বাংলাদেশের কবিতায় অনীক মাহমুদের আবির্ভাব সত্তর দশকের দ্বিতীয় প্রান্তিকে। এই দশকের অন্যসব কবির চেয়ে স্বতন্ত্র তিনি আঙ্গিক কুশলতায়, প্রকরণ প্রসাধনে। বিষয়ের জন্যে একজন কবি সিদ্ধি অর্জন করেন না। সিদ্ধি অর্জন করেন তাঁর আঙ্গিকের অভিনবত্বে, নতুনত্বে, টেকনিকে। আর তাই বলা হয়ে থাকে, ‘কবিতার ইতিহাস, তার টেকনিকের ইতিহাস।’ নিজস্ব poetic diction তথা স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বরের কারণে তিনি সত্তর দশকের, এমনকি গোটা বাংলাদেশের কবিতার প্রেক্ষাপটে একজন গুরুত্বপূর্ণ কবি। পুরাণ, লোকঐতিহ্য থেকে তিনি তাঁর কবিতার অনেক উপকরণ পরিগ্রহণ করেছেন।
পুরাণ, পৌরাণিক চরিত্র, পৌরাণিক প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গ, গ্রামবাংলার লোকঐতিহ্য তাঁর কবিতার মূল মোহান্ত হলেও আধুনিক বাংলা কবিতার রশ্মিকেই মহামহিম করেছেন অনীক মাহমুদ। তাঁর কবিতার কেন্দ্রে পুরাণচারিতা, লোকঐতিহ্যচারিতা; যদিও তিনি প্রকরণ নিষ্ঠায়, আঙ্গিককুশলতায় দুর্দান্ত আধুনিক। ঐতিহ্যনিষ্ঠ কবি বলেই এমনটি হয়েছে অনীক মাহমুদের ক্ষেত্রে। তাঁর কবিতায় ইয়েটীয়-জীবনানন্দীয় স্বপ্নময় রোমান্টিকতা একেবারে দুর্লভ নয়। জীবনের প্রতি হার্দ্য টানের ফলেই তাঁর কবিতায় পৌরাণিক চরিত্র, পৌরাণিক প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গ, লোকজ প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গ এসেছে; লোকসংস্কৃতির প্রতি আকর্ষণ লক্ষ্য করা গেছে।
অনীক মাহমুদের কবিতায় আনুভূমিক বিস্তার যেমন লক্ষ করা যায়, তেমনি গভীর জীবনবোধে আলোড়িত হয়ে দার্শনিক দৃষ্টির প্রক্ষেপণও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ফলে তাঁর কবিতা পাঠকের চেতনার ভেতর প্রদেশকেও আলোকিত করে। জীবনকে বিবিধ প্রক্ষেপণ থেকে আলো ফেলে দেখার প্রবণতা লক্ষ করা যায় অনীক মাহমুদের কবিতায়। তিনি কোনোভাবেই তাৎক্ষণিকতার অবধূত নন। জীবনের অপার রহস্যময়তাকে প্রবাদপ্রতিম কবিত্বে উদ্ঘাটনের সযত্ন-প্রয়াস চালান এবং ব্যক্তিমানুষের মানসজগতের দ্বন্দ্বের দ্বৈরথসমূহের সুলুক সন্ধান করেন এই কবি। ফলে তাঁর কবিতায় জীবন-জিজ্ঞাসা গভীর:
১.
এইভাবে শেষ হলো সাগরের গান পড়ন্ত বিকেলে,
যারা ঝিনুকের খোঁজে গিয়েছিলো বেলাভূমি
তারা মুক্তোর সফেদ গরিমায় পেয়েছে প্রত্যয়,
কেউ কেউ দূর থেকে সাগরের নীলে বোঝেনি কারাভাঁ
শুধু লাল কাঁকড়ার লুকোচুরি ভাঙা শামুকের তেজারতি
দেখে বুঝতে চেয়েছে শঙ্খশিল্প কি রকম হতে পারে,
তাদের কুহক দৃষ্টি সত্য নয়, সত্য নয় কুড়িয়েছে তারা
কেবল ঘ্রাণের রন্ধ্রে ঝিনুকের গলিত রক্তের পুঁজ, নাড়ির পিঙ্গল;
যারা দেখেছিলো সাগরের ঘুম, শুনেছিলো ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে চলার শিঞ্জিনী
তাদের শ্রবণে ছিলো নিন্দুকের নাস্তিমান আস্ফালন,
টিকে থাকার সংগ্রাম কী বীভৎস আরতির উদগাতা হয়ে ওঠে!
[সাগরের গান: এইসব ভয়াবহ আরতি]২.
আর কোনো দ্বিধা নয় প্রত্যয়ের মূলে
ঢেলে দাও প্রেমের সলিল,
জ্যোৎস্নার জড়িমায় স্নিগ্ধতার ফুলে
ভালোবাসা হোক অনাবিল।
অনূঢ়া কামিনী হলে শক্ত হয় হাত
দীপ্ত হয় সাহসী সন্তান,
ব্যর্থতার রোদ থেকে এসো হে যুবতী
প্রেমের সহেনা অপমান।
[যুবতীর প্রতি: আসন্নবিরহ বিষণ্নবিদায়]৩.
সেই কবে কালের প্রত্যুষে আমাকে নিয়ে ওর
বিষধর চালবড়া
নাগিনীর মতো শুরু করে রেষারেষি,
সুন্দ-উপসুন্দ অসুরেরা লুটে নেয় তিলোত্তমা অপ্সরার মায়া,
আদমের হাড়ে হাড়ে হাওয়ার অপচ্ছায়া
মিশিয়ে হেনস্থা করে সর্গচ্যুতি নগ্ন অপবাদে,
আকাশের নীলে নীলে বাতাসের সুনিবিড় কাঁধে
চাপিয়ে ব্যথার শিলা আজো আমি
পরিত্যক্ত শকুন্তলা দিশে দিশে কালে কালে
বয়ে যাই মাতার কলঙ্ক বিশ্বামিত্রধ্যানভঙ্গকারী মেনকা ঘাতিনী
কিংবা গিরিরাজকন্যা পার্বতীর কালিমায়
শিবধ্যান ভঙ্গকারী ছিনাল ভামিনী।
[দীর্ঘদংশন নীলজ্বালা: দীর্ঘদংশন নীলজ্বালা]
অনীক মাহমুদ তাঁর কবিতায় বক্তব্য অনুসারে নতুন, অভিনব ও সার্থক ভাষারীতির প্রয়োগ দেখিয়েছেন। তাঁর কবিতার মাধ্যমে আমাদের জনগোষ্ঠীর মানস-প্রতিবেশ, প্রেম-দ্রোহ, প্রাকৃতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক বৈরিতা বিশেষভাবে ভাষা পেয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনীক মাহমুদের কবিতা মার্কসবাদী চেতনা ও মার্কসবাদী কবিদের জীবনান্বেষণ ও কাব্যদর্শনের সমগোত্রীয়। পাঠক অনীক মাহমুদের কবিতা নিবিড়ভাবে পাঠ করলে অনুধাবন করতে সক্ষম হবেন যে, প্রথমদিকে আত্মসংকট ও নেতিচেতনা তাঁকে আমূল নিমজ্জিত করতে চাইলেও তিনি তা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। স্বদেশমন্থনপ্রিয়তা অনীক মাহমুদের কবিতার অনিবার্য অনুষঙ্গ। কবিতা রচনা করতে করতে ক্রমাগত তিনি স্বদেশকে আবিষ্কার করেছেন। নগরের অনুষঙ্গ কবিতায় এনেছেন তিনি নগরের ব্যর্থতা, দৈন্য, অমানবিকতা, অবক্ষয় ও অন্তঃসারশূন্যতাকে প্রতিপন্ন করার জন্যে। প্রকৃতপক্ষে তিনি নগরজীবনের যাপিত অভিজ্ঞতার গ্লানি, ক্রোধ, ক্ষোভ ও নৈরাশ্য থেকে মুক্ত হয়ে গ্রামীণ অনুষঙ্গে, গ্রামীণ জনপদে, গ্রামীণ জীবনধারায় ও গ্রামীণ নিসর্গে মুক্তি খুঁজেছেন। গ্রামীণ জনপদের বৈভব, উত্তরাধিকার, প্রাণময়তা, সজীবতাকে স্বদেশ তথা বাংলাদেশের সমগ্রতায় উপস্থাপন করেছেন:
১.
