উনিশ শ একাত্তর সালের সতেরো ডিসেম্বর ‘দৈনিক পাকিস্তান’ পত্রিকাটি ‘দৈনিক বাংলা’য় রূপান্তরিত হয়। পরের বছর ওই পত্রিকা থেকেই প্রকাশিত হয় ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’। উনিশ শ বাহাত্তর সালের সেই পত্রিকায় ‘একরাত্রি’ অথবা ‘কালরাত্রি’ নামে একটি গল্প প্রকাশিত হয়েছিল। লেখক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হুমায়ূন আহমেদ। সেই পত্রিকাটির পুরনো একটি কপি পেয়ে লেখাটি পড়েছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসে পাকিস্তানি মিলিটারিদের হামলা এবং নির্যাতনের টাটকা গল্প। লেখাটির সরলতা পাঠককে মুগ্ধ করার মতো। আশির দশকে যখন থ্রিলার সাহিত্যের পাঠক ছিলাম তখন হুমায়ূন আহমেদের মিসির আলি সিরিজের ‘দেবী’ উপন্যাসটির পেপারব্যাক সংস্করণ থ্রিলার হিসাবেই কিনেছিলাম। পরে বিভিন্ন পত্রিকার ঈদসংখ্যায় ‘নিষাদ’, ‘নিশিথিনী’, ‘সাজঘর’, ‘অচিনপুর’, ‘অপরাহ্ণ’, ‘একজন মায়াবতী’, ‘আমাদের শাদাবাড়ি’, ‘বাসর’ ইত্যাদি পড়েছিলাম। ‘উন্মাদ’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে পড়েছি ‘এলেবেলে’। এভাবেই হুমায়ূন আহমেদচর্চা চলছিল।
উনিশ শ একানব্বই সালটা বিশেষ গুরুত্বের; ঐ বছর প্রথম বাংলা একাডেমির বইমেলায় গিয়েছি। সেখানে যাওয়ার কারণেই জীবিত লেখক-সাহিত্যিকদের স্বচক্ষে দেখার সুযোগ লাভ করেছি। সেবা প্রকাশনী থেকে যে পরিমাণ থ্রিলার এবং ক্লাসিক সাহিত্যের অনুবাদ কিনেছি, সমসাময়িক হুমায়ূন আহমেদের বইও ঐ পরিমাণই কিনেছিলাম। সে বছর ঢাকার আজিমপুরবাসী নবম শ্রেণীর এক ছাত্রী রেবেকা সুলতানা বীথির সাথে পত্রমিতালি শুরু হয়। আমিও একই ক্লাসে পড়তাম। বীথি ছিলেন হুমায়ূন আহমেদের একজন ভক্ত এবং বইপোকা। হুমায়ূন আহমেদের যখন আশিটি বই প্রকাশিত হয়েছে, তার মধ্যে পঁয়ষট্টিটি বই বীথির পড়া ছিল। তাঁর পত্রগুলোতেও হুমায়ূন আহমেদের ভাষার প্রভাব ছিল অস্বীকার না করার মতো। এ রচনার মাধ্যমে তিরিশ বছর পরে বীথির প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি, তাঁর উৎসাহ এবং অনুপ্রেরণায় আমিও হুমায়ূন আহমেদের বইপড়া বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। গুলিস্তান স্টেডিয়ামের দোতলায় ‘ম্যারিয়েটা’ এবং ‘নতুন কথা’ নামে দুটি বইয়ের দোকান ছিল। আরো একটা ছিল, ‘চলন্তিকা বই ঘর’—ওখান থেকে রাশিয়ান বাংলাবই কিনতাম। ‘নতুন কথা’ থেকে হুমায়ূন আহমেদের ‘শ্রেষ্ঠ উপন্যাস’ এবং ‘সায়েন্স ফিকশন সমগ্র’ কিনেছিলাম। ফুলবাড়িয়া বাসটার্মিনাল থেকে মুন্সীগঞ্জের বাসে ওঠানামা করতাম। সেখানকার একটি সংবাদপত্র বিক্রয় কেন্দ্রের মালিক আমার হুমায়ূন আহমেদপ্রীতি দেখে তাঁর নতুন নতুন প্রকাশিত বই, এবং আমার অপঠিত বইগুলো এনে রাখতেন। শুধু বই না, কবে, কোন পত্রিকায় হুমায়ূন আহমেদ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, স্মৃতিকথা লিখেছেন সেসবও তিনি আমার জন্য যোগাড় করে রাখতেন।
