কোনো তত্ত্বের ছাঁচে ফেলে আবদুল মান্নান সৈয়দের কবিতার বিশ্লেষণ করা অবিচারের সমান। কারণ, মান্নান সৈয়দ তাত্ত্বিক নন; মতবাদীদের তত্ত্বের শিকার। এ কারণে তিনি ‘পরাবাস্তববাদী’ উপকবির খণ্ডিত অভিধায়ও অভিষিক্ত। যে অভিধা কোনোভাবেই তার জন্য কোনও সম্মান বয়ে আনে না। বরং একজন সার্বভৌম কবিকে উপগ্রহে পর্যবসিত করে।
আবদুল মান্নান সৈয়দ সার্বভৌম কবি; সম্পন্ন কণ্ঠস্বর। ‘জনপ্রিয়তার দুঃসহ সাধারণে’ ভেসে যাওয়ার সামর্থ্যহীনতাকে হৃদয়ের ঔদার্যে বরণ করেও আবেগের সংহতি ও প্রজ্ঞার সম্মিলনে আলোড়নসম্ভব অভিঘাতে ঘুমন্ত মগজকে হৃদয়ের সামনে সমর্পণ করেন তিনি। ‘জন্মান্ধের’ কবিতায় মানুষের আদিম ভয় ‘অভাব’ দাঁড়িয়ে থাকে আড়চোখে। জিজ্ঞাসার মতো আরক্তিম কাতারে। এ উপলব্ধি কোনও জনপদে প্রভাবসঞ্চারী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের নয়। নয় নিছক সমাজকর্মী কিংবা সমাজচিন্তকেরও।
বাঙালির এই দ্বিধাজড়িত মানসিকতা বাঙালির মানসিক বিকাশের পথকে রুদ্ধ করে রেখেছে শতকের পর শতকের। কেউ তার বিরুদ্ধে টু শব্দটি পর্যন্ত উচ্চারণ করার সাহস করে না। যারা করেন, তাদের নেই সে প্রথাগত ধারণাকে ভেঙে নতুন ধারণা জন্ম দেওয়ার প্রজ্ঞা ও সামর্থ্য।
রাজনৈতিক সমাজকর্মী ও সমাজচিন্তকের বিনিময় প্রত্যাশা থাকে। তারা অবদমন শেখেনি। প্রয়োজনে কেড়েও নিতে জানে। তাই তারা অবদমনের মর্মজ্বালা উপলব্ধিতে ব্যর্থ। কিন্তু যিনি চরাচরের বিভিন্ন ঘটনা ও আচরণের সংঘর্ষে আপন হৃদয়কে রক্তাক্ত করার মতো ইচ্ছার অবদমনের শিকার, তার অক্ষোম আক্রোশে দূরারোগ্য ব্যাধির মতো মস্তিষ্কের কোষে কোষে অনুরণন তোলে অতৃপ্ত কামনা। সেখানে নীতিবোধ নিতান্ত তুচ্ছ। প্রেমে কামের আবেদন চিরন্তন। কবি অন্তর্দ্বন্দ্বকে শিল্পিত মহিমায় মহিমান্বিত করে তোলেন।
আমার চেয়ে সৎ শহরতলীর সরোবর লক্ষ করে নদীর তীরের মতো অলস সেই গাধা-অবিকল নগ্ন, উন্মোচিত; আর আমি জানোয়ারশোভন শার্টের তলায় জনাব সৈয়দ, মানবেন্দ্রসংবৃত ত্বকের তলায় জনাব কুকুর: পল্লবের পর পল্লব-ঘেরা সংবরণ ভেদ করে, আমার প্রতিভা অর্থাৎ শয়তান, কোনোদিন তোমাকে ছুঁয়ে যেতে পারবে না, মহিলা হে। (গাধা এবং আমি)
মান্নান সৈয়দ যখন একজন ধর্মাবতারের মতো স্বর্গলোকের সিঁড়িতে বসে চিত্তের চাঞ্চল্যের অর্গল খুলে শুরু করেন:
