মানুষ চায় জগতে পরিবর্তন আনতে, বিশ্বসমাজকে আরও উন্নত করে তুলতে। দুটি জিনিসের মাধ্যমে এটা সম্ভব। একটি হচ্ছে জ্ঞান, অন্যটি শিল্প। (আন্দ্রেই তারকোভস্কি)
এক.
সিনেমাকে তিনি কবিতা করে তুলেছিলেন। কবিতা যেমন জগৎ, মানবতা, সৌন্দর্যের বিমূর্ততা নিয়ে ভাবার, জীবনবোধের সূক্ষ্ণতা প্রকাশ করার মৌলিক একটি ধারা, ঠিক তেমনি তারকোভস্কির সিনেমাও দর্শককে বিশ্ব-জগতের অসীমতার ধারণাকে নিয়ে, ধর্ম, শিল্প ও দর্শন ও মানবতা নিয়ে ভাবতে বাধ্য করে। একজন কবির মতোই তিনি তার সিনেমায়, ছোট কোনো একটি বিষয়কেই সুসমঞ্জস সমগ্রে পরিণত করতেন। সিনেমাকে কখনোই পণ্য হিসেবে দেখেননি তিনি। সিনামা তার কাছে ছিল স্রেফ তরতাজা শিল্পের আরেকটি রূপ। ধার্মিক মানুষ হিসেবে তিনি ঈশ্বরের সন্তুষ্টির জন্য এবং মানুষের আধ্যাত্মিক বিকাশের জন্যই নির্মাণ করতেন চলচ্চিত্র। তার ধ্যান-ধারণা, ভালোবাসা, আশ্রয়; সবই ছিল তার চলচ্চিত্র। এ কারণেই তারকোভস্কিকে বলা হয় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম আধ্যাত্মিক ফিল্মমেকার ও সিনামার কবি। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক বারগম্যান তার সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘আমার কাছে তারকোভস্কিই সর্বশ্রেষ্ঠ পরিচালক, তিনি চলচ্চিত্রের নতুন ভাষা উদ্ভাবন করেছেন, চলচ্চিত্রের প্রকৃতির প্রতি তার ছিল সততা, যেমন করে প্রতিবিম্ব জীবনকে অধিগ্রহণ করে এবং জীবনের ওপর স্বপ্ন প্রতিফলিত হয়।’ শিল্পীর জীবন সম্পর্কে, তার নিজের কাজ অর্থাৎ চলচ্চিত্রভাবনা সম্পর্কে তারকোভস্কি মনে করতেন, শিল্পী সত্যের অনুসন্ধান পরিত্যাগ করলে শিল্পকর্মে তার প্রভাব হয় সর্বনাশা। তাই শিল্পীর লক্ষ্য হতে হবে সত্য। সেই সত্যের দীর্ঘ কণ্টকাকীর্ণ পথ পরিক্রমের জন্য তারকোভস্কির পছন্দ ছিল চলচ্চিত্র পরিচালনার কাজটি। তার মতে, ‘সিনেমায় সবচেয়ে বড় হচ্ছে আর্টিস্টের তথা পরিচালকের মনোভঙ্গি। বিশ্বের বর্তমান সমস্যাগুলো তাকে তলিয়ে বুঝতে হবে। ডাক্তার যেমন অস্ত্রপ্রচার করে শরীরের অভ্যন্তরীণ ভাগ নিরীক্ষণ করেন রোগ নির্ণয়ের জন্য, তেমনি আর্টিস্টেরও উচিত ছবির মাধ্যমে বিশ্বের বর্তমান ও চিরন্তন সমস্যাগুলো দর্শকের সামনে তুলে ধরা। সমস্যাগুলো একবার জানা হয়ে গেলে বিশ্বের জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিরা তার সমাধানের উপায় খুঁজে বের করতে পারেন।’
দুই.
ছেলেবেলায় তারকোভস্কির পুরো নাম রাখা হয়েছিল আন্দ্রেই আরসেনিয়েভিট তারকোভস্কি। ইভানোভো ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওবাস্টের ইউরিয়ভেটস্কি (রাশিয়ার কোস্ট্রোমা ওবাস্টের কাদিসস্কি জেলা) জেলার জাভ্রাজে গ্রামে ১৯৩২ সালের ৪ এপ্রিল তিনি জন্মগ্রহণ করেন। একইসঙ্গে রাশিয়ান চলচ্চিত্র নির্মাতা, লেখক, চলচ্চিত্র সম্পাদক, চলচ্চিত্র থিওরিস্ট, থিয়েটার ও অপেরা পরিচালক হিসেবে তিনি কাজ করেছেন। দীর্ঘ শটের মাধ্যমে অপ্রচলিত নাটকীয় কাঠামো, স্বতঃস্ফূর্তভাবে সিনেম্যাটোগ্রাফির ব্যবহার, আধ্যাত্মিকতা ও জীবনের চিত্রকল্পের সঙ্গে আত্তীকরণের মাধ্যমেই তিনি চলচ্চিত্রের সার্থকতা খোঁজার চেষ্টা করতেন। সিনেমায় তার অবদান এতটা প্রভাবশালী ছিল যে, অন্য কোনো সিনেমায় একই ধরনের কোনো শট নেওয়া হলেই তাকে বলা হয় তার্কোভস্কিয়ান কাজ। সিনেমা নিয়ে খুব সাধারণভাবে অন্য সবার মতো করে তিনি ভাবতে চাননি। তিনি বিশ্বাস করতেন সিনেমার গূঢ় বৈশিষ্ট্য নিহিত রয়েছে কালচেতনায়। চিরকাল একার সংকটে থেকে, সমস্যা ও বিরোধের সঙ্গে লড়ে, পথে পথে হোঁচট খেয়ে ও দিনের পর দিন বেকার থেকেও তিনি অবিচল থেকেছেন সাম্যের পথে। জীবনবোধের উন্মেষণ নিয়ে, শৈশব নিয়ে বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন,‘আমরা সেসময় খালি পায়ে চলাফেরা করতাম। গ্রীষ্মকালে জুতাই পরতাম না, কেননা জুতা ছিল না। শীতে আমি পশমি কাপড়ের বুট পরতাম এবং বাইরে যাওয়ার দরকার হলে মা-ও তাই পরতেন। দারিদ্র্য সঠিক শব্দ নয়, চরম দুরবস্থার চেয়েও খারাপ সেই অবস্থা। সম্পূর্ণ বোধাতীত, কল্পনাতীত। মা না থাকলে কিছুই হতো না, সবকিছুর জন্যই আমি মায়ের কাছে ঋণী।’
