আখতারুজ্জামান ইলিয়াস উপন্যাসে ব্যক্তির অন্তর্লোক-বহির্লোক পর্যবেক্ষণ ও চিত্রায়ণ করেন। কেবল আখ্যান বর্ণনায় যেমন তিনি অনীহ, তেমনি কাহিনির তারল্যেও। আখ্যান বর্ণনার সময় চরিত্র কিংবা গল্পের শরীরে কোনও অলঙ্কার চাপিয়ে দেন না তিনি। একেবারে নিরলঙ্কৃত তাঁর ভাষা। অথচ সামগ্রিকভাবে অলঙ্কৃত ভাষার চেয়ে আকর্ষণীয়। ঘটনার বর্ণনায় তাঁর রচনা সাংবাদিক প্রতিবেদন হয়ে ওঠে না। আবার পুঁথিকারের বয়ানও তাঁর লক্ষ্য নয়। সব মিলিয়ে সামাজিক ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ব্যক্তির অন্তর্জগতে কী অভিঘাত সৃষ্টি করে—তারই শৈল্পিক চিত্র ‘চিলেকোঠার সেপাই’ ও ‘খোয়াবনামা’। প্রথম উপন্যাসের মূল প্রতিপাদ্য ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলন। শহুরের রাজনীতির সঙ্গে গ্রামীণ পটভূমির সমান্তরাল চিত্র আঁকার প্রতি ইলিয়াস বিশেষ মনোযোগী ছিলেন। চিলেকোঠার সেপাইয়ের মূল চরিত্র ওসমান ও আনোয়ার। যদিও উপন্যাসের শুরু এবং শেষ রহমতউল্লাহর বাড়ির চিলেকোঠার বাসিন্দা ওসমানের বিভিন্ন আচরণ ঘিরে, তবু তাকেই মূল চরিত্র বিবেচনা করা যায় না। ওসমান একটি অবদমিত চরিত্র, সে কেবল ঘটনার নীরব দর্শক এবং পর্যবেক্ষক মাত্র; ঘটনা নিয়ন্ত্রণে কি সংঘটনে কোনও ভূমিকা রাখতে তাকে দেখা যায় না।
উপন্যাসের শুরু চিলেকোঠার বাসিন্দা ওসমানের স্বপ্ন দেখার বর্ণনা দিয়ে। সে ওসমান দীর্ঘ দিন ধরেই অদমিত, যাপন করে অচরিতার্থ জীবন। একদিন দরজায় করাঘাত শুনে তার ঘুম ভেঙে গেলে উঠে বসে। দরজা খুলতেই সে যা শোনে, সে সংবাদ শোনার জন্য ওসমান প্রস্তুত ছিল না। তবু শুনতে হলো, পুলিশের গুলিতে মারা গেছে একই বাড়ির ভাড়াটিয়া মকবুল হোসেনের ছেলে তালেব। তালেবের মৃত্যুই ওসমানকে টেনে নেয় গণ-আন্দোলনে। ওসমানের সঙ্গে যোগ দেয় ধীরে ধীরে আনোয়ার, শওকত, হাড্ডি খিজির ও জুম্মন। গণ-আন্দোলনে মহল্লাবাসীদের নেতৃত্ব দেয় যে, সে আলাউদ্দিন পাকিস্তানপন্থী বাড়িঅলা রহমত উল্লাহর ভাগ্নে। সুখে-দুঃখে একে অন্যের শুভাকাঙ্ক্ষী। রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রশ্নে দুজন দুই মেরুর হলেও, পুঁজি আর শোষণের প্রশ্নে দুজন একই পন্থী। ছয় দফা আন্দোলনে যখন বাঙালি জেগে ওঠে, তখন আইয়ুব খানের ক্ষুদ্র সংস্করণ রহমতউল্লাহ ধরে উল্টো স্লোগান। আইয়ুবপন্থী রহমত উল্লাহ মরতে মরতেও শেষ পর্যন্ত বেঁচে যায়, গণ-আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী, মিছিলের জোরালো স্লোগানদাতা হাড্ডি খিজির পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারায়। গণ-আন্দোলনে ওসমানের প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখতে না পারা, রানুর প্রতি আকর্ষণের বাস্তব রূপ দিতে ব্যর্থ হওয়ার সঙ্গে যোগ হয় তার আন্দোলনের সহকর্মী নিম্নবর্গের হাড্ডি খিজিরের অপঘাতে মৃত্যুর অভিঘাত। সব মিলিয়ে ওসমানের শুরু হয় মনোবিকলন। হয়ে ওঠে অপ্রকৃতিস্থ।