‘এই রাত্রিরা বেথেলহামকে ব্রথেল-এ পরিণত করে, করুণ কবাটের মতো ঝোলানো বাড়ির দেয়াল থেকে লুটিয়ে থাকে যেন বর্ম কিংবা বিরুদ্ধ পদ্ধতি হাওয়ার-রুপালি চাবির অভাবে। এই রাত্রিরা সেই লাল আলোর ভালো যা তোমাকে প্রশস্ত স্ট্রিট থেকে নিয়ে যাবে কঙ্কালের সরু-সরু পথে, অনাব্য স্ত্রীর মতো কেবলি অন্যদিকে—যখন জানালায় ছিন্নপত্র ঝরে অবিচ্ছিন্ন, লোকালোক পুড়ে যায় বরফে। এই রাত্রিরা জিরাফের গলা বেয়ে লতিয়ে উঠতে দ্যায় আগুন, যেটা আমাদের আকাক্সক্ষা, অবশ্য যদি তার মাংস হতে রাজি হই তুমি আর আমি; ঈশ্বর-নামক গৃহপালিত মিস্তিরি ভুল সিঁড়ি বানাচ্ছে আমাদের উঠোনে বসে—আগুনের, যে অসম্ভবের সিঁড়ি উঠতে উঠতে আমরা সবাই পাতালে নেমে যাবো হঠাৎ। (পাগল এই রাত্রিরা)
তখন মান্নান সৈয়দ কবি, শিল্পীর ও ধর্মাবতারের ভেদরেখা মুছে দিয়ে একজন সম্পন্ন মানুষ হয়ে ওঠেন। যার কাছে স্বর্গ মূল্যহীন; নরক পবিত্র মনোরম ও চিত্তাকর্ষক।
চিৎপ্রকর্ষের প্রশ্নে নৈতিকতার প্রসঙ্গ তার কাছে অবান্তর। তার কাছে পাপ ও প্রেম অভিন্ন প্রপঞ্চের দুই সম্পূরক রূপের মর্যাদা পায়। তার উপলব্ধি দ্ব্যর্থহীন ‘পাপের ভিতর গোলাপ থাকে এমনকী শব্দের পাপেও, কবিরা যেমন’ (পাগল এ রাত্রিরা)।
বাঙালির প্রায় সবকটি চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্য মান্নান সৈয়দে উপস্থিত। তার কবিতা কখনো বাঙালির অবদমনকে ছাড়িয়ে মুক্তমনের স্মারক হয়ে ওঠে না। তার প্রেমও বাংলা কবিতার প্রথাগত কবিদের মতোই শাশ্বত ও নিষ্কাম। কাম সেখানে দ্বিধাজড়িত। প্রেমের প্রশ্নে মান্নান সৈয়দ রূপকথা-উপকথাকে ছাড়িয়ে রক্তমাংসের মানুষের মনোদৈহিক সম্পর্কের প্রতি আস্থা স্থাপন কর চাননি। চাননি তার কারণ বাঙালির সমাজ ব্যবস্থাপনার সংকীর্ণরূপ ও গোঁড়া মনস্তত্ত্ব। বাঙালির এই দ্বিধাজড়িত মানসিকতা বাঙালির মানসিক বিকাশের পথকে রুদ্ধ করে রেখেছে শতকের পর শতকের। কেউ তার বিরুদ্ধে টু শব্দটি পর্যন্ত উচ্চারণ করার সাহস করে না। যারা করেন, তাদের নেই সে প্রথাগত ধারণাকে ভেঙে নতুন ধারণা জন্ম দেওয়ার প্রজ্ঞা ও সামর্থ্য। তাই তারা যা বলেন, তা মূলত ব্যক্তিগত অভিরুচি প্রকাশের স্বার্থেই। কতকটা সমাজে চমক সৃষ্টির উদ্দেশ্যেও। কিন্তু প্রজ্ঞাবান ও মেধাবী কবিরা চিরকালই প্রথাগত প্রেমে স্বস্তি পেতে চেয়েছেন।
যে প্রেমের ধারণা তারা মূলত সুফিদের কাছ থেকে পেয়েছেন। সুফিদের প্রেমে সৃষ্টি ও স্রষ্টার অভিন্ন সত্তারই জয়গান গাওয়া হয়। সেখানে মানবচিত্তের উদ্বোধন সম্ভব হয় না। মান্নান সৈয়দও তার ব্যতিক্রম নন। তিনিও বলেন,
এসো পান করো অপ্রেম, হায় আত্মতাড়িরা, পতিতার মতো অতিরঞ্জিত সত্যের মুখমণ্ডল রাখো প্লেটের উপর অভুক্ত, এসো তোমরা, আস্তিন ভিজিয়ে ব্যতিক্রম খাও, বলো: ‘আমি অসাধারণ হতে পারি নাকো, ছোট্টো অসাধারণ! ধার-করা অর্ধ-মুকুটে হও বাস্তব পান করো মধ্যরজনীর চুল’। —শ্রুতির ভিতর এই সিংসং কণ্ঠস্বর পাঁচনের মতো পুরে বসে রইলাম আমি রমণদূর মা: ঈশ্বর ও শয়তানের। (বাঙালি কবিতা)