পরে সৈয়দ শামসুল হক, রশীদ করীম, মাহমুদুল হক, শওকত আলী, শওকত ওসমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, রিজিয়া রহমান, হাসনাত আবদুল হাই, আবুল খায়ের মুসলেহউদ্দিন, দিলারা হাশেম, আমজাদ হোসেন, মিরজা আবদুল হাই, সেলিনা হোসেন, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস প্রমুখের লেখার সাথে পরিচিত হওয়ার পরে হুমায়ূনপ্রীতি স্নান হতে থাকে। হওয়াটাই স্বাভাবিক। যদিও এর মধ্যে হুমায়ূন আহমেদের সত্তর-আশিটি বই পড়া হয়ে গেছে। পরে আর তেমনভাবে টানে নাই। শুনেছি, শেষের দিকে তিনি অনেকগুলো ‘ভালো’ উপন্যাস লিখেছেন। সেসব ‘ভালো’ বইয়ের মধ্যে শুধু ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ পড়েছিলাম। এরমধ্যে, আগে কেনা হুমায়ূন আহমেদের বইগুলো সংরক্ষণ করার প্রয়োজনীয়তা হারিয়ে ফেলায় আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে বিলিবণ্টন করে দিয়েছি।
এখানে শরিফার অবস্থাও তাই হয়। দিনে দিনে সন্দেপ্রবণ হয়ে ওঠে। কুবের যেমন দিনে দিনে পঙ্গু মালাকে পাশ কাটিয়ে কপিলার জালে আটকা পড়ে, এখানে মতি মিয়াও রহিমার প্রতি আকৃষ্ট হয়।
হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যমূল্যায়ন এক অর্থে কঠিন কাজ। সত্তর দশক থেকে আহমেদ নূরে আলম নামের একজন লেখক বিভিন্ন পত্রিকায় পাঠকের চিঠিপত্রের উত্তরে মানসিক সমস্যার সমাধান দিতেন। হুমায়ূন আহমেদ এ কাজটি করতেন সরাসরি। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে রসায়ন শাস্ত্রের গবেষণা করতে গিয়েছেন। মনোবিজ্ঞান সাবজেক্টটি খুব ভালো লাগত তাঁর। যুক্তরাষ্ট্রের মনোবিজ্ঞানীরা প্রধানত আচরণবাদী। হুমায়ূন আহমেদ বাঙালি মধ্যবিত্তের আচরণগত দিকটাই তুলে ধরতেন। এ কারণে তাঁর সাহিত্যে এবং টিভিনাটকে চরিত্রেরা আচরণগত দিক থেকে সমাজের পরিচিত কিন্তু অস্বাভাবিক আচরণ প্রকাশ করে। দিনে দিনে বিষয়টি দর্শক এবং পাঠকের কাছে হাসির এবং হাস্যকর হয়ে ওঠে। সাধারণ মানুষেরা বিষয়টি ‘পাগলামি’ বলে মনে করে। পরে যখন রশীদ করীমের সাহিত্যে মনঃসমীক্ষণধর্মী আচরণ এবং সৈয়দ শামসুল হকের রচনায় মনোবিকলনধর্মী আচরণ এবং সংলাপের সাথে পরিচিত হই, তখন আর মার্কিন-আচরণবাদ ভালো লাগে না, বেশ পানসে লাগে। তবে একথা সত্য আমার পড়া হুমায়ূন আহমেদের সেরা উপন্যাসের মধ্যে একটি হলো ‘অপরাহ্ণ’। এটি মধ্যবিত্ত নয়, নিম্নবিত্ত নিয়ে লেখা। কাজেই মধ্যবিত্তের কারিগর বলে হুমায়ূন আহমেদকে একটি শ্রেণীতে আটকে রাখা বোধহয় ঠিক না। তিনি নিম্নবিত্তশ্রেণী এমনকি শূন্যবিত্তের বস্তিবাসীদের চিত্রও ভালো আঁকতে পারতেন। বর্তমান আলোচ্য উপন্যাসটিও ভিন্ন রকম।
হুমায়ূন আহমেদের বইগুলোর একটা বড় সমস্যা মুদ্রণপ্রমাদ। লেখকহিসাবে তিনি মনে করতেন, ছাপা-টাপার দায় প্রকাশকের। এজন্য তিনি প্রুফ দেখতেন না। প্রকাশিত হওয়ার পরে নিজের লেখা নাকি পড়তেনও না। বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে এসব কথা তিনি বলেছেন। সমালোচনাকে গ্রাহ্য করতেন না বলেও তাঁর প্রতি অভিযোগ ছিল।
দুই.
