সৎ চিন্তা, পারিপার্শ্বিক চেতনা ও আবেগ থেকে উত্থিত অন্তর্দাহ একজন কবিকে দিয়ে লিখিয়ে নেয় তার অভিজ্ঞান। কবিতা সৃষ্টির এ মর্মযাতনা বোদলেয়ার, ইয়েটস, এলিয়ট, জীবনানন্দ হয়ে বিনয় মজুমদার পাঠে যেমন পাওয়া যায়, তেমনি একই যাতনা তীব্রতর হয়ে ওঠে হেলাল হাফিজের কবিতায়ও। ভাষা আন্দোলনের রক্তক্ষরণ পরবর্তী স্বাধীনতার দাবিতে ঊনসত্তরের গণ আন্দোলনের উন্মাতাল সময়ই হেলাল হাফিজকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে তার শ্রেষ্ট কবিতা ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’। হেলাল হাফিজের কবিতা ক্ষরিত সময়ের গভীরে জন্ম নেওয়া এক আলোকপর্বমুখী বোধ। যা সমকালীন পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় স্বতন্ত্র, উজ্জ্বল।
‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়
এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’
(নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়/ যে জলে আগুন জ্বলে)
হেলাল হাফিজের এ কবিতাটি বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। মিছিলে, স্লোগানে সর্বাধিক উচ্চারিত হওয়ায় কবিতাটি সময়ের জীবন্ত দলিল হিসেবেও বিবেচিত হয়ে আসছে।
একজন প্রকৃত কবির শক্তি তার সৌন্দর্য সচেতনতা ও কল্পনার সুসংহত জগতকে ঘিরে বেড়ে ওঠে। কবির উদ্দেশ্য হচ্ছে মনোবিশ্বের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনভূতি সমকালীন বাস্তবতার নিরিখে নন্দনতাত্ত্বিকভাবে উপস্থাপন করা। সময়ের অনুভবে ভর করে চিরকালের প্রকাশাকাঙ্ক্ষায় সে কবিতা প্রকৃত কবিতার মর্যাদা পায়। শার্ল বোদলেয়ার বলেন, I have Sound a definition of the Beautiful. It is something intense and sad, Something a little vague, leaving scope for conjecture.’ অর্থাৎ—‘আমি আমার সৌন্দর্যের সংজ্ঞা পেয়েছি, আমার নিজের সৌন্দর্যের ধারণা। এ হচ্ছে এমন একটা কিছু যা তীব্র ও বিষণ্ন, একটা কিছু যা একটু অস্পষ্ট, সুতরাং আভাসে ও অনুমানে যা বুঝে নেওয়ার বিষয়।’ বোদলেয়ারের এ উক্তি প্রণিধানযোগ্য এ কারণে যে, একজন কবি নিজেকে চেনার দিব্যক্ষমতা দিয়েই কবিতার সৌন্দর্য আবিষ্কার করেন। সৌন্দর্যের মূল ধর্মই বিষণ্নতা। যা কবিকে নৈঃসঙ্গতাড়িত করে। আধুনিক বাংলা কবিতায় রচনা শৈলীর গুণে জীবনানন্দ দাশকে ‘নির্জনতার কবি’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে। কবিতার বোধ বিবেচনায় তিরিশ পরবর্তী একমাত্র হেলাল হাফিজই নৈঃসঙ্গচেতন কবি। তার কবিতার নিবিড় পাঠে এ সত্য উপস্থাপন করা যায়।
