যৌনতা ও আধ্যাত্মিকতার সুসংমিশ্রিত উপস্থাপনা দিয়ে বাংলা কবিতার যাত্রা শুরু। এই যাত্রার সূচনাবিন্দু হচ্ছে চর্যাপদ। চর্যাপদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য এই যে—এখানে শুচিবায়ুগ্রস্ততা নেই । চর্যাপদে মানুষের আটপৌরে শ্লীল-অশ্লীল মুখের ভাষাকে কবিতার ভাষা হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। অতপর কবিতা নিয়েছে দেব-দেবী-ঈশ্বরের নানন্দীপাঠের রূপ। মানুষ নয়, দেবতা-অসুর—এরাই হয়েছে কবিতার বিষয়-আশয়।
ধর্মগ্রন্থসমূহের মতো সব বর্ণনা ও বক্তব্য পথ খুঁজে পেতে চেয়েছে ঈশ্বরের মহিমাকীর্তন ও করণা-কামনায়। মধ্যযুগে মূলত বাঙালি মুসলমান কবি-পুঁথিকারদের হাতে কবিতার বিষয় পাল্টে যেতে থাকে। তারা ঈশ্বরের পরিবর্তে মর্ত্যের নরনারীর প্রেম এবং শৌর্যবীর্যকে কবিতার কেন্দ্রীয় বিষয় করে তোলেন। এ সকল কবিতা উপাখ্যানের শুরুতে ঈশ্বরের প্রশংসাসূচক ভূমিকা থাকতো। সেটা শুধু ভূমিকা, মূল বিষয় নয়। দেবদেবী বা ঈশ্বরের পরিবর্তে রক্তমাংসে তৈরি মাটির মানুষের প্রেম-ভালোবাসা, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, জয়-পরাজয়, ধর্ম-অধর্ম, যুদ্ধ-শান্তি ইত্যাদি বিষয় কবিতার কেন্দ্র হয়ে ওঠে।
ইংরেজদের আগমেনের পর বাংলা ভূণ্ডে জন্মগ্রহণকারী একদল উচ্চশিক্ষিত তরুণ-যুবক পশ্চিমাসাহিত্যের সংসম্পর্শে আসেন; তারা উপন্যাস, ছোটগল্প, মহাকাব্য, সনেট অমিত্রাক্ষর ছন্দ প্রভৃতি বিষয় রপ্ত করেন। এবং বাংলা ভাষায় সেসবের চর্চা শুরু কেন। তাদের সফল শিরোমণি ছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তিনি প্রথম বাংলা ভাষায় মহাকাব্য, সনেট এবং অমিত্রাক্ষর ছন্দে কবিতা লেখেন। তিনি প্রচলিত বিশ্বাসের বিপরীতে রামচন্দ্রকে আক্রমণকারী এবং রাবণকে দেশপ্রেমিক হিসেবে উপস্থাপন করেন। বিষয় ও প্রকরণ উভয় দিক থেকেই এটি বাংলা কবিতার একটি বড় বাঁক বদল।
ওজনদার শব্দের পাশাপাশি তিনি কবিতায় আরবি-ফার্সি-উর্দু শব্দের ব্যবহার ঘটান সর্বাধিক সফলতায়। তাঁর হাতে কবিতা হয়ে ওঠে অরুগ্ন বলিষ্ঠ এবং হিংস্র—এক কথায় সাবলাইম। তিনিই কবিতায় মনের সাথে শরীরকে উপস্থাপন করেন সমান গুরুত্ব দিয়ে।
মধুসূদনের পর রবীন্দ্রনাথ নিয়ে আসেন উৎকৃষ্ট রোমান্টিক গীতিকবিতার ভাণ্ডার। তিনি বাংলা সাহিত্যের একটি সুরুচি তৈরি করে দেন। পরিশীলন এবং পরিমিতি বোধ তাঁর কবিতার একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। অশ্লীলতা, ভালগারিজম, যৌনতা এসব এড়িয়ে গেছেন তিনি। মানুষের শরীরিক চাহিদার চেয়ে তার হৃদয়িক পিপাসাকে প্রধান্য দিয়ে রচেছেন প্রেমের কবিতা। তাঁর হাতে বাংলসাহিত্য এবং বাংলাভাষা দুই-ই সমৃদ্ধ হয়েছে অতুলনীয় পরিমাণে। এরপর নজরুল আনেন কবিতাগানে-প্রবন্ধে বাঁধভাঙা জোয়ার। আধুনিক কালের সাহিত্যে