যিনি কবি বা শিল্পী, তাঁকে স্ব-সমাজের প্রতি সৎ থাকতে হয়। অন্তত সৎ থাকার চেষ্টা তাঁকে করে যেতে হয়। তাঁর এই সততা, সাহিত্যিক, সামাজিক ও নৈতিক। অর্থাৎ সমাজস্বীকৃত সততার পাশাপাশি শিল্পসততাও তাকে দেখাতে হয়। এ জন্য তাঁকে শনাক্ত করতে হয়, সমাজের অসুখ, অবক্ষয় ও সম্ভাবনার সূত্রগুলো। তাঁর আবিষ্কৃত সূত্রগুলোর আলোকেই তাঁকে বাস্তবতার চিত্র আঁকতে হয়, লিখতে হয় স্বপ্নের কথাও। তাঁকেই ঠিক করতে হয়, প্রচলিত সমাজবাস্তবতার সঙ্গে মিল রেখে, তিনি কী ধরনের সমাজ সৃষ্টি করতে চান, তা-ও। কেবল সমাজে সংঘটিত ঘটনাবলির চিত্র শিল্পী আঁকেন না, সমাজকে কিভাবে কল্পনা করেন, তা-ও তাঁকে দেখিয়ে দিতে হয়। এখানেই সাংবাদিক প্রতিবেদনের সঙ্গে কবির তফাত। সাংবাদিক যেখানে সংঘটিত ঘটনাবলির বর্ণনা দেন, কবি সেখানে ওই ঘটনার সঙ্গে নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছার রঙও চড়িয়ে দেন। কাজটি করতে গিয়ে তাঁকে ভাবতে হয়, সামাজিক বাস্তবতার রূপ, রাজনৈতিক চেতনা, ঐতিহাসিক পটভূমি, ঐতিত্যের রূপায়ণ, স্বদেশপ্রেম, মানবপ্রেম, প্রকৃতি ও আধ্যাত্মচেতনা তাঁকে বহুমাত্রিকর চেতনায় অস্থির করে রাখে। কিন্তু এগুলো-ই সব নয়। এর বাইরে আরও বেশি যে বিষয়গুলো আত্মস্থ করতে হয়, সেগুলো হলো-শব্দালঙ্কার-অর্থালঙ্কার, নিরূপিত-অনিরূপিত ছন্দ। এ সবের সঙ্গে রয়েছে কবির আবেগ ও মনীষার রূপায়ন। তবেই একজন কবি, উপস্থিতকালের হয়েও উত্তরকালের, অতীতের হয়েও বর্তামানের। আবিদ আনোয়ারের কবিতায় এ সব বিষয়-অনুষঙ্গের রূপায়ণ অল্পবিস্তর রয়েছে।
শিল্পের মূল স্রোত আবেগ-আশ্রয়ী-একথা সত্য। তবে সে আবেগ প্রজ্ঞাশাসিত না হলে তা প্রগলভতায় পর্যবসিত হয়। এজন্য শিল্পী বিশেষত কবি, যিনি আপন হৃদয়কে ক্ষত-বিক্ষত করে বুদ্ধির দীপ্তি, দৃষ্টির প্রাখর্যে তার প্রকাশ ঘটান সন্তর্পণে। আবিদ আনোয়ার আবেগের প্রকাশ ঘটান, তবে তা প্রজ্ঞা ও মনীষার অনুশাসনকে মান্য করেই। ‘কবলিত মানচিত্রে’ কবিতায় ব্যক্তির অন্তর্বেদনা, একাকীত্ব, সর্বস্ব হারানো কিংবা আত্মত্যাগ-এসবের যোগসূত্র আবিষ্কার করে তা উপস্থাপন করেছেন। তিনি প্রাকৃতিক ক্ষয়-পূর্ণচক্রের নিয়মের মতোই দেখেন মানুষের হারানো-প্রাপ্তি বিষয়কে। এ কারণে বলতে পারেন-‘বৃক্ষের বাড়ন্ত কোষ দিনে দিনে ঢেকে ফেলে তাবৎ খোড়ল।’ অর্থাৎ প্রাণের অস্তিত্ব নি®প্রাণকে মুছে ফেলে। অনেক পুরনো ক্ষতের কষ্টও নতুন প্রাণের চাঞ্চল্য ভুলিয়ে দেয়।
