কবিতা ও পাঠক—এই দুয়েরই ‘হয়ে উঠতে হয়’। অনেকেই মনে করেন, কবিতাকেই শুধু কবিতা হয়ে উঠতে হয়, পাঠকের যোগ্যতার তেমন কোনো দরকার নেই। কেউ কেউ তো কবিতার ক্রমবিবর্তন রূপান্তর প্রক্রিয়াটি না জেনেই কবিতার সমালোচনায় কলম ধরেন। এদেরই জীবনানন্দ দাশ ‘অশিক্ষিত পটু’ বলেছিলেন। কবিতার মতো ‘হয়ে ওঠার’ জন্য পাঠককেও সময়ের পরিবর্তনে আর সব সৃজনশীল কর্মের মতো কবিতার পেছনে পরিবর্তমান হতে হয়। নবায়ন করে নিতে হয় চিন্তা-চেতনাকে। দায়টি কেবল পাঠকের কাঁধে চাপিয়ে বসে থাকলেও চলে না। সে-কারণেই জীবনানন্দ দাশ কবিকে নিজের কবিতা বিষয়ে কলম ধরতে বলেছেন। তিনি নিজেও সেই কাজটি করেছেন ‘কবিতার কথা’য়।
প্রাচ্য-পুরাণে কবিকে ‘সত্যদ্রষ্টা পণ্ডিত’ ও ‘তত্ত্বজ্ঞ’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কবি সমকাল থেকে এগিয়ে থাকেন—চিন্তাচেতনা ও ভাষায়। তিনি ত্রিকলাজ্ঞও বটে। পরন্তু বিশ্বভাষী ও বিশ্বমানবও। সে জন্যই কবিতা হয়ে ওঠে। দূর ও নিকট, কাল ও মহাকালের সব ভালো ও মন্দকে, আনন্দ ও বেদনাকে ধারণকারী মানবজীবনের গহনগামী এক শিল্পমাধ্যম কবিতা। ফলে কোনো কবি যখন কবিতা বিষয়ে কিছু বলেন, পাঠক তখন কাব্যবোধতন্তুর লাইনটি হাতে পেয়ে যান। কাব্যসমালোচনা নানামুখী, নানামাত্রিক। এই বহুমাত্রিকতার মধ্যেই, সমস্ত বিতর্কের শব্দজাল সরিয়ে, সচেতন পাঠক একটি স্বচ্ছ বোধের বর্গে এসে দাঁড়াতে চান। তারপরও কবিতা আরও উন্মোচনের অপেক্ষা রাখে। কারণ শেষ পর্যন্ত কবিতা একটি অমীমাংসিত সত্য।
এমার্সনের মতে—‘মনে মনে সব মানুষই কবি।’ তার বহু আগেই হোরেস বলেন—‘যে লোক কবিতা সম্পর্কে কিছুই জানে না, সেও কবিতা রচনার ধৃষ্টতা দেখায়।’ হোরেস আমাদের জীবনানন্দ দাশের ‘কেউ কেউ কবি’র কথা স্মরণ করিয়ে দেন। এই ‘কেউ কেউ কবি’কে বোঝার জন্য যে প্রজ্ঞা ও চেতনার প্রয়োজন, পাঠকের ভেতর সেটি তৈরি করা খুব সহজ কাজ নয়। দুরূহ এই কাজটি করতে যেমন প্রচুর পঠনপাঠন দরকার, তেমনি প্রজ্ঞা ও হিম্মতেরও প্রয়োজন আছে। সততার সংজ্ঞায় যেমন নিজে সৎ থাকলেই চলে না, অন্যের অসততাকেও প্রতিরোধ করা বোঝায়, একজন সৎ ও মহৎ কবির দায়িত্বও সে রকম। কবি আবু হাসান শাহরিয়ারের কবিতাবিষয়ক গদ্যগুলো এই ধারার। তার কিংবা অন্যের কবিতা বোঝার জন্য এই গদ্যগুলো হাজার দুয়ারি কবিতাঘরের চাবি।
এজরা পাউন্ড প্যারিস রিভিউ পত্রিকায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন—‘যে কেউ কবিতা লিখতে পারে।’ শাহরিয়ার এ কথা বলেন না। তিনি বোদলেয়ারের মতো কবির মধ্যে একজন সমালোচককেও দেখতে চান। তবে তার দেখার চোখ একটু আলাদা। বোদলেয়ার বলেন- ‘প্রত্যেক বড় কবি স্বভাবতই অনিবার্যরূপেই সমালোচক।… একজন সমালোচক কবি হয়ে উঠলে আশ্চর্য হওয়ার কথা, কিন্তু একজন কবির মধ্যে যদি একজন সমালোচক জেগে না থাকে সেটা আরও আশ্চর্যের’। (শার্ল বোদলেয়ার, তার কবিতা, বুদ্ধদেব বসু)। আর শাহরিয়ার বলেন—‘শাস্ত্রজ্ঞ না-হলেও কবির চলে। কিন্তু কাব্যসমালোচকদের ঘটে কিছু বিদ্যা থাকা চাই।’