৬৫ সালের প্রথম থেকেই আন্দ্রেই তার ফিল্ম প্রোডাকশন অ্যাসিস্টেন্ট লারিসা কিজিকোভার সঙ্গে একসঙ্গে বসবাস করতে থাকেন এবং ১৯৭০ সালে তার প্রথম স্ত্রী ইরমার সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদের পর তিনি লারিসাকে বিয়ে করেন। ৭০ সালের ৭ আগস্ট তাদের পুত্র আন্দ্রিয়ুস্কার জন্ম হয়।
বাবা ইউক্রেন বংশোদ্ভূত আরসেনি তারকোভস্কি ছিলেন রুশ কবি ও অনুবাদক। মা মারিয়া ইভানোভনা ভিশনিয়াকোভা তারকোভস্কায়া ছিলেন থিয়েটার ও ফিল্ম অভিনেত্রী, যিনি মস্কোর ম্যাস্কিম গোরকি লিটারেচার ইনস্টিটিউটের গ্রাজুয়েট। ভল্গা নদীর তীরে গড়ে ওঠা শহর ইয়োরিয়েভেটসে কেটেছে তার শৈশব। শৈশবে তার অসংখ্য বন্ধু ছিল। বন্ধুদের মাঝে তিনি খুব সক্রিয় ও জনপ্রিয়ও ছিলেন। ১৯৩৭ সালে তার বাবা আরসেনি তারকোভস্কি সংসার ত্যাগ করলে তিনি ছোট বোন ও মায়ের সঙ্গে মস্কো চলে যান। ১৯৪১ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তার বাবা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। তারকোভস্কির মায়ের স্বপ্ন ছিল ছেলেকে শিল্প ও সংগীত ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত করা। তিনি ছেলেকে একটি মিউজিক স্কুলে পিয়ানো ক্লাসে ও আর্ট স্কুলে ভর্তি করান। ছবি আঁকা আর পিয়ানো বাজানো ছাড়াও তারকোভস্কি কবিতার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তিনি ১৯৩৯ সালে মস্কোতে এসে ৫৫৪ নম্বর স্কুলে ভর্তি হয়ে পড়ালেখা শুরু করেন। তবে যুদ্ধের জন্য পড়ালেখা স্থগিত হয়ে গেলে তিনি তার মা ও বোনের সঙ্গে নানির বাড়িতে আশ্রয় নেন। ওখান থেকে ১৯৪৩ সালে ফিরে এসে তিনি আবারও আগের স্কুলে ভর্তি হন। সোভিয়েত ফিল্ম স্কুল ভিজিআইকেতে ভর্তি হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি সংগীত ও ড্রয়িংয়ে পড়ালেখা চালিয়ে যান। এরইমাঝে ১৯৪৭ সালের নভেম্বর থেকে ৪৮ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত তিনি টিউবারকুলিস (যক্ষ্মা) রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। জীবনের নানামুখী সংগ্রামে যুদ্ধরত তারকোভস্কি বিশ্বাস করতেন, একজন শিল্পী কখনো আদর্শ এবং আরামদায়ক জায়গায় থাকাকালীন অবস্থায় খুব ভালো কোনো কাজ করতে পারেন না। শিল্পের জন্য চাই অপ্রাপ্তি। কোনো ফাঁপা পরিবেশে শিল্পীর পক্ষে বাস করা মুশকিল। শিল্পের জন্য চাপ দরকার, দরকার কষ্টের অনুভূতি। পৃথিবী যদি খুব আদর্শ জায়গা হতো তাহলে এখানে শিল্পের দরকার হতো না। আসলে অসুস্থ পরিবেশেই মহান শিল্পের জন্ম হয়।
তিন.
তারলোভস্কি লেখাপড়ার ব্যাপারে কখনো খুব বেশি মনযোগী ছিলেন না। ফলে ১৯৫১-৫২ সালে, মস্কো ইনস্টিটিউট ফর ওরিয়েন্টাল ল্যাঙ্গুয়েজে আরবি ভাষায় পড়া শুরু করেও শিগগিরই তিনি এ বিষয়ের প্রতি সব আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন।
