কবিতা মূলত অনুভূতির প্রকাশ ও বিস্ময় সৃষ্টির শিল্প। তা-ও প্রতিটি ইমেজ যদি একেকটি কবিতা হয়। তাহলে ঠিক শব্দটি সঠিক মাত্রায় ব্রহ্মাণ্ডের দ্যুতি হয়ে ওঠে ঠিক কখন? অবশ্য অন্তর্দ্যুতিও হতে হয় কখনো কখনো। তবু কবিতাকে জাগায় এমন একটি সোনার কাঠির শব্দ, সেই লৌকিক শব্দের কাঠি নিয়ে, যুগে যুগে কবিরা এসেছেন কুহক হয়ে। এই কুহকের ম্যাজিক আমি একুশ শতকের কবিদের হাতেও দেখেছি। কারণ, এই সময়ের তারুণ্যের কবিতার সেই আশ্চর্য্য কোলাজ সঞ্জীবনীতে, তেমনি শব্দবৃত্তের গুঞ্জরণ রয়েছে। তাই, মনে হয়েছে এ সব কবিতা কখনো অকৃত্রিম, কখনো কৃত্রিম—ভেতরে ভেতরে মনোজগতের নিশ্চয়তা আছে বলেই। অবশ্য এদের ইনার আই—উদ্ভাবিত কাব্যদৃষ্টি কখনোই অবিনাশী শক্তির দ্বন্দ্বে মথিত নয় বলেই অগ্রজের প্রবাহমানতায় ঋণ আছে, ভারনাকুলারের (মাতৃভাষা) সাধনাও আছে।
নিজস্ব এক কাব্যভাষা আছে বলেই ইমতিয়াজ মাহমুদের ‘তোমার দিকে যাই’ কবিতায় রচিত হয়—
চোখের সামনে পুড়ছে আমার ডানা
তীরন্দাজের তীরগুলো তাক করা
তবুও তোমাকে বলছি দূরের পাখি
আমার এখনো উড়তে অনেক বাকি
একই চিন্তার নৈকট্য আছে শামীম হোসেনের ‘নদীসঙ্গ’ কবিতায়ও।
উপনদীর নাভিতে জমেছে পলি
উধাও বাঁশির সুর
ভাটিয়ালি গান—
মৎস্যকুমারীর ঠোঁটে মৃদু অভিমান।
যদিও, এ থেকেই কোনও কালের সমগ্র রূপ ফুটে ওঠে না। কিংবা একুশ শতকের নির্বাচিত এই কবিদের কবিতায় হয়তো ভাববাদী স্পিচের যাবতীয় সারল্য দিয়েও, কেবল এদের দারুণ সব কবিতার তুলনামূলক আলোচনা করা সম্ভব নয়। তবে, কিছুটা হলেও কাব্যস্বভাবের দুর্মোচ্য গুণ্ঠন ফুটিয়ে তুলতে পারলেও, প্রত্যেকের কাব্যধারায় প্রচ্ছন্ন মেধাবী কবিতার স্বাতন্ত্র্যও আছে। সেই সময় ও স্বাতন্ত্র্যের সহায়ক হয়েছে এদের অগ্রজদের থেকেই। তেমনি কিছু কবিতার উদাহরণ তুলেই না হয় এই আলোচনার আরও গভীরে যাওয়া যাক।
শরীর—
মাংসের যন্ত্রণা!
নিজের মুখেই চিবিয়ে খাই
হাড়গোড় জমানো সূর্যের সিঁড়ি
কংকাল
দেখে চিনতে পারি
ওটা আমার বেশ্যাতে জন্মানো
জারজ!