অর্ধ শতাব্দীরও বেশি কালব্যাপী নিবিড় নিরন্তর পাঠের ভেতর ‘একার সন্ন্যাস’ যাপন করেছেন এই কবি। রচনা করেছেন পঞ্চাশেরও বেশি গ্রন্থ। জীবনের কোনো দুর্বল মুহূর্তেও ‘একার সন্ন্যাস’ থেকে সরে আসেননি। বরং, মিডিয়াকে আঙুল তুলে দেখিয়ে দিয়েছেন বাণিজ্যশাসিত ভুলগুলো। নিজে পরিশুদ্ধ না-থাকলে সাহস ও প্রজ্ঞার এমন সংশ্লেষণ সম্ভব নয়। কবিতার মতো শাহরিয়ারের গদ্যপাঠেও পাঠককে তাই সু-সচেতন হতে হয়। ইতিহাস-পুরাণসহ কবিতার প্রাকরণিক অতিসাম্প্রতিক রূপান্তরের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ছাড়াও সমকালিন রাজনৈতিক অসারতাকে এমন তীক্ষ্ণ পঙ্ক্তিবাণে বিদ্ধ করেন শাহরিয়ার, যা সম্প্রতি আর কোনো কবির মধ্যে আমরা পাই না। বুদ্ধদেব বসুর মতো তিনিও, কবিতা লেখার পাশাপাশি, প্রতিভাদীপ্ত নিভৃত কবিদের আড়াল উন্মোচনের গুরুদায়িত্বটি পালন করেন। এক্ষেত্রে চেনা-অচেনা, শত্রু-মিত্র, বড়-ছোট কোনো অভিধা দিয়েই কবিকে বিচার করতে নারাজ তিনি। বলেন—‘কবিতাকে বুঝতে কবিতাই যথেষ্ট।’ অর্থাৎ বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা ছাড়া কবিতার কোনো শেষ কথা নেই’ –এর বিবর্তিত উত্তরসাধনা দেখতে পাই আমারা তার গদ্যে। আমাদের দেশের প্রচলিত তথাকথিত ‘মন্তব্যপ্রধান’ কাব্যালোচনা তিনি করেন না। যুক্তি ও বিশ্লেষণ দিয়ে পাঠকের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে ভালোবাসেন, বহুমুখী তর্ক ও প্রশ্নে মেতে ওঠেন এবং শেষ পর্যন্ত পাঠককে নিয়েই একটি মীমাংসায় পৌঁছেন।
আবু হাসান শাহরিয়ারের গদ্য যারা পড়েছেন, তারা জানেন—এই কবির প্রতার্কিক গ্রহণযোগ্যতা কত গভীর ও তীক্ষ্ণ। সমকালীন কবিদের (এমনকি জীবদ্দশায় কবি শামসুর রাহমানেরও; যার সঙ্গে তার গভীর বন্ধুত্ব ছিল) দায়িত্বহীন কাব্যালোচনার তীব্র সমালোচনা করেছেন তিনি। ভালোকে ভালো, মন্দকে মন্দ বলার সৎসাহস রাখেন বলেই শাহরিয়ার খাদ ও নিখাদের পার্থক্য পাঠককে অবলীলায় ধরিয়ে দিতে পারেন। সম্পর্ক তার কাছে কোনো বাধাই নয়। এ প্রসঙ্গে তার ব্যাখ্যা—‘কবিতার নতুন বাঁকের বিশ্লেষণে এই বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেয়া উচিত বলে আমি মনে করি। নইলে সমকালীন এমন অনেক উত্তেজনা প্রশ্রয় পায়, যেগুলোর আদৌ কোনো সাহিত্যমূল্য নেই।’
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর সম্পাদিত ‘অন্য দেশের কবিতা’য় রবার্ট ফ্রস্ট-এর বিখ্যাত পঙ্ক্তিকে কোলরিজ-এর বলে (ভূমিকায়) উল্লেখ করায় শাহরিয়ার সুনীলের ‘অমনোযোগ’কে কটাক্ষ করেন। ঐ কটাক্ষ যে অযৌক্তিক নয়, তার একটি সাম্প্রতিক প্রমাণ আবু মুসা চৌধুরী অনূদিত পরের বাগান-এর ভূমিকা। সুনীল-কৃত ভুলের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে মুসাকৃত ভূমিকায়। শাহরিয়ারের গদ্যের মধ্যবর্তিতা মানলে এ-ভুলটি অনায়াসে এড়ানো যেত। আবার পাবলো নেরুদার ‘এখন আমি লিখতে পারি না’ শিরোনামে সুনীলকৃত অনুবাদে মূল কবিতার দুটি গুরুত্বপূর্ণ পঙ্ক্তি অনেকটা সেই প্রকার, অডেন যাকে ‘মেমোরেবল স্পিচ’ বলেছেন। ‘হয়তো সুনীলের কিছু যায় আসে না। কিন্তু আমার কাছে ওই পঙ্ক্তি দুটি বাদ দেওয়া মানে কবিতাটিকেই খুন করা। মূল স্প্যানিশ দূরে থাক, মারউইনের ইংরেজি অনুবাদের পাশে রেখে সুনীলের বাংলা অনুবাদটি পাঠ করলেই বোঝা যায়, কবিতা শুধু অনুবাদেই নয়, ফাঁকিবাজিতেও হারায়।’ (কবিতার বীজতলা)। -যে ফাঁকিবাজিতে সুনীল গঙ্গপাধ্যায়ের মতো অনেক বিখ্যাতরই কিছু যায় আসে না, আবু হাসান শাহরিয়ার সেখানে আপসহীন। এভাবেই তিনি অন্যদের থেকে আলাদা করেন নিজেকে।
