হৃদয়ের যে স্পন্দন তারও রয়েছে নিজস্বতা। সেই নিজস্বতাকেই পুঁজি করেছেন সৌমিত বসু। তিনি কবিতাকে মিলিয়ে দিয়েছেন হৃদপিণ্ডের স্পন্দনের সঙ্গে। যে স্পন্দনের প্রতিটি কম্পন এক-একটি কবিতা হয়ে ধরা দিয়েছে তার হাতে। দৈবনির্ভর বাণীর মতো নির্ভরতার প্রতীক হয়ে কবিতা তার কাছে হয়ে উঠেছে সাধনার অংশ। কবিতাকে সাধনার যে স্তরে নিয়ে গিয়েছেন সৌমিত বসু, সেখানে বরাবরই তিনি আশাবাদী। তার কবিতা দ্রোহকে লালন করলেও তা যেন কোনোভাবেই নৈরাশ্যে না পৌঁছায়, সেদিকেও সতর্ক। জীবনকে তিনি দেখেন আশাবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে। নৈরাশ্য বা হননকারী চিন্তাকে তিনি প্রশয় দেন না।
সাময়িক সব প্রবণতাকে ধারণ করেই সৌমিত বসু নিজস্ব ব্যাকরণ তৈরির চেষ্টা করেছেন। বহুপ্রজ এই কবি শুরু থেকেই কৌতূহল, একাকিত্ব, যন্ত্রণাকাতর জীবনের পরিণতি সন্ধান করেছেন। সম্ভাবনাহীন, অস্তিত্বহীন জীবন সম্পর্কে তিনি দ্বিধামুক্ত, ফলে তিনি কবিতাকে করে তুলছেন সার্বভৌম। তার কবিতায় উঠে এসেছে জাতিক-আন্তর্জাতিক, সমকালীন ও কালাত্তীর্ণ বিভিন্ন বিষয়।
তাই তার ব্যক্তিক অনুভূতি কখনো শুধু প্রতীকী ব্যাঞ্জনার ঘেরাটোপে আটকে থাকেনি। অনুভূতিপুঞ্জকে তিনি শিল্পপ্রভাবিত শব্দের বন্ধনের সঙ্গে মিলিয়েই ভাষা দিয়েছেন। এতে তার কবিতা এক বিশেষত্বপূর্ণ দিক নির্দেশ করে।
সৌমিত বসুর কবিতা ইঙ্গিতবাহী। হৃদকম্পনের সঙ্গে মিলিয়ে তার কবিতা হয়ে উঠেছে হৃদয়ের অন্তর্গত অনুভূতির সারৎসার। তাই ক্ষয়িষ্ণু সময়কে ধারণ করলেও, নৈঃসঙ্গ্যতাকে লালন করলেও, তিনি উপলব্ধি করেছেন শিল্প কখনোই অস্তিত্ববিমুখ নয়। তাই সামাজিক উপাদানকেও তিনি অনায়াসে মনস্ততাত্ত্বিক করে তুলতে পারেন। যেখানে মানুষের মনের বিচ্ছিন্নতাবোধকে তিনি সামাজিক অনুষঙ্গ ব্যবহারের মাধ্যমে দেখিয়ে দিতে পারেন। এর ফলে তার কবিতায় সমগ্র বিচ্ছিন্নতাবোধ অতিক্রম করে ক্রমশ আবিষ্কৃত হয় এক নতুন অস্তিত্বমুখ। যখন তিনি বলেন,
রাণুবউদি, ডেকেছ বলেই এতরাতে ঝোপঝাড় পেরিয়ে এসেছি
এখন অস্বীকার করো, তুমি কি মানুষ?আমার ভায়ের মতো যে তারাটি এতক্ষণ সঙ্গে থেকেছে
বলো, তাকে কী জবাব দেবো।
নম্র বাতাস আর টিলার ওপার থেকে
পিচকিরি দিয়ে ওঠা জ্যোৎস্নারঙ
আহত বন্ধুকে দেখে মাথা নিচু করে, বলো, তাকে কতটুকু বলা যেতে পারে।আজ রাতে যে সমস্ত গয়নাগাটি নামিয়ে রাখলে জলে, রাণুবউদি
কোনো দিন আর খুঁজে পাবে?