অনন্ত তরঙ্গে চলে যে নারীর বুক ছুঁয়ে শতরূপা নদী,
স্বপ্নীল স্রোতের টানে বাজে যার সমাহিত ইমনের সুর,
রাতের সমুদ্র্ েনামে ক্লান্তিময় মাছেদের ঘুম নিরবধি
শিথানে সবুজ পাপ, সুজলা বুকের ক্ষত সুখে ভরপুর,
রক্তের মসীতে লেখা যার নাম পৃথিবীর স্বপ্নময় ভালে,
জন্মতার নিরালোকে সেই এক শপ্তনীল একাত্তর সালে।
এখানে সোনালী সূর্য, ওখানে ধূসর চন্দ্র, অস্তাচলে ফাগ;
বুনো বেতসের ঘরে দুঃখিনী জননী কাঁদে দারিদ্র্যের শাপে,
সায়াহ্নে গোধূলি কাঁদে, দূরে জ্বলে শোকতপ্ত আলোর চেরাগ,
আশার আকাশে জমে দুরাশার কালোমেঘ আহত সন্তাপে,
মাঝরাতে স্বপ্ন ভাঙে বালিশে আঁসুর টুপ চারদিকে দুঃখ,
বহতা চোখের জলে চেয়ে দেখি অবলীন মহামাতৃ মুখ।
[জন্ম তার একাত্তর সালে: একলব্যের ভবিতব্য]২.
বৃষ্টিহীন তেপান্তরে সাদা সাদা মেঘেদের ঘুম
ঘুমের ভেতরে আধো আধো স্বপ্নাবেশ
স্বপ্নের আড়ালে আড়মোড়া অপঘন অবসাদ,
জ্যৈষ্ঠতে জামাই ষষ্ঠি নটবর বাংলায় আসে
দক্ষযজ্ঞ ধ্বংস করে এখনও ধ্যানাসনে বসেনি ভৈরব
গ্যাসকন্যা তেলকন্যা
নাকি গৌরী গঙ্গা
কেমন রয়েছো বাছা সংক্ষুব্ধ ভাঁড়ারে?
:‘ভালো নেই, বুকেপিঠে ঝুলে আছে
লালসার নলকণ্ঠী পাইপ লাইন,
কখন যে বিদ্ধ হই টোমাহক সিরিঞ্জ নিডিলে’।
[মেঘেদের ঘুম: বৃহন্নলা ছিন্ন করো ছদ্মবেশ]
নানাবিধ রহস্যগভীরতা, দ্বন্দ্ব-দ্বৈততার কাব্যিক উন্মোচন করেছেন। আর তা করতে গিয়ে সমকালের খোলকরতালের সাথে মহাকালের ও মহাজীবনের দুন্দুভি মিশিয়েছেন। সমকালীনতার কাব্যবিবরণী দিতে গিয়েও তিনি তাঁর কবিতায় অভিজ্ঞতার নাভিকেন্দ্রে স্বপ্নের ও কল্পনার চক্রমণ ঘটিয়েছেন। তারপরও অনীক মাহমুদের কবিতায় ভায়োলেন্ট বস্তু ও ঘটনার সন্নিবেশ ঘটেছে বাস্তবনিষিক্ত হতে গিয়ে:
এখন আমি ভালোই আছি দুঃখের মতো ভালো আছি
এক শহরে দুজন থাকি নতুন রঙের পৃথক পাহাড়-
ভালোবাসার জেব্রাক্রসিং পার হয়ে আজ শব্দ মাতাল
অন্য নেশায় হন্যে হয়ে ছুটছি শুধু ছুটছি এখন,
এখন আমি তেমনি আছি
দুঃখের মতোই যেমন থাকে দুঃখ বিলাসী।
জীবনটাকে সহজ করে কতোদিনই দেখে গেলাম,
কতোদিনই মদের গেলাস সহজ ভাবেই পিয়ে গেলাম,
বাস্তবতার ঝড় যেখানে ব্যস্ত বুকের আশার পাইন
মুচড়ে ভাঙে,
গন্ধমাদন গন্ধবিহীন, সুখ যেখানে বাতুলতা
ইচ্ছে শুধু ইচ্ছে হয়েই মরালাশের গন্ধ শুঁকে
সেইখানে আজ আমার আমি আমার হয়ে কেমন আছি?
কাঁদার মতো হেসেই শোভন
মৃতের মতোন বেঁচে আছি।
সব কথা তো যায় না বলা, যায় না বলা সেসব কথা
ইতিকথার পরের কথা।
তবু আমি বলতে পারি কসম খেয়ে তৃষার চাতক
যেমন ভাবে ঘা শুকালেও দাগ থেকে যায়।
[দুঃখের মতো ভালো আছি: প্রেম বড় স্বৈরতন্ত্রী]
অনীক মাহমুদের ভৌগোলিক চেতনা, ইতিহাসচেতনা, সময়চেতনা-কোনোভাবেই শৃঙ্খলিত নয়; ছোট কিংবা বৃত্তাবদ্ধ নয়। সভ্যতার ঊষাকাল থেকেই যেন কবিতায় জেগে আছেন অনীক মাহমুদ। কবিতার মাধ্যমে তিনি যেন সভ্যতা থেকে সভ্যন্তরে ঘুরে বেড়ান। প্রত্নতাত্ত্বিকের বিভিন্ন সভ্যতার হাড়গোড়ের মধ্যে তিনি যেন মানবিক দিক চিহ্ন খোঁজেন। এ বিবেচনায় কবি কালপুরোহিত। অনীক মাহমুদ মনে করেন যে, প্রাক্তন সভ্যতাগুলোর উত্থান-পতন বর্তমানের মানবকুলের সামষ্টিক বিকাশ ও বিপর্যয়ের সাথে সম্পর্কিত। তিনি ভালো করেই জানেন যে, সময়ের দূরবর্তী ঢেউ অনেক দূরের তীরেও আছড়ে পড়ে। অনীক মাহমুদের কবিতায় যেন মমির গন্ধ পাওয়া যায়। ফলে পাঠক কবিতায় এক ধরনের যন্ত্রণাময় অনীক মাহমুদকে আবিষ্কার করেন। তাঁর কবিতায় বেদনা স্থায়িত্ব লাভ করে, আনন্দের আয়ু ফুরিয়ে যায়:
১.