খাটতে হয় জেল। শেষ দৃশ্যে সর্বস্বান্ত হতে হয় ফুলজানকেও। আলাউদ্দিন দেশপ্রেমিক, পুঁজিবাদী এবং শোষক। তার শোষণের চিত্র সাধারণ্যে অস্পষ্ট, দেশপ্রেমের চিত্র প্রকাশ্য। গণ-আন্দোলনে সাধারণ মানুষের সঙ্গে তার সম্পৃক্তিই প্রমাণ করে, দেশমুক্তির আন্দোলনে তার ভূমিকা গুরুত্ববহ।
আনোয়ার প্রাণের ডাকে ফিরে যায় গ্রামে। সেখানে সাধারণ মানুষের সর্বস্ব হারানো প্রতিবাদের ভাষা তাকেও নাড়া দেয়। সে দেখে গ্রামেও শহরের রহমত উল্লাহর মতো, খয়বার গাজী হয়ে ওঠে আইয়ুব খানের গ্রামীণ সংস্করণ। দেশের মানুষের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তির ছয় দফা আন্দোলনে দেশবাসী জেগে উঠেছে। সে আন্দোলনে শহরে বাধা হয়ে দাঁড়ায় রহমত উল্লাহ। তাই তার গ্যারেজ লুট করতে উদগ্র হাড্ডি খিজিরের নেতৃত্বে রিকশাচালকের দল। গ্রামেও সমান দৃশ্যের অবতারণা—খয়বার গাজীর লোক হোসেন আলী ফকির গ্রামের মানুষের গৃহপালিত পশু নিয়ে নদীর বুকে ধারাবর্ষা চরে বেঁধে রাখে। গ্রামের গরিব মানুষের কাছ থেকে টাকা আদায় করে সে পশু ফেরত দেয়। এ নিয়ে কেউ প্রতিবাদের সাহসও পায় না। আনোয়ারের উপস্থিতিতেই হোসেন আলী ফকিরকেও আগুনে পুড়ে মরতে হয়। তারপর গ্রামের করমালি, আলীবক্স, চেংটু মিলে তৈরি করে গণ-আদালত। সেই গণ-আদালতে মানুষ হত্যা ও অন্যের জমি জবরদখলের অভিযোগ খয়বার গাজীর মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে। কিন্তু ধর্মের অজুহাতে চিরকাল ভণ্ডরা যেমন মানুষকে বোকা বানিয়ে ন্যায়বিচারকে করেছে কলঙ্কিত, এখানেও তার ব্যত্যয় ঘটে না। খয়বার গাজী মৃত্যুদণ্ড থেকে মার্জনা চায় না, তবে জুমার নামাজ পড়ার আগ্রহ দেখায়। ঘটনাক্রমে গ্রামেও গণ-আন্দোলনের হাওয়া লাগে। সেখানেও পৌঁছে যায় ছাত্রদের মিছিল। সঙ্গে জনসভায় যোগ দেওয়ার আহ্বানও। একদিকে জাতীয় স্বার্থে ছাত্রদের ডাকা জনসভা, অন্যদিকে গ্রামীণ জনপদে জোতদার উচ্ছেদের বিচারব্যবস্থা। শেষ পর্যন্ত বিচার বিলম্বিত হয়। সুযোগ পেয়ে খয়বার গাজী পালিয়ে যায়। এর জন্য বিচারপ্রার্থীরা আনোয়ারকে দায়ী করে। আনোয়ার কোনও উত্তর দিতে পারে না। খয়বার গাজীর আশীর্বাদপুষ্ট আনোয়ারের ফুফা জালাল মাস্টার খয়বার গাজীর বেঁচে যাওয়ার সমস্ত কৃতিত্ব দিতে চায় আনোয়ারকেই। জালাল মাস্টার উভয়কূলই