অভিজ্ঞতা, প্রজ্ঞা, মনীষা, অধ্যয়ন ও কল্পনার মিথস্ক্রিয়ায় সৃজিত হয় শ্রেষ্ঠ সাহিত্য। মনের বিশৃঙ্খল অবস্থা সৃজনের শ্রেষ্ঠ সুযোগ কিন্তু শ্রেষ্ঠ সৃষ্টির পূর্বশর্ত শৃঙ্খলা। বৈজ্ঞানিক তত্ত্বানুসারে, মহাবিশ্বে গ্রহ-উপগ্রহ সৃষ্টির পেছনে নক্ষত্রের বিশৃঙ্খলাই দায়ী। কোনো সুচিন্তিত প্রপক্রিয়ার ফলে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ ও সংকোচন ঘটে না। সৃষ্টিশীলতার যেকোনো প্রপঞ্চের ক্ষেত্রেও ওই সূত্র আংশিক সত্য। কবি প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা-ভিন্ন স্বকপোলকল্পিত বিষয়কে সব সময় কবিতা করে তুলতে পারেন না। যিনি পারেন তিনি হৃদয়বৃত্তির কাছে যেমন সৎ নন, তেমনি বুদ্ধিবৃত্তির ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। যে কবির অভিজ্ঞার ভাণ্ডার বিচিত্রমুখী, অনেকান্ত ঘটনার যিনি গভীর পর্যবেক্ষক, তাঁর পক্ষে কেবল স্বকপোলকল্পিত সাহিত্যসৃষ্টি সম্ভব নয়। পাঠ ও যাপিত-জীবনের অভিজ্ঞতা যাঁকে প্রাজ্ঞ করে তুলেছে, কল্পনা যাঁকে করেছে কবি, তাঁর কবিতায় বুদ্ধির দীপ্তি এবং মনীষার ছাপ থাকবেই। ব্যক্তি তাঁর অভিজ্ঞার বাইরের গিয়ে কেবল কল্পনায় ভর করে প্রকাশ করতে পারে না। অত্যল্প পাঠের ওপর নির্ভর করে কবি কল্পনা-প্রবণ হয়ে উঠতে পারেন কিন্তু বিপুল পঠন-পাঠনে যিনি নিজেকে ঋদ্ধ করে তুলেছেন, তাঁর পক্ষে যুক্তিহীন কল্পনার স্রোতে ভেসে যাওয়া সম্ভব নয়। তাঁকে হতে হয় বুদ্ধি, প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতা ও কল্পনার সমন্বয়ক। একই সঙ্গে ইতিহাস-ভূগোল-রাজনীতি-অর্থনীতি-ধর্ম ও সমাজ সচেতনও। আধুনিক যুগের জটিল পরিস্থিতির ভেতর বসবাস করে সময়ের জটিল আবর্তন শনাক্ত করাও তাঁর দায়।
আধুনিক বাংলা কবিতার প্রথম আধুনিকদের একজন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। তাঁর কবিতায় আবেগের চেয়ে প্রজ্ঞা, কল্পনার চেয়ে অভিজ্ঞতা এবং ভাবালুতার চেয়ে বুদ্ধিবৃত্তির পরিচয় বহুল পরিমাণে বিধৃত। ফলে তাঁর কবিতা সহজবোধ্য হয়ে ওঠেনি। এর কারণ কবিতা নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে ধ্যানস্থ হওয়া এবং কবিতাকে অভিজ্ঞতা ও ভাবনা প্রকাশের বাহন করে তোলা। এ প্রসঙ্গে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘কাব্য সংগ্রহ’র ভূমিকায় লিখেছেন বুদ্ধদেব বসু, ‘‘সুধীন্দ্রনাথ কবিতা লিখতে আরম্ভ করেছিলেন, তাঁর স্বভাবেরই প্রণোদনায়, কিন্তু তাঁর সামনে একটি প্রাথমিক বিঘ্ন ছিলো বলে, এবং অন্য অনেক কবির তুলনায় যৌবনেই তাঁর আত্মচেতনা অধিক জাগ্রত ছিলো বলে, তিনি