দক্ষিণ বাহুর পেশী যুগান্তের ডিহিদার মাশুলে মহান
দক্ষিণ দুয়ারী ঘর কিংবা দক্ষিণ যাজকী পন্থা
বরাবর স্বার্থের ওলান ধরে বংশপরম্পরা টানাটানি করে,
ফরাসি ফসিল থেকে জারের জিরাত ব্যাপী
সর্বত্র স্বার্থান্ধ সন্ধি ইতিহাসে সাক্ষ্য দিয়ে যায়,
ইজ্জতের দহলিজ, বিবেকের বোধিবৃক্ষে প্রতিক্রিয়া মগ্নতায়
ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায় …
উপমহাদেশ দক্ষিণায়ণের অবরূপী অবশেষ,
প্রাকৃতজনের ভাষা একদা উদরে পুরে স্বৈরাচারী উন্মত্ততা
ছুড়েছিল জন্মমৃত সংস্কৃত সংরাগ, কিংবা রাজসূয় মন্ত্রবীত
উঁচু করে মিনারের মতো মাথা তুলেছিল পাঠান ইংরেজ বুলি।
রামমোহনের মল্লযুদ্ধে সতীদাহ, বিদ্যাসাগরের
অগ্নিদাহে বিধবাবিবাহ হলো গতায়ুর ফাঁদ থেকে মুক্ত,
অন্ধকার আত্মরতি জ্বালালো প্রদীপ
এইভাবে কালচক্রে কালনেমি বাধা দেয়
হনুমান মুক্ত করে ষড়যন্ত্র সরোবর আছাড়ে আছাড়ে
বাংলার শ্যামল শোকে ঘনীভূত হয় যতো হনন হূণের থাবা
পাথর সরানো গানে ততো সিদ্ধ হয় মুক্তিকামী প্রতিপক্ষ।
[দক্ষিণের দিনপঞ্জি: এইসব ভয়াবহ আরতি]২.
মৃত্তিকার চোখে আজ কষ্টের কাজল
মুখে মেদুরতা অধরে ক্ষয়িষ্ণু বিয়াবান
দুঃখবতী ক্ষত
প্রেমাংশুর দায় নিয়ে বুকের উপরে পৃথ্বীধর যুগল উপমা
মৃত্তিকার সমুদ্র মেখলা জলের যৌবন
কীভাবে উদ্বাস্তু হয়ে ধড়িবাজ সময়ের অঙ্কশায়ী হলো
দেখেছো কখনো বিম্ববতী
: না।
আকাশে বাসর পাতালে তারার উল্টোরথ ষষ্টি
মধুমাসে রাখীভাই জুড়ে দেয় লাশের বহরে
মাংসাশী প্রদর্শনী,
হাঁপানি প্রান্তরে সাদা মেঘে শকুনিরা উড়ে,
পবনদূতের সমিন্ধনে
পরিষদে হিস্টিরিয়া জমে,
টাইরেসিয়াস সমাদৃতা রানিমাতা
জানো সে কি ধুলোর ঘটনা?
: না, না, জানিনা শুনিনা ।
না- এর বন্ধনে সময়ের অজারেণু উড়ে যায় শুধু
মঙ্গার ফানুস ধরে মৃত্তিকার ঘাম
শুকিয়ে শুকিয়ে নিজেরাই হয়ে যায় ব্যথার লাটাই…।
[কষ্টের কাজল: বৃহন্নলা ছিন্ন করো ছদ্মবেশ]৩.
অকৃতজ্ঞ সারমেয় প্রভুহীন হলে একদিন
বেওয়ারিশ নিরেট ভাগাড়ের স্তূপে স্থান পায় সরল নিয়মে-
বাঙালির শ্যামল বাংলা কৃতঘ্নের নাগপাশে
হয়তোবা নতজানু ছিল কখনো কখনো
কিন্তু আত্ম বিক্রয়ের জঞ্জালে থাকেনি মুমূর্ষু চিরকাল;
তাই বুঝি বায়ান্নোর মাতৃকল্প, একাত্তর স্বাধীনতা বীজমন্ত্র হাঁকে
পনের আগস্ট সমার্থক স্বপ্নবনে আজো কাঁদে
জনকের শূন্যতার ছায়াঞ্চল ধরে,
কিন্তু কাপুরুষ খল জাতকের জিঘাংসার পাশবপিপাসা
চিরদিন অসুরের ঘৃণা আর ধিক্কারের ছড়াবে অঙ্কুশ!
ইতিহাস সত্যসন্ধ হলে অন্ধকার কেটে যায়,
কালান্তর দীর্ণ করে জেঁকে বসে আলোর মিছিল।
[ইতিহাস সত্যসন্ধ হলে: ভদ্রলোকসংহিতা]
অনীক মাহমুদ জীবনঘনিষ্ঠ কবি বলেই শব্দে কবিতার মেজাজ ও ঘনত্ব আত্মীকৃত করেছেন। তাঁর কবিতায় শব্দের ব্যুৎপত্তিগত দিকের চেয়ে প্রায়োগিক দিকটা বরং বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। অনীক মাহমুদের কবিতার শব্দ বিষয় ও বিষয়ীকে অনেক সময় এক করে ফেলে। তাঁর কবিতার শব্দগুচ্ছ যেন চৌম্বকক্ষেত্রে আকর্ষণ প্রত্যাশী বস্তুকণা। অনীক মাহমুদের কবিতায় ব্যবহৃত শব্দগুচ্ছকে কখনো কখনো মনে হতে পারে রেলগাড়ির বর্ণিল, মিশ্র যাত্রীসাধারণের মতো। বিষয়বস্তুকে ভাষিক কাঠামো দিতেই তাঁর এই প্রয়াস। তাঁর কবিতায় ব্যবহৃত স্বাধীন, সার্বভৌম, প্রতিস্থাপনযোগ্য, স্বমহিমায় ধন্য শব্দের সংখ্যা একেবারে কম নয়। সময়ের ত্রিভুজত্বকে, জীবনের অবিভাজ্য অংশকে কবিতায় তুলে আনতে গিয়ে অনেক অনেক চিত্র তৈরি করেন কবিতায়। মৃত্যুর তুহিনস্তব্ধতায়ও অনীক মাহমুদ জেগে উঠেন জীবনের হাজারের কণ্ঠ নিয়ে, জীবনের অনন্তধারা হয়ে:
শেষাবধি নির্বিকল্প জীবনের জয় হয় অনন্য মাহাত্ম্যে,
সময়ের পত্রপুটে কিশলয়ে কিংবা শুকনো শাখার মামে
বিশুষ্ক পাতার রাশে রাশে
চোখ রেখে দেখেছি এসব রক্তনদী, সংহার মচ্ছব
ঘাতকের জিঘাংসায় উন্মাতাল বুক নিয়ে- হাত নিয়ে
শেষমেষ তস্করের ছায়ামূর্তি ধার করে লুকিয়েছি মুখ,
তোমরা কি দেখতে পাওনি হে প্রপিতামহ নক্ষত্র আকাশ,
মাঠের আবাদী চোখ, আরণ্য সম্পূট ধূর্তবৃক্ষদাম,
নিরেট গোধূলি?
দেখতে পাওনি ঘাতকের রক্তমাখা হাত
কী রকম অসহায়! বিচলিত মধ্যবিত্ত বিব্রত ফড়িয়া!
যে সময়ে হন্তারক সেজে নিশ্চিহ্ন করেছি
শাহই বুলন্দ ইকবাল দারাশিকো ভ্রাতার মস্তক,
বিনা প্রক্ষালণে বিনা জানাজায় ভোল্টের কবন্ধে
ঢাকিয়েছি তার লাশ অবজ্ঞায় দাফনের কূটচালে,
সে থেকেই নাজেহাল পরান্মুখ আমি
চারদিকে অশান্তির হলাহল দিল্লি ছেড়ে দাক্ষিণাত্যে
সাজলাম পরবাসী সেখানেও মন্বন্তর প্লেগের দৌরাত্ম্য,
একে একে উজাড় হয়েছে দক্ষিণের গ্রাম-গঞ্জ-নগর-মহল্লা
অর্থকষ্ট, সৈনিক বিদ্রোহ, সন্তানের ষড়যন্ত্র শেষতক নিঃসঙ্গ মরণ
আলমগীর হয়েও পেলাম না পরিত্রাণ প্রকৃতির নিষ্ঠুর ছোবল থেকে!
