শিল্পের প্রধান উপকরণ মানবসমাজ। ভাবনাবিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে শিল্পের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। কবিতা শিল্পের সবচেয়ে সংবেদনশীল প্রপঞ্চ—এ ধারণা সুবিধিত। কবিতা আধুনিককালকে স্পর্শ করেছে সংবেদনশীলতায়, আবেগে এবং বুদ্ধির সংশ্লেষে। বুদ্ধির দীপ্তি, যুক্তির পরম্পরা ও বস্তুসত্যের সঙ্গে চিন্তা ও কল্পনার সমন্বয়ে আধুনিক কবিতা হয়ে উঠেছে সময়ের স্মারক। সমকালীন বিষয়ের প্রতিচিত্র অঙ্কনের কারণে আধুনিক কবিতা আধুনিক মানুষের রুচি গঠনেও সহায়ক ওঠে। আধুনিকতার যুগচিহ্ন মূলত বিবর্তনে। এ বিবর্তন ঘটে প্রধানত আঙ্গিকে। বিষয়-ভাব এবং চেতনায় ঘটে ধীরে ধীরে। আঙ্গিকের বিবর্তনের ক্ষেত্রে কবির কাব্যচর্চার ধারাবাহিকতা এবং স্বাতন্ত্র্যবোধ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যেকোনো বড় কবিই শুরুতে প্রথাসম্মত পথেই চলেন। প্রথাগত শৈলী আত্মস্থ হওয়ার পর স্বাতন্ত্র্যবোধ কবিকে আত্মমর্যাদা সচেতন করে তোলে। আত্মমর্যাদা ও স্বাতন্ত্র্যবোধই প্রকাশভঙ্গি এবং কবিতার আঙ্গিক পরিবর্তনে কবিকে প্রণোদিত করে। তবে এই পরিবর্তন আকস্মিক ঘটেনি। ঘটেছে ধীরে ধীরে। সামান্য কিছু ক্ষেত্র বাদ দিলে এই পরিবর্তনের ধারাবাহিকতা আধুনিক বাংলা কবিতাকে দিয়েছে ঐতিহ্যিক পরম্পরা।
বাংলা কবিতার ঐতিহ্যের পরম্পরায় যুক্ত হয়েছে বাঙালির সংগ্রাম, দ্রোহ ও বিপ্লবও। বাংলা কবিতার যে ধারা গেছে সংগ্রামের দিকে, বিপ্লবের দিকে, সে ধারার প্রথম সার্থক কবি কাজী নজরুল ইসলাম—সন্দেহ নেই। এরপর বিপ্লব, সংগ্রাম ও দ্রোহের কবিতা অনেক রচিত হয়েছে। সেই প্রেমেন্দ্র মিত্র, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সুকান্ত ভট্টাচার্য থেকে শুরু করে শামসুর রাহমান পর্যন্ত অনেকের কবিতায় এ ধারা ঋদ্ধ হয়েছে। তবে বিস্ময়ের বিষয় এই— দ্রোহ-বিপ্লব ও সংগ্রাম যেখানে অনিবার্য সেখানে প্রেমও উপস্থিত। এই দুই ভিন্ন মেরুর আশ্চর্য সঙ্গংগম ঘটেছে বাংলা কবিতায়; তবে এ ধারার রূপকার খুব নন। এই অত্যল্প কুশীলবদের একজন হেলাল হাফিজ। বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের পক্ষে এই কলমযোদ্ধার ভূমিকা অবিস্মরণীয়। উত্তাল সময়ে শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তিনি লিখেছেন অবিনাশী সব পঙ্ক্তি। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের সময় রচিত ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ যুগপৎ সংগ্রাম, প্রেম, জীবন ও শিল্পের উচ্চারণ হয়ে উঠেছে। ‘শিল্পীর সার্বক্ষণিক চেষ্টা হচ্ছে তাঁর কমিউনিকেশনের দক্ষতা বাড়ানো। তিনি যতটা জ্ঞাপন করতে পারেন, তার চেয়ে অধিকতর কিছু জ্ঞাপন করতে চান।’ (আধুনিক শিল্পকলা: ভাষার ব্যবহার ।। সৈয়দ আলী আহসান)। হেলাল হাফিজ অল্পকথায় পাঠকের সঙ্গে তাঁর মনঃসংযোগ করতে চান। এ কারণে তাঁর কবিতা স্বল্পদৈর্ঘ্যরে, কিন্তু বর্ণনায়, শব্দে যা বলেন, চিত্রকল্পে-উপমায় তারও বেশি উপলব্ধি করানোর চেষ্টা তাঁর থাকে।
তাঁর কবিতায় বিবরণ আছে, আছে চিত্রও। বিষয় বর্ণনায় তিনি স্বল্পভাষী। মিতকথনে অন্বিষ্ট বিষয় স্পষ্ট করে তোলেন তিনি। বিষয়োপযোগী তাঁর ভাষা, শব্দ চয়ন, অলঙ্কার সৃষ্টি ও ছন্দ নির্বাচন। আঙ্গিক নির্মাণেও বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষার স্বাক্ষর স্পষ্ট। বিষয় -প্রকরণের দিক থেকে তাঁর কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো হলো—
১. মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধিকার আন্দোলন ও রাজনীতি সচেতনতা
২. নারী ও প্রকৃতি প্রেম
৩. কল্পনার প্রাচুর্য ও আবেগের তীব্রতা
৪. ছন্দের বৈচিত্র্য ও অলঙ্কারের সহজ প্রকাশ
৫. বহুরৈখিক একাকিত্ব
৬. সমর্পণ ও স্মৃতিচারণা
৭. অহঙ্কার ও চিত্তের দার্ঢ্য
হেলাল হাফিজ কবি— বাইরে দ্রোহের, অন্তরে প্রেমের। তাঁর কবিতায় বিষয়-বৈচিত্র্যের চেয়ে নির্বাচিত অনুষঙ্গের প্রাধান্যই লক্ষণীয়। কিছু নির্দিষ্ট অনুষঙ্গে বারবার কবি নিজেকে প্রকাশ করেন। এই বিষয়ের পৌ পুনঃপুপৌনিক ব্যবহারে তিনি সিদ্ধহস্ত। এ ক্ষেত্রে প্রেম, দ্রোহ, বিরহ, কষ্ট নারী, যুদ্ধ ও অস্ত্রের প্রসঙ্গ উল্লেখযোগ্য। তাঁর বহুল পঠিত কবিতাটি হলো—‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’। এ কবিতা জাতীয় মুক্তির কাঙ্ক্ষায় সহযোদ্ধা ও স্বজাতিকে প্রেরণাদানকারী। কবি যেমন তারুণ্যের জয়গান গেয়েছেন, তেমনি যৌবনে ঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়টিও প্রস্তাবও করেছেন। দেশপ্রেমের কাছে অনেক সময় নারীপ্রেম ম্লান মনে হয়েছে তাঁর। ব্যক্তিগত সুখভোগের চেয়ে সামষ্টিক মুক্তিকামিতাই তাঁর কাছে বড় হয়ে উঠেছে। ফলে সংকটকালে নারীপ্রেমকে তুচ্ছ মেনেছে। কবির মতে, বীরের প্রেম অস্ত্রের সঙ্গে, যুদ্ধকালীন পরিবেশে প্রেয়সী নয়, অস্ত্রই আরাধ্য। এমনই চিত্র মেলে ‘দুঃসময়ে আমার যৌবন’ ও ‘অস্ত্র সমর্পণ’ কবিতায়। ঠিক বিপরীত চিত্রের কবিতা ‘অগ্ন্যুৎসব’। শেষোক্ত কবিতায় জন্মভূমি ও নারীর মধ্যে সতিনের সম্পর্ক আবিষ্কার করেছেন কবি। ‘অন্য রকম সংসার’, ‘বাম হাত তোমাকে দিলাম’, ‘একটি পতাকা পেলে’, ‘যেভাবে সে এলো’ প্রভৃতি কবিতায় দেশপ্রেম, মুক্তিযুদ্ধ বারবার উচ্চারিত।
ভাষা আন্দোলনের পর বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন মুখ্য হয়ে ওঠে। ধর্মভিত্তিক জাতীয়তার বিপরীতে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার প্রশ্নে জাতি সংগঠিত হতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত পূর্ববর্তী কয়েক বছর—বিশেষত ঊন সত্তরের গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে সমগ্র জাতি মুক্তির কাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে। সমগ্র জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার যে বেগ সৃষ্টি হয়েছিল ওই সময়ে, এর সঙ্গে কবি ও কথা-সাহিত্যিক ও শিল্পীরা একাত্মতা পোষণ করেছিলেন। ওই সময়ে যার দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলার অংশীদার ছিলেন, পরবর্তীকালে তাদের মধ্যে ওই স্মৃতি ও রেশ রয়ে গেছে। ওই রেশ যেমন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে প্রেরণা জুগিয়েছে, তেমনি পরবর্তীকালে দেশ গড়ার কাজে নিয়োজিতদেরও দৃঢ়প্রত্যয়ী করেছে। এ ধরনের মাঙ্গলিক কাজে কবিদের ভূমিকা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। তারা অভিজ্ঞতা, কল্পনা ও প্রত্যয়কে শব্দ-ছন্দ-অলঙ্কারের মাধ্যমে স্পষ্ট করে তুলেছেন। হেলাল হাফিজ এই ধারার কবিদের প্রতিভূ। তাঁর কবিতায় যুদ্ধ-অস্ত্র-সংগ্রাম একই সঙ্গে চিত্রিত। নানা ধরনের বিষয় বর্ণনা করলেও মূলত প্রেম ও দ্রোহই তাঁর কবিতার মুখ্য অনুষঙ্গ। এর মধ্য দিয়ে তিনি নিজের কথাগুলো প্রকাশ করতে চান। ‘পাখির একটা সুবিধা আছে, যেখানেই থাক, একই গান গাইবে সে, যদি গান গাইতে চায়। মানুষ তা পারে না। তাঁর গান বলে যায় স্থানে ও কালে। মানুষ ইতিহাস দ্বারা বন্দী, যে-ইতিহাস সে নিজেই তৈরি করেছে, নিজের হাতে। যদিও একা নয়, মিলিত হস্তক্ষেপে।’ (মনীষার সময় ও সুযোগ : সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী)। বাঙালির যে ইতিহাস এই ইতিহাস ইংরেজ-পাকিস্তানি ও বাঙালির যৌথ কর্মে রচিত। এই ইতিহাস ইংরেজ ও পাকিস্তানিদের জন্য পরাজয়ের, গ্লানির; বাঙালির আত্মত্যাগ ও অহঙ্কারের। সে অহঙ্কারকে কবি মূর্ত করে তুলেছেন।
হেলাল হাফিজ মননের চেয়ে হৃদয়ের দাবিকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। ফলে তাঁর আবেগ ও কল্পনা বাস্তবকে ছুঁয়ে গেছে কি না, সে খবর তিনি রাখেননি। যখন যা মানসপটে ভেসে উঠেছে, তা-ই অকপটে বর্ণনা করেছেন। এ ক্ষেত্রে খুব বেশি ভাবিত হননি। তীব্র ভাবাবেগে ভেসে যান বলে লিখতে পারেন দ্বিধাহীন থরোথরো সব প্রেমের কবিতা। কারও আহ্বানের অপেক্ষা না করেই নিজেকে উপস্থাপন করেন অকপটে। তাঁর প্রেমের কবিতাগুলোয় প্রেমিক হৃদয়ের দার্ঢ্য স্পষ্ট, কোনো কুণ্ঠা নেই তাঁর কণ্ঠে। ফলে তাঁর প্রেমের কবিতাগুলো পাঠকালে পাঠকহৃদয় আন্দোলিত