সমালোচক হিসেবে গতানুগতিকের ঊর্ধ্বে ‘গুণবিচারী’ এক বিরল প্রতিভা আবু হাসান শাহরিয়ার। সম্পর্ক উজিয়ে তিনিই শুধু বলতে পারেন—‘এক শামসুর রাহমানের কথাই যদি ধরি, অসংখ্য অপাঠ্যগ্রন্থের মোড়কউন্মোচন করে অনেক অযোগ্যকেই তিনি কবিস্বীকৃতি দিয়েছেন। কলাম লিখেছেন তাদের কবিতা নিয়ে। বিপরীতে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে নীরব থেকেছেন যোগ্যদের সম্পর্কে।’ এরকম স্পষ্ট কথা বলেন বলেই শাহরিয়ার এ-ও জানেন—‘কেউ কেউ অসাহিত্যিক আচরণে আমার প্রতি বিদ্বেষ প্রকাশ করেন। অযোগ্যের হাটে উপেক্ষা আর অবহেলাই যে কাজের পুরস্কার সেকথা আমি জানি। সে-ও এক ধরনের পাঠপ্রতিক্রিয়া। অতএব বামন ও গৌণদের কাছেও আমি কৃতজ্ঞ।’ (আঁতুড়কথন: কবিতা অকবিতা অল্পকবিতা)।
আবু হাসান শাহরিয়ারের ‘কবিতা অকবিতা অল্পকবিতা’ কবি ও কবিতাপ্রেমীদের জন্য একটি অপরিহার্য গ্রন্থ। ভাব থেকেই যে কবিতার জন্ম, ভাবালুতা থেকে নয়, ভাবালুতার মানে যে অতিকথন, বাহুল্য, বিবরণধর্মিতা—যাদের তা জানা নেই, তাদের জন্য এ বইয়ের নামগদ্যটি একটি নির্দেশিকা হতে পারে। বাচ্য আছে, ব্যঞ্জনা নেই, এমন রচনা যে কবিতা নয়—উদাহরণসহ সেই পাঠও আছে গদ্যটিতে। কবিতার Space, চিত্রকল্প, ছন্দ, তারল্য, অল্পকবিতা, অকবিতার বহুরৈখিক পথ হাঁটিয়ে শেষঅব্দি এমন এক বিন্দুতে এনে দাঁড় করিয়েছেন শাহরিয়ার, যেখানে মহার্ঘ কবিতা আর ‘একার সন্ন্যাস’ সমার্থক। তিনি বলেন—‘আমৃত্যু নবায়নযোগ্য থাকতে হলে কবিকে নষ্টদের কাছ থেকে সরে-সরে আসতে হয়।’ তাঁর মতে—‘খাঁটি কবির হাতেও আছে শব্দের ব্রহ্মাস্ত্র। এবং কালান্তরে তাদেরই জয় হয়েছে। এর জন্য সৃষ্টিকামী আড়াল অপরিহার্য। এই আড়াল খাঁটি কবিদের বর্ম, মাঝারি কবিদের পক্ষে তা আয়ত্ব করা সম্ভব নয়। কারণ মাঝারিরা কোলাহলেই বাঁচেন।’ স্বকালেই হারিয়ে যান। কবিকে তত্ত্ব, প্রকরণ, দশক গোষ্ঠী, বড় ও ছোট কাগজ, মঞ্চ ও পুরস্কার, উৎসব ও খ্যাতি বহু কিছুই হাতছানি দেয়। ছোট ও মাঝারি কবিরা সব ডাকেই সাড়া দেন। ‘ফলে তাদের অবসর অপচয়ে গড়িয়ে যায়। বড় কবিরা এই অবসরকেই জীবনের অশেষ ভাঁড়ার করে তুলতে জানেন।’ তিনি আরও বলেন—‘মিডিয়া ও প্রতিষ্ঠান মাঝারি কবিদের বেশি পছন্দ করে। কারণ মাঝারিরা সবার মন যুগিয়ে চলতে পারেন। ধর্ম, রাষ্ট্র, রাজনীতি, যৌনতা নিয়ে তারা এমন কোনো বেফাঁস কথা বলে বসেন না, যার ফলে প্রাতিষ্ঠানিক বা সামাজিক পশ্চাদপদতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। সমাজ দড়িদাড়া নিয়ে দাঁড়ালে তার ফাঁসের গেরো মানুষের গলায় পরিয়ে দেন মাঝারিরা। বিপরীতে, বড় কবিরা দড়িদাড়া মানে না। তাঁরা বেফাঁস কথা বলেন বলেই ফাঁসের গেরো আলগা হয়। কবিতার বাঁক বেফাঁসেই সাব্যস্ত হয়েছে চিরকাল।…মহার্ঘ কবিতা একখণ্ড শাদা কাগজেও বাঁচতে পারে।’ (কবিতার বীজতলা)।