মুসলমানদের জীবন ছিল অনুপস্থিত। নজরুল সে শূন্যতা পূরণ করে দেন একাই এবং একহাতেই। তিনি কবিতায় অপ্রচলিত শব্দের ব্যবহার ঘটান। তিনি হিন্দু-মুসলিম মিথ ও ইতিহাসকে তুলে ধরনে তাঁর কবিতায়। বাংলা কবিতা বাঙালি হিন্দু-মুসলমান সকলের কবিতা হয়ে ওঠে। ওজনদার শব্দের পাশাপাশি তিনি কবিতায় আরবি-ফার্সি-উর্দু শব্দের ব্যবহার ঘটান সর্বাধিক সফলতায়। তাঁর হাতে কবিতা হয়ে ওঠে অরুগ্ন বলিষ্ঠ এবং হিংস্র—এক কথায় সাবলাইম। তিনিই কবিতায় মনের সাথে শরীরকে উপস্থাপন করেন সমান গুরুত্ব দিয়ে। তিনি গণমানুষের পক্ষ নিয়ে কবিতাতে একটি গণতান্ত্রিক ও গণমুখী চারিত্র্য দান করেন। তিনি নারী-পুরুষের বৈষম্যবিরোধী কবিতা রচনা করেন। তিনি প্রচলিত পাপ-পুণ্য, বারাঙ্গনা, সতী, অসতী, চোর, ডাকাত—ইত্যাদিবিষয়ক প্রচলিত ধারণার মূলে কুঠারাঘাত করেন। এভাবেই বাংলা সাহিত্যে তাঁর হাতে সূচিত হয় আধুনিকতা।
নজরুলের পর পঞ্চপাণ্ডব বাংলা কবিতায় আধুনিকতার জোয়ার বইয়ে দেন। তারা কবিতায় আধুনক নাগরিক জীবনের ক্লেদ. বিবমিষা, নৈরাশ্য, হতাশা, নৈঃসঙ্গ, স্রষ্টার প্রতি অবিশ্বাস, অনিকেত অস্থিরতা প্রভৃতি বিষয়কে কবিতায় সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে উপস্থাপন করেন। তাঁরা কবিতার আঙ্গিকেও ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে আসেন। তাদের মধ্যে জীবনানন্দ দাশ নিজেকে আধুনিক বাংলা কবিতার সম্রাট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। চিত্রকল্প ও উপমায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনেন জীবনানন্দ । তিনি ঈশ্বরভাবনায় নীরব থেকে সম্পূর্ণরূপে ইহলৌকিক কবিতা উপহার দেন। তিনি কবিতায় সারাবিশ্বের মিথ ও ইতিহাসকে ব্যবহার করেছেন অসীম দক্ষতায়। যত সময় গেছে, পাঠকমহলে তাঁর কবিতা উত্তরোত্তর জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
সুকান্ত ভট্টচার্য্য সাম্যবাদের কবিতা উপহার দেন। তবে তাঁকে সাম্যবাদী নজরুলের এক ধরনের সম্প্রসারণ বলা যেতে পারে। এরপর ফররুখ আহমদ বাংলা কবিতায় নিয়ে আসেন মধ্যপ্রাচীয় মিথ ও ইতিহাসের জোয়ার। তবে ফররূখ সূচিত ধারা বেশিদূর আগ্রসর হতে পারেনি। জসীমউদ্দীন বাংলা কবিতাকে শহর থেকে গ্রামে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে কিংবা গ্রামবাংলাকে আধুনিক বাংলা কবিতার পাঠকের নিকট উপস্থাপনের নিয়ত নিয়ে রচেন অজস্র কবিতা। সেসব প্রমিত বাংলা ভাষায় রচিত, তবে প্রকরণের দিক থেকে পণ্ডিতদের মতে আধুনিক নয়। পশ্চিমবঙ্গে শক্তি চট্টোপাধ্যায় কবিতায় আটপৌরে, কথ্য, এবং কিছু কিছু অশ্লীল শব্দ যুৎসই ও সাহসী ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলা কবিতার মেজাজে, রুচিতে এবং নির্মাণকৌশলে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সাধন করেন।