[স্বপ্নসম্ভাষণ: দীর্ঘদংশন নীলজ্বালা]
অনীক মাহমুদের কাব্যচৈতন্যময়তার ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত প্রাসঙ্গিক। বিভিন্ন সময়ের জাতির সন্তানদের আত্মত্যাগ ও বারুদের মতো জ্বলে জ্বলে ওঠার প্রসঙ্গ যেমন এসেছে, তেমনি বিশ্বাসঘাতকদের বিশ্বাসঘাতকতা, এসেছে ভীরুতা, পশ্চাদপরতা, আপোসকামিতা। স্বাধীনতাতো কেবলমাত্র পতাকার পরিবর্তন নয় কিংবা একটি জনগোষ্ঠীর পরিচয় বদল নয়। এর সঙ্গে জড়িত মাটি ও মানুষ, ভাষা এবং ঐতিহ্য বিবর্তনের ইতিহাস। তাছাড়া এর সঙ্গে জড়িত সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রসঙ্গ। কবি তাই উচ্চারণ করেন:
১.
হে হার্দ্য দুঃখিনী দয়িতা চন্দ্রাবলী,
কতোদিন, কতোদিন এভাবে ফিরিয়ে দেবো শহীদের অঙ্গীকার
জ্বলন্ত জবাব?
সাবিত্রী বসন খুলে আর একবার বলে দাও মিনারে ওদের
তোমার বর্ণমালা এখনো কাঁদছে …
এখনো … এখনো …
[বর্ণমালা এখনো কাঁদছে: একলব্যের ভবিতব্য]২. অনেক রক্তের পরে ফিরে এলো বুকের ব্যারাকে
আজন্ম স্বাধীন পাখি প্রাণখোলা দুঃখিনীর ভাষা,
কালের প্রতীতি হয়ে নির্ঘুম রাতের শুক্ল বাঁকে
যে ভাষাতে কথা বলে গৃহহীন অবলীন চাষা,
অনেক রাত্তির হলে চেয়ে দেখি জানালার ফাঁকে
সে ভাষাতে মুসাফির খুঁজে নেয় বিবেকের বাসা।
হঠাৎ আঁসুর ঝর্না ফেটে পড়ে আমার বালিশে
মাঝরাতে চন্দ্রাবলী ধেয়ে আসে খেয়ালি ভুখায়
বাংলা নামের ভিড়ে একটি মা সতত ককায়
অস্থি বহুল দারিদ্র্য পথ খুঁজে যাতনার বিষে।
[আমার দুঃখিনী মাতৃভাষা: আসন্নবিরহ বিষণ্নবিদায়]৩.
স্রোতের উজানে বহুদিন জড়ো করেছিলে বামেদের ঘাম
নষ্ট সাঙাতের কূটচালে কাঁচা মাংস কাঁচা মদিরার ছাইভস্ম গিলে
আত্মবিক্রি পর্বটাকে গোপন বৈঠকে করে দিলে শেষ
অতিবাম অতিডান বৈপরীত্যে ওড়াওড়ি করে অনেকের মতো
পেিচরি শিলংয়ের নিভৃতির ঘেরাটোপে ঘুমালে নিশ্চুপ
তুমি বাবু ষোল আনা কাবু হয়ে মলো আজ নিজেরই কর্ণমূল
যেন বোকাই বানর
তমালের ডালে ঝুলে পেঁচাদের আঁধারের ভুলে
জোনাকির সহবাসে শেষাবধি ইচ্ছাচাঁদ নেমে গেলো নিচে
স্তাবকতা তুমি তেল দিলে প্রভুদের পায়ে
ভজহরি মুনিষ্যিটা সে তেলের ভাজা কৈ মাছটি
উল্টিয়ে তো জানতো না খেতে
এখন তিমির মন্ত সময়ের প্রতীক্ষা ঘোটক
[খুড়া মাহাত্ম্য: দীর্ঘদংশন নীলজ্বালা]
গণচেতনা ও ইতিহাসচেতনা নতুন গতিপথ খুঁজে পেয়েছে অনীক মাহমুদের কবিতায়। সারল্য গভীরতার কাব্যভাষা ও কৃৎকৌশলের জন্যেই তিনি কবিতায় নিজস্ব কণ্ঠের অধিকারী হতে সক্ষম হয়েছেন। লোক-ঐতিহ্যের অন্তর্লীন মরমিতা ও গভীর দ্যোতনাযুক্ত জীবনানুভব তাঁর কবিতার মহার্ঘ সম্পদ। গ্রামীণ ভাবানুষঙ্গ ও প্রতিবেশকে সহজেই যুক্ত করেছেন তিনি কবিতায়। জীবনকে অবলোকনের চশমাটিকে নিরঞ্জন রাখার প্রয়াস চালান এই কবি। তাঁর কবিতায় এক ধরনের মোহন আড়াল লক্ষ্য করা যায়। জীবনের অপার রহস্যময়তাকে কবিত্বে উদঘাটনের সযত্ন প্রয়াস চালান এই কবি। পাশাপাশি মানুষের সংগ্রামশীলতাকেও নতুন মাত্রা ও আয়তন দেন তিনি:
১.
আমাদের দুঃখনদী
ধারাজলে ভাসে তার অযুত ডিঙার ঝকমারি
গণতন্ত্র সদাগর দুইতীরে শুল্কমুক্ত বাণিজ্যের বড় দাবিদার,
সমাজতন্ত্রের পণ্য নিয়ে ছুটাছুটি করে কয়েক বজরা
বিচ্ছিন্ন কান্ডারি,
সমদর্শী মার্কস লেনিন মাল্লা ভক্তকুল
ছইতোলা নৌকার ভেতরে অবরুদ্ধ নারীর ঘেরাটোপে
নিগড়ের পাশা খেলে পলিত কেশের ফড়িয়া হুজুর
তারাও একান্তে বিপ্লবের গন্ধ নিয়ে বসে আছে কানাবগি
ওঁৎ পেতে পগারের ধারে,
নদীপাড়ে লাশমেলা হোসেন মিয়ার স্বপ্ন ভাসে।
[আমাদের দুঃখনদী: বৃহন্নলা ছিন্ন করো ছদ্মবেশ]২.