এরপর অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স ইনস্টিটিউট ফর নন- ফোরাস মেটালস অ্যান্ড গোল্ড-এ খনিজ সন্ধানীর কাজ নেন। এ সময় সিদ্ধান্ত নেন ফিল্ম নিয়ে পড়ালেখা করার। ১৯৫৪ সালে গবেষণা অভিযান থেকে ফিরে আসার পর তিনি স্টেট ইনস্টিটিউট অব সিনেমাটোগ্রাফি (ভিজিআইকে)তে আবেদন করেন এবং চলচ্চিত্র পরিচালনার প্রোগ্রামে ভর্তি হন। ভিজিআইকে রাশিয়ার সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে একটি। তাকে খুব কঠিন প্রতিযোগিতায় পাস করে এখানে পড়ালেখা করতে হয়েছিল। ওই সময় অর্থাৎ সোভিয়েত রাষ্ট্র্রপ্রধান নিকিতা ক্রুসচেভের শাসনামলে তরুণ চলচ্চিত্র পরিচালকদের জন্য কিছু নতুন সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল। যদিও ১৯৫৩ সালের আগ পর্যন্ত এখানে বছরে খুব কম চলচ্চিত্রই তৈরি হতো, তবে ৫৪ সালের পর থেকে সেখানে নতুন নতুন পরিচালক আসতে শুরু করে এবং চলচ্চিত্রের সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। ক্রুসচেভের সময়ে তিনি সোভিয়েত সমাজে পশ্চিমা সাহিত্য, সিনামা ও সংগীত বিষয়ে বেশকিছু ডিগ্রি প্রবর্তনের ব্যবস্থা করেন। এ সময় কুরোশাওয়া, বুনুয়েল, বার্গম্যান, ব্রেসোকে পরিচালক হিসেবে দেখার এবং তাদের তৈরি সিনামাগুলো দেখার সুযোগ পান তারকোভস্কি। পরবর্তী সময়ে তার ওপর এই পরিচালকদের গভীর প্রভাব লক্ষ করা যায়। ফিল্মস্কুলে সিনেমা তৈরির ব্যাপারে মিখাইল রম ছিলেন তারকোভস্কির শিক্ষক ও পরামর্শক। যার ছাত্রদের মধ্যে শুকশিন ও কোঞ্চালোভস্কির মতো প্রভাবশালী চলচ্চিত্র পরিচালকরাও ছিলেন। তারকোভস্কি মনে করতেন, চলচ্চিত্র পরিচালক হবেন নানাদিক থেকেই একজন সংগ্রাহক। সিনেমার সঙ্গে তার আবেগ অনুভূতির ব্যাপারগুলো, ইমেজগুলো, প্রকৃতপক্ষে তার পুরো জীবনটাই একটি নির্দিষ্ট অর্থময় ব্যঞ্জনায় বেঁধে থাকবে। সেখানে অভিনেতাদের উপস্থিতি থাকুক না থাকুক, তাতে খুব একটা বেশি কিছু যায় আসে না। চলচ্চিত্রের নিমগ্ন ছাত্র তারকোভস্কি ১৯৫৭ সালের এপ্রিলে ভিজিআইকের সহপাঠী ইরমা রাউসকে বিয়ে করেন। ১৯৬২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর তাদের প্রথম সন্তান সেঙ্কার জন্ম হয়। বাবা আরসেনি তারকোভস্কির নামেই ছেলের নাম রাখা হয়। ভিজিআইকেতে পড়ার সময়েই তারকোভস্কির কাজ পছন্দ হয়ে যায় চলচ্চিত্র পরিচালক গ্রিগোরি চুখরাইয়ের। ছাত্রের প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে চুখরাই তার ফিল্ম ক্লিয়ার স্কাইসের জন্য সহকারী পরিচালক হিসেবে তাকে নিতে চেয়েছিলেন। আন্দ্রেই প্রথমে আগ্রহ দেখালেও পরে তিনি নিজের গবেষণা ও প্রকল্পগুলোতে মনোযোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ফিল্মস্কুলের তৃতীয় বছরে পড়ার সময় তারকোভস্কির পরিচয় হয় কঞ্চালোভস্কির সঙ্গে। যিনি পরবর্তী সময়ে রাশিয়ার একজন চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক ও স্ক্রিপ্ট রাইটার হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। পরিচয়ের প্রথম থেকেই তারা দুজন ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। তাদের চিন্তার জগৎ, ভাবনা ও পছন্দের জায়গার মিল থাকায় তারা দুজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে ওঠেন। ১৯৫৯ সালে দুজন মিলে লিখে ফেলেন এন্টারটিকা-ডিসেন্ট কান্ট্রি নামক একটি স্ক্রিপ্ট। স্ক্রিপটি তারকোভস্কি ফিল্ম প্রোডাকশন ইউনিট লেনিন ফিল্মে জমা দেন। ওই সময় অবশ্য সেটি এক্সেপ্টেড হয়নি। পরবর্তী সময়ে তারা দ্য স্টিমরোলার অ্যান্ড দ্য ভায়োলিন নামক আরেকটি সফল স্ক্রিপ্ট তৈরি করেন। সেটি বিক্রি করেন রাশিয়া ও ইউরোপের সবচেয়ে পুরাতন ও বৃহৎ ফিল্ম স্টুডিও মসফিল্ডে। ১৯৬০ সালে এটি তারকোভস্কির গ্রাজুয়েশন প্রোগামে কাজে লাগে। যা তাকে ডিপ্লোমা পেতে সাহায্য করেছিল। পরের বছর নিউইয়র্ক স্টুডেন্ট ফিল্ম ফেস্টিভালে এটি প্রথম পুরস্কার লাভ করে। ৬৫ সালের প্রথম থেকেই আন্দ্রেই তার ফিল্ম প্রোডাকশন অ্যাসিস্টেন্ট লারিসা কিজিকোভার সঙ্গে একসঙ্গে বসবাস করতে থাকেন এবং ১৯৭০ সালে তার প্রথম স্ত্রী ইরমার সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদের পর তিনি লারিসাকে বিয়ে করেন। ৭০ সালের ৭ আগস্ট তাদের পুত্র আন্দ্রিয়ুস্কার জন্ম হয়।
চার.