প্রথম থেকেই বুঝেছিলেন—যা আমার উপলব্ধি করতে অন্তত কুড়ি বছরের সাহিত্যচর্চার প্রয়োজন হয়েছিলো—যে কবিতা লেখা ব্যাপারটা আসলে জড়ের সঙ্গে চৈতন্যের সংগ্রাম, ভাবনার সঙ্গে ভাষার, ও ভাষার সঙ্গে ছন্দ, মিল, ধ্বনিমাধুর্যের এক বিরামহীন মল্লযুদ্ধ। তাঁর প্রবৃত্তি তাঁকে চালিত করলে কবিতার পথে— সে-পর্যন্ত নিজের উপর তাঁর হাত ছিলো না, কিন্তু তারপরেই বুদ্ধি বললে, ‘পরিশ্রমী হও।’ এবং বুদ্ধির আদেশ শিরোধার্য করে অতি ধীরে সাহিত্যের পথে তিনি অগ্রসর হলেন, অতি সুচিন্তিতভাবে, গভীরতম শ্রদ্ধা ও বিনয়ের সঙ্গে।’’ শিক্ষা ও রুচিবোধ যাঁকে মার্জিত ও আবেগের সংহতি দিয়েছে, তাঁর পক্ষে প্রগলভতায় ভেসে যাওয়া দুরূহ। সুধীন দত্তের কবিতায় এমন এক মার্জিত রুচির প্রলেপ ছড়ানো যাকে দুর্বোধ্য বলে দূরে ঠেলে দেওয়া যায় না, সসম্ভ্রমে প্রণতি জানাতে হয়। এ কথা সত্য—তাঁর কবিতার সঙ্গে সাধারণ পাঠকের প্রীতিপূর্ণ কোনো সম্পর্ক গড়ে ওঠে না; যা গড়ে ওঠে দীক্ষিত পাঠকের ক্ষেত্রে।
প্রবুদ্ধি ও হৃদয়াকুতি—এ দুয়ের মিথস্ক্রিয়ায় যে কবিতার সৃষ্টি, সে কবিতা পাঠকের মনকে সহজে আকৃষ্ট করে না কিন্তু চিন্তা জগতে সসুক্ষ্ম অভিঘাত সৃষ্টি করে। তাঁর কবিতা বিশেষভাবে পূর্বকল্পিত সৃষ্টি; কোনোভাবেই আকস্মিক ঘটনা কিংবা তাৎক্ষণিক অনুভূতির তরল প্রকাশ নয়। ‘কবিতার নির্মাণ: সুধীন্দ্রনাথ’ প্রবন্ধে অশ্রুকুমার শিকদার উল্লেখ করেছেন, ‘সুধীন্দ্রনাথের কবিতার গঠন উদ্ভিদের অচিন্তিতপূর্ব নিয়মে সম্পাদিত হয় না। তার বিকাশ ও শ্রীবৃদ্ধি স্থাপত্যের মতো পূর্বপরিকল্পিত। বাস্তুশিল্পী যেমন ব্লুপ্রিন্ট বা নকশা তৈরি করে তারপর সৌধনির্মাণে হাত দেন, তেমনি এই কবির প্রতিটি কবিতার পিছনে আমরা এক পূর্বকল্পনা বা নকশার অস্তিত্ব অনুভব করি। ইটের মতো শব্দ সাজিয়ে সাজিয়ে গড়ে ওঠে তাঁর কবিতার এক একটি স্তবক। ন্যায়ের পরম্পরায় সেই স্তবকগুলি সাজিয়ে নির্মিত হয় তাঁর এক একটি কবিতা। কবিতাগুলি যেন সঙ্গীত বেদনায় মুখর এক একটি কক্ষ। অনেকগুলি কবিতা নিয়ে এক-একটি কাব্যসংকলন—যেন এক-একটি মহাল। সেই সব মহাল নিয়ে এই মহিমাময় কাব্যের সৌধ।’ অশ্রুকুমার সিকদারের এই মূল্যায়ন যথার্থ; কিন্তু ইটের মতো শব্দ সাজিয়ে নির্মাণের যে অভিমত, তা সম্পূর্ণ সত্য নয়। কারণ এ কথা মেনে নিলে সুধীন্দ্রনাথকে কবিতা বিনির্মাণকলার একজন কৌশলী বলেই মনে হয় এবং প্রকৃত কবির যে বৈশিষ্ট্য ও অভিধা, তা থেকে বঞ্চিত করা হয়।
