উপন্যাসের জনপ্রিয়তার ধারায় আকবর হোসেন গুরুত্বপূর্ণ নাম। খুব সাহসের সঙ্গে উপন্যাসের বিষয়বস্তু নির্বাচন করেছিলেন। গতানুগতিকতাকে পরিহার করে জীবন ও সমাজের গভীর সত্য ও ক্ষতকে শিল্পভাষ্যে নতুন মাত্রা দিয়েছিলেন উপন্যাস সাহিত্যে। তার উপন্যাস শুধু নির্মাণ নয়, দর্শনও। উপন্যাসের চরিত্রের ভেতর দিয়ে তার প্রয়াস ঘটিয়েছেন। রূপরূপে রয়েছে গম্ভীরতার স্বরূপ। প্রেম-শরীর-রক্তজীবের যৌনতা আর তুমুল পুরুষতান্ত্রিক হয়রানি নিঃশঙ্কচিত্তে তুলে এনেছেন। এসব অনেকেই ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেননি। কিন্তু এসবের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আকবর হোসেন প্রণিপাত জানিয়ে জীবনের আলো-ছায়ার খোঁজ করেছেন, ছুড়ে ফেলেছেন আইন-কানুনের পর্চা, জীবন ও সমাজের গহীন সত্যটি বিশ্বাসের প্রবাহে বুনেছেন। পঞ্চাশ থেকে সত্তর এই তিন দশক তিনি বাঙালি পাঠকদের মন্ত্রমুগ্ধের মতো ধরে রাখতে সক্ষম হন। এসব কারণেই পাদপ্রদীপের আলোয় হয়ে ওঠেন অগ্রগণ্য। একই সঙ্গে জনপ্রিয়। বিশেষ করে তার ‘অবাঞ্ছিত’ উপন্যাস বাংলা কথাসাহিত্যে বিশেষ একটি স্থান দখল করে নিতে সক্ষম হয়। উপন্যাসটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে পাঠকমহলে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু উপন্যাসটির জন্ম ও প্রকাশ-ভাগ্যে ঘটেছিল বহুমাত্রিক নাটকীয়তা। সেটিও যেমন গুরুত্বের, তেমনি উপন্যাসের আড়ালেও যে আরেক উপন্যাস থাকে, সেই গহীন সত্য আবিষ্কৃত হয়েছে।
ব্রাত্যভূমি বাংলা বলেই হয়তো এর সাহিত্য এত উর্বর। সে উর্বরতায় এর উপকরণগুলোও অশ্রুসিক্ত-আবেগায়িত। সে আবেগ চর্যাপদের সাধনাসঙ্গীতে যেমন মুখর, মধ্যযুগের ‘ব্যক্তিত্বহীন’ দৈববিলাসী কাব্যেও তেমনি স্বতঃস্ফূর্ত। এর কারণটি হচ্ছে, ‘বাঙলা চিরদিনই কবিতার দেশ। একমাত্র প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বৈচিত্র্যই বাঙালিকে কবি করেনি, তার কবি প্রতিভার মূলে মননরীতির বৈশিষ্ট্যও সমান পরিস্ফুট। বাঙলার আকাশে নিদাঘ রৌদ্রের নিষ্ঠুর দীপ্তি, আষাঢ়ের ঘন বর্ষার মেঘ সম্ভারের মধ্যে ঐশ্বর্য ও মহিমা এবং শ্রাবণের দিবারাত্র, অবিরাম বর্ষণধারার সঙ্গীতে হৃদয়াবেগের প্রতিচ্ছবি।’
বাংলার এ প্রতিচ্ছবি থেকে উপন্যাসের মতো এক নিরুদ্বেগ ও নিরাসক্ত শিল্পসৃষ্টির জন্য বাঙালিকে অপেক্ষা করতে হয়েছে প্রায় বারোশত বছর। উপন্যাস সাহিত্যের একটি আধুনিক আঙ্গিক। এই আঙ্গিক তার মননে, মগজে। বিপর্যস্ত সময়ে বিপন্ন মানুষের আন্তঃভাবনার জটিল নির্যাসই তো উপন্যাস। সে নির্যাস কখনো মধুময়, কখনো বিষাক্ত। তবু তা নীলকণ্ঠের ধারক হয়ে বেঁচে থাকা মানুষের অন্তর্ক্রন্দনের সুবিন্যস্ত ব্যক্তিদর্শন। সে দর্শনে দেশ, সমাজ কাল এক অনিবার্য বিষয়। কেননা ‘শিল্পী সমাজসত্তার অগ্রসরমান চেতনার ধারক।’ অর্থাৎ শুধু সমসাময়িক মনন ভাবনাই শুধু সে দর্শনের মূল ভিত্তি নয়; এর সার্বিক সম্ভাব্যতাও নিরূপিত হয়ে থাকে উপন্যাসে। চর্যাপদ থেকে শুরু করে পুরো মধ্যযুগ অর্থাৎ আঠারো শতক পর্যন্ত বাঙালির সে প্রস্তুতি ছিল না। আধুনিক মন-মনন ও মেজাজ থেকে এই ভূমি অনেক দূরে ছিল বলেই এর শিল্পসন্তানের হাতে উপন্যাসের শিল্পমূর্তি গড়ে ওঠেনি।
বাঙালির নিশ্চল জীবনে বহু দূর থেকে প্রথম আঘাত করে ইখতিয়ার উদ্দীন মোহাম্মদ-বিন বখতিয়ার খিলজী। ১২০৪ সালের এ আঘাত বাঙালি হিন্দুদের সমাজ ব্যবস্থায় যেমন পরিবর্তন এনে দেয় তেমনি অস্তিত্বের দরজায়ও কড়া নাড়ে। কিছু সময়ের জন্য সচকিত হয়ে ওঠে এ বঙ্গের মানুষ। কিন্তু ক্রমান্বয়ে মুসলিম শাসনের সাম্য সমাজব্যবস্থায় তা অনেকটা নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। বাংলা হয়ে ওঠে হিন্দু-মুসলিমের এক মিলনমেলা। সেখানে দেবস্তুতি কিংবা পীর খান্দানের দোয়া দরুদেই পুরো মধ্যযুগের সময় কাটে। এ শতকের একেবারে শেষ সময়ে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে আসে ব্রিটিশ ব্যবসায়ী। সে সময়ের সবচেয়ে আধুনিক সভ্যতার পতাকাবাহী এ জাতি। ক্লাইভ-প্রহসনে পরাজিত হয় সিরাজ। আর এ পরাজয়ের মধ্য দিয়েই বাঙালির জীবনে এক নতুন যুগের সূচনা। দীর্ঘ শোষণের করাঘাত আসে বাঙালির দরজায়। ততদিনে এ জাল ছড়িয়ে গেছে বাঙালির সর্বশরীরে। ১৮০০ সালের ফোর্ট উইয়িলাম কলেজ ও ১৮০১ সালের বাংলা বিভাগের যাত্রা শুরু হয় বাঙালির সে শোষিতশরীরের রূপ নিয়েই। কারণ ‘এর সঙ্গে বাঙালির যোগ ছিল না কিন্তু বাংলা সাহিত্যের বিশেষতঃ গদ্য সাহিত্যের যোগ ছিল।’ আর এই গদ্য সাহিত্যের প্রধান বাহন হয়ে ওঠে উপন্যাস। কেননা, উপন্যাসের বিস্তৃত অধ্যায়ে ব্যক্তির যে সামাজিক পরিবেশ ও রাজনৈতিক আখ্যান ফুটে ওঠে তা অন্তত সে সময় অন্যকোনো মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব হয়নি। কারণ সে সময় যে সামাজিক জাগরণ লক্ষ করা গেছে তা সামষ্টিক; যে দ্বন্দ্ব লক্ষ করা গেছে, তা ব্যক্তির নয় সমাজের। আর ‘প্রাচীন ও নবীন সম্প্রদায়ের চিন্তা এবং আদর্শগত দ্বন্দ্ব সংঘাত এই জাগরণের উৎসমুখ।’ সে উৎসমুখ অনেক দীর্ঘ। আবার আধুনিক জীবনের এ দীর্ঘায়ত শিল্পভাষ্য একমাত্র উপন্যাসেই বাণীমূর্তি পায়।
নিশ্চল জীবনের নিষ্ক্রিয় সমাজ ব্যবস্থায় পশ্চিমা রাজনৈতিক আঘাত ও নব্য সাংস্কৃতিক স্বরাঘাত বাঙালিকে সচকিত করে তোলে। বাঙালি তার নব্য আত্মভাবনার রূপায়ণ খুঁজতে থাকে। আর এ সন্ধানে তাদের সাহিত্যই মাধ্যম হয়ে ওঠে। সে থেকে সামন্তবাদী; সমাজচেতনার ধারাবাহী এ জনপদের মানুষ ধীরে ধীরে পুঁজিবাদী শিল্পচেতনায় নিজেকে আবিষ্কার করতে থাকে। নীল চাষের বাধ্যবাধকতা আর পশ্চিমা শিল্পবিপ্লবের মধ্য দিয়ে বাংলা অর্থনৈতিক ভাবে অন্তঃসারশূন্য জাতিতে পরিণত হতে থাকে। ‘ভারতীয় কাঁচামাল ইংল্যান্ডের যন্ত্রশিল্পের কল্যাণে পাকা মালে পরিণত হয়ে এদেশে অবাধে আসার ফলে এবং আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যাপক প্রচলনের কারণে দেশীয় শিল্প ধ্বংসের সম্মুখীন হয়।’ এ অবস্থায় ধর্মীয় মতামত প্রচারেও তারা সক্রিয়। তবে একদিকে অর্থনৈতিক পঙ্গুত্ব আর সে পঙ্গুত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্য রাজনৈতিক কৌশলের আরোপ যেমন এদেশীয় মানুষের নাভিশ্বাস করে তোলে তেমনি সাংস্কৃতিক আগ্রাসন এদেশের প্রাচীন সংস্কারগুলোর মূলে কুঠারাঘাত করে। ফলে বাঙালি অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে অনেকটা পরনির্ভরশীল হয়ে পড়তে শুরু করে। তবে পাশ্চাত্য নবচেতনায় জাগ্রত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজা রামমোহন রায় কিংবা ডিরোজিওর মতো আধুনিক মনস্করা এ নির্ভরশীলতাকে কমিয়ে আনতে চেষ্টা করেন।
০২.