ব্যক্তিগত জীবনে সর্বদা প্রতিকূল অবস্থায় থাকা তারকোভস্কিকে ৫৪ বছরের জীবদ্দশায় মোকাবিলা করতে হয়েছে একের পর এক দুর্ভাগ্য, বাধাবিপত্তি আর হয়রানি। এছাড়া সোভিয়েত চলচ্চিত্রের সঙ্গে জড়িত থাকার ২০ বছরের কর্মজীবনে ১৭ বছরই তাকে বেকার অবস্থায় থাকতে হয়েছে। এই সময়ে তিনি নির্মাণ করতে পেরেছিলেন মাত্র সাতটি ফিচারফিল্ম। সেগুলো হচ্ছে, ইভান’স চাইল্ডহুড (১৯৬২), আন্দ্রেই রুবলেভ (১৯৬৬), সোলারিস (১৯৭২), দি মিরর (১৯৭৫), স্টকার (১৯৭৯), নস্টাজিয়া (১৯৮৩) ও দ্য সেক্রিফাইস (১৯৮৬)। এছাড়া তিনি একটি প্রামাণ্যচিত্র ভয়েজ ইন টাইম (১৯৮২) ইতালি থেকে প্রযোজনা করেন। ফিল্ম স্কুলের ছাত্র থাকা অবস্থায় দ্য কিলার (১৯৫৬), দেয়ার উইল বি নো লিভ টুডে (১৯৫৯) ও দ্য স্টিমরোলার অ্যান্ড ভায়োলিন (১৯৬১) নামে তিনটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রও নির্মাণ করেন। অল্পসংখ্যক চলচ্চিত্র তৈরি করার পরও তার প্রত্যেকটি সৃষ্টি সত্য ও সুন্দরের যাত্রাপথে এক-একটি নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। শিল্পী হিসেবে তিনি চিরকাল স্বাধীনতার জন্য লালায়িত ছিলেন। নিজ দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নে তিনি কখনোই স্বাধীনভাবে কাজ করার কোনো সুযোগ পাননি। রাষ্ট্রের সদয় সম্মতি ছাড়া সেখানে একটি শটও নেওয়া সম্ভব নয়। ফলে সিনেমা করতে গিয়ে তাকে প্রতিমুহূর্তে হয়রানির শিকার হতে হতো। প্রচলিত অর্থে চলচ্চিত্র বলতে যা বোঝানো হয়, তারকোভস্কির সৃজন প্রক্রিয়ায় আসলে আমরা সেটা দেখি না। চলচ্চিত্রের সঙ্গে জীবনের চিত্রকল্পের সম্পূর্ণ আত্তীকরণের মাধ্যমেই তিনি চলচ্চিত্রের অস্তিত্ব ও সার্থকতা খুঁজে পেতেন। তার কাছে চলচ্চিত্র মানেই সত্যের অন্বেষণ, দর্শন, মানব প্রবৃত্তি, অনুভূতির সাবলীলতা, শাশ্বত চেতনার প্রবাহমানতা অথচ কাঠামোগত প্রচলিত দৃশ্যবিন্যাসে অনীহা। তিনি ছিলেন এক স্বপ্নমগ্ন প্রেমাতুর শিল্পী। যিনি যত্নবান ছিলেন মানবিক সম্পর্কগুলোর প্রতি। মানব জীবনের বিভিন্ন ঘাত প্রতিঘাতের ভেতর দিয়ে প্রতিনিয়ত তাকে যেতে হয়েছে। তাই তিনি বিশ্বাস করতেন প্রতিটি মানুষকেই মানুষ চিনতে হবে। একবার চিনতে পারলেই মানুষের মধ্যে পারস্পারিক বোঝাপড়া এসে যাবে এবং সেখান থেকেই আসবে বিশ্বপ্রেম।
সিনেমাটির ওপর অভিজাততন্ত্রের শর্ত চাপানো হয়। কর্তৃপক্ষ এটিকে তৃতীয় শ্রেণীর ফিল্ম হিসেবে গণ্য করে। আর শুধু তৃতীয় শ্রেণীর সিনেমা হলগুলোতে এবং শ্রমিক ক্লাবে দেখানোর অনুমূতি দেয়।
পাঁচ.
তারকোভস্কির প্রথম ফিচার ফিল্ম ইভান’স চাইল্ডহুড তাকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দেয়। ১৯৬২ সালে ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে এটি সর্বোচ্চ পদক গোল্ডেন লায়ন জিতে নেয়। এতিম ছেলে ইভান যার বাবা-মা ও বোনকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান সৈন্য নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল। তার মনস্তাত্ত্বিক যন্ত্রণা ও যুদ্ধ চলার সময়ের তার যে অভিজ্ঞতা, সেটাই মূলত এ ছবির উপজীব্য। এখানে যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি ও বীভৎসতা দেখানো হয়। এটি সম্পর্কে বলতে গিয়ে তারকোভস্কি বলেছেন যে, যুদ্ধের প্রতি তার ঘৃণাকেই তিনি ছবিতে তুলে ধরতে চেয়েছেন, যেখানে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিশুরা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পূর্বফ্রন্টে সোভিয়েত আর্মির সঙ্গে জার্মান ওয়েরমাট ও জার্মান নাজির সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধের নানা ফ্ল্যাশব্যাক দেখানো হয় ছবিতে। ১২ বছর বয়সী ইভান যুদ্ধের স্বপ্ন দেখে ঘুম থেকে জেগে ওঠে এবং গ্রামের একটি জলাশয় পার হয়ে যাওয়ার সময় সোভিয়েত আর্মি তাকে ধরে নিয়ে ক্যাম্পে রাখে। সেখান থেকে বোর্ডিং স্কুলে পাঠানোর চেষ্টা করা হলে সে কিছুতেই স্কুলে না গিয়ে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত জানায়। ইভান তার বাবা-মায়ের হত্যার প্রতিশোধ নিতে চায়। ফলে যুদ্ধের একপর্যায়ে গভীর রাতে বনের জলাভূমিতে ক্যাপ্টেন কলিন ও গেলসেভের সঙ্গে একটি অপারেশনে অংশ নেওয়ার একপর্যায়ে