কবিতায় সবসময় ব্যক্তি নিজের কথা বলে না, বলে সমাজের কথা, রাষ্ট্রের কথা, স্বজাতির কথাও। এ কারণেই কবিতা ব্যক্তির সৃজনকর্ম হয়েও হয়ে ওঠে তার ভাষাগোষ্ঠী ও স্বজাতির সম্পদ। যদি সে ধরনের কবিতা রচিত হয়। বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে রবীন্দ্র-উত্তরকালে কবিরা নিজেকে বিজ্ঞপিত করার চেষ্টা যতটা করেছেন, ততটাই সমাজকে বুঝতে চেয়েছেন। এই দুয়ের মিশ্রণেই তৈরি করেছেন নিজেদের কবিতার অবয়ব; প্রাণভোমরা। এই সময়ের কবিরা রাজনৈতিক, সামাজিক নানা কারণে কখনো তীব্র আগেবে থরোথরো কেঁপে উঠেছেন, কখনো প্রতিবাদে হয়েছেন মুখর। আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ ঠিক এই সময়ের কবি। অর্থাৎ সাত চল্লিশের দেশভাগের পর বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের রেশ ও প্রভাব তার কবিতার প্রধান অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। অবশ্যই পরবর্তীকালে এসে মুক্তিযুদ্ধ, এই সংক্রান্ত বিবিধ অনুষঙ্গও তার কবিতার অনুষঙ্গ হয়েছে।
আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর কবিতায় মূলত দেশপ্রেম, নারীপ্রেম ও প্রকৃতিই প্রধান অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সমকালীন রাজনীতি, আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটও। শুরুটা করেছেন স্বল্পকথন, ছোট ছোট বাক্যে, স্বরবৃত্তের হালকা চালে। ধীরে ধীরে পৌঁছেছেন গম্ভীর অক্ষরবৃত্তে। কথা বলেছেন স্বরাট স্বরে।
শুরুর দিকের কবিতায় তুলে এনেছেন নিম্ন-মধ্যবৃত্তের যাপিত জীবন। তাদের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা চিত্রিত করেছেন ছোট-ছোট পঙ্ক্তির কবিতায়। ছন্দ হিসেবে বেছে নিয়েছেন স্বরবৃত্তকেই। কারণ, স্বরবৃত্তে প্রাত্যহিক জীবনের সহজ-সরল ঘটনার বর্ণনা দেওয়া যায় সাবলিলভাবেই। হয়তো একারণেই কবি শুরুর দিকে এই লোকজছন্দকেই বেছে নিয়েছেন। ‘সাতনরী হার’ কাব্যের প্রায় সব কবিতা-ই এই ছোটছোট পঙ্ক্তির। এখানে তিনি তুলে ধরেছেন সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা, স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের বেদনার কথা। বলেছেন একটি রাষ্ট্রের সমাজব্যবস্থায় বৈষম্য বিরাজ করলে, তার অধিবাসীরা কখনোই সম্পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করতে পারে না। কারণ, তার আত্মিক মুক্তিরও পূর্বশর্ত অর্থনৈতিক মুক্তি; বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থা। না হলে মানুষের স্বপ্নের সঙ্গে তার বাস্তবজীবনের সম্পর্ক হবে রীতিমতো সাংঘর্ষিক। সেখানে কোনোভাবেই সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।
ক.
কুঁচবরণ কন্যা তোমার
মেঘবরণ চুল
চুলগুলো সব ঝরেই গেল
গুঁজব কোথা ফুল।
(সাতনরী হার)খ.
কণ্ঠে দেব গজমোতি
পাঁজর ভেঙেছি
কন্যে তোমার গায়ে-হলুদ
তত্ত্ব এনেছি।
(কন্যে তোমার)গ.
