খুব সরল একটি প্রশ্ন, কেন লিখি? সে কি ভাষায় মারপ্যাঁচ দেখানোর জন্য, না কোনো মতবাদ প্রচারের জন্য? আসলে সমাজের বিচিত্র মানবগোষ্ঠীর মধ্যে সংগত-অসংগত বিবিধ অবস্থার মধ্যে দিয়ে আমরা চলি। আমাদের কামনা, বাসনা, লোভ, হিংসা, বিদ্বেষের বিচিত্র দোলায় নিজেকে দোলায়িত অবস্থায় অনুভব করি। আপন মানুষকে বিশ্বাস করে অকৃপণ বর্বরতার আঘাতে যখন রক্তাক্ত হই, মানবিক প্রেমের মধ্যে যখন বিরোধের বাহাস ঢুকে পড়ে, ব্যর্থতার বন্ধন থেকে সাময়িক মুক্তির প্রসন্নতায় কখনো বা সমাজের কৌশলপ্রবণ কুচক্রের মধ্যেও চিরসত্যের বিকাশ ঘটে, প্রকৃতি তখন হেসে ওঠে চিরন্তন রূপের রঙিলা রসিক হয়ে। আমরা কি তখন খুঁজে পাই না, নিজেকে সর্বত্র? সমস্ত বন্ধনকে ছিন্ন করে ব্রহ্মাণ্ডের সব অংশে নিজেকে ছড়িয়ে দিতে? এই যে আকুতি আর তার সফলতার মধ্যেও অপরিপূর্ণতার আক্ষেপ হয়তো তার প্রতিশোধগুলোই ভাষায় রূপকল্পের সাহায্যে কল্পলোক রচনার ভেতর দিয়ে ফুটিয়ে তুলতে চাই। তখনই বাস্তবজগৎ থেকে অভিজ্ঞতালব্ধ সকাতরে বয়ে যাওয়া সত্যের মাধ্যমে আমরা তার সন্ধান করি।
এই সন্ধানের হালহকিকত জানতে, জানাতে অবশেষে কলম ধরি। দীর্ঘদিনের জমে থাকা বোবা কান্নাগুলো ব্যক্ত করি। কখনো তা কবিতায়, গল্পে, উপন্যাসে, নাটকে। অর্থাৎ সাহিত্যের বিবিধ শাখায় আমরা তাকে ছড়িয়ে দিতে চাই। এই চাওয়ার মধ্য দিয়েই আমার আমিত্বকে খুঁজে পেতে চেষ্টা করি।
সমাজের অবহেলা তো তাকে কুরে কুরে খেয়েছে। বেঁধে রেখেছে আষ্টেপৃষ্ঠে। শামীমা বলছে—‘প্রথম রক্তক্ষরণ আমার এগারো বছরের খুদে পৃথিবীকে ভরে দিয়েছিল ভেজা আঁশটে গন্ধ আর স্যাঁতস্যাঁতে অস্বস্তিতে। আঁশটে গন্ধের চাপে আমার শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসছিল থেকে থেকে। ক্রমশ আমি বুঝতে পারি এ গন্ধের উৎস আমারই শরীর।
মূলত নিজেকে চেনার, সমাজের নানা চোরাগলির মধ্যে কোথায় তার অবস্থান, কে তাকে দেখছে কোন দৃষ্টিকোণ থেকে, কোন বলয়ে আবদ্ধ করতে তৎপর তারা, এসবই প্রশ্নের আকারে আকিমুন রহমানের ‘পুরুষের পৃথিবীতে এক মেয়ে’ উপন্যাসটিতে উঠে এসেছে পরতে পরতে। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশে প্রথম প্রকাশিত এই উপন্যাসটি ২০০৯ সালে প্রকাশ পেয়েছিল ভারতে। সর্বশেষ ২০১৩ সালে অঙ্কুর প্রকাশনী উপন্যাসটিকে ফের পুনর্মুদ্রণ করেছে। কাহিনির কথায়, প্রেক্ষাপটের পরিসীমায়, চরিত্রের ভ্যারিয়েশনে উপন্যাসটি কতটা শক্তপোক্ত তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। তবে একজন নারী শিশুর জন্ম থেকে শৈশব, কৌশোর তথা পূর্ণাঙ্গ নারীর বেড়ে ওঠার সত্যিকারের ঠাসবুননের অপূর্ব চিত্র এটি, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
আজ পর্যন্ত মানব সমাজ যত প্রকার ইজম বা মতবাদের যোগান দিয়েছে আসলে তা সব-ই মানুষ ও তার সমাজের দৈহিক ও মানসিক রোগের প্রতিফলন। মানব সৃষ্টির দুটি ধারার একটির দিকে নজর দিলে আমরা স্পষ্ট দেখতে পাই সেই জ্ঞানবৃক্ষ থেকে ফলভক্ষণে প্ররোচিত করার অপরাধে সাব্যস্ত করা হলো নারীকে, ঘোষণা করা হলো, ‘নারী নরকের দ্বার, নারীই জগতের সকল অহিতের মূল।’ আর সেই থেকে সমাজের সমস্ত অভিশাপ, ঘৃণা অবধারিতভাবেই বর্ষিত হয় নারীর ওপর। তাকে গিয়ে দাঁড়াতে হয় গৃহপালিত পশুর চেয়েও নিচের ধাপে। পুরুষ তার একক আধিপত্যে ভোগ করছে প্রকৃতিকে। বিনিময়ে প্রকৃতিও ভূক্ত হচ্ছে পুরুষের দ্বারা। এর ফলে ক্লেদাক্ত হয়ে উঠছে সমাজ। প্রচল ভাঙার সত্যিকারের সাহস নিয়ে এগিয়ে আসেনি কেউ। ফলে যা হওয়ার যুগের পরে যুগ চলে যায় নিখিলপুরুষ নিখিলনারীকে ভোগ করে চলেছে অবিরাম।
বস্তুত আকিমুন রহমানের এই উপন্যাসের আদ্যোপান্ত হলো সেই অকিঞ্চিৎকর অবহেলিত সেই নারী, যে কিনা শিশু থেকে কিশোর বালিকা থেকে নারীর নানা বঞ্চনা, বেদনার বাদলে সিক্ত হতে হতে ব্যক্ত করেছে তার বুকফাটা আকুতির কথা। যার সারৎসার হলো তাকে ঘিরে গড়ে ওঠা সমাজ। যে সমাজে কী করে শামীমারা প্রতিনিয়ত মৃত্যুর মাঝে বেঁচে থাকে। সর্বনাশের কথা আরও প্রকট হয়ে ওঠে যখন পরিবারও সেই স্রোতে ভাসিয়ে দিতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করে না। আমরা দেখেছি পিতৃতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে নারী নিপীড়নের ধারাবাহিক উল্লাসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের স্পৃহা থেকেই জন্ম নিয়েছিল নারীবাদের। হাজারো অনুকূল পরিস্থিতি তাদের সাহস জুগিয়েছিল মানবিকতাবাদের গর্ভে শতপুষ্পের বিকাশের দাবি নিয়ে তারা তাদের ব্যক্তিসত্তার স্ফূরণকে লালন করেছিল। আকিমুন বোধ করি সেই গর্ভেরই একজন সাহসী সন্তান। যিনি অকপটে সরল আর সত্য কাহিনির ওপর ভর করে তরতর করে এগিয়ে যান তার এই উপন্যাসে শামীমাকে সঙ্গী করে। সমাজ তথা পরিবারের হাজারো অসঙ্গতি, বিচ্যুতির সাক্ষী শামীমার বেড়ে ওঠার মধ্যে দিয়ে।