আবু হাসান শাহরিয়ার মন্তব্যপ্রধান গতানুগতিক গদ্য লেখেন না। মন্তব্যের পেছনে যুক্তিও খাড়া করেন। প্রশ্ন ও মীমাংসাসহ। পাঠক হিসেবে তার প্রজ্ঞা ও গভীর অভিনিবেশটি ধরা পড়ে, যখন তিনি একটা কবিতার নানাভাষী অনুবাদের আলোচনা-সমালোচনা করেন, দু’জন কবির দুটো কবিতা পাশাপাশি রেখে দেখান- কোনটি কেন অনুসরণ বা অল্পকবিতা অথবা আলাদাভাবে দুটোই কীভাবে শিল্পোত্তীর্ণ কবিতা—‘‘ফরিদ কবিরের কবিতায় যেমন রণজিৎ দাসের, একইভাবে সিকদার আমিনুল হক ও ওমর কায়সারের উদ্ধৃত কবিতাংশে যথাক্রমে শঙ্খ ঘোষ ও পূর্ণেন্দু পত্রীর প্রত্যক্ষ প্রভাব লক্ষ করি আমরা। চেতনেই হোক আর অবচেতনেই হোক, এ জাতীয় অনুসরণের কবল থেকে নিজেকে মুক্ত রাখাও কবির কর্তব্যের অংশ বলে আমি মনে করি। এলিয়ট বলেছিলেন- ‘নবিশ কবিরা নকল করে, আর পাকা কবিরা করে চুরি’ –ওপরের অভিযোগগুলো নবিশি হাতের নকল।” যুক্তি দিয়ে শাহরিয়ার দেখান যে, “অনুসারী কবিরা শুধু বিষয় বা প্রকাশের প্রকরণেই মূলানুসারী (যা কবিতার নকল) হননি, অনুসরণ করেছেন তাদের ছন্দ-রীতিও। যেমন- ফরিদ কবির নিয়েছেন রণজিতের অক্ষরবৃত্ত, সিকদার নিয়েছেন শঙ্খর পাঁচ মাত্রার মাত্রাবৃত্ত, ওমর নিয়েছেন পত্রীর স্বরবৃত্ত, জয় নিয়েছেন সুনীলের স্বরবৃত্ত এবং ময়ুখ নিয়েছেন আবিদের অক্ষরবৃত্তীয় চালের গদ্য স্বাচ্ছন্দ্য। এমন কী পূর্ণেন্দু পত্রীর মূল কবিতা থেকে ‘পদ্ম কেবল পর্দানশীল’ চিত্রকল্পটিও উঠে আসে ওমর কায়সারের কবিতার শিরোনামে (চন্দ্র এখন পর্দানশীল)।” (কবিতা অকবিতা অল্পকবিতা)।
কাব্যসাহিত্যে নানা ধরনের ধারা, উপধারা, মতবাদ, ইজম থাকবেই। অতীতেও থেকেছে। সেই বিষয়ে শাহরিয়ার বলেন—‘অতএব বাঙলা কবিতার পোস্টমর্ডনিজমের স্বপ্নদ্রষ্টাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই।… কবিতা নিজেও একটি নিরন্তর পরিবর্তনশীল সৃজন প্রতিক্রিয়া। সুতরাং বিপ্লব তার স্বভাবেই নিহিত আছে, বাইরে থেকে চাপিয়ে দেয়ার প্রয়োজন পড়ে না।’ (কবিতা ও পোস্টমর্ডনিজম)।
শাহরিয়ারের গদ্যে যে-রিডিং পাওয়া যায়, পূর্বধারণাকে যুক্তিসহ খারিজ করে নতুন ধারণার বীজ বপন, সেই প্রতিক্রিয়া পাঠকের চিন্তাবর্গে অচেনা দুয়ার খুলে দেয়। জীবনানন্দের ছন্দ সম্পর্কে তার মুল্যায়ন— “আসলে জীবনানন্দের ছন্দ অক্ষরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্তের এক নতুন মিশ্রণ। এই ছন্দের রীতিটি অক্ষরবৃত্তের হলেও চালটি মাত্রাবৃত্তের। নিজেও কবি ‘মাত্রাবৃত্ত ও মুক্তক’এর ইঙ্গিত দিয়েছেন তার গদ্যে। দণ্ডী-কুন্তক কী বলতেন, জানি না, তাল লয়ের কান, এক কথাই বলে। আবার এও বলা যেতে পারে— পয়ারবন্দি চালের শৈথিল্যে জীবনানন্দ বৈষ্ণব কবিদের নতুন সংস্করণ।” কবিতা অকবিতা অল্পকবিতার ‘জীবনানন্দ দাশের কালমঞ্চ ও তার কুশীলবগণ’ গদ্যে রিডিংটি আছে। পরবর্তীকালে ‘ভুমিকা অথবা জীবনানন্দকে নিয়ে একটি সার্বভৌম গদ্য’ শিরোনামে শাহরিয়ার সম্পাদিত জীবনানন্দ দাশের গ্রন্থিত অগ্রন্থিত কবিতা সমগ্র-তেও গদ্যটি সূচিবদ্ধ হয়েছে। সম্পাদিত এই গ্রন্থটি দুই বাংলায়ই ব্যাপকভাবে সমাদৃত। কারণ এটি জীবনানন্দের গ্রন্থিত অগ্রন্থিত সর্বাধিক কবিতার সমষ্টিগ্রন্থ। এখানেও শাহরিয়ার অন্য সম্পাদকদের থেকে আলাদা। বানানে ও পাঠে কবিকৃত সর্বশেষ পরিমার্জন অনুসরণ করেছেন তিনি। বিশ্লেষণী ভূমিকা ছাড়াও ভূমিকার অন্তরালে অন্য অনেক সমালোচকের সম্পূরক মুল্যায়ন নিয়েছেন। ইত্যাদি কারণে উচ্চতর গবেষণার ছাত্রদের জন্যও এটি হয়ে উঠেছে একটি প্রামানিক গ্রন্থ।