ইভান বনের গভীরে নিখোজ হয়ে যায়। এরপর যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে লেফটেন্যান্ট গেলসেভ জানতে পারে যে, ক্যাপ্টেন কলিনকে হত্যা করা হয়েছিল এবং ইভান জার্মান আর্মির কাছে ধরা পড়ায় তাকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছিল। ফিল্মটি গোল্ডেন লায়ন ছাড়াও সান ফ্রান্সিস্কো ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে গোল্ডেন গেইট অ্যাওয়ার্ড জিতে নেয় এবং ৩৬তম অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডে বেস্ট ফরেন ল্যাঙ্গুয়েজ ফিল্ম হিসেবে মনোনীত হয়।
এরপর ১৯৬৫ সালে, ১৫ শতকের আইকন পেইন্টার আন্দ্রেই রুবলভকে নিয়ে ‘আন্দ্রেই রুবলেভ’ নামেই তিনি একটি ফিচার ফিল্ম তৈরি করেন। ছবিটি তৈরির পর থেকেই সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ তার ওপর ভীষণভাবে রুষ্ট হয়ে ওঠে এবং সিনেমাটির ব্যাপারে প্রবলভাবে বাধা দিতে থাকে। ফলে বহুবার কাটছাঁট করার ফলে এটির বেশ কয়েকটি ভার্সন তৈরি হয়। ১৯৬৯ সালে এর একটি ভার্সন দেখানো হয় কান চলচ্চিত্র উৎসবে। ছবিটি সেখানে ফিপ্রেস্কি প্রাইজ জিতে নেয়। রাশিয়ার আইকন চিত্রশিল্পী রুবলেভের ভাবনা ও অনুভূতিকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে চলচ্চিত্রটি। কবি-সন্ন্যাসী রুবলেভ পৃথিবীকে দেখেছিলেন একজন বালকের দৃষ্টিতে, যার চোখের সামনে ঘটে চলেছিল একের পর এক পাশবিক হিংস্রতা ও নারকীয় ভয়াবহতা। অথচ তিনি ছিলেন একজন দয়ালু মানুষ। উপলব্ধি করেছিলেন, একমাত্র শুভচেতনা ও মুক্তমনের ভালোবাসাই পারে সব হিংস্রতাকে পরাজিত করে মানবিক এক পৃথিবী গড়তে। তারকোভস্কি ফিল্মটির মাধ্যমে দর্শককে দেখাতে চেয়েছিলেন দূষিত পঙ্কিল ব্যধিগ্রস্ত একটি কালেও, দুর্বিনীত সময়ের দাসত্বের মধ্যেও, ধ্বংসাত্মক লড়াইয়ের ভেতরেও কী করে সহমর্মিতার আকাক্সক্ষার জন্ম হয়। আর সেখান থেকেই জন্ম হতে পারে ট্রিনিটির মতো মহান শিল্পের। ফিল্মটি শুরু হয় একটি গরম বায়ু চালিত বেলুনের যাত্রার মধ্য দিয়ে। বেলুনটি একটি নদীর পাশের গির্জার সঙ্গে দড়ি দিয়ে পেঁচানো ছিল। ইয়েফিম নামে এক লোক (নিকোলায় গ্লাজকোভ) বেলুনের নিচের দড়িকে বর্ম হিসেবে ব্যবহার করে ওড়ার চেষ্টা করছিলেন। তার ওড়ার চেষ্টার প্রথম মুহূর্তেই নদী থেকে একদল অজ্ঞ মানুষে এসে হাজির হয় এবং তার চেষ্টাকে ব্যর্থতায় পরিণত করতে ইয়েফিমকে সহায়তা করছে এমন একজনের মুখে জ্বলন্ত কাঠখণ্ড চেপে ধরে। এতকিছুর পরেও বেলুনটি সফলভাবে আকাশে উড়ে যায়। ইয়েফিম আকাশে ওড়ার আনন্দ অনুভব করে ও ওপর থেকে অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখার আনন্দে অভিভূত হয়। অবশ্য সে ক্রাশ ল্যান্ডিংকে কিছুতেই প্রতিহত করতে না পেরে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ে। এই পতনের পর পুকুরের পাশে আমরা একটি বিষণ্ন ঘোড়াকে গড়াগড়ি খেতে দেখি, ঘোড়াটি ছিল সব ঘটনার একজন নীরব সাক্ষী। তারকোভস্কি সবসময় জীবনের প্রতিশব্দ হিসেবে ঘোড়াকে দেখেছেন। তিনি বলেন, ‘যখন আমি একটা ঘোড়ার দিকে তাকাই, তখন জীবনের প্রত্যেক সারবস্তুর সংস্পর্শে আছি বলে মনে করি। সেটা সম্ভবত এই কারণে যে, ঘোড়া একটি খুব সুন্দর জন্তু ও মানুষের বন্ধুতুল্য। এছাড়া ঘোড়া ভীষণভাবে রুশীয় নিসর্গের বৈশিষ্টসূচকও বটে। সিনেমাটিতে রুবলেভ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তার প্রিয় অভিনেতা আনাতোলি সোলোনিৎসি। আন্দ্রেই রুবলেভ ১৯৭১ সালয়ে মুক্তি পায়।
এরপর পোলিশ সায়েন্সফিকশন লেখক স্তানিশল লেমের ১৯৬১ সালে প্রকাশিত কল্পবিজ্ঞান উপন্যাস সোলারিস অবলম্বনে ১৯৭২ সালে তিনি ‘সোলারিস’ মুভিটি তৈরি করেন। সোলারিস নামক একটি অদ্ভূত গ্রহের চারদিকে আবর্তনরত, মানুষের তৈরি একটি কৃত্রিম উপগ্রহে ঘটতে থাকা অদ্ভূত সব ঘটনাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে সিনেমাটির কাহিনি। ঘটনা সম্পর্কে জানার জন্য পৃথিবী থেকে একজন মনোবিজ্ঞানী ক্রিস কেলভিনকে (দোনাতাস বানিয়োনিস) সেখানে পাঠানো হয়। এমন মনে হতে থাকে যে, সোলারিস গ্রহটি নিজেই একটি বিশাল মস্তিষ্ক। কেলভিন লক্ষ করেন, গ্রহটি কৃত্রিম উপগ্রহের অধিবাসীদের অবচেতন মনে প্রবেশ করে সেখানে যা যা দেখতে পায়, তাকে বাস্তবের মতো তার সামনে এনে উপস্থিত করতে পারে। একদিন কেলভিন তার মৃত স্ত্রী হারিকে নিজের ক্যাবিনেটে দেখতে পান। হারি পৃথিবীতে থাকা অবস্থায় আত্মহত্যা করেছিল। একসময় স্পেসশিপের বিজ্ঞানীরা হারিকে তার ১০ বছর আগে পৃথিবীতে থাকতে আত্মহত্যা করার কথা করিয়ে দেয়। ফলে হারি তরল নাইট্রোজেন খেয়ে আবার আত্মহত্যা করার চেষ্টা চালায়। কিন্তু সেখানে আবারও তার পুনর্জন্ম হয়। এটি আসলে ব্যক্তি ও ব্যক্তির দহনকে মুখ্য করে তৈরি করা একটি ফিচার ফিল্ম।