সুধীন দত্ত কবিতাকে অভিজ্ঞতা ও কল্পনার সমন্বয়ে প্রজ্ঞার স্মারক করে তুলেছেন। চিন্তাশূন্য কল্পনাবিলাসিতার বিপরীতে অবস্থা নিয়েছে তাঁর কবিতা। সঙ্গত কারণে অপ্রস্তুত পাঠকের পক্ষে তাঁর কবিতার রস আস্বাদন অনায়াস-সাধ্য নয়। এ কথা অস্বীকার যায় না—তাঁর কবিতায় তৎসম শব্দের বাহুল্য রয়েছে, সেই সঙ্গে রয়েছে মিথ ও পাণ্ডিত্যের সংশ্লেষ। এর অন্য কারণও রয়েছে। সুধীন দত্ত যুক্তিনিষ্ঠ এবং বিজ্ঞানমনস্ক। প্রমাণ ছাড়া অন্তঃসারশূন্য বিষয়ের প্রতি কোনো মোহ ছিল না। বস্তুসত্যের ওপর কল্পনার প্রলেপে কবিতা সৃষ্টিই একমাত্র লক্ষ্য ছিল। কেবল ভাবের জগতে বিচরণ করে, যুক্তিহীন স্বপ্নচারিতায় প্রতিভার অপচয় সময়ের অপব্যবহারে ছিলেন অনীহ। যা কিছু দেখেছেন, উপলব্ধি করেছেন তাকেই কবিতায় রূপান্তর করেছেন। তাঁর কবিতার অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে খুব তুচ্ছ বিষয়ও, কিন্তু তার প্রকাশভঙ্গির আভিজাত্যে বিন্দুমাত্র আঁচড় লাগেনি। ‘উটপাখি’, ‘কুক্কুট’ নিয়ে কবিতা লিখেছেন তেমনি লিখেছেন দর্শন, সমাজ, রাষ্ট্র, অধ্যাত্ম-সংকট নিয়েও। কিন্তু এসব কবিতাকে কোনোভাবেই বিষয়ের অনুগত করে তোলেননি। তাঁর কবিতা যেমন দর্শনে আক্রান্ত নয়, তেমনি ধর্মীয় বাণী প্রচারের অনুষঙ্গও নয়। বরং কোনো কোনো সমালোচক তাঁর কবিতায় নিখিল নাস্তির সন্ধানও পেয়েছেন। এ সম্পর্কে ‘সুধীন্দ্রনাথ দত্ত: শব্দের অনুষঙ্গে’ শীর্ষক প্রবন্ধে সৈয়দ আলী আহসান লিখেছেন, ‘‘সুধীন্দ্রনাথ দত্তের জড়বাদী দুটি জিনিস তাঁর কবিতার মধ্য দিয়ে তিনি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। একটি হচ্ছে তিনি যে নাস্তিক একথা বারবার বলতে চান। এই বলাটা তো কবিতা হয় না। কিন্তু এই বলাটাকেই তিনি রূপ দেবার চেষ্টা করেছেন কবিতায়। ‘হয়তো ইশ্বর নেই: স্বৈর সৃষ্টি আজন্ম অনাথ’—বলে তিনি একটা পরিতোষ লাভের চেষ্টা করেছেন। সৃষ্টি সত্যিই অনাথ কি না, এগুলো নিয়ে দার্শনিকরা চিন্তাভাবনা করুন, কিন্তু কবি এগুলো নিয়ে কথা বলবেন—এটা ভাবতে আমাদের অসুবিধা লাগে এবং এটা একটা বক্তব্য মাত্র। এ বক্তব্যের নানা রকম প্রসার ঘটিয়েছেন তিনি কবিতায়।’’ সুধীন্দ্রনাথের ঈশচিন্তা—নিয়ে সৈয়দ আলী আহসান অস্বস্তি বোধ করেছেন। কারণ সুধীন দত্ত যেমন নিখিল নাস্তির জয়গান গেয়েছেন, তেমনি সৈয়দ আলী আহসান আস্তিক্যকে করেছেন শিরোধার্য। ফলে বিশ্বাসের দিক থেকে পরস্পর বিপরীত মেরুর ছিলেন বলেই সুধীনদত্তের দার্শনিক অভিজ্ঞা সৈয়দ আলী আহসান নির্মোহ দৃষ্টিতে গ্রহণ করতে অনীহ ছিলেন। সুধীনদত্তের শিল্প বা কাব্যসিদ্ধি নিয়ে সৈয়দ আলী আহসান নিঃসংশয়; কিন্তু আদর্শিক বৈপরীত্যের কারণে তাঁর প্রতি তিনি সুপ্রসন্ন হতে পারেননি। একই রকম অপ্রসন্ন ছিলেন