উপন্যাস শুরুই হয়েছে একজন নারীর প্রকৃত নারীত্বের প্রকাশের মধ্যে দিয়ে। যা কিনা প্রাকৃতিক এবং অতি অবশ্যই বৈজ্ঞানিক। সাময়িক যন্ত্রণা বাদ দিলে তা একজন নারীর আনন্দের প্রকাশও বটে। কিন্তু আকিমুন রহমানের এই উপন্যাসে শাশীমার কাছে যা দুঃস্বপ্ন বা বিভীষিকাময় হয়ে ধরা পড়েছে। তিনি বলছেন, ‘আমি আমার পিরিয়ডের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আমি তার কথা মনেও করতে চাই না। ঘেন্না করি আর অপেক্ষা করি ওই দিনগুলোর জন্য, প্রতিমাসে।’ ‘পুরুষের পৃথিবীতে একজন মেয়ে’র শামীমা মূলত একজন এনজিওকর্মী। যিনি তার প্রেমিকের মাধ্যমে গর্ভবতী এবং তার এই গর্ভের সন্তানের দায়িত্ব নিতে প্রেমিক তার টানাপড়েনের মাঝে থেকেই স্বীকারের কথা বললেও পরক্ষণেই অস্বীকারের অজুহাতও বাড়িয়ে দিয়েছেন তাকে ঠকাতে। ভোগের ভয়কে জয় করতে পুরুষ যে নির্লিপ্ত হতে পারে, শামীমার দীর্ঘ বর্ণনার মধ্য দিয়ে তা ব্যক্ত করেছেন এর কাহিনিকার আকিমুন রহমান।
শেষ ভরসা প্রেমিকা যখন তাকে অবিশ্বাসের কাতারে ঠুকে দিলো, শামীমা তখন পিছন ফিরে চায় যেখানে ঘটেছে তার জন্মকালীন অবহেলা, সেখানে। ঘটেছে স্বয়ং জন্মদাতা তথা মাতা-পিতার অবহেলা। সর্বোপরি সমাজের অবহেলা তো তাকে কুরে কুরে খেয়েছে। বেঁধে রেখেছে আষ্টেপৃষ্ঠে। শামীমা বলছে—‘প্রথম রক্তক্ষরণ আমার এগারো বছরের খুদে পৃথিবীকে ভরে দিয়েছিল ভেজা আঁশটে গন্ধ আর স্যাঁতস্যাঁতে অস্বস্তিতে। আঁশটে গন্ধের চাপে আমার শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসছিল থেকে থেকে। ক্রমশ আমি বুঝতে পারি এ গন্ধের উৎস আমারই শরীর। ক্রমশ আমার শরীর বুঝতে শেখে নানারকম বিদঘুটে গন্ধের ভার বহন করাও আমার নিয়তি।’
উপন্যাসের ব্যাপ্তিটা হয় বৃহত্তর সমাজ ও তার সময়কে ধারণ করে। প্রবাহমান একটা সময়ের ভেতরে নানমুখী স্রোতধারা প্রবাহিত হয়। গতির সঙ্গে, স্রোতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রকৃত নির্গলিতার্থ একটি উপন্যাস যখন তার দরকারী উপাচার-উপাদানের মধ্যে ধারণ করতে সক্ষম হয় তখন সেটা নিঃসন্দেহে সামাজিক ইতিহাস হয়ে দাঁড়ায়।
অবহেলা আর যতনা-যন্ত্রণার করালগ্রাসে আগাগোড়া দগ্ধ-শ্রান্ত-হতাশাগ্রস্ত শামীমার এই জীবন কাহিনি সেইসব পাঠকদের বোধে, মস্তিষ্কে ধাক্কা দিতে পেরেছেন আকিমুন। প্রকৃতপক্ষে সমাজের কঠিন বর্মগুলো তার যাথার্থ মর্মভেদ করে যখন কোনো বেদনাবিলাপ উঠে আসে সঙ্গত কারণেই তার ভেতরে থাকে এক শাশ্বত ঝংকার। থাকে আত্মার সৌরভ। সমাজে খেলনার মতো সাজিয়ে রাখা আমাদের দুর্বল চিহ্নগুলো তিনি বারবার ইন্ডিকেট করেছেন। কখনো ভাঙতে চেয়েছেন। তাদের শতাব্দীবাহিত আচার-আচরণ, দাবি-আব্দার এবং ইউটোপিয়ার কল্পলোকে বিহার। আকিমুন আঘাত করেছেন এখানে। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন নারীর আইডেনটিটি ক্রাইসিস কতটা প্রকট আজও এই আধুনিক সমাজে। তিনি শামীমার চলমান জীবন প্রণালির মধ্য দিয়ে আমাদের বোঝাতে চেয়েছেন—এ সমাজে নারীর মর্যদা আজও ভূলুণ্ঠিত। আমাদের সমাজে পুরুষ কতটা ঠকায়, কিভাবে ঠকায় শামীমাকে ফলো করলে তার মূল চিত্র ধরা পড়বে একজন পুরুষ পাঠকের কাছেও। প্রশ্ন জাগে সে কি তখন শুধরাবে না? মানবিকতার মিহি জালে আটকে পড়ে হে পুরুষ! তুমি আরও কতটা পৈশাচিক হবে? এসবই ভাবায় আমাদের।
প্রেমিক তাকে যতই দূরে ঠেলুক, সমাজ তাকে যতই বন্দি করুক কিন্তু আপন পরিবারেও শামীমা যে কতটা কোণঠাসা, আলোচ্য অংশটুকু পড়লেই বুঝে যাই আমরা—‘আম্মা কান ধরে আমাকে টেনে তুলে আমাকে পড়ার টেবিলে বসিয়ে দেন। আমি দৌড়ে ছুটে যাবার সময় দাদির গায়ে যদি আমার হাত লেগে যায়, দাদি আম্মাকে শাসান, ‘এই মাইয়ারে যে হুঁশজ্ঞান শিক্ষা দিতাছ না, এর ফল তোমারেই ভোগ করণ লাগব।’ দাদির টিপ্পনী আম্মাকে ক্ষেপিয়ে দেয়। আম্মা আমার ওপর ফুঁসে ওঠেন, ‘হারামজাদি মাইয়া, জন্ম থেইক্যাই তো জ্বালানি শুরু করছ।’ সমাজে আজ একজন ছেলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নারীও যে এগিয়ে যাচ্ছে। জয় করছে বিশ্বভান্ডার সে খোঁজ কে কাকে দেয়? আর রাখেই বা ক’জনা? সবাই চায় সংসারে পুত্র হোক। জাত রক্ষা হোক। আয়ের সংস্থান হোক। কিন্তু নারীও যে নরের চেয়ে আজ কোনো অংশে কম নয় এই ভ্রান্তিরই শিকার মূলত শামীমা। ফলে তাকে পরিবার থেকে এমন গর্হিত কথাও শুনতে হয়—‘পেট বেদনা করতাছে! কোন পেট? কী কস’? ‘তলপেট ব্যথা করতাছে আম্মা’, ‘কি, তলপেট বেদনা অইতাছে!’ আম্মা ক্ষোভে বিস্ফারিত হয়ে যান, ‘হেদিন এগারো বছর অইল; বারো বছর পুরতে দুনিয়ার দিন বাকি, তুমি অহনই অশান্তি বান্ধাইতে তৈয়ার অইছ? খাটাশের বাচ্চা।’
খুব গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, যুগে যুগে জাতিতে-জাতিতে, দেশে-দেশে, গোষ্ঠীতে-গোষ্ঠীতে, মানুষে-মানুষে প্রথমেই চাই মর্যাদার সাম্য প্রতিষ্ঠা। যেখানে অন্তর্ভূক্ত থাকবে নর এবং নারী। এর পরে আসে আর্থিক সাম্য এবং তার পরিণামের কথা। দুঃখের এবং ভানার বিষয় আমাদের এ সমাজে আজও যা অধরাই রয়ে গেল। ফলে যা হবার ঘটে চলেছে ঘটনাগুলো আপন মনে এমনই উল্টো পথে। পরিস্থিতির যাতাকলে পড়ে সমাজ এভাবেই নারীকে দিনকে দিন পাঠিয়ে দিচ্ছে পিছনের সারিতে। যদিও নারী আজ অতি সচেতন প্রকৃত সত্তা। যে চায় পুরুষকে বাঁচিয়ে রেখেই নিজ মর্যদা প্রতিষ্ঠা করতে।
