বাংলার পলিমাটি, বাংলার নদীনালা, বাংলার পুষ্পগুচ্ছ কথা বলে ওঠে তাঁর কবিতায়। তিনি সব্যসাচী লেখক-কবি, সৈয়দ শামসুল হক। সাহিত্যের সবকটি শাখায় তাঁর বিচরণ সমানভাবে। চিরতরুণ এই কবির শেষ দিকে লেখা একটি কবিতা পড়া যাক। আমরা বুঝতে পারব তিনি কত ঘনিষ্ঠভাবে ধারণ করছেন বাঙালি পাঠকের মন-মনন।
দীর্ঘ দীর্ঘ দিন। বড় দীর্ঘ- আমি স্বস্তিহীন।
খ্রিস্টের বৎসর যদি পার হয়ে যায়,
রক্ত তার এখনো ঝরায়-
এখনো এ পৃথিবীতে মানুষ ক্রুশেও!
অগ্নি ছোটে হাওয়ায় হাওয়ায়।ক্রমেই নিজের থুতু
তার কাছে হতে থাকে পেয়-
এখনো মাটিকে লাথি যার সমীচীন।
আমি নতজানু এই রক্তাক্ত মাটিতে।
চৌচির এ বুকে তৃষ্ণা- দীর্ঘ জাগরণ-
আর এই প্রার্থনা এখন
আবার বহিয়ে দাও ব্রহ্মপুত্র-
শীতল পাটিতে
আবার বাংলাকে এনে অপরূপ অবসর দাও।শুধু হাত! বাড়াবে না তাও?
বাংলার মেঘের বুকে
ফিরে দাও বর্ষণের জল-
নাচের ঘুঙুর দাও বয়াতির পায়।
করে তোলো চেতনার সংসার সচ্ছল
অগ্নি যদি যদি শুধু ছাই
আমার জীবন-লতা তবু ধরে সেই পিপাসাই
সবুজ রৌদ্রের আজও,
শুনে উঠি কানে
প্রতিটি উঠানে
ঢেঁকি পাড় দিয়ে চলে ইতিহাস-
ব্যর্থ হয় ত্রাস-সামান্যের জন্মদিন
তেরোশত নদীর এ দেশে সে তো নবান্নেরই দিন॥
(সবুজ রৌদ্রের এই পিপাসাই)
বিশ্বজুড়ে কবির ভ্রমণপিপাসু মন ঘুরে বেড়ায়, বিপুলা পৃথিবীর কাছে হাত পাতেন কবি। কবির আরাধ্য বিচিত্র ধ্বনিময়, অর্থময় শব্দ। শব্দ ব্যতীত কবিতা অচল। নানা অনুষঙ্গ, আবেগপুঞ্জ ও অনভূতির প্রতিনিধি শব্দ। যে শব্দ সাধারণ মানুষের কাছে তুচ্ছ, অগ্রাহ্য, গুরুত্বহীন, সে শব্দই কবির কাছে মূল্যবান, গ্রাহ্য, গ্রহণীয় হয়ে উঠতে পারে। শব্দ তার আভিধানিক অর্থ হারায়, অনড় অর্থের বিপর্যয় ঘটায় কবিতায়। এক প্রকার কঠিন স্থিরতা ও নীরবতা ভেঙে শব্দ যেন চঞ্চল হয়ে ওঠে নতুন অর্থব্যঞ্জনায়। কবির স্পর্শেই শব্দ নতুনভাবে জেগে ওঠে, দ্বিতীয়ার্থের শব্দপুঞ্জ শাসিত, নির্বাচিত, গ্রন্থিত ও নির্মিত হয়। উল্লিখিত মন্তব্যের আলোকে উদ্ভাসিত কবি সৈয়দ শামসুল হক, আমাদের কাব্যবাসরের এক সম্পন্ন কাব্যপুরুষ। তিনি কাব্যবিশ্বাসে যেমন সমাজ সংলগ্ন, তেমনি কবিতার মেজাজ ও আয়োজন, প্রতিন্যাসে ও প্রতিতুলনায় চিত্রকল্প ও শব্দ বিন্যাসে আতীব্র রোমান্টিকতার অভিসারী। বাস্তবতার অনুরাগ ও সৌন্দর্য্যলিপ্সাসম আকাঙ্ক্ষা এ দু’য়ের প্রতি যত্নশীল হয়ে তিনি কবিতা নির্মাণ করেছেন। অর্থাৎ আধার ও আধেয়কে তিনি সমাজে গুরুত্ব মানেন। কবিতার পাশাপাশি তিনি গল্প, উপন্যাস