বাংলা সাহিত্যে আলোচিত উপন্যাসগুলোর একটি ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’। প্রান্তিক মানুষকে সাহিত্যের ভরকেন্দ্রে স্থাপন করে যিনি প্রথম উপন্যাস রচনায় সাহস দেখিয়েছেন তিনি তারাশঙ্কর। উচ্চবর্ণের উত্তিরীয় গায়ে জড়িয়ে জন্মগ্রহণ করলেও নিম্নস্তরের সবহারাদের ছেঁড়া আঁচলের তলে যে জীর্ণ জীবন, যে সুখ-দুঃখের কাহিনি সুচাঁদ বুড়ি শোনায়, তা পরম মমতায় তুলে আনতে সমর্থ হয়েছেন তারাশঙ্কর। উপন্যাসটিকে যতই সমালোচকরা ‘অশ্লীল’ ও ‘অং’ এর খেলা বলে অভিযুক্ত করুন না কেন এ অভিযোগ তারা কেউ করেনি যে—ব্যক্তিগতভাবে তারাশঙ্করের বাগদী, বৈষ্ণব, বেদে বা ঝুমুর দলে’র সঙ্গে যোগসূত্র নেই বা ছিল না কিংবা তিনি তাদের চেনেন না।
হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’র উৎসর্গ পত্রে কবি কালিদাস রায়ের উদ্দেশে তিনি অবলীলায় লেখেন—‘রাঢের হাঁসুল বাঁকের উপকথা আপনার অজানা নয়। সেখানকার মাটি, মানুষ, তাদের অপভ্রংশ ভাষা সবই আপনার সুপরিচিত। তাদের প্রাণের ভোমরা-ভোমরীর কালো রঙ ও গুঞ্জন আপনার পল্লী জীবনের ছবিও গানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। এই মানুষদের কথা শিক্ষিত সমাজের কাছে কেমন লাগবে জানি না। তুলে দিলাম আপনার হাতে।’
অর্থাৎ তারাশঙ্কর তার ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথার’ নায়ক নায়িকা বা পাত্র-পাত্রীর সঙ্গে কতটুকু পরিচিত এবং বিশ্বস্ত ছিলেন এটা হলো তার প্রামাণ্য স্বীকারোক্তি। এ রকম স্বীকারোক্তি আমরা তার আত্মজীবনীতেও লক্ষ করি—‘এদের সঙ্গে পরম সৌভাগ্যের ফলে একটি আত্মার আত্মীয়তা গড়ে উঠেছে। এমনই যে আত্মীয়তা যে, প্রবাসে থাকি—প্রতিষ্ঠা খানিক পেয়েছি, তবু সে আত্মীয়তা এতটুকু ক্ষুণ্ন হয়নি। এ পাওয়া যে কি পাওয়া সে আমি জানি। তাই আমি এদের কথা লিখি। এদের কথা লিখবার অধিকার আমার আছে। আমি ওদের জানি—ওদের আত্মার আত্মীয় আমি। উপকারী নয়, কৃতজ্ঞতা ভাজন নয়, ভালোবাসার জন।’
এ-উপন্যাসের ভরকেন্দ্রে যারা আছে তারা কাহার। কাহার কোনো জাতির নাম নয়। লেখক নিজেও এ কথাটি স্বীকার করেছেন—‘কাহার বলে কোনো নির্দিষ্ট জাতি নেই। হরিজনদের মধ্যে যারা পাল্কী বয়, তারা কাহার—বাগদীদের মধ্যে যারা পাল্কী বয় তারা বাগদি কাহার।’ অর্থাৎ পাল্কীবাহকেরাই মূলত কাহার নামে পরিচিত। ‘বঙ্গীয় শব্দ কোষ’-এ হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় কাহার শব্দের নানা অর্থ দিয়েছেন এর একটি হলো ‘কাওরা’ (কেওরা!) এবং অন্যটি হলো ‘শিবিকাদি বাহক হিন্দু জাতি বিশেষ’।
তাহলেও ১৯০১ সালের সেন্সাস রিপোর্ট ‘কাহার’ নামক জাতির উল্লেখ গবেষকদের বিভ্রান্ত করে। আবার হরিচরণ তার অভিধানে কাহার অর্থ কাওরা বুঝিয়েছেন যে অথে সেই অর্থে ‘কাওরা’ বা ‘কেওরা’ নামক আদিজনগোষ্ঠীর উল্লেখ আছে ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দের আদমশুমারির রিপোর্টে। পশ্চিমবঙ্গের আটটি জেলায় (বীরভূমসহ) কেওরাদের শনাক্ত করা যায়। যার মধ্যে ৫৫ শতাংশ (তৎকালে) বাস করত চব্বিশ পরগণা, হুগলি ও হাওড়ায়। কে বলতে পারে এই কেওরা আর হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় কাওরা বা কাহার এক কিনা! গবেষকগণ নৃতাত্ত্বিকভাবে এর খোঁজ নিলে তা পরিষ্কার হওয়া যাবে। ভারতের তপশিলভুক্ত জাতির তালিকাতেও কেওড়া আছে, কাহার নামে কোনো জাতের উল্লেখ নেই। এ দিকে জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস তার ‘বাংলা ভাষার অভিধান’-এ কাহার শব্দটির ব্যাখ্যা করেছেন এইভাবে—কাহার সংস্কন্ধবার; হি. কাহার; বাং কাহারক—যারা কঙ্কে করিয়া শিবিকা বহন করে, যানবাহক।
‘কাহার কোনো জাত নয়’—পাল্কীবাহক সম্প্রদায়—পেশাগত সম্প্রদায়। কাহার হলো ‘কাঁধ’ এবং ‘ভার’ শব্দের একত্রিকরণ অর্থাৎ কাঁধে ভার বয় যারা—কাহার। তারাশঙ্কর বাঁশবাঁদি গ্রামে বসবাসরত কাহার অর্থাৎ পাল্কীবাহক বা বেহারাদের নিয়েই তার উপাখ্যান রচনা করেছেন। এই উপন্যাসটিকে ড.শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন—‘মহাকাব্যের সংঘাতধর্মী উপন্যাস’। যেখানে ‘কাহার কূলের জীবন কাহিনীর মধ্যদিয়ে লেখক একটি আমূল সংস্কৃতি বিপর্যয়ের—ইতিহাস তুলে ধরেন। হাঁসুলি বাঁকের উপকথায়—সুঁচাদের মুখে বর্ণিত গল্প উঠে এসেছে, ইতিহাস নয়।’ এখানে যেটুকু ইতিহাস আছে তা ইতিহাসের ছায়া মাত্র। ইতিহাস মানে তো বড় বড় রথী মহারথীদের আখ্যান। এ উপন্যাসেও কিছু কিছু আছে, যেমন—নীল যুগ,সামন্তযুগ,দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ—এসব ইতিহাসের ছোঁয়া। কিন্তু নিয়মতান্ত্রিক ঐতিহাসিক দলিলে বাঁশবাঁদি গ্রামের কাহারদের নাম আর তাদের লাভ-ক্ষতির হিসেব পাওয়া যাবে না। পাওয়া যাবে—হাঁসুলী বাঁকের উপকথায়। এই উপকথা সুচাঁদ বুড়ি রচনা করে, কোনো ঐতিহাসিক নন।
হাঁসুলী বাঁকের উপকথায়—কাহার গোষ্ঠীর ইতিহাস, জাতি-পরিচয়, বাসভূমি, জীবনযাত্রা, বিশ্বাস, সংস্কার, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, তাদের সুখ-দুঃখ-এসবই লেখক দেখিয়েছে কাহার সম্প্রদায়ের দিক থেকে।
মহাশ্বেতী দেবীর অন্ত্যজরা যখন কথা বলে তখন সে কথা হয় নিম্নবগের্র অবস্থান থেকে উচ্চবর্গকে লক্ষ করে। আবার বিভূতিভূষণ একান্তভাবেই মধ্যবিত্ত সমাজের কথা বলেন। মানিক বন্ধ্যেপাধ্যায় তাঁর ‘পদ্মানদীর মাঝি’ উপন্যাসে জেলেদের স্বকীয়তার চেয়ে— ব্যক্তি চরিত্রকে প্রাধান্য দিয়েছেন। আরণ্যকের দোয়াদ বা গঙ্গাতারা যাচাই হয় ‘ভদ্র’ মধ্যবিত্তের দৃষ্টিতে। কিন্তু তারাশঙ্কর একেবারেই ভিন্ন। এ উপন্যাসে কাহারদের সমান্তরালে আর কোনো গোষ্ঠী তিনি উপস্থিত করেননি। এমনকী কোনো বিশেষ চরিত্রকেও তিনি আলাদা প্রাধান্য দেননি—স্বতন্ত্র করেননি।
