কথাসাহিত্যের বিপুল ভাঁড়ার হুমায়ূন আহমেদ রেখে গেছেন আমাদের জন্য—যার দিকে তাকালে বিস্মিত হতে হয়। বিস্মিত এই জন্যে না যে, তিনি প্রচুর লিখেছেন। বিস্মিত এজন্যেই যে, তার প্রতিটি লেখাই পঠিত। বিপুলভাবে পঠিত। হুমায়ূন নিজেও বলতেন, মরার পর তাঁর লেখার কী হবে, এই নিয়ে তিনি ভাবিত নন। তাঁর সব লেখা পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে পারছেন, এতেই তাঁর আনন্দ।
যদিও হুমায়ূন আহমেদের নামের পাশে প্রশংসার পাশাপাশি নিন্দাও জুটেছে বিস্তর। কিন্তু সুখের কথা এই যে, নিন্দামন্দ জীবিতাবস্থায় তাঁর কলমের গতিকে স্থিমিত করতে পারেনি। মাঝে মাঝে ভাবি, কী এমন জাদু আছে তাঁর লেখার মধ্যে, যার জন্যে তার সামান্য বিষয়ে লেখাও অসামান্য লেগেছে পাঠকের কাছে। অথবা অন্যভাবে বলা যায়, কেন বারবার হুমায়ূন পড়ি? একই লেখা বহুবার পড়লেও কেন প্রথম পাঠের মতোই মুগ্ধ করে?
আহমদ ছফা এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, (আহমদ ছফা বললেন: পৃষ্ঠা-৪৭) ‘তাঁর (হুমায়ূন আহমেদ) প্রথম বই যখন বেরিয়েছিল, আমিই সবচাইতে বেশি উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছি। তখন আমার মনে হয়েছিল হয়তো হুমায়ূনের মধ্যে কালে কালে আমরা চেখভের মতো একজন প্রতিভার সন্ধান পাবো।’ বলাবাহুল্য, আহমদ ছফার স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল, যা পরের কথাগুলোতে ব্যক্ত হয়েছে। আর আমরাও বলবো না, হুমায়ূন আহমেদ চেখভের মতো একজন প্রতিভাবান ছিলেন।
কৌতূহলের জায়গাটা হলো তাঁর (আহমদ ছফা) মনে চেখভের কথা এসেছিল কেন? চেখভের কামিলিয়াতি কোথায়?
সৈয়দ মুজতবা আলী চেখভ (যদিও সৈয়দ সাহেব লিখতেন ‘চেখফ’) সম্পর্কে এক গদ্যে লিখেছেন, ‘চেখফের বহু ক্লাইমেক্স্ বর্জিত গল্পের ভারকেন্দ্র এমনভাবে সমস্ত গল্পে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে যে, পাঠক রসিয়ে রসিয়ে নিশ্চিন্ত মনে গল্পগুলো পড়তে পারে।’
অনুমান করি, আহমদ ছফা এই ‘রসিয়ে রসিয়ে’ পড়ার বিষয়টিই হুমায়ূন আহমেদের লেখায় লক্ষ করেছিলেন। তাই উপরিউক্ত কথাটি বলেছিলেন। যাই হোক, আমাদের কথা হচ্ছে—হুমায়ূন আহমেদের শব্দে শব্দে রস ছিল। তাঁর লেখাগুলো রসিয়ে রসিয়ে পড়া যেতো। উপভোগ করা যেতা। তাই তাঁর এ জনপ্রিয়তা। আমরা তাঁর কিছু ছোটগল্প নিয়ে এর সত্যতা বিচার করে দেখতে পারি।
যদিও হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাসের তুলনায় তিনি গল্প বেশি লেখেননি। তাঁর গল্পগ্রন্থের সংখ্যা মাত্র পনেরটি। তাঁর গল্পের সংখ্যা শ’খানেক। সাধারণত দেখা যায়, যে লেখক গল্প-উপন্যাস দুটোই লিখেছেন, তাঁর গল্পের সংখ্যা উপন্যাসের সংখ্যার চেয়ে বেশি। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদের ক্ষেত্রে তা ঘটেনি। এর একটি ব্যাখ্যা আমরা তাঁর এক সাক্ষাৎকারে পাই। তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ‘গল্প এবং উপন্যাস এ দুটোর মধ্যে আপনি কোনটাতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন?’ জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘উপন্যাসে একটু জায়গা বেশি, তাই কথা বলতে পারি কিন্তু গল্পে জায়গাটা কম। আমি গুছিয়ে উঠতে পারিনা। অনেক সময় লাগে আমার।’ তাঁর ছোটগল্পের সংখ্যা কম হওয়ার আরেকটি কারণ হিসেবে আমরা বলতে পারি, প্রকাশক কিংবা সম্পাদকদের কাছে তাঁর উপন্যাসের এত বিপুল চাহিদা ছিল যে, তিনি উপন্যাস রেখে ছোটগল্পের দিকে খুব বেশি সময় দিতে পারেননি। তবে এর মধ্যেই তিনি যে ছোটগল্প রচনা করেছেন, তা এককথায় অসামান্য। তিনি যে বলেছেন, ছোটগল্পে তিনি গুছিয়ে উঠতে পারেন না। তাঁর গল্প পড়লে উক্তিটি একজন শক্তিমান লেখকের বিনয়-বচন বলেই প্রতীতি জন্মে। হুমায়ূন আহমেদের ছোটগল্প বয়ানে কোনো বাহুল্য নেই। একেবারে নির্মেদ। টানটান। স্বতঃস্ফূর্ত। পাঠক তাই শুরু করার পর গল্প থেকে চোখ ফেরাতে পারেন না। পড়ে ওঠেন শেষপর্যন্ত। এবং মুগ্ধ হন।
হুমায়ূন আহমেদের গল্পের পটভূমি আমাদের পরিচিত জগৎ। তবে লেখক আমাদের পরিচিত জগৎ থেকে এমন কিছু দৃশ্য তুলে ধরেন, যা প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত দেখার পরেও আমাদের কাছে ছিল অদেখা। হুমায়ূন আহমেদের কলমে আমাদের পরিচিত দৃশ্যের সঙ্গেই নতুন করে পরিচিত হই। তাঁর ‘ফেরা’ গল্পের কথা-ই ধরা যাক। (এ নামে হুমায়ূন আহমেদের একটি উপন্যাসও আছে। তাঁর বেশ কিছু ছোটগল্প ও উপন্যাসের নাম একই। যেমন, শ্যামল ছায়া, অপেক্ষা, সৌরভ, কৃষ্ণপক্ষ প্রভৃতি। এই নামে তার গল্পও আছে, উপন্যাসও আছে)। এটি একটি নিম্নমধ্যবৃত্ত পরিবারের গল্প। ছেলে-মেয়ে নিয়ে পরিবারের সদস্য সংখ্যা মোট পাঁচজন। তবু অভাব তাদের নিত্যসঙ্গী। ছেলে-মেয়ে তৃপ্তি সহকারে খেতে পারে না। প্রতিদিন একই খাবার খেতে খেতে তাদের অরুচি ধরে গেছে। একদিন পরিবারের কর্তা বাবা বেতন বৃদ্ধি হওয়ায় একটি বড় রুইমাছ কিনে বাড়ি ফেরেন। ততক্ষণে ছেলেমেয়ে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। বড় মাছ আনা উপলক্ষে তাদের ঘুম থেকে জাগানো হলো। রাতেই মাছ রান্না করে সবাই উঠোনে খেতে বসলো। একটি মাছকে কেন্দ্র করে বাড়িতে উৎসব হয়ে গেলো, গল্প এতটুকুই। খুব সাধারণ। লেখক তাঁর জাদুকরি গদ্যে গল্পটি যদি এখানে শেষ করতেন, তবে পাঠককে একটি মধ্যবৃত্ত পরিবারের চিত্র দেখেই তৃপ্ত থাকতে হতো। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ গল্পটি শেষ করতে ব্যবহার করেন কয়েকটি বাক্যের আরও একটি স্তবক। যখন তিনি লেখেন, ‘রাত বাড়তেই থাকল। খাওয়া-দাওয়া অনেক আগেই সারা হয়েছ্ তবু ছেলেমেয়েরা বাবাকে ঘিরে বসে রয়েছে। সামান্য সব কথায় হা হা করে হেসে উঠছে। বাসন-কোসন কলতলায় রাখতে গিয়ে হাসিনা অবাক হয়ে দেখে মেঘ কেটে অপরূপ জ্যোৎস্না উঠেছে। বৃষ্টি-ভেজা গাছপালায় ফুটফুটে জ্যোৎস্না। সে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে সেদিকে। অকারণে তার চোখে জল এসে যায়।’ তখন হাসিনার সঙ্গে পাঠকেরও চোখে অকারণে জল আসে, পাঠক একাত্ম হয়ে যান গল্পের সঙ্গে। এখানেই গল্পকারের শক্তিময়তা, পাঠক পড়তে পড়তে অবচেতন মনেই গল্পের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যান।
হুমায়ূন আহমেদ পাঠকের জন্য তাঁর গল্পের সমাপ্তিতে কোথাও কোথাও এক রকম চমক রেখে দেন। না, মোঁপাসার গল্পের চমক আর হুমায়ূন আহমেদের গল্পের চমক এক নয়। তবু সমাপ্তির কয়েকটি লাইনেই তিনি গল্পকে নতুন দ্যোতনা দান করেন। পাঠকের কাছে গল্পটিকে আরও হৃদয়গ্রাহী করে তোলেন। তাঁর প্রায় সবকটি গল্পের সমাপ্তিই এ রকম বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত, যা একান্তই হুমায়ূনীয়। প্রমাণস্বরূপ ‘সাদাগাড়ী’ গল্পের কথা ধরা যাক। গল্পটি উত্তমপুরুষে বর্ণিত হয়েছে। গল্পকথকের সঙ্গে ঘটনাক্রমে সাব্বির নামে এক ধনীর ছেলের পরিচয় হয়। সাব্বির নিঃসঙ্গ, লাজুক ও হার্টের রোগী। সাব্বির মাঝে মাঝে সাদা গাড়ি নিয়ে কথকের সঙ্গে দেখা করতে আসে অথবা দূর থেকে ফলো করে। এজন্য কথক সাব্বিরের প্রতি কিছুটা বিরক্ত। এই বিরক্তি লেখক গল্পবলাকালীন সঞ্চারিত করে দেন পাঠকের মাঝেও। সাব্বিরের সঙ্গে গল্পকথকের যেদিন শেষ দেখা হয়, সেদিন সাব্বির তাকে জিজ্ঞেস করে, ‘পৃথিবীর মানুষ এত সুখী কেন বলুন তো?’ এরপর কথকের সঙ্গে সাব্বিরের আর দেখা হয় না কিন্তু সাব্বিরের স্মৃতি তাড়া করে কথককে। গল্পটির শেষাংশে কথক বলছে, ‘বৃষ্টির রাতে যখন হঠাৎ বাতি চলে যায়, বাইরে হাওয়ার মাতামাতি শুরু হয় আমি গভীর আবেগে হাত রাখি তার (স্ত্রীর) গায়ে। তখেই মনেহয় কাছেই কোথাও সাদা গাড়িটি বৃষ্টিতে ভিজছে। চশমা পরা একটি তরুণ ভুরু কুঁচকে ভাবছে মানুষ এত সুখী কেন?’ তখন তরুণটির জন্য আমাদের মনে সহানুভূতি জন্মে। যে তরুণ পৃথিবীতে সুখ পায়নি, লেখক ঠিকই তার জন্যে পাঠকের মনে সুখের জায়গা করে দিয়েছেন।
বলা যায় ‘খাদক’ গল্পের কথা। যেখানে মতি মিয়া নামে এক খাদক যার কাজ বাজি ধরে খাওয়া, লোকজন তাকে হায়ার করে নিয়ে যায়। মতি মিয়া আর কোনো কাজ করে না, তাই সংসারে অভাব লেগেই আছে। তার ছেলেমেয়ে পেট ভরে খেতে পারে না। বাবার খাবারের সময় তারা পাশে বসে তাকিয়ে দেখে, মতি মিয়া বাজিতে হারার ভয়ে এক টুকরো মাংসও তুলে দেয় না সন্তানের মুখে। গল্পের শেষ অংশে যখন আমরা পড়ি, ‘সকাল দশটা হোক, এগারোটা হোক মতি মিয়া খাওয়া শেষ করবে। কোনো দিকে ফিরেও তাকাবে না। এত কিছু দেখলে খাদক হওয়া যায় না।’ তখন মনে প্রশ্ন জাগে এই খাদক কি গ্রামের সহজ-সরল মতি মিয়া না কি অন্য কেউ, যার বা যাদের অন্তহীন ক্ষুধা গ্রাস করে নিচ্ছে আমাদের সবার খাদ্য?
‘নিশিকাব্য’ গল্পে দেখি আনিস বাড়ির বড় ছেলে হঠাৎ অনেকদিন বাড়িতে এসেছে। অফিসের কাজের চাপে গত চার মাস বাড়িতে আসতে পারেনি। আনিস যখন বাড়িতে আসে, তখন সবার রাতের খাওয়া শেষ হয়ে গেছে। বাড়িতে আসার পর একটা উৎসবের মতো শুরু হয়ে যায়। সবাই আনিসকে ঘিরে ধরে। কিন্তু আনিসের স্ত্রী পরী তখন ব্যস্ত থাকে আনিসের খাবার তৈরির জন্য। আনিসের খাবার শেষ হতে হতে অনেক রাত হয়ে যায়। পরী যখন আনিসের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পায়, তখন রাত শেষ হতে খুব বাকি নেই। কিছুক্ষণ কথা বলার পরই আনিসের বাবা বাইরে থেকে ডাকতে থাকে রওনা দেওয়ার জন্য। কারণ আনিস একরাতের জন্যই বাড়ি এসেছিল।
এখানে লেখক কোথাও উল্লেখ করেননি, তবু পাঠকের বুঝতে বাকি থাকে না, আনিস ও পরীর অনেক কথাই অব্যক্ত রয়ে গেছে। অনেক কথাই বলা হয়নি, যা তারা বলতে চেয়েছিল। গল্প শেষে আনিস বা পরীর মনের অতৃপ্তি পাঠকের মনেও জায়গা করে নেয়। হাহাকার তৈরি করে।
হুমায়ূন আহমেদের গল্পগুলোতে মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, অন্তর্দ্বন্দ্ব, মনোবিকলন, রিরংসা, সমকালীন সংকট, চাওয়া-পাওয়া, স্বপ্ন, হতাশা উঠে এসেছে কখনো সরাসরি, কখনো রূপকের ছদ্মাবরণে। কিন্তু কোনো গল্পই পাঠকের মনে অভিঘাত সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয় না। এজন্যই সৈয়দ শামসুল হক কিংবা রমাপদ চৌধুরী মনে করতেন, বিশ্বের বিশটি ছোটগল্পের একটি লিস্ট করলে সেখানে হুমায়ূন আহমেদের ছোটগল্প স্থান পাবে।