‘তুমুল ফাল্গুন যায়, ডাকে না কোকিল কোনো ডালে,
আকস্মিক দু’একটা কুহু কুহু আর্তনাদ
পৃথিবীকে উপহাস করে।’
(দুঃখের আরেক নাম/যে জলে আগুন জ্বলে)
হেলাল হাফিজ তার কবিতায় বোধের সঙ্গ-অনুষজ্ঞ বিবেচনা করে কবিতায় আলো আঁধারির সচেতন জগত নির্মাণ করেছেন। জীবনানন্দ দাশ এ বোধকে চিহ্নিত করেছেন সৌন্দর্যের আধার হিসেবে। যে বোধ কবি মনে শিল্প সৌন্দর্যের জন্ম দেয়। শিল্প সম্পর্কিত নানা ভাব ও বিষয়ের বৈচিত্র্য হেলাল হাফিজ সহজেই কবিতায় রূপান্তরের মাধ্যমে কবিতাকে নির্জনতার ঘোর আবহে উদ্ভাসিত করেন। বাস্তব জীবনের নিঙড়ানো অভিজ্ঞান যথাযথ শৈল্পিক বিন্যাসে কবিতায় মূর্ত করে তোলেন। যে কারণে তার কবিতা হয়ে ওঠে বাস্তব জীবনের সংকেতময় অভিব্যক্তি। মনোভূমের যাবতীয় হতাশা, নৈরাশ্য, শঙ্কা ও বঞ্চনার প্রবল উপস্থিতির কারণে তার কবিতার পংক্তি নিরাশার মধ্যে এক মোহময় অন্তর্জাল তৈরি করে।
‘কার পুড়েছে জন্ম থেকে কপাল এমন
আমার মতো ক’জনের আর
সব হয়েছে নষ্ট,
আর কে দেবে আমার মতো হৃষ্টপুষ্ট কষ্ট।’
(ফেরীঅলা/যে জলে আগুন জ্বলে)
জীবন এবং প্রকৃতিকে যে কবি নিবিড় পাঠে সক্ষম সে কবির অন্তরে লালিত সূক্ষ্ম চেতনা পরিবর্তিত সময়ের বাস্তবতায় কবিতায় ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হন। হেলাল হাফিজ তার কবিতায় প্রকৃতির সঙ্গে মানবজীবনের সরল যোগসূত্র স্থাপন করেন। তবে কবিতার অন্তর্গত বহুমাত্রিক ছায়ারাজ্যে বিচরণ করে হেলাল হাফিজ কিসের সন্ধানে ব্রতী? মানুষের জীবনের সব চাওয়া-পাওয়ার অন্তরালে যে প্রেম-বিরহের গুঞ্জন নানাভাব ও মাধুর্যে বাঙ্মময় হয়ে ওঠে, তা হেলাল হাফিজের কবিতায় ফুটে ওঠে। তার ইন্দ্রিয়ঘন বোধের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে নৈরাশ্যজারিত চিত্রকল্প। যা কবিতার ভাব ও ভাষাকে সাংকেতিক অলঙ্কারে অলঙ্কৃত করে পাঠকের চৈতন্যলোকে সুখানুভূতি সৃষ্টি করে। বিস্ময়াভিভূত পাঠক তার কবিতা পাঠে নিজের ঘটনাবহুল জীবনেরই সাক্ষাৎ পান।
‘এখন তুমি কোথায় আছো, পত্র দিয়ো।
এক বিকেলে মেলায় কেনা খামখেয়ালীর তাল পাখাটা
খুব নিশীথে তোমার হাতে কেমন আছে, পত্র দিয়ো।
ক্যালেন্ডারের কোন পাতাটা আমার মতো খুব ব্যথিত
ডাগর চোখে তাকিয়ে থাকে তোমার দিকে, পত্র দিয়ো।’
(প্রস্থান/যে জলে আগুন জ্বলে)