হয়, আলোড়ন তোলে মস্তিষ্কের কোষে-কোষেও। ‘কেউ ডাকেনি তবু এলাম, বলতে এলাম ভালোবাসি’ প্রবন্ধে শুচি সৈয়দ যথার্থই লিখেছেন, ‘বাংলা কবিতার মূলধারায় যে স্বল্প ক’জন কবি কবিতাকে তাঁর পাঠকের কাছে অনিবার্য প্রতিপন্ন করেছেন, হেলাল হাফিজ তাঁদের অন্যতম। তাঁর কবিতা দাগ কেটে বসে গেছে পাঠকের হৃৎপিণ্ডে। তাঁর কবিতা অনুভূতি উপলব্ধির অর্ঘ্যরূপে নিবেদিত হয়েছে তাঁর পাঠক তথা তাঁর দেশের মানুষের হৃদপদ্মে। মানুষের উদ্দেশে, মানবের উদ্দেশে এ এক অনন্য অন্তরাঞ্জলি।’ এ প্রসঙ্গে তাঁর ‘যাতায়াত’ কবিতাটির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। একজন দৃঢচেতা, বোহেমিয়ান, আজন্ম দুঃখলালনকারীর দিন যাপনের গল্প—এ কবিতা। তাঁর প্রিয় প্রসঙ্গ একাকিত্ব। নৈঃসঙ্গপ্রিয় কবি পাড়ি দিয়েছেন দীর্ঘপথ। নিশ্চিত জানেন তাঁর জন্য কেউ অপেক্ষায় নেই। কেউ তাঁকে আপন করে পেতে চাই না। অথচ প্রবল আত্মবিশ্বাসের জোরে কবি ভালোবাসার দাবি নিয়ে মানুষের দুয়ারে এসে দাঁড়িয়েছেন—‘কেউ ডাকেনি তবু এলাম, বলতে ভালোবাসি।’ কবি যতটা আত্মপ্রত্যয়ী ততটাই সমর্পিত। আত্ম নিবেদনের আভাস ‘যাতায়াত’ কবিতায় কিছুটা মেলে। কিন্তু পরিপূর্ণ সমর্পণের স্বভাব ও অভিপ্রায় স্পষ্ট ‘বাম হাত তোমাকে দিলাম’, ‘কষ্ট’, পরানের পাখি, ‘কবিতার কসম খেলাম, প্রত্যাবর্তন, দুঃখের আরেক নাম’, হিরণবালা’, আমার সকল আয়োজন, প্রতিমা’, ‘অন্যরকম সংসার’ প্রভৃতি কবিতায়। এসব কবিতায় স্মৃতি রোমন্থন ও আত্মসমর্পণ প্রায় সমানভাবে উপস্থিত।
অহঙ্কার ও চিত্তের দার্ঢ্য প্রকাশে কবি স্পষ্টবাদী। সমাজ ও রাষ্ট্রের অনিয়ম ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে কবিরা স্বভাবগুণেই সোচ্চার। রাষ্ট্রীয় দুর্বৃত্তায়ন, রাজনীতিবিদদের অলজ্জ আচরণ, আইনশৃঙ্খলার অবনতির মতো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো কবিকে তাড়িত করে। ‘যার যেখানে জায়গা’য় সংক্ষুব্ধ কবি ওই ভাবনারই প্রতিফলন এঁকেছেন। সরাসরিই ঘোষণা করেছেন, শাসকগোষ্ঠী যতই মানুষ ঠকানোর ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠুক, মানুষ জেগে উঠলে ষড়যন্ত্রীরা ব্যর্থ হতে বাধ্য। মানুষের সহ্যক্ষমতারও সীমা আছে। এই সীমা পার হয়ে গেলে তারাও ‘চুতমারানি’ গাল দিয়ে প্রতিবাদ জানাতে পারে। সাধারণ মানুষের অসাধারণ রকমের অহঙ্কার রয়েছে। সে অহঙ্কারকে সম্মান দিতে জানে না সমাজের সুবিধালোভীরা। তাতে কী? সাধারণ মানুষের প্রতিভূ যে কবি, যিনি সমাজের সমস্ত অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার তাঁর অহঙ্কার ও দৃঢ়ঢচিত্তের উৎকৃষ্ট উদাহরণ—‘রাখালের বাঁশি’। পুরো কবিতাটি এখানে উদ্ধৃতিযোগ্য।
কে আছেন?