উপন্যাসের সুচাঁদ, বসন্ত, গোপালী বালা, কালোশশী, সুবাসী, পাখি, মধুবালা—করালী ও বনওয়ারিদের তিনি খুব সাবলীল ভাবে বেড়ে উঠতে দিয়েছেন। এখানে চরিত্ররা নিজেদের কথা বলেছে—লেখকের উদ্দেশ্যপ্রসূত বাক্য প্রয়োগ করেনি কেউ অর্থাৎ লেখক কোন চরিত্রে হস্তক্ষেপ করেননি। তারাশঙ্করের এই উপন্যাস তাই আর সকলের থেকে পৃথক।
উপন্যাসে কাহারদের দুটি উপবিভাগ একটি আটপৌরে কাহার আর অপরটি বেহারা কাহার। উপন্যাসে এর বিবরণ পাই—‘বাঁশবাঁদি পুরোপুরি কাহারদের গ্রাম—গ্রাম ঠিক নয়, ওই জাঙল গ্রামেরই একটা পাড়া। তবে জমিদারি সেরেস্তায় মৌজা হিসেবে ভিন্ন বলে—ভিন্ন গ্রাম বলেই ধরা হয়। দুটি পুকুরের পাড়ে দুটি কাহার পাড়া। বেহারা—কাহার এবং আটপৌরে—কাহার।…বেহারা—কাহারেরা পালকি বয়।… বেহারাপাড়া থেকে রশি খানেক পশ্চিমে আট পৌরে—কাহারদের বসতি। ‘গোরার বাঁধ’ বলে মাঝারি একটা পুকুরের পাড়ের ওপর ঘর কয়েক আটপৌরে—কাহার বাস করে। আট পৌরেরা পালকি কাঁধে করে না, ওরা বেহারাদের চেয়ে নিজেদের বড় বলে জাহির করে।…বলে—আট পৌরে হলো অট্টপ্রহরী অর্থাৎ ‘অষ্টপ্রহরী’। বেহারা কাহারেরা নীলের জমি চাষ করত এবং প্রয়োজন মতো—সাহেব-মেমদের পালকি বইত। আট পৌরেরা মেম-সাহেবদের বাড়ি বা কুঠির পাহারাদার। তারা কুঠিবাড়ির চাকুরে। এরপর সাহেব যায়—সাহেবের সম্পত্তি পায় চৌধুরীরা। উপন্যাসে—চৌধুরীকর্তা দেবতার দয়ায় শুধু যজ্ঞের ধনই পেলেন না সাহেব কোম্পানির তামাম সম্পত্তিও পেয়ে গেলেন জলের দাম। কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। চৌধুরীদের আমলেও কাহাররা বেহারার কাজ করেছে। চৌধুরীদের পালকি ছিল দুখানা। ডুলি ছিল খানচারেক। আট পৌরেরা তাঁদের বাড়িতেও আটপৌরের কাজ করেছে।’
ক্ষেত্র সমীক্ষায় উপন্যাসের এই তথ্যের সত্যতার প্রমাণ পাওয়া গেছে। রাজবাড়ী পাংশা ও বগুড়ার ধুনট উপজেলার বেহারা পাড়ায় গিয়ে—দেখা গেছে এরকম দুটি শ্রেণী রয়েছে তাদের। পাংশা বেহারারা—নিজেদের বলে “ডুলে বাগদি”—আর অন্যরা নিজেদের বলে শুধুই বাগদী—সরদার। বাগদী সরদার কারণ তারা সাহেবের আমলে নীলকুঠিতে চাকরি করত পাহারাদারের অর্থাৎ উপন্যাসের কাহার এবং পাংশার বাগদীদের সাক্ষ্য-প্রমাণ অভিন্ন। তাদের (পাংশার চেহারা) মধ্যেও নানা রকম ভাগ রয়েছে কিন্তু সে অন্য কথা। সবচেয়ে বড়কথা হলো—উপন্যাসের কাহাররা সুচাঁদের মুখে যেখানে অতীত বৃত্তান্ত শোনে—সেখানে—‘বাঁশবাঁদি মৌজা বন্দোবস্ত নিয়ে সায়েবরাই ওখানে পুকুর কাটায় এবং বাঁশবাঁদির সমস্ত পতিত জমি নীল চাষের জন্য হাঁসিল করে তোলে। সেই হাঁসিল করবার জন্যই এই কাহার পাড়ার লোকেরা বাঁশবাঁদিতে আসে। এসেছিল অনেক লোক। তার মধ্যে এই কাহার কয়েক ঘরই এখানে বসবাস করে। কয়েক জন পেয়েছিল কুঠিবাড়িতে চাকরি, লাঠি নিয়ে ঘুরত ফিরত, আবার দরকার মতো সাহেব মশায়দের ঘরদোরে কাজ করত; …বেহারা কাহাররা নীল চাষ করত এবং প্রয়োজন মতো সাহেব মেমদের পালকি বইত।’ এদিকে বাংলাদেশের নানা অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাগদীরাই একমাত্র স্বীকার করে যে—তারা নীল চাষের সময় সাহেবদের নীল চাষের কাজে আসে। ধুনটের নীল কুঠির পাশেই তাদের পাড়া কুঠিবাড়ি নামে পরিচিত। বর্তমান হেলি প্যাডের নিচে যে সেই নীল জ্বাল দেওয়ার বড় হাউজ ছিল তা দেখান সেখানকার বেহারারা।
নড়াইলের লোহাগড়ার বেহারারা মুসলিম হলেও তারা তাদের বসতির পাশাপাশি নীল চাষের জমি ছিলো বলে জানান। একই কথা জানান পাংশার সরিষা বাড়ি ইউনিয়নের কবির সর্দার। তারাও বাগদী বেহারা।
উপন্যাসের বর্ণিত ইতিহাস এবং বাংলাদেশে বসবাসরত বেহারাদের মুখের ইতিহাসে কোন ফাঁক কিংবা ফাঁকি নেই। পাংশার সরদার বাগদীদের সাথে কথা বলতে গিয়ে এক ধরনের অহং নজরে এসেছে। তারা ছুৎছাৎ ভাব করেছে—ডুলে বাগদী প্রসঙ্গে যেমনটা আমরা লক্ষ করি উপন্যাসের আটপৌরে—বেহারাদের ক্ষেত্রে। তাই বলে ডুলে বাগদীদের যে অহঙ্কার নেই তা নয়। তারা আবার চর ডুলুপাদিয়ার মেছো বাগদীর চেয়ে উঁচু জাতের। বনওয়ারীর জাত-পালকি কাঁধে করত বলে তাদের দুঃখ নেই বরং তাদের মতো পাল্কীবাহক এত তল্লাটে খুঁজে পাওয়া ভার—এতই ছিল তাদের নাম ডাক।
ধুনটের সুবল রায় এখনো বিয়ের ডাক এলে খুশি হয়ে ওঠেন। তার পাড়ায় সংরক্ষিত আছে একটি পাল্কী। সেটি নিয়ে তিনি বছরে দু’একবার বিয়ের ডাকে যান। উপন্যাসের বনওয়ারীর কথা মনে করিয়ে দেয় ধুনট উপজেলার সুবল বাগদী। যখন বনওয়ারীকে আট পৌরেরা যখন বলল, ‘তা তোমরাও পালকি বহনটি ছাড়ো, আমরাও তোমাদের সঙ্গে এক হয়ে যাই। কী বল সব?” “বনওয়ারী ঘাড় নাড়লে উঁহু। সে হয় না। বেবাহ আর জ্ঞানগঙ্গা এ দুটিতে ডাকলে যেতেই হবে।” তার সঙ্গে সব বেহারারা সায় দেয়। বাগদী বেহারা সুবল রায় ও তাই বিয়ের ডাক পেলে সদলবলে হাজির হন পাল্কী সমেত। একসময় সুবল রায়েরাও পাল্লা দিয়ে পাল্কী বইতো। তারাও তালে তালে ছড়া কেটে মাইলের পর মাইল পথ পার হতো। হাঁসুলী বাঁকের উপকথায় সেই তথ্যও উন্মোচিত হয়েছে কাহার—বেহারাদের সম্পর্কে। “সাহেব-মেমকে কত্তা-গিন্নিকে কাঁধে নিয়ে পাল্লা দিয়ে তালে তালে “প্লো-হিঁ-প্লো-হিঁ শব্দে হাঁক মেরে চারিদিকে “শোর” জাগিয়ে ছুটত তারা। সেকাল চলে গিয়েছে। এখন ভাঙ্গা পাল্কীর আমল।
কাহারদেরও আর চাকরান নাই, দেশেও আর সে সব পাল্কী নাই। সে আমলের সেসব পাল্কী চড়িয়ে কর্তা-গিন্নিও নাই। এই কর্তার চেহারা, পাকি আড়াই মন ওজন। তেমনি চেহারা গিন্নির, দু মনের তো কম নয়, তার উপর গিন্নির গায়ে গয়না সেও কোন না আধ মন ওজন হবে। পাল্কী কাঁধে উঠল তো মনে হল, কাঁধ কেটে বসে গেল। …রসিক বেহারারা নানা বোলের মধ্যে মাঝে মাঝে বলত—বাবু বড় ভাণ্ডারী।”
উপন্যসে বনওয়ারী তেমনি এক বিয়ের বর কনে নিয়ে আলাদা আলাদা পালকি করে পাল্লা দিয়ে পথ চলেছে। “সে হাঁসুলীর বাঁকের কাহারপাড়ার আদ্যিকালের গান গাইতে গাইতে এসেছে।… পাগল গেয়েছে—
—সরাসরি ভালোপথে—
পিছন ওয়ালারা হেঁকেছে প্লো- হিঁ।
জোর পায়ে চলিব।
প্লো—হিঁ—প্লো—হি
আরো জোর কদমে—
প্লো—হিঁ—প্লো—হিঁ—প্লো—হিঁ—
পাগল হাসতে হাসতে সুর করে এবারে বলে—
বরেরো পালকি। —প্লো—হিঁ—প্লো—হিঁ!—পড়িল পিছনে—
প্লো—হিঁ—প্লো—হিঁ!
আগে চলে লক্ষ্মী—
প্লো—হিঁ—প্লো—হিঁ
—পিছে এস লারায়ন।”
এভাবে বেহারারা গান গাইতে গাইতে পথ চলত। তাদের সেই গান হত তাৎক্ষণিক ভাবে তৈরি। কেননা পাল্কী বহনের জন্য পায়ের ছন্দ থাকা যেমন জরুরি তেমনি কণ্ঠে গান থাকাও জরুরি। কাহারদের আয় মূলত চাষাবাদে। ক্ষেত মজুরি আর গুড় জ্বাল দেওয়ার কাজ। ঘর—ছাওয়া এবং কদাচিৎ পাল্কী বহনের কাজ করে কাহাররা জীবিকা নির্বাহ করে। অর্থাৎ পাল্কী বহনের কাজ তাদের মূল পেশা নয়। তবুও পাল্কীবাহক কাহাররা পূর্বপুরুষের প্রথা মেনেই বিয়ের অনুষ্ঠানে দু’দিনের বেশি আমোদ করে না বা মদ খায় না।—কারণ বেহারার পা টললে পাল্কী টলে যাবে। তারা তাই সাবধান হয়। হাক ছাড়ে— ‘বেহারা সাবোধান। প্লো—হিঁ—প্লো—হি। আল পথে নামিলাম। পায়ে পায়ে—পায়ে পায়ে।
…ডাইনে বেঁ-কি-ব। হুঁশ করে— হুঁশ করে।” এই হুঁশ ঠিক রাখতে হলে মদ সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হয়—বেহারাদের। শুধু এই নিয়ম নয় আরো নিয়ম আছে কাহারদের। বিয়ের জন্য পাল্কী নিলে বড় বাবুদের মাছ সম্মানী দিতে হয়। জ্ঞানগঙ্গা নিয়ে যাবার জন্য পাল্কী নিলে দিতে হয় সিধে— ঘি-ময়দার সিধে। এগুলো বহন করে নিয়ে যায় কাহার বেহারারাই। এ রকম নিয়ম চালু ছিল বাগদী বেহারাদের বেলায়ও। এখন এসব আর মানা নেই। মানবে যে পাল্কী কই? আর সেই পুরানা কাল ।
কাহারদের দেবতা কালারুদ্র—তারা ডাকে কর্তা ঠাকুর বাংলাদেশের বাগদী বেহারারা শিবকে বলে পাট ঠাকুর। কাহারদের কালারুদ্র শিব ঠাকুরই। বনওয়ারী সেই শিবের কাছে চরকপাটায় শুয়ে প্রার্থনা করেছিলো, “শিবো হে, আসছে জন্মে উচ্চকুল দিয়ো।” এই উচ্চকুলের বাসনা বাংলাদেশের বাগদী বেহারাদের মধ্যে এসেছে। কেন? কারণ কাহারদের ক্ষেত্রেও যা; বাগদীদের ক্ষেত্রেও তা-ই। বাগদীরা