রক্ষা করতে চায়। বিব্রত হয় আনোয়ার। ওসমান যেখানে নিষ্ক্রিয়, আনোয়ার সেখানে সক্রিয়। আনোয়ারের ভূমিকা ঢাকা থেকে সে গ্রাম পর্যন্ত তার যাতায়াত। তার কাজের পরিধিও শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত। আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে শহরের চলমান গণ-আন্দোলনে তার তেমন ভূমিকা না থাকলেও তার উপস্থিতিতে গ্রামের চেংটু, আলীবক্সরা মনে সাহস পায়। তারা জোতদার উচ্ছেদে অগ্রসর হয়। ওসমান রহমত উল্লাহ, আলাউদ্দিন মিয়ার স্বার্থের মারপ্যাঁচের ভেতর একজন হাড্ডি খিজিরকে অপঘাতে মারা যেতে দেখে, দেখে জুম্মনের মাকে স্বামীর জন্য ব্যথিত না হয়ে বাড়িঅলা মহাজন রহমতউল্লাহহর দাসত্ব করে তৃপ্তি পেতে। জুম্মনের মা কেবল শক্তি ও টাকার খেলা দেখে। তার কাছে বর্তমান স্বামী হাড্ডি খিজির যেমন, তালাক দেওয়া কামরুদ্দিন তেমন। কারও জন্য তার আলাদা কোনও প্রেম নেই।
শহরের হাড্ডি খিজিরের সমান্তরাল চরিত্র গ্রামের চেংটু। দুই জনেরই অপঘাতে মৃত্যু ঘটে, দুই জনই সংগ্রামে সক্রিয় এবং উচ্চকণ্ঠের কর্মী। এরা কোনও ক্রমেই লাভক্ষতির প্রশ্নে হিসেবী নয়। মানবমঙ্গল এবং দেশের স্বাধীনতা ও গ্রামের শোষিত মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তিই তাদের ল্য। হাড্ডি খিজির যেমন আইয়ুব খান উৎখাতের আন্দোলনে নেমে, তারই এদেশীয় দালাল রহমত উল্লার ধ্বংস কামনা করে, তেমনি চেংটুও খয়বার গাজীর মৃত্যু কামনা করে। শেষ পর্যন্ত তারা দুজনেই ক্ষমতার কাছে পরাজিত হয়, প্রাণ হারায় অপঘাতে। এ চরিত্রগুলোর ভেতর দিয়ে চিরকালীন বৈষম্য ফুটে ওঠে। মানবসমাজের স্তর বিন্যাসে দুর্বল চিরকালই সবলের কাছে মার খেয়েছে। এই নিম্নবর্গের মানুষদের শক্তিকে পুঁজি করে, অপোকৃত ধনীরা, পুঁজিপতিরা এবং জোতদাররা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করেছে। প্রয়োজনের সময় নিুবর্গের মানুষের সঙ্গে বর্ণচোরা মধ্যবিত্ত সমাজ প্রতারণা করে এসেছে।
‘খোয়াবনামা’ ইলিয়াসের দ্বিতীয় উপন্যাস। সম্পত্তির রায় কৌশল হিসেবে গ্রামের জোতদারদের তৈরি বিভিন্ন ধরনের কুসংস্কার মানুষ লালন করে বাধ্য হয়ে। জোতদার আর জমিদারদের তৈরি মিথকেই সাধারণ মানুষের মানতে হয় স্রষ্টার দেওয়া শাস্তি বলে। তারা বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়, অশরীরী কোনও জীব এসে তাদের বিভিন্ন কাজে বাধা দেয়। তারা বঞ্চিত থাকে নিজেদের প্রাপ্য থেকে। তার চিত্র খোয়াবনামায় বর্ণিত কাৎলাহার বিল, বহুকাল আগের কোনও এক ফকিরের কাৎলাহার বিল রার জন্য তার ভৌতিক উপস্থিতি। তমিজের বাপের কাৎলাহার বিলে মাছ ধরতে যাওয়া এবং সেখানে ফকিরের আবিভর্ভাব এসবই জমিদার জোতদারদের সম্পত্তি গ্রাসের মোম উপায় মাত্র। সাধারণ মানুষ যুক্তি মানে কম, মানে বেশি কুসংস্কার। তাদের বিশ্বাসের খুঁটি খুব শক্ত। বাস্তবের গুলির চেয়ে তাদের বেশি ভয় ভুতের ঘাড় মটকে দেওয়ায়। তাই তারা বল্লম কি লাঠির সামনে বুকে চেতিয়ে দাঁড়ালেও, অন্ধকার নির্জন পথে পা বাড়াতে সাহস দেখায় না। এ উপন্যাসের কুলসুম এবং ফুলজান দুটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। প্রথম চরিত্র, তমিজের সৎ মা। যে বৃদ্ধ স্বামীর সঙ্গে অচরিতার্থ জীবনযাপন করে আর অবচেতন মনে কামনা করে সৎ ছেলের স্পর্শ। দ্বিতীয়জন প্রকাশ্যে তমিজকে মাঝির বেটা বলে তিরস্কার করলেও দেহমনে কামনা করে তাকেই। একসময় তমিজ ফুলজানকে বিয়ে করে সত্য, কিন্তু তার সংসার বেশিদিন করা হয় না, জমিদার শরাফত মণ্ডলের কৌশলের কাছে তাকে পরাজয় বরণ করতে হয়। খাটতে হয় জেল। শেষ দৃশ্যে সর্বস্বান্ত হতে হয় ফুলজানকেও। আলাউদ্দিন দেশপ্রেমিক, পুঁজিবাদী এবং শোষক। তার শোষণের চিত্র সাধারণ্যে অস্পষ্ট, দেশপ্রেমের চিত্র প্রকাশ্য। গণ-আন্দোলনে সাধারণ মানুষের সঙ্গে তার সম্পৃক্তিই প্রমাণ করে, দেশমুক্তির আন্দোলনে তার ভূমিকা গুরুত্ববহ।
চিলেকোঠার সেপাইয়ের লেখক কেবল আখ্যান বর্ণনা করেন, কোনও ঘটনায় তার ভূমিকা সেখানে গৌণ। প্রতিটি চরিত্রই সমান গুরুত্বে নিজ গন্তব্যে পৌঁছে যায়, অনিবার্য পরিণতির মতোই। ফলে লেখক গণ-আন্দোলনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখতে না পারা ওসমানকে দীর্ঘদিন সুস্থ রাখতে পারে না। সে চেষ্টাও করে না। আনোয়ারকে নিষ্ক্রিয় করতে করতেও করে না। যদিও উপন্যাসের মূল স্রোত ও ঘটনার ঘূর্ণাবর্ত ওসমানকে ঘিরে, তবু কর্মচাঞ্চল্য এবং বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে আনোয়ারই হয়ে ওঠে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। কিন্তু উপন্যাসের নাম চিলেকোঠার সেপাই হওয়ায় চিলেকোঠার বাসিন্দা ওসমানকেই দিতে হয় মূল নায়কের ভূমিকা। উপন্যাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তার ভূমিকা স্বপ্নচারীর। যে স্বপ্ন তার অচরিতার্থ জীবনে, অবদমিত ইচ্ছার ভেতর দেয় কিঞ্চিৎ সুখ, সে স্বপ্নপ্রবণতাই তাকে শেষ পর্যন্ত টেনে নেয় সংগ্রামের পথে। নিজেকে যথাসময়ে প্রকাশ করতে না পারার বেদনাবোধ তাকে এক সময় অপ্রকৃতিস্থ করে তোলে। ফলে অবচেতনে সে দেখে বুড়িগঙ্গার পানি আগুনে পরিণত হতে। সে আগুনে আইয়ুব খানের ক্ষমতার ভিত নড়ে উঠতেও দেখে।