ও নাটকও লিখছেন। তিনি অত্যন্ত সজাগ লেখক। কবিতার আঙ্গিক নিয়ে পরীক্ষার কাজ তিনিই সবার চেয়ে বেশি করেছেন। চৌদ্দ মাত্রার পয়ারে লেখা ‘বৈশাখে রচিত পংক্তিমালা’ কিংবা কাব্য নাটক ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ তারই বড় প্রমাণ। এ দুটি কাব্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক সত্তার ক্রম উদ্বোধনের ভাষ্য। কিন্তু সৈয়দ শামসুল হক বিষয় থেকে শিল্পের নির্যাস এমন কুশলী হাতে নিঙ্ড়ে নেন যে, তাঁর কবিতায় বিষয়োত্তর মহিমার স্বাদ জড়িয়ে থাকে শেষ পর্যন্ত।
তিনি লেখেন:
বাংলার নদীতে সেই বিদ্যাপতি মহাজন বিখ্যাত ভাদরে
জলের তুমুল চুমো একদিন মনে মনে
কামরাঙা সে কার অধরে!
আমিই সে আমি বুঝি ভাদর বাদলে ভেজা মেয়েটির মুখ
করতলে তুলে নিই, রাখি ঠোঁট- ওতেই যা হয়েছিলো সুখ
এখনো ভুলিনি সেই দস্যিপনা প্লাবিত সবুজে!
(বাংলার নদীতে সেই)
দুই.
আত্মগত প্রসঙ্গ, আত্মজৈবনিকতার সূত্রে সমকাল এবং মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ যথাক্রমে উপজীব্য হয়ে উঠেছে- ‘বিরতিহীন উৎসব’, ‘বৈশাখে রচিত পঙ্ক্তিমালা’ এবং ‘প্রতিধ্বনিগণ’ নামক তিনটি কাব্য সংকলনে। আত্মগত বিষয় কবিতার প্রসঙ্গ হয়ে ওঠায় ‘বিরতিহীন উৎসব’ এবং ১৯৫০-এর দশকের দ্বিতীয়ার্ধে রচিত ‘একদা এক রাজ্যে’(১৯৬১) কাব্যের কবিতাগুলোর মধ্যে বহিরাবরণে কোনো উত্তরণ লক্ষ করা যায় না। তবে ‘বৈশাখে রচিত পঙ্ক্তিমালা’ বিষয়বৈচিত্র্যে অনেক বেশি সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে। আত্মজৈবিক স্মৃতিচারণমূলক ভঙ্গিতে রচিত একটি মাত্র দীর্ঘ কবিতার পরতে পরতে মিশে আছে পাকিস্তান-উত্তর পূর্ব বাংলা, বিশেষ করে ষাটের দশকের বাংলাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতি, স্ফীতকায় মধ্যবিত্তের নতুন সৃষ্টি ঢাকা শহর, নিজের সৃষ্টিশীল জীবন প্রভৃতি অনুষঙ্গ। তাঁর কবিতায় উপব্যয়িত হয়েছে অসাম্প্রদায়িক মনোভাব তথা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আকর্ষণ। কবির ভাষায়: ‘অনুপম শান্তি সম্পর্ণে বললেন পিতা/ একসাথে থাকিস বাছারা।’
কিন্তু উপনিবেশিক শাসনের কূটকচালে পাকিস্তানি রাষ্ট্রের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিপন্ন, বিধ্বস্ত মানুষের মন। সামাজিক, রাজনৈতিক বিকাশ অসঙ্গগতিপূর্ণ কালো দশকের আবির্ভাব ‘অক্টোবরে কাঁদে দেশ’। ভদ্রাসন বিক্রি করে ভাই, মন্ত্রীরা শপথ নেয় গাঢ় স্বরে দাবার ঘরে- আমার সন্তান যেন বাংলার শ্মশানে থাকে দুধে-ভাতে’। বিকাশমান মধ্যবিত্ত শ্রেণীও অসঙ্গতিতে আক্রান্ত। কারও কারও বাড়ি-গাড়ি হয়। আমেরিকা, ইউরোপ ছোটে ছাত্র, অধ্যাপক। ছাপা হয় ছবি, ইলিশের গন্ধে আজো ডুবে যায় কত