(ভ্রম: অগ্রন্থিত কবিতা)
‘ভ্রম’ নামক অগ্রন্থিত এই কবিতাকে যদি আত্ম-অভিজ্ঞতা বলেও দেখিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়, তবু তার মাঝে খুঁজে পাওয়া যায়, এক ধারালো দ্বিধামুক্ত জীবনোপলব্ধির মূল্যবোধ। যেখানে সৌমিত বসু সামাজিক ঘটনাপ্রবাহের মাধ্যমে দেখিয়ে দিতে পারেন চিন্তার জগতের বহুমুখিতা। যেখানে তিনি নিমজ্জিত অথচ প্রশ্নবিদ্ধ ব্যক্তিক অভিজ্ঞতাকে বিভক্ত করে ছড়িয়ে দিতে পারেন নতুন যাত্রার দিকে।
১৯৪৭ সালের দেশভাগের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাও ভাগ হয়ে যায়। বিভক্তির পরে, বাংলার দুই অংশেই জীবনচৈতন্যে যে অস্থিরতা, ব্যক্তির সংকট, সংঘাত তার প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে। সত্তর দশকে পাকিস্তানের নাগপাশ থেকে সশস্ত্র রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধনীতা অর্জন করে বাংলাদেশ। একই সময়ে পশ্চিমবঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে নকশাল আন্দোলন। সামাজিক ও রাষ্ট্রিক কাঠামোর মধ্যে যন্ত্রণাকাতর এক অভিঘাত তাকে তাড়া করে স্বপ্ন ও স্বপ্নহীনতার ভেতরে। সেসব অভিঘাতকে লালন করে এগিয়ে চলা সমাজের ভেতর থেকেই উঠে এসেছেন সৌমিত বসু। তাই তার ব্যক্তিক অনুভূতি কখনো শুধু প্রতীকী ব্যাঞ্জনার ঘেরাটোপে আটকে থাকেনি। অনুভূতিপুঞ্জকে তিনি শিল্পপ্রভাবিত শব্দের বন্ধনের সঙ্গে মিলিয়েই ভাষা দিয়েছেন। এতে তার কবিতা এক বিশেষত্বপূর্ণ দিক নির্দেশ করে। যেখানে জীবনের সব অস্থিরতা ও সংঘাতকে অনায়াসে অতিক্রম করে সমাজজীবনের অন্তর্গত বেদনাকে তিনি মূর্ত করে তোলেন। যেখানে প্রতীকী ব্যাঞ্জনার বাইরেও তার কবিতার জীবনের ঘনিষ্ঠ দিকের প্রতি ইঙ্গিত দেয়, দেখিয়ে দেয় মানবিকতার টানাপড়েন, দ্বন্দ্বমুখর পৃথিবীর অস্থির রূপ।
অসামান্য হ’য়ে ফুটে উঠবার আগে
তুমি চোখ মেলে সামান্য চাইলে
দু-দিকের ঘন বন কেঁপে উঠলো তুমুল বিশ্বাসে
একটু পরেই জেরুজালেম আলো ক’রে যিনি আসবেন
তিনি সাজিয়ে নিচ্ছেন তার ঘরকন্না লুম্বিনী উদ্যানে
আজ বাতাসে উড়ছে বৃন্দাবনের ধূলো
চোখমুখ অস্পষ্ট ক’রে তিনি শুধু উড়ে চলেছেনএক আকাশ কান্না শুয়ে রয়েছে ঘাসের ওপর
ঘুম ভেঙে উঠে তিনি দেখবেন শূন্যতা জীবনের অন্যপ্রান্তের অনুলিপি।চোখ মেললেই যদি দেখা হয় তুমল অবিশ্বাসের সাথে
যদি কানে এসে লাগে পাড়ভাঙার শব্দ
সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে এই চোখ মেলা, অদৃষ্টের মলিন ছায়ায়।
(কৃষ্ণকথা-১৩: কৃষ্ণকথা)
সৌমিত বসু অতীতের বর্ণনা করেন। কিন্তু তিনি স্মৃতিকাতর নন। তার কবিতায় হতাশা নেই, অবক্ষয়-পীড়িত জীবনের গল্প নেই। বরং হতাশা এবং অবক্ষয়-পীড়িত ছবির ভেতর থেকেই তিনি প্রেরণার দিকে চোখ মেলেন। উপলব্ধির নতুন দরজা খুলে দেন। খুঁজে ফেরেন ঐশ্বর্যমণ্ডিত জীবনের স্পন্দন। আলদা করে দেখার এই উপলব্ধিই তাকে প্রতিনিয়ত উজ্জ্বল করে তুলতে থাকে। ক্ষতবিক্ষত যন্ত্রণার ভেতর থেকে তিনি যখন বেরিয়ে নতুন পথের দিশা খুঁজতে থাকেন, তা সুদূরের স্বপ্নের মতো কড়া নাড়তে থাকে ভাবনায় গোড়ায়। এক্ষেত্রে স্বঘোষিত বিশ্বাসকেই সৌমিত বসু ব্যক্ত করেন কবিতায়। এতে করে পাঠকও নৈকট্য খুঁজে পান তার পঙ্ক্তিতে। দ্বিধামুক্ত দৃষ্টিতে দেখা জীবনের সকল ছদ্মবেশকে তিনি যখন তুলে আনেন প্রজ্ঞা ও আবেগের সংমিশ্রণে, তখন তার ভাবনা ইঙ্গিত দেয় নতুন পথের। যেখানে সংশয় থাকে না, থাকে না অতিরঞ্জিত আবেগনির্ভর অনুভূতি। এখানেই তার সার্থকতা। সব অস্থিরতাকে মুঠোবন্দি করেই তিনি উৎসের দিক-নির্দেশ করতে পারেন, যা একইসঙ্গে বিস্ময় ও ধ্যানস্থতার ইশারায় অনুভূতিকে পরিতৃপ্ত করে।