শামসুর রাহমানকে নিয়ে ‘কালের ঈগল, ডানার বিস্তার’ শিরোনামে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধও আমরা পাই কবিতা অকবিতা অল্পকবিতায়। শামসুর রাহমানের কবিতাকে বাংলার দারিদ্র-দাঙ্গা, শোষণ, নিপীড়ন, স্বপ্ন-সংগ্রাম, ধর্মান্ধতা এসবের কালানুক্রমিক প্রামাণ্য চিত্র কল্পের ভুমিতে- বিকল্প ইতিহাস হিসেবে দেখেন শাহরিয়ার। বলেন, ‘বাঙলা কবিতার আদি ও মধ্যপর্ব পৌরাণিক কাহিনীতে ভরপুর। আধুনিক পর্বেও এই পুরানের নব্য রূপায়ন লক্ষ করি আমরা। কিন্তু শামসুর রাহমানই বাঙলা কবিতায় প্রথম সার্থক সমকালপুরাণ রচিয়িতা। বৃহত্তর জনজীবন আর তার জয়-পরাজয়ময় সংগ্রামী ইতিয়াসের আশ্চর্য সমবায়ই এই সমকাল পুরাণ। চটুল পাঠে এই রস উদ্ধারযোগ্য নয়। যেকোনো মহার্ঘ রচনার মতোই তা দাবি করে নিবিড় পাঠের একাগ্রতা।… বাঙলা কবিতার ইতিহাসে তিনি এক মৌল কবিসত্তা। নিকটঅতীতে এমন প্রবল মৌলিকত্ত্বের নজির মেলে কেবল জীবনানন্দ দাশের কাব্যেই। সেই জীবনানন্দের প্রভাবের মধ্যে শামসুর রাহমানের উত্থান, আবার সেই প্রভাববলয় ভেঙেই তার একাকী যাত্রার শুরু।’
কবিকে কোনো দলভুক্ত দেখতে চান না শাহরিয়ার। সুসচেতন মানবতাবাদী হতে বলেন। কবিতা বিষয়ে বলতে গিয়ে মানুষের জীবনের আরও বহুবিধ দিকে আলো ফেলেন তিনি। যে বিষয়েই বলেন না কেন, তার গদ্যের একটি অনন্যসাধারণ দিক হচ্ছে ভাষার জাদু। প্রতিটি শব্দবুননে, পারঙ্গমতায় বাক্যের গাঁথুনিতে বেরিয়ে আসে ভাষার ভাইটাল ফোর্স আর ডায়নামিজম। এই প্রাণদায়িনী ভাষা যখন শাহরিয়ার কবিতায় ব্যবহার করেন, তখন তাতে বেজে ওঠে চিরকালের সুর। সে কারণেই একটি ছোট্ট পঙক্তি বা কবিতায়ও দেখি এক ধরণের এপিকপ্রবণতা। খণ্ড থেকে অখণ্ডের দিকে ইশারা। এক বৃহৎ সত্তাকে ক্ষুদ্র আখরের ভেতর ধারণের প্রচেষ্টা ও আকুলতা। পরিসরে ক্ষুদ্র হলেও ব্যঞ্জনায় এরা ব্যাপক, তীব্র ও ধারালো। কখনও কখনও গদ্যেও এই কাব্যিক ব্যঞ্জনাকে গুরুত্ব দেন শাহরিয়ার। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক- “নগর থেকে দূরের এক রাত্রিতে সোমক দাসের কবিতাটি আমাকে গভীরভাবে ছুঁয়ে গিয়েছিল। শীতের হাওড় বিল এবং মৈমনসিংহ গীতিকার কবি চন্দ্রাবতীর টানে ‘এগারো সিন্ধু’র জানালায় চোখ রেখে রাত্রি পাড়ি দিচ্ছিলাম। ঈশা খাঁর স্মৃতিবিজড়িত এগারো সিন্ধুর নামে ট্রেন। কেবলই মনে হচ্ছিলো, ইতিহাসের কোনো লুপ্ত জনপদের দিকে ছুটছে সেই ট্রেন। সে সময় ভৈরব নদীর তীরবর্তী একটি জায়গায় ট্রেন হঠাৎ থেমে গেকে অন্ধকার ফুঁড়ে বেড়িয়ে এসেছিল সোমক দাসের ‘আলো’। দেখেছিলাম একহাতে টর্চ, অন্য হাতে কোচ নিয়ে পাড়ের নদীতে হাঁটুজলে ঘুরে বেড়াচ্ছেন এক