কৃষিভিত্তিক বাঙালির জীবনে ফসলকেন্দ্রিক যেসব উৎসব আনন্দের অনুষঙ্গ হয়ে হৃদয়ের গভিরে প্রোথিত হয়েছে, জীবনকে আরও বেশি মাটিবর্তী করেছে, আগ-উৎসব সেগুলোর অন্যতম। এছাড়া বাঙালির জীবন তো কৃষকেরই জীবন! কৃষিনির্ভর জীবন! উৎসবপ্রিয় জাতি বাঙালি। বাঙালির জীবনাচারে জড়িয়ে রয়েছে বহুমাত্রিক উৎসবের ব্যঞ্জনা! এসব উৎসব জীবনের ভিন্ন ভিন্ন দিকের প্রতিনিধিত্ব করে। আগ-উৎসবের মাধ্যমে বাংলার ঘরে ঘরে পৌঁছে যায় নবান্নের আগমণী র্বাতা। জীবন ও জনপদ উৎসবের রঙে রঙিন হয়ে ওঠে। মাঠভরা ফসলের পানে তাকালে বুকের মধ্যে শিহরণ খেলে যায়। দিগন্তবিস্তিৃত মাঠজুড়ে কেবল সোনাঝরা ধান। আহা, পাকা ধানের শীষগুলো অসীম সম্ভাবনায় যেন মাথা নুয়ে থাকে!
আগ-উৎসব বলতে আমরা যা বুঝি—আমন মৌসুমে গৃহস্থের ফসল যেদিন প্রথম কাটা হয় ওইদিনের রীতিনীতি ও আচার অনুষ্ঠান। আরও নির্দিষ্ট করে বললে, বলতে হয় শুরুর আয়োজনের কথা। বস্তুত ফসলের দানা পুরুষ্ঠু ও রঙিন হওয়ার সঙ্গে-সেঙ্গে উৎসবের আমেজ অনুভূত হয়। আনন্দে অন্তর দুলে ওঠে। ধান কাটা ও উৎসবের নির্দিষ্ট কিছু নিয়মকানুন আছে। অঞ্চলভেদে নিয়মের ভিন্নতাও পরিলক্ষিত হয়। নতুন ধান কাটা কাঁচি নিয়ে কৃষক ফসল কাটা আরম্ভ করে। তার আগে পশ্চিমমুখী হয়ে ক্ষেত ও কাঁচি ছুঁয়ে সালাম করে। ফসল তখনো পরিপূর্ণভাবে পেকে ওঠে না। কাঁচাপাকা। যেসব স্থানে তুলনামূলক বেশি রঙ ধরে সেখান থেকে গোছা গোছা ধান কেটে আটি বাঁধে। কোনো কোনো কৃষক ক্ষেতের তিন কোণ থেকে কয়েকে আঁটি ধান কাটে। কাটা ধানের আঁটি মাথায় নিয়ে চতুর্থ কোণ অর্থাৎ যে কোণ থেকে ধান কাটা হয়নি, সেই কোণ থেকে ক্ষেতের বাইরে আসে। তিন কোণ থেকে ধান কাটা বিষয়ে তাদের মতো লোহা ও ফসলের সংস্পর্শে অপদেবতা বা অনিষ্টকারীর পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। অবশিষ্ট পথ ধরে কেবল দেবী লক্ষ্যি ও কৃষক যাতায়াত করতে পারবে।
খুব ভোরে উঠে কৃষাণী গোবর ও আলোমাটি দিয়ে ঘরের পিঁড়ি বা উঠোন লেপে দেয়। ফসলের গায়ে ঝাঁটার স্পর্শ লাগা অমঙ্গলের আলামত। অতএব সতর্ক কৃষক ঝাঁটা এড়িয়ে চলে। ধান গোছাতে হাত, গামছা কিংবা খড়ের গোছা ব্যবহার করে। মাড়ায়ের ক্ষেত্রেও ভিন্ন পদ্ধতি। বিশেষ এক ধরনের কাঠের গুঁড়ি বা তক্তা ব্যবহার করে। স্থানীয়ভাবে ওই তক্তাকে ‘পাট’হিসেবে উল্লেখ করা হয়। গচ্ছিত ধান কাঠা বা পালিতে করে মাপ-পরিমাপ করা হয়। পরিমাপ শেষ হলে কাঠার মধ্যে একমুঠো ধান নিয়ে গচ্ছিত ধানের উঁচুভাগে তা রেখে দেয়। ওই একমুঠো ধান নাকি দেবী লক্ষ্মীর সম্মানে। দেবী এতে খুশি হয়ে কৃষকের মঙ্গলে আরও আরও বর দেবে!