খোয়াবনামার তমিজ পরিশ্রমী, সংগ্রামী। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জোতদারের সঙ্গে টিকতে পারে না। চিলেকোঠার সেপাই এ প্রতিটি চরিত্র নিজের যোগ্যতায় চলাফেরা করে, চিন্তা করে আপনাপন বিচারবুদ্ধিতে। খোয়াবনামার চরিত্ররা চলাফেরা করেন লেখকের ইচ্ছায়। মাঝে-মধ্যে লেখক চরিত্রের সঙ্গে লীন হয়ে যাওয়ায় তাকেও উপন্যাসের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র মনে হয়। খোয়াবানামার চরিত্রগুলোর মূলত লেখকের ইচ্ছারই বাস্তবায়ন করে, নিজেরা স্বাধীনভাবে স্বপ্ন পর্যন্ত দেখে না। সাধারণ মানুষগুলো স্বপ্ন দেখে— লাঙল যার জমি তার। তাদের সে স্বপ্ন উদ্বুদ্ধ করে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর কিছু মানুষকে। যারা ক্ষমতায় যাওয়ার তারা যায় ঠিকই, কিন্তু প্রাণ হারায় খেটে খাওয়া মানুষগুলো। এ দৃশ্য চিলেকোঠার সেপাইতেও বর্তমান।
ইলিয়াস কেবল গল্প বোনেননি, গল্পকে করে তুলেছেন কালের দলিল। মানবজীবনকে চিত্রায়ণ করেছেন শিল্পের মোড়কে। তাঁর উপন্যাস মূলত জীবন ও শিল্পের যৌথপাঠ।
দুটি উপন্যাসে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতির অসঙ্গতি ও বৈষম্যের চিত্র এঁকেছেন ইলিয়াস, সঙ্গে শ্রেণীবৈষম্যও। নারী-পুরুষের সম্পর্ক ও সম্পর্কের ধরন আঁকতে গিয়ে কোনও কল্পনার আশ্রয় নেননি। ফলে চরিত্রের সামাজিক মর্যাদা অনুসারেই তৈরি করেছেন সংলাপ। এসবের পাশাপাশি বর্ণিত আখ্যানের ধারাবাহিকতা এবং প্রবহমানতা রার প্রতিও লেখক যত্নশীল। চিলেকোঠার সেপাই অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক মুক্তির আন্দোলনে একটি বিশেষ সময়ের দলিল। একটি দেশের গ্রামে ও নগরে যে ধরনের আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে তার চিত্র। অন্যদিকে খোয়াবনামা স্থান-কাল নির্বিশেষে মানবজাতির বিশ্বাস ও আচরণের যৌক্তিক,কল্পিত জীবনযাপনের আখ্যান।
ইলিয়াস জীবনকে দেখেছেন রূঢ় বাস্তবতার ভেতর। রূঢ় জীবনের ছবি আঁকতে গিয়ে উপন্যাসের ভাষাকে করে তুলেছেন ঝরঝরে। রূঢ় জীবনে যে মাঝে-মধ্যে রোমান্টিকতার আগমন ঘটে, সে রোমান্সের ভাষাও খুব পরিশীলিত। ফলে প্রেমের দৃশ্যেও খুব ভাবালুতা সর্বস্ব কোনো সংলাপ শোনা যায় না। সেখানে মনের সঙ্গে দৈহিক চাহিদারও গুরুত্ব সমান। চিলেকোঠার সেপাইয়ের মানুষগুলো নিজেদের প্রয়োজনে সংগ্রামে নামে, সাড়া দেয় গণ-আন্দোলনের ডাকে। গণ-আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়া হাড্ডি খিজিরকে লেখক পুলিশের গুলিতে মারতে গেলেন কেন? তবে কি শেষ পর্যন্ত হাড্ডি খিজির বেঁচে থাকলে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠত? তার ভাবমূর্তি