মাছশিকারি। শিকারির হাতে ধরা টর্চ মাছের ভুবন আলোকিত করলেও সেই আলোর পেছনে ওৎ পেতে আছে কোচের ধারালো ফলা। হতদরিদ্র বাংলাদেশের গাঁ-গেরামেরও একই দশা। টর্চ হাতে বিশ্বব্যাংক আর এনজিও ঘুরে বেড়াচ্ছে সেখানে, ঋণের কোচে বিদ্ধ হচ্ছে এমন কী ভূমিহীনরাও। অসহায় মানুষের শেষ সম্বলটুকুও কেরে নিতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উত্তরসূরিরা নতুন প্রকরণে ফিরে এসেছে এই আধপেটা মানুষের দেশে। নিরন্নের দেশে হাইব্রিড প্রযুক্তি এসেছে, কিন্তু মাঠের খাতায় যারা সোনালি কালিতে শস্য লেখেন, সেই কৃষকদের ভাগ্য খুব একটা বদলায়নি, মাঠ-মাঠ দুঃখে কান পাতলে আজো শোনা যায় তেভাগার আন্দোলনের সেই গাঢ়তম পংক্তিগুলো।… বরং আরও পরিকল্পিতভাবে ফিরে এসেছে একালের জমিদাররা। মুখে তাদের উন্নয়নের কত কী ভুল-ভুলাইয়া, রাষ্ট্র তাদের রক্ষক। এবং এগার সিন্ধুর জানালা দিয়ে ভৈরবের নদী দৃশ্যে সোমক দাসের কবিতার ‘আলো’য় হতদরিদ্র দেশের মাঠ-মাঠ বঞ্চনার দৃশ্যও দেখতে পেয়েছিলাম সে-রাতে। একটি মহার্ঘ কবিতাই পারে পাঠকের ভাবনাকে এভাবে উস্কে দিতে।” (কবিতার বীজতলা)।
ভাষিক এ দক্ষতার জন্যই আবু হাসান শাহ্রিয়ারের কয়েকটি গদ্যগ্রন্থ প্রতিউপন্যাস এর পর্যায়ে উঠে এসেছে। তার গদ্যে আছে নিবিড় স্বচ্ছতার পাঠ। সেখানে- যা অস্বচ্ছ, অস্বাদু, গতানুগতিক, বাঁকহীন- তা বর্জনের দৃঢ়তা এবং যুক্তি খুঁজে পান পাঠক। ফলে মুক্তিও পান। যেমন—ড. হুমায়ুন আজাদের প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধা থাকা সত্ত্বেও তাঁর (ড. আজাদের) সম্পাদিত আধুনিক বাঙলা কবিতা গ্রন্থ থেকে কবি আল মাহমুদকে বাদ দেয়ায় কলম ধরেন মুক্তকণ্ঠী শাহরিয়ার। বলেন, ‘কবিকে কেবল কবিতা দিয়েই বিচার করতে হয়।’ পাঠককে বিভ্রান্তির হাত থেকে মুক্ত করতে সুস্থ তর্কও ডেকে আনেন তিনি—‘তাই যে যুক্তিতেই হুমায়ুন আজাদ তার সম্পাদিত আধুনিক বাঙলা কবিতা থেকে আল মাহমুদকে বর্জন করুন না কেন, তা কবিতার শুদ্ধাচারী মূল্যায়নে কোনো শুভবুদ্ধির পরিচয় বহন করে না। আল মাহমুদের কবিতা তাতে মিথ্যে হয়ে যায় না, বরং হুমায়ুনের হুমায়ুন আজাদের সম্পাদনাই ক্লিশে প্রমাণিত হয়। সামাজিক শত্রু-মিত্রতায় যদি কবিতার বিচার সম্ভব হতো, এজরা পাউন্ডের নামও কবিতার ইতিহাস থেকে মুছে যেত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি বাহিনীর পরাজয়ের সঙ্গে সঙ্গে।’ (কবিতা: দিগন্তের পাড়ে অনন্তের ভাষা)।
সমূহ রাষ্ট্রিক যাপিত জীবনে যেমন, তেমনি আমাদের সাহিত্যও এক ভয়াবহ ভাইরাস ঢুকে পড়েছে- যার বিনাশ এখনই অতি আবশ্যক। কিন্তু সেই বিনাশমন্ত্র পাঠ তো খুব সহজ কাজ নয়। যজ্ঞের জন্য বহু পথ পাড়ি দিতে হয়। শাহরিয়ারের পক্ষেই কেবল সেই যজ্ঞানল জ্বালানো সম্ভব। তিনি বলেন, ‘কেবল নিজেরই বৃত্তে আবর্তিত হলে চিন্তার মুক্ত নেই। এই রোগে কেবল উঠতি কবিরাই আক্রান্ত নন, কবিযশোপ্রার্থী অনেক বয়সীও শয্যাশায়ী। দলবাজির স্বার্থে সময়ের বড় কবিরাও এদের প্রশ্রয় দেন।’