এরপর ১৯৭৩ থেকে ৭৪ পর্যন্ত তিনি মিরর সিনেমাটির শুটিং করেন। এটি একটি আত্মজীবনীমূলক সিনেমা। এখানে আমরা নানা আঙ্গিকে একজন মৃত্যুপথযাত্রী কবির অর্থাৎ তার বাবা আর্সেনি তারকোভস্কির স্মৃতিকে উন্মোচন হতে দেখি। যিনি তার জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তার সন্তান ও সংসারকে ত্যাগ করেছিলেন। ছবিটিতে স্বল্প প্রবাহের ইমেজগুলোর গতি হারিয়ে সমৃদ্ধ এবং সংকেতিক প্রতীকের সঙ্গে একাত্ম হয়ে মিশে যেতে দেখি। মিরর আসলে অ্যালেক্সেরই শিশু, কিশোর এবং তার চল্লি¬শ বছর বয়সী জীবনের প্রতিফলন। একইসঙ্গে তার আশেপাশের দুনিয়ার বিষয়-আশয়, চিন্তাভাবনা, আবেগ ও স্মৃতিগুলোর বর্ণনাও এখানে দেখানো হয়। চলচ্চিত্রের গঠনটি প্রচলিত প্লটে না ফেলে এতে নানা স্মৃতি ও স্বপ্নকে বিছিন্নভাবে দেখতে পাওয়া যায়। এখানে তিনটি ভিন্ন সময় ফ্রেম অর্থাৎ যুদ্ধের আগের ১৯৩৫ সালের শৈশবের স্মৃতি, ১৯৪০ সালের যুদ্ধের সময় এবং যুদ্ধের পরের ১৯৬০/৭০ সালের মধ্যে সে পরিক্রমণ করতে থাকে। মস্কো থেকে যুদ্ধের সময় গ্রামাঞ্চল এলাকায় ফিরে যাওয়া, তার বাবার সংসার ত্যাগ করা, একজন মুদ্রণযন্ত্রের প্রুফ-রিডার হিসেবে তার মা’র জীবন সংগ্রামকে ঘিরেই মিরর সিনেমাটি গড়ে উঠেছে। শুরুতে এই ফিল্মটিকে খুব একটা ভালোভাবে নেয়নি সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ। সিনেমাটির ওপর অভিজাততন্ত্রের শর্ত চাপানো হয়। কর্তৃপক্ষ এটিকে তৃতীয় শ্রেণীর ফিল্ম হিসেবে গণ্য করে। আর শুধু তৃতীয় শ্রেণীর সিনেমা হলগুলোতে এবং শ্রমিক ক্লাবে দেখানোর অনুমূতি দেয়। সোভিয়েত সমাজে ওই সময় কোনো সিনেমা তৃতীয় শ্রেণীর তালিকাভুক্ত হলে সেটি ফিল্মমেকারের জন্য অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের কারণ হয়ে দাঁড়াতো। পরবর্তী সময়ে সেই ফিল্মমেকারের কোনো সিনেমায় কেউ আর টাকা লগ্নি করতেন না। ফলে এ সময় কঠিন এক বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল তারকোভস্কিকে।
এরপর প্রখ্যাত সোভিয়েত লেখক স্ক্রুগাৎস্কি ভ্রাতৃদ্বয়ের বিজ্ঞ্যান কল্পকাহিনী ‘রোডসাইড পিকনিক’ অবলম্বনে স্টকার সিনেমাটি তৈরি হয়। মানব জীবনের অর্থ ও উদ্দেশ্য নিয়ে মানুষের যে চিরন্তন দার্শনিক জিজ্ঞাসা, সেটার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে সিনেমাটিতে। এটিতে বাস্তব ও কল্পনা, লিরিক্যাল ও এপিক, মনোজগৎ ও বাস্তব জগতের মেলবন্ধন দেখানোর প্রয়াস ছিল। এখানে দেখানো হয়, পারমাণবিক বিস্ফোরণের ফলে পৃথিবীতে একটি বিস্ময়কর অঞ্চলের সৃষ্টি হয়। সেখানকার মানুষ বিশ্বাস করে যে, জায়গাটির একটি পরিত্যক্ত ভবনের কক্ষে প্রবেশ করলেই মনের সব ইচ্ছে পূরণ করা সম্ভব। এটিকে জোন নামে ডাকা হয় এবং কক্ষটিকে বলা হয় রুম। এখানে প্রবেশ নিষিদ্ধ। তবে স্টকার নামে পরিচিত কিছু লোক আছে যারা অর্থের বিনিময়ে জোনে নিয়ে জেতে পারে। এমনই একজন স্টকার একজন বিষণ্ন লেখক এবং একজন প্রফেসর, যিনি নোবেল প্রাইজ পেতে ইচ্ছুক এমন দুজন মানুষকে পথ দেখিয়ে নিষিদ্ধ ধ্বংসস্তূপের ভেতর দিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু সেখানে গিয়ে রুমে ঢোকার আগেই তাদের বিশ্বাস টলে যায়। জোনের অস্তিত্ব সম্পর্কে তাদের মনে প্রশ্ন জাগে। এমনকি স্টকারও সন্দিহান হয়ে ওঠে। তাই তারা জোনে প্রবেশ না করেই ফিরে আসে। চলচ্চিত্রে স্টকার চরিত্রে অভিনয় করেছেন আলেকজান্দার কাইদানোভস্কি। বিশ্বের সেরা ৫০টি সিনামার একটি হিসেবে স্টকারকে ধরা হয়।
এটিও কান চলচ্চিত্র ফেস্টিভ্যালে জিতে নেয় গ্রান্ড প্রিন্স স্পেশাল জুরি প্রাইজ, ফিপ্রেস্কি প্রাইজ ও প্রাইজ অব দ্য ইকুমেনিক্যাল জুরি।