কি ওসমানকেও ছাড়িয়ে যেত? চিলেকোঠার বাসিন্দার মাহাত্ম্য ম্লান হতে পারে সে শঙ্কায় কি লেখক সবচেয়ে প্রাণবন্ত চরিত্র হাড্ডি খিজিরের মৃত্যু নিশ্চিত করলেন অপঘাতে? আবার গ্রামের চেংটু প্রসঙ্গেও একই প্রশ্ন তোলা যায়। তার মৃত্যুও কি লেখকের ইচ্ছাধীন? এ সবই একজন মনোযোগী পাঠকের নিছক প্রশ্ন মাত্র। গভীরভাবে ভেবে দেখলে উপলব্ধ হয়—বিপ্লবে-সংগ্রামে এই হাড্ডি খিজির আর চেংটুরাই চিরকাল ঝাঁপিয়ে পড়ে লাভ-লোকসার হিসাব না করেই। আলাউদ্দিন মিয়া ও জালালউদ্দিন মাস্টাররা সব সময় রহমত উল্লাহ আর খয়বর গাজীদের মানসম্মানে কথা ভাবে। তারও আগে ভেবে নেয়, নিজেদের লাভ-ক্ষতিও। ব্যর্থ বিপ্লবের ফলে আন্দোলনের বেঁচে যাওয়া করমালিরা বিচারের মুখোমুখি হয়, সফল বিপ্লবের ফল ভোগ করে আলাউদ্দিন মিয়া আর জালালউদ্দিন মাস্টাররাই।
খোয়াব নামার আখ্যানের সঙ্গে চরিত্রচিত্রায়ণ সুসামঞ্জস—এ কথা অনস্বীকার্য। এ উপন্যাসের তমিজের বাপ এবং তমিজের পরিণতিও চিলেকোঠার সেপাইয়ের চেংটু, হাড্ডি খিজিরের মতোই। চিলেকোঠার সেপাইয়ের ওসমান অবদমিত, নিজের ইচ্ছা প্রকাশ করে না সে। কিন্তু খোয়াবনামার তমিজ নিজের ভালো লাগার কথা অকপটেই জানায় ফুলজানকে। ফলে ফুলজান এবং তমিজের প্রণয় পরিণয়ে রূপ পায়। ওসমান অদমিত ও ভীরু হওয়ায় তার সঙ্গে রানুর কোনও সম্পর্ক শেষ পর্যন্ত দাঁড়ায় না। বরং রানুর ছোট ভাই রঞ্জুকে আহত করার দায়ে রানুর পুরো পরিবারই তাকে ঘৃণা করে একসময়। ওসমান বন্ধু আনোয়ার ছাড়া আর কারও সহানুভূতি পায় না। এমনকি, আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া আলাউদ্দিন মিয়াও ওসমানের প্রতি কোনো ভালোবাসা দেখায় না। ইলিয়াস মানবজীবনের কঠিন ও বাস্তবচিত্র আঁকতে গিয়ে দেখিয়েছেন, সমাজের উঁচুতলার মানুষের সম্পর্ক নির্ণীত হয়, সম্পদের মাপকাঠিতে। সম্পদই উঁচুতলার বাসিন্দাদের আত্মীয়তা ও মর্যাদারার সূত্র। তাই, যখন উত্তেজিত রিকশাচালকরা রহমত উল্লাহর গ্যারেজ থেকে রিকশা নিয়ে মিছিল করতে চায়,তখন আলাউদ্দিন রিকশাঅলাদের সে উদ্যোগকে স্বাগত জানায় না; বরং রিকশাঅলাদের উদ্যোমকে হঠকারী বলেই তার মনে হয়। আবার যখন গণ-আন্দোলনকারীদের জনসভায় যখন রহমতউল্লাহর দেশদ্রোহিতার বিবরণ দিতে চায় হাড্ডি খিজির, তখন আলাউদ্দিন তাকে বাধা দেয়। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে গ্রামের খয়বার গাজীর বিচারেও। সবাই যখন খয়বার গাজীর মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করার জন্য গণ-আদালতে রায় ঘোষণা করে, তখন জালাল উদ্দিন মাস্টার দেখেন সেখানে একজন মানী লোককে অসম্মানের দৃশ্য।