দীপ্তি ত্রিপাঠীও। ‘সুধীন্দ্রনাথ দত্ত’ শীর্ষক গবেষণা-প্রবন্ধের শুরুতেই লিখেছেন, ‘সুধীন্দ্রনাথের কাব্য যেন ভ্রষ্ট আদমের আর্তনাদ। তিনি স্বর্গচ্যুত কিন্তু মর্ত্যে অবিশ্বাসী। তাঁর মধ্যে বিজ্ঞতা আছে কিন্তু শান্তি নেই, যুক্তি আছে কিন্তু মুক্তি নেই। তাঁর কাব্য কোনো আশ্বাসের আশ্রয়ে আমাদের পৌঁছে দেয় না। সুধীন্দ্রনাথের নঞর্থক ও পরে ক্ষণবাদী জীবনদর্শন আমাদের ধর্মপুষ্ট বাংলা সাহিত্যে এক অভিনব সংযোজন। এমনকী আধুনিক কাব্যের অনেকগুলি লক্ষণ যদিচ তাঁর মধ্যে বিদ্যমান তথাপি এই দর্শন-বৈশিষ্ট্যে তিনি আধুনিক কবিদের মধ্যেও স্বতন্ত্র।
______________________________________________
তাঁর মনে হয়েছে, চরাচরে চিরায়ত বলে কোনো বস্তুর অস্তিত্ব নেই, নেই কোনো সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী কোনো শক্তিও। ফলে তিনি আর ‘শাশ্বতের নিষ্ফল সন্ধানে’ সময় ব্যয় করবেন না।
______________________________________________
সুধীন্দ্রনাথের কাব্যপাঠকালে মনে হয় কবি যেন এক নিঃসঙ্গ চূড়ায় দাঁড়িয়ে আধুনিক জীবনের নিঃসীম শূন্যতা নৈরাশ্যভারাতুর নয়নে অবলোকন করছেন।’ আধুনিক যুগে মানুষের প্রতি মানুষ প্রশ্নহীন আস্থা স্থাপন করতে পারে না বিচিত্র কারণে। জীবন-যাপনে যেখানে অনিশ্চয়তা, যুদ্ধ বিগ্রহে যেখানে মুহূর্তে লাখ-লাখ মানুষের মৃত্যু হয়, সামান্য কারণে যেখানে মানুষ খুন হয়, যেখানে সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল রাষ্ট্রের নাগরিকদের পেছনে গুপ্তচর লেলিয়ে দিয়ে রাখে, আণনবিক বোমার আঘাতে এক-একটি ভূ-খণ্ড মুহূর্তে ধুলিস্যাৎ হয়ে যায়, যেখানে ঐশীশক্তির কোনো নিদর্শন দেখা যায় না, সেখানে যুক্তিনিষ্ঠ, বিজ্ঞান-মনস্ক কবি সংশয়ী হবেন; এটাই স্বাভাবিক। সুধীন দত্ত এই স্বভাবের জাতক। ‘অর্কেস্ট্রা’ কাব্যের ‘মৈমন্তী’ কবিতায় লিখেছেন, ‘বৈদেহী বিচিত্রা আজি সংকুচিত শিশিরসন্ধ্যায়’। এখানে স্পষ্ট হয়ে ওঠে হতাশা আর ভালোবাসার জন্য কাকুতি এবং সবশেষে না-পাওয়া বেদনা। তাঁর মনে হয়েছে, চরাচরে চিরায়ত বলে কোনো বস্তুর অস্তিত্ব নেই, নেই কোনো সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী কোনো শক্তিও। ফলে তিনি আর ‘শাশ্বতের নিষ্ফল সন্ধানে’ সময় ব্যয় করবেন না। এই উপলব্ধি নিছক ধর্মবিদ্বেষ বা আস্থাহীনতা থেকে উদ্ভূত নয়, নয় নাস্তিক্যের চেতনা থেকেও। তাহলে অন্যত্র (চপলা কবিতায়) উচ্চারণ করতেন না, ‘জনমে জনমে, মরণে মরণে, / মনে হয় যেন তোমারে চিনি।’ নিখিল নাস্তিক বহুজনম বা পুনর্জন্মে বিশ্বাস করবেন কোন ভিতের ওপর নির্ভর করে?