আকবর হোসেন কলকাতা রিপন কলেজে বি.এ ক্লাসে অধ্যয়নকালে তার প্রথম উপন্যাস ‘অবাঞ্ছিত’ রচনা করেন। বিখ্যাত এই গ্রন্থটি মাত্র আঠার দিনের রচনা। প্রথম পাণ্ডুলিপিতে বিভিন্ন চরিত্রের নাম হিন্দুয়ানি নামাঙ্কিত করেছিলেন। গ্রন্থ প্রকাশের পূর্বে তা পরিবর্তন করে প্রায় সমস্ত চরিত্রগুলোর নাম মুসলিম পরিবারে প্রচলিত নামানুসারে নামাঙ্কিত করেন। আমরা প্রথম পাণ্ডুলিপিতে ইন্দ্র, শীলা, মীনাক্ষী ও নরেনকে। পরবর্তী সময়ে ফিরোজ, রোকেয়া, রেখা ও আমীর রূপে পাই। সমাজ, ধর্ম ও রাষ্ট্র জীবনে একটা অবাঞ্ছিত সন্তানকে মর্যাদার সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত করার এ প্রয়াস লেখকের মধ্যে কীভাবে দানা বেঁধে উঠেছিল তারই স্বরূপ লক্ষ করা যায় এ গ্রন্থে। এ প্রসঙ্গে লেখকের নিজের বক্তব্য, ‘তারুণ্যের জোয়ারে প্রতিটি জীবন পেতে চায় সুখের আস্বাদন। জীবদেহে এ অত্যন্ত স্বাভাবিক এক উন্মাদনা। আর সে উন্মাদনায় অসামাজিকভাবে সক্রিয় হয়ে লাঞ্ছনা ভোগ করে শুধু নারীরাই। কারণ তারা সন্তানবতী হয়ে লোক-সমাজে ধরা পড়ে যায়। আমার প্রশ্ন হলো; অপরাধী কি শুধু নারীরাই; এই প্রতিবাদের ফলশ্রুতি হিসেবে জন্মলাভ করে অবাঞ্ছিত উপন্যাস।’
ভদ্রলোক চার পাঁচদিন ধরে দর কষাকষি করলেন। প্রথমে দেড় হাজার, তারপর দু’হাজার, আড়াই হাজার এবং অবশেষে তিন হাজারে রাজি হয়েছিলেন।
অবাঞ্ছিত’র পাণ্ডুলিপি নিয়ে তিনি দেখা করেছেন অনেক লব্ধ প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিকদের সাথে। তাদের মূল্যবান মতামত জানার প্রত্যাশায়। ১৯৪১ সালে রচিত এ উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি নিয়ে প্রথমে গিয়েছিলেন গোপাল হালদারের কাছে। দীর্ঘ এক বছর তিনি সেখানে ঘুরেছেন। অনেক দুঃখ বেদনা হতাশা নিয়ে শেষ পর্যন্ত খাতাটি ফেরত নিয়ে আসেন। এরপর বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-১৯৭৪), কাজী আব্দুল ওদুদ (১৮৯৮-১৯৭০), ব্যারিস্টার এস. ওয়াজেদ আলী (১৮৯০-১৯৫১), নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় (১৯১৮-১৯৭০) ও কবি জসীম উদ্দীন (১৯০৩-১৯৭৬) প্রমুখ কবি-সাহিত্যিকের দ্বারে ধরনা দিয়েছেন বছরের পর বছর। কিন্তু কেউই তাঁর এই উপন্যাসটি পড়েন নি। শুধু ব্যারিস্টার এস.ওয়াজেদ আলী পাণ্ডুলিপিটি ফেরত দেবার সময় বলেছিলেন :
‘লিখে যাও আরও লিখে যাও। অন্য কারও দ্বারা লেখার মূল্যায়ন করার দরকার হবে না। দীর্ঘদিন ফেলে রেখে হঠাৎ একদিন মনোযোগ দিয়ে নিজের লেখাটি পড়বে। দেখতে পাবে অনেক ভুল-ত্রুটি। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তোমার এগিয়ে যাওয়া মন নিজের লেখার মান বিচার করতে সক্ষম হবে। দু’তিন বার এমনি করে পড়ে নতুনভাবে লিখে নিজেই একদিন সফলতা অর্জন করতে পারবে।’
আকবর হোসেন ব্যারিস্টার এস. ওয়াজেদ আলীর উপরোক্ত উপদেশটি আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৪১ সালে লেখা উপন্যাস ছাপার অক্ষরে বের হয় ১৯৫০ সালে। এই দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে তিনি দু’বার পাণ্ডুলিপিটির সংস্কার সাধন করেছিলেন।
‘অবাঞ্ছিত’র পাণ্ডুলিপি একদিন আকস্মিকভাবে প্রখ্যাত ফিল্ম ডাইরেক্টর সুশীল মজুমদারের স্ত্রীর হস্তগত হয়। এটি ১৯৪৬ সালের প্রথম দিকের ঘটনা। সুশীল মজুমদারের স্ত্রী পাণ্ডুলিপিটি পড়ে মুগ্ধ হন এবং পাণ্ডুলিপির কাহিনি সংক্ষিপ্তাকারে লিখে বোম্বাইয়ে অবস্থানরত স্বামীর নিকট পাঠিয়ে দেন। সুশীল বাবু এটি পড়ে স্ত্রীকে প্রত্যুত্তরে জানান : ‘তোমার পাঁচ পাতায় লেখা কাহিনির সারাংশ পড়ে আমি বিস্মিত হয়েছি।… তুমি লেখককে সঙ্গে করে বোম্বে চলে এসো। এমন কাহিনির আমি নিশ্চয়ই চিত্ররূপ দেব।’১৯৪৬ সালের ১৮ই আগস্ট ছিল লেখকের বোম্বাই যাবার নির্ধারিত দিন। কিন্তু দু’দিন আগে অর্থাৎ ১৬ই আগস্টে শুরু হয় ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। বিধ্বস্ত হয়ে যায় গোটা কলকাতা মহানগরী। স্তব্ধ হয়ে যায় স্বাভাবিক জীবনযাত্রার চলমান গতি। ভেঙে যায় লেখকের বোম্বাই যাবার স্বপ্নসৌধ। এ প্রসঙ্গে লেখক বলেছেন : ‘এরপর দাঙ্গার ভয়াবহতা কমে গেলেও বিক্ষিপ্তভাবে খুনোখুনি চলতে থাকে। ইতিমধ্যে সুশীল বাবুর স্ত্রীর নিকট থেকে পাণ্ডুলিপিটি চলে যায় ফিল্ম অভিনেতা বিশ্বনাথ মুখার্জ্জির কাছে। তিনি ভবানীপুরের লাভ্লক্ প্লেসে নিজের বাড়িতে থাকতেন। তারই চার-পাঁচখানা বাড়ির পর ছিল ফিল্ম ডাইরেক্টর প্রমথেস বড়–য়ার বাড়ি। কাহিনির চমৎকারিত্বে মুগ্ধ হয়ে বিশ্বনাথ বাবু পাণ্ডুলিপিটি তুলে দেন প্রমথেস বড়ুয়ার হাতে। তিনি এ কাহিনির চিত্ররূপ দেবার জন্যে প্রস্তুত হন এবং প্রায় এক-তৃতীয়াংশ চিত্রনাট্য লিখেও শেষ করেন।’
দাঙ্গা আবার বেড়ে ওঠে। হিন্দু-মুসলমানের পার্থক্য পৌঁছে চরম পর্যায়ে। ফলে দেশ ভাগাভাগিই চরম সিদ্ধান্তে পরিণত হয়। ঠিক হলো ১৪ই আগস্ট ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষকে ভেঙে দু’টি পৃথক রাষ্ট্রের জন্ম হবে। দেশ ভাগাভাগির কারণে লেখক কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় চলে আসার জন্যে মানসিক প্রস্তুতি নেন। সে কারণে তিনি পাণ্ডুলিপিটি উদ্ধারের জন্যে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। জীবন বিপন্ন করে শেষ বারের মতো তিনি চেষ্টা করেন। এবং সে সুযোগও তিনি পেয়ে যান। ১৩ আগস্ট ১৯৪৭; শেষ বিদায়ের আগের দিন। চৌরঙ্গীর ট্রাম লাইনের পাস থেকে তিনি অকস্মাৎ দেখতে পেলেন চলন্ত গাড়িতে মুখার্জি বাবু মধ্য-কলকাতার দিকে যাচ্ছেন। সিদ্ধান্ত নিলেন এ সুযোগে ভবানীপুরে গিয়ে পাণ্ডুলিপিটি উদ্ধারের শেষ চেষ্টা করবেন। তারপর তিনি রওয়ানা দিলেন প্রথমে ট্রামে তারপর দোতলা বাসে। কয়েকজন হিন্দু বাবুর সাথে বাসের ভেতর তার দেখা। তারা নিষেধ করেছিলেন লেখককে ভবানীপুর যেতে। গাড়ি ভর্তি হিন্দুদের রুক্ষ দৃষ্টির মুখে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়লেন চলন্ত গাড়ি থেকে। এতে মারাত্মক আহত হন তিনি। তবু থামেনি তার যাত্রা। ভবানীপুরের ফোর্ড কোম্পানির সামনে নেমে সোজা চলে যান হেইশাম রোড ধরে লাভ্লক্ প্লেসে মুখার্জি বাবুর বাড়িতে। সেখানে নিজেকে হিন্দু পরিচয় দিয়ে বাড়ির গৃহিণীকে বললেন: ‘মুখার্জি বাবু টালিগঞ্জের স্টুডিওতে গেলেন। ঘরে নাকি কোনো এক মুসলমানের লেখা অবাঞ্ছিত নামক একটা বইয়ের পাণ্ডুলিপি আছে। ওটি নিয়ে যাবার জন্য আমাকে পাঠিয়েছেন।’ মুখার্জি বাবুর গৃহিণী প্রথমে খাতাটি দিতে চাননি। পরে তার কিশোর ছেলে খাতাটি সামনে আনতেই লেখক তার কাছ থেকে একরূপ ছিনিয়ে নিয়ে যখন পদ্মপুকুর ঘুরে পার্ক-সার্কাসে ফিরে আসেন তখন সারা কলকাতায় সান্ধ্য-আইন জারি করা হয়েছে। সেদিন লোকমিছিলের ওপর হিন্দুরা গুলি চালিয়ে তিন হাজার মুসলমানকে হত্যা করেছিল। ১৩ই আগস্ট ১৯৪৭ সালে ঔপন্যাসিক আকবর হোসেন জীবন বাজি রেখে চরম দাঙ্গার ভেতর নাটকীয়ভাবে উদ্ধার করেছিলেন অবাঞ্ছিতর পাণ্ডুলিপি। ‘অবাঞ্ছিত’র পাণ্ডুলিপি কলকাতা থেকে উদ্ধার করা সম্ভব হলেও দেশ ভাগ হওয়ার পর তিনি ঢাকায় ‘দিলরুবা’ নামক একটি মাসিক পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে ছাপাবার জন্যে পাণ্ডুলিপিটি পত্রিকার সম্পাদককে দেন। কিন্তু দীর্ঘ এক বছরে একটা বাক্যও ছাপার অক্ষরে বের হয় নি। তারপর একদিন ‘দিলরুবা’ পত্রিকার প্রকাশ বন্ধ হয়ে যায়। তিনি বেশ কয়েকদিন উক্ত পত্রিকা অফিসে গিয়ে তালাবদ্ধ দেখে ফিরে আসেন। তারপর একদিন সহ-সম্পাদকের কাছে জানতে পারেন: ‘ও (দিলরুবা) পত্রিকা আর বের হবে না। তালাবদ্ধ ঘরেও কোনো কাগজপত্র নেই। সবকিছু ফেলে দেওয়া হয়েছে পাশের ডাস্টবিনে।’ এটি শোনার সাথে সাথে তিনি হতাশায় মুষড়ে পড়েন। তারপর তিনি নিজেই ডাস্টবিনের ময়লা কাগজ-পত্রের মধ্যে পাণ্ডুলিপিটি খুঁজতে শুরু করেন এবং ভাগ্যক্রমে এক পর্যায়ে পেয়েও যান।
১৯৫০ সালের জানুয়ারি মাস। কলকাতার সিটি কলেজের এক হিন্দু প্রফেসর এসেছিলেন ঢাকার ওয়ারীতে শ্বশুরালয়ে; তিনি তার শ্যালকের কাছ থেকে পাণ্ডুলিপিটি পড়ে দারুণভাবে মুগ্ধ হন এবং এটি কেনার জন্যে ভদ্রলোক প্রস্তাব দিলে লেখক কোনো কিছু চিন্তা না করে বলেন : ‘হ্যাঁ বেচতে পারি, সাড়ে তিন হাজার টাকা পেলে।’ ভদ্রলোক চার পাঁচদিন ধরে দর কষাকষি করলেন। প্রথমে দেড় হাজার, তারপর দু’হাজার, আড়াই হাজার এবং অবশেষে তিন হাজারে রাজি হয়েছিলেন।