দয়া করে আকাশকে একটু বলেন—
সে সামান্য উপরে উঠুক,
আমি দাঁড়াতে পারছি না।
সৃষ্টিশীল মানুষ দৃঢ়প্রত্যয়ী না হলে উপস্থিতকালের সবাইকে ছাড়িয়ে মহাশূন্যে মাথা তুলে দাঁড়ানো তার পক্ষে অসম্ভব। আত্মবিশ্বাস মানুষকে কখনো কখনো নিজের স্বরূপ চিনতে সাহায্য করে। ব্যক্তি তার উচ্চতা মাপতে পারলে আরোপিত মানদণ্ড ও উচ্চতার সীমাবদ্ধতাকে উপেক্ষা করার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে। কবি মাত্রই বৃত্তছিন্নকারী। তাঁকে কোনো সংঘ, সময় কিং বা গোষ্ঠীর ক্ষুদ্রবৃত্তবন্দি করে রাখা যায় না। এ কারণে হেলাল হাফিজকে নির্দিষ্ট কোনো তত্ত্বের, সময়ের গণ্ডিতে বিচার করলে তাঁর প্রতি অবিচার করা হয়। ‘‘যে জলে আগুন জ্বলে’ ১৯৮৬ সালে বেরিয়েছিল বলে কেউ কেউ হেলাল হাফিজকে বলেন আশির দশকের কবি। তাঁদের এ বলার মধ্যে হেলাল হাফিজের আকাশ ছোঁয়া পাঠকপ্রিয়তার প্রতি আছে ঈর্ষাকাতরতা। আছে এক ধরনের অজ্ঞতা। আবার হেলাল হাফিজদের দশকের বিভাজনে আটকাতে না পারলে ‘কবিপাড়ায়’ তাদের ‘সিনিয়রিটি’ বা ‘অভিভাবকত্বও’ থাকে না। কবিতার আলোচনার সুবিধা বিবেচনায় এনে দশকওয়ারি বিভাজন মানলে বলতে হবে, হেলাল হাফিজ মধ্য ষাটের কবি। মধ্য আশির দশকে বই প্রকাশের হিসাবে তাঁকে ওই দশকে আটকে দেয়ার সঙ্কীর্ণতা লজ্জার! পঞ্চাশ, ষাট, সত্তরের অনেকের বই হেলাল হাফিজের মতো বেরিয়েছে তাদের দশক কেটে যাওয়ার পর।’’ (কবিতার জলে হেলাল হাফিজের নতুন আগুন: হাসান শান্তনু)।
তবে হেলাল হাফিজ যে সময়ে কবিতাচর্চা শুরু করেছেন, সে সময়ের নিরিখে তাঁকে বিচার করলে তাঁর প্রজ্ঞা-কল্পনা-আবেগের চূড়ান্ত রূপ স্পষ্ট হবে; তাতে সন্দেহ নেই। কারণ,— ‘৭১ পূর্ববর্তী কবিতা উপনিবেশ বৃত্ত ভেঙে আÍস্বরূপকে দিতে চেয়েছে আমাদের জীবনরূপের প্যাটার্ন; মানবিক দ্রোহ-দুঃখ-গ্রামস্পৃহার চিরায়ত বিভা। (বাংলাদেশের পঁচিশ বছরের কবিতা : পরিপ্রেক্ষিত ও প্রান্ত— বেগম আকতার কামাল)। কাব্যচর্চার পটভূমির বিবেচনায়ও এই কবি সম্পূর্ণরূপে বৃত্তভাঙা, বোহেমিয়ান ও কল্পনার স্বেচ্চারী। তাঁর সময়, বেড়ে ওঠা, জীবন-যাপন, রাজনৈতিক পরিস্থিতি—এসবই তাঁকে এমন দ্রোহী করে তুলেছে। তাঁর কবিতা জীবনোপলব্ধি ও অভিজ্ঞতা প্রকাশের উপায় মাত্র নয়, আত্ম আবিষ্কার, চিত্ত-উদ্বোধনেরও মাধ্যম। হেলাল হাফিজ এই উভয়বিধ স্বভাব ও চারিত্র্যের মধ্যে সেতুবন্ধ রচনা করেছেন। সমাজ-রাষ্ট্র-রাজনীতি, ব্যক্তির মনোবিকারকে কবিতায় চিত্রায়িত করতে গিয়ে তাঁর ভাষা কখনো জটিল হয়ে পড়েনি। তাঁর কবিতায় প্রবল দ্রোহ এবং তীব্র আবেগ প্রকাশের সময়ও এক শান্ত, সৌম্য চিত্র ফুটে ওঠে। যে স্বভাব একজন মানুষের ভেতর যুগপৎ দ্রোহী ও প্রেমিক সত্তার উদ্বোধন ঘটায়। ‘হেলাল হাফিজ অতি সরল ভাষায় তাঁর অসাধারণ কবিতাগুলো রচনা করেছেন। এ কবিতাগুলো বুঝতে বা অনুধাবন করতে কোষ্ঠকাঠিন্য আক্রান্ত কবিদের কবিতা পড়ে বোঝার মতো প্রয়োজন হয় না। হেলাল হাফিজের কবিতাগুলো নিজগুণেই পাঠকের মন ছুঁয়ে যায়।’ (কবিতা একাত্তর হেলাল হাফিজকে নিয়ে বিভ্রম: কবির হুমায়ূন)। আমাদের মনে রাখতে হবে—প্রকৃত কবি সময় ও স্থানের সীমানা ছাড়ানো অসীম সত্তা। এ কারণেই কবি হেলাল হাফিজ বয়স-নির্বিশেষে প্রেমিক-সংগ্রামী সবার প্রিয় কবি।
ছন্দনির্বাচনে কবি মাত্রাবৃত্ত ও অক্ষরবৃত্তে স্বস্তিবোধ করেছেন, স্বরবৃত্তেও লিখেছেন বেশ কিছু কবিতা। তবে অক্ষরবৃত্তে তাঁর দক্ষতা বিস্ময়কর। বিশেষত ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’-এর মতো কবিতায় তিনি অক্ষরবৃত্তের নিয়ম ভেঙে যে পঙ্ক্তি রচনা করেছেন, তাতে তাঁর নিয়ম মানা ও না-মানার শক্তির প্রমাণ মেলে। স্বাক্ষর মেলে অলঙ্কার সৃষ্টির ক্ষেত্রেও। ‘প্রাণধর্মের অনুশাসন থেকে আমরা দুটি দিকে মুক্তির পথ পেয়েছি; দর্শনে আর শিল্পকলায়। দর্শন বিশুদ্ধ পড়হংবঢ়ঃ সমূহের বিন্যাসের মধ্যে অন্তঃসঙ্গতি আনতে চায়; শিল্পীর কারবার রসধমব নিয়ে। এই মানসপুতুলগুলিকে সে খুশীমতো ভাঙে আর গড়ে, সাজায় আর গুছায়।’ (আধুনিক বাংলা কবিতা : ভূমিকা/ আবু সয়ীদ আইয়ুব)। হেলাল হাফিজ এই খুশিমতো ভাঙাগড়ার কাজে স্বতঃস্ফূর্ত। নিয়ম মেনে যেমন তাঁর কবিতা রচিত হয়েছে, তেমনি নিয়মের ব্যত্যয় করেও। তাঁর কবিতায় প্রাণধর্মের উপস্থিতি সর্বাধিক, চিন্তনের রেশও কম নয়। প্রাণধর্ম ও চিন্তনের মিথস্ক্রিয়ায় তাঁর কবিতার সৃষ্টি। এ কারণে পড়হংবঢ়ঃ-এর বিন্যাসে সঙ্গতি যেমন রয়েছে, তেমনি রসধমব ও স্পষ্ট করে তুলেছেন। কিছু দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক।
১. এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়
এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময় ( নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়)২. আঙুল দিয়ে তোমার আঙুল ছুঁয়েছিলাম বলেই আমার
আঙুলে আজ সুর উঠেছে
নারী-খেলার অভিজ্ঞতার প্রথম এবং পবিত্র ঋণ
তোমাকে নিয়ে কবিতা লিখে সত্যি কি আর শোধ হয়েছে? (হিরণবালা)৩. মৌলিক প্রেমিক আর কবি হলে অধিক হারায় (প্রত্যাবর্তন)
৪. নিউট্রন বোমা বোঝো
মানুষ বোঝো না! ( অশ্লীল সভ্যতা)৫. গাভিন ক্ষেতের ঘ্রাণ জলের কলস, কাক
পলি মাটি চেনা মানে আমাকেই চেনা।
আমাকে চেনো না?
আমি তোমাদের ডাক নাম উজাড় যমুনা। (নাম ভূমিকায়)৬. মানুষের মতো আর অতো নয় আগুনের সোনালি সন্ত্রাস (মানবানল)
৭. ভালোবাসাবাসিহীন এই দিন সব নয়— শেষ নয়
আরো দিন আছে
ততো বেশি দূরে নয়
বারান্দার মতো ঠিক দরোজার কাছে। (লাবণ্যের লতা)৮. পরিপাটি নির্দোষ সন্ত্রাস নিয়ে
আমি কতো বিনীত বিদ্রোহী
পাখিকে জিজ্ঞেস করো সব জেনে যাবে
অবিকল আমার মতন করে কবুতর নির্ভুল জানাবে। (কবুতর)
উদ্ধৃত পঙ্ক্তিগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে—কবি বিভিন্ন বিষয়ের আশ্রয়ে মূলত নিজেকে প্রকাশ করতে চেয়েছেন। এই চেষ্টায় কখনো চিত্রকল্প, কখনো উৎপ্রেক্ষা, কখনো উপমা সৃষ্টি করেছেন। বিষয় হিসেবে কখনো যুদ্ধ, কখনো প্রেম, কখনো প্রকৃতি এসেছে। আপাতত মনে হতে পারে, তাঁর বিষয়ের সঙ্গে বিষয়ের সামঞ্জস্য প্রচ্ছন্ন, বিরোধী প্রকট। কিন্তু আধুনিক কালের কবিস্বভাবকে একটু ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে উপলব্ধি উচিত— ‘আধুনিক বাংলা কবিতার দিকে দৃষ্টিপাত করলে আমরা যে সবিস্ময়ে এই কথাটা উপলব্ধি করি যে ঐক্যের মধ্যেও বিপরীতের স্থান আছে, বিরোধের মধ্যেও সংহতির সম্ভাবনা।
আধুনিক কবিতা এমন কোনো পদার্থ নয় যাকে কোনো একটা চিহ্ন দ্বারা অবিকলভাবে শনাক্ত করা যায়। একে বলা যেতে পারে বিদ্রোহের, প্রতিবাদের কবিতা, সংশয়ের, কান্তির, সন্ধানের, আবার এরই মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে বিস্ময়ের জাগরণ, জীবনের আনন্দ বিশ্ববিধানে আস্থাবান চিত্তবৃত্তি।’ (আধুনিক বাংলা কবিতা: ভূমিকা ॥ বুদ্ধদেব বসু)। বুদ্ধদেব বসুর যুক্তি ও ব্যাখ্যার ষোলোআনাই হেলাল হাফিজের ক্ষেত্রে খাটে। তাঁর কবিতায় প্রেম-বিরহ, যুদ্ধ-শান্তি, অস্ত্র, চুম্বন, নারী, প্রকৃতি সমানভাবে উপস্থিত। এ সবের মধ্যে বিরোধের চেয়ে সংহতি বেশি, বিপরীতের চেয়ে ঐক্য। শেষ পর্যন্ত হেলাল হাফিজ মূলত বিনীত বিদ্রোহী।