সমাজ-জীবনে সত্য-মিথ্যার অস্তিত্ব আছে; কিন্তু এই সত্য-মিথ্যা আপেক্ষিক, না শাশ্বত? যদি যুক্তিবোধ এবং বাস্তবতার নিরিখে সত্য-মিথ্যা নিয়ে ভাবা যায়, তাহলে সত্য এবং মিথ্যা দুটি আপেক্ষিক পদ মাত্র; দুটিই সাপেক্ষ পদ। একটির অভাবে অন্যটির অস্তিত্ব প্রশ্নবিদ্ধ। মানবজীবনে এ ধরনের তর্কের সামাজিক কি আর্থিক, কোনো মূল্য নেই। কিন্তু শিল্পের প্রশ্নে—বিশেষত কবিতায় সত্য-মিথ্যার সম্পর্ক সুনিবিড়। এ সম্পর্কে বিনয় ঘোষ ‘সত্য ও বাস্তব’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘সত্য পরিবর্তনশীল ক্রমবির্ধমান ও সমাজাশ্রয়ী।’ অর্থাৎ সত্যের কোনো চিরন্তন রূপ নেই। কবিতায় এ সত্য বা বাস্তবতার প্রসঙ্গ আরও সূসুক্ষ্মভাবে এসেছে। বাস্তবতা হলো একটি বস্তুকে মানুষস কোন দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করে? মানুষের উপলব্ধি এবং বোধের তারতম্যের ওপর নির্ভর করে কোনো একটি বস্তুর গুণাগুণ বিচারের দৃষ্টিভঙ্গিও। কবিতা মানুষের উপলব্ধিজাত বিষয়গুলোর একটি। তাই কবিতার সত্য এবং বস্তুসত্য কোনোকালেই এক ছিল না, এখনো নয়।
সময়, সমাজ, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির আন্তঃসম্পর্কের ধরন সম্পর্কে সুধীন্দ্রনাথের ছিল গভীর পর্যবেক্ষণ। জীবন ও সংসার সম্পর্কে তাঁর উপলব্ধি স্পষ্ট, কিন্তু ওই অভিজ্ঞান প্রকাশে সংশয়ী। ফলে তাঁর চেতনার উপরিতল সম্পর্কে ‘নাস্তিপ্রবণ’ বলে শনাক্ত করা হয়। মহাশূন্যের দিকে তাকালে তাঁর মনে হয় ‘নির্বাক নীল, নির্মম মহাকাশ’। কল্পনাপ্রবণ কবির কাছে নীল যেখানে রোম্যান্টিকতার প্রতীক, বুদ্ধিবাদী কবির কাছে সেখানে কেবল নির্মম। অথচ ‘নাম’ কবিতায় শুরুতে তাঁকে অস্থির ও অধীর মনে হয়। কাক্সিক্ষতকে চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাওয়ার জন্য কালক্ষেপণ করার ধৈর্য নেই তাঁর। কাঙ্ক্ষিতের অভাবে ‘অসহ্য অধুনা’ এবং ‘ভবিষ্যৎত বন্ধ অন্ধকার’, ফলে তার ‘কাম্য শুধু স্থবির মরণ’। চাওয়ার সঙ্গে সব সময় পাওয়ার সমন্বয় ঘটে না। হয়তো তাই, এই অস্থিরতা। হয়তো এ কারণেই এই উচ্চারণ—‘বজ্রাহত অশোকেরে অলজ্জায় করেছি বিনত / ক্ষণিক পুষ্পের লোভে।’ কিন্তু এ প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির নিকট সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা সবার পক্ষে সম্ভব হয় না।