আবু হাসান শাহরিয়ারে কবিতা বিষয়ক গদ্য প্রচল বহু ধারণার বাইরে এসে কবিতাকে নতুনভাবে চিনতে পাঠককে সাহায্য করে। যেমন বুদ্ধদেব বসু বা শঙ্খ ঘোষ বা পূর্ণেন্দু পত্রী বা সুজিত সরকারের গদ্য। তাঁদের মতো শাহরিয়ারও অন্যের ধার-করা কথায় সাতকাহন রচনা করেন না। সমালোচনার তিনি ‘গুনবিচারী’ এবং কবিতাকে বিচার করেন কেবলমাত্র ‘কবিতা’ দিয়েই। তাঁর ভাষায়—‘সৎ সমালোচককে সম্পর্কবিচারী হলে চলে না, হতে হয় গুণবিচারী।’ তাঁর কাছে কবিতা এক অমল-তুমুল আরাধনা। আর সে কারণেই সকল কোলাহল উজিয়ে কবিকে ‘একার সন্ন্যাস’ যাপন করার কথা বলতে পারেন তিনি। দ্বিধাহীন কলমে লিখতে পারেন—‘আমার গদ্য খারাপকে খারাপ বলার দার্ঢ্য রাখে; তাই খারাপরা আমার থেকে দূরে দূরে থাকে। আমিও চাই তারা দূরে থাকুক। তাতে আমার কাজে বিঘ্ন ঘটে কম।ৱ’
শক্তি চট্টোপাধ্যায় তাঁর কবিতায় অন্তঃমিল আর ছন্দের প্রচল রীতিকে ভেঙেচুরে নতুন এক কাব্যভাষা নির্মাণ করেছিলেন। জীবনানন্দ ‘ড্যাস’ চিহ্ন দিয়ে ‘স্পেস’ তৈরি করেছিলেন। শক্তি নানামাত্রিক ব্যঞ্জনা এনেছিলেন শব্দের নতুন বিন্যাসে। অন্যদিকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় জীবনানন্দের ‘ড্যাস’-এর ঘোর বিরোধী। আবার উৎপলকুমার বসুতে ‘ড্যাস’-এর প্রবল প্রভাব দেখতে পাই আমরা। কবিতাকে বোঝার জন্যে পাঠককে কবিতার ভেতরই একটু বিশ্রাম দিতে কবিদের এই যে স্পেস নিয়ে নানামুখী ভাবনা- আবু হাসান শাহরিয়ারের গদ্য পাঠককে সে কথাও জানায়। পাশাপাশি নিজের কবিতায় এ কাজটি শাহরিয়ের কীভাবে করেছেন- সেকথাও উঠে আসে। টানাগদ্যের ছদ্মবরণে লেখা শাহরিয়ারের একই প্রকাশপ্রকরণের তিনটি কাব্যগ্রন্থ (ফিরে আসে হরপ্পার চাঁদ, হাটে গেছে জড়বস্তুবাদ ও সে থাকে বিস্তর মনে বিশদ পরাণে) সম্পর্কেও জন্ম নেয় নতুন প্রতীতি। আমরা জানি, টানাগদ্যে কবিতা লিখলে কোনো স্পেস থাকে না। ফলে পাঠক পড়তে পড়তে ক্লান্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু শাহরিয়ারের এই তিনটি গ্রন্থের কবিতাগুলো আঙ্গিকেই কেবল টানা, অন্তরাত্মায় তারা পয়ারছন্দিত বলে একঘেয়ে নয়। একটানা পয়ারেও যদি পাঠক একটু দম নিতে চান? পাঠকের একঘেয়েমি বা ক্লান্তি দূর করতে space–এর বদলে শাহরিয়ার গুঁজে দিলেন মূলকবিতার মেজাজের বাইরের দু’একটি অত্যুজ্জ্বল পঙক্তি, যা আবহসঙ্গীতের মতো অনুচ্চস্বরে অস্তিত্বমান হল তার কবিতায়। কোথাও কোথাও সার্বভৌম চিত্রকল্প হিসেবে। গদ্যকবিতায় এভাবে দম নিতে দেয়ার বিষয়টা আমার কাছে নাটকের ‘রিলিফ’ দৃশ্যের মতো মনে হয়েছে। বাঙলা কবিতায়, আমার জানামতে, এমন অসাধারণ কাজ আবু হাসান শাহরিয়ারই প্রথম করেছেন। তার কবিতা এমন অনেক বাঁকের গল্পে ভরা। একটি-দুটি বাঁক সম্পর্কে ইঙ্গিতটুকু শুধু রেখে যান তিনি তার কবিতা বিষয়ক গদ্যে। নিজের চেয়ে অন্যের প্রতি আগ্রহ বেশি বলে স্বভাষা-বিভাষার অন্য কবিদের কথাই সেখানে বেশি থাকে। শক্তিমান কবিরা তো উঠে আসেনই, সম্ভাবনাময় নবীন কবিরাও বাদ পড়েন না।
কবি আবু হাসান শাহরিয়ারের অনেক পঙক্তি সমকালেই প্রবাদখ্যাতি পেয়েছে। একই গুণ তার গদ্যেও আছে। যেমন:
০১. দশক গৌণ কবিদের আশ্রয়।
০২. সৎ সমালোচককে সম্পর্কবিচারী হলে চলে না, হতে হয় গুণবিচারী।