দৃশ্য ও ঘটনার পরম্পরা বর্ণনায় কবিকে অনেক সময় চিত্রকল্প, উপমা, বক্রোক্তি তৈরি করতে হয়। আর চিত্রকল্প ও বক্রোক্তি তৈরি কখনো কখনো নিতে হয় প্রতীকের আশ্রয়। কারণ কোনো বহুল পরিচিত বা বহুলশ্রুত বস্তু বা ঘটনার সঙ্গে প্রতিতুলনায় উপস্থিতকালের ঘটনাবস্তুকে বর্ণনা করতে না পারলে কোনো স্মরণীয় বাক্য সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। কেবল বাক্-বিভূতি বা উক্তিপ্রধান পঙ্ক্তিরাশি কবিতাকে স্মরণীয় করে তুলতে পারে না। এজন্য কবিকে অলঙ্কার সৃষ্টি করতে হয়। ‘নন্দনতত্ত্ব’ কবিতায় আবিদ আনোয়ার প্রতীকাশ্রয়ী চিত্রকল্প ও শ্লেষোক্তির সমন্বয়ে রচনা করেছেন। পুরো কবিতাটি মানুষের জীবন সংগ্রামের করুণ দৃশ্যে পরিপূর্ণ। কিন্তু কবি এমনভাবে দৃশ্যের পর দৃশ্য সাজিয়েছেন, তাতে করুণ দৃশ্য ছাপিয়ে তা হয়ে উঠেছে উপভোগ্য। আর এই জীবনচক্র বর্ণনার জন্য বেছে নিয়েছেন অসমপার্বিক পঙ্ক্তিসমবায়ের অমিল অক্ষরবৃত্ত। বক্তব্যের প্রবহমানতার স্বার্থে পঙ্ক্তিভুক্ত পর্বসংখ্যা কমবেশি করেছেন। তবে, পর্ব সাজানোর স্বাভাবিক ধারাক্রম বজায় রেখেছেন। দীর্ঘ পর্বের পরে হ্রস্ব পর্বের ব্যবহার করেছেন। আবার কখনো কখনো একটি চরণকে ভেঙে তিন থেকে চারপঙ্ক্তিতেও চারিয়ে দিয়েছেন। অবশ্যই, এই বৈশিষ্ট্য তাঁর অনেক কবিতায় দেখা যায়।
গতকাল জোছনা ছিল বিগলিত চাঁদের বর্ষণ
যেন কদরের রাতে নূরের বৃষ্টিতে
ভিজে গেছে কার কাজলা বরনের গাই।
(নন্দনতত্ত্ব)
এখানে বোঝানো হয়েছে, জোছনার রূপালি আলোর ঢেউয়ে অন্ধকার কেটে গেছে। যেমনটা তীব্র আলোর বিচ্ছুরণে কালো রঙের গাভীর শরীর থেকে রঙ ঠিকরে ঠিকরে পড়ে। এখানে ‘কাজলা বরন গাই’ অন্ধকার রাতের এবং ‘নূরের বৃষ্টি’ পরাবাস্তব আলোর প্রতীক। এই দুয়ে মিলে সৃষ্টি হয়ে একটি প্রকৃতিলগ্ন চিত্রকল্পের।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সময়টা একইসঙ্গে আনন্দের, দুঃখের; গর্বের। আবার প্রতিশোধ স্পৃহারও। যারা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদারদের দোসর হয়ে, বাঙালিদের খুন ও ধর্ষণে জড়িত ছিল, তাদের ধরে-ধরে শাস্তি দেওয়া-ই ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের ব্রত। পাকিস্তানি হানাদারের চেয়ে দেশীয় রাজাকার-আলবদল-আলশামস বাহিনী ছিল বেশি ভয়ঙ্কর। কিন্তু মুশকিল ছিল, এই সব রাজাকার-আলবদর আর আল শামস বাহিনীর সদস্য মুক্তিযুদ্ধের পরপরই ভোল পাল্টাতে শুরু করে। কেউ-কেউ সফলও হয়। এই বর্ণচোরদের দলে খোদ লেখক-শিল্পীদেরও কেউ-কেউ ছিলেন। কবিদেরও কেউ-কেউ ভোল-বোল দুটো-ই বদলে স্লোগান