এত টাকায় দীর্ঘদিনের অবহেলিত পাণ্ডুলিপি বিক্রি হবে এবং কয়েক ঘণ্টার মাঝে একটা ‘সামান্য খাতা’র পরিবর্তে এতগুলো টাকা পাবেন ভেবে বিস্ময়ে আনন্দে লেখক অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন। লেখক ভদ্রলোকের জন্যে প্লেটভর্তি করে দিয়েছিলেন মিষ্টি আর একসঙ্গে এক কেটলি চা। গোপীবাগের বাসায় সে ছিল এক আনন্দঘন মুহূর্ত। কিন্তু চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ভদ্রলোক যখন জানান লেখক হিসেবে গ্রন্থে তার (আকবর হোসেন)-এর নাম থাকবে না।
এ কথা শোনার পর ম্লান হয়ে যায় আকবর হোসেনের মুখের হাসি। তখন তিনি দৃঢ়কণ্ঠে বলেন ‘পাণ্ডুলিপি আর বিক্রি হবে না।’ ততক্ষণে ব্যাগ ভর্তি টাকা নিয়ে এসেছিল ভদ্রলোকের শ্যালক। আকবর হোসেনের সামনে সাড়ে তিন হাজার টাকার বান্ডিল তুলে ধরেন তিনি। কিন্তু আকবর হোসেন আর রাজি হননি। তিনি কিছুতেই ভাবতে পারছিলেন না নিজের বই ছাপা হবে অন্যের নামে। এ প্রসঙ্গে এম.এ. মোহাইমেন-এর বক্তব্য স্মরণযোগ্য: ‘তাঁর প্রথম বই অবাঞ্ছিত প্রকাশের পূর্বে অনেকেই প্রচুর অর্থের বিনিময়ে তাঁর বইটি তাদের নিজের নামে ছাপাবার অনুমতি চেয়েছিল। পরবর্তীকালেও জনপ্রিয় লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠার পর এইরূপ অনুরোধ অনেকবার পেয়েছিলেন। কিন্তু টাকার বিনিময়ে, তা যত বেশিই হোক, নিজের সৃষ্টিকে অন্যের নামে প্রকাশের প্রস্তাব তিনি বরাবরই ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। এসব প্রস্তাবকে টাকার বিনিময়ে সন্তান বিক্রির সমতুল্য বলে তিনি মনে করতেন।’
আকবর হোসেন এ ঘটনার পর নিজের সম্বন্ধে সচেতন হন, আত্মবিশ্বাস জন্মে তার নিজের লেখার প্রতি। তারপর সেই রাতেই পাণ্ডুলিপিটি তিনি আবার পড়েন এবং তারই সৃষ্ট নায়ক-নায়িকার হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখের সঙ্গে একাত্ম হয়ে স্থির সংকল্প হন যে, এ পাণ্ডুলিপিটি বই আকারে বের হলে নিশ্চয়ই পাঠকমন জয় করতে পারবে। তারপর তিনি বহু প্রেসে প্রকাশনা মালিকদের কাছে ধরনা দিয়ে প্রতিক্ষেত্রেই নিরাশ হয়েছেন। অবশেষে দেখা করেন পাইওনিয়ার প্রেসের মালিক এম.এ. মোহাইমেনের সঙ্গে। এ প্রসঙ্গে এম.এ. মোহাইমেন বলেন:
‘ভদ্রলোকের মুখের অবস্থা ও হতাশাপূর্ণ কণ্ঠস্বর শুনে আমার মায়া হলো। পাণ্ডুলিপিটি নিয়ে নাড়াচাড়া করে দেখলাম। বইয়ের নাম অবাঞ্ছিত। দু’চার পাতা পড়লাম, পড়ে আমার মনে হলো ছাপলে বইটি চলবে। তখন ভদ্রলোককে বললাম, দেখুন বইটি ১২৫০ কপি ছাপতে প্রায় ১৩০০.০০ (তেরশত) টাকার মতো কাগজ লাগবে। আপনি কাগজের টাকাটা দিতে পারবেন কিনা বলুন। কাগজের টাকাটা দিতে পারলে আমি ছাপা ও বাঁধাই খরচ সব বাকিতে করে দিব। আপনি বই বিক্রি করে দেনা শোধ করে দেবেন। শুনে ভদ্রলোক খানিকটা ভেবে বললেন, তেরশত টাকা আমি কোনো প্রকারে যোগাড় করতে পারবো, কিন্তু কভারের কাগজ, ব্লক ইত্যাদির জন্য কিছুই দিতে পারবো না। আমি বললাম তথাস্তু। আপনি কাগজের টাকা যোগাড় করতে থাকেন বই ছাপার দায়িত্ব নিচ্ছি।’
আকবর হোসেনের এই তেরশত টাকা যোগাড় করতে তাকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছিল। কুষ্টিয়ার কয়া গ্রামের নিজের বসতবাড়ি বিক্রির প্রতিশ্রুতি দিয়ে তারই জ্ঞাতিভ্রাতা লুৎফর রহমানের নিকট থেকে টাকা গ্রহণ করেছিলেন। লুৎফর রহমান তখন আকবর হোসেনের বাড়িতেই বসবাস করতেন। পরবর্তী সময়ে লেখক এ বাড়িটি লুৎফর রহমানের নিকট সম্পূর্ণভাবেই বিক্রি করেন। বাড়ি বিক্রির টাকায় তার সুবিখ্যাত উপন্যাস অবাঞ্ছিত ছাপার অক্ষরে বের হয় ১৯৫০ সালে।
পাইওনিয়ার প্রেস থেকে তখন সবুজ, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম ও ফজলে লোহানী অগত্যা মাসিক পত্রিকা বের করতেন। তারা তিনজন পাইওনিয়ার প্রেসে অবাঞ্ছিতর ছাপা ফর্মা পড়েই মুগ্ধ হয়ে ক্ষুদ্র অথচ উৎসাহব্যঞ্জক আলোচনা লিখে অগত্যায় ছাপেন।
০৩.
আকবর হোসেনের প্রথম উপন্যাস ‘অবাঞ্ছিত’ (১৯৫০)। কাহিনির সারাৎসারে জানা যায়, জমিদার পুত্র ফিরোজ ও গোমস্তা ওসমানের নাতনি রোকেয়ার মধ্যে প্রণয় জন্মে। উভয় উভয়কে মনে প্রাণে গ্রহণ করে, সম্পর্কের গভীরতা শারীরিক সম্পর্কে গড়ায়। কিন্তু পিতা-মাতার কারণে ফিরোজ রোকেয়াকে বিয়ে না করে, জমিদার কন্যা রেখাকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়। কিন্তু এদিকে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে রোকেয়া। বিষবৃক্ষের ফলস্বরূপ অবাঞ্ছিত শিশুর আগমন সম্ভাবনা দেখে দুশ্চিন্তায় কাতর হয়ে পড়ে বৃদ্ধ গোমস্তা। মান-সম্মানের ভয়ে রাতের অন্ধকারে গোমস্তা সপরিবারে আজমীরে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। ফিরোজের সংসারে নিজের দাবি প্রতিষ্ঠার জন্যে রোকেয়া এক রকম সাহসী ভূমিকা নিলেও ফিরোজের নিরবতার কারণে শেষ অবধি ব্যর্থ হয়ে দাদু ওসমানের সঙ্গে আজমীরে চলে যায়। সেখানে গিয়ে প্রসব করে এক পুত্র সন্তান; মহব্বত। রোকেয়ার জীবনে ক্ষ্যাপা ঝড়ের মতো আবির্ভাব ঘটে আমীরের। স্বভাবে সে মাতাল। নষ্টা নারীদের সাথে তার সখ্য। রোকেয়া আমীরকে ছোট ভাইয়ের মতো স্নেহ সুলভ দৃষ্টিতে দেখলেও আমীর রোকেয়াকে চেয়েছে প্রণয়িনী হিসেবে। চেয়েছে রোকেয়াকে বিয়ে করে সংসার বাঁধতে। আমীরের এ প্রস্তাবে সে রাজি হয়নি। নিজেকে সে পরিচয় দিয়েছে বিবাহিতা বলে। তার শরীরে পড়ে আমীরের হিংস্র থাবা। আমীর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে উদগ্র কামনায় রোকেয়ার সুঠাম দেহ ভোগ করার জন্যে। তার বাধার পরও সে জোরপূর্বক তাকে আঁকড়ে ধরে চুমু খেয়ে মুখে রক্তদাগ করে দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি। ক্ষুধার্ত মার্জারের ন্যায় তাকে কামড় দিয়ে হরণ করতে চেয়েছে তার নারীত্ব। তার সমস্ত শরীরে ঝুঁকে পড়ে সে, কিন্তু রোকেয়ার মরণপণ বাধার কাছে সে ব্যর্থ হয়। ক্রোধে ফেটে পড়ে আরো নির্লজ্জভাবে শেষ বারের মতো চেষ্টা করেছে রোকেয়ার দেহ ভোগ করার জন্য। এরপর সে ব্যর্থ হয়ে রাগে-ক্ষোভে ঘর ত্যাগ করে দূর শহরে চলে যায়। আমীর ভালোবেসে রোকেয়াকে আয়ত্ত করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত জোরপূর্বক তাকে পেতে চেয়েছিল সেক্ষেত্রেও সে যখন ব্যর্থ হলো তখনই সে জীবনের মোড় ঘুরিয়ে নিতে চেষ্টা করল অন্যদিকে। বৃদ্ধ দাদু ওসমানের মৃত্যুর পর রোকেয়া একান্তভাবে অসহায় হয়ে পড়ে। একদিকে ফিরোজের কথা ভাবতে থাকে। আর এক দিকে তার দেহ ভোগ করার জন্যে আমীর এতদিন যে হিংস্রপণা করেছে তার কাছে এসব স্বাভাবিক বলে মনে হতে থাকে। নিষ্পাপ বলে ভাবতে থাকে তাকে। নিজের দেহমন আর ফিরোজকে নিয়ে অনেক সময় ভাবার পর মানসিকভাবে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে শেষ পর্যন্ত আমীরের কাছে নিজেকে সমর্পণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
নিজেকে অভিনব সাজে সজ্জিত করে রাতের অন্ধকারে হিংস্র দানবের নখের থাবা উপেক্ষা করে ছুটে আসে খুব সাবধানে ফিরোজের শয়নকক্ষের পাশে। কিন্তু ফিরোজ-রেখার প্রেমালাপে সে আহত হয়ে ফিরে এসে রাতের আঁধারে দাদুর সাথে আজমীরে চলে যায়।