সৌন্দর্য সচেতন কবি হেলাল হাফিজের কবিতায় প্রেম এক নান্দনিক প্রত্যয় নিয়ে উপস্থিত থাকে। কবিতার পংক্তিতে পংকিক্ততে উজ্জ্বল হয়ে ওঠা অপূর্ণতা ও বিরহ কাতরতার সুর পাঠকের হৃদয়ে অনুরণন তোলে। কবির মনোলোকে সূচিত মানবিক প্রেম-বিরহ-দ্রোহের সঘন উপস্থিতিতে পাঠকও বেদনা মথিত হয়। প্রেমের মধ্যে বঞ্চনাকে খুঁজে পাওয়া যত সহজ, সত্যকে খুঁজে পাওয়া ঠিক ততটাই কঠিন—এ সত্য বুঝে হেলাল হাফিজ উচ্চারণ করেন, ‘আর না হলে যত্ন করে ভুলেই যেও, আপত্তি নেই।’ এখানে প্রেমের প্রতি কবির এক ধরনের উন্নাসিকতারই বহিঃপ্রকাশ ঘটে। তিনি আবার বলেন, ‘এক জীবনে কতোটা আর নষ্ট হবে,/এক মানবী কতোটাই বা কষ্ট দেবে!’ প্রেমের প্রতি এ মোহমুক্তিই কবিকে নির্জনতায় পথে টেনে নিয়েছে এ কথা বলা বোধ করি অসঙ্গত হয় না। নারীকে তিনি শুধু রক্ত-মাংসের নারী হিসেবে না দেখে দেখেছেন অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে, মানবাত্মাকে বিশুদ্ধ করার বীজমন্ত্র রূপে। তিনি লেখেন—‘তোমার বুকে বুক রেখেছি বলেই আমি পবিত্র আজ/তোমার জলে স্নান করেছি বলেই আমি বিশুদ্ধ আজ।’ নিজেকে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে, বিশুদ্ধ হওয়ার তাড়নায় তিনি নারীর স্পর্শ প্রত্যাশী হয়েছেন। নারীকে তিনি শৈল্পিক তাবিজ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। তার কবিতার এ শৈল্পিক নারীকে মূলত ‘কবিতা’ হিসেবেই চিহ্নিত করা যায়। কারণ নারীর মতোই কবিতা বিচিত্রমুখী এবং নিয়ত রহস্যময়। যা ধরা ছোঁয়ার বাইরে—একমাত্র ইন্দ্রিয় দিয়েই যার উপলব্ধি সম্ভব।
এখন তুমিই বলো নারী
তোমার উদ্যান ছাড়া আমি আর কোথায় দাঁড়াবো।
আমাকে দাঁড়াতে দাও বিশুদ্ধ পরিপূর্ণতায়,
ব্যাকুল শুশ্রূষা দিয়ে আমাকে উদ্ধার করো
নারী তুমি শৈল্পিক তাবিজ,
এতোদিন নারী ও রমণীহীন ছিলাম বলেই ছিলো
দুঃখের আরেক নাম হেলাল হাফিজ।
(দুঃখের আরেক নাম)
সৌন্দর্যের খোঁজে এক চিরতরুণ পরিব্রাজকের নাম হেলাল হাফিজ। কবিতায় নৈর্ব্যক্তিক ফর্ম সৃষ্টি করায় তার সময়ের কবি থেকেও হেলাল হাফিজ স্বতন্ত্র। তা ছাড়া স্বতন্ত্র কাব্যভাষা সৃষ্টি করে জীবদ্দশায় তিনি কবিতার প্রবাদপুরুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। তার কবিতার পাঠ বিবেচনায় একথা বলা বোধ করি অসঙ্গত হয় না যে, বাংলা কবিতাঙ্গনে হেলাল হাফিজ ‘কবিতার বিস্ময়’। অস্থিমজ্জায় কবি তিনি। কবিতাই তার জীবনীশক্তি। নৈঃসঙ্গচেতনার এ কবি কষ্টের সঙ্গে নিরন্তর কথা বলেন। জীবনের সব আকাঙ্ক্ষার মূলে কবিতাকে স্থান দিয়েছেন। কবিতার প্রতি প্রেমের শক্তিই তার বেঁচে থাকার প্রেরণা।