মেয়েটার বর মরেছে আর বছর
মেয়েটার ঘর পুড়েছে তার খবর
এ গাঁয়ের জানে সবাই পাঁচজনে
মেয়েটার মা মরেছে সেই সনে।
(মেয়েটা)
এ তো গেলো, স্বপ্ন, স্বপ্নভঙ্গ ও বেদনার প্রসঙ্গ। এর বাইরে রয়েছে আরও নানা অনুষঙ্গ। তবে তার এই পর্বে রচিত কবিতাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে হৃদয়সংবেদী ও বহুলপঠিত কবিতাটির নাম ‘মাগো ওরা বলে’। এটি একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনাকে উপজীব্য করে রচিত। এ কবিতায় কবি দেখিয়েছেন, মায়ের ছেলেরা কী করে মাতৃভাষার মানরক্ষা করতে গিয়ে বুক পেতে দেয়। আর ফিরে আসে লাশ হয়ে। সেই লাশও সমাজের ভাষাশত্রুদের কাছে অপমানের শিকার হয়। তারা শহীদকেও ছিন্নভিন্ন করে দেখে।
ঝাপসা চোখে মা তাকায়
উঠোনে উঠোনে
যেখানে খোকার শব
শকুনিরা ব্যবচ্ছেদ করে।
(মাগো ওরা বলে)
আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ শুরুতে স্বরবৃত্তে ছোটছোট পঙ্ক্তি কবিতা রচনা করলেও শেষদিকে আগ্রহী হয়ে ওঠেন দীর্ঘ কবিতায়। একইসঙ্গে ছন্দেরও পরিবর্তন আনেন। এক্ষেত্রে তিনি বেছে নেন প্রবহমান অমিল, অসমপার্বিক অক্ষরবৃত্তের। ফলে তার বক্তব্যে আসে একটি প্রবাহ; একইসঙ্গে সুরের ঐকতানও। এ পর্বে তার সবচেয়ে সফল কবিতাটির নাম ‘আমি কিংবদন্তির কথা বলছি’। এই কবিতায় তিনি দেখিয়েছেন, জাতির মুক্তি-বিকাশের পথে সহায়ক বৈশিষ্ট্যগুলো। এ কবিতায় সমাজজীবনে আপাতত গুরুত্বহীন বিষয়কেও তিনি গুরুত্ববহ করে প্রকাশ করেছেন। বলেছেন, ‘যে কবিতা শুনতে জানে না/ সে ঝড়ের আর্তনাদ শুনবে/ যে কবিতা শুনতে জানে না / সে দিগন্তের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে।’
বিষয় হিসেবে উঠে আসছে রাজনীতি, অর্থনীতি থেকে শুরু করে সামাজিক পরিস্থিতি এমনকী আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও।
বিষয়টি বাস্তবজীবনে সরাসরি গুরুত্বহীন। কেবল শিল্পসচেতন সমাজের জন্য এর গুরুত্ব রয়েছে। এমনটা সাধারণ সত্য হিসেবে ধরে নিতে পারি। কিন্তু এর ভেতরে যে সত্য লুকিয়ে রয়েছে, তা হলো, মানুষের সুকুমারবৃত্তিকে নাড়িয়ে দেওয়ার জন্য, তার ভেতরের মানবিক মূল্যবোধকে জাগিয়ে দেওয়ার জন্য কবিতা মহৌষধের মতো কাজ করে। অর্থাৎ একজন নিষ্ঠুর মানুষও কবিতা শুনতে শুনতে হয়ে উঠতে পারে কোমলপ্রেমিক। তার ভেতরে জেগে উঠতে পারে সহৃদয়বানের মন। দীর্ঘ এ কবিতায় প্রেম-প্রকৃতি, মানুষ, রাজনীতি, দেশপ্রেম ও সমাজনীতির নানা বিষয় ফুটিয়ে তুলেছেন আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ। কবিতার শেষে এসে তিনি বলছেন,
সশস্ত্র সুন্দরের অনিবার্য অভ্যুত্থান কবিতা
সুপুরুষ ভালোবাসার সুকণ্ঠ সংগীত কবিতা
জিহ্বায় উচ্চারিত প্রতিটি মুক্তশব্দ কবিতা
রক্তজবার মতো প্রতিরোধের উচ্চারণ কবিতা
আমরা কি তাঁর মতো কবিতার কথা বলতে পারব
আমি কি তাঁর মতো স্বাধীনতার কথা বলতে পারব।
প্রায় একই স্বর-সুর মেজাজের আরেকটি কবিতার নাম ‘বৃষ্টি এবং সাহসী পুরুষের জন্য প্রার্থনা’। এ কবিতাও বেশ দীর্ঘ। তবে এটির শুরু নেতিবাচক তথ্য দিয়ে। এরপর একে পরিবেশ পরিস্থিতি বর্ণনা দিতে দিতে এগিয়ে চলেছে আশাবাদী-স্বপ্নের দিকে। শেষে এসে বলছেন,
আমাদের ভূমি
প্রভাতের সূর্যাস্তে যেন রঞ্জিত হয়
ভাদ্রে কার্তিকে যেন বারিসিক্ত হয়
কৃষকেরা কাজ করে কৃষকের গাভি
সুস্থ সবল থাকে নিরাপদে থাকে।
একজন কবিকে তার স্বপ্ন রচনার পাশপাশি দেশ নিয়েও গভীর ভাবনায় ডুবে যেতে দেখি। দেশের মানুষ বাদ দিয়ে দেশপ্রেমের কথা অন্তসারশূন্য বলেই মনে করেছেন তিনি। এ কারণেই নিজের সুখস্বপ্ন দেখার চেয়ে দেশের মানুষের আশার কথা, আকাক্সক্ষার কথা বলেছেন।
আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ এ পর্বে এসে আর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কবিতা রচনায় স্বস্তি পাচ্ছিলেন না। বিষয় হিসেবে যেমন বিস্তৃত ইস্যু বেছে নিয়েছেন, তেমনি বর্ণনার ঢংয়েও এনেছেন বিপুল পরিবর্তন। দীর্ঘপ্রলম্বিত লয়ে তিনি বলা শুরু করেন, শেষও করেন সে স্বরাট স্বরে। যেমন ‘আমার সকল কথা’। এই কবিতায় প্রকৃতি, ভূমি, সমুদ্র, মাঠ থেকে শুরু করে পারিবারিক জীবনের নানাদিক তুলে এনেছেন। একইসঙ্গে নিজের শৈশব-কৈশোর থেকে শুরু করে পরিণত জীবনের নানা স্তরে নানা জনের প্রেম-ভালোবাসা স্নেহ-মমতার বর্ণনা দিয়েছেন। কবিতাটি পড়তে পড়তে পাঠকের মনে হতে পারে এটি আসলে কাব্যে রচিত আত্মজীবনীর সারাংশ। এই কবিতার পরিপূরক কবিতা ‘আমার সময়’। ‘আমার সময়ে’ তিনি দেখিয়েছেন, প্রকৃতির সঙ্গে নারীর প্রেমে যেমন মিল রয়েছে, তেমনি রয়েছে দুঃখেও। পুরো কবিতাটি মূলতস্মৃতিচারণ। আর কবি স্মৃতিচারণের ছলে বলছেন তার কালের নানা ঘটনা-দুর্ঘটনার কথা। তুলনা করছেন অতীতের সঙ্গে বর্তমানের সঙ্গতি-অসঙ্গতির নানা দিক। বিষয় হিসেবে উঠে আসছে রাজনীতি, অর্থনীতি থেকে শুরু করে সামাজিক পরিস্থিতি এমনকী আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও।
আমার সময়ে সন্ত্রাস
চতুর কামোটের মতো
বিবেচনার বিষয় ছিল
যেমন আমি
পাতা উড়তে চমকে উঠি
পথিকের ভুরুতে
ভয়ংকরের ভাবনা দেখি
দ্বীপপুঞ্জে প্রজাপতির মতো
রোদ উঠলে
অথবা টিয়া পাখিরা
উচ্চকণ্ঠ হলে
জানালা বন্ধ করে দি।
আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ রাজনীতি সচেতন ছিলেন। একইসঙ্গে ছিলেন প্রেমিকও। তাই তার কবিতায় রাজনৈতিক নানা অনুষঙ্গ যেমন উঠে এসেছে, তেমনি প্রেমবিরহ, ভালোবাসাও চিত্রিত হয়েছে।
একইসঙ্গে নিজেও উঠেছেন বাংলা কবিতার এক পরম কিংবদন্তি। যা তাকে পাঠক হৃদয়ে যুগযুগ বাঁচিয়ে রাখবে।
একটি বিষয় পরিষ্কার তিনি ছোট ছোট কবিতা রচনা করুন আর দীর্ঘ কবিতাই রচনা করুন। তার পঙ্ক্তিগুলো প্রায় ছোটছোট। কখনো কখনো দুই পর্বে বা তিন পর্বে শেষ হয় একেকটি পঙ্ক্তি।
উপমা চিত্রকল্পে অভিনবত্ব পাঠককে বিস্মিত করে। তবে তিনি চিত্রকল্প ও উপমাকে প্রায় সমান গুরুত্বে গ্রহণ করেছেন। একারণে তার উপমা চিত্রকল্পে লীন হয়ে যায় না। স্বতন্ত্র রূপ গ্রহণ করে। কিন্তু কখনো কখনো উপমাকে আশ্রয় করেও তিনি চিত্রকল্প সৃষ্টি করেছেন। যা কবিতাকে বিশিষ্ট করে তুলেছে।
ছন্দের সঙ্গে বিষয়বস্তুও সম্পর্ক বিশেষভাবে ভূমিকা পালন করে। কবিতাকে কবিতা করে তুলতে হলে কবিকে মনে রাখতে হবে, যিনি বুদ্ধির ধারকে অস্বীকার করে, চিন্তার প্রাখর্যকে উপেক্ষা করে কেবল হৃদয়বৃত্তির নামে প্রলাপ আওড়াতে চাইবেন, আর যাই হোক তিনি কবিতা লিখতে পারবেন না। যার আবেগ প্রজ্ঞার শাসনে নিয়ন্ত্রিত, বুদ্ধি মনকে প্রবোধ দেয়, আবেগকে করে তোলে সংহত, তিনি-ই প্রকৃত কবি। বিষয়টি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেছেন। তাই তার কবিতায় ছন্দেও সঙ্গে আঙ্গিকের, বিষয়ের সঙ্গে উপমা-চিত্রকল্পের সুষম সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। তিনি স্বরবৃত্তে যেমনর ছোট ছোট সমিল পঙ্ক্তি রচনা করেছেন, তেমনি অক্ষরবৃত্তের রচনা করেছেন অমিল পঙ্ক্তি। অর্থাৎ বিষয়ের সঙ্গে আঙ্গিকের সম্পর্ক স্থাপনে তিনি বেশ সচেতন।
আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর কবিতায়, দেশ, ভাষা, মানুষের চিত্র বেশ পরিষ্কার। ব্যক্তির অন্তক্ষরণের চিত্র অঙ্কনে তিনি সুক্ষ্ণরুচির পরিচয় দিয়েছেন। কবিতায় বলেছেন কিংবদন্তির কথা। একইসঙ্গে নিজেও উঠেছেন বাংলা কবিতার এক পরম কিংবদন্তি। যা তাকে পাঠক হৃদয়ে যুগযুগ বাঁচিয়ে রাখবে।