শিশুসন্তানকে শুয়ে রেখে রাতের অন্ধকারে সে আমীরের ঘরে আসার জন্য মনস্থির করে। তার ঘরের দরজার কাছে এসে দরোজা খোলার জন্য কয়েকবার ডাক দেওয়ার পর হঠাৎ সে সংবিৎ ফিরে পায়। তারপর কৌশলে আমীরের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করে নিজের ঘরে ফিরে আসে। আমীর অনেক আগেই রোকেয়ার সন্তানের খবর জানিয়ে ছবিসহ চিঠি লিখেছিল ফিরোজকে। কিন্তু সে ছবি ও চিঠি ফিরোজের হাতে না পড়ে জমিদারের হাতে পড়ে। ফিরোজকে পড়তে বললে সে কৌশলে এ চিঠিকে বন্ধুর পুত্র সন্তানের খবর ও ছবিকে বন্ধুপুত্রের ছবি বলে জানিয়ে দেয়। কিন্তু এ চিঠির রহস্য এবং ছবিটি যে তারই ঔরসজাত সন্তানের তা রেখার চোখকে ফাঁকি দিতে পারে না। তাই বৃদ্ধ জমিদার আজমীরে এ সন্তানটিকে আশীর্বাদ করতে আসতে চাইলে ফিরোজ ও রেখার পক্ষ থেকে বাধা ছিল প্রচুর। তবু শেষ পর্যন্ত পুত্র ও পুত্রবধূর বাধাকে উপেক্ষা করে আজমীরে আসেন। সেখানে এক হোটেলের সামনে তিনি মহব্বতকে দেখতে পান। মহব্বত আমীরের সঙ্গে খেলা দেখতে এসেছিল। আমীর জমিদারকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যায়। সেখানে দেখা হয় রোকেয়ার সঙ্গে। জমিদারের কাছে সমস্ত রহস্য পরিষ্কার হয়ে যায় দিবালোকের মতো। পাগলিনীপ্রায় রোকেয়ার হিংস্র মূর্তিতে জমিদার স্তম্ভিত হয়ে যান। সঙ্গে নিজেকে মনে করেন অপমানিত। এ অপমানের প্রতিশোধ ও রোকেয়াকে শাস্তিস্বরূপ কৌশলে তিনি চুরি করে নিয়ে যান মহব্বতকে। মহব্বতকে হারিয়ে নিঃস্ব রোকেয়া অনেকদিন খোঁজাখুঁজি করে নিরাশ হওয়ার পর জমিদারের চিঠি পেয়ে তার সন্তানের খবর জানতে পারে। কিন্তু অভিমানিনী রোকেয়া নিজের প্রতিষ্ঠা দাবি কিংবা সন্তানকে দেখার উসিলায় ছুটে যায়নি ফিরোজের সংসারে। একদিন নীরবে আমীরের খোঁজে পাটনার পথে পা বাড়ায়। জীবনের প্রয়োজনে সে হয়েছে ‘মতি ভিখারি’। তারপর বাঁকীপুর স্কুলের শিক্ষয়িত্রী। এক আকস্মিক ঘটনার ভেতর দিয়ে সাক্ষাৎ হয় আমজাদ মাস্টার রূপী আমীরের সাথে। আমীরের আদর্শে মুগ্ধ হয়ে স্বেচ্ছায় নিজেকে বিলিয়ে দিতে চায় তার কাছে। কিন্তু আমীর তাকে গ্রহণ করে বোনের মতো। বোনের মর্যাদায় হৃদয়ে তার আসন হয় স্থায়ী।
বাঁকীপুরে নতুন জমিদার মহব্বত এলে ভিখারির সারিতে দাঁড়িয়ে রোকেয়া দেখার চেষ্টা করেছে পুত্র মহব্বতকে। মহব্বতের দু’পাশে ফিরোজ ও রেখা। পুত্রকে দেখা মাত্র অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায় রোকেয়া। তাকে আমীরসহ স্বেচ্ছাসেবকের দল সেখান থেকে নিয়ে গেলে মহব্বতের মনে অনেক প্রশ্নের সঞ্চার হয়। অসুস্থ রোকেয়া মহব্বতকে একদণ্ড প্রাণভরে দেখার আকুল আবেদন জানালে মহব্বত তার পাশে এলেও সে কিছুতেই নিজের পরিচয় দেয়নি। আমীর অসুস্থ রোকেয়ার পাশে অধিকাংশ সময় কাটালে স্কুলের সেক্রেটারি তাদের নামে মিথ্যে কুৎসা রটনা করলে, সবার হৃদয়ে মাতৃসম রোকেয়া আমীরের সাথে রাতের অন্ধকারে কলকাতার উপকূলে হাজির হয়। সেখানে একভদ্র পরিবারে আশ্রয় নেয়। এ বাড়িটির সামনে হঠাৎ এক বৃদ্ধ দুর্ঘটনা কবলিত হয়। রোকেয়ার চোখে পড়তেই সে তার সেবার দায়িত্বে তৎপর হয়ে ওঠে। বৃদ্ধ একটু সুস্থ হয়ে বাড়িতে চিঠি লিখলে ফিরোজ, রেখা ও মহব্বতসহ অন্যেরা দ্রুত চলে আসে। জমিদার আর্দ্রকণ্ঠে পরিচয় করিয়ে দেয় রোকেয়াকে সবার সাথে। কিন্তু জমিদার নিজেও বুঝতে পারেনি এই মহিলাই মহব্বতের মা রোকেয়া। রোকেয়া আর সহ্য করতে না পেরে দ্রুত ছুটে বের হতেই দরজার সঙ্গে আঘাত খেয়ে জ্ঞানহীন হয়ে পড়ে যায়। আমীরের কণ্ঠে ‘রোকেয়া’ শব্দ শুনে মহব্বত মা বলে কেঁদে ওঠে। রোকেয়াকে স্ত্রী হিসেবে ঘরে তোলার জন্য বৃদ্ধ জমিদার অনুরোধ করেন পুত্র ফিরোজকে। ক্ষমাপ্রার্থী হন তিনি নিজে। আমীর সজল চোখে রোকেয়াকে নিষ্পাপ বলে ফিরোজের হাতে তুলে দেয়। তারপর তাকে আশীর্বাদ করে দ্রুত বের হতে উদ্যত হলে রোকেয়া তার হাত চেপে ধরে। কিন্তু বলতে পারে না কিছুই, শুধু তার শীর্ণ ঠোঁট দু’খানা তির তির করে কেঁপে ওঠে। তাতে বেজে ওঠে হৃদয় ছেঁড়া এক বেদনা। আলো আঁধারের অমূল্য সন্ধিক্ষণে আমীর অশ্রুসিক্ত চোখে সবার কাছে থেকে বিদায় নিয়ে নিঃশব্দে অন্তর্হিত হয়ে গেল এক নতুন পৃথিবী গড়ার স্বপ্নে। বিচ্ছেদবেদনার বিরাট ক্ষত রেখে গেল শীর্ণ রোগ পাণ্ডুর রোকেয়ার হৃৎপিণ্ডের গোপন এক কোণে। সে ব্যথা কেউ বোঝে না। বোঝা যায় না। শুধু ব্যর্থ বিদগ্ধ হৃদয় নিঃশেষ হয় তিলে তিলে মরমের মাঝে। আর সামাজিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হয় অবৈধ যৌন সুখের ফসল স্বরূপ অবাঞ্ছিত সন্তান মহব্বত।
উপন্যাসের কাহিনি গ্রন্থনে সবলতা ও দুর্বলতা উভয়ই রয়েছে। ফিরোজ রোকেয়ার পরিবর্তে জমিদার কন্যা রেখাকে বিয়ে করেছিল। যে চরিত্রটি যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে উপন্যাসের শুরুতে লক্ষ করা গেলো। অথচ উপন্যাসের আর কোথাও তার উপস্থিতি বা পরিণতি ঘটলো না। অসমাপ্ত চরিত্র এটি। যা উপন্যাসের সফলতার ক্ষেত্রে অনেকটা বাধা স্বরূপ। যে রোকেয়াকে বিয়ে না করে বিয়ে করল রেখাকে; আর সেই রোকেয়াকে অন্তঃসত্ত্বা করে ঠেলে দিলো দুঃসহ জীবন যন্ত্রণার দিকে, আবার সেই রোকেয়া যখন দাদুর সঙ্গে আজমীরে চিরদিনের জন্য চলে গেলো। এই চলে যাওয়ার সংবাদ শুনে ফিরোজের ঘোড়া থেকে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাওয়া হাস্যকর বলে মনে হয়। ফিরোজ রেখার সঙ্গে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পর থেকে ভুল করেও রোকেয়ার ভালোবাসার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বা আন্তরিকতা দেখায়নি। সুতরাং ফিরোজের ঘোড়া থেকে পড়ে যাওয়া অবাস্তব বলে মনে হয়। আবার রোকেয়া আজমীরে চলে যাওয়ার আগে ফিরোজের সংসারে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য রাতের অন্ধকারে দীর্ঘপথ পেরিয়ে দারোয়ান পাহারারত বিশাল বাড়িতে ফিরোজের শয়নকক্ষের পাশে একা এসে দাঁড়ালো অতি নাটকীয় বলে ভাবতে আমাদের কষ্ট হয় না। নারীলোভী আমীর যে রোকেয়ার দেহ ভোগের নেশায় উদগ্র কামনায় অস্থির। কামনার বহ্নিজ্বালায় যে তাকে কয়েকবার আঁকড়ে ধরে ভয়ঙ্কর শোষণ চুম্বন পর্যন্ত করেছে সেই আমীর যখন তার মন জয় করার আশায় বাবার বাক্স ভেঙে এক গাদা টাকা চুরি করে এবং মদ গিলে আসে আর সেই সাথে অস্থির হয়ে ওঠে দেহ ভোগের নেশায় তারপর সে অসাড়ভাবে পড়ে থাকলে রোকেয়া তাকে খাটের ওপর শুইয়ে দিয়ে নিজে খোকনকে বুকে জড়িয়ে মেঝেতে রাতের অন্ধকারে শুয়ে থাকে নিশ্চিন্তে, ফলে নিশি রাতে নেশার চুর কেটে গেলে সে ক্ষুধার্ত মার্জারের ন্যায় ঝুঁকে পড়ে তার ওপর এবং রোকেয়ার বাধার মুখে সে ব্যর্থ হয়। এ সবই অস্বাভাবিক ঘটনা। আবার বাঁকীপুর থেকে রোকেয়া এবং আমীরকে ঘিরে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে চরিত্রগত যে কুৎসা রটনা হয় যার ফলে রাতের অন্ধকারে দুজনকে সেই স্থান ত্যাগ করে কলকাতার উপকণ্ঠে চলে আসতে হয়, এই চলে আসার সময় নিজ সন্তান এবং স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্যে তার ভেতর বিন্দুমাত্র মানসিক প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায়নি। আবার সেই কুৎসা যে মিথ্যা; যা তাদের গোপনে পালিয়ে চলে আসার কারণে বাস্তবে বা সত্যে পরিণত হয়েছে বলে ধারণা করা যায়। এ ঘটনা ফিরোজ নিজেও সে মুহূর্তে জেনেছে।
অথচ কলকাতার উপকণ্ঠে জমিদারের পরিবার অর্থাৎ ফিরোজের সাথে যখন রোকেয়ার দেখা হয় তখন তাদের কারো মধ্যেই এর প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায়নি। এসব বিষয়ে লেখক আর একটু সচেতন হলে এ কাহিনি আরো গাঢ় ও মজবুত হয়ে উঠতো নিঃসন্দেহে। অবাঞ্ছিত একটি সন্তানকে ঘিরে তিনি যে কাহিনি দাঁড় করিয়েছেন তাতে অবিশ্বাস্য কিছু ঘটনা থাকলেও আধুনিক মনোবৃত্তি ও ভাষার স্বচ্ছতা এবং দৃঢ়তায় তা বিশ্বাসযোগ্য করে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। সবচেয়ে বড় কথা, ফিরোজ এবং আমীরকে ঘিরে ব্যক্তি জীবনের প্রয়োজনে প্রেমকে কেন্দ্র করে রোকেয়ার যে মানসিক অন্তর্দ্বন্দ্ব ফুটে উঠেছে তা নিঃসন্দেহে সার্থকতার দাবিদার।
অবাঞ্ছিত একটি সন্তানকে কেন্দ্র করেই অবাঞ্ছিত গ্রন্থের কাহিনি বিবৃত। কুমারী জীবনে সন্তানের জন্মদান। সে সন্তান নিঃসন্দেহে সামাজিক বিধি মোতাবেক অবাঞ্ছিত। এই অবাঞ্ছিত সন্তানটিকে ঘিরেই জমিদার পরিবার থেকে শুরু করে উপন্যাসে বর্ণিত সমস্ত চরিত্রই প্রায় সম্পর্কযুক্ত। উপন্যাসের প্রায় প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত অবাঞ্ছিত এই সন্তানটির কাহিনিই বর্ণিত হয়েছে। এমনকি রোকেয়া যখন রাতের অন্ধকারে আমীরের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে তার দরোজার কাছে গিয়ে তাকে ডেকেছে; এই যাওয়ার সময়ও রোকেয়া মানসিকভাবে মহব্বত থেকে দূরে থাকতে পারেনি। আবার আমীরের দরোজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে তার মধ্যে যে পরিবর্তন সেক্ষেত্রেও অবাঞ্ছিত সন্তান মহব্বতের মুখই তাকে নিজের আয়ত্তে ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করেছিল, ফিরোজের প্রেম এবং নিজের বিবেক সেখানে নীরব, অর্থহীন, কোনো কাজ করেনি। আবার আমীরের উদ্দেশে রোকেয়া যে পাটনার পথে পা বাড়ায়, সেও মহব্বতেরই কারণে। মহব্বতকে হারিয়ে একমাত্র অবলম্বন হিসেবে সে আমীরকে পাওয়ার আশায় পাটনার দিকে পা বাড়িয়েছিল। মহব্বতকে না হারালে সে কখনো আমীরের কাছে যে আত্মসমর্পণ করতো না ভালোবাসার নামে, সে কথা আমরা জোর করে বলতে পারি। আবার জমিদার এবং জমিদারপুত্রবধূ রেখার মধ্যে যে উত্তেজনাপূর্ণ ব্যবহার; সে সবেরও মূল কারণ অবাঞ্ছিত সন্তানটি।