ধরেছেন ভিন্নকণ্ঠে, অন্যসুরে। এ সব কেবল রাজনৈতিক কর্মকা- ছিল না, কবিতা চর্চারও অংশ হয়ে উঠেছিল। স্বাধীনতাবিরোধীদের আস্ফালন দেখে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন কবিরা। তাই প্রতিবাদ করেছেন প্রকাশ্যে। কারও স্বর ছিল তীব্র, কারও কারও মৃদু কিন্তু তীক্ষ্ণ শেলবর্ষী। এমন ক্রুর সময়ের চিত্র এঁকেছেন ‘অবলোকনের মাত্রা’য়। এ কবিতায় বলেছেন, যখন প্রাণীকূলের শনাক্তচিহ্ন খুঁজে পায় না, তখন এমন হয়,
সুন্দরী নারীর সাথে মাদীকুকুরের
বস্তুতই আর কোনো পার্থক্য থাকে না।
শিবির দাপিয়ে-ফেরা কোনো কোনো জাঁহাবাজ সেনা
সহসা শুয়োর হয়ে নেমে পড়ে ক্ষমতার সমূহ কাদায়;
উরুর বন্ধ ছিঁড়ে ঘরের গৃহিণী ডাইনী হয়ে উড়ে চলে যায়।
(অবলোকনের মাত্রা)
এই উপলব্ধি উপস্থিতকালের রাজনৈতিক নৈরাজ্য, সামাজিক অবক্ষয় ও সাংস্কৃতিক সংকট-সৃষ্ট ঘটনার ফল। তাই কবি এমন বিতৃষ্ণ চিত্র আঁকার পর পাশাপাশি সে চিত্রের মহাকালিক ব্যঞ্জনা নিয়েও অতৃপ্তি প্রকাশ করেন। বলেন-‘এমন যে অন্তর্ভেদী চোখের মালিক সেও দেখতে পারি না/ আমার অক্ষরগুলো মহাকাল ঠিকমতো জমা করে কি না।’
রাষ্ট্রে-সমাজে নানা শ্রেণী-পেশার মানুষের বাস। প্রতিদিন মানুষ পার্থিব, অ-পার্থিব বিষয়ে ভাবনাবিনিময় করে। তবে, এই বিনিময়ের বেশিরভাগই সামাজিকতা। এর ভেতর ভদ্রতা আছে সত্য, আন্তরিকতা নেই। প্রয়োজন মেটানোর উপকরণ আছে, কাক্সক্ষা আছে; নেপথ্য কারণ নিয়ে কোনো গভীর বিবেচনা নেই। প্রায়ই কোনো দার্শনিক জিজ্ঞাসা নেই। কেবল প্রয়োজন মিটিয়ে যাওয়া আছে। মানুষের সঙ্গে মানুষের দেখা-সাক্ষাৎ আছে, আলাপ আছে, এমনকি একত্র বাসও আছে। কিন্তু একের সঙ্গে অন্যের সত্যিকার অর্থে জানাশোনা নেই। আধুনিক সমাজব্যবস্থা যেন নগরের উচ্চবিত্তের ড্রয়িংরুমের সুদৃশ্য ‘অ্যাকুরিয়াম’ আর নগরবাসী তার বাসিন্দা। তাদের চলাফেরা আছে, গতি আছে, এমনকি প্রাণও আছে। কিন্তু যা নেই, তাহলো প্রাণচাঞ্চল্য। আবিদ আনোয়ার একটি অতিপরিচিত বস্তুকে প্রতীকরূপে উপস্থাপন করে নগরজীবনের এই প্রাণচাঞ্চল্যহীন গতির বর্ণনা করেছেন।
জলেই থাকি কিন্তু তবু মাছের থেকে দূরে
ঘর বেঁধেছি স্বচ্ছ বালি, জলজ ক্যাকটাসে;
রুই-কাতল ও টাকির মেকি ফেনানো বুদ্বুদে
মন মজেনি ঘুচাতে চাই মীনের পরিচয়।আমার ঘরে নৈশব্দ্যও শব্দ থেকে দামী:
ফ্রাই উপমান, সিদ্ধ ধ্বনি, কল্পনা চচ্চরি,
প্রতীক-পরাস্বপ্নে চলে অলীক খাওয়া-দাওয়া;
যুগান্তরের পোশাক প’রে ঢুকছে যুগের হাওয়া!আমার ঘরে আসলে তুমি পেরিয়ে কাচের বাধা