০৩. বই-ই হচ্ছে আত্মমর্যাদাশীল কবি লেখকদের জন্য সবচেয়ে সম্মানজনক প্রকাশমাধ্যম।
০৪. সান্ধ্যভাষার আরেকটি ধারা সাঁওতালদের গান।
০৫. কবিতার বাজি কবিতাতেই ধরতে হয়।
০৬. কোনো সমকালে সম্পাদক-সমালোচকরা একযোগে কবিতামূর্খ হলে একার সন্ন্যাসই খাঁটি
কবিদের উত্তম অবলম্বন।
০৭. অযোগ্যের হাটে উপেক্ষা আর অবহেলাই কাজের পুরস্কার।
০৮. খাঁটি কবি কারুর নির্দেশ মানেন না।
০৯. খাঁটি কবি দল, সঙ্ঘ বা দশকের ঝাঁপি থেকে নন, উঠে আসেন তার কবিতার নিজস্বতা থেকে।
১০. তত্ত্বকে বুঝতে হলে বুদ্ধির প্রয়োজন, কিন্তু কবিতাকে বুঝতে হলে থাকা চাই উপলব্ধির
যোগ্যতাসম্পন্ন একটি মন।
১১. যিনি প্রকৃত কবি- যে-কোনো আন্দোলন থেকেই তিনি তার প্রয়োজনীয় উপাদানটুকু সংগ্রহ করে নেন আড়ালে বসেই।
১২. পাঠক চিরকাল কবিতায় কবিতা খুঁজেছেন এবং ওস্তাদিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন।
১৩. শাস্ত্রজ্ঞ না হলেও কবির চলে। কিন্তু কাব্যসমালোচকদের ঘটে কিছু বিদ্যা থাকা চাই।
১৪. আড়াল খাঁটি কবিদের বর্ম। মাঝারি কবিদের পক্ষে তা আয়ত্ব করা সম্ভব নয়। কারণ
মাঝারিরা কোলাহলেই বাঁচে।
১৫. আমৃত্যু নবায়নযোগ্য থাকতে হলে কবিকে নষ্টদের কাছ থেকে সরে সরে আসতে হয়।
১৬. মহার্ঘ কবিতা একখণ্ড সাদা কাগজেও বাঁচতে পারে।
১৭. খাঁটি কবিদের গদ্য মহার্ঘ কবিতার প্রযত্ন।
আবু হাসান শাহরিয়ারের কবিতার মতো তার গদ্যও নিত্যপাঠের জন্য, কেননা তিনি নিরন্তর অগ্রসরমান এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, ইনসাইটফুল-ভিশনারি। সব ছাপিয়ে অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ মিলিয়ে ত্রিকালজ্ঞও বটে। আর সে কারণেই সুপাঠকের ঘর-কুঠরিতে এসে স্থিত হয় তার বোধন-চিন্তানুক্রম। অকবি-অসাহিত্যিকদের কাছ থেকে শুদ্ধ কাব্য সাহিত্যকে মুক্ত রাখার সতর্ক বাণীটি তিনি গ্রহণ করেছিলেন ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে, বাংলা কবিতায় অকবিদের উৎপাত দেখে যিনি সেই ১৮৬৭ সালে লিখেছিলেন—‘যেমনি জন্মাইলা, অমনি কবিতাইলা।’ আজ শাহরিয়ার বলছেন—‘সহজতম উপায়ে কবিতার কঠিনতম পথ পাড়ি দেওয়া যায় না।’ আরও বলছেন—‘মানুষের প্রতিটি তৃষ্ণারই ধর্ম এক।’ সুতরাং জ্ঞানপিপাসু মানুষের প্রতিদিনই নবজন্ম হয়। শাহরিয়ার কবিকে নবায়নমুখী হতে বলেন। এই কথার ব্যাপ্তি গভীর থেকে গভীরতর এক বোধে নিয়ে যায় পাঠককে। উত্তরপ্রজন্মকে বৃত্ত ছেড়ে বেরিয়ে আসার এমন ডাক দেবার, এরকমভাবে পথ বাতলে দেবার লোক আর কে আছেন? এ যাবৎ যা দেখেছি, যেভাবে দেখেছি তাকে, সেটাই কি সব এবং সঠিক? না। এর বাইরেও আরও ভাববার আছে। ফলে শাহরিয়ার যা বলেন, তা আমাদের নবায়নমুখী করে তোলার জন্য অনস্বীকার্য হয়ে ওঠে। আমরা হাঁটি তার পেছনে—‘ডিভাইন কমেডি’র সেই সিংহসদন থেকে দান্তে যেমন অনুসরণ করেছিলেন ভার্জিলকে, আজকের অগ্রসর পাঠক তেমনি-শাহরিয়ারকে। পাঠকের মনোগহনে এভাবেই কবি, প্রাবন্ধিক, সম্পাদক আবু হাসান শাহরিয়ার ছিপ ফেলেন, তার প্রতার্কিক গ্রহণযোগ্যতা বাড়ান, তর্ক-বিতর্ক, পক্ষ-বিপক্ষের খেলা শেষে পাঠককে নিয়ে দাঁড়ান খোলা প্রান্তরে- নতুনতর পথের খোঁজে।