উভয় উপন্যাসেই দেখা যায়, মানুষের সামাজিক স্তরবিন্যাস এবং সে স্তরবিন্যাসে ধনীদরিদ্রের নানামুখী বৈষম্য। তবে ইলিয়াসের কৃতিত্ব এখানে যে কেবল আখ্যান বর্ণনার মধ্য দিয়ে একটি বিশাল পটভূমি তুলে ধরেন খোয়বনামায়। ব্যর্থ খোয়াব বা স্বপ্ন দেখে কেবল গরিব মানুষেরা,তাদের খোয়াবের ব্যাখ্যা তাদের জীবনে কখনো সফল হয় না। কিন্তু ধনীদের সব ধরনের স্বপ্নই পূরণ হয়। শরাফত মণ্ডল কেবল কাৎলাহার বিলের মালিকানার মিথ্যে স্বপ্নই দেখেন না,সে স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য থানা পুলিশ থেকে শুরু করে ভৌতিক বিষয়-আশয় এবং ফকিরের আশ্রয়ও নেন। ফলে গ্রামের গরিব মানুষেরা এক অশরীরীর ভয়ে কাৎলাহার বিলে নিজেদের দাবি কখনো প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। শেষ পর্যন্ত শরাফত মণ্ডলই সেখানে তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। গ্রামীণ জনপদের সাধারণ মানুষের কুসংস্কারকে ভিত্তি করে, ইলিয়াস চিলেকোঠার সেপাই উপন্যাসে যেমন বটগাছের আদি বাসিন্দা জ্বিনের ভয় দেখান, তেমনি খোয়াব নামায় দেখান মৃত ফকিরের বিল পাহারা দেওয়ার ভয়। আবার ধনীদরিদ্রের বৈষম্য,কংগ্রেস-মুসলিম লীগের দ্বন্দ্ব, দেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে সাধারণ মানুষ জোতদার উচ্ছেদ করে সম্পত্তির সুষম বণ্টনের শুধু স্বপ্নই দেখেন না; প্রত্যয়ও ব্যক্ত করেন। তাত্ত্বিকরা সম্পদের সুষম বণ্টনকে মার্কসবাদী চেতনা বলতে পারেন, বটগাছের জ্বিন, নদীর ভেতর ঘোড়ার ডাক কিংবা তমিজের বাপের ঘুমের ভেতর হাঁটা কিংবা কাৎলাহার বিলে ফকিরের আত্মার পাহারাকে জাদুবাস্তবতা বলতে পারেন। কিন্তু সাধারণ মানুষের ন্যায্য পাওনার দাবি কিংবা ভূতপ্রেতের বিষয়-আশয়ও যদি বাঙালিকে পশ্চিম থেকে আমদানি করতে হয়, তাহলে তার নিজস্ব বলতে থাকল কী?
ইলিয়াসের সমস্ত সাহিত্যকর্ম বিবেচনা করলে দেখা যায়, চিলেকোঠার সেপাই প্রচল ধারার উপন্যাসের উন্নত সংস্করণ। খোয়াবনামা সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারার সৃষ্টি। চিলেকোঠার সেপাইয়ে লেখক পর্যবেক এবং কথক মাত্র; খোয়াবনামায় সর্বজ্ঞ। বিষয়বস্তু এবং পটভূমি বিবেচনায় এ উপন্যাসটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। ‘চিলেকোঠা সেপাই’ লেখকের অধ্যয়ন, অনুশীলন ও পরিশ্রমের ফল হলে ‘খোয়াব নামা’ কল্পনা ও প্রজ্ঞার স্বাক্ষর। ইলিয়াস কেবল গল্প বোনেননি, গল্পকে করে তুলেছেন কালের দলিল। মানবজীবনকে চিত্রায়ণ করেছেন শিল্পের মোড়কে। তাঁর উপন্যাস মূলত জীবন ও শিল্পের যৌথপাঠ।
(সমকালীন সাহত্যিচিন্তা থেকে)