দেখতে পাবে তেজস্ক্রিয় শাশ্বত এক নুড়ি,
সান্দ্র আলোর ফিনকি দিয়ে সত্য করে ফেরি,
একটু ছুঁলেই ছলকে ওঠে সমুদ্র-কল্লোলও।যুগের তালে কানকো নাড়ে তিন-পাখার এক মাছ
পটভূমি স্বচ্ছ বালি জলজ ক্যাকটাস…
(অ্যাকুরিয়াম)
এখানে প্রতীকাশ্র্রয়ী চিত্রকল্পের সাহায্যে কবি আধুনিক নগররাষ্ট্রের বাসিন্দাদের জীবনকে এঁকেছেন। যে জীবন দৃশ্যত মনোরম, বাস্তবে করুণ ও অসহায়ত্বে ভরপুর। যেখানে ভোগ আছে, গতি আছে, কিন্তু উপভোগের আনন্দ নেই, আপন ইচ্ছায় হারিয়ে যাওয়ার স্বাধীনতা নেই।
অর্থাৎ একইসময়ে একই জায়গায় বসবাস করেও একে অন্যের অচেনা। যেখানে আন্তরিকতার চেয়ে মেকি আভিজাত্যের দৌরাত্ম্য মানুষকে ব্যথিত করে। তাই এই পরিচয় ঘুচিয়ে আত্মপরিচয়ের সন্ধানে ব্যকুল হয়ে ওঠেন কবি। আধুনিককালের একটি অস্থির স্বভাব হলো, বারবার আত্মপরিচয় হারিয়ে ফেলা। তাই কবিকে স্বপ্ন দেখতে হয় আত্মপরিচয় আবিষ্কারের। কিন্তু অনেক সময় কবি সমকালীন সমাজবাস্তবতার চিত্র দেখে ব্যথিত হন। তখন তীব্র ক্ষোভ ও শ্লেষোক্তির ভেতর দিয়ে উপস্থিতকালের ক্রুর চিত্র আঁকেন তিনি। সমকালের তার্কিকদের নিষ্ফল তর্কযুদ্ধে বিরক্ত হন তিনি। কারণ ‘টেবিল ফাটানো প্রগতির ডামাডোলে/ বিজ্ঞেরা চুপ, মূর্খেরা আজ হিরো।’ কবি বলতে চান, মূর্খরা যেসব বিষয় নিয়ে তর্ক জুড়ে দেয়, সেসব বিষয় প্রায় অর্থহীন হয়। যেমন-‘যেনবা নদীতে নৌকাই নেই/ জলহীন স্রোতে দাঁড় টানে শত মাঝি।’ বর্তমান সময়ের মননহীনতা, প্রগলভতায় কবি বিব্রত, ব্যথিত। কারণ, এ সময়ে স্টান্টবাজদের দৌরাত্ম্যে রাজনীতি, সংস্কৃতি, সমাজনীতি সর্বত্রই নৈরাশ্য-নৈরাজ্য দেখা দিয়েছে। প্রস্তুতি নেই, তবু তার্কিক, নদীতে নৌকা নেই, জলও নেই। তবু তর্কের নদীতে শত শত ‘মূর্খা’ দাঁড় টানার ভান করে। মাত্রবৃত্তের সুর-লয়ের আশ্রয় সমকালকে কবি এভাবেই তুলে ধরেন।
ছন্দ প্রয়োগে আবিদ আনোয়ারের নিজস্ব কৌশল রয়েছে। কখনো কখনো স্বরবৃত্তের পঙ্ক্তিগুলো এমনভাবে বিন্যস্ত করেন, পাঠকালে মাত্রাবৃত্তের দোলা লাগে। উল্টো চিত্রও রয়েছে। মাত্রাবৃত্তকে এমনভাবে প্রয়োগ করেন, তাতে বেজে ওঠে স্বরবৃত্তের সুর। সে রকম একটি কবিতা ‘বোধন’। এ কবিতার মূল বিষয় সমকালীন অসঙ্গতিকে বিদ্রূপ করা। তবে সে বিদ্রূপচিত্র এঁকেছেন উপমাআশ্রিত চিত্রকল্পে। আবার একই পঙ্ক্তিতে প্রকৃতি আশ্রয়ী চিত্রকল্প যেমন নির্মাণ করেছেন, তেমনি মধ্যখণ্ডনও করেছেন। উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি পরিষ্কার করা যাক—
বিশ-শতকী পাঁকের রঙে রাঙিয়ে ছেঁড়া জামা