(শারদুল সজল: রাস )জননী পান-সুপারি নিয়ে নিয়ে প্রহরপর্ব বরণ করে নেই
দুঃখ করে বলে—তোর বাবা বেঁচে থাকলে
গোলা ভরা ধান সুখী সংসারের মন্দিরা বাজাতো।
(মিজানুর রহমান বেলাল: বেঁচে থাকার গল্প )রাগিও না, নক্ষত্র ছেপে দেব।
সেই যে মিনুদি, কৈশোরের গল্পচ্ছলে
দেখিয়েছিলেন দুধাল কোমর
এর আগে বুঝিনি
মানুষের শরীরে যে নদী বাস করে
শোনা যায় ঢেউয়ের আওয়াজ।রাগিও না, বলে দেব সেই কথা।
(চন্দন চৌধুরী: প্রকাশ )কথা দিয়ে কোনোদিনও জল সে দেয় না,
কোনোদিনও সমুদ্রে মেশে না,তৃষ্ণার্ত হোসেন হায়! নদী এক জন্মান্ধ আয়না।
(জাকির জাফরান: নদীও কূটনীতি জানে )কেমন পুতুল বৌ এনে দিলে মা
সারাবেলা বৌ বৌ খেলে ভেসে গেলো সোনার সংসার
বৌ আমার কুয়াতলায় মাটির কলসি ভাঙে রোজ
চালুনি-কুলার কাজে ভুল করে কাঁদেহাঁড়ির ভেতর পুড়ে চাড়া হয় লাউফুল ভাত।
(অতনু তিয়াস: বৌ )
ফর্মের নিজস্বতায় কেউ যদি নিয়ম ভেঙে নতুন কোনও সম্ভাবনার অধিকার দেখাতে পারেন, তবেই তো সেই নিয়ম ভাঙার মায়া-বিভ্রম, আলো-ছায়ার পক্ষপাতিত্বেই ফুটে ওঠে সেই কবির অমৃত অহঙ্কার। ফলে কারও কারও কবিতায় প্রথা—প্রচলিত ধারণার বিপরীতে কোনো বাঁক, কোনো অনির্ণেয় পরিবর্তন—কোনো উদ্ভাসের স্বপ্নও তৈরি হয়। কিন্তু উল্লিখিত সমস্ত কবিতার কাব্যদর্শন ও জটিল যন্ত্রণার নির্ভরতা, তাদের কবিতায় কতটা সাবলীল তা-ই দেখা বিষয়। যদিও অভিনব কাব্য উপকরণ, শব্দ-ছন্দ-অলঙ্কার—যা প্রকৃত কবি মাত্রেরই নিজস্ব সৃষ্টির নিশ্চয়তার মধ্যে থাকে। নানাবিধ সেই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা দিয়ে এই কবিরা নিজস্ব সচেতনতা তৈরি করেন। টানাগদ্যে কবিতা লেখার প্রবণতা তাদের পূর্ববর্তী কবিরাও কমবেশি শুরু করেছিলেন। কিন্তু একুশ শতকের বেশির ভাগ কবিই যেন এই ফর্মেই কবিতা লেখার মণীষা, বৈদগ্ধ্য ও অন্যান্য তাত্ত্বিক অনুভূতিতে সময়কে উপস্থাপন করছেন অনেক বেশি করে। কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যাক—
সেবিকার চোখে ইহকাল জাগে তার। শহরে শহরে গড়ে ওঠা বৃদ্ধ পিরামিড থেকে চুরি হয়ে যায় চুড়ি— বিমানবালিকা! মনোবিজ্ঞান পড়েনি সে, শুধু বিমূর্ত সূচের অগ্রভাগে দেখে নিয়েছে চোখ। এখন মৃতবালিকার লাশ হয়ে অ্যাপ্রোন জাগে না। মনে হয় ব্যবহৃত জোসনা মেখে চলে আসেন মিস পূর্ণিমা চ্যাটার্জি
জোয়ার আসেনি এখনো। দৃশ্যবাদী কাগজ ঢুকে গিয়েছে প্রেসক্রিপশনে। অনন্ত গর্ত হতে বেরিয়ে আসে প্রদত্ত স্বপ্ন, আর স্বপ্নের ভিতরে ক্রীড়াশীল দুটো টিকটিকি…
আসুন মহামান্য ফ্রয়েড, সংস্কারের অর্থমূল্যে কিনে নেব সেবিকার হাত, বিমানবালিকার চুড়ি…
(এমরান কবির: রোগী)ছুটে আসছে ফণাতোলা ঢেউ—এত নাচমুদ্রা ধরে আছ পৃথুল শরীরে…সমুদ্র,
সাঁতার জানি বলে তোমার মাহাত্ম্য এতটা বিশদ—এই তো দিয়েছি ঝাঁপ। কে জানে তোমার কতটা গভীরে আমার গন্তব্য স্থির
হয়ে আছে—মারিয়ানা ট্রেঞ্চ, না কি সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড? বলো, বিষতীর
বিদ্ধ করে কত দূর গেলে শোনা যাবে শিস—শাঁখের নিনাদ?প্রবালমহল আর ঝিনুক-অরণ্য ঘুরে আজ কোনো মুক্তা কুড়াব না। বরং ল্যাবরাডার,
পেরুভিয়ান স্রোত কেটে কেটে একদিন অন্তরীপবাসী হব। কেননা প্রশান্ত, পীত,
বঙ্গোপসাগর আর শৈবালসমুদ্র ঘুরে আমি আজ জলমুগ্ধ জীব।একদিন তোমাকেও মুগ্ধ করে দেব। আর জানি, সেদিন লোনা ঢেউয়ের গর্জন
ছাপিয়ে তুমিও বলে উঠবে—সহসা শরীরে বর্শা গেঁথে দিল এ কোন মাছকুমার…
(চাণক্য বাড়ৈ: সমুদ্রসঙ্গম )
এছাড়া, এই সময়ের প্রধান কবিদের কবিতায় রয়েছে ব্যাপক ইমেজের প্রসঙ্গ। বিষয়টি এত গভীর এবং অর্থবহ এই কারণে যে, পাউন্ডের যে সংজ্ঞাটিতে ‘ইমোশনাল কমপ্লেক্স’-এর বলে যে উল্লেখ রয়েছে, এদের কবিতায় কিন্তু তার সঙ্গে ‘ইনটেকচুয়াল’ বিষয়টিও সমান গুরুত্বের সঙ্গে আছে। কেননা, কবিতা প্রায়শই আবেগের প্রকাশ হলেও এক্ষেত্রে মননের ভূমিকাও কোনো অংশে কম নয়। সে রকম সুদৃঢ় প্রবণতার কবিতাও কিছু পড়ে নিলে ক্ষতি কিছু আছে?