ঝাঁঝালো বিক্ষোভ, অশ্রু, দুঃখ, পরাজয়:
ইলিশের দরে আজো ডুবে যায় কত
ঝাঁঝালো বিক্ষোভ, অশ্রু, দুঃখ পরাজয়
মানুষেরা বেঁচে থাকে, বংশে বংশে যায়
বাঁচার বরাত দিয়ে কাঁকনে লোবানে
উত্তীর্ণ বয়সের বিলাপ উঠে আসে সেখানে উপস্থিত বান্ধব, প্রেম, অচরিতার্থতা, সন্ধি, শহুরে হয়ে ওঠে আত্মসর্বস্বের আস্তানা, যৌনবিকৃতি আর কুৎসিত কাণ্ড-কারখানার স্তূপ। এরই মাঝে শুরু হয় সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতি, মুক্তি সংগ্রামের ডামাঢোল। জন্মমৃত্যু শোকে বসে সে জীবন জনাকীর্ণ, অনবরত চলতে থাকে চেতনার প্রবাহ। ধর্ম-পুরাণ, সংস্কৃতি ঐতিহ্য প্রাত্যহিক শর্তে কবির আয়ুকে বাড়ায়:
আবার পুড়তে থাকে মাঝিপাড়া
কুড়িগ্রামে, দাঁড়ায় যুদ্ধের জিপ। ভোরে
পরিমল পালায় ভারতে। দুর্যোধন
কাড়ে সিংহাসন। বেশ্যার যোণিতে খুঁড়ি
সুড়ঙ্গ স্বর্গের-
কি চমৎকার তার শব্দের গাঁথুনি। একজন নীলকণ্ঠ কবি সবসময় অতীত-বর্তমানকে নিয়ে বেঁচে থাকেন। আগামীতে নিজেকে সম্প্রসারিত করার লক্ষ্যে তার মহৎ সৃষ্টিকর্ম রচনা করে থাকেন। কবি তখন ভাবেন তিনি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবেন? কাব্য সৃষ্টিতে কোন কালকে নির্বাচন করবেন। সেটাই তখন তার বিবেচ্য হয়ে দাঁড়ায়। একজন কবির কবিতায় বলে কবিতাটি কোনো বিষয় সময়কে ধারণ করেন। সমকালীন বাস্তবতার নিরিখে তখন কবিতা হয়ে ওঠে সর্বজনীন। কবি সৈয়দ হক কবিতায় আদি-ছন্দের চৌদ্দ পয়ার বেছে নিয়ে সমকালীন ঐতিহ্যকে চিত্রিত করেছেন। জন কল্লোলের মতো এই পয়ার মধুসূদনের বহমানতা, রবীন্দ্রসঙ্গীতময়তাকে সার্থক আত্মসাৎ করে আধুনিক চৈতন্যের সেতুবন্ধন রচনা সিদ্ধিলাভের পর্যায়ে পৌঁছেছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। আঙ্গিকের নিত্য-নতুন উজ্জীবনের ভেতর যেন কবির পরবর্তী পরিণামেরই প্রতীকী আভাস পাওয়া যায়। ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’-এর আঙ্গিকে যে ঐশ্বর্যের দ্যুতি জিকিয়ে উঠেছে বাংলা কাব্যের বনেদি অক্ষরবৃত্তের শরীরে। তার সঙ্গে দেশজ অভিব্যক্তির রঙ ফলিয়েছেন তিনি, ঘরোয়া ছড়ার ছন্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দিয়েছেন কবিগান ও কবিতার ধারারও। বললেন:
কী হইলো এতগুলো জুয়ান মরদ?