১৯৭৯ এর গ্রীষ্মে অর্থাৎ ১৬ জুলাই তারকোভস্কি ইটালির রোমে যান। সেখানে তার দীর্ঘদিনের বন্ধু কবি টনিনো গুয়েরার সঙ্গে যৌথভাবে তৈরি করেন ভয়েজ ইন টাইম নামের একটি ডকুমেন্টরি। ১৯৮০ সালে দুই বন্ধু মিলে তৈরি করেন নস্টালজিয়া সিনামাটির স্ক্রিপ্ট। ১৯৮২ সালে নস্টালজিয়া বানানো শুরু করেন। কিন্তু সামনে এসে হাজির হয় মহাবিপদ। মসফিল্ম কর্তৃপক্ষ আর অর্থলগ্নি করবে না বলে জানিয়ে দেয়। হাল ছাড়েন না তারকোভস্কি। তিনি ইতালির পাবলিক ব্রড কাস্টিং কোম্পানি আরএআই (রেডিওটেলিভিশন ইতালিয়ানা)-এর আর্থিক সহায়তায় ফিল্মের কাজ শেষ করেন। পরে এটি কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রদর্শিত হয় এবং সেখানে এটি ফিপ্রেস্কি প্রাইজ এবং প্রাইজ অব দ্য ইকুমিনিক্যাল জুরি জিতে নেয়। রোবের ব্রেসোর সঙ্গে গ্র্যান্ড প্রিন্স স্পেশাল জুরি প্রাইজটিও জিতে নেয়। ছবিটির কাহিনি হচ্ছে, একজন রুশ লেখক ও প্রফেসর আন্দ্রেই গোরচেকভ রাশিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতালির রেনেসাঁ স্থাপত্যের ইতিহাস পড়ান। অথচ তিনি কখনোই ইতালিতে যাননি। একসময় গবেষণার জন্য তিনি ইতালিতে যান। একজন দোভাষীকে সঙ্গে নিয়ে তিনি ইতালির নানা প্রাসাদ ও স্মৃতিসৌধ দেখা শুরু করলে তার নিজের সমস্ত জ্ঞান, গবেষণা ও পড়াশোনা সবকিছুই তার কাছে একসময় নিরর্থক, মৃত ও শূন্য মনে হতে থাকে। তার মনে হয় যে, যারা এসব স্মৃতিসৌধ, প্রাসাদ গড়ে তুলেছেন, তাদের আত্মা, হৃদয় এখানেই রয়ে গেছে। তারা সবকিছু বুঝতে পারেন, অবলোকন করতে পারেন। তিনি উপলব্ধি করেন, শুধু বইপত্র, পুঁথি পড়ে এতদিন তিনি যা কিছু ছাত্রছাত্রীদের শিখিয়েছেন, তা আসলে কখনো পূর্ণতা পায়নি। আসলে এইসব অভিজ্ঞতা, অনুভূতি সবই উপলব্ধির ব্যাপার, এগুলো কোনো ক্লাসঘরে ছাপানো বইয়ের মাধ্যমে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তিনি বুঝতে পারেন না, দেশগুলোর মধ্যে এতসব দেয়ালের কারণটা কী? সেইসব কৃত্রিম রীতিনীতিসমূহ, যা মানুষকে অন্যের থেকে আলাদা করে দেয়, সেগুলোকে তিনি গ্রহণ করেন না। দুনিয়াদারি সম্পর্কে তার এই অপাপবিদ্ধ দৃষ্টি এবং দেশ ছেড়ে আসার বাস্তব অবস্থার সংঘাতের মধ্যে একদিন ডোমেনিকো নামের একজনের সঙ্গে তার পরিচয় ও বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। লোকটি প্রকৃতপক্ষে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ও বিষণ্ন, যিনি সাত বছর ধরে তার স্ত্রী-সন্তানকে পৃথিবীর খারাপ সংস্পর্শ থেকে বাঁচানোর জন্য গৃহবন্দি করে রেখেছেন। তিনি বিশ্বাস করেন, একটি জলন্ত মোমবাতি হাতে নিয়ে খনিজ পুকুরের একপাশ থেকে অন্যপাশ পর্যন্ত হেঁটে যেতে পারলে এই পৃথিবীকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে। ডোমেনিকো তার এই স্বপ্নটি পূরণ করার দায়িত্ব গোরচেভকে দেয়। গোরচেভ একসময় বিশ্বাস করতে থাকে যে, তার ভেতর ডোমেনিকো প্রবেশ করেছে। ফলে সে একাধিক চেষ্টার পর জ্বলন্ত মোমবাতিটি পুকুরের অন্য প্রান্তের একটি দেয়ালে প্রতিস্থাপন করে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ে। তারকোভস্কি নস্টালজিয়া সিনামাটিতে শুধু একজন ব্যক্তির আবেগকে তুলে ধরতে চাননি, বরং এটিকে তিনি একটি রোগ বা এমন একটি অসুস্থতা হিসেবে দেখিয়েছেন, যা মানুষের আত্মার শক্তি, কাজ করার ক্ষমতা, বেঁচে থাকার আনন্দকে নিঃশেষ করে দেয়। তিনি বলেন, ‘একটি কাহিনির অবয়বে সমস্যাটির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, ইতালিতে আসা একজন সোভিয়েত বুদ্ধিজীবীর মধ্যে, আমি এই নস্টালজিয়ার ধরন ও প্রবণতাকে খুঁটিয়ে লক্ষ করতে চেয়েছি।’ নস্টালজিয়া কী? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে তারকোভস্কি বলেছিলেন, ‘নিছক অতীত সম্পর্কে শোকাচ্ছন্নতাই নস্টালজিয়া নয়। নিজের অন্তরের প্রতিভাকে গণ্য না করে, তাকে ঠিকভাবে সাজিয়ে না তুলে ব্যবহার না করে এবং এইভাবে নিজের কর্তব্যে ফাঁকি দিয়ে যে সময়কে বয়ে যেতে দিয়েছে, তার জন্য বিষাদের অনুভূতিই নস্টালজিয়া।’