হুমায়ূন আহমেদের ক্লাসিকধর্মী উপন্যাস ‘ফেরা’। এ উপন্যাস তাঁর নিজের নেত্রকোনা, মোহনগঞ্জ, নীলগঞ্জ, সোহাগী ইত্যাদি বৃহত্তর ময়মনসিংহের ভাটি অঞ্চলের পটভূমিতে লেখা। উপন্যাসের ঘটনাকাল সম্ভবত স্বাধীনতার পূর্বেকার, অর্থাৎ পাকিস্তান আমলের। লেখকের ছোটবেলার অথবা জন্মের আগের। রাজনৈতিক গন্ধ না থাকায় বিষয়টি অনুমান করা শক্ত। অভিজ্ঞতার বাইরে গিয়ে লিখলে কিছু সাধারণ বিষয়েও অসঙ্গতি পাওয়া যায়। এ উপন্যাসের শুরুর দিকে একটি অসঙ্গতি রয়েছে। শুরুতেই দেখানো হয়েছে ঝড়-বাদলের রাতে মতি মিয়া সরকার বাড়িতে গিয়ে নিবারণের গান শোনে। বলা হয়েছে বৈশাখ মাস। আবার তখন দেখানো হয়েছে শরিফাকে নীলগঞ্জে চিকিৎসার জন্য নেওয়ার সময় একটা পাকা কাঁঠাল নৌকায় নেওয়া হয়েছে, পাকা আম নেওয়ার আশাও ব্যক্ত করা হয়েছে। বর্তমানে কৃষিবিজ্ঞানের উন্নতির কারণে বৈশাখ মাসে আম পাকা সম্ভব হলেও সে যুগে এ সময় আম-কাঁঠাল পাকার কথা না। আবার এই বৈশাখ মাসেই দেখানো হয়েছে হাওরের পানির প্রবল বর্ষা। কিন্তু পরবর্তী বছরে বর্ষাকালেই পানিবৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে। আসলে বৈশাখ মাস সম্পর্কে নগরজীবনে বেড়েওঠা হুমায়ূন আহমেদের ধারণা স্পষ্ট ছিল না হয়তো।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পঁাঁচালী’র মতোই এখানে সমকালীন রাজনৈতিক আঁচড় নাই। চরিত্রচিত্রণ এবং অনুভূতির দিক দিয়ে উপন্যাসটি পড়ার সময় বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা মনে পড়বে। এখানে ‘পথের পাঁচালী’র হরিহরের মতোই চরিত্র মতি মিয়া এবং মনু। শরিফাকে সর্বজয়ার সাথে মেলানোও যায়। রহিমা যেন ইন্দিরা ঠাকরুন। অপু আর দুর্গার সাথে মিলানো যায় অনুফা-নূরুদ্দীনকে।
আবার মিল খুঁজে পাওয়া যায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মানদীর মাঝি’র সাথে। পদ্মানদীর মাঝিতে আছে আমিন বাড়ি; আর এখানে আছে আমিন ডাক্তার। পদ্মানদীর মাঝিতে ঝড়ে ঘরচাপা পড়ে গোপীর পা ভেঙে গেলে কুবের আর তার শালী কপিলা গোপীর চিকিৎসা করাতে আমিনবাড়ি হাসপাতালে নিয়ে যায় গোপীকে। তারা সেখানে এক হোটেলে রাত্রিযাপন করে। ‘ফেরা’তে শরিফার চিকিৎসা করাতে তাকে মিশনারি হাসপাতালে নিয়ে যায় মতি; সাথে যায় আমিন ডাক্তার। মতি ফিরা আসে; কিন্তু আমিন ডাক্তার প্রায় দেড় মাস সেখানে থাকে শরিফার সাথে। বিষয়টি নিয়ে কানাঘুষাও হয়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কুবেরের স্ত্রী মালা পায়ে খাটো— পঙ্গু। আর এখানে শরিফার পা কেটে ফেলার পরে পঙ্গু হয়ে যায়। মালা পঙ্গু হওয়ার কারণে হীনমন্যতায় ভোগে। সবাইকে পর বলে ধারণা করে। এখানে শরিফার অবস্থাও তাই হয়। দিনে দিনে সন্দেপ্রবণ হয়ে ওঠে। কুবের যেমন দিনে দিনে পঙ্গু মালাকে পাশ কাটিয়ে কপিলার জালে আটকা পড়ে, এখানে মতি মিয়াও রহিমার প্রতি আকৃষ্ট হয়।