ঢুকবে একবিংশে নাকি অন্য কোনো ঝড়
বলবে ডেকে বালকপনা থামা এবার থামা,
সূর্য থেকে আসছে নেমে নতুন কারিগর।
(বোধন)
এই উদ্ধৃতির দ্বিতীয় পঙ্ক্তির প্রথম পর্ব ও দ্বিতীয় পর্বে একটি মধ্যখণ্ডন রয়েছে। পঙ্ক্তিটি হলো—’ঢুকবে এক/বিংশে নাকি/ অন্য কোনো/ ঝড়’। এখানে ‘একবিংশ’ শব্দটির ‘এক’ প্রথম শব্দ ‘ঢুকবে’র সঙ্গে মিলে প্রথম পর্ব এবং ‘বিংশ’ শব্দটি পরবর্তী শব্দ ‘নাকি’র সঙ্গে মিলে দ্বিতীয় পর্ব গঠন করেছে। এতে পঙক্তির প্রবহমানতা যেমন বজায় রয়েছে, তেমনি উক্তির অর্থ প্রকাশেও ব্যাঘাত ঘটেনি। কবি পাঁচ মাত্রার পর্বসংবলিত পর্বের পঙ্ক্তিটি এভাবেও সাজাতে পারতেন-‘একবিংশে/ ঢুকবে নাকি/ অন্য কোনো/ ঝড়’। এতে প্রতিটি পর্ব স্বাধীন হতো বটে, কিন্তু প্রবহমানতায় ব্যাঘাত ঘটতো। একইসঙ্গে কবি বঞ্চিত হতেন মধ্যখণ্ডনের একটি চমৎকার প্রয়োগ কৌশল থেকে।
উপস্থিতকালের অস্থিরতা ও নৈঃসঙ্গ চেতনা কবি মনে বিক্ষিপ্ত করে তুলেছে। মানুষের হাসির পেছনে ক্রুর স্বভাব, আপাতত ভদ্র আচরণের পেছনে স্বার্থে চোরাবালি তাঁকে ব্যতিত করেছে। তিনি দেখেছেন সমাজকর্মী থেকে শুরু করে রাজনীতিবিদ-মন্ত্রী থেকে কবিপর্যন্ত স্বার্থসিদ্ধির জন্য মেরুদণ্ডহীনে পরিণত হন। ‘লক্ষ্যস্থল পা নয়, পদবী’ কবিতায় দেখিয়েছেন ‘লেহনের লক্ষ্যস্থলও আজকাল পা নয়, পদবী;/ চতুর কৌশলে চলে পরস্পর প্রাপ্য দেওয়া-নেওয়া।’ এমন সামাজিক বাস্তবতায় সুন্দরের স্বপ্ন দেখতেও হৃদয়বানরা ভয় পান। যেখানে কেবল ‘পরস্পর প্রাপ্য দেওয়া-নেওয়া’র শর্তে চলে মানুষ, সেখানে সুকুমার বৃত্তি পরিচর্যা উপেক্ষিত থাকে-এটাই স্বাভাবিক। আর এমন স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের বেদনার চিত্র আঁকতেই আবিদ আনোয়ার লিখেছেন আটপঙ্ক্তির কবিতা-‘অষ্টক’। অক্ষরবৃত্তের আঠারো মাত্রায় রচিত এ কবিতায় মানবতা-শিল্প-উপস্থিত কালের যুগল বর্ণনা রয়েছে। তীব্র শ্লেষ ও মিথের আশ্রয়ে পুরো কবিতাটি রচিত। প্রকৃতি ও মানুষের স্বভাবের বৈরিতা, স্বার্থপরতার ছবি আঁকতে গিয়ে মঙ্গলকাব্যের আশ্রয় নেন কবি। সপ্রাণ লখিন্দরের চেয়ে কঙ্কাল লখিন্দরের প্রার্থনা করেন। ক্রুর সময়ের এমন চিত্র তিনি আঁকেন, যেখানে মমত্ব বোধ, সৌন্দর্য চেনতার মূল্য আপাতত নেই। কারণ সুন্দরের সাধককে কেবল পথে-পথে ‘বৈরি জুজুবুড়ি’ ভয় দেখায়। তাই প্রেম, ভালোবাসা কিংবা মাঙ্গলিক কর্মযজ্ঞে মানুষ হতোদ্যোম হয়ে পড়ে। পুরো কবিতাটি এখানে উদ্ধার করা যাক—
লখাই কঙ্কাল হোক, যদি ফের ফিরে পায় আয়ু