আমি তো ময়ূরের অলঙ্কারগুলো চুরি করে তোমাকেই দিতে চেয়েছিলাম
অথচ হাজার অলঙ্কারেও তোমার বৈধব্য কাটলো না
বৈধব্য মানে অন্যপক্ষের মরে যাওয়ার গল্প!
(অথির চক্রবর্তী : বৈধব্য)একটু একটু করে মানুষ আমাকে মনে রাখুক।
খোলা মাঠে, আড্ডায়—তৃষ্ণার চেয়ে
চায়ের উষ্ণতা বেশি মগ্ন করে।
(মামুন রশীদ : একটু একটু করে)শুভরাত্রি। বেঁচে থাকলে
কাল আবারও কথা হবে।
এই কথা বলে বিদায় নিলাম
তারার কাছে
যে ঘরে শুয়ে কবিতা লিখি
বরফের মেশিন
বৈদ্যুতিক চুলা
চকচকে বটি
ধারালো চামচ
তাকিয়ে থাকে!
(রবু শেঠ: টা টা…)যদি ভুল করে কোনো ভুলফুল ফোটে তোমাদের ছাদে
জেনে রেখো সে ভুল আমি;
জেনে রেখো তোমার খোঁপায় ঠাঁই হলো না
তাই ফুটেছি অকালে—হৃদয়ের দাবি নিয়ে জংলি কুসুম!
কাচের দেয়াল ঘেরা তুমি-আমি-আমাদের পৃথিবীতবু কেন মনে হয়—এই ছুঁই এই ছুঁই?
(মোহাম্মদ নূরুল হক: জংলি কুসুম)আঘাতে আঘাতে মানুষ দস্যু হয়ে যায়।
চিতই পিঠার মতো জালি জালি কলিজায়
রক্ত ফিনকি দিয়ে ওঠে তার।বুকের গহিনে অদৃশ্য চুলোয় স্বপ্নরে পুড়ে দেয়
যে স্বৈর দহন ,
তারই বিধ্বস্ত পাড়ে পড়ে থাকে একাকী
জ্বলন্ত অঙ্গার মানুষ
(কাজী নাসির মামুন : কুকুরীর জন্য সংবেদনা)
স্বপ্ন আন্দোলিত, অদৃশ্য শব্দ-ধ্বনির গভীরতায় এ সব কবিতার অর্থ খুঁজে পেতে হয়তো রহস্যের পর রহস্যকে পার হতে হয়। অবশ্য এ-প্রসঙ্গে রনজিৎ দাশই যথার্থ বলেছেন, ‘প্রথমত, মানুষের মস্তিস্কে, আবেগ এবং মনন দুটি মিউচুয়ালি এক্সক্লুসিভ প্রক্রিয়া নয়। আবেগ এবং মননের মিশ্র প্রবাহই মানুষের চেতনাস্রোত। বিভিন্ন ‘‘ব্রেন সারকিট’’-এর মধ্যে অবিশ্রাম ‘‘ক্রস টকি’’র মাধ্যমে আমাদের চেতনার উদ্ভব হয়। আসল প্রশ্ন হচ্ছে, একজন কবি নিজে তাঁর চেতনাপ্রক্রিয়ার এই মৌলিক সংগঠনটি স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করেছেন কি না, এবং দ্বিতীয়ত, তাঁর কবিসত্তার পক্ষপাত কোন দিকে—আবেগের দিকে. না মননের দিকে। সজ্ঞানে কিংবা অজ্ঞানে, এই পক্ষপাত কিংবা প্রবণতাই একটি নির্ণায়ক শক্তি; এই প্রবণতার তারতম্যেই একজন কবি সুইনবার্ন এবং আরেকজন কবি এলিয়ট হয়ে ওঠেন। আসলে, বড় কবিরা প্রত্যেকেই এই আবেগ ও মননের শঙ্খ-লাগা শক্তিকে চূড়ান্ত মাত্রায় উজ্জীবিত করেন এবং ব্যবহার করেন।’
ফলে, একেক কবির মেটাফর একেক রকম এবং নানা কৌণিক ও নানা প্রসেসের মাধ্যমে বিস্তারিত হয়। যা কেবল বাস্তব-পরাবাস্তব প্রতিক্রিয়ার থেকেও মারাত্মক। কখনো যৌন-জটিল সম্প্রসারণের ইন্টারকোর্স থেকেও এই কবিদের কোনো-কোনো কবিতা কাব্য রহস্যের তন্তুজট খুলে বেরয় সেইসব অগ্রসর কবির আবচেতন বোধ! একুশ শতকের এই নির্বাচিত কবিতা পাঠ করতে করতে মনে হলো, এই কবিতাগুলো যেন সৃষ্টির বিস্ময়। একই সঙ্গে অনুভূতির বিস্ময়কর প্রকাশও।