ক্ষেতের এই প্রথম ফসল থেকে সিদ্ধ করে চাউল তৈরি করা অনূচিত। এ-কারণে রোদে শুকিয়ে ঢেঁকিতে ছেঁটে চাউল বানায়। বিশেষ এই চাউলের নাম ‘আলোচাল’। আলোচালের সঙ্গে আখের গুড় মিশিয়ে তৈরি হয় পায়েশ বা সিন্নি। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের মাঝে সিন্নি বিতরণের আগে কিছু সিন্নি পশুপাখিদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার রেওয়াজ প্রচলিত আছে। এ-সময় কৃষক-পরিবারের উৎসবের আমেজ বিরাজ করে। পড়শীরা আগ্রহভরে গিন্নীকে রান্নায় সহায়তা করে। শিশু-কিশোরদের মধ্যে উচ্চস্বরে ধ্বনিত হয় সৃষ্টিকর্তার নামাবলি। ক্ষণিক সময়ের বিরতিতে পুণপুণ নামের মালা জপে। চাউল তৈরি থেকে সিন্নি পর্যন্ত যে বিষয়ে গিন্নীকে সতর্ক থাকতে হয়; তা হলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা। কোনো কোনো গৃহিণী রান্নার আগে গোসল ও নতুন শাড়ি পরিধান করে।
আগ-উৎসব নিয়ে নানাজনের নানামত। অধিকাংশের মতে পূর্বসূরিদের ঐতিহ্য ধরে রাখতেই এই আয়োজন! কিন্তু সাম্প্রতিক চিত্র ভিন্ন। প্রথা পালনে শিক্ষিত সমাজ আগের মতো আন্তরিক নয়। কেউ কেউ হয়তো চিরায়ত প্রথাগুলো ইতোমধ্যে বিসর্জন দিয়েছেন। তবে এ কথা মিথ্যে নয় যে, কৃষিভিত্তিক সমাজে আগ-উৎসবের ভূমিকা ছিল বিরাট ও ব্যাপক। জীবন ও জীবিকা ছিল পরনির্ভরশীল। মহাজনের নিকট থেকে দাদন নিয়ে সংসারের ব্যায় নির্বাহ করতে হতো। যেহেতু আয়ুশ ও আমনের মধ্যবর্তী সময়ে তখনো বোরোর আবাদ প্রচলন হয়নি সেহেতু আষাঢ় মাস থেকে অভাব আরম্ভ হতো। বাঙালির জীবনে আষাঢ় একদা চরম অভাবের মাস বলে বিবেচিত ছিল। মাঠে-ঘাটে অন্য কোথাও বিশেষ কাজ থাকতো না। হাত-পা গুটিয়ে ঘরে বসে থাকতো। আকাশের পানে তাকিয়ে হাঁপিত্যেশ করতো। সুদিনের আশায় আগ-উৎসবের জন্য অপেক্ষা করতো। আগ-উৎসবের গুরুত্ব সম্ভবত এখানেই। অভাবের হাত থেকে মুক্তি পেতে, সন্তানদের মুখে অন্ন তুলে দিতে দরিদ্র কৃষক জমি থেকে সময়ের আগেই পাকা বা আধাপাকা ধান আঁটি করে ঘরে নিয়ে আসতো! আর ভেতরে-ভেতরে প্রস্তুতি চলতো নবান্নের!
মন্তব্য