যে এক সপ্রতিভ দীপ্তি আছে। রুচি মনন ও বুদ্ধির প্রাখর্যে তার কবিতা সহলেখকদের চেয়ে আলাদা, স্বভাব সুন্দর। প্রায় ক্ষেত্রে নাতিদীর্ঘ (দু’একটি ছড়া) এবং সম্ভ্রান্ত ও সুদর্শন, সহজ ও প্রতীকী, শুদ্ধ ও শান্ত, প্রেম ও শোকের। মাটি মানুষ ও প্রকৃতির আর্তিতা কবিতার মূল সুর হলেও কবির আত্ম-অভিজ্ঞতার মর্মকথা এবং সমকালীন জীবনের চিত্র এসব কবিতা।
বিজ্ঞাপনে দিন হাসে,
নামঞ্জুর স্বপ্নে খেলে রাত;
এভাবেই ক’ বছর।
মামা নেই—
বৈবাহিক সূত্রটুকু ভবনে পৌঁছেনি।
তাই নিয়ম আমাকে জানে সৎপুত্র।ও নিয়ম। ও আমার বিমাতার বর।
. তুমি মোর হও তবে কে?
(নিয়মের সৎপুত্র: শেষ হেমন্তের জোছনা)আমাদের চারপাশে বিস্তারিত কচুক্ষেত
সেই ক্ষেতে খোলা হাওয়ায় দোলে
বামনচাষের হাসি
আমাদের মাটিবর্তী দেহ, শয্যাবতী মন
ঘাড়ে ব্যথা নিয়ে তবে আর কাম কি
আকাশবর্তী তালগাছের শাখায় ঝুলে থাকাবাবুইয়ের স্বর্গ দেখে!
তাই তো আমরা ইতিহাসের উঠোন থেকে
কুড়াল এনেছি-কুড়াল
আমরা অনার্যের ওয়ারিশ কি না!বটগাছের দিন শেষ
আমগাছের গোড়ায় শেষ সামন্তের জল
অতএব কচুক্ষেত;
(কচুক্ষেতের হাসি: কুয়াশার বর্ণমালা)
এ আমাদের সাম্প্রতিক জীবনের কুৎসিত রূপ, রাজনৈতিক, আমলাতান্ত্রিক সামাজিক বাস্তবতার নিখুঁত নিপুণ শিল্পচিত্র। রক্তাক্ত যন্ত্রণা নিয়ে কবি পিছিয়ে থেকেও প্রত্যক্ষ করেছেন জ্ঞানহীন দৌড়পটুদের অন্যায্য উত্থান। আমাদেরই চলতি জীবনের করুণ ক্রীড়া।
কবিতা কেবল বোধের বাহন নয়, চোখেরও ফুর্তি। পাঠককে চাক্ষুষ সৌন্দর্য দানে সক্ষম এই কাব্যকলা—ভাবতে যেমন প্রলুব্ধ করে শব্দে গড়া বস্তুদৃশ্যও নয়নাভিভূত করে। বস্তু-প্রণোদিত এমনই একটি প্রাচীন ফর্মের নানা অনুষঙ্গ ঐতিহ্য (বিশেষ করে নদীমাতৃক জীবন, ও যান্ত্রিক জীবনের ছবি) ইতিহাসও চলে এসেছে কবি আমিনুলের কাব্যধ্যানে। সমকালীনতার উপরে দাঁড়িয়ে অতীত বর্তমান আর ভবিষৎকে এক সূত্রে গেঁথেছেন তিনি শিল্পে। তার এই সমাকালীন শিল্প চেতনার ধ্যানই পৌঁছে দেবে কালের ওপারে। আমরা আশাবাদী।