আদিবাসী, তারা এদেশের ভূমিজ নয়; তারা ঠকে তাদের সরলতার জন্য। ঠকতে ঠকতে তারা জাতে উঠতে চায়। তারা করালীর মতো প্রতিবাদ করে না। অন্যদের কাছে মাথা নত করে বেঁচে থাকে কিন্তু তারা যখন অনুভব করে উচ্চবর্গের অবদমন তখন তারাও ভেতরে ভেতরে বনওয়ারীর মতো প্রার্থনা করে পাট ঠাকুরের কাছে। ক্রমে আদিবাসী সংস্কৃতি ত্যাগ করে তারা হিন্দু হয়—বগ্রক্ষত্রিয়ের জাতে ওঠে। তবু তাদের দুর্দিন ঘোচে না। সময় পাল্টায়—রেল স্টেশনে তারা কুলির কাজ করে; পাকা রাস্তায় রিক্সা চালায়। রিক্সার চাকার সাথে সময় ঘোরে পেশার পরিবর্তন হয় কাহার পাড়ায় বা বাগদিপাড়ায় কিন্তু জীর্ণ জীবনের কোন পরিবর্তন আসে না। চূড়ান্ত আধুনিকতার যুগেও ভাত কাপড়ের প্রয়োজন তাদের অল্প। তারা খায় নুন ভাত, জঙ্গলের শাকপাতা, ডোবারগেঁড়িগলি। পুরুষদের চাষাবাদের সময় গামছা হলেই চলে— অন্য সময় ছেঁড়া কাপড়েও তাদের আপত্তিনেই। মেয়েদের দু’চারখানা ভালো কাপড় দরকার—তা তারা নিজেরাই জোগাড় করে নেয়। চিনি খায় না, নুন আর কেরোসিন তাদের দরকার।বছরের পর বছর থেকে এভাবেই একই ছাচে চলে এসেছে তাদের জীবন।এই নিস্তরঙ্গ জীবনে তরঙ্গ তুলে দেয় করালী। কাহারদের কোঠা ঘর তৈরি করতে নেই, করালী করে। করালী এমন সব কাণ্ড করে যার সঙ্গে কাহারদের কোনোকালেই কোনো পরিচয় ছিল না। বাইরের পরিবর্তনের ধারাটা যেন করালীর হাত ধরে বনোয়ারির উঠানে এসে হাজির হয়েছে। আর তাই বাবাঠাকুরের থানের জঙ্গল পরিষ্কার হয়ে যায়। সেখানে যুদ্ধের মোটর গাড়ির আড্ডা হয়—লোপ পেয়ে যায় গ্রামের ছায়া ঢাকা পথ এজন্য সুচাঁদ বলেছিল—‘যেমন কলি তেমনি চলি’। যে ঘটনা অতীত ও বর্তমানের কাহারজীবনকে আলাদা করে দিয়েছে সেই ঘটনাটির উল্লেখ পাই পগলের গানে—
ও সায়েব রাস্তা বাঁধালে
কাহার কুলের অন্ন ঘুচালে
পালকি ছেড়ে রেলে চড়ে যত বাবু লোক।’
এখনো বাংলাদেশে যে ক’ঘর বেহারা আছে তারা বনওয়ারির আফসোস নিয়ে তারা চিতায় ওঠে। এখন বাগদীপাড়ায় যতটুকু সুচাঁদ বুড়ির গল্প বেঁচে আছে সময়ের প্রলয়ঙ্করী বন্যায় একদিন বাংলাদেশের এই বাগদীপাড়া আর তাদের সেই গল্পগুলোও মুছে যাবে কাহারদের হাঁসুলী বাঁকের মতো। কাহারদের ছোট কোপাই নদীট যেমন ইতিহাসের বড় বন্যায় ভেসে গিয়ে তাঁদের রূপান্তরিত করেছে কারখানার শ্রমিকে তেমনি বাগদী বেহারারাও গ্লোবাল সময়ের স্রোতে ভেসে ভেসে বদলে ফেলবে তাদের পেশা। আর যতই কাহাররা কোপাইয়ের পাড়ে হাঁসুলী বাঁকে ফেরার স্বপ্ন দেখুক না কেন সে স্বপ্ন যেমন সত্য হয়নি তেমনি বাংলাদেশের বাগদী-বেহারাদের অবস্থাও হয়েছে তাই। চিরকালের নিরীহ এই জাতটার ওপর এখন ভর করেছে হতাশা যন্ত্রণা আর দৈন্য। যে দৈন্যের সঙ্গে এক সময় তারা পরিচিত ছিল না।