অথচ, এ ধার করা অনলেই পুড়েছে অধিকাংশ বাঙালি কবি। যাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল বাঙালি পরিচয় ঘুচিয়ে আধুনিক হয়ে ওঠা। যারা মনে করেন, বাঙালি সংস্কৃতির রূপান্তরের মধ্যে আধুনিকতা নেই, সেখানে আছে গ্রাম্যতা, তারা মনে করেন জসীমউদ্দীন গ্রাম্যকবি, নজরুল-সুকান্ত উচ্চকণ্ঠের চেঁচামেচির কবি। তাই নজরুল-জসীমউদ্দীন-সুকান্তকে আধুনিক কবিতার আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন না, সেসব অভিজাত কাব্যবোদ্ধা সমালোচক।
চিৎপ্রকর্ষের সমস্ত গোপন আয়োজন এমন অলৌকিক রাত্রেই সম্পন্ন হয়। না হলে সবই আয়োজনই বৃথা হতে বাধ্য। গদ্যবাক্য যেখানে স্পন্দনহীন ভাব প্রকাশ করে তার দায়িত্ব শেষ করে; সেখানে গদ্যছন্দে রচিত পঙ্ক্তি ভাবপ্রকাশ করার পরও তার ভিন্ন রকম আবেদন নিয়ে পাঠকের সামনে উপস্থিত হয়।
সময় বদলে গেছে। কালক্রমে রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দ-সুধীন্দ্রনাথ দত্তের দলছুট নজরুল-জসীমউদ্দীন-সুকান্তই বাঙালির নিত্যপাঠ্য বিষয়ে পরিণত হতে পেরেছেন। মাঝখান থেকে কোনো-কোনো ‘পরধন লোভে মত্ত’ কবি ও সমালোচক আত্মশ্লাঘায় ভোগার মতো হীনমন্যতার পরিচয় দিয়েছিলেন মাত্র। যারা কালের র্যাঁদার টানে মুছে গেছেন নিজের মুখোশসহ। মান্নান সৈয়দের কবিতায় সে দলছুট কবিদের আত্মারই প্রতিধ্বনি শোনা যায়।
দেশি বিষয়কে মননের স্মারক করে তোলার পক্ষে মান্নান সৈয়দের প্রচেষ্টা লক্ষণীয়। ‘সান্দ্র চাষা’ কবিতায় ‘তরমুজ খেত-ভরা সোনালি চরের একফালি’ চিত্রকল্পে যে আবহমান বাংলার ছবি দেখান, সে ছবিই ‘শহরে, অচেনা মাছ’ কবিতায় একটি মাছের অস্তিত্বের ভেতর হাঁপিয়ে উঠে যুক্তিরহিত আবেগে-কল্পনায় নিজেকে ভাসিয়ে যায় আরোপিত পরাবাস্তব জগতের ‘অচেনা শহরে’? যেখানে কবি উপলব্ধি করে প্রাণিত হন— ‘আমি সমুদ্রে চলেছি’। যে ‘স্বপ্নবিদ্ধ’ কবি ‘তারাদের তহবিল-তসরুপ করেছি আমিই’ বলে নিজেকে বিভিন্ন ঘটনাপ্রপঞ্চের ভেতর আবিষ্কার করেন, সে কবিই ‘বুদ্ধিজীবী’ কবিতায় উপলব্ধি করেন খ্যাতিকাঙাল বুদ্ধিজীবীদের বসবাস মূলত ঈর্ষাকাতরতার ভেতর। যেখানে নিজেরা কেবলই কাদা ছোড়াছুড়ির মধ্যে ব্যস্ত থাকতে পছন্দ করেন।