কয়েকটি পরিচ্ছেদজুড়ে বাঁধভাঙা বন্যার কথা আছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেখানে নিত্যনৈমিত্তিক, সে চিত্রও ধারণ করেছেন লেখক। বন্যার পরের প্রকট দারিদ্র্যের কথাও তিনি সরল এবং প্রাঞ্জল ভাষায় লিখেছেন।
আবার উপন্যাসটির মিল পাওয়া যাবে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কবি’ উপন্যাসের সাথেও। তারাশঙ্করের নিতাই কবিয়াল গানের কবি, আর ‘ফেরা’র মতি মিয়া গাতক। উভয়েই গানের টানে দেশে দেশে ঘুরে বেড়ায়। কোনো স্থানের মাটি তাদের ধরে রাখতে পারে না। রহিমাকে ঠাকুরঝি এবং পরবতীকালে বিয়ে করা স্ত্রীকে বসন্তের সাথে মেলানো যায়। আমিন ডাক্তারকে কবির বন্ধু রাজুর সাথে মিলিয়ে দেখা যায়।
ওপরের তিনজন মহান কথাসাহিত্যিকের তিনটি উপন্যাসের সাথে মিলে যাওয়া অস্বাভাবিক না; কারণ তিনজনই হুমায়ূন আহমেদের প্রিয় ঔপন্যাসিক। হুমায়ূন আহমেদ বলতেন যে, তিনি প্রতি বছর একবার করে তারাশঙ্করের ‘কবি’ উপন্যাসটি পড়তেন এবং চোখের পানি ফেলতেন। “জীবন এত ছোট কেনে” এই অমোঘ প্রশ্নের আঘাতে চোখে পানি আটকে রাখা কঠিন। তিনজনকেই তিনি প্রিয় লেখক বলে স্বীকার করতেন বলেই মিল খুঁজে পাওয়া যাবে।
আরো মিল খুঁজে পাওয়া যাবে ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’র কোনো কোনো কাহিনির সঙ্গে। বানিয়াচঙ্গ, সোনাফর, আলাল, দুলালদের যেন এই উপন্যাসে ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়।
কিন্তু হুমায়ূন আহমেদের ‘ফেরা’ পড়তে থাকলে দেখা যাবে যে, শেষ পর্যন্ত অনেক গল্প বা উপন্যাসের ভিড় ঠেলে উপন্যাসটি আপন শক্তিতে এগিয়ে চলেছে। শেষ পর্যন্ত অন্য লেখকদের ভুলেই যেতে হয়।
বৃহত্তর ময়মনসিংহের হাওড় অঞ্চলের মানুষের সুখ-দুঃখের গাথা। শুরুতেই শরিফার পায়ের সমস্যায় অসুস্থ দেখা যায়। আমিন ডাক্তারের সহযোগিতায় এবং তারই পরামর্শে মতি তার স্ত্রীকে খ্রিস্টান মিশনারির ডাক্তার নিখিল (নিকলসন)-এর কাছে নিয়ে যায়; দেড় মাস চিকিৎসা চলে। সেখানে আমিন ডাক্তারকেই থাকতে হয় বন্ধুপত্নীর সেবায়। মতি মিয়া দুই দিন পরেই চলে আসে। মাঝখানে সে যাত্রাদলের টানে থানা শহরে থেকে যায়।