সুতরাং এই উপন্যাসের যে কাহিনি তা অবাঞ্ছিত সন্তানটিকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে। ‘অবাঞ্ছিত’ উপন্যাসে অবাঞ্ছিত সন্তানটিকে বাদ দিয়ে এর কাহিনি কল্পনাও করা যায় না। উপন্যাসের নামকরণ অবাঞ্ছিত সার্থক ও সুন্দর হয়েছে। প্রশ্ন উঠতে পারে, অবাঞ্ছিত সন্তানটির নাম যেহেতু মহব্বত; সেহেতু উপন্যাসের নাম ‘মহব্বত’ হতে পারত। উপন্যাসের নামকরণ সাধারণত দু’টি উপায়ে হয়। একটি হলো উপন্যাসের অর্থের ওপর নির্ভর করে, অপরটি প্রধানকে চরিত্র কেন্দ্র করে। এ ক্ষেত্রে উপন্যাসটির অর্থগত দিকের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। অর্থের ওপর লক্ষ রেখেই উপন্যাসটির নামকরণ করা হয়েছে। সমাজে নর-নারী অবৈধ যৌন সুখে লিপ্ত হয়ে যে সব অবাঞ্ছিত সন্তানের জন্ম দেয়, তার ফলে নারী হয় সমাজে কলঙ্কিত নিগৃহীত আর ঘৃণা অস্পর্শ এক বস্তুতে পরিণত হয় অবাঞ্ছিত নবজাতক। অথচ এই সন্তানের জন্মদাতা পুরুষ এই সমাজে কোনো কলঙ্কিত হয় না, ভদ্র সভ্য মানুষ হিসেবেই তার স্থান থেকে যায় এ সমাজে। ঔপন্যাসিক আকবর হোসেন সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং ধর্মীয় আবহে যুক্তি তর্কের মাধ্যমে অবাঞ্ছিত সন্তান মহব্বতের মাধ্যমে সমস্ত অবাঞ্ছিত সন্তানদের সামাজিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার দাবি জানিয়েছেন। সুতরাং সেদিক থেকে অর্থগতভাবে এ গ্রন্থের নাম অবাঞ্ছিত সার্থক ও যথার্থ হয়েছে।
চরিত্র চিত্রণের ক্ষেত্রেও আকবর হোসেন মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। এ উপন্যাসে কেন্দ্রীয় চরিত্র রোকেয়া। লেখক রোকেয়া চরিত্র সৃষ্টির ক্ষেত্রে যতটা যত্নশীল এ উপন্যাসে আর কোনো চরিত্রে তা লক্ষ করা যায় না। লেখকের যত আয়োজন তা সবই যেন রোকেয়ার জন্যে। জমিদারের গোমস্তা ওসমানের নাতনি রোকেয়া। জমিদারপুত্র ফিরোজের সাথে তার গভীর প্রণয়ের সৃষ্টি হয়। রোকেয়া ছিল অসাধারণ সুন্দরী। লেখকের ভাষায় : ‘সদ্য স্নাতা প্রসাধন ভূষিতা রোকেয়া বেহেস্তি হুরীর মতো এ পৃথিবীতে যেন আবিভর্‚তা। শান্ত, অচঞ্চলতার চাহনী, অনিন্দ্য সুন্দর নিটোল দেহ লতা। রাঙা আপেলের মতো সুডোল মসৃণ দু’টি সতেজ গণ্ড তার, আর তারই উপরিভাগে অদ্ভুত স্বপ্নমাখা দু’টি চোখ।’
অসাধারণ রূপ যৌবনের অধিকারিণী রোকেয়া ফিরোজকে মনে প্রাণে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করে হারিয়ে ফেলেছিল শারীরিক পবিত্রতা। পিতার আভিজাত্যের অহংকার আর মায়ের অশ্রুসজল অনুরোধের কাছে দুর্বল হয়ে রেখাকে বিয়ে করে বিশ্বাসঘাতকতা করে অন্তঃসত্ত্বা রোকেয়ার সাথে। দেহের পবিত্রতা নষ্ট হবার যন্ত্রণা কুরে কুরে খায় তাকে। ফিরোজকে তাই রোকেয়া বলেছে : ‘কিন্তু জীবনভর অশান্তি ভোগ করবো আমি তোমায় দেহ দিয়েছি বলে। মনকে চাবকে সোজা করে নেবো কিন্তু দেহকে ত আর পারবো না। এতদিনের কুৎসিত দৈহিক বিলাসিতা চিরকাল ধরে মনের পাশে আঘাত হানবে।’ দাদু দুশ্চিন্তায় মুষড়ে পড়ে রোকেয়া অন্তঃসত্ত্বা হওয়ায়। দাদুর সিদ্ধান্তে তাকে চিরদিনের মতো জন্মভ‚মি ত্যাগ করে আজমীরে স্থায়ী বসবাসের জন্য চলে আসার জন্য রাজি হতে হয়। কিন্তু রোকেয়া মনে মনে প্রস্তুত হয় ফিরোজের সংসারে প্রতিষ্ঠিত হতে। কারণ তার গর্ভে তখন ফিরোজের ঔরসজাত সন্তান। নিজেকে অভিনব সাজে সজ্জিত করে রাতের অন্ধকারে হিংস্র দানবের নখের থাবা উপেক্ষা করে ছুটে আসে খুব সাবধানে ফিরোজের শয়নকক্ষের পাশে। কিন্তু ফিরোজ-রেখার প্রেমালাপে সে আহত হয়ে ফিরে এসে রাতের আঁধারে দাদুর সাথে আজমীরে চলে যায়। ক্ষোভে-লজ্জায়-ঘৃণায় আত্মহত্যার কথা ভাবলেও প্রবাসের স্বাভাবিক সহজ পরিবেশ ও পরিস্থিতি তাকে বাঁচার সাহস যোগায়।
নিজে এখানে পরিচিত হয় বিবাহিত এবং স্বামী বঞ্চিত হিসেবে। এখানে জন্ম নেয় তার এক পুত্র সন্তান; মহব্বত। রোকেয়ার জীবনে আসে ক্ষ্যাপা ঝড়ের মতো যৌন কামনা যন্ত্রণাগ্রস্ত আমীর। আমীরের প্রতি তার স্নেহ সুলভ ভালোবাসা থাকলেও সে ভালোবাসাকে উপেক্ষা করে রোকেয়াকে একান্তভাবে পেতে চেয়েছে কামাগ্নি বাহুতলে। রোকেয়া নিজেও বুঝতে পারে ‘আমীর তার কাছে কী চায়’। আমীর তার মন জয়ের লক্ষ্যে পিতার বাক্স ভেঙে একগাদা টাকা চুরি করে এনে মদ গিলে গভীর রাতে রোকেয়ার কাছে আসে। রাতের গভীরতা লক্ষ করে মান সম্মানের ভয়ে ঘরের দরজা খুলে দিলে সে অসাড় হয়ে এক সময় পড়ে থাকে। তখন সে তাকে খাটের ওপর শুইয়ে দিয়ে নিজে মেঝেতে শুয়ে পড়ে। অনেক রাতে আমীরের ঘুম ভেঙে মদের নেশা ছুটে যায়।
বিষ খেয়ে চোখ বুজে সাধু সাজলেই কি বিষের ক্রিয়া বন্ধ হয়? মৃত্যুকে এগিয়ে আনবেই। এতদিনে তুমি হয়ত ছেলের বাপ হয়েছ।
দরোজা বন্ধ ঘরে রোকেয়াকে ঘুমন্ত দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং উগ্র কামনায় ঝুঁকে পড়ে তার দেহের ওপর। রোকেয়া প্রবলভাবে বাধা দেয়। অনুরোধ করে সংশোধনের জন্যে। সরলতার সুযোগ নিয়ে বিদায়ের মুহূর্তেও সে জোরপূর্বক তাকে আঁকড়ে ধরে ভয়ঙ্কর শোষণ চুম্বন করেছে। ফলে তার মুখে রক্তদাগ জমে গেছে। আয়নায় মুখে সেই রক্তদাগ দেখে কান্নায় উপচে উঠেছে তার বুক। দুঃখে বুকে জড়িয়ে নিয়েছে খোকাকে। অথচ সে মাতাল এবং বেশ্যাসক্ত আমীরকে বোঝাতে চেয়েছিল ‘নারীর দেহ গলিত শবের ন্যায় দুর্গন্ধময় বিষাক্ত।’ কিন্তু কোনো লাভ হয়নি তাতে। তার সে কথাতে আমীরের মনে কোনো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেনি। বরং তার অসাধারণ দেহ সৌন্দর্য ভোগ করতে না পেরে সে বহুদূর চলে যায় এ সংসার এ শহর ত্যাগ করে।
দাদু ওসমানেরমৃত্যুর পর অসহায় রোকেয়া অবলম্বনহীন হয়ে পড়ে। বাস্তবতার মুখোমুখি নিয়ে দু’হাতে আঁকড়ে ধরে চায় আমীরকে। আমীরের কথা মনে পড়ে। সে বুঝতে পারে ফিরাজ তার জীবনে আর আসবে না। রূপ-যৌবনও ভাটা পড়ে যাবে। বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন মনে করে আমীরকে। বহুরাত অবধি ঘুম আসে না দু’চোখে। যৌন কামনা চরিতার্থ করতে আমীর তার ওপর যে সব নগ্ন অত্যাচার চালিয়েছে এতদিন, সে জন্য আর তাকে রোকেয়া দোষী মনে করে না; মনে করে না চরিত্রহীন। ওর সব দোষ ছেড়ে দেয় নিজের রূপ-যৌবনের ওপর। রোকেয়ার ভাবনা : ‘আমার প্রতি এত তীব্র ওর কামনা। এত উন্মাদ ও। কিন্তু ও কি এর জন্যে দায়ী? আমার রূপ যৌবন যদি ওর মনে দাগ কেটেই থাকে, তবে ওর দোষ কোথায়।’
তারপর সে খোকাকে বেদনার্ত কণ্ঠে বলে: ‘খোকন, তোমার মাকে ক্ষমা করো বাপ। আমি যে আর সইতে পারি না।’ এরপর বের করে ফিরোজের ছবি। ছবির দিকে তাকিয়ে ফিরোজকে উদ্দেশ করে বেদনা বিগলিত কণ্ঠে বলেছে : ‘তোমার পথ চেয়ে জীবনের অমূল্য সময় কাটিয়েছি, তবু তুমি এলে না। আজ নিজেকে বড় অসহায় ভাবছি, বড় দুর্বল বোধ করছি। আজ আমায় মুক্তি দাও, তোমার জীবন থেকে সরে যেতে দাও।’ অথচ এই রোকেয়াই আজমীর থেকে ফিরোজকে একদিন লিখেছিল : ‘আমি শুকিয়ে ঝরে যাবো, কিন্তু ভুলেও দ্বিচারিণী হবো না কোনোদিন।’ শেষ পর্যন্ত সব চিন্তার অবসান ঘটিয়ে যৌন কামনায় উন্মত্ত হয়ে উন্মাদিনীর মতো রাতের আঁধারে আমীরের ঘরের পাশে ছুটে এসে ভীরু মাদকতায় তাকে ডাকতে থাকে। আমীর দরোজা খুলতেই তাকে দেখা মাত্রই তার অন্ধমোহ দূর হয়ে যায়, স্বাভাবিকভাবে ঘরে ফিরে আসার চেষ্টা করে। ঘরে ফিরে খোকনকে বুকে জড়িয়ে নিজের দুর্বলতা দূর করার জন্য প্রার্থনা করে খোদার কাছে। রোকেয়া চরিত্রে ক্ষোভ লক্ষ করা যায়। হামিদ সাহেবের বাড়িতে জমিদার মহব্বতের গায়ে নিজ হাতে পোশাক পরিয়ে দিলে খোকার গা থেকে সে পোশাক খুলে দিয়ে জমিদারকে অপমানসূচক কথা বলতে দ্বিধাবোধ করেনি। আর সেই অপমানের প্রতিশোধ স্বরূপ জমিদার সহব্বতকে চুরি করে নিয়ে গিয়ে রোকেয়াকে এক সময় চিঠিতে জানায় এবং তার জীবিকা নির্বাহের জন্য তিনি একটা মাসোহারা নির্ধারণ করলে সে ঘৃণাসহকারে প্রত্যাখ্যান করে নিরুপায় হয়ে আমীরের সন্ধানে পাটনার উদ্দেশে রওনা দেয়। তবু ফিরোজের সংসারে ফিরে যায়নি নিজের আত্মসম্মানবোধ নষ্ট করে। পাটনায় যাবার পথে ক্ষুধার যন্ত্রণায় ভিক্ষাবৃত্তি থেকে শুরু করে বাড়ির চাকরানী পর্যন্ত হতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত শমসেরের সহযোগিতায় বাঁকীপুর স্কুলের শিক্ষয়িত্রীর চাকরি পায়। বাঁকীপুরে আমজাদ মাস্টার ছদ্মবেশে আমীরকে আকস্মিকভাবে গভীর রাতে ঘরের ভেতর পেয়ে তার শিরা-ধমনিতে বয়ে যায় আনন্দ লহরী। ভুলে যায় ফিরোজের বিবেক বর্জিত প্রেম। মুগ্ধ হয় আমীরের আদর্শে।