মান্নান সৈয়দ কবিতায় শেকড়ের কথা বলেন, স্বপ্নের কথা বলেন, ঐতিহ্যের ছবি আঁকেন। তার কবিতার বিষয়বস্তু আবহমান বাঙলার মাঠ-ঘাট প্রান্তর থেকে শুরু করে বিশ্ব চরাচরের বিবিধ প্রপঞ্চ থেকে আহরিত। কবিতাকে নিছক স্বপ্নগ্রাহ্য শব্দপুঞ্জের গহ্বরে পরিণত করা তার লক্ষ্য নয়। কবিতায় ব্যবহৃত শব্দসমবায় এককভাবে ও সমবায়ীরূপে মানুষের মনস্তত্ত্বকে যেমন ধারণ করে, তেমনি সমাজের বহু অনুষঙ্গকেও নিজস্ব বিষয়ে পরিণত করে। ফলে ‘কর্দমে নক্ষত্রে’ কবিতায় ‘প্রাণপণ তোমাকে ধরে/ কর্দমে ডুবেছে পা, মাথা ঠেকে গিয়েছে নক্ষত্রে’, ‘স্বপ্নের অ্যানটেনা’ কবিতায় ‘কারফ্যু-শাসিত চার দেয়ালের মধ্যে বন্দি হয়ে আছি আমি’, ‘ফিনিক্স’ কবিতায় ‘কাবার মরে গেছি অসুখে, আঘাতে প্রত্যাখ্যানে; তারপরই দাহ থেকে জ্বেলেছি গোলাপ’, ‘পার্কস্ট্রিটে একরাত্রি’ কবিতায় ‘ছিঁড়ে ফ্যালো বৌদ্ধ শান্তি!/ -মহাযুদ্ধ মন্বন্তর পার-হওয়া ছেঁড়াখোঁড়া মানুষ এসেছি’ পঙক্তিসমবায় হয়ে ওঠে জীবনের শিল্পিত পাঠভুবন।
যে ভুবনে কেবল স্বপ্নচারী মানুষের অবাধ যাতায়াতকে স্বাগত জানানো হয় না; সঙ্গে সত্যসন্ধ-বস্তুনিষ্ঠ মনীষাকেও সসম্ভ্রমে আলিঙ্গন করা হয়। এভাবে তার কবিতা হয়ে ওঠে একজন মগ্ন শিল্পীর অনুধ্যান। ধ্যানস্থ সন্তের জ্যোতির্ময়ী অভিজ্ঞান। শিল্পের শর্তপূরণে তিনি নিমগ্ন। ধ্যানীর নিভৃত চর্চার ফাঁকে সৃষ্টি হয় ‘রাত্রি’ নামের এক অত্যাশ্চার্য কবিতা। তীব্র ঘোরের ভেতর মথিত না হলে এমন মাদকতাপূর্ণ কবিতা লেখা সম্ভব নয়। দৈর্ঘ্যের কারণে কবিতাটিকে কেউ কেউ এড়িয়ে যেতে পারেন। কিন্তু মনোযোগসহ পাঠ করলে অনুভবে ধরা পড়ে— এ কবিতা একজন কবির কেবল মনোবিকারকে বাজিয়ে তোলে না, সঙ্গে একটি সমাজব্যবস্থার অনিয়ম ও ভঙ্গুর আদর্শকেও তিরস্কার করে। শুরুই হয় প্রবহমান ঝর্ণার মতো শব্দস্রোতে পাঠককে ভাসিয়ে নিয়ে। ‘আজ রাত্রে আমি বেরিয়ে পড়েছি অক্ষরের বৃত্ত ভেঙে/ অক্ষরবৃত্তের বৃত্ত ভেঙে’ বলে সংকীর্ণতার গণ্ডি অতিক্রমণের ঘোষণা করেন। মানবসভ্যতার অগ্রগতির পথে মানুষই বারবার মারণাস্ত্র নিয়ে মানুষেরই ধ্বংসকে অনিবার্য করে তুলেছে।
আবার ‘তারারই কবিতার শব্দে আতীব্র উঠেছে বেজে অশ্বক্ষুরধ্বনি’। রাত্রি কেবল অন্ধকারের স্মারক নয়, রাত্রি আলোরও গহ্বর। রাত্রি নতুন দিনেরও সূচনাচিহ্ন। তাই স্থান-কালের সীমারেখার বৃত্ত ভেঙে এ রাত্রি হয়ে ওঠে মানবতার আত্মমুক্তি ও আত্ম-উদ্বোধনের মাহেন্দ্রক্ষণ। চিৎপ্রকর্ষের সমস্ত গোপন আয়োজন এমন অলৌকিক রাত্রেই সম্পন্ন হয়। না হলে সবই আয়োজনই বৃথা হতে বাধ্য। গদ্যবাক্য যেখানে স্পন্দনহীন ভাব প্রকাশ করে তার দায়িত্ব শেষ করে; সেখানে গদ্যছন্দে রচিত পঙ্ক্তি ভাবপ্রকাশ করার পরও তার ভিন্ন রকম আবেদন নিয়ে পাঠকের সামনে উপস্থিত হয়।
ঈশচিন্তায় তিনি ভাববাদী। সংশয়ীর দলে তাকে ফেলা যায় না। স্বনির্মিত কাব্যভাষায় অনেক দূর চলার দার্ঢ্য তার স্বভাবজাত। যা আয়ত্ত করেছেন, তা তার প্রজ্ঞা ও মনীষার ভিত্তিতেই করেছেন।