মহাকাব্যিক উপন্যাসের মতো অনেক বড় বড় ঘটনা এবং নানা ঘাত-প্রতিঘাতের বৈচিত্র্য আছে এ উপন্যাসে। আছে বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের বন্যা, আছে বন্যাপরবর্তী দারিদ্র্য-দুর্ভিক্ষ, আছে কলেরার মতো মহামারীর ঘটনা। আরো আছে কৈবর্তদের বিদ্রোহ, যে বিদ্রোহে উস্কানি দেওয়ার অভিযোগ আমিন ডাক্তারকে চৌধুরীরা পুলিশ ডেকে ধরিয়ে দেয়। এগারো বছর জেলখেটে একদিন ফিরে আসে আমিন ডাক্তার। তার এই ফিরে আসাতেই উপন্যাসের নাম হয়েছে ‘ফেরা’। এ সময়ের মধ্যে এলাকায় অনেক পরিবর্তন বা উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। আমিন ডাক্তার নিজেই এলাকা যেন আর চিনতে পারে না।
উপন্যাসটি কিন্তু শুরু হয়েছে বৈশাখ মাসের এক ঝড়-বাদলের রাতের বর্ণনা দিয়ে। সহায়তা পাওয়ার আশায় শরিফার স্বামী মতি মিয়া চৌধুরীদের বাড়ি যায়। গিয়ে ঝড়ে-বৃষ্টিতে আটকা পড়ে। নিবারণের গান শুনে মুগ্ধ হয়। মরমী গানের বাণী তার মরমে প্রবেশ করলে কিছুটা আনমনা হয়ে যায়। শরিফার ফোলা পায়ের চিকিৎসা করাতে আমিন ডাক্তারকে সাথে নিয়ে নীলগঞ্জে যায় মতি। সেখানে স্ত্রীকে আমিন ডাক্তারের দায়িত্বে রেখে চলে আসে। দেড় মাসের মধ্যে তাদের ফেরার খবর ছিল না। আমিনডাক্তারের সাথে শরিফার নাম নিয়ে মতির ঘনিষ্ঠ বন্ধু নৈমদ্দিন মাঝি আকারে-ইঙ্গিতে অনেক শোনা কথা বোঝানোর চেষ্টা করে, শেষে একদিন সরাসরি বলেও ফেলে। বন্ধুর মুখে স্ত্রীকে নিয়ে ঠাট্টা শুনে গম্ভীর হয়ে যায় মতি। দেড় মাস পর এক-পা কেটে ফেলার পরে আমিন ডাক্তারের সাথে ফিরে এসে শরিফা আমিন ডাক্তারের সাথে দেড় মাস কাটানোর ব্যাপারে কোনো কৈফিয়ত দেওয়ার চেষ্টা না করে, কোনো অনুতাপ প্রকাশ না করে বরং তাদের বাড়িতে রহিমার মতো একজন গুণবতী মেয়ে এখনো রয়েছে কেন এ বিষয়ে স্বামীকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। শরিফার অনুপস্থিতিতে মতির সংসার গুছিয়ে রেখেছিল রহিমা। শরিফার ফিরে আসার পরে একদিনের নোটিশে রহিমা তার পোঁটলা-পুঁটলি নিয়ে চৌধুরীদের একটা ভাঙ্গা কুঠুরিতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। রহিমার স্বামী মনুর বিয়ের সময়কার কথা আছে, তার নিখোঁজ থাকার কথাও আছে।
হাওর অঞ্চলের কৃষিজীবী পরিবারগুলোর সাংবাৎসরিক চিত্র ধারণ করা হয়েছে এ উপন্যাসে। সাথে আছে পল্লিচিকিৎসক, গ্রাম্য গাতক প্রভৃতি কৃষিনির্ভর কিছু পেশার মানুষের কথা। কয়েকটি পরিচ্ছেদজুড়ে বাঁধভঙ্গা বন্যার কথা আছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেখানে নিত্যনৈমিত্তিক, সে চিত্রও ধারণ করেছেন লেখক। বন্যার পরের প্রকট দারিদ্র্যের কথাও তিনি সরল এবং প্রাঞ্জল ভাষায় লিখেছেন।
তিন.
হুমায়ূন আহমেদের আচরণবাদী মনস্তত্ত্বগত দিক এখানে কিছু বিষয়ে লক্ষ্য করা যায়। রহিমার বিয়ের পরে চৌধুরীদের বাড়ির পাশে কাঁচ বাঁশ দিয়ে তোলা ঘরে কাঁচা বাঁশের গন্ধে রহিমার বিবমিশা বোধকরা [আহমেদ, ১৯৯০: ০০]। এটি গ্রামের মেয়ে হিসাবে রহিমার হওয়ার কথা না। গ্রামের মেয়েদের বাঁশের গন্ধে বমি হয় না, শহরের লেখকের বমিভাবকেই চরিত্রের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।
আমিন ডাক্তারকে এক জায়গায় ভিতু বলা হয়েছে [আহমেদ, ১৯৯০: ২৭৫]। এটি আসলে মতির আত্মশক্তিসঞ্চয়ের একটি কৌশল। মতি মিয়ার এক সময় নিজের কাছে খারাপ লাগে, অস্থির লাগে, উদাস লাগে [আহমেদ, ১৯৯০: ২৮০]।
হাওরকে ‘বিল’ বলা হয়েছে একটি রোমান্টিক দৃশ্যে [আহমেদ, ১৯৯০: ২৮৪]।
আবার একটি দৃশ্যে দেখানো হয়েছে সবাই দূরে দূরে সরে যাচ্ছে [আহমেদ, ১৯৯০: ২৯২]।
আমিন ডাক্তার মতির চিঠি পড়ার সময় চালাকি করে। আজরফের মায়ের কথা না থাকলেও মিথ্যাভাবে বানিয়ে বানিয়ে বলে [আহমেদ, ১৯৯০: ২৯৯]।
ব্যক্তিগতভাবে হুমায়ূন আহমেদের অবস্থান ধর্মঘট জাতীয় একটি প্রতিবাদী কর্মসূচি শুরু করে আমিন ডাক্তার। সে চৌধুরীদের কাছে খুনের ঘটনা জিজ্ঞাসা করবে এবং অপরাধের শাস্তির দাবিতে চৌধুরীদের বাগানে গিয়ে অবস্থান নেবে বলে সেদিকেই এগিয়ে যায়।
মনোযোগ দিয়ে পড়লে উপন্যাসটিতে এমন আরো ছোটখাটো লক্ষণ পাওয়া যাবে। তবে উপন্যাসের শেষের দিকে প্রকৃতি এবং সময় এখানে দুটি অনিবার্য চরিত্র হয়ে উঠেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের বর্ণনা দেওয়ার ভাষাগত শক্তি লেখকের কলমে বেশ ভালোই ছিল। যেমন,
বর্ষার প্রধান প্রস্তুতি শেষ হয়েছে।
সোহাগীর চারপাশে বাঁশপুতে চইল্যা গাছ ঢুকিয়ে মাটি শক্ত করা হয়েছে। প্রবল হাওয়ায় যখন হাওরের পানি এসে আছড়ে পড়বে সোহাগীতে তখন যেন মাটি ভেঙে না পড়ে।
উত্তর বন্দ সবচে নিচু। সেটি ডুবল সবার আগে। তারপর একদিন সকালে সোহাগীর লোকজন দেখল যেন মন্ত্রবলে চারদিক ডুবে গেছে। থৈ থৈ করছে জল। হুম হুম শব্দ উঠছে হাওরের দিক থেকে। জঙ্গলা ভিটার বাঁশ আর বেত বনে প্রবল হাওয়া এসে সারাক্ষণ বোঁ বোঁ শোঁ শোঁ আওয়াজ তুলছে। চিরদিনের চেনা জায়গা হঠাৎ করে যেন জেগে উঠেছে সবুজ রঙের ছোট্ট ‘সোহাগী’।
নাইওরীদের আসবার সময় হয়েছে। [আহমেদ, ১৯৯০: ৩০৫]।
এখানে লক্ষ্যণীয় যে হুমায়ূন আহমেদের এই উদ্ধৃতিতে তাঁর অন্যতম প্রিয় লেখক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গদ্যের কথাই মনে পড়ে যায়। তবে নতুন অনুচ্ছেদের একেবারে শেষের বাক্যটি একেবারে হুমায়ূন আহমেদীয়, তাতে কোনো সন্দেহ নাই। এরপরে দশম পরিচ্ছেদে আবার নিসর্গের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য স্থান পেয়েছে শুরুর দিকেই। এখানে সাপের উপদ্রবের কথাও আছে। অনেকেই জানেন বাংলাদেশে বিষধর সাপের উপদ্রব ময়মনসিংহ অঞ্চলেই বেশি, লেখক সে দিকটি স্বাভাবিকভাবেই তুলে এনেছেন।
সিরাজ মিয়ার একটি বকনা বাছুর সাপের হাতে মারা পড়েছে। [আহমেদ, ১৯৯০: ৩০৮]।
একাদশ পরিচ্ছেদের শুরুতেও বন্যার কথা:
সোহাগীতে পানি ঢুকেছে এই ভয়রাবহ খবরটি চৌধুরীদের পাগল ছেলে প্রথম টের পেল।” [আহমেদ, ১৯৯০: ৩১১]।
দ্বাদশ পরিচ্ছেদে শুরুতেই আছে দুর্ভিক্ষের কথা:
ভাত না খেয়ে বাঁচার রহস্য সোহাগীর লোকজনের জানা নেই। চৈত্রমাসের দারুণ অভাবের সময়ও এরা ফেলে ছড়িয়ে তিন বেলা ভাত খায়। এবার কার্তিক মাসেই কারো ঘরে একদানা চাল নেই। জমি ঠিক করার সময় এসে গেছে, বীজ-ধান দরকার। হালের গরু দরকার। [আহমেদ, ১৯৯০: ৩১৪]।
এই অধ্যায়েই ভেদবমি অর্থাৎ কলেরার মহামারীতে রহিমার মৃত্যু হয়। গ্রামের আরো ছয়জনের মৃত্যুসংবাদ লেখক দিয়েছেন। গ্রামীণ তান্ত্রিক চিকিৎসাপদ্ধতির কথাও আছে।
গ্রাম বন্ধন দেয়ার জন্য ফকির আনতে লোকজন গেছে। ফকির শুধু গ্রাম বন্ধনই দিবে না ওলাওঠাকে চালান করে দেবে অন্য গ্রামে। অমাবশ্যার রাত্রি ছাড়া তা সম্ভব নয়। ভাগ্যক্রমে আগামীকাল অমাবশ্যা। [আহমেদ, ১৯৯০: ৩১৫]।
ত্রয়োদশ অধ্যায়ে আবার ভাতের কথা। এখানকার ভাষা একেবারে নির্মেদ।
ভাতের কষ্ট বড় কষ্ট।
নূরুদ্দীনের পেটে সারাক্ষণের ভাতের ক্ষিধে লেগে থাকে। শরিফা রোজই বলে, আজরফ টেকা পয়সা লইয়া আসুক দুই বেলা ভাত রানমু।
কোন দিন আইব?
কবে যে আসবে তা শরিফাও ভাবে। কোনই খোঁজ নেই। নূরুদ্দীন গয়নার নৌকায় রোজ দু বেলা খোঁজ করে। মাঝে মাঝে চলে যায় লাল চাচীর বাড়ি।
দুপুরে কি রানছ চাচী? ভাত?
না রে। জাউ। খাবি জাউ? দেউ এক বাটি?
নাহ।
নূরুদ্দীন খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, রাইতে ভাত হইবনি চাচি? [আহমেদ, ১৯৯০: ৩১৭]।
সচেতন পাঠকের এখানে বিরক্তি লাগবে বানানের ত্রুটি আর বিরামচিহ্নের অসতর্ক প্রয়োগে। এটা লেখকের আত্মসচেতনতা নয়, আত্মগরিমার ফল।
উপন্যাসের একেবারে শেষে একটি হত্যারহস্যের উন্মোচন করা হয়েছে। জোতদার বা ভূস্বামী চৌধুরীদের বাড়ির একজন নববধূকে হত্যা করে পানিতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সে লাশটি নূরুদ্দিন মাছ ধরতে গিয়ে দেখে ভয় পেয়েছিল। তবে সে ঘটনাটিকে স্বপ্ন অথবা চোখের ধাঁধা বলে মেনে নিলেও আমিন ডাক্তার খুনের ঘটনাটি তাকে খুলে বলে। এবং ব্যক্তিগতভাবে হুমায়ূন আহমেদের অবস্থান ধর্মঘট জাতীয় একটি প্রতিবাদী কর্মসূচি শুরু করে আমিন ডাক্তার। সে চৌধুরীদের কাছে খুনের ঘটনা জিজ্ঞাসা করবে এবং অপরাধের শাস্তির দাবিতে চৌধুরীদের বাগানে গিয়ে অবস্থান নেবে বলে সেদিকেই এগিয়ে যায়।
এ উপন্যাসে যে হুমায়ূন আহমেদকে পাওয়া যায়, তিনি মধ্যবিত্তের নিপুণ শিল্পী নন, মধ্যবিত্তের কারিগর নন। কৃষিজীবী গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবনসংগ্রামের শিল্পী হিসাবেই তাঁকে পাওয়া যায়।
সহায়ক গ্রন্থ:
১। হুমায়ূন আহমেদ: ফেরা: শ্রেষ্ঠ উপন্যাস: বিদ্যা প্রকাশ, ঢাকা। প্রথম প্রকাশ-১৯৯০।