প্রায় সমসময়ে এদেশে শামসুর রাহমান এবং আল মাহমুদের আবির্ভাব। শামসুর রাহমান প্রথমে বোদলেয়ারী-কাম জীবনান্দীয় ভাবধারার কবিতা লিখলেও দ্রুত পাল্টে যান। বাংলাদেশের চলমান ইতিহাস ও সংগ্রাম এবং নর-নারীর প্রেম তাঁর কবিতার কেন্দ্রীয় বিষয় হয়ে ওঠে। শামসুর রাহমান বাংলা কবিতাকে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় করে তোলেন। অন্যদিকে মফস্বল টাউন থেকে উঠে আসা আল মাহমুদ জীবনানন্দ দাশ এবং জসীম উদদীনকে সফলভাবে স্বীকরণ এবং এশিয়ার ইতিহাস-ঐতিহ্যকে সযত্নে লালন করে খাঁটি বঙ্গদেশীয় বা এশীয় কবিতা উপহার দেন পাঠকদের। তিনি বাংলার লোক-জীবনের নানাবিধ উপকরণ সহযোগে আধুনিকতম প্রকরণে লিখেছেন অজস্র বাংলা কবিতা। তাঁর কবিতা বাংলার মাটির গভীর থেকে উঠে এসেছে; আবার তিনি একইসঙ্গে অনেক অলংকার গ্রহণ করেছেন আর্ন্তজাতিক ভূগোল থেকে। তাঁর কবিতা পঞ্চপাণ্ডবের কবিতার মতো ধার-করা-বোধানলে-দগ্ধ বাংলা ভাষায় রচিত ইউরোপীয় কবিতা নয়, আবার সেগুলো জসীমউদদীনের পল্লীকবিতাও নয়। বলা যেতে তাঁর কবিতা হচ্ছে এই দুয়ের স্বীকরণ ও সুসমন্বিত সংমিশ্রণ।
কেউ কেউ বিষয়-রিক্ত কবিতা লেখার মাঝে আত্মপ্রতিষ্ঠা ও আত্মমহিমা প্রচারের প্রয়াস পেয়েছেন। দলবদ্ধতা ও গোষ্ঠীবদ্ধতা এই সময়ের কবিতা চর্চার একটা প্রধান দিক। তাছাড়া জ্যেষ্ঠকবিদের কবি-কীর্তিকে অস্বীকার করার একটা প্রবণতাও কাজ করেছে এদের মাঝে।
আমার মনে হয়—এটি আধুনিক বাংলা কবিতার সর্বোৎকৃষ্ট রূপ। ষাটের দশকে নির্মলেন্দু গুণদের বিপ্লবী কবিতার পাশাপাশি আবুল হাসানের হাতে বাংলা কবিতা এদেশের পলিমাটির রসে সিক্ত বেদনার কবিতা এবং আবদুল মান্নান সৈয়দের হাতে পরাবাস্তব সৃষ্টি হয়ে ওঠে। তবে কোনোটাই ততোটা বেগবান হতে পারেনি।
অতপর যুদ্ধ। স্বাধীনতা। সত্তরের দশকে কবিতা হয়ে স্বদেশপ্রেম আর বিপ্লবের স্বপ্নে, সাফল্যে ও ব্যর্থতায় সোচ্চার, কিছুটা উচ্চকণ্ঠও। আশি ও নব্বইয়ের দশকের কবিরা কবিতার বিষয়গত ও প্রকরণগত নিরীক্ষায় মনোনিবেশ করেন। তারা বিষয়কে গুরুত্ব দেননি। কবিতার একটি কেন্দ্রীয় বিষয় থাকতেই হবে—এমন দাবি এ সময়ে কবিরা অগ্রাহ্য করেছেন। উত্তরাধুনিকতার প্রভাব পড়েছে এই সময়ের কবিতায়। কেউ কেউ বিষয়-রিক্ত কবিতা লেখার মাঝে আত্মপ্রতিষ্ঠা ও আত্মমহিমা প্রচারের প্রয়াস পেয়েছেন। দলবদ্ধতা ও গোষ্ঠীবদ্ধতা এই সময়ের কবিতা চর্চার একটা প্রধান দিক। তাছাড়া জ্যেষ্ঠকবিদের কবি-কীর্তিকে অস্বীকার করার একটা প্রবণতাও কাজ করেছে এদের মাঝে। আরেকটি বিষয় উল্লেখ্য, পশ্চিমের পোস্ট মডার্ন তত্ত্বের আলোকে পশ্চিমবঙ্গের একদল কবি তাদের মতো করে উত্তরাধুনিক বাংলা কবিতা লেখার প্রয়াস পান। তাদের কবিতা-চর্চায় বাঙালির শেকড়ে ফিরে যাওয়ার ঘোষিত অভিপ্রায় আছে। এবং সেটা কখনো কখনো বিশুদ্ধ হিন্দুত্বে ফিরে যাওয়ায় পরিণতি লাভ করতে চেয়েছে।
বাংলাদেশের তরুণ কবিদের কেউ কেউ সেটাকেই প্রকৃত বাংলা কবিতা ভেবে সেপথই অনুসরণ করতে চেয়েছেন। এদের কেউ কেউ জন্মগত পারিবারিক নাম (মুসলিম নাম) পাল্টে বিশুদ্ধ বাঙালি নাম গ্রহণের মতো অনর্থকতায়ও উৎসাহ দেখিয়েছেন। শূন্য ও প্রথম দশক এখন পর্যন্ত কিছু উজ্জ্বল ব্যতিক্রম ছাড়া আশি-নব্বই-দশকের কমবেশি সম্প্রসারণ হয়ে রয়ে গেছে বলা যায়।
আমাদের কবিতার গতিবিধি আমরা একটু দেখে নিলাম। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের কবিতার ভবিষ্যৎ কী অথবা কোন্ দিকে? বাংলা কবিতার অতীত ও বর্তমান সম্পর্কে আমরা কিছুটা আলোকপাত করলাম। আসলে আমাদের দেশে এখন যারা বাংলা কবিতা লিখছেন, তাদের মধ্যে সাত চল্লিশরে দেশভাগের পর থেকে শুরু করে গত শতকের শেষসময় পর্যন্ত লিখেছেন, (দশকপন্থীরা যাদের পঞ্চাশ-ষাট-সত্তর-আশি-নব্বই দশকের কবি বলেন) সে সব কবি আছেন; তার সাথে যোগ হয়েছে একুশ শতকের কবিরা। (এখানেও দশকপন্থীদের মতে শূন্য ও দ্বিতীয় দশকের কবি)।
গত শতকের শেষ কুড়ি বছরে যারা লিখেছেন, তাদের কাছ থেকে এখন আর নতুন কোনো প্রত্যাশা নেই। তৎপরবর্তী কবিদের হাতেই নির্ভর করছে বাংলাদেশের কবিতার গতিপ্রকৃতি। বর্তমানে এদের অবস্থান সুস্পষ্ট নয়। গোষ্ঠীবদ্ধতা, দলবদ্ধতা, পূর্বজজনদের কবিকীর্তিকে অস্বীকার করা—এ সময়ের কবিদের একটি সাধারণ প্রবণতা। এ সময়ের কবিরা কিছুটা দিশাহীনও বটে। ফলে দলবদ্ধতা। কিন্তু তারা দলদ্ধভাবে এই সময়ের কবিতাকে কোথাও নিয়ে যেতে পারবেন না; শুধু ঘুরপাক খেয়ে যাবেন কেন্দ্রহীন বৃত্তে। আসলে সত্তর দশক থেকে আজ পর্যন্ত নতুন মোড় রচনাকারী তুখোড় কোনো একক মেধাবী কবির আবির্ভাব ঘটেনি আমাদের দেশে। আর যে কোনো সমাজের যে কোনো অবস্থার মোড় ঘোরাতে দরকার হয় তুখোড় মেধাবীদের। গড়পড়তাদের দিয়ে কোথাও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব নয়। আমরা যদি বিজ্ঞানের দিকে দৃষ্টি দিই তো দেখতে পাই—জাবের ইবনে হাইয়ান, গ্যালিলিও, আইজ্যাক নিউটন, মেন্ডেল, ডারউইন, জগদীশচন্দ্র বসু, মার্কনী, রাদারফোর্ড, মাইকেল মাইকেল ফ্যারাডে, ম্যাক্স প্লাঙ্ক, আলবার্ট আইনস্টান প্রমুখ তুখোড় মেধাবীরা তাঁদের সৃষ্টি দিয়ে পাল্টে দিয়েছেন পৃথিবীর দৃশ্যপট। তাঁরা তাঁদের সৃজনশীলতার জগতে কোনো দলবদ্ধ বা গোষ্ঠীবদ্ধ প্রাণী ছিলেন না। অনুরূপভাবে সাহিত্যে নতুন মোড় সৃষ্টি করেছেন—জালাল উদ্দিন রুমী, ওমর খৈয়াম, হাফিজ, সেক্সপিয়ার, গ্যেটে, বোদয়োর, টলস্টয়, পুশকিন, জাঁপল সার্ত্রে, মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, ইকবাল, নজরুল, জীবনানন্দ দাশ, আল মাহমুদ প্রমুখ শাণিত মেধাবীরা। রাজনীতিতেও মহাত্মা গান্ধী, জিন্নাহ, নেহেরু, কেনেডি, মেন্ডেলা, মুজিব-দের