মাংসপেশী খুবলে খাক গাঙুরের ক্ষুধিত বোয়াল
হাড়েও বসাক থাবা সময়ের হিংস্র জলবায়ু-
ভেলা ও বেহুলা যদি বয়ে যায় আরও কিছুকাল।শুকনো পাতা ঝরে যাক হেমন্তের দারুন দাপটে
প্রকৃতির রসায়নে পুনর্জন্মে হয় যদি কুঁড়ি;
ভাঙুক নদীর পার জমে যদি অন্য কোনো তটে-
যে যায় পরীর দেশে পথে দেখে বৈরী জুজুবুড়ি।
(বৈরি জুজুবুড়ি)
ক্ষুদ্র একটি কবিতায় সমকালের ক্রুর চিত্র এঁকে তিনি উত্তরকালের জন্য একটি সতর্কবার্তাও দিয়েছেন। তা হলো, সুন্দর ও মঙ্গলযাত্রীর পথ কখনো মসৃণ হয় না, তার পথে পথে বাধা থাকে, ষড়যন্ত্র থাকে। তার পথেপথে গাঙুরের ক্ষুধার্ত বোয়াল হা করে থাকে। মিথ ও প্রতীকাশ্রয়ী চিত্রকল্প ‘গাঙুরের ক্ষুধিত বোয়াল’-এর মাধ্যমে আধুনকিকালের মানবশত্রুদের চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন কবি। এই ‘ক্ষুধিত বোয়াল’রা যুগেযুগে মানবসভ্যতার ক্ষতির চেষ্টা করেছে, মানুষকে করেছে বিভ্রান্ত। কবি এই ক্ষুধিত বোয়ালদের কাছ থেকে মানবজাতিকে রক্ষা পাওয়ার কোনো পথ বলে দেন না, বরং বক্রোক্তির মাধ্যমে বলেন, মানুষের প্রতীক লখাইয়ের হাড়মাংসও খেয়ে নেওয়ার কথা বলেন। কারণ, মানুষ যতক্ষণ পর্যন্ত আত্ম বলে বলিয়ান না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো বৈরি পরিবেশকে জয় করতে পারবে না। ভীরু অভিযাত্রীর সামনেই বারবার জুজুবুড়ি এসে হাজির হবে। আর এই জুজুবুড়ির ভয়কে জয় করতে হলে মানুষকে আত্মবলে বলিয়ান হতে হবে, তবেই পুনর্জন্মে ‘কুঁড়ি’ হওয়া সম্ভব।
কবিতা আবিদ আনোয়ারের কাছে কেবল আবেগ প্রকাশের মাধ্যম নয়, প্রজ্ঞা ও মনীষারও স্বাক্ষর। তিনি আধুনিক মানুষের জীবনযাত্রাকে অবলোকন করেছেন গভীর অভিনিবেশের সঙ্গে। উপস্থিতকালের নিষ্ঠুরতা, গতি ও পোশাকি আচরণ তাকে ব্যথিত করেছে সত্য, বিমর্ষ করতে পারেনি। তিনি কল্পনা, পর্যবেক্ষণ, চিন্তা ও মনীষার মিথস্ক্রিয়ায় আধুনিক জীবনের বহুরৈখিক চিত্র এঁকেছেন। সে ছবির রেখা আলোছায়া ও রঙের ব্যবহারে তিনি স্বেচ্চাচারী নন। তাঁর পরিমিতি বোদ ও রুচির আভিজাত্যের ছোঁয়ায় সে ছবিতে দিয়েছেন প্রাণচাঞ্চল্য। তাতে তাকিয়ে থাকার আনন্দ আছে, দৃষ্টির স্বস্তি আছে। বস্তুগত বিষয়ের সঙ্গে নির্বস্তুর যোগসূত্র স্থাপনের চেষ্টা আছে। সময়ের প্রধান অসুখ শনাক্ত করে তার চিত্র আঁকার কৌশল তাঁর করায়ত্ত। তিনি যেকোনো বিষয়কে হৃদয়ে ধারণ করার পাশাপাশি করোটিতেও ধারণ করেন। এ কারণেই তাঁর আবেগ নিয়ন্ত্রিত, প্রজ্ঞাশাসিত। কবিতায়ও মিথকথনের স্বাক্ষর স্পষ্ট।