১৯৮৪ সালের বেশিরভাগ সময় তিনি কাটান সেক্রিফাইস ফিল্মটির প্রস্তুতির কাজে। ইতালিতে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি আর কখনো সোভিয়েত ইউনিয়নে ফিরবেন না বলে ঘোষণা দেন। নিজ দেশে স্বাধীনভাবে কাজ করতে না পারার কষ্ট থেকে তিনি মুক্তি চেয়েছিলেন। সিনেমার জন্য সর্বচ্চো আত্মত্যাগেও তিনি পিছুপা হননি কখনো। স্টকার চলচ্চিত্র করার সময় ক্যানসারের ঝুঁকি নিয়েই পরিত্যক্ত পারমাণবিক রিঅ্যাক্টরের কাছে শুটিং চালিয়ে গেছেন। ধারণা করা হয়, এর ফলেই স্বাধীনভাবে ফিল্ম তৈরি করে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকা মানুষটি ১৯৮৫ সালে ক্যানসারে আক্রান্ত হন। অবশ্য এতকিছুর পরেও তিনি ৮৫ সাল পুরোটাই সুইডেনে ছিলেন এবং দ্য স্যাক্রিফাইস সিনেমার কাজ চালিয়ে যান। সিনেমাটিতে আমরা মানষিকভাবে যন্ত্রণাক্লিষ্ট অ্যালেকজান্ডার নামের একজন মানুষকে দেখি, যিনি পারমাণবিক বিপর্যয়ের হাত থেকে পৃথিবীকে বাঁচাতে তার সবকিছু ত্যাগে প্রস্তুত। তিনি মনে করেন যা কিছু তার প্রিয় অর্থাৎ তার বাড়ি, এমনকি তার সন্তান লিটিল ম্যানকেও তিনি এই পৃথিবীকে বাঁচানোর জন্য স্যাক্রিফাইস করতে রাজি থাকেন। ফলে একদিন তিনি তার পরিবারের সবাইকে বাড়ির বাইরে বেড়াতে যেতে উদ্বুদ্ধ করেন এবং সমুদ্রের পাশে অবস্থিত তার নিজের অত্যন্ত প্রিয় বাড়িতিতে আগুন ধরিয়ে দেন। অ্যালেকজান্ডার ঈশ্বরে বিশ্বাসী নন অথচ আমরা দেখতে পাই আকস্মিক এক দুর্বিপাকের ঘোষণায় তার জীবনে চরম দুর্দশা ঘনিয়ে আসে। তখন তিনি তার শেষ আশ্রয় হিসেবে ঈশ্বরকে আকড়ে ধরেন এবং ঈশ্বরের সন্তুষ্টির জন্য তার নিজের সবচেয়ে প্রিয় বস্তু উৎসর্গ করেন।
ছয়.
সিনামায় কাজ করা নিয়ে তারকোভস্কি কিছু নিয়ম মেনে চলতেন। সেটা হচ্ছে সামগ্রিক স্ক্রিপ্ট সম্পর্কে অভিনেতা অভিনেত্রীদের কিছু জানাতেন না। তিনি মনে করতেন, স্ক্রিপ্ট জেনে গেলে অভিনেতা-অভিনেত্রীরা সচেতনভাবে অভিনয় শুরু করেন। ফলে শটটি তার স্বাভাবিকতা হারায়। উদাহরণস্বরূপ তিনি বলেন, ‘মিরর এর প্রথম দৃশ্যে যখন প্রধান চরিত্রাভিনেত্রী বেড়ার ওপর বসে সিগারেট খেতে খেতে স্বামীর জন্য অপেক্ষা করে, আমি চেয়েছিলাম, অভিনেত্রী মারগারিটা তেরোকোভা যেন চিত্রনাট্যের বিশদ কিছু না জানতে পারেন। তার মানে, তিনি জানেনই না যে মানুষটা শেষ পর্যন্ত ফিরবে কি না। না কি লোকটি চিরকালের জন্য চলে গেছে। এটা করা হয়েছিল এই উদ্দেশ্যে যে, যার চরিত্রে অভিনেত্রী অভিনয় করেছিলেন, তিনি একদা যেভাবে থাকতেন, ঠিক সেভাবে তিনিও ওই মুহূর্তে থাকবেন ভবিষ্যৎ জীবনের ঘটনাবলির কথা না জেনেই। অভিনেত্রীটি যদি জানতেন যে তার স্বামী আর কখনোই ফিরবেন না, তাহলে নিঃসন্দেহে তিনি তার আগাম আশাহত অবস্থাটিকে অভিনয়ের মধ্যে আপনা আপনিই প্রকাশ করে ফেলতেন এবং না চাইলেও বড় পর্দায় তার মুখের হতাশার ভাব কখনো লুকানো যেতো না।’
কর্মজীবনের বেশিরভাগ সময় বেকার থেকেও তিনি একের পর এক সাতটি সিনেমা শেষ করেন। তার সর্বশেষ সিনেমা স্যাক্রিফাইসের শুটিং শেষ হয় ৮৬ সালের জানুয়ারিতে। এরই মধ্যে তিনি ভীষণভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। জানুয়ারির শেষে তিনি প্যারিসের একটি হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি হন। নানাবিধ ঝামেলার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে ছেলে আন্দ্রিয়ুস্কা সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে ছাড়া পেয়ে বাবার কাছে আসার সুযোগ পায়। তারকোভস্কির হাসপাতালে চিকিৎসারত অবস্থায় থাকার সময়েই ১৯৮৬ সালের ৯ মে দ্য স্যাক্রিফাইস ছবিটি মুক্তি পায়। এটিও কান চলচ্চিত্র ফেস্টিভ্যালে জিতে নেয় গ্রান্ড প্রিন্স স্পেশাল জুরি প্রাইজ, ফিপ্রেস্কি প্রাইজ ও প্রাইজ অব দ্য ইকুমেনিক্যাল জুরি। বাবার অসুস্থতার কারণে ছেলে বাবার হয়ে পুরস্কারগুলো গ্রহণ করেন। ১৯৮৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর প্যারিসের একটি হাসপাতালে আন্দ্রেই তারকোভস্কি মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৮৭ সালের ৩ জানুয়ারি ফ্রান্সের রাশিয়ান সেমেন্ট্রি সেন্ট জেনেভিয়েভ-দেসবোয়ারে তাকে সমাধিস্থ করা হয়।
এপিটাফে লেখা হয়, ‘দেবদূতের দেখা পেয়েছিলেন এই মানুষটি।’
বিশ্ব সিনেমার কথা
ফারহানা রহমান
প্রচ্ছদ: মনিরুল মনির
প্রকাশক: খড়িমাটি
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি, ২০২০
মূল্য: ২০০ টাকা