ভূমিকা ছিল ক্ষণজন্মা প্রতিভার দান। উল্লেখ্য, চিরকালই এই প্রতিভাধরদের আশেপাশে অনেক গড়পড়তারাও থাকেন। তাদের ভূমিকাও তুচ্ছ নয়। তবে সেটা সহযোগীর বা পরিপূরকের ভূমিকা। নেতৃত্ব সবক্ষেত্রেই এবং সবসময়ই বিরল প্রতিভাধরদের কাজ। সুতরাং আমাদের কবিতায় আরও নতুন বাঁক সৃষ্টি হওয়ার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে ক্ষণজন্মা প্রতিভার আবির্ভাবের পথে।
পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মানুষের চেয়ে এদেশের মানুষ অনেক বেশি আবেগপ্রবণ, সংবেদনশীল এবং কল্পনাবিলাসী। যে-কারণে এদেশে বিজ্ঞানীর সংখ্যা কম, গুণী সমালোচকের একান্ত অভাব, সেই একই কারণে এদেশে প্রকৃত কবি, ঊন-কবি, হাফ-কবির সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে এইযে— বাংলা কবিতার নিজের ভবিষ্যৎ কী? বিশ্বায়নের ফলে সর্বত্র ইংরেজি ভাষা, এবং হলিউডী-বলিউডী সংস্কৃতি জুড়ে বসছে। প্রতিদিন আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গনটি একটু একটু করে দখল করে নিচ্ছে আকাশপথে এবং ইন্টারনেটে-ফেসবুকের পথ ধরে চলে আসা হলিউড-বলিউড। বলা যায়—আমাদের মাতৃভাষাও একধরনের হুমকির সম্মুখীন। আর ভাষা যদি আগ্রসনের শিকার হয়, তবে সে-ভাষার সাহিত্য তো হুমকির মুখে পড়বেই। দিন যত যাচ্ছে, মেধাবী ছেলেমেয়েরা দেশে থাকতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলছে। আর দলবাজি-গোষ্ঠীবাজির কারণে এদেশে কোনো ক্ষেত্রেই মেধাবীরা তাদের মেধার যথাযথ কদর পাচ্ছে না। এটা কবিতার ক্ষেত্রেও প্রয়োজ্য। অথচ ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য চর্চা করলে নানাবিধ আন্তর্জাতিক পুরস্কার পাওয়ার পথ সুগম হয়ে আছে এবং সেপথ দিনদিন বেশি বেশি প্রশস্ততর ও সহজতর হয়ে উঠছে। ভারতের, আফ্রিকার, ল্যাটিন আমেরিকার বহু মেধাবী সাহিত্যিক তো নিজ ভাষা বাদ দিয়ে আজকাল ইংরেজি ভাষাতে সাহিত্য চর্চা করছেন। আমাদের দেশের মেধাবীরাও যে সেদিকে ব্যাপকভাবে ঝুঁকে পড়বেন না, তার কি নিশ্চয়তা আছে?
তারপরও কবিতা চর্চা অব্যাহত থাকবে এদেশে। এদেশের মৃত্তিকা এবং জলহাওয়া কবিতা লেখাবে, গান ভালোবাসাবে এদেশের ভবিষ্যৎ মানুষদেরও। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মানুষের চেয়ে এদেশের মানুষ অনেক বেশি আবেগপ্রবণ, সংবেদনশীল এবং কল্পনাবিলাসী। যে-কারণে এদেশে বিজ্ঞানীর সংখ্যা কম, গুণী সমালোচকের একান্ত অভাব, সেই একই কারণে এদেশে প্রকৃত কবি, ঊন-কবি, হাফ-কবির সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। সেই পরম্পরা ধরেই এদেশে কবিতার ভালো ভবিষ্যৎ রয়েছে। একদিন অবশ্যই তেমন উজ্জ্বল মেধাবী কবির জন্ম হবে এদেশে। তার বা তাদের নবসৃষ্টির প্রবল বন্যায় ধুয়ে যাবে আজকের সাময়িক ব্যর্থতার যাবতীয় জঞ্জাল।