এই উপন্যাসে একজন নারী কথাকারের স্মার্ট এবং সাবলীল ভাষার প্রক্ষেপণ, যে কোনো পাঠককেই খানিকটা হলেও প্রথমে চমকে দেবে। দিতে বাধ্য। অনেকটা একরৌখিক এই উপন্যাসের রগরগে ইরোটিক বর্ণনাগুলো কতটা কাহিনির সূত্রে গাঁথা তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। কখনো কখনো অতি আরোপিত বলা চলে, শামীমাকে যতটা বিধ্বস্ত করা যায় লেখক যেন সেই উন্মাদনায় মেতে উঠেছেন। তিনি বলছেন—‘করতে দেও মণি, করতে দেও। এইটা স্বাইস্থ্যের জন্যে বালা। একদিন করলে কিছু অয় না। শরীল নরম কর মণি’। গরম হালকা ঝাপটা দেয় আমার স্তনের বৃন্তে, আমি জ্বলে উঠতে থাকি। শক্ত শাবল খুদে খুদে পথ বের করে নিতে থাকে সুড়ঙ্গে ঢোকার। আ আ—আমি ককিয়ে উঠি। সুড়ঙ্গে ঢুকে যাবার জন্য শক্তি দিয়ে সে ছুঁড়ে দিতে থাকে কালো কঠিন শাবল। শাবল পড়তে থাকে ধপ, ধপ, ধপ, ধপ। শোন আমি বলতেছি, ওইটা আউট করে ড্রপ করব। তাইলেই হবে।’
এমন শরীরবৃত্তীয় বাতাবরণ আকিমুনের পুরো উপন্যাসের যত্রতত্রই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এরূপ ঝাঁজালো যৌনগন্ধীর উদ্রেক করে হয়তো তিনি বোঝাতে চাইছেন, কেবলমাত্র নরই নারীর অমর্যাদা বা অবমাননা করছে। এতে নারী অবদমিত হচ্ছে। সমগ্র পুংপরিমণ্ডলটাই গ্রহণ করছে নিয়ন্ত্রকের বা শাসকের ভূমিকা। আসলে সাহিত্যের একটি স্বতন্ত্র সত্তা রয়েছে। তাকে বিচার করতে হলে সেই সত্তার অন্তর্লীন রূপরেখা প্রথমত হৃদয় দিয়ে এবং পরে বুদ্ধি দিয়ে বুঝতে হয়। যদিও বলাটা যত সহজ পূর্ণ উপলব্ধি ততটাই ধূসর। এটা তখনই সম্ভব যখন একজন পাঠক নিঃস্বার্থভাবে, নিজের ভাবধারা থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিজের মন-মানষ এবং হৃদয় দিয়ে তা অনুভব করার চেষ্টা করবেন।
সরল এবং সোজা কথায় পাঠক আছে দুই প্রকারের। দীক্ষিত এবং অদীক্ষিত। অদীক্ষিত পাঠক চিরকালই উপন্যাসের ভিতর অন্বেষণ করেন কাহিনির আকর্ষণ। বিপরীতে দীক্ষিত পাঠকমাত্রই খুঁজে ফেরেন তার ভিতরে অন্তর্নিহিত নন্দন, দর্শন, উপন্যাসটির অন্তর্বয়ানে, বিন্যাসে কতটা কৃৎকৌশল ধরা পড়েছে সেসবও দেখতে চান কেউ কেউ। উপন্যাসের ব্যাপ্তিটা হয় বৃহত্তর সমাজ ও তার সময়কে ধারণ করে। প্রবাহমান একটা সময়ের ভেতরে নানমুখী স্রোতধারা প্রবাহিত হয়। গতির সঙ্গে, স্রোতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রকৃত নির্গলিতার্থ একটি উপন্যাস যখন তার দরকারী উপাচার-উপাদানের মধ্যে ধারণ করতে সক্ষম হয় তখন সেটা নিঃসন্দেহে সামাজিক ইতিহাস হয়ে দাঁড়ায়। সেই উপন্যাসটি এক সময় আমাদের সামাজিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের গতি-প্রকৃতির যথার্থ দলিল হয়ে ওঠে। সুতরাং একজন ঔপন্যাসিককে সময় ও সমাজের উপর, তল ভেতর বাহির থেকে আলো ফেলে ফেলে তার মূল কাঠামোর অন্তরীক্ষে ঘটিত ও ঘটমান নানা ভাঙচুর, টানাপোড়েন, বাঁক-প্রতিবাঁকের সুস্পষ্ট ও স্বচ্ছদৃষ্টিতে তা বুঝতে হয়।
এখনো তা প্রতীকী ব্যঞ্জনায় ছড়িয়ে আছে সমাজের সর্বত্র। আছে নারী ও পুরুষের সম্পর্কে, তাদের নিজস্ব কাজের জগতে, শরীরের ভাষায়, মেয়েদের প্রতি অঙ্গ প্রত্যঙ্গে। নারীর অন্তর্দহন তার প্রকৃত যন্ত্রণা সুচারুভাবে অনুধাবন করতে পারেন কেবল একজন নারীই।
আকিমুন রহমানের এই উপন্যাসটি সেই অর্থে আংশিক সফল—বাক্যটি বলতে যেমন দ্বিধা নেই ঠিক ব্যর্থতার বিগরোল প্লে না করলেও রয়ে গেছে নানা অসঙ্গতি। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি, ফেনিয়ে ফেনিয়ে তিলকে তাল করায় কোথাও কোথাও ঝুলে পড়েছে। ন্যারেশনে আঞ্চলিক ভাষার প্রয়োগ যথার্থ ব্যবহার হলেও একেবারে শেষ দিকে ডা. টি. এম. বানুর সংলাপে খটকা লাগে। একজন গাইনি ডাক্তারের মুখ থেকে এমন লোকাল ল্যাঙ্গুয়েজ আশা করাটা দোষের নয়, তবে দুষিত তো বটেই। তিনি বলছেন—‘দেখি দেখি, শোন তো দেখি; তার মুখ বিরক্তিতে ভরে যায়, তার চোখ ক্ষোভে ভরে ওঠে। ‘এইটা কী? এখনও ব্লিডিং হওনের তো কথাই ওঠে না।’ আপনে তো বড় ঝামেলা বান্ধানের পাবলিক—দুই হাজার সাইত্রিশটা করলাম কিছু হইল না, আর আপনের হইল! তাও এমন তুচ্ছ ব্যাপারে এমন কলস কলস রক্ত যাইতাছে। যাউগ গা শোনেন, কালকের মধ্যে আপনারে আবার এম.আর করাইতে হবে। এছাড়া আর কোনো উপায় দেখতাছি না।’
আসলে উপন্যাস মূলত একটি আখ্যান। এটি হতে পারে জীবনের আবার কখনো পরা-জীবনেরও। এর ভিতরে গ্রথিত থাকে চেতনার চাঞ্চল্য ঠিক ততটাই অবচেতনের আহাজারি। আজ অজস্র চড়াই-উৎড়াই পেরিয়ে উপন্যাসের শিল্পরূপ বাংলাদেশে অতি অবশ্যই সুপ্রতিষ্ঠিত। যদিও প্রশ্ন থেকে যায়—উপন্যাস কি কেবল নিটোল কাহিনি, না আখ্যানের অন্তরালে রয়ে যায় অন্য এক গভীরতর কাঠামোর আদল। বাংলা উপন্যাস তার দেশজ কথান্যাসের ধরন থেকে কতটা উপকরণ কতটা নির্যাস আত্মস্থ করতে পারছে এ বিষয়ে গভীরতর ভাবনায় মনোযোগ দিয়েছেন অনেকেই। তারা দেখতে চাইছেন সময় ও পরিসরের পরিপ্রেক্ষিতে কীভাবে বদলে যাচ্ছে উপন্যাসের আদল!