কোনো কোনো প্রিয় মুখ রক্ত মাংস কামনাবিহীন,
বিনাশী পাথরে সমাহিত রাখে ভূর্জবৃক্ষ প্রেম,
কবির বৈদুষ্য চিন্ময় লোচন গড়ে আঁখি ঋণ,
তাই বুঝি আশা ও আবেগে ওঠে রব ‘শেম-শেম’;
এখানে পুতুল মেম বিনাশী তিমিরে বাঁধা বুক,
মুত্যুর মদিরা পানে সেরে যায় প্রেমের অসুখ।
[মায়াকোভস্কি: সুমিত্রাবন্ধন]
জীবন ও জগতের বিন্যাসে, বক্তব্যের প্রগাঢ়তায় ও বয়ন কৌশলের স্বাতন্ত্র্যে অনীক মাহমুদ স্বতন্ত্র দ্বীপ হয়ে কবিতায় জেগে থাকার প্রয়াস চালিয়েছেন। জীবনোপলব্ধির বিন্যাসে নিজস্ব অর্থময়তা সৃষ্টি করে, কবিতায় তিনি অর্থদ্যোতনার পরিসর বাড়িয়েছেন আপন যোগ্যতায়। জীবনের বহু বিচিত্র বিরোধের ঐকতানকে সংহত রূপ দিয়েছেন তিনি কবিতায়। অনীক মাহমুদ এমন এক কবি, যিনি আপাত সারল্যের সাথে দাম্পত্য রচনা করতে পারেন জটিলতার, পারেন বিভিন্ন বৈপরীত্যকে সঙ্গমে প্রলুব্ধ করতে। অসাধারণ রহস্যময়তার সৌন্দর্যে ও লীলা ভাষ্যে অনীক মাহমুদের কবিতা একই সাথে লাবণ্যময়ী ও মহার্ঘ হয়ে উঠেছে। কবি তাঁর অসাধারণ কল্পনা প্রতিভার ও অভিন্ন এক ভাবনাকে বহু কৌণিক করে তোলেন। তাঁর কবিতায় ধ্বনিসাম্যের মধুর বিস্তার লক্ষ্য করা যায়। যা অর্থবোধকতায় যেমন বিচিত্র, তেমনি বহুস্বরিক। দ্বন্দ্বময়তার নানা অনুষঙ্গ ও বিচিত্র বিরোধকে কবিতায় একই সঙ্গে জায়গা করে দিয়েছেন অনীক মাহমুদ। ফলে তাঁর বহু কবিতা অনেকান্ত ব্যাখ্যার আধার হয়ে ওঠে। আর আধুনিক কবিতার পাঠকমাত্রই জানেন যে, কবিতায় বহুমাত্রিক রহস্য রচনা করতে না পারলেও কবিতা বহুবাচনিক হতে না পারলে একজন কবি প্রকৃত আধুনিক কবি হতে পারেন না। নিজস্ব কণ্ঠস্বর নিয়ে কবিতায় কথা বলতে পারেন না। অনীক মাহমুদ বহুমাত্রিক রহস্য রচনা করে এবং বহুবাচনিক হয়ে প্রকৃত আধুনিক কবি হতে পেরেছেন। এক্ষেত্রে তাঁর নিজস্ব কবিস্বভাব ও প্রকরণপ্রসাধনও কার্যকর ভূমিকা পালন করে:
১.
আহার-বিহার-নিদ্রা-কাম-ক্রোধ বোধের বিকার
কোকিলা ছেড়েছে বন বৃক্ষ-ফুল ক্লান্ত অসহায় ।
হররোজ গলগণ্ডে কাঁটা হয়ে বিঁধে এলাঙের মতো,
পাখিদের জয়গানে তবু নেই সত্যের স্বীকার,
গ্ল্যামারের কূটচালে ব্যবসায় চলে অবিরত ;
এখন নিকট জন ভিন্নধর্মী সময়ের চাঁই,
[বৃক্ষ-ফুল: সুমিত্রাবন্ধন]২. সাধনার ছায়া থেকে জেগে ওঠে প্রাণ
আলোকের ঝর্ণা হতে পথের সঙ্কেত,
সুরের আকুতি দিয়ে সিদ্ধ হয় গান,
মীড়ে মীড়ে পূর্ণ হয় আশা-অনিকেত;
জীবনের পথে যারা হেঁটে অফুরান-
সুরমন্ত্রে এক করে শাল-সুন্দি-বেত,
আপাতঃ ঘটলে এই দেহের প্রয়াণ,
বাঁচে তারা নিয়ে সুধা সুর ভরা ক্ষেত।
[অমিয় সুরের দ্যুতি: ভদ্রলোক সংহিতা]৩. প্রেম সে তো কাদা মাটি
পুরোটাই আঠালো,
তারই ভারে রাধাদেবী
কৃষ্ণকে খাটালো।
[১ সংখ্যক কবিতিকা: কান্তবোধি কবিতিকা]৪.
নিমের ডাল ঘষায় ভালো
দাঁতের পিঠে চাঁদের আলো,
বৌ-এর গাল ঘষায় লাল,
বিদ্যা হলো গুণীর ঢাল।
[৪ সংখ্যক কবিতিকা: কান্তবোধি কবিতিকা]
সমাজ, সাম্যবাদ, প্রেম, যৌনতা, প্রকৃতি, নিসর্গ, লোকায়ত জীবন অনীক মাহমুদের কবিতায় অসাধারণ ধ্বনিপ্রবাহ নিয়ে হাজির হয়। অনীক মাহমুদের কবিতা পড়তে গিয়ে পাঠকের মনে হতে পারে যে, একটি কবিতার মধ্যেই প্রোথিত আছে শত কবিতার বীজ। তাঁর কবিতায় ব্যক্তি-কবির অমোঘ হৃদয়যন্ত্রণা যেমন প্রকাশিত হয়, তেমনি একটি জনগোষ্ঠীর সমস্যা-সংকট ও সম্ভাবনাও মূর্ত হয়ে ওঠে:
১.
অনাদি মুক্তির ডাকে ঝেড়ে ফেলে বিষাদের গলা
জীবনের জয়গানে ভরে দাও নিরেট সমাজ,
বঞ্চিতের মুখে পুঁতে দাও কুলীশ কথার ফলা
হে মহান কমরেড, স্বস্তি পাক আর্তজনে আজ,
যে কিষাণ অর্ধনগ্ন ভুখাতুর থাকে দুইবেলা,
বিত্তহীন শ্রমজীবী বুকে যার শূন্যতার বাজ
সাধ্যের সীমানা দিয়ে করে যায় অহর্নিশ খেলা,
এ সবে বাড়াও হাত সেধে দাও লোহিত কোলাজ।
বৈষম্যের নাগপাশ ছিন্ন করে সমতার পথে
শোষণের যন্ত্রজাঁতা ভেঙে ফেলে রুদ্ধ পদভরে
চলে এসো কমরেড দুঃখিতের কল্যাণের ব্রতে
[স্বাগতম: একলব্যের ভবিতব্য]২.
সুখকে কবর দাও, যযাতি রাখুক হাত নহুষের শবে,
মানুষ মানুষ গন্ধ জাতকের ড্রেনগুলো ভরে ভরে দিক,
এদিকে চেয়োনা তুমি, ছুঁয়োনা শাওন বুক, পাগলির পিঠ,
এখানে তৃতীয় বিশ্ব মারীর বন্দনা করে
যন্ত্রণার বেহালা বাজায় নেকড়ের নোখে,
দুর্ভিক্ষের হাত তুলে প্রেম প্রেম ভিক্ষা চেয়ে
এখানে এ জীবনে আজো
রাত কাঁদে, রাতের হৃদয় কাঁদে পাড়াগাঁর নলিনীর চোখে।
[রাত কাঁদে রাতের হৃদয় কাঁদে: একলব্যের ভবিতব্য]
আত্মসমীক্ষা অনীক মাহমুদের কবিতার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কবিতায় সাবলীলতাকে মহামহিম করেছেন তিনি। দুর্মর জীবনতৃষ্ণা ছড়িয়ে আছে তাঁর কবিতার পঙ্ক্তিতে, পঙ্ক্তিতে। তিনি স্বাপ্নিক হলেও কোনোভাবেই স্বপ্নপীড়িত কবি নন। নগরের ক্লান্তি, হতাশা, নির্বেদকে তুলে ধরতে গিয়ে তিনি বিরানভূমির মরুবাতাস একটি ধুয়ার মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। নগরক্লান্তি ও নিঃসঙ্গতার নান্দীপাঠের বিপরীতে অনীক মাহমুদ লৌকিক মিথ এবং কৃষি জীবন-সন্নিহিত বিশ্বাস পরম্পরাকে কবিতায় ভাষা দিয়েছেন। তাঁর কবিতার শব্দের লাবণ্য ও ইঙ্গিতময়তা কবিতাকে দিয়েছে যেন পবিত্র স্তোত্রপাঠের গভীর স্বনন। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অতিরিক্ত মাত্রা সংযোজন করেছেন:
১.
লাঙল জোয়াল কাঁদে অশ্রুহীন মাটি নিয়ে নিষ্ফল পাথারে
বলো তবে কার কাছে জমা দেবো হে রমণী,
এই ঘরগেরস্থালি, শঙ্খনীল সংসার,
পীযুষ পাপের ভাঁজে বেড়িবদ্ধ দীপ্ত ভালোবাসা?
সেই কবে ছিলে তুমি কোল-ভিল-শবরীর ঘরে এক বঙ্গাল জননী,
কতো রাজন্য আমীর তোমার নিবিদে এসে করেছে স্বার্থের হানাহানি,
হয়তো দেখেছো তুমি কতো তাতার তৈমুর ঘুরে গেছে পুষ্পল কুটির
দুমুঠো ঘাসের জন্য দিয়েছে অজস্র হানা বখ্তিয়ারের ঘোড়া,
যুগের জাগরী ডাকে হয়েছো কখনো মোগল বেনিয়া খানের ফসিল
শুদ্ধসীমা বায়ান্ন ব্যাকুল, একাত্তরে রক্তশ্রাবী শঙ্খিল শিকার-
কেউ কথা রাখেনি মৃন্ময়ী, যন্ত্রণা জিরাতে শুধু
দিয়েছে হিংস্রের থাবা হিরণ্য হৃৎপিণ্ড আর মাংসের মণ্ডায়
প্রত্যেকেই নিয়েছে যক্ষের মতো হাড়ের হিসেব।
[আজন্ম দুঃখিনী: একলব্যের ভবিতব্য]২.
সাত সমুদ্দুর তেরো নদীর বাস্তুছাড়া খরিস খাটাস
দুশো বছর নারীত্বকে নিয়েই কী তোর
খেললো হাজার ছিনিমিনি
পশ্চিমা সব প্রভুর নামে উজ্জীবিত
দালালেরাও করলো নানা ছলচাতুরি
তোকে নিয়েই আমার যতো বৈরী বিপদ জীবনজ্বালা
আশার ঘায়ে নুনের ছিটে দুঃখ দাহন বুকে পিঠে
বায়ান্নতে রক্ত দিয়ে আটান্নতে ক্ষোভ দেখিয়ে
ঊনসত্তর বাষট্টিতে আগ্রাসী চাল রাজ্যপাটে
ঢের করেছি লুপ্ত লোপাট
একাত্তরের ভিয়েতনামি যুদ্ধ করেই পেলাম শুধু
কাঠ কয়লার পোড়ো শরীর
তিরিশ লাখের রক্ত চুষে প্রাণ পেয়েছিস নমাস পরে
ক্ষুৎপিপাসু বৈষ্ণবী তুই।
[বৈষ্ণবী তোর দোহাই লাগে: আসন্নবিরহ বিষণ্নবিদায়]
লোকজ ও আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার অনীক মাহমুদের কবিতায় সপ্রাণতা যুক্ত করে। পাশাপাশি যুক্ত করে এক ধরনের চমক ও নতুন সম্ভাবনা। বৃহত্তর জনগোষ্ঠী গ্রামবাসী বলে গ্রামীণ আধুনিক বাংলা কবিতায় অবশ্যই কাক্সিক্ষত। এই গ্রামীণ জনগোষ্ঠীই বলতে গেলে বাংলাদেশের প্রায় এক প্রাণস্রোত। আধুনিক কাব্য-কাঠামোতে এই প্রাণস্রোত, গ্রামীণ নিসর্গ ও লোকজ ভাষা যুক্ত করে অনীক মাহমুদের কবিতায় নতুন সৌরভ ছড়িয়েছে। কবিতায় আবহমান গ্রামবাংলার রূপায়ণ অব্যশই অভিপ্রেত। কবিতায় লোকজ শব্দ ব্যবহার করলেও নিরীক্ষা করেননি তিনি লোকজ শব্দ কিংবা প্রকাশভঙ্গি নিয়ে। কবি তাঁর কবিতায় অবিকল আঞ্চলিক বিশেষ্য ও ক্রিয়াপদ প্রপঞ্চ ব্যবহার করেছেন সচেতনভাবেই। লোকজ অভিব্যক্তি অনীক মাহমুদের কবিতার জন্যে কোনোভাবেই পশ্চাৎমুখীনতা কিংবা ‘ফবভবধঃরংস’ নয়। লোকিক ভাবনাসজ্ঞাত হওয়া কোনোভাবেই একজন কবিকে অনাধুনিক করে না। আঙ্গিক বিবেচনায় কোনোভাবেই গ্রাম্য কবিতার আঙ্গিকের কবি নন। শীলিত ও সচেতন মনন-প্রক্রিয়ায় তিনি গ্রামীণ জীবন ও গ্রামীণ নিসর্গকে কবিতায় ধারণ করেছেন আধুনিক কবির সৃষ্টিশীলতায় ও নাগরিক বৈদগ্ধ্যে। অথচ কোনোভাবেই তিনি নগর-অনুভবের কৃত্রিম প্রকাশ ঘটাননি। গ্রাম তাঁর কবিতায় এসেছে শেকড় অন্বেষণের প্রয়োজনে, শৈশবস্মৃতি ও জীবনস্মৃতির শিল্পলোক তৈরি করার প্রয়োজনে:
১.
আমার ভেতরে আজ সঘন আষাঢ়ে বয় চৈত্রের হাওয়া,
ফাল্গুনে বুকের বৃক্ষে গান গায় ভয়ার্ত গৃধিনী
আশার গেলাস হাতে প্রত্যহ প্রার্থনা করি হলদেটে মেঘ,
একফোঁটা পানি দাও প্রত্যয়ের ভূর্জবৃক্ষমূলে!
এইভাবে কতোদিন ছুটে গেছি নদীর পাতালে-
সাগরের সফেন কন্দরে এসে বহুবার চেয়ে গেছি এক বুক
পিপাসার জল,
নীরব বেদনা দিয়ে মর্ত্যরে গরাদ খুঁড়ে শেষটাতে লুকিয়েছি
হায়েনার শাপ।
অতঃপর হৃদয়ের নোনাজলে নগ্নস্নান হয়নি এখনো …
তারপর এমনি করেই
রাগের ফসল বুনে প্রতিদিন নিঙড়াও এই স্নায়ু মাঠ।
[রাগ: প্রেম বড় স্বৈরতন্ত্রী]২.