শিঙ তুইলা ছুইটা আসলো পাগলা বলদ
লোক সংস্কৃতির উপাদানের সঙ্গে আধুনিক চেতনার অন্বয়ে ‘পায়ের আওয়াজ’এক ভিন্ন স্বাদের কাব্য।
সমকাল চিহ্নিত দেশীয় ধারাটি সৈয়দ হকের মধ্যে প্রাণবন্ত সবচেয়ে বেশি। কবির সামগ্রিক চেতনা আসলে দেশ-ঐতিহ্য অস্তিত্বে নিরংকুশ নিবেদিত প্রাণ। অর্জন কিংবা প্রার্থীর মূলে বাংলাদেশের অস্তিত্ব, তার জন্ম পরবর্তী বেড়ে ওঠা, জন্ম ও শৈশব অতিক্রান্ত কালবৃন্তে বাঙালি হিসেবে আমাদের প্রতিষ্টিত প্রেরণা সবকিছুর মর্মমূলে থাকে বাংলাদেশ হওয়ার পথটিতে প্রতিরোধ শক্তিকে চিনে নেওয়ার পর্যায়টি। কবি এখানে আপসহীন আবর্তিত। পৌনঃপুনিক তাঁকে প্রান্ত স্পর্শ করে ওই একই কারণেই। আর দায়বোধের জায়গাটিতেও তিনি নিরন্তর হয়ে ওঠেন তার কবিতায়:
অসংখ্য কীট-কোটি কোটি কীট-
এবং সেই কীটের ভেতরে, হায় কি ভাগ্য কিম্বা দুর্ভাগ্য-
একটি এখন দ্রুতগামী বাসে ছড়ে ভ্রমণ করছে দুঃখের এই বাংলাদেশ
(আমি জন্ম গ্রহণ করিনি) ।
তিন.
গ্রামীণ জনজীবনের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সরল জীবন, চরিত্রের সারল্য, লোককথার রাজপুত্রের কবি আলিঙ্গন করে বিভারূপে চিত্রিত করে লোকজীবনের মমার্থ অনুধাবনে প্রত্যাশী হন। কিন্তু সময়ের বির্বতনে সে লোকজীবনের সেবী আজ হৃতসর্বস্ব হয়ে পড়েছে, তাই উড়ে যাওয়া পাখিকে রূপকের আশ্রয়ে এই বিচ্যুতিকে বিন্যস্ত করতে চাইছেন কবি:
এই সেই পাখিরা যারা আমাদের
বাড়ির মধ্যে
উঠানের মধ্যে বৃক্ষের মধ্যে
রূপকথার মধ্যে
ঘুমন্ত রাজপুত্রের শ্রুতির নিকটে দাপট ছিল; এখন
সেই পাখিরা গেল কোথায়?
(পাখি বিষয়ক কবিতা)
লোক সাহিত্যের বিষয় ও আঙ্গিক অবলম্বী অধুনা কাব্য রচনার রীতিও এ কবির চেতনায় পাওয়া যায়। এ প্রসঙ্গে কবি বিখ্যাত ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’র অনুষঙ্গে ও তার চরিত্র মহুয়াকে উপমান চিত্ররুপে গ্রহণ করেন:
শত্রু লোকালয় থেকে মহুয়াও বদলে গিয়েছে, পেছনে কুকুর
পাল ঘনঘন শৃঙ্গার চিৎকার
ময়মনসিংহ গীতিকার পাতা ছিড়ে আজো যে ফিরছে
(একটুকু জমি সে ছাড়েনি)
কাব্য আঙ্গিকের শব্দ-ছন্দ-অলঙ্কারকে কবি লোকমেলা ও লোকমেলায় প্রদর্শিত বাজিকরের জাদুমন্ত্রের সঙ্গে তুলনা করেন। শব্দে-ছন্দ অলঙ্কার ঝুমঝম করে চলে পেছনে আসা বেলার দিকে দুপুরের রোদ ছিড়ে যায়, বাজিকর তার সঙ্গে পোষা জন্তু লাল জামা পরে। ভঙ্গুর মাসে যুদ্ধে খুনি হয়েও কবি লোকশিল্পের গৌরব ঐতিহ্যকে তাঁর কবি চেতনায় অম্লান করে তোলেন।
তাই স্বদেশ চেতনায় আপ্লুত হয়ে তিনি গ্রামের সেই নকশী কাঁথা উপমা চিত্রে গ্রহণ করে শব্দশিল্পের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন:
দুঃশীল এ সময়ের জাগে তলদেশ
আজ রাতে
রঙ্গিন সুতোয় সুঁচে ভেতরের নকশি কাঁথায়
তবুও জীবন লিঙ্গে বাহান্নর শহীদের নামে
গ্রামীণ সংস্কৃতি সমষ্টি গ্রামের সেই শ্বাশত অভিজ্ঞতায় জমাটবদ্ধ হয়ে জন্ম-মৃত্যুরহস্যকে শ্রেণীস্তরে প্রকাশ করেন কবিতায়:
নিঝুম জঙ্গলে তুমি শুনছিলা ধনেশের ডাক?