১৯৯৯ সালে প্রকাশিত হয় আকিমুন রহমানের দ্বিতীয় উপন্যাস ‘রক্তপুঁজে গেঁথে যাওয়া মাছি’। বলতে গেলে এ উপন্যাসেও আকিমুন কাহিনির মধ্য দিয়ে অনুসন্ধান করেছেন নরীর সহ্য ক্ষমতা। কত কত না বলা কথার কলঙ্কে সমাজে অযথাই লেপ্টে থাকে তারা। নারীর প্রতি সকলের এই অবহেলা এই বিভেদ নিয়ে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও দুটি সংখ্যার নিমিত্তে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি নর নারীকে শূন্য ও এক দিয়ে বোঝাতে চেয়েছিলেন—‘নারী হল শূন্য আর নর এক। নরের সহযোগিনী হয়ে তার বাম পাশে বসে তাদের যৌথশক্তিকে সে দশগুণ বাড়িয়ে দিতে পারে। আবার নরের দক্ষিণে বসে তার উপর খবরদারি করে সেই শক্তিকে একশ গুণ কমিয়ে দিতে পারে নারীই। তার মতে মেয়েদের নিজের স্বভাবেই বাঁধন মানার প্রবণতা আছে। নারী হলো সে কারণে পুরাতনী। বিপরীতে নর হল আপন জগতে, নিজস্ব মহিমায় সে বারে বারে নতুন হয়ে আসে। তাকে দেওয়া হয়েছে বিশ্বের তাবৎ কৌতুহলপ্রবণ বুদ্ধি। এর মানে দাঁড়ায় নারী হল মূখ্যত পূর্ববিধান আর নর হল মূখ্যত স্বাধীনতা।
আলোচ্য উপন্যাসে শুরু থেকেই পারভীন পাঠকের স্নেহের শর্করার সন্ধান পায়নি। স্কুল শিক্ষিকা পারভীনের জীবনে বিয়ের বৈতরনী পার হতে হয়নি। সে অংশে, সামাজিকতার সেই আখ্যানে বন্দি না হয়েও সে পরপুরুষের দিকে কেন ধাবিত হয়, পাঠকমাত্রই আমাদের হোঁচট লাগে। পারভীন যখন বলে—‘বৈধ পুরুষের নিচে যাওয়া ধারাচার্য হয়েও চিরকালের জন্য না হয়ে গেল যার—সে আমি।’ আর এভাবেই কাহিনির সরলতা নিয়ে, মূর্তমান বিশ্বাসের উপর আঘাত করে প্রচণ্ড এক ধাক্কা। যৌনতাকে জোর করে কহিনির মধ্যে ঢোকাতে গিয়ে লেখক তার মূল্যবোধকে তুলোট কাগজের মতো ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করেছেন। পাঠকচিত্তে অকারণে জাগিয়ে তুলেছেন অস্থিরতা আর সংশয়।
আকিমুন রহমানের এই উপন্যাস পড়তে গিয়ে একটি কথাই মনে হয়, অবরোধ তো লুপ্ত হয়েছে এখন। কিন্তু লেখকের সৃষ্ট চরিত্রদের দিকে নজর দিলে মনে প্রশ্ন জাগে—সত্যিই কী লুপ্ত? সর্বাংশে? নারীর এ অবরোধ তো শুধু আক্ষরিক অর্থে নয়। এখনো তা প্রতীকী ব্যঞ্জনায় ছড়িয়ে আছে সমাজের সর্বত্র। আছে নারী ও পুরুষের সম্পর্কে, তাদের নিজস্ব কাজের জগতে, শরীরের ভাষায়, মেয়েদের প্রতি অঙ্গ প্রত্যঙ্গে। নারীর অন্তর্দহন তার প্রকৃত যন্ত্রণা সুচারুভাবে অনুধাবন করতে পারেন কেবল একজন নারীই। এ ক্ষেত্রে লেখক আকিমুন রহমান নিজে একজন নারী হয়ে অবতীর্ণ হয়েছেন তার না বলা কথাগুলো পারভীনের ভাষ্যে আমাদের শোনাতে। যেমন: পারভীন তার প্রথম জীবনে আকস্মিকভাবে তার বাবা-মা’কে যৌনসম্পর্কে লিপ্ত হতে দেখেছেন। মানসিক ভারসাম্যহীন তার ছোট ভাই শাহ আলমের মধ্যে শরীরবৃত্তীয় অভিজ্ঞতার আলোচনা টেনে এনেছেন।
বা বলা চলে বাকি বোনদের বাঁচাতে তার এই স্যাকরিফাইজ মেন্টালিটি বা সংসারের হাল ধরতে তার এই বলিদান সাহসী নারীর উজ্জ্বল প্রতীক হয়ে ফুটে উঠেছে। এখানে উল্লেখ্য যে রুহী যা পারেনি, রুবি তা পেরেছে। এই যে তাদের ইউনিটি, বন্ডিং নিঃসন্দেহে উপন্যাসটিকে অন্য এক মাত্রা এনে দিতে পারতো।
নারী আজও কতটা উপেক্ষিত, কতটা অনাদরে তার বেড়ে ওঠা ভাবলে শিউরে উঠতে হয়। পদে পদে তার বঞ্চনা নিয়ম ছাড়াই নির্যাতন এ সবই নারী ও পুরুষের প্রণয়কে ম্লান করে দেয়, ভালোবাসার ভাবলীলায় কলঙ্কের কালি মাখায়। সাম্যচেতনায় বিদঘুটে প্রশ্নচিহ্ন এঁকে দেয় টকটকে লাল রক্তের অক্ষরে। তথাকথিত সুখী জনগোষ্ঠীর স্থিরচিত্রে নারীর এই রূপ, এমন বাস্তবতা তীক্ষè ফলার মতো কোথায় জানি বিঁধে আছে। সারাক্ষণ এফোঁড় ওফোঁড় করে দিচ্ছে আমাদের। অথচ কতটা নির্লিপ্ত আমরা। পুরুষের পাষাণ পতাকা তবুও ওড়ে পতপত করে। সে দেখে আনন্দ পায়।
‘জীবনের রৌদ্রে উড়েছিল কয়েকটি ধূলিকণা’য় এসে লেখক আকিমুন রহমান খানিকটা ভিন্ন স্বরে ভিন্ন নারীর ভিন্ন বাসনার কথা ব্যক্ত করেছেন। কাহিনিতে যারা কলরব তুলেছেন তারা একে অপরকে বলছেন—এসো আমাতে যোজিত হও। ওপক্ষে পুরুষও আবেদন জানায়—অবকাশ দাও! তোমাতে লীন হয়ে যাই। প্রকৃতি ও পুরুষ একে অপরের প্রতি লীলার আকাক্সক্ষায় চিরব্যাকুল। এর কোনো শ্লীল অশ্লীল হয় না। যেমন ফুলের প্রস্ফুটিত হওয়া ও সৌরভ ছড়ানোর মধ্যে উচিত-অনুচিত নেই। কিন্তু পুরুষ-প্রকৃতির মধ্যেকার সাম্যাবস্থা নষ্ট হলে মর্যাদার অসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে একসময় সর্বপ্রকারের যৌনগন্ধই বিকৃত হয়ে যায়। তখন একজন হয়ে যায় দমিত, অন্যজন দমনকারী। আর ঠিক তখনই, সেই বিকৃত যোজনগন্ধই চিহ্নিত হতে শুরু করে এবং সেটাও হয়ে পড়ে একতরফা। পুরুষ হয়ে যায় শাসক। আর এ কারণেই রুহীর মা’কে সবার কাছে নিন্দিত হতে হয়। রুহীরা ছয় বোন। কেবল একটি ভাই অর্থাৎ পুরুষের তাগাদা থেকেই অপ্রত্যাশিত সন্তানের এই সংখ্যাটা ছয়ে এসে ঠেকেছে। হায় রে পুরুষ! কেন পুত্র সন্তান হচ্ছে না এমন দুশ্চিন্তায় রুহীর বাবাও হতাশ, বিপর্যস্ত, মাঝেমাঝেই তাকে দুঃখে ভারাক্রান্ত হতে দেখি। শুধু সমাজ নয় এই পুত্রসন্তান গর্ভে ধারণ না করায় দায় রুহীর মা’কে নিতে হয় প্রথমেই তার নিকট মানুষদের কাছ থেকে। আঘাতের প্রথম ধাক্কাটা আসে ভিতর থেকে। সকল নিন্দাকারী রুহীর বাবার পক্ষের আত্মীয়স্বজন।