গিন্নি ছিলো আস্ত যেনো বিন্নি ধানের খই
খইয়ের সাথে মিশলো প্রেমের গামছা বাঁধা দই,
দই পারানি সই,
মনে যে হয় কালযমুনা নঈ।
গিন্নি যখন শিরনি মেনে অশ্রু ফেলে একা,
একার মাঝে লেখাতে পায় যুগল প্রেমের দেখা,
দেখার কুহু কেকা,
মনে দাগায় অসীম স্মৃতিরেখা।
গিন্নি প্রাতে ফিরনি রেঁধে ডাকলে সূর্য হাসে,
হাসির ব্যথার রোদ খেলে যায় শিশির ভেজা ঘাসে।
[গিন্নি: এইসব ভয়াবহ আরতি]
অনীক মাহমুদের কবিতায় প্রকৃতি-নিসর্গ ও মানুষ দেশাত্মবোধে সমীকৃত হয়ে এসেছে। দেশের প্রকৃতি ও নিসর্গপ্রীতি থেকে উদ্ভুত এ-সব কবিতা তাঁর সৌন্দর্য-অন্বেষণের ও প্রত্যক্ষ ফল। দেশের প্রকৃতি ও নিসর্গের সঙ্গে অনীক মাহমুদের এই প্রীতির বন্ধন তাঁর দেশের মানুষের প্রতি এক সর্বাত্মক আত্মীয়তাবোধকেও জাগ্রত করে কবিতায়। এ প্রসঙ্গে আমরা মনে করতে পারি: ‘দেশ মানুষের সৃষ্টি। দেশ মৃন্ময় নয়, সে চিন্ময়। মানুষ যদি প্রকাশমান তবেই দেশ প্রকাশিত। সুজলা-সুফলা মলয়জশীতলা ভূমির কথা যতই উচ্চকণ্ঠে রটাব ওতই জবাবদিহির দায় বাড়বে। প্রশ্ন উঠবে প্রাকৃতিক দানতো উপাদান মাত্র, তা নিয়ে মানবিক সম্পদ কতটা গড়ে তোলা হল। মানুষের হাতে দেশের জল যদি যায় শুকিয়ে, ফল যদি যায় মরে, মলয়জ যদি বিষিয়ে ওঠে মারীবীজে, শস্যের জমি যদি হয় বন্ধ্যা, তবে কাব্যকথায় দেশের লজ্জা চাপা পড়বে না। দেশ মাটিতে তৈরি নয়, দেশ মানুষে তৈরি।’
দেশের প্রকৃতি-নিসর্গ, নদী, মাঠ-প্রান্তর দেশপ্রেমিক কবি অনীক মাহমুদের হৃদয়কে আনন্দে উদ্বেল করে, উচ্ছ্বসিত করে। পাশাপাশি দেশের মানুষের যাপিত জীবন সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা, আশা-আকাক্সক্ষা, স্বপ্ন-কল্পনা ও তাঁর অন্তরকে গভীর ভাবে স্পর্শ করে:
১.
জীবনের পথচলা সহজ নদীর মতো হয়ে যায় যদি
বুকের মিনার জুড়ে গীত যদি হয় কোন সহজ পুরবী
সকলের কানে বাজে। ভাবের মোহিনী খালে কতজন ধন্য হয় বলো?
নীরব বেদনা গুলো হৃদয়ের রঙ খেয়ে বেশ তাজা হয়
অথচ দ্যাখোনা ভেবে সময়ের ফ্রেম ভেঙে তারা কতো
পরাজিত হয়!
ভালোবাসা কোন পাপ নয় অনেক শুনেছ বুঝি!
পেলব ঠোঁটের মাঝে অনেক ক্ষয়েছ হারানো দিনের গান,
তথাপি বুঝোনা কেন আদিম সমাজ কোন পুষ্পদেব নয়
যন্ত্রণার মালিকেরা এখানে বেঁধেছে শুধু নিয়মের ঘর
অশোভন চোখ দেখে তুমি কেন ভয় পাও বলো?
শীতের নিশুতি রাত মল্লিকার বন ছেড়ে চলে গেছে দূরে
নির্ঘুম চোখের ভূমি জলের অভাবে শুধু ফেটে ফেটে গেছে
[দাঁড়াও আসছি আমি: আসন্নবিরহ বিষণ্নবিদায়]২. জীবনটাকে সুতার মতোন পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে
যদি বানানো হতো বা ঘুড্ডির লাটাই কেমন যে হতো!
যদি জীবনের আকাশটা উল্কাঝড়ে সংক্ষুব্ধ ব্যথার ভারে
স্বাতী আর সপ্তর্ষির মালায় বনে যেতো ঝামা তার
কোন ভাইকিং বা স্কাইলাব এর স্পর্শ জুটতো না
এলিয়টের আনরিয়্যাল সিটির গম্বুজে মাথা ঠুকে ঠুকে
অছিয়ত করে যেতে হতো পূর্ব পুরুষের গ্রাম্য সমাধিতে
‘পুঁতে রেখো যদি মরি নিঃসঙ্গ ছোবলে’!
[একাকিত্বের দায়: এইসব ভয়াবহ আরতি]
অনীক মাহমুদের কবিতায় ওঠে এসেছে শ্রমনির্ভর বৃহত্তর জনসমাজের যাপিত জীবন। পল্লিজীবন ও পল্লির ঐতিহ্যের সার্বিক সমন্বয়ে তাঁর কবিতা পাঠকের কাছে নতুন আকর্ষণ হয়েছে। তিনি পল্লির রূপে মুগ্ধ থেকে লৌকিক বিষয়কে তাঁর কাব্যে গ্রথিত করেছেন। ফলে তাঁর কবিতা হয়ে উঠেছে বৃহত্তর সমাজমানসের কণ্ঠস্বর। অবহেলিত অন্ত্যজ সমাজকে স্থান দিয়েছেন তিনি তাঁর কবিতায়। পল্লির জীবনপ্রবাহ তাঁর কবিতায় অকৃত্রিম অন্তরপতায় ওঠে এসেছে। পল্লির বিষয়কে পরিমার্জিতভাবে সংস্থাপন করেছেন তিনি কবিতায়। পল্লির সাধারণ বর্ণনা, পল্লিজীবনের চিত্র, পল্লির মাটি ও মানুষ প্রসঙ্গ পল্লির ঐতিহ্যের বর্ণনা, পল্লিপ্রেমের বিরহ-মিলন, পল্লির কৃষকের ও কৃষিজীবনের বর্ণনা, পল্লি-মাটির মাহাত্ম্য বর্ণনাসহ লোকঐতিহ্য এবং লোকসংস্কৃতির নানা প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গ যথাযথ জীবনাবেগ ও শিল্পাবেগের মাধ্যমে তাঁর কবিতায় ওঠে এসেছে:
নিবিড় আঁখির ভীড়ে জীবনের সুরম্য সঙ্গীত
মালকোষে বাঁধাছিলো, নির্মল আকাশে কালোপীত
ছিলো না কখনো মেঘ, নির্যাতিত বিহগের ডানা;
জীবিত মাছের মতো সময়ের গান ছিলো জানা,
অরণ্য অধরে সুপ্ত নিরামিষ জীবনের হিত
শুভ্র বলাকার মতো এনেছিলো সময়ের জিত
এখন শুধুই দেখি অনাদ্রি আঁখিতে ব্যর্থ হানা।
গান শেষে ফিরে গেলে কেঁদে যায় সকাতর মন,
সুরের পিয়ানো ধরে গ্রাম-গঞ্জ-মাঠে সারাদিন
সকল কথারা ভাসে, দেখে আসে মানুষের ঋণ,
জীবনের বাতায়নে বয়সের প্রথম উন্মন
আজো দেখি নাড়া দেয় শোকাহত প্রিয়ার মতোন,
আমার সেদিন ছিলো অগণিত সুখের শিরীন।
[আমার সেদিন ছিলো: প্রেমবড় স্বৈরতন্ত্রী]
অনীক মাহমুদের জন্ম গ্রামে। গ্রামের অম্লমধুর অনেক স্মৃতি তাঁকে তাড়া করে বেড়ায়। সে স্মৃতিপ্রসঙ্গ এসেছে তাঁর কবিতায়। পল্লিপ্রকৃতি আর পল্লির মানুষ ও মাধুর্য কবির স্মৃতিতে নতুন নতুন মাহাত্ম্য নিয়ে হাজির হয়। তখন তিনি অনুধান করেন যে, অতীত দিনের স্মৃতি বিস্মৃত হওয়া যায় না। মানুষের জীবনে গোপনে গোপনে কাজ করে যায় সে স্মৃতি:
মেঘের আঁচলে মুখ ঢেকে দু চোখে শাওন মাখা কতোটা কঠিন
বৈশাখ দাহের বালা তুমি সহজে বুঝতে পারো কিন্তু সে বোঝে না;
গোমতীর ঘোলাজলে ভিজতে ভিজতে মাছ ধরা ঠান্ডাক্লান্ত
অসহায় জনক ফরাজ আলি শুকনো কাঁথার মধ্যে
বিবস্ত্র সন্তান আক্কাসকে নিয়ে লজ্জানীল হতে দেখে
যখনই সেৎসাহে বলে: ‘লজ্জা না করচ
আঁই তোর পোলা ন বাজান’!