আর এই যে অখণ্ড অনুভূতি যাকে শুরু থেকেই সৌমিত বসু জোড়া দিতে চেয়েছেন কবিতার ভেতরে, তা পাঠকের সঙ্গে সেতু নির্মাণ করে। বর্তমানের স্থুল সময়কে ধারণ করেই সৌমিত বসু মধ্যবিত্তের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে প্রাণ দিতে চেয়েছেন। যা তার নিপুণ বর্ণনায় প্রাণ পেয়েছে বারে বারে। যা তাকে বার বার প্রকাশিত হওয়ার প্রেরণা দিয়েছে-এক দূরবর্তী পথে
শুধু সৌন্দর্যমুগ্ধ, প্রকৃতিনির্ভর, স্মৃতিকাতরতাকে কবিতায় রূপ দিতে চাননি সৌমিত বসু। তার কবিতা বাস্তবতার নির্মম কষাঘাতে অনাসক্তভাবে খুলে দিতে পারে বন্দনা ও বন্দনাহীনতার মাঝের সেতু।
‘এই যে ঐশ্বর্য রাইকে ভেবে নিজের বউকে আর ভালোই লাগে না এও এক অসুখের মতো। কেন যে অসুখের মতো তাও জানি, তবে চাপ দিলে একটা কথাও বলবো না। তুমি কি চাও সংসারে অশান্তি হোক, কপাল কেটে রক্তে ভিজে যাক শার্টের হাতা কিংবা দুটো মানুষ মাঝখানে পাশবালিশ রেখে শুয়ে থাক সারাটাজীবন। যদি না চাও তাহলে আলগোছে বলি, কেন যে ঐশ্বর্য আমার দিকে তাকিয়ে অভিনয় করে, ভেবেই পাই না। আর এই ভাবনা নিয়ে দু-দণ্ড যে বউয়ের সাথে সময় কাটাবো তারও উপায় কই, আসলে চকলেট বোম মানে, চকলেট বোম, মানে শুধুই চকলেট বোম। কখনোই কালীপটকা নয়।
ঐশ্বর্য কাঁদলে বুক হু-হু ক’রে ওঠে। বউ কাঁদলে বিরক্ত। ঐশ্বর্যের ডানা আছে একথা ভাবতে খুব কষ্ট হয় না অথচ বউ কী ক’রে যে এস এস সি পায়! ঐশ্বর্য হেসে উঠলে হাজার হাজার মুক্তো মাটিতে গড়িয়ে যায়, বউ হাসলেই ভয় হয় পয়সা খসার। কখনো অসুখ হ’লে ঐশ্বর্যকে কাছে ডাকি, বউ এসে বিছানায় বসে। যতোবার তন্দ্রাঘোরে ঐশ্বর্য চেয়েছি, হাতের মুঠোয় দেখি ফেলে দেওয়া মায়ের আঙুল। ভাবনাগুলো ভারী হ’য়ে জলে ডুবে যায়।
ঘুম পেলে ঐশ্বর্যকে জড়িয়ে ধরতে চাই, অন্ধকারে বউ এসে আমায় জড়ায়’।
(হে ঐশ্বর্য, তোমাকে: শৃঙ্গারের মায়াশব্দরূপ)
সৌমিত বসু মধ্যবিত্তের ব্যর্থতাবোধ ও ব্যক্তির বেদনাবোধের মধ্যে সমন্বয় ঘটানোর মাধ্যমে তৈরি করেন বিদ্রুপাত্মক এক বোধ। যেখানে স্পষ্ট হয় মধ্যবিত্তের মানসিকতা। জীবন সম্পর্কে যে জিজ্ঞাসা, তাকে তিনি প্রতিনিয়ত নিজের ভেতরে লালন করেন। ফলে তার কবিতা কখনোই একরৈখিক অভিব্যক্তিকে তুলে ধরে না। সেখানে অবলীলায় আসা-যাওয়া করে জীবনযন্ত্রণার সব অনুষঙ্গ। তার মর্মমূলে রয়েছে আধুনিক নগর জীবনের ক্লান্তি, অপ্রাপ্তির বেদনা এবং ‘যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই, যাহা পাই তাহা চাই না’। আর এই যে অখণ্ড অনুভূতি যাকে শুরু থেকেই সৌমিত বসু জোড়া দিতে চেয়েছেন কবিতার ভেতরে, তা পাঠকের সঙ্গে সেতু নির্মাণ করে। বর্তমানের স্থুল সময়কে ধারণ করেই সৌমিত বসু মধ্যবিত্তের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে প্রাণ দিতে চেয়েছেন। যা তার নিপুণ বর্ণনায় প্রাণ পেয়েছে বারে বারে। যা তাকে বার বার প্রকাশিত হওয়ার প্রেরণা দিয়েছে-এক দূরবর্তী পথে।