হঠাৎ আছাড় দিয়া পড়ছিল রূপার বাসন?
জলপির গাছে কুড়ালের কোপের মতন।
তাই কি তোমার দেহে ল্যাখা তিন বাইন তালাক?
পল্লীকবি জসীম উদ্দীন, আবুল হোসেন, শহীদ কাদরী, আল-মাহমুদ, ওমর আলী, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, মুহম্মদ নূরুল হুদার প্রমুখের কবিতায় যেমন প্রত্যাশিত গ্রামীণ-লোকসংস্কৃতি লোক সাহিত্য-ঐতিহ্য লোকজ শব্দের ব্যবহার লক্ষনীয়, তেমনি সৈয়দ শামসুল হকের কবিতায়ও লক্ষণীয়।
স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে, ‘বৈশাখে রচিত পঙ্ক্তিমালা’ থেকে শুরু করে- ‘ভষ্ম যদি সর্বাঙ্গে আমার’ পর্যন্ত সৈয়দ হকের যে কটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে, তাতে তাঁর সৃষ্টিশীলতায় এক নতুন ও পেশীল নিরীক্ষা শক্তি সঞ্চারে সহায়ক হয়েছে। আর এভাবে সৈয়দ শামসুল হক হয়ে উঠেছেন বাংলা কাব্য আসরে অনন্ত স্বতন্ত্র ও শক্তিমান কাব্যপুরুষ।
চার.
সৈয়দ হক চলচ্চিত্রের জন্য গানও রচনা করেছেন। ‘এমন মজা হয় না গায়ে সোনার গয়না’, ‘এই যে আকাশ এই যে বাতাস’, ‘তুমি আসবে বলে কাছে ডাকবে বলে’, ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস’, ‘তোরা দেখ দেখ দেখরে চাহিয়া’ ইত্যাদি গান সমৃদ্ধ করে বাংলা চলচ্চিত্রকে। তবে চলচ্চিত্র অঙ্গনে তাঁর এ ব্যস্ততার মধ্যেও থেমে থাকেনি সৈয়দ শামসুল হকের কবিতা কিংবা ছোটগল্প রচনা। ১৯৬১ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘একদা এক রাজ্যে’। ১৯৫৪ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত লেখা তাঁর ছোটগল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘তাস’, ‘শীত বিকেল’, ‘রক্ত গোলাপ’ প্রভৃতি।
সৈয়দ শামসুল হকের উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে ‘এক মহিলার ছবি’, ‘অনুপম দিন’, ‘সীমানা ছাড়িয়ে’, ‘নীল দংশন’, ‘স্মৃতিমেধ’, ‘মৃগয়া’, ‘এক যুবকের ছায়াপথ’, ‘বনবালা কিছু টাকা ধার নিয়েছিল’, ‘ত্রাহি’, ‘তুমি সেই তরবারি’, ‘কয়েকটি মানুষের সোনালী যৌবন’, ‘নির্বাসিতা’, ‘খেলারাম খেলে যা’, ‘মেঘ ও মেশিন’, ‘ইহা মানুষ’, ‘বালিকার চন্দ্রযান’, ‘আয়না বিবির পালা’ প্রভৃতি। সৈয়দ হকের লেখা কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘বৈশাখে রচিত পঙ্ক্তিমালা’, ‘বিরতিহীন উৎসব’, ‘প্রতিধ্বনীগণ’, পরানের গহিন ভিতর’ উল্লেখযোগ্য।