আমীর যে দেশের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করতে পেরেছে এ গর্ব যেন আজ তার নিজেরই। তার ব্যক্তিত্বের কাছে পরাজিত হয়ে রোকেয়া বলে:
‘আজ যে তোমার ব্যক্তিত্বের কাছে আমারই সালাম জানাবার দিন, আমীর। সবকিছু তোমার কাছে বিলিয়ে দেবার চরম মুহূর্ত। একদিন তুমি আমার সব চেয়েছিলে, কিন্তু তোমার আমার সে দিন অতীতের গর্ভে ডুবে গেছে। দেহের কামনা উভয়ের মাঝে বিলুপ্ত হয়ে গেছে, এখন শুধু মনের আগুন জ্বলছে ধিক্ ধিক্ করে।’
পুলিশের কাছ থেকে যখন সে শুনেছে ইংরেজ পুলিশ অফিসারকে খুন করে ফাঁসির রজ্জু ঘাড়ে করে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। পুলিশ যখন রোকেয়াকে অনুরোধ করেছে আমীরকে ধরে দেবার জন্যে, লোভ দেখিয়েছে পুরস্কারের; তখন রোকেয়া আপন মনে ভেবেছে : ‘কিন্তু কাকে আমি ফাঁসির মঞ্চে তুলে দেবো? নিজের জীবন নিয়ে ফাঁসি হয়ে গেলাম যার কাছে, তারই অস্তিত্বকে’? কিন্তু তখন আমীর দেশপ্রেমে আত্ম উৎসর্গীকৃত এক প্রাণ হওয়ায় দৈহিক প্রেমের ঊর্ধ্বে উঠে গেছে। রোকেয়া আমীরকে বহুবার ‘জীবন সাথী’ ও ‘তুমি আমার’ বলে সম্বোধন করেছে। শেষ অবধি রোকেয়া এবং আমীরকে নিয়ে চরিত্রগত যে মিথ্যা কুৎসা রটনা হয় তখন মান-সম্মানের ভয়ে সকলের কাছে ‘মা’ বলে সম্বোধিত রোকেয়া আমীরের সাথে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে আসে কলকাতার উপক‚লে। সেখানে দু’জন এক সাথে বসবাস করার পরও তাদের দৈহিক পবিত্রতা নষ্ট হয়নি। কিন্তু আমীরকে যে সে জীবন সাথী হিসেবেই ভালোবেসেছিল যার প্রমাণ স্বরূপ আমরা বলতে পারি ফিরোজের সংসারে অধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় রোকেয়ার মধ্যে কোনো পরিবর্তন বা আনন্দ অনুভূতি লক্ষ করা যায়নি। বরং ফিরোজের সংসারে ফিরে যাওয়াই তার কাছে এক ধরনের বিব্রত বলে মনে হয়েছে। সে সময় আমীরের হাত আঁকড়ে ধরে অশ্রুসিক্ত চোখে সে যে তার ভালোবাসার শাশ্বত সত্যরূপ প্রকাশ করেছে তা সহজেই অনুমেয়।
বেদনায় কেঁপে উঠেছে তার শীর্ণ ঠোঁট দু’খানি। পরিশেষে আমরা লক্ষ করি রোকেয়া ফিরোজকে কাছে পেয়েও সে তার প্রতি কোনো আকর্ষণবোধ করেনি; প্রয়োজন মনে করেনি একান্ত পাশে ডাকার। ফিরোজ এবং মহব্বতের চেয়ে তার জীবনে বড় সত্য হয়ে উঠেছে আমীরের প্রেম। তখন আমীরই তার জীবনে একমাত্র সত্য। অবশ্য সে ক্ষেত্রেও রোকেয়া এক ব্যর্থ নারী। ফিরোজ গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হলেও এ চরিত্রটি কোনো বিকাশ লাভ করতে পারেনি। রোকেয়াকে অন্তঃসত্তা করে সে তাকে বিয়ে করেনি। পিতার সাথে সামান্য বাগ্বিতণ্ডা হলেও পিতার আভিজাত্যের অহমিকা এবং মায়ের চোখের পানির কাছে প্রেমকে দিয়েছে বলি। রোকেয়ার কাছে সে নিজেই অক্ষম অপারগ এবং বিশ্বাসঘাতক বলে আখ্যায়িত করেছে। আবার বাসর ঘরে নববধূ রেখাকে সম্বোধন করেছে ‘আজন্ম ছন্দময় সাথী’ বলে। সে রোকেয়াকে ভালোবেসে মনে প্রাণে গ্রহণ করে এবং দৈহিক সম্পর্ক পর্যন্ত গড়ে ওঠে, অথচ সেই ফিরোজ বাসরঘরে নিজের মনকে ‘ফাঁকা পৃষ্ঠা’ বলে উল্লেখ করে সেখানে আনন্দ লহরে রেখাপাত করার জন্য অনুরোধ করে রেখাকে। রেখাকে সে যখন বুকে টেনেছে তখন একটিবারও রোকেয়ার জন্য ক্ষত বিক্ষত হয়নি। অথচ কৌশলে রোকেয়ার গর্ভে তার ঔরসজাত সন্তানকে রক্ষা করার জন্য অনুরোধ করেছে ‘একদিন আবার মিলন হবেই আমাদের’। এ আশ্বাস প্রদান করে। অথচ সে কোনো অবস্থায়ই তার সন্ধান রাখেনি। রোকেয়ার চলে যাবার কথা শুনে সে যে ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়েছিল এ অতি নাটকীয় বলে মনে হয়। ফিরোজ প্রায়ক্ষেত্রেই মিথ্যে এবং ছল-চাতুরীর আশ্রয় নেবার চেষ্টা করেছে। মিথ্যে করে নিজেকে নিষ্পাপ করে দেখাতে চেষ্টার ত্রুটি করেনি কিন্তু প্রতিক্ষেত্রেই তার সে সব ছল-চাতুরী মিথ্যের আশ্রয় ধরা পড়েছে। যে রোকেয়া তার জন্য অনিশ্চিত ভয়াবহ অন্ধকার জীবনে সারাজীবন হোঁচট খেয়েছে তার জন্যে মুহূর্তের জন্য সে মানসিকভাবে ক্ষত-বিক্ষত হয়নি। রেখার দেহ পেয়েই সে যেন ভুলে গেছে তার সমস্ত অতীত। নিভে গেছে তার বুকের সমস্ত যন্ত্রণা। খুব স্বাভাবিকভাবে সে সংসারে থাকতে পেরেছে জমিদারীর সমস্ত দায়িত্ব পালনের ভেতরে। সন্তানের ক্ষেত্রে যে সামান্য দরদ পরিলক্ষিত হয় তাও এক প্রকার কৃত্রিম বলে মনে হয়। মিথ্যের আশ্রয়কারী ফিরোজ চরিত্রে কোনো বিকাশ লক্ষ করা যায় না। বরং এ চরিত্রের চেয়ে আমীর চরিত্র অনেক বেশি শক্তিশালী এবং সফল চরিত্রের দাবিদার।
বিষ খেয়ে চোখ বুজে সাধু সাজলেই কি বিষের ক্রিয়া বন্ধ হয়? মৃত্যুকে এগিয়ে আনবেই। এতদিনে তুমি হয়ত ছেলের বাপ হয়েছ।
আমীর ডা. হামিদের সন্তান। স্বভাবে মাতাল। বেশ্যাসক্ত। যৌন কামনায় অস্থির এক যুবক। ডা. হামিদের সংসারে আমীর এক দুষ্টক্ষত। আমীর সম্পর্কে ছোট বোন রানুর সতর্কবাণী : ‘সাবধান রুকু বুবু। আমীর ভাই আসছেন। ভারি বদ কিন্তু।’ আমীর চরিত্রে এক ধরনের সহজাত্য লক্ষ করা যায়, স্বাভাবিকভাবে যার-তার সাথে মেলামেশার একটা ক্ষমতা তার মধ্যে আছে। গায়ে পড়ে কথা বলায় ওস্তাদ সে। আমীরের সাথে প্রথম পরিচয়ে তার সম্পর্কে রোকেয়ার ধারণা : ‘আমীরকে সত্যি কেমন যেন বুনো মনে হয়।’ রোকেয়া আমীরকে স্নেহ সুলভ চোখে দেখলেও আমীর কিন্তু তাকে দেখেছে কামনার চোখে ‘প্রণয়িনী’ হিসেবে। সে সুবোধ বালকের মত কাক্সিক্ষত রোকেয়ার কাছে ভালো হতে চেষ্টা করেছে। অন্তরে সে জ্বলছে কামনার আগুনে, বাহ্যিকতায় রোকেয়ার ব্যথায় সে নিজেও ব্যথিত হয়ে পড়ে : ‘আমায় তুমি অনুমতি দাও, যেমনি করে পারি সে পাষণ্ডটাকে ধরে নিয়ে আসবো। তোমার সুখের মাঝেই যে আমার সুখ আর শান্তি, তোমার মুখে হাসি ফোটানই যে আমার ব্রত।’ এখানে তার বুদ্ধিমত্তার পরিচয় সুস্পষ্ট। রোকেয়ার স্নেহ সুলভ শাসনে সে তার আশার ইঙ্গিত খুঁজে পায়। আর তাই সে রোকেয়াকে খুব স্বাভাবিকভাবে বলতে পারে : ‘সত্যি আমার ভালো তুমি চাও? তাহলে অকপটে তোমার কাছে স্বীকার করছি, গত দু-তিন বছর সজ্ঞানে এতটুকু পাপও আমি করিনি।’ ক্রমেই তার উচ্ছৃঙ্খলতা প্রকাশ পায় রোকেয়ার কাছে। হীন বাসনা চরিতার্থ করার জন্য পিতার বাক্স ভেঙে টাকা চুরি করে মদ গিলে মাতলামি করার জন্যে এগিয়ে আসে রোকেয়ার কাছে। টাকার লোভ দেখায় তাকে। দরোজা খোলার জন্য অনুরোধ করে মাতলামির স্বরে। কিন্তু রোকেয়া যখন আর কিছুতেই দরোজা খোলে না তখন নিরুপায় হয়ে ফিরে যাবার সময় বলেছে : ‘আঃ ভয় দেখাচ্ছ? বেশ। না খুললে দুয়ার। আমি মিনু বাইজীর ঘরে যাবো। ও আমার সব। ও হীরের আংটি। ওকে চুমু দিয়ে ঘুমিয়ে যাবো; একেবারে মরে যাবো। ভালোবাসতে তুমি জান না; বোকা। তাই এত টা-কা।’
আমীরের হাতে এত টাকা দেখে চম্কে ওঠে রোকেয়া। আর ভাবতে থাকে বেশ্যাদের হাতে এ টাকা পড়লে একটা কানাকড়িও ঘরে ফিরবে না। এসব ভেবেই মুহূর্তেই দরজা খুলে আমীরের হাত ধরতেই সুবোধ বালকের মতো তার সাথে ঘরে আসে। বিছানায় শুতে বলার সাথে সাথে সে শুয়ে পড়ে। রোকেয়াও খোকনকে বুকে জড়িয়ে মেঝেতে শুয়ে পড়ে। শেষ রাতে ঘুম ভাঙলে আমীর দেখে পূর্ণ যৌবনা রোকেয়া স্বল্পলোকিত গৃহে সোনালি দেহ বিছিয়ে পড়ে আছে; মুহূর্তে তার মধ্যে দোলা দেয় জঘন্য পশুবৃত্তি। উন্মত্ত কামনায় ক্ষুধার্ত মার্জারের ন্যায় সে তার ঘুমন্ত দেহের প্রতি খুব সাবধানে অতি সন্তর্পণে এগিয়ে এসে ধীরে ধীরে রোকেয়ার ঘুমন্ত কুসুম শরীর পাবার চেষ্টা করে। রোকেয়াকে আবক্ষ আবেষ্টিত করে হিংস্র্র চুম্বনে ক্ষতবিক্ষত করে। অস্বাভাবিক উত্তেজনায় আমীর উন্মাদ হয়ে ওঠে তার সুঠাম সতেজ দেহের ওপর। রোকেয়া আর্তচিৎকার করে উঠলে সে প্রাণপণ চেষ্টা করেছে হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে রাখতে। কিন্তু তাতে সফলকাম হয়নি। ব্যর্থ কামনায় অনুশোচনায় ভিজে ওঠে তার চোখের পাতা। রোকেয়ার তীব্র বাধা আর ঘৃণার মুখে সে বলেছে, “তোমাকে ‘বুবু’ ডেকেছিলাম তোমার সাথে অবাধ মেলামেশার সুযোগ হবে বলে।”