যে সমাজে আজও মেয়েদের নিজস্ব বিষয়, চিন্তাভাবনা, এমনকি মেয়েদের জীবনকেও ঠিক তথাকথিত ‘মূল’ পৃথিবীর অংশ বলে গণ্য করা হয় না সেখানে রুহী জানে তার মেয়ে হয়ে জন্ম নেওয়াটা কতটা ঘৃণার, বেদনাবিদ্ধ, বিস্ময়চিহ্নের মতো শক্ত দেয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া তার আর কিছুই করার নেই। তাই তো সে স্পষ্টত বলতে পারে—‘আমার পৃথিবী কেবলই অযত্ন আর শাসানি তর্জনে ভরা।’ আজ যুগের হাওয়া যেখানে সবকিছু বদলাতে শুরু করেছে, আইনের কড়া বেষ্টনীতে সকলেরই বাঁধা পড়ার ভয় রয়েছে সেখানে আমাদের সমাজে কেন একজন পুরুষ ও নারীশিশুর প্রতি পিতামাতার এমন বৈষম্যমূলক আচরণ? নির্মম এবং বর্বরতার শেষপ্রান্তে এসে ঠেকেছে সেইসব প্রশ্ন। উত্তরগুলো এলোমেলো, অজানা হলেও আলোচ্য উপন্যাসে এর যথার্থ বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। আমরা জানি পরস্পর-বিরোধী চেতনা নিয়েই সময় বর্তমানে অবস্থান করে। সেখানে একটি ধারা সবসময় তার স্থিতাবস্থাকে আঁকড়ে ধরে থাকতে চায়, বিপরীতে অন্য ধারাটি চায় সেই স্থবিরতাকে উৎরে সামনের দিকে অগ্রসর হতে। এই স্থবির এবং অগ্রসরপ্রবণ সময় দুটি ধারার মধ্যে এসে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে। স্থাণুকে পরাজিত করে অগ্রবর্তী সময়চেতনা একটি নতুন ক্ষেত্রে এসে স্থির হয়। দ্বন্দ্বের এই খেলা সবসময় জমে ওঠে। এবং তাকে কেন্দ্র করেই ইতিবাচক সময় সামনের দিকে অগ্রসর হয়।
আকিমুনের এই উপন্যাসে সময় যেন স্থির। ফলে রুহীরা একদিন তারই চাচাতো ভাইয়ের কাছ থেকে উকিল নোটিশ পায়। তার পরিবারের সবার বিরুদ্ধে আদালতে করা সেই কেসের নোটিশ রুহীদের জীবন কাহিনির এক অনন্য অধ্যায় উন্মোচন করে। এখানে রুহীর কাহিনি প্রকৃতঅর্থে রুহীদের কাহিনিতে রূপান্তরিত হয়েছে। গভীরভাবে মনোযোগ দিলে দেখা যায় উপন্যাসের অন্তর্বর্তী যুক্তি-শৃঙ্খলা এবং উপস্থাপনার রীতি নতুন নতুন বিস্ময়ের ইন্দ্রজাল তৈরি করে চলেছে। জীবন যদি হয় নিরন্তর দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর জটিল এক প্রশ্নমালা তাহলে তার মীমাংসার প্রয়াস মিলবে কোথা থেকে। আবার উল্টো দিক থেকে ভাবলে এটাও সত্য যে, মীমাংসাটা কী সত্যিই জরুরি? বরং প্রশ্নের বিস্তারে নানা কূটাভাসে তাকে আরো জটিল গ্রন্থি করলে দোষটা কোথায়? তর্কে গেলে বলতে হয় দোষ-ত্রুটি কিছু তো আছেই এই ভাবনা কারকদের। তারা বলতে পারেন অমন গোলকধাঁধায় পথ হারাতে যাবো কেন? বোধ করি এমন ভাবনা থেকেই আকিমুন তার এই উপন্যাসের ফাঁদ পেতেছেন সরল আর শীতল করে যেখানে রুহী উপন্যাসের মূল কথক হলেও সে নিজেই বলছে একসাথে ছয়জনের কথা। রসিয়ে রসিয়ে। তার মুখ দিয়েই উচ্চারিত হচ্ছে এর একটা বড় কারণ বাকিরাও তার সমগোত্রের। পিতার মৃত্যুর পর এই ছয় বোনের অসহায়ত্ব, তাদের বিলাপ আমাদের ভাবিত করে—‘আমরা ছয়জন, কিন্তু আব্বা তো নাই—আব্বা তো নাই—ক্যামনে কী হবে—কী করব- কোথায় যাব—আব্বা যে নাই—কে পথ দেখায়ে দেবে? আমি হাউমাউ করে কাঁদতে থাকি ঘরে ঢুকেই। কান্না সামলাতে পারি না যে—রুবি ফুঁপিয়ে ওঠে। কী হইছে, কী মেজো আপা—বেবী ঝাঁপিয়ে পড়ে দুবোনকে জড়িয়ে ধরে। কী হইছে…।’
উপন্যাসের যত্রতত্র নারীর প্রতি এই যে নির্যাতন আর নির্যাতন! কিন্তু সেখানেই তো সব শেষ হয়ে যায় না। প্রতিবাদী, সচেতন একটি মেয়ে কতদিন মেনে নেবে এই জীবন। বাধ্য হয়েই তাকে একদিন ঘর ছেড়ে বাইরে এসে দাঁড়াতে হবে। সে যাবে রোদের পথে। যেখানে আলোর রেখা উঁকি দিচ্ছে। আশার আশকারারা ডেকে ডেকে হয়রান সে যাবে তার সাথে। যদিও এই পথ বড় বন্ধুর, এখানে পদে পদে ঠোক্কর লাগার ভয়, কিন্তু নারীর আত্মবিশ্বাসে যদি একবার কেউ উস্কানি দিতে পারে তাহলে পুরুষের এই দম্ভ, এই আচরণ কখন কোথায় অচল হয়ে যাবে তা কেবল সময়ের হাতে ছেড়ে দেওয়াই ভালো। কেন একজন নারীকে বলতে হয়—অর্ধেক যে জনতাকে আমরা স্তন দিয়ে লালন করি সেই তারাই আমাদের বিচ্ছিন্ন করবে আর উদ্ভট শাসনে আবদ্ধ করে রাখবে? এখানে সকল নারীর প্রতিনিধি হিসাবে রুহীর উপস্থিতি অতি অবশ্যই জোরাল। সে তার ব্যাক্তিগত ঘটনার মধ্য দিয়েই বারবার উপস্থাপন করেছে রুবী, বেবী, বাবলি, খুকু আর ইতির ঘটনা। রুহীরা নারী হয়েও শিক্ষিত। ওদিকে তাদের চাচাতো ভাই শফিক-রফিকরা ধ্বজাধরা সমাজের উচ্ছিষ্ট, ভ্যাগাবন্ড। যারা মামলা ঠুকে মুসলিম আইনের ধারায় কুপোকাত করতে চায় রুহীদের। সম্পত্তির এই ভাগবাটোয়ারা বুঝিয়ে দেয় ধর্মও নারীকে কতটা কম মূল্য দিয়েছে। সে অধ্যায়েও নারীরা আজও কোনঠাসা। জমিজমার এই মামলা রুহীর জীবনের নতুন একটি দিক উন্মোচিত করেছে। সে হয়তো বলতে পারে আমাকে ঠিক মারেনি তারা, তবু আমার বিষণ্ন নারীশরীর প্রচণ্ড প্রহার অনুভব করেছিল।
নারীরও শরীরের খিদে আছে, চাওয়া পাওয়া আছে। আছে প্রত্যাশা ভঙ্গের বেদনা। এমনকি মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধেও তার শরীর বেজে ওঠে। তাইতো পত্রমিতালির সূত্রে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া এক যুবকের সঙ্গে রুহীর প্রাণ ইন্দ্রিয়সুখের জন্য তৈরি হয়েছিল। অজানা এক কাঁপনে সে কুঁকড়ে যাচ্ছিল করুণভাবে। এই উপন্যাসে রুহী উচ্চশিক্ষিত একজন নারী। যদিও উপার্জনের অন্বেষণে চাকরিতে প্রবেশ করা হয়নি তার। বা বলা চলে বাকি বোনদের বাঁচাতে তার এই স্যাকরিফাইজ মেন্টালিটি বা সংসারের হাল ধরতে তার এই বলিদান সাহসী নারীর উজ্জ্বল প্রতীক হয়ে ফুটে উঠেছে। এখানে উল্লেখ্য যে রুহী যা পারেনি, রুবি তা পেরেছে। এই যে তাদের ইউনিটি, বন্ডিং নিঃসন্দেহে উপন্যাসটিকে অন্য এক মাত্রা এনে দিতে পারতো। কিন্তু গ্রহের কোন গন্ডগোলে জানি না আকিমুন রহমান নারীকে ফের পরাজিতের কাতারে শোয়ালেন।
মেয়েটি বলে এসো, আমি তোমার জন্য প্রতিক্ষা করে আছি। তুমি এসে পূর্ণ করো আমাকে। মিলনের জন্য তাকে পাবার জন্য সবাই প্রস্তুত। হয়তো অজানা ব্যথায় ভেঙে পড়ার জন্য তার স্বপ্নের দ্বীপটিও। কিন্তু শত চেষ্টাতেও যাত্রা তার সফল হয় না।
নারী যদি পুরুষের অর্ধাঙ্গিনী হয়, পুরুষও নারীর অর্ধাঙ্গ। মেয়েদের কোমল অনুভূতি নিয়ে খেলতে গিয়ে আমরা অনেক সময় তাদের বার্বি ডলের ভূমিকায় রেখে দেই। ভাবি এই বুঝি তার ভালোবাসা উড়ে গেলো। প্রতিটি নারীই তার প্রিয়তম পুরুষকে অবশ্যই মনের মতো করে পেতে চায়, কিন্তু তা কখনোই মাথা নত করে নয়! পুরুষের গৌরবে গৌরবান্বিত হয়ে নয়। দেখেও দেখে না যে পুরুষ, তার উদ্দেশে নারীর অবিরাম সংকেত, সন্দেহ, প্রতিবাদ চলতেই থাকে। তখন আর কিছু নয় শুধু তার ভাষাটা বদলায়। একুশ শতকে পা বাড়ানো মেধাবী, সৃজনশীল, সংবেদনশীল নারী রুহী, রুবি কেন শফিক-রফিকের উকিলের হুমকিতে কোর্ট-প্রাঙ্গণ থেকে প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে আসবে? যেখানে আশৈশব এই রুহীরা লড়াই করে এসেছে! যে মেয়েরা ভাষা, বয়স, ধর্ম ও শ্রেণির ব্যবধান সত্ত্বেও এক ভাষায় কথা বলে ওঠেন। প্রতিবাদে একই উপলব্ধির উন্মোচন ঘটান। সেই যন্ত্রণা থেকে উৎসারিত রুহীদের আকিমুন রহমান কেন যন্ত্রণা সাথে লজ্জার আঁচে ভাজলেন? এ এক বিরাট বিয়োগ চিহ্নের মতো মনে হলো আমার কাছে। হালহীন নাবিকের মতো তার এই অসহায় আত্মসমর্পণ অবশেষে প্রতিফলিত হল ব্যর্থতায়, বিদ্বেষে, বঞ্চনা ও অবিচারের দ্বন্দ্বে জর্জরিত সেই পুরুষশাসিত সাজানো সমাজের মধ্যে। আর এখানেই কাহিনির ঝুলে পড়া, এখানেই তার ভরাডুবি।
উপন্যাস নিয়ে অনেক কথা হলো এবার কথাসাহিত্যিক আকিমুন রহমানের ছোটগল্প নিয়ে আমাদের হৃদয়ে বেজে চলা অন্তরের ধুনগুলো শোনাতে চাই। সাম্প্রতিককালে আমাদের অধিকাংশ গল্পকারের গল্প যখন এক অনতিক্রান্ত সীমাবদ্ধতার ভেতর কখনো হাবুডুবু কখনো বা সাঁতরে বেড়াচ্ছে, বেশিরভাগ গল্পই যখন গতাানুগতিক এক পানসে জীবনবোধের পাঁকের মধ্যে তার পিচ্ছিল দেহটা নিয়ে স্বাদের ঘোলাজল আরও ঘোলা করছে, ঠিক সে মুহূর্তে হাতে গোনা দু’একজনের মধ্যে আকিমুন রহমানের ‘এইসব নিভৃত কুহক’ মনস্ক পাঠককে জানান দিয়ে যায় সৎ গল্প, প্রকৃত গল্প এখনও নির্মাণ করা যায়। সে গল্পের ব্যুৎপত্তি শিল্পের মতো। গভীর এক বোধ নিয়ে তা নিমিষেই স্বঅস্তিত্বের অভ্যূদয় ঘটায়। আকিমুনের এই গ্রন্থের গল্পগুলো রম্য মেজাজে তারিয়ে তারিয়ে পড়ার মতো নয়। গল্পগুলোর মেজাজ যেন এক ধ্রুপদী চলচ্চিত্রের মতো। কিছুটা মন্থর। কিছুটা রুক্ষ। পাথুরে পথের মতো থেকে থেকেই যার চড়াই উৎড়াই। হালকাভাবে নিলে এ পথ অতিক্রম করা কিছুটা দুষ্কর। তার গল্পগুলো পড়লে মনে হবে দুর্ভেদ্য অরণ্যের মতো বিশাল আর গভীর। অন্ধকারাচ্ছন্ন আর নিশ্চেধ্য। তাতে প্রবেশ করতে হলে নিজের মনোযোগকে দাঁড় করাতে হবে তীক্ষ্ণ ছুরির মতো। অন্ধকার ব্যূহ ভেদ করতে পারলে অরণ্যের গভীরে বনে বাদাড়ে যে সৌন্দর্য, সবুজাভ যে দৃশ্যের সন্ধান পাওয়া যাবে—তাতে অন্তত নিজের সেই রক্তাক্ত অভিযানকে সার্থক করে তোলার পক্ষে যথেষ্ট।
আকিমুনের গল্প সেই অকৃত্রিম মনোযোগের গল্প। সেই অভিনিবেশের গল্প। ‘এইসব নিভৃত কুহক’ ২০১৭ সালে প্রকাশিত হয়েছে খড়িমাটি থেকে। মোট নয়টি গল্প নিয়ে প্রস্তুতকৃত তার এই গ্রন্থ অতীতের আকিমুন থেকে অনেকটা সরে এসে আমাদের মননে চিন্তার ছাপ ফেলতে পেরেছে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। নামের ভেতরেই লুকিয়ে আছে বিপুল এক রহস্য। যে রহস্যকে খুলতে হলে আমাদের মগজে বাঁধতে হবে অন্য কিসিমের রেঞ্জ। তার এই একান্ত মায়াজাল, জনসংযোগবর্জিত নিভৃত নির্জনে তিনি আপন অছিলায় নির্মাণ করেছেন এক ম্যাজিক রিয়ালিজম। মনে হবে এ নিছক ছলনা, নিজের সঙ্গে নিজের প্রতারণা। এ ভেলকি এ ইন্দ্রজালে আমার কখনো আটকে পড়ি, কখনো বেরুতে পারি গোপন সেই চোরা পথ ধরে। আমরা ধারনা করতে পারি অনেকটা প্রাজ্ঞ হয়ে এই সময়ের মানস-সংগঠনে মাটি মানুষ বিল-ঝিল-নদী-জঙ্গল জন্ম-মৃত্যু-প্রেম-লোভ-ঘৃণা-দ্বন্দ্ব ইত্যাদি মানবিক ও প্রাকৃতিক বিষয়, প্রসঙ্গ আবহ অতীত এবং বর্তমানের সঙ্গে এমনভাবে মিলেমিশে তার ভিতর শিল্প-বীজ তৈরি হয়েছিল—যা পরবর্তী সময়ে ‘এইসব নিভৃত কুহক’ গল্পগ্রন্থের ভেতর দিয়ে তার এবং বহু মানুষের অবচেতনের ফল হিসেবে জাদুর জয়গানের আকারে প্রকাশ পেয়েছে।
আমরা জানি ‘ব্যক্তিমানুষ তার অন্তর্গূঢ় মর্মমূলে শুধু নিজস্ব স্মৃতি-অভিজ্ঞতা এবং সমকালীন বিশ্ব-পরিশ্রুত অভিজ্ঞান বহন করে না, নিজের জীবকোষে বহন করে নৃতাত্ত্বিক অভিজ্ঞান। মিথ তার নৃতাত্ত্বিক অভিজ্ঞানের অংশ। এ-জন্যই মিথের প্রতি সৃষ্টিশীল ব্যক্তি স্বভাবতই আকর্ষণ অনুভব করেন। প্রকাশমাধ্যম হিসেবে মিথ সাহিত্যক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সৃষ্টিক্ষম প্রতিভার সমসাময়িক জীবনচেতনা শাশ্বত মিথ-অভিজ্ঞানের সঙ্গে সমন্বিত হয়ে সাহিত্যে তৃতীয় মাত্রার সংযোজন ঘটায়। ব্যক্তি-অভিজ্ঞতা ও পুরাণ-অভিজ্ঞানের সংযোজন-সমন্বয়ে সাহিত্য পায় শাশ্বতকাল মাত্রা।
‘আমি ও আমার অদ্ভুত দ্বীপ’ প্রথম এই গল্পটিতে তিনি শোনাচ্ছেন তার বাবার কাছ থেকে পাওয়া একটি দ্বীপের কথা। যে দ্বীপ হতে পারে বাস্তবের হতে পারে তার কল্পনার। অনেকটা ফ্রি-ভার্সে লেখা একটানা মুক্তগদ্যের মতো শোনালেও আকিমুন অন্য ঢঙে পাঠকের চিত্তে আরোপ করেছেন। এর ভাষা, এর ন্যারেটিভ বর্ণনায়, এই মূর্ত তো ক্ষণিক পরেই বিমূর্তের প্রবেশ আমাদের অন্য আনন্দে ভাসাতে পেরেছে। তার বাবার নির্দেশ বংশের সবাই জীবনে একবার অন্তত সেখানে যাবে। স্থায়ীভাবে নয়, কয়েকটা দিন সেখানে কাটাবে তারা। সেই সূত্রে গল্পের নায়ককেও যেতে হয়েছে সেখানে। অনেক জলরাশি পার করে, লোকালয় থেকে দূরের সেই দ্বীপে কেউ যেতে রাজি নয়। এখানে প্রাণ এবং নিষ্প্রাণের বিমূর্ত কিছু কথা আমরা শুনতে পাই। আমি যখন সেই দ্বীপে পৌঁছনোর জন্য জলস্রোতে নৌকা ভাসাই টেবিলে পড়ে থাকা ফরাসি চায়ের পেয়ালাকে প্রস্তাব দেই তুমি যাবে? সে প্রত্যাখ্যান করে। বলে উষ্ণ গৃহে বরং একা একা আয়েশ করবে। এভাবে তার সখের হাতঘড়ি, ইজিচেয়ার সবাই সেই দ্বীপে যাবার, তার সঙ্গী হওয়ার প্রস্তাবটি পাশ কেটে যায়। অবশেষে তিনি একাই রওনা হন। কেটে যায় আনন্দে গড়া তার হাজারো মুহূর্ত। এভাবে অনেকগুলো স্বপ্নাতুর ঋতু কেটে যাওয়ার পর সেই দ্বীপে এসে হাজির হয় এক স্বপ্নের জলজান। সেখানে যেতে কে যেন তাকে ডাকে। আসলে তার অতীত তার ছেলেবেলা তাকে ডাকছে। এক ফুটফুটে মেয়ে শিউলি বনে এসে দাঁড়িয়ে আছে। যার ঝুঁটি বাঁধা চুল ওড়ে বাতাসে। তিনি মনেপ্রাণে সেখানে তার শৈশবে যেতে প্রস্তুত। নিঃশব্দ বেলাভূমির কাছে এসে থামে সেই জলজান। মেয়েটি বলে এসো, আমি তোমার জন্য প্রতিক্ষা করে আছি। তুমি এসে পূর্ণ করো আমাকে। মিলনের জন্য তাকে পাবার জন্য সবাই প্রস্তুত। হয়তো অজানা ব্যথায় ভেঙে পড়ার জন্য তার স্বপ্নের দ্বীপটিও। কিন্তু শত চেষ্টাতেও যাত্রা তার সফল হয় না। একদিকে দৈব জলজান অন্যদিকে তার দ্বীপ উভয়ই ব্যথিত চোখে তাকায়। মলিন হয়ে আসে তাদের প্রভা। ফলে আবার ঘুম। স্মৃতি থেকে ছিটকে যাওয়া সময়। আবার জেগে ওঠা।
নির্মেঘ আকাশে চাঁদ ওঠে আকাশে তেমনি আকিমুন রহমানকে পাঠ শেষে আমরা বলতে পারি তিনি মানব-জীবনের কংকরময় মৃত্তিকা খুঁড়ে খুঁড়ে সংগ্রহ করেছেন মানবীয় উপাদান। বিপুল অভিজ্ঞতা, জীবনবোধ, গভীর পর্যবেক্ষণ, চরিত্র সৃষ্টি সব কিছু মিলেই তিনি তার সাহিত্যের রাজ্য তৈরি করেছেন।
আসলে সত্তাই অস্তি। সত্তার বাইরে কেবলই শূন্যতা। আকিমুনের এই গ্রন্থের গল্পগুলো বলে দেয়, আমি আছি, আমি স্বয়ম্ভু। আমার বাইরে যা-যা, তা আমার সত্তার স্ফুরণের পক্ষে অকেজো, অবান্তর। আমার বর্তমান, আমার অতীতের প্রতিফলন আর আমার ভবিষ্যৎ আমার বর্তমানের কল্পনা-যোজনা-জিজ্ঞাসার সংশ্লেষণ থেকেই জাত হবে তারা। আমি একা, আমার শূন্যতার মধ্যে জেগে থাকা হাজারো দ্বীপ বাইরের আবেগ তাকে মহাদেশ কিংবা মহাসমুদ্রের সন্ধান দিতে পারে না। কোনো চিন্তার বিদ্যুৎ এইসব গল্পের সত্তাকে কলুষিত করবে না। তিনি বলতে পারেন আমার গল্পের বহিঃপ্রকাশ প্রকৃতির অভিভাবের বাইরে। আসলে হয় কি এই আমাদের চেনা সমাজ, দেশ, সখ্য এ সবই মানুষের স্বেচ্ছাকৃত শৃঙ্খল কিন্তু কখনোই নিয়ামক নয়। সেখানে মানবিক অনুশাসন মিথ্যা, সামাজিক সংজ্ঞাদি অলীক, এমন কি বন্ধুতার অনুগত্য পর্যন্ত আপন খেয়াল খুশির ওপর নির্ভর করে চলে। এই যে সত্তা থেকে সত্তান্তরে, অস্তিত্ত্ব থেকে অন্য এক অস্তিত্ত্বে, এক বিশেষ অবস্থা থেকে অন্য এক অবস্থার আবহে আহরণ সেখানে লেখকের অভিযাত্রা, সিদ্ধান্তগুলো একান্তই তার। যেকানে অংকুর থেকে উদগম, ফের উদগম থেকে বৃদ্ধি এরপর তার বিকাশ।
আসলে টিকে থাকার প্রতি ধাপেই আমরা চিন্তা করছি, নিজেকে ব্যক্ত করছি, কখনো গঠন করছি, ভাবছি। গল্পের প্লাবনে কাহিনিকে ভাসাচ্ছি, আগুনে পোড়াচ্ছি। যে কোনো মুহূর্তেই লেখক তার গতিকে বদলে দিতে পারে। ব্যক্তিগত পরিসংখ্যানে আনতে পারে বিপ্লব। প্রথাকে পরিণত করতে পারে উপহাসে। গল্পগুলোতে প্রচলিত অর্থে যেভাবে নায়কের উপস্থিতি থাকে, তেমন কোনও নায়ক নেই। তবে আপন উদ্ভাসনে তৈরি করা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চরিত্রদের সঙ্গেী করে আপন আলপথ ধরে তার ছুটে চলা, প্রগাঢ়ভাবে সবার অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতিতে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যের চালচিত্রের পরিস্ফুটন আকিমুনের এই গ্রন্থের মূল আকর্ষণ।
‘আচার্য ও বিদ্যার্থী কথা’ গল্পে গ্রামবাংলার স্পর্শগ্রাহ্য জীবন দিয়ে শুরু। এরপর তাকে যেতে হবে নগরে। খনির মতো গুহার ভেতর বক্তবের হীরক রেখে গল্পে আকিমুন বাইরে তৈরি করেছেন ব্যঞ্জনার প্রচ্ছন্ন ছায়াময় জটিল স্তম্ভ। পাঠককে আঙ্গিকের জটিল স্তম্ভের তলদেশে সুড়ঙ্গ করে চলে যেতে হবে। সেখানে আছে জীবনের মতো এক অস্থির বিস্ফোরণ। নগর কী করে শুষে নিচ্ছে গ্রামকে? বর্ণনায় আমরা পাই—‘পিতামহ আমার দ্বাদশ বর্ষ পূর্ণ হবার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। আমি জানতাম আমার দ্বাদশ বর্ষ পূর্ণ হলেই ভোররাত থেকে দিনভর খেতের কাজে থাকব, হুঁকো টানতে পারবো অবাধে।…আমি ওই জীবনের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আর মায়ের পাশে বসে জাল বুনতে বুনতে শুনছিলাম—অনেক দূরের এক নগরীর গল্প।’ যেখানে বিদ্যা আছে, বুদ্ধি আছ। জ্ঞান আছে, গ্রন্থ আছ। আচার্যদের সম্মান আছে।
স্মৃতিচারণ থেকে উৎসারিত মনে হলেও এই গল্প সে কথা বলে না। এ গল্প অনুশোচনার, অবক্ষয়ের, হতাশার যত্নহীন শিথিল অবয়ব থেকে তৈরি নয় এ গল্প। এ গল্প প্রতিবাদের, এ গল্প লড়াইয়ের আগের কিছু টুকরো টুকরো ফ্র্যাগমেন্ট। আকিমুন শোনাচ্ছেন—‘আমি কেমন করে প্রবেশ করবো জ্ঞান ও শুদ্ধতার ভুবনে। ও দীপ বলো আমি কি নিভে যাবো—ও চন্দন সুগন্ধ বলো—আমি কি লুপ্ত হয়ে যাবো অন্ধকারে?’
আকিমুনের এই গল্পগুলোয় আঙ্গিকের এরূপ পদ্ধতি সুসাধ্য নয় এবং তা বিতর্কের অবকাশ রাখে। পদ্ধতির এই প্রবণতা স্বভাবতই দুর্বোধ্য এবং সাধারণ্যে দুষ্প্রবেশ্য। তবু আমাদের ভালো লাগে যখন তার সব ইন্দ্রিয় মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। সব প্রবাহ এসে মিশে যায় একধারাতে।
সফল ঝড়ের পরে প্রৃকতি যেমন শান্ত হয়ে যায়। নির্মেঘ আকাশে চাঁদ ওঠে আকাশে তেমনি আকিমুন রহমানকে পাঠ শেষে আমরা বলতে পারি তিনি মানব-জীবনের কংকরময় মৃত্তিকা খুঁড়ে খুঁড়ে সংগ্রহ করেছেন মানবীয় উপাদান। বিপুল অভিজ্ঞতা, জীবনবোধ, গভীর পর্যবেক্ষণ, চরিত্র সৃষ্টি সব কিছু মিলেই তিনি তার সাহিত্যের রাজ্য তৈরি করেছেন। যেকোনো অর্থেই, সাহিত্যে, প্রতিতুলনা একটি আপেক্ষিক বিষয়। এখানে কে কাকে ছাপিয়ে যান বা গিয়েছেন। কে অগ্রবর্তী কে পিছিয়ে পড়েছেন এ তর্ক এখানে টেনে আনা অমুলক। কেননা ব্যক্তিত্বের স্বতন্ত্র্যই একজন স্রষ্টার মৌলিকত্বের দ্যোতক।