বাংলা মঞ্চ নাটকেও শক্তিমান এক পুরুষ হিসেবে নিজের লেখনীর প্রমাণ দিয়েছেন সৈয়দ হক। তাঁর লেখা নাটকগুলোর মধ্যে ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ এবং ‘নূরলদীনের সারা জীবন’ সমকালীন অভিপ্রায়ের এক দৃপ্ত প্রকাশ। সৈয়দ হকের লেখা অন্যান্য নাটকের মধ্যে রয়েছে ‘গণনায়ক’, ‘ঈর্ষা’, ‘নারীগণ’, ‘উত্তরবংশ’ ইত্যাদি।
অগণিত পাঠকের ভালোবাসার পাশাপাশি দেশের প্রায় সব প্রধান পুরস্কারই নিজের অর্জনের খাতায় জমা করেছেন সৈয়দ শামসুল হক। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো বাংলা একাডেমি পদক, একুশে পদক, আদমজী সাহিত্য পুরস্কার, পদাবলী কবিতা পুরস্কার, জাতীয় কবিতা পুরস্কার, স্বাধীনতা পদক প্রভৃতি।
তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি একজন সমাজ সংস্কারক কবি।তিনি কবিদের ডাক দিয়েছেন ‘ আমরা চাই একাত্তরের বিজয়ী বাংলাদেশ’।
তিনি ক্ষতবিক্ষত বাংলাদেশকে দেখে আহত-বিক্ষুব্ধ হন। ভুল পথে স্বদেশের যাত্রা তাকে ভাবিয়ে তোলে। তার সংক্ষুব্ধ উচ্চারণ:
ফিরে এসো বাংলাদেশ
কোথায় যাচ্ছ তুমি ধেই ধেল্ল করে
পাইকপাড়ার দিকে টুপি এঁটে
সারিন্দায় পল্লী ধুন তুলে
যেন সঙ্গে আছে
হাজার বছর।
ফিরে এসো বাংলাদেশ
ফিরে এসো
লোহিত্য নদের কিনারে
ফিরে এসো বুক রঙ্গী মাছের সংসারে
লাল শাদা শাপলার
কচুরির বেগুনি জাজিমে।
সৈয়দ শামসুল হক সযত্নে স্বদেশকে তার কবিতায় ধারণ করেছেন। রাজনীতিকদের অসততা, আমলাদের দুর্নীতি-অনিয়ম বাংলাদেশের অন্ধকার গন্তব্য তাকে আন্দোলিত করে। মানুষের অসন্তোষ তিনি কবিতায় তুলে ধরেন। তার অবদমিত কবিসত্তা শৃঙ্খল মানে না। রাজনৈতিক চেতনার শিকার সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে তিনি কবিতা লেখেন বিভিন্ন সংকট উত্তরণের মিছিলে সৈয়দ হকের উজ্জ্বল উপস্থিতি উল্লেখ করার মতো।
সৈয়দ শামসুল হক রাজনীতিসচেতন কবি। যদিও বহু অভিধায় তাকে আলোকিত করা যায়। কিন্তু তার কবিতায় রাজনৈতিক ভাবনা বিশেষভাবে থাকার কারণে তিনি স্বমহিমায় ভাস্বর। রাজনীতি আমাদের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ। এ প্রসঙ্গকে সৈয়দ হক কবিতার বিষয়বস্তু করে মানুষের কাছে নানা মেসেজ পৌঁছে দিয়েছেন। সৈয়দ হকের কবিতায় রাজনীতিতে কবিতার ভূমিকা বিষয়ক নিরীক্ষা লক্ষ করা যায়।
আর এর জন্যই তিনি অন্য কবিদের চাইতে বেশি উজ্জ্বল।