আমীর প্রথমেই জোরপূর্বক আঁকড়ে না ধরে তার শরীরে মধুর স্পর্শ বুলিয়ে কামনার উদ্রেক করে যৌন মিলনে আকর্ষিত করতে চেয়েছে; সেক্ষেত্রে কোনো সাড়া না পেয়ে আশ্রয় নিয়েছে হিংস্রতার। সুতরাং প্রথমে সে জোরপূর্বক দেহ ভোগ করতে চায়নি কিন্তু যখন সে আর নিজেকে নিজের আয়ত্তে ধরে রাখতে পারেনি তখনই তার এ নগ্নতার প্রকাশ ঘটেছে। আমীর রোকেয়াকে দৃঢ়তার সাথে বলেছে: ‘তোমার সাথে পরিচিত হবার পর আমি আর কখনো কোনো নারীর কাছে যাইনি, কোনো নারীর প্রতি আমার আসক্তি জন্মেনি; এ কথা আমি শপথ করে বলতে পারি। তাই তোমার কাছে এতদিনের লালিত কামনাকে পূর্ণ করতে এসেছিলাম। তুমি তাও আজ কাঁচ পাত্রের বুকে আঘাত দেবার মতো চুরমার করে দিলে। ব্যথা দিলে চরমভাবে।’
এরপর আমীর চরিত্রে ঘটে বিরাট পরিবর্তন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যোগ দেয়। দেশমাতৃকার জন্যে আত্মউৎসর্গ করে নিজেকে। দু‘জন ইংরেজ অফিসারকে খুন করে যখন ফাঁসির রজ্জু ঘাড়ে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ঠিক তখনি আকস্মিকভাবে দেখা হয় রোকেয়ার সাথে। রোকেয়া আমীরকে পেয়ে আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। নিজেকে পরাজিত ভাবে আমীরের ব্যক্তিত্বের নিকট। আমীরকে রাত্রির অন্ধকারে বৃষ্টির শব্দের ভেতর একটি ঘরের ভেতর একান্ত করে পেয়ে যখন রোকেয়া বলে, ‘সব কিছু তোমার কাছে বিলিয়ে দেবার চরম মুহূর্ত। তখন আমরা দেখি দারুণ রকম সংযত সংযমশীল আমীরকে। যে আমীর রোকেয়াকে পাওয়ার জন্য অন্ধ উন্মত্ত সেই আমীর আজ রোকেয়াকে হাতের মুঠোয় শুধু পায়নি; রোকেয়া স্বয়ং নিজেই নিজের দেহ-মন সর্বস্ব তার কাছে বিলিয়ে দেবার জন্য প্রস্তুত অথচ আমীর সেই কামুকি হিংস্রতা পরিহার করে দেশের স্বাধীনতার জন্য নিবেদিত এক সত্যিকার প্রাণ। এখানেই আমীরের শ্রেষ্ঠত্ব। এরপরও আমীর রোকেয়ার সাথে দীর্ঘদিন বিভিন্ন স্থানে কাটিয়েছে এমনকি তাদের নিয়ে কুৎসা রটনা পর্যন্ত হয়েছে। রোকেয়া নিজেও তাকে ‘জীবন সাথী’ ও ‘তুমি আমার’ বলে সম্বোধিত করেছে। আমীর সে সব ক্ষেত্রে তার মানবিকতার পরিচয় দিয়েছে। কারণ রোকেয়া তো আমীরের হাতে নিজেকে সমর্পণ করে তাকে নিয়ে বাঁচার আশায় আজমীর থেকে পাটনায় এসেছিল এ কথা অত্যন্ত পরিষ্কার। রোকেয়া রীতিমতো জানতো আমীর তার কাছে কী চায়; আর আমীরকে তা দেবার মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই তার সন্ধানে এসেছিল এবং তাকে পাওয়ার পর তার কাছে নিজের সব কিছু বিলিয়ে দেবার কথাও নিজ মুখেই বলেছে। অথচ আমীর রোকেয়াকে গ্রহণ করে বোনের মর্যাদায়; জলাঞ্জলি দেয় নগ্ন কামনার। আবার সে নিজেই ফিরোজের হাতে রোকেয়াকে তুলে দিয়ে নিজের সমস্ত অপরাধের কথা স্বীকার করে অকপটে ফিরোজকে জানিয়ে দেয় রোকেয়ার চরিত্রের নিষ্কলঙ্কতা। পরিচয় করিয়ে দেয় রোকেয়াকে ‘খাঁটি’ বলে। আবার অশ্রুসজল হয়ে রোকেয়ার কাছে ক্ষমা চেয়েছে ‘তোমায় যদি সত্যি দুঃখ দিয়ে থাকি; তুমি ক্ষমা করো রোকেয়া।’
এরপর ব্রিটিশদের হাত থেকে দেশ উদ্ধারের জন্যে বেরিয়ে পড়তেই রোকেয়া তার হাত আঁকড়ে ধরে। চোখ বেয়ে টস্টস্ করে জল পড়ে। কেঁপে ওঠে র্তর্ত তার শীর্ণ দু’খানা ঠোঁট। প্রিয়জন হারানোর বেদনায় পাঁজর ভেঙে যায় রোকেয়ার; রোকেয়া যে এ জীবনে বেঁচে থাকার জন্য একান্ত আপন করে আমীরকেই চেয়েছিল; তা রোকেয়ার এই অবস্থাই প্রমাণ করে। আমীর সবকিছু ত্যাগ করে সমস্ত যন্ত্রণা বুকের ভেতর আটকে দেশমাতৃকার টানে বেরিয়ে পড়ে রাতের অন্ধকারে। আমীর চরিত্রে যে বিকাশ ঘটেছে তা প্রশংসনীয়। দোষেগুণে আমীর চরিত্র একটি শক্তিশালী সৃষ্টি। যে চরিত্রের কাছে ম্লান হয়ে গেছে ফিরোজের চরিত্র।
আবার রেখা চরিত্রটিও এ উপন্যাসে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। রেখা রসুলপুরের জমিদার কন্যা। ফিরোজের স্ত্রী। অর্থাৎ একদিকে সে জমিদার কন্যা অপরদিকে জমিদার পুত্রবধূ। অসাধারণ রূপের অধিকারিণী। এতসবের পরও রেখা ছিল নিরহঙ্কার এবং উদার মানসিকতা সম্পন্ন। রোকেয়ার সাথে আকস্মিক পরিচয়ে সে বুঝতে পেরেছে এই নারীই হয়ত তার স্বামীর জীবনের সাথে জড়িত ছিল। এর জন্য সে রোকেয়ার প্রতি দুর্ব্যবহার করেনি বরং সহানুভূতির দৃষ্টি রেখেছে তার প্রতি। আবার অন্যায়ের সাথে সে কখনো আপোস করেনি। এক বুক আশা নিয়ে সে সংসার করতে এসেছিল স্বামীর সংসারে। স্বামীকে চেয়েছিল আপনার করে। রোকেয়ার সাথে তার সম্পর্কের কথা জেনেও সে স্বামী ফিরোজের সাথে এ বিষয় নিয়ে কখনো বাড়াবাড়ি করেনি। রোকেয়ার দেশ ত্যাগের কারণ যে ফিরোজ রেখার তা বুঝতে বাকি থাকে না। তাই সে স্বামীকে বলে : ‘ওরা লোক লজ্জার ভয়েই এদেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। পুরুষ মানুষের তো আর ইজ্জতের ভয় নেই।’ ফিরোজের কারণে যে রোকেয়া অন্তসত্ত্বা তা আর বুঝতে বাকি থাকে না রেখার। রেখা নিজেকে রোকেয়ার স্থানে ভাবে আর ফিরোজের প্রতি জন্মে এক ধরনের বিদ্রূপাত্মক ভাব। ফিরোজ রেখার কাছ নিজের অসভ্য অতীত গোপন করার চেষ্ট করলে রেখা তাকে স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে: ‘মিছেমিছি রাগ দেখাচ্ছ তুমি। আমি মেয়ে মানুষ, তাই মেয়েদের অন্তরের অনেক কথাই জানি। তোমার সম্বন্ধে অবশ্য আমি কোনো কিছু বলবো না। কারণ পুরুষ চরিত্র মাত্র খরস্রোতা নদীর মতোই নির্মল; অন্তত দৈহিক দিক থেকে। তার বুকে আবর্জনা জমে না বহির্মুখী স্রোতের সাথ সব চলে যায়। আর মেয়েরা বদ্ধ জলাশয়ের মতো। তাতে বহির্মুখী স্রোত নেই। ফলে বর্ষার মাদকতায় জোয়ার বেগে নদী তার স্রোতের মুখে আবর্জনা ভাসিয়ে এনে রেখে যায় বদ্ধ জলাশয়ী নারীর জীবনে। নারী সে আবর্জনা হজম করতে পারে না। এমনি এক আবর্জনাই রোকেয়াকে বিব্রত করেছে। আমি জানি সে কুমারী জীবনে অন্তঃসত্ত্বা, আর তুমিই তার মূলে। এ সত্য অস্বীকার করতে পারবে না।’
এরপরও ফিরোজ তার কাছে মিথ্যের আশ্রয় নিলে রেখা কৌশলে স্বামীকে খুশি রাখার জন্যে নিজে অনেকটা অনুতপ্ত হওয়ার ভাব দেখায়। কিন্তু যখন এ মহাসত্য আবিষ্কার হয়ে পড়ে তখন রেখার ঝাঁঝালো কণ্ঠ বেজে ওঠে ফিরোজের প্রতি: ‘গোপন থাকলেই বুঝি সুখী হতে? বিষ খেয়ে চোখ বুজে সাধু সাজলেই কি বিষের ক্রিয়া বন্ধ হয়? মৃত্যুকে এগিয়ে আনবেই। এতদিনে তুমি হয়ত ছেলের বাপ হয়েছ। কিন্তু সে কথা আমার কাছেও চেয়েছ লুকাতে? এভাবে লুকাবার প্রয়োজন আছে কি? তুমি তাকে স্ত্রীর মর্যাদায় ঘরে তুলে আন। এমন তো অনেক হয়।’
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের একটা দিক এতে চিত্রিত হয়েছে। সংলাপগুলো অনেকটা আবেগধর্মী। নাটকের সংলাপের মতোও মনে হয়; কখনো কখনো। বেশ সুন্দর একটা পরিণতি এ গ্রন্থে রয়েছে; এ সব দিক বিচার করে গ্রন্থটিকে একটি সার্থক এবং পাঠকপ্রিয়তায় কালোত্তীর্ণ উপন্যাস হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।
রেখা যে উদার মানসিকতার পরিচয় দিয়েছে তাতে প্রকৃত নারীসত্তার স্বরূপটিই এখানে ফুটে উঠেছে। রোকেয়ার ওপর এই অমানবিক অত্যাচার সে মানসিকভাবে কখনো সহ্য করেনি। শ্বশুর আজমীর থেকে রোকেয়ার সন্তান চুরি করে আনলে তার এই অমানবিক কাজের জন্যে সে প্রতিবাদ মুখর: ‘উপযুক্ত কাজই করেছেন। নিছক সত্যি কথা। কিন্তু ওর মাকে যে অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছেন, সে অধিকার কি শুধু তার পুত্রটাকে কেন্দ্র করেই সত্যে পরিণত হলো? এই কি অধিকারের রীতি?’ শুধু তাই নয়, রেখা যে এক অসাধারণ মানসিকগুণে গুণান্বিত তার প্রমাণ অনেক আছে। রেখা নিজেকে রোকেয়ার স্থানে ভেবে শিহরিত হয়ে স্বামীকে বলেছে: ‘ভাবো দেখি আজ যদি এমন অবস্থায় এনে আমাকে দূরে ঠেলে দিতে? আমি কি অভিশাপের বাহু তুলে খোদার কাছে ফরিয়াদ জানাতাম না।’