মান্নান সৈয়দের কবিতায় দেশীয় অনুষঙ্গের পাশাপাশি বিদেশি অনুষঙ্গের প্রবেশ অবাধ ও আনন্দের সঙ্গে সংবর্ধিত। উপমাকে তিনি প্রতিদিনের অভ্যাস থেকে মুক্তি দিয়ে ভিন্নতর উপলব্ধির বাহন করে তুলেছেন। উপমা নির্মাণে তার প্রাতিস্বিকতা রয়েছে।
কবিকে সময়ের কাছে তার জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করে যেতে হয়। না হলে মহাকাল কবিকে বরণ করে নিতে অনীহ থাকে। তখন কবির হয়তো আর কিছু করার থাকে না। নতুন কিছু চিত্রকল্পে পাঠকের দৃষ্টিকে আটকে রাখার ষোলো আনা দক্ষতা তার রয়েছে। এদিক থেকে তিনি চিত্রকল্পপ্রধান কবি। ‘সাঁঝের কমলাদ্যুতি’ কবিতায় ‘নশ্বর কমলাদ্যুতি জ্বেলেছিলে বিস্রস্ত নিখিলে’, ‘মাছ’ কবিতায় ‘শরতের স্বচ্ছ রাত্রি কাচের নদে/ ডুব দিয়ে খুঁড়ে চলে চেতনার মাছ।’ ‘শ্রাবণ’ কবিতায় ‘বৃষ্টি ঝরে যাচ্ছে এক দ্যুতিশীল ঝাড়লণ্ঠনের মতো’, উপমা ও চিত্রকল্পে তার মৌলিকতা সুস্পষ্ট। তার কবিতার বিষয়বস্তু আবহমান বাংলার পথঘাট-প্রান্তর থেকে আহরিত। চেতনায়ও বাঙালির চিন্তা ও মননের সম্পর্ক উজ্জ্বল। যেটুকু তার বহির্মুখীন স্বভাব, সেটুকু নিতান্তই বাংলা কবিতার সঙ্গে বিভাষার কবিতার সম্পর্কসূত্র স্থাপনের। অর্থাৎ ভাবনার আদান-প্রদান ও চেতনার প্রতিতুলনার প্রকাশ মাত্র।
সেখানে লুঙ্গিপরা বাঙালির কাঠি দিয়ে পান্তা খাওয়ার কষ্টকর কসরৎ নেই। যা আছে, তা আপন হৃদয়কে রাঙিয়ে নেওয়ার সুরটুকু মাত্র। এর বেশি নয় কোনো মতোই। সে সঙ্গে দেশীয় অনুষঙ্গের বৈশ্বিক বিষয়কে কবিতার অনুষঙ্গে রূপান্তরের যে পরাকাষ্ঠা তিনি দেখিয়েছেন, তা তাকে কোনো খণ্ডিত অভিধায় অভিষিক্ত করা যায় না। তিনি সার্বভৌম কবি।
পরাবাস্তব কবি অভিধা তার খণ্ডিত পরিচয়। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে কবিতায় নৈর্ব্যক্তিক প্রপঞ্চে উন্নীত করার ক্ষেত্রে তার কৃতিত্ব সুবিদিত। নিরূপিত ছন্দে যেমন সিদ্ধহস্ত; গদ্যছন্দেও তেমন স্বচ্ছন্দ। মিথের ভাঁড়ার থেকে যেমন রসদ গ্রহণ করেছেন, তেমনি চলমান জীবনের ঘটনা ও দুর্ঘটনাকেও করেছেন কবিতার অনুষঙ্গ। ঈশচিন্তায় তিনি ভাববাদী। সংশয়ীর দলে তাকে ফেলা যায় না। স্বনির্মিত কাব্যভাষায় অনেক দূর চলার দার্ঢ্য তার স্বভাবজাত। যা আয়ত্ত করেছেন, তা তার প্রজ্ঞা ও মনীষার ভিত্তিতেই করেছেন।
শব্দ তৈরি-নির্বাচন ও গঠনে অনেকটা বুদ্ধিবৃত্তিক। আবেগের তারল্যে ভেসে যায়নি তার কবিতার শব্দসমবায়। অপ্রচল শব্দকে করেছেন গতিশীল, দিয়েছেন প্রাণচাঞ্চল্যও। সঙ্গতকারণে কবিতা পাঠের সময় শব্দের আভিধানিক অর্থোদ্ধারের প্রয়োজনীয়তা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে।