গল্প লেখার আগে লেখকের বিপুল প্রস্তুতির বিষয় থাকে, জমিয়ে গল্প বলার অভ্যাসও। দীর্ঘ পরিকল্পনা শেষে, খুব জমিয়ে গল্প বলেন দীক্ষিত লেখক। আবার কেউ কেউ পরিকল্পনাহীন শুরু করেন, শেষ হয় পরিকল্পিত গল্পের মতোই বিস্ময়সমেত। হুমায়ূন আহমেদ এই শেষোক্ত ধারার লেখক। এ গল্পকার গল্পে জীবন চিত্রায়িত করেন, ফুটিয়ে তোলেন মানুষের অন্তর্দ্বন্দ্ব। তাঁর গল্পে কথা বলে সমাজের ব্রাত্যজন থেকে শুরু করে উচ্চবৃত্তও। ঘটনার ঘনঘটা এবং বর্ণনার বাহুল্য তাঁর গল্পে নেই। কথক সেটুকুই বলেন, যেটুকুর অভাবে পাঠক গল্পের পরম্পরা অনুধাবনে ব্যর্থ হতে পারেন। পাঠকের সঙ্গে লেখকের আন্তঃযোগাযোগের সূত্র এ লেখক রক্ষা করেন চাতুর্যহীন সততায়। তাঁর গল্প নির্মেদ, মিতবাকশৈলীর।
হুমায়ূন আহমেদ গল্প বলার সময় চরিত্রকে স্রষ্টার ইচ্ছার প্রতি সমর্পিত রাখেন না। চরিত্রগুলো স্বমহিমায় প্রাণবন্ত। তাঁর গল্পে যতটা ঘটনার বিবরণ থাকে, তারও বেশি থাকে ব্যক্তির অন্তর্দ্বন্দ্ব। একাধিক চরিত্রের মনোবিকলন, আকাঙ্ক্ষা, রিরংসা ও প্রতিহিংসার অকৃত্রিম প্রকাশ তাঁর গল্পে মেলে। রঙ চড়িয়ে গল্পকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার চেষ্টা তাঁর থাকে না। গল্প বলেন স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে। বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলায় তাঁর অনীহা লক্ষণীয়। সমাজে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর অসম্পাদিত রূপই ফুটে ওঠে তাঁর গল্পে। সাধারণত যে কথা মানুষ কাউকে বলতে গেলে সামান্য পরিবর্তন করে নেয়, সে কথাও অপরিবির্তত অবস্থায় তাঁর গল্পে দেখা যায়। সে রকম একটি গল্প ‘রূপা’। গল্পটি রেলস্টেশনে বসেই শোনেন কথক। মূল কথকের জীবনের একটি অলঙ্ঘনীয় পরিণতি ও সংশোধন-অযোগ্য ভুলের কাহিনি এটি। মূল কথক ভালোবাসেন একজনকে, ভালোবাসার কথা জানান আরেক জনকে। সঠিক তথ্য সংগ্রহ না-করে কেবল একটি ভুল তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ঝুঁকি নেন। তথ্য যাছাই করার আগেই অনাকাঙ্ক্ষিত এক নারীর কাছে নিজেকে সমর্পণ করে বসেন। যাকে তিনি ভালোবাসতেন, তিনি জানতেই পারেন না মূল কথকের মনের কথা, স্ত্রীও কোনো দিন জানতে পারেন না—তার ভালোবাসার আসল মানুষ কে? বিস্ময়ের বিষয়—সে নারী তার বিয়ের প্রস্তাবে রাজিও হন। তাকে নিয়েই সংসার করেন কথক ‘ভদ্রলোক’। রেলস্টেশনে বসে বাধ্য হয়ে গল্পটি শোনা বলে ভদ্রলোকের নামটিও জানা হয় না। আর এই সহজ-সরল ভদ্রলোক একটি দার্শনিক তত্ত্ব প্রকাশ করেন—‘পুরুষদের রূপের প্রতি মেয়েরা কখনো আকৃষ্ট হয় না। পুরুষদের সব কিছুই তাদের চোখে পড়ে—রূপ চোখে পড়ে না’। বস্তুগত অর্থে এ সূত্রটি সমর্থনযোগ্য। চুম্বকের ধর্ম—চুম্বকের সমমেরু পরস্পরকে বিকর্ষণ করে, বিপরীত মেরু করে আকর্ষণ। নারী রূপের প্রতীক, তাই বিপরীত লিঙ্গের রূপের প্রতি তারা আকর্ষণ বোধ করে না। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি তার দাবি থাকে তার কাঠিন্য, প্রেম এবং নির্ভার আশ্রয়ের জন্য। তীব্র প্রেম, ঘৃণা, চিকিৎসাবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, গোয়েন্দা তত্ত্বের মিলিত রূপ ‘চোখ’। গণিতজ্ঞ আর শিল্পীর দাম্পত্য জীবনের করুণ ট্র্যাজডিমিশ্রিত এ গল্প। এ গল্পের বিষয়বস্তু মর্মান্তিক, হৃদয়সংবেদী ও বিজ্ঞানভিত্তিক। গল্পের রহস্য উন্মোচনকারী মিসির আলি এখানে গোয়েন্দা নন, নন মনোবিজ্ঞানীও। কিন্তু এসব গুণের সমন্বয় তাঁর চরিত্রে ঘটেছে। ফলে রহস্য উদ্ঘাটনের কৃতিত্ব তিনি একা নেন না, কৃতিত্বের ভার অন্যকেও দেন। গল্পের মূল চরিত্র রাশেদুল করিম, স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা তীব্র। সে স্ত্রী তার চোখ দেখে ভয়। স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসায় অন্ধ রাশেদুল করিম স্ত্রীকে ভয় থেকে মুক্তি দিতে গিয়ে নিজের চোখ নিজেই নষ্ট করেন। স্ত্রী তার ভালোবাসার বিষয়টা উপলব্ধি করে না, বরং স্ত্রীর মনে হয় রাশেদুল করিম একজন পিশাচ। রাশেদুল করিমের স্ত্রী জুডির একটি উক্তি, ‘এই লোকটা পিশাচ। আমি প্রমাণ পেয়েছি। কেউ বিশ্বাস করবে না। কিন্তু আমার কাছে প্রমাণ আছে’। প্রমাণ আছে কিন্তু কেউ বিশ্বাস করবে না কেন? কারণ, মানুষ নিজের অভিজ্ঞতার বাইরের সত্য কখনো গ্রহণ করতে পারে না। তাই সমাজের বিচণ শ্রেণীও সাধারণ নিয়মের বাইরের সত্য গ্রহণে অসমর্থ্য। নতুন চিন্তা ও অভ্যাসকে সমাজ সহজে গ্রহণ করে না। এ গল্পের চরিত্রগুলোও এর ব্যতিক্রম নয়। এমনকি, যে রাশেদুল অবচেতন মনে নিজের চোখ গেলে দেন, তারও নিশ্চিত ধারণা—স্ত্রী জুডিই তার চোখ নষ্ট করেছেন। হুমায়ূন আহমেদের লেখক সত্তার কৃতিত্ব এখানে—কেবল দৃশ্যমান মানবাচরণ নয়, অবচেতন মনের খবরও পাঠককে জানান।
মানুষের অভিজ্ঞতার বাইরের বিষয় গ্রহণে অসামর্থ্যরে আরেকটি গল্প ‘নিউটনের ভুল সূত্র’। মনোবিকলনের বিশেষ মুহূর্তে জগতের সমস্ত নিয়ম-কানুনকেই মনে হয় ভুল। অবচেতন মনে মানুষ অনেক রকম সত্যের মুখোমুখি দাঁড়ায়। চিন্তার রেখা যখন অভিন্ন গতি পায়, তখনই কেবল সমমনার উপলব্ধ বিষয় নিজের উপলব্ধিতে ধরা পড়ে। এ গল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র অমর। তার মনে হয় নিউটনের মাধ্যাকর্ষণসূত্র ভুল। কারণ, অমর বাবু একটি নির্দিষ্ট সময় শূন্যে ভেসে থাকতে পারেন। বিষয়টা কেউ বিশ্বাস না করলেও একই স্কুলের ‘হেডস্যার’ সে দৃশ্য দেখেন, বিশ্বাসও করেন। কিন্তু সে সত্য কাউকে প্রকাশ করতে পারেন না। সব সত্য সব সময় প্রকাশ করা যায় না। করলে সমাজে পাগলের বদনাম নিয়ে বাঁচতে হয়। বিষয় নির্বাচনে হুমায়ূন আহমেদ নির্বিচারী। চরাচরের কোনো বিষয়ই তাঁর কাছে মূল্যহীন নয়। তাই পারিবারিক খুনসুটি থেকে শুরু করে বিজ্ঞান, অর্থনীতি, যৌনতা, রাজনীতি, সমাজনীতি এমনকি, ব্যক্তির গোপন কাঙ্ক্ষাও তাঁর গল্পের বিষয়। পারিবারিক খুনসুটি ও সামাজিক স্তর বিন্যাস এবং মানুষের অসহায়ত্ব, মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা, ঘৃণা, অনুরাগের মিথস্ক্রিয়ায় লিখেছেন, ‘জীবনযাপন’। এ গল্পে অসম বয়সী দম্পতি আর অসহায় স্ত্রীর ছোট ভাইয়ের জীবনযাপন চিত্রায়িত। বোনের সংসার টেকানো, আর নিজের একটু খানি আশ্রয়ের জন্য দুলাভাইয়ের যেকোনো ধরনের নিপীড়ন মুখ বুজে সহ্য করে কথক। তাই গভীর রাতে বৃষ্টির মধ্যে দুলাভাইয়ের জন্য সিগারেট এনে যখন কথক বোন বিনুর সামনে দাঁড়ায়, বিনু জানতে চায়, ‘সিগারেট ভিজে যায়নি তো’? তখন অসহায় কথককে গাঢ়স্বরে বলতে শুনি, ‘আমি ভিজেছি, সিগারেট ভিজেনি’। এরপর বিনু হাসে, সে হাসি দেখে ভালো লাগে কথকের।
ইতিহাস চেতনা তার গল্পের একটি বিশেষ দিক। মুক্তযুদ্ধকালীন ঘটনার বর্ণনা রয়েছে ‘১৯৭১’ গল্পে। গ্রামের পর গ্রাম যখন পাকিস্তানি বাহিনী এবং দেশীয় আলবদর, রাজাকারদের নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার তখন এক জন আজিজ মাস্টার মাথা উঁচু করে দাঁড়ান। ‘খাদক’ অতিশোয়োক্তি আর জীবন নিয়ে প্রহসনের গল্প। মানুষের বাজির কাছে মানবিক গুণও তুচ্ছ। খাদক গল্পে হুমায়ূন সে স্বাক্ষরই এঁকেছেন। নিতান্ত দরিদ্র মতি মিয়া বাজি জেতার জন্য আধমণ মাংস একা খায় অনেক কষ্ট করে। পাশে বসে থাকে ‘পেট বের হওয়া হাড় জিরজিরে কয়েকটি শিশু। চোখ বড় বড় করে বাবার খাবার’ দেখে। খাদক মতি জীবন বাজি রেখে একা আধমণ মাংস একা খেলেও অভুক্ত শিশুদের মুখে এক টুকরো মাংস তুলে দেওয়ার যোগ্যতা তার নেই। এখানে তার বাজি জেতার পণ, সন্তানের মুখের দিকে তাকানো অপরাধ। তাছাড়া যারা বাজি ধরে, বাজিতে জেতাই তাদের পণ; মানবিক গুণ তাদের কাছে তুচ্ছ। তদুপরি কথক নিজেও সচেতন অধ্যাপক। তবু তার পক্ষে সম্ভব হয় না, মানবিক গুণসম্পন্ন হয়ে মতির মাংস ভক্ষণ থামিয়ে তার অভুক্ত শিশুদের মুখে খাওয়ার তুলে দিতে কাউকে প্রণোদিত করতে। এই-ই সমাজের নিয়ম। সমাজের সম্পদশালীদের ইচ্ছার ওপরই নির্ভর করে বাকিদের জীবনজীবিকা। সম্পদশালীদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাওয়ার সামর্থ্য সবার থাকে না। এ গল্পের অধ্যাপক কথকও তার ব্যতিক্রম নয়। যে বিষয়টি নিজের কাছে অমানবিক ঠেকে, সে বিষয়টিও সমাজের উঁচু তলার মানুষকে বোঝাতে পারেন না কথক। পাছে নিজের সম্মানটুকু যায়, ণিকের আশ্রয়টুকু হারাতে হয়। ‘খাদক’ গল্পের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ‘কবি’ও। কবি আপন সৃষ্টির আনন্দের বিভোর। ধ্যানমগ্ন। সন্তানের প্রতি অমোঘ টান, অসীমও। কিন্তু সে সন্তান অসুস্থ, তার করুণ মিনতি কবির কানে পৌঁছায় না। কবি বলেই সে ধ্যানমগ্ন, সে ধ্যান আত্মমগ্নতার; কিন্তু মানবকল্যাণের পে তার কোনো তুল্যমূল্য নেই। মানুষ প্রায় নিজেকে অতিগুণসম্পন্ন হিসেবে প্রকাশ করতে চায়, চায় নিজের অনন্য প্রতিভার খবর সবাইকে জানাতে। জানায়ও। উপকার করে দশজনের, আনন্দ দেয় সমাজের দশজনকে কিন্তু স্বজনদের সময় কাটে নিরানন্দে।
‘মন্ত্রীর হেলিকপ্টার’ রাজনৈতিক দূরদর্শিতার আড়ালে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগের গল্প। যাদের ভোটে মন্ত্রীর মতার শিখরে ওঠেন, সময়ে তাদেরকে মনে হয় বোঝা। রাজনীতিবিদরা বক্তৃতার তোড়ে শ্রোতার মন ভোলান, কিন্তু তাদের দুঃখ-কষ্ট শোনার সময় তাঁদের কখনোই হয় না। তাই প্রতিশ্রুত বিষয়ও নেতাদের মনে থাকে না। নেতারা নির্বাচনের আগে অর্থ খরচ করেন, নির্বাচিত হওয়ার পর সে অর্থোদ্ধার করে নিজেদের ভোগবিলাসে ব্যয় করেন। কিছু মানুষের স্বভাব নিজের বা স্বজনের যে কোনো কৃতিত্ব অন্যকে জানানো। সে কাজ সহজে হয় না অনেক সময়। তাই কখনো-কখনো ছলনার আশ্রয় নিতে হয় তাকে। মানুষ নেইও। মানুষ যখন নিজেকে দশজন থেকে ভিন্ন মনে করে, তখন সে ভিন্ন রূপ সবাইকে জানাতে চায়। জানানোর জন্য যেস ত্রে প্রয়োজন তা সব সময় প্রস্তুত থাকে না। ফলে মানুষ তার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে নেয়। সে রকম গল্প ‘রহস্য’’। এ গল্পে স্ত্রীর লেখকসত্তা আর গানের প্রতিভা জানানোর জন্য তক্ষকের ডাককে উপলক্ষ করা হয়েছে মাত্র। মানবচরিত্রে একটি বিশেষ দিক কাঠিন্য। বিশেষত যখন কোনো বিশেষ দায়িত্ব পালন করে সে। সবাই সংকটে, বিপদে তার সাহায্য চায়। দুর্যোগ যখন সব কিছু ছাপিয়ে সবার ওপরই নামে, তখন সংসারের দায়িত্বে থাকা কঠিন মানুষটিও গলে। অন্যরা সংকটে পড়ে তার আশ্রয় চায়, কিন্তু সে সংকটে পড়লে কান্নাই তার একমাত্র উপায়।
‘বান’ গল্পে সে সত্যই ফুঠে ওঠে। বানের রাতে রহমান ভয়ার্ত মা-দাদির আচরণে বিরক্তি প্রকাশ করে সত্য, কিন্তু সর্বস্বান্ত হয়ে নিজেও কেঁদে ওঠে। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার জটিলতা, রাষ্ট্রীয় প্রতারণা, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন নিয়ে লিখেছেন, ‘মন্ত্রীর হেলিকপ্টার’, ‘একজন সুখী মানুষ’, ‘জুয়া, ‘খেলা’। মানবিক প্রেম, মানুষের বিচিত্র স্বভাব, আত্মপ্রকাশ, বিজ্ঞান, রহস্য, প্রকৃতির বিভিন্ন রীতিনীতি নিয়ে লিখিত গল্প ‘‘পিঁপড়া’, ‘একটি নীল বোতাম’, ‘অচিন বৃক্ষ’র মতো বিচিত্র গল্প। মানবজীবনে আধ্যত্ম্যসংকট একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। হুমায়ূন আহমেদের গল্পে আধ্যাত্মিক চেতনা কখনো কখনো প্রবল। ‘চোখ’, ‘১৯৭১’ গল্পের চরিত্রগুলোকে কখনো-কখনো স্ববিরোধী আচরণ করতেও দেখা যায়।
শিল্পীর মৌল দায় জীবনের স্বরূপ চিত্রায়ণ। সে চিত্রায়ণে যে কথাশিল্পী যত দক্ষ, তার সাহিত্যকর্ম পাঠকমনে তত দাগ কাটতে সক্ষম। কথাশিল্পীর কাজ মানবচরিত্রের সেসব বিচিত্র অভিজ্ঞতা ও নিজের অভিজ্ঞান গল্পে চিত্রায়িত করা। হুমায়ূন আহমেদ বিচিত্র অভিজ্ঞতাকে গল্পের বিষয়বস্তু করে তোলেন। তাঁর গল্পের কথক চরিত্র অধিকাংশ সময়ই নির্মোহ থাকে। সব কিছুতেই তার নিরাসক্তি। এ ধরনের নিরাসক্তি নিয়ে গল্প বলার ঝুঁকি অনেক। যে চরিত্র সম্পর্কে তাঁর ঔদাসীন্য গল্পকার নিজেই কবুল করেন, সে চরিত্রের প্রতি পাঠকের সহানুভূতি কাঙ্ক্ষা করেন কী করে? তাঁর ভাষা সম্মোহক। একজন কথাশিল্পীর মহত্তম কাজ তাঁর সাহিত্যকর্মের উপযোগী ভাষা তৈরি করা। প্রকৃত গল্পকার স্বসৃষ্ট ভাষায় কথা বলেন, অন্যের ভাষার প্রতি সম্মান দেখান। অন্যের সৃষ্ট ভাষায় তাঁর পথ চলা হয় না। গল্পকার স্বসৃষ্ট ভাষায় গল্প বোনেন বলেই, বড় গল্পকারের নাম ছাড়াও তাঁর গল্পশৈলী পাঠক সহজে শনাক্ত করতে পারেন। হুমায়ূন আহমেদের ভাষা তাঁর সৃষ্টভাষা। ফলে তাঁর যেকোনো গল্পের প্রথম দুটি বাক্যে ধরা পড়ে তাঁর ভাষাশৈলী। ছোট ছোট বাক্যে তিনি গল্প বোনেন। সহজসরল শব্দযোগে তিনি কথা বলেন। পাঠক শুরুতেই সম্মোহিত হয়ে পড়েন।
চরিত্রগুলো সহজ ও অকপট। জটিল চরিত্র তাঁর গল্পে নেই। গল্প পাঠের সময় যে কোনো পাঠক তাঁর চরিত্রের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যেতে পারেন। সেখানে কোনো রুচি, শ্রেণীবিন্যাস বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। প্রাকরণিক দিক থেকে তাঁর গল্প প্রথাসম্মত। প্রথাভাঙা বা নিরীক্ষার নামে গল্পকে গল্পহীন করে তোলার কোনো চেষ্টা তাঁর মধ্যে নেই। একটি গল্পে একটিই ঘটনার বিবরণ; একরৈখিকতাই তাঁর গল্পের মৌল বৈশিষ্ট্য। বহুরৈখিকতার নামে গল্পের ভেতর ঘটনার ঘনঘটা নেই। নেই একাধিক গল্পের বীজ। ফলে দ্রুত তাঁর গল্পের মর্মোদ্ধার সম্ভব। কষ্টকল্পনার কসরৎ না থাকায় প্রথম পাঠেই তাঁর গল্পের মর্মমূল স্পর্শ করা যায়। গল্প একরৈখিক হওয়া তাঁর পরিণতিও স্বাভাবিক ও স্বচ্ছন্দ্য। গল্পের শুরু যেমন আকস্মিক, শেষও তেমন; অনিবার্যও। কোনো জটিলতা নেই, তবে একধরনের ঘোর আছে। সে ঘোর পাঠককে ধরে রাখে গল্পপাঠ শেষেও গল্পের রেশে। তাঁর গল্পের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হাস্যরস ও ব্যঙ্গ রূপ। খুব কঠিন কথাও হাস্যরস ও ব্যঙ্গ রূপের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। কোনো চরিত্রের প্রতি লেখকের বিশেষ কোনো পপাত থাকে না। ফলে পাঠক স্বাধীনভাবে তাঁর গল্পে যে কোনো চরিত্রবিকাশের পথে সঙ্গী হতে পারে। লেখক নিজের চিন্তা কারও মধ্যে সঞ্চার করেন না। পাঠকের রুচিকেও বাধাগ্রস্ত করে না তাঁর রুচিবোধ। তবে অতিমাত্রায় বিশেষ চরিত্রের প্রতি নিস্পৃহ মনোভাব এবং ঔদাসীন্য কথকের প্রতি পাঠককে বীতশ্রদ্ধ করে তোলে। হুমায়ূন আহমেদ গল্পে জীবনকে চিত্রায়িত করেন। ফুটিয়ে তোলেন সমাজ-রাষ্ট্র ও ব্যক্তির বহিরাঙ্গ ও অন্তর্লোকের বিষয়-আশয়। তবে সমাজের বহিরাঙ্গ চিত্রায়ণের চেয়ে ব্যক্তি মনোবিকলন অঙ্কনে তাঁর আগ্রহ বেশি। ফলে তাঁর গল্প হয়ে উঠেছে, অনেকটা ব্যতিক্রমী, মনস্তাত্ত্বিক এবং বিজ্ঞানমনস্ক ব্যক্তিত্বের রুচির পরিচায়ক। বাকচাতুর্যে অনীহ এ কথাশিল্পী মানুষের মুখের ভাষা প্রয়োগে অকৃত্রিম।
তাঁর গল্পে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের ভাষা অবিকৃতভাবেই গৃহীত। গল্পের আন্তঃসংগঠনে কোনো অলঙ্কারের রঙ চড়ানোর ইচ্ছা তাঁর নেই, সাধারণ বর্ণনাই বুননগুণে হয়ে ওঠে অলঙ্কার। গল্পের চরিত্র এবং পাঠকের একাত্মতায় একেকটি গল্পের শরীর ও অন্তরাত্মার সৃষ্টি। রবীন্দ্রনাথ কথিত ‘নাহি তত্ত্ব, নাহি উপদেশ’ সংজ্ঞার প্রতি হুমায়ূন আহমেদ আনুগত্য দেখাননি। তাঁর গল্পে তত্ত্ব যেমন আছে, তেমনি আছে প্রতিতত্ত্বও। আবার উপদেশের প্রমাণও মেলে। গুটিকয়েক বোদ্ধাপাঠকের প্রশংসার চেয়ে সাধারণ পাঠকের হৃদয় জয় করাই তাঁর লক্ষ্য। এ কথা অস্বীকার করা যায় না—এই ক্ষেত্রে হুমায়ূন আহমদ ঈর্ষণীয়। এখানেই তাঁর গল্পের সার্থকতা। হুমায়ূন আহমেদ জটিল জীবন চিত্রায়ণ করেছেন খুব সহজে। শেষ পর্যন্ত তাঁর গল্প হয়ে উঠেছে জটিল জীবনের সহজ গাথা।