মায়ের মতো বুকে তুলে নেওয়ার তার চরিত্রের এক অপূর্ব অভূতপূর্ব বিকাশ ঘটেছে। কলকাতার উপক‚লে আকস্মিকভাবে রোকেয়ার সাথে দেখা হলে আহত রোকেয়কে আপন বোনের মতো বুকে তুলে নিয়ে সংসারে ফিরিয়ে এনে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। রেখা চরিত্রের সবচেয়ে বড় দিক সে কোনো প্রতারণা বা মিথ্যের আশ্রয়কে স্থান দিত না। সত্যের প্রতি সে ছিল শ্রদ্ধাবান। রোকেয়া এবং সন্তানের প্রতি সে যে উদার ও মহত্ত দেখিয়েছে এবং রোকেয়াকে এ সংসারে ফিরিয়ে আনার জন্যে সংসারের ভেতর স্বামী এবং শ্বশুরের সঙ্গে যে প্রতিবাদ করেছিল তাতে সে এক মহৎ নারীর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হতে পেরেছে।
আভিজাত্যের অহমিকায় অন্ধ জমিদার সামান্য গোমস্তার নাতনির সঙ্গে একমাত্র পুত্র ফিরোজের বিয়ের কথা তিনি ভাবতেও পারেননি। রোকেয়াকে বিয়ে করলে তিনি প্রয়োজন বোধে পুত্রকে ত্যাজ্যপুত্র করতে চেয়েছেন। আবার আজমীরে রোকেয়ার ব্যবহারে তিনি নিজেকে অপমানিত মনে করেন এবং তার প্রতিশোধ স্বরূপ রোকেয়ার সন্তান চুরি করে আনেন। আবার ফিরোজের জঘন্যতম কাজের শাস্তি স্বরূপ নিজের জমিদারি ফিরোজকে দান না করে ফিরোজের বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কের ফসল মহব্বতকে জমিদারি উইল করে দেন।
জমিদারের চরিত্রে কাঠিন্য থাকলেও তার অন্তর মানসে একজন সহজ সুন্দর মানুষের সন্ধান মেলে। ওসমানের দেশ ত্যাগের কথা শুনে তিনি যেমন মর্মাহত হয়েছেন তেমনি ভাবে তিনি ব্যথিত হয়েছিলেন তার মৃত্যু সংবাদ শুনে। আবার ফিরোজের মুখে আজমীর থেকে আসা চিঠি পড়া শুনে যখন তিনি জেনেছেন এ তার বন্ধুর পত্র এবং এ ছবি বন্ধু পুত্রের। তখন তিনি আনন্দিত হয়ে আজমীরে গিয়ে নবজাতকটিকে আশীর্বাদ করার উৎসাহবোধ করেছেন। এবং সরল বিশ্বাসে তিনি এক সময় গিয়ে সন্তানের এ সব ছলচাতুরী বুঝতে পেরে তিনি দারুণভাবে মর্মাহত হন। ফিরোজকে শাস্তিস্বরূপ প্রাপ্য জমিদারী থেকে বঞ্চিত করেন। সুতরাং জমিদার বাহ্যিক ভাবে একজন কঠিন মানুষ হলেও অন্তরে তাঁর সহজ সরলতাও লক্ষ করা যায়। স্বল্প পরিসরে হলেও ওসমান চরিত্রটি অনবদ্য সৃষ্টি। রোকেয়ার সাথে ফিরোজের অবাধ মেলামেশার সুযোগ দেওয়ার মূলে ছিল ফিরোজের প্রতি তার অগাধ বিশ্বাস। স্ত্রীর বাধার পরও তিনি নাতনি রোকেয়ার সাথে ফিরোজের মেলামেশার বাধা হয়ে দাঁড়াননি। ফিরোজের বিশ্বাসঘাতকতায় তিনি চরমভাবে ব্যথা পান। শেষ পর্যন্ত মান-সম্মানের ভয়ে রাতের আঁধারে চিরদিনের মতো জন্মভূমি ত্যাগ করে সপরিবারে আজমীরে চলে যান এবং সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন। একজন সৎ সহজ সরল মানুষ হিসেবে গোমস্তা ওসমানের চরিত্রটি সুন্দরভাবে চিহ্নিত হয়েছে। সহজ সরল মানুষ হিসেবে ডা. হামিদের চরিত্রটিও অনবদ্য হয়ে উঠেছে স্বল্প পরিসরে।
স্বদেশি মানুষের প্রতি তার যে আন্তরিকতা ফুটে উঠেছে তাতে একজন বড় মাপের মহৎ মানুষ হিসেবে তাকে চিহ্নিত করা যায়। স্বল্প পরিসরে অর্থাৎ লেখকের তুলির আঁচড়ে রানু চরিত্রটিও জীবন্ত হয়ে উঠেছে। রেখার একটানে নিমাই মাঝির মনের বাসনাকে যেমন তুলে ধরেছেন তাতে সমস্ত দরিদ্র মানুষের একটা স্বরূপ অনুভব করা যায়। অবুঝ কিশোর মহব্বত লেখকের সযত্ন তুলির আঁচড়ে চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবী চরিত্র হিসেবে শমসের এবং বাসন্তী দেবীর চরিত্র প্রশংসনীয়। সুতরাং চরিত্র সৃষ্টিতে লেখক যে যত্নশীল তা উপলব্ধি করা যায়।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের চিত্র লেখক এ গ্রন্থে চিত্রিত করেছেন। ব্রিটিশদের অত্যাচার, নিপীড়ন ও নির্যাতনে এদেশের যে করুণ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল লেখক তা সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। শমসের, বাসন্তী দেবী এবং আমীর চরিত্রের মাধমে তিনি অঙ্কন করেছেন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে এদেশের সাধারণ মানুষের সংগ্রামী মনোভাবের বাস্তব চিত্র ব্রিটিশদের অত্যাচারের স্টিমরোলার এমনভাবে চলেছিল যার কারণে শমসেরের মতো যুবকেরা অস্ত্র হাতে নিতে বাধ্য হয়েছিল দেশমাতৃকাকে উদ্ধারের লক্ষ্যে।
১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয়, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে তার প্রভাব যে সক্রিয়ভাবে পড়েছিল তা তিনি বলতে চেষ্ট করেছেন। মূলত ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের চিত্র তিনি এ গ্রন্থে স্বল্প পরিসরে তুলে ধরেছেন, এতে তার দেশ-কাল সম্পর্কে সচেতনতার পরিচয় পাওয়া যায়। বাসন্তী দেবীর বর্ণিত স্মৃতিচারেণের ভেতর দুর্ভিক্ষের যে চিত্র তুলে ধরেছেন তা বাস্তব সম্মত হয়ে উঠেছে। ব্রিটিশরাই যে শুধু এদেশের উওপর নির্যাতন চালিয়েছে তা নয়। এ দেশের জমিদাররাও সমাজ জীবনে দুষ্ট গ্রহের মতো বিরাজমান ছিল। তারা সাধারণ মানুষদের শোষণ করে আভিজাত্যের সুরম্য প্রাসাদ গড়ে সমাজকে ইচ্ছে মতো পরিচালনা করেছে। সাধারণ মানুষের সাথে সব সময়ই একটা দূরত্ব তারা বজায় রেখেছে। বৃদ্ধ জমিদার যিনি একদিন আভিজাত্যের অহংকারে ছিলেন অন্ধ; জমিদার পুত্রের বউ হয়ে রোকেয়া এ সংসারে এলে তার আভিজাত্য হবে কলঙ্কিত; যে কারণে নিষ্পাপ রোকেয়া সারাজীবন ভোগ করেছে দুঃসহ যন্ত্রণা; কবর দিয়েছে কামনা বাসনাকে। অথচ সেই বৃদ্ধ জমিদারই আবার রোকেয়াকে ঘরে তোলার অনুরোধ জানান। সুতরাং সে সময় সমাজ জীবন চিত্র জমিদারদের হাতের খেলনা স্বরূপ ছিল তা বোঝা যায়। সাধারণ মানুষের যে সে সমাজে কোনো অবস্থান ছিল না রোকেয়ার দুঃসহ জীবন চিত্রই তার প্রমাণ বহন করে। মান-সম্মানের ভয়ে ভিটেমাটি ছেড়ে চোরের মতো রাতের অন্ধকারে পালিয়ে বাঁচতে হয়। সেই সমাজে সাধারণ মানুষের এই ছিল অবস্থা। এ উপন্যাসে মূলত তিনটি পরিবারের কথা বর্ণিত হয়েছে। জমিদারের পরিবার, গোমস্তা ওসমানের পরিবার এবং আজমীরে ডা. হামিদের পরিবার।
অবশ্য কলকাতার উপকূলে মমতাজদের পরিবার এবং পাটনায় যাবার পথে রোকেয়া যে বাসায় রান্নার কাজ করেছিল তা এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। জমিদার পরিবারে প্রথমে পুত্র ফিরোজ এবং পরবর্তী সময়ে মহব্বতকে ঘিরে অশান্তি ও অস্থিরতা বিরাজ করে নষ্ট হয়েছে এ পরিবারটির সমস্ত শান্তি। গোমস্তা ওসমান সাধারণ একজন মানুষ। সহজ সরল জীবন যাপনে অভ্যস্ত। তার সংসারের সুখ-শান্তি মুহূর্তে কর্পূরের মতো উবে গেছে কুমারী নাতনি রোকেয়ার অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার কারণে। ডা. হামিদের পারিবারিক জীবন সুখের হলেও সে সুখ নষ্ট হয়েছে পুত্র আমীরের কারণে। সুতরাং পারিবারিক জীবনের সুখ-দুঃখের চিত্র এ উপন্যাসে পরিলক্ষিত হয়। প্রত্যেকটি পরিবারেই এক ধরনের মানসিক অস্থিরতা লক্ষ করা যায়। উপন্যাসের অন্যতম প্রধান এবং প্রথম শর্ত কাহিনি। এ উপন্যাসে আমরা একটি সুনির্দিষ্ট কাহিনি পাই। এ কাহিনি প্রণয় মধুর। ফিরোজ-রেখা, রোকেয়া আর আমীরের প্রেমকে ঘিরে এ কাহিনি আবর্তিত।
আবার ফিরোজ-রোকেয়ার অবৈধ যৌন মিলনের ফসল স্বরূপ ‘মহব্বত’কে যুক্তিতর্কের ভিত্তিতে লেখক এ সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। এই মহব্বত উপন্যাসটির প্রত্যেকটি চরিত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত। এসব বিবেচনায় রেখে বলা যায়, উপন্যাসটিতে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিরাজিত ক্ষত উঠে এসেছে। সময়কাল বিবেচনায় সেসময় এরকম একটি কাহিনী উপন্যাসের উপজীব্য করা সহজতর ছিল না। মোটের উপর বৈচিত্র্যময় একটা কাহিনি এ গ্রন্থে রয়েছে। চরিত্র বিচারে রোকেয়া, ফিরোজ, রেখা, আমীর ও মহব্বত বিশেষ চরিত্রের দাবিদার। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের একটা দিক এতে চিত্রিত হয়েছে। সংলাপগুলো অনেকটা আবেগধর্মী। নাটকের সংলাপের মতোও মনে হয়; কখনো কখনো। বেশ সুন্দর একটা পরিণতি এ গ্রন্থে রয়েছে; এ সব দিক বিচার করে গ্রন্থটিকে একটি সার্থক এবং পাঠকপ্রিয়তায় কালোত্তীর্ণ উপন্যাস হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।
আরও পড়ুন: সাম্প্রতিক সাহিত্য