এক মুঠো রৌদ্রের মহিমা কতোটা প্রাণদ হতে পারে
তা সহজে বোঝা যায় কিন্তু সে বোঝে না … …।
[সে: এইসব ভয়াবহ আরতি]
গ্রামীণ প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গ কবিতায় স্থান দিয়ে অনীক মাহমুদ দেশাত্মবোধে নিজেকে সমীকৃত করেছেন এবং দেশাত্মবোধের অর্থকে সত্যিকার অর্থেই অর্থময় করে তুলেছেন। তিনি সমগ্র দেশ ও দেশবাসীকে কবিতায় আপনা থেকে অভিন্ন জ্ঞান করেছেন। এক্ষেত্রে তাঁর কল্পনার স্বকীয়তাও প্রকাশের মাধুর্যে অনুপম। আবহমান বাংলার নিসর্গশোভা ও দেশজচারিত্র্য অপূর্ব রঙে ও রেখায় ফুটে উঠেছে অনীক মাহমুদের কবিতায় যা জাতয়িতাবাদী আন্দোলন ও স্বাধিকার – স্বাধীনতাচেতনার সঙ্গে ও একাত্ম:
রাজাকারের নৌকা ঠুকে
. আলবদরের মাঝি,
খেয়াঘাটের টোলে হাসে
. পঁচাত্তরের গাজী।
আমরা জেলে দূরে থাকি
. মাছের গন্ধ পাই,
শিকস্তি আর পয়ঃস্তিতে
. কোনখানে নাই।
এখন তিনে টানছে হীনে
. চার বোয়ালের ফাতা,
নদীর বুকে হাঁটু পানি
. ডুববে কোথায় ফাতা।
[চার বোয়ালের ফাতা: বৃহন্নলা ছিন্ন করো ছদ্মবেশ]
অনীক মাহমুদের কবিতায় আছে গ্রামীণ জীবনের আবহ, গ্রামীণ জীবনের স্নিগ্ধতা, সজীবতা। গ্রামীণ আবহের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি তাঁর ছোটবেলার জীবন অভিজ্ঞতা বিবৃত করেছেন। তাঁর কবিতায় ওঠে এসেছে ধুলো উড়ানো শৈশব, শৈশব-স্মৃতি। পল্লির প্রকৃতি ও নিসর্গ বর্ণনার পাশাপাশি ঋতুর পালাবদল আর বিভিন্ন ঋতুর সনাক্তকারী বৈশিষ্ট্যের বর্ণনা। সেই সাথে আছে গ্রামীণ জীবন-আবহের একটু আধটু রহস্যের বর্ণনা, বাস্তুভিটা প্রসঙ্গ, নদী, গাছ, ফুল-ফল-ফসলের বর্ণনা:
১.
আমি যদি তোমার নিকটে কোনো সনাতন বৃক্ষ হয়ে তসবি গুণতে থাকি,
তাহলে দেখবে চেয়ে মাটির চিবুক দিয়ে বসে গেছে ব্যথার শেকড়,
ডাঁটোয়ান কিশলয়ে জমে গেছে নামহীন বেদনার ব্যাধি
কেবল বাতাস এলে ফুরফুরে পাতাগুলো নড়ে এলোমেলো,
এবং তখনই আমি তোমার ব্যাকুল চোখে সুখী বোনে যাবো?
আমাকে যদি বা দেখো কোনো নাব্য নদের মতোন
সেখানে দেখতে পাবে মাতাল ছন্দের ভিড়ে একবুক হলদেটে জল,
হতাশার নৌকাগুলো কি বেগে চলছে ছুটে নিরাশার হাটে
মাঝির কোমল কণ্ঠে সুরের মোহন কারুকাজ
বয়না উজান। তথাপি এখানে আমি স্বাভাবিক রবো?
খুব স্বাভাবিক?
[জলহীন মেঘহীন: প্রেম বড় স্বৈরতন্ত্রী]২.
মৌন পাহাড়ে উঠতে আর ইচ্ছে করে না।
বর্ষাহীন শ্রাবণের মতো কদম্বের বাহারি আস্ফালন,
জলহীন নদীর যৌবনে চড়ার ঊর্ণলাভ হাঁটুভঙ্গি,
নিয়ত গরল ভেল দেখতে আর ইচ্ছে করে না।
মায়ার পল্লব ছিন্ন চিতাভস্ম শ্মশানের মতো
বিরান পোড়ো শৈল মিনারে উঠতে আর ইচ্ছে করে না
. ইচ্ছে করে না।
[মৌন পাহাড়ের সূত্রলতা: ভদ্রলোকসংহিতা]
গ্রামীণ প্রকৃতি-নিসর্গ, পরিবেশ-প্রতিবেশ, মানুষ ও মানুষের যাপিত জীবন যখনই অনীক মাহমুদের কবিতায় এসেছে, তখনই তার স্বদেশনিষ্ঠা ও শেকড়ের টান সহজেই অনুভব করা যায়। বাংলার শাশ্বত ঐতিহ্যের নিদর্শন হিসেবে নবান্নের উৎসবের প্রসঙ্গও এসেছে তাঁর কবিতায়। বাংলার ধান-ফসলের দিনে এই নবান্নের উৎসব জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে গ্রাম-বাংলায় বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা ও বিচিত্র অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উদ্যাপিত হয়। আমেরিকায় ‘থ্যাংকস গিভিং’-নামক এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়, সেটিও নবান্নের উৎসব। আমেরিকার প্রথম অভিযাত্রী দল যখন প্রচুর ফসল ফলাতে সক্ষম হলো, তখন থেকেই এই ‘থ্যাংকস গিভিং’ শীর্ষক নবান্নের উৎসব উদ্যাপিত হয়ে আসছে। একইভাবে বিভিন্ন নামে বিভিন্ন দেশে এই উৎসব উদ্যাপিত হয়। যেমন রাশিয়ার ‘রাদুনিৎসা’ শীর্ষক উৎসব। তাছাড়া ইউরোপ, আফ্রিকা, জাপান এবং ইরানেও বিভিন্ন নামে এই নবান্নের উৎসব আয়োজন করা হয়ে থাকে। নবান্নের উৎসব উপলক্ষে হাটে-বাজারে, বটতলায় জমে নবান্নের উৎসব। তদানীন্তন ব্রিটিশ বাংলার জনস্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালক মি. বেন্টলী তাঁর ‘ফেয়ারস অ্যান্ড ফেস্টিভ্যাল ইন বেঙ্গল’ গ্রন্থে মেলাভেদে ৫শ’ থেকে ৫ লাখ পর্যন্ত মানুষের মেলায় সমবেত হওয়ার কথা বলেছেন। গ্রামের জীবনচিত্র অনীক মাহমুদের কবিতায় লোক-ঐতিহ্যকে সঙ্গে করে বিচিত্র প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গ নিয়ে উপস্থাপিত হয়েছে।