বুদ্ধির দীপ্তি ও প্রজ্ঞার অনুশাসনও যে কবিতা হয়ে উঠতে পারে, এর প্রমাণ সুধীন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন অনেক কবিতায়। এর মধ্যে ‘শাশ্বতী’ও একটি। কবিতাটি তিন পর্বের ছয়মাত্রার মাত্রাবৃত্তে রচিত। প্রথম দুই পর্ব পূর্ণমাত্রার শেষ পর্বের মাত্রা সংখ্যা দুই। মাত্রাবৃত্তের যে সাংগীতিক লয়, সে লয় এখানে পুরোপুরি রক্ষিত হয়নি। আবার অক্ষরবৃত্তের ধীর, গম্ভীর লয়ও অনুপস্থিত। অর্থাৎ সংগীতময়তার ভেতর, ধ্বনি-সংহতি, গাম্ভীর্যের ভেতর সুললিত সুর—এ সবের সম্মিলনে সৃষ্ট এ কবিতা। ভাব ও বিষয়ের যুগলচিত্র প্রচ্ছন্ন হয়ে ওঠে এভাবে—
সে-দিনও এমনই ফসলবিলাসী হাওয়া
মেতেছিল তার চিকুরের পাকা ধানে;
অনাদি যুগের যত চাওয়া, যত পাওয়া
খুঁজেছিল তার আনত দিঠির মানে।
একটি কথার দ্বিধাথরথর চুড়ে
ভর করেছিল সাতটি অমরাবতী;
একটি নিমেষে দাঁড়ালো সরণীজুড়ে,
থামিল কালের চিরচঞ্চল গতি;
আগেই বলেছি—সুধীন্দ্রনাথকে কোনো কোনো সমালোচক নৈরাশ্যবাদী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর এই নৈরাশ্যবাদী পরিচয় ছাপিয়ে ভিন্ন পরিচয় আবিষ্কারের চেষ্টা তেমন কারও ভেতর নেই। অথচ তাঁর কবিতাগুলোয় বেশির ভাগই প্রত্যাশা ও সামান্য সংশয়বাদের পরিচয় পাওয়া যায়। এই পঙ্ক্তিগুলো আশাবাদের সাক্ষ্য দেবে—‘বিরহবিজন ধৈর্যের ধূসরিমা / রঞ্জিত হবে দলিত শেফালি শেজে।’ একটি বিশেষ কালসীমার পর অন্য ধরনের অভিজ্ঞতা মানুষের জন্য অপেক্ষা করে। এরপরেই সংকটকাল শেষও হতে পারে। ফলে জীবনের কোনো কোনো স্মৃতি মানুষ আজীবন ধরে রাখে। কখনোই সে স্মৃতি ভুলতে পারে না।
তাঁর চিত্রকল্প ও উপমা ভাবাবেগ নয় বুদ্ধির সাক্ষ্য বহন করে। ফলে কেবল অনুভবগ্রাহ্য অলঙ্কারেই তিনি তৃপ্ত নন, দৃশ্যগ্রাহ্য ও অভিজ্ঞতালব্ধ চিত্রকল্প-উপমা-উৎপ্রেক্ষার প্রমাণ রেখেছেন কবিতায়। ভাবাবেগের চেয়ে বুদ্ধির দীপ্তি ও প্রজ্ঞা মানবজীবনে ভূমিকা রাখে বেশি। কেবল তীব্র ভাবাবেগ ও হৃদয়াকুতির কাছে সমর্পিত কবির পক্ষে তারল্যপূর্ণ কবিতাচর্চা সম্ভব, মনীষার প্রতি আস্থা রাখা অসম্ভব।
সুধীন্দ্রনাথের মানসপ্রকৃতি শেষ পর্যন্ত সংশয়বাদী। সংশয়-ই তাঁর মনীষার ভূষণ। যেন কোনো একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে আস্থা রাখতে পারেন না কবি, যেন কোনো উপমা-ই তাঁর মনোঃপূতঃ হয় না, কেবলই বারবার রুচির পরিবর্তন ঘটান, রূপান্তর চান চিন্তারও। ‘মহাসত্য’, ‘মার্জনা’, ‘সংশয়’, ‘প্রশ্ন’, ‘দ্বন্দ্ব’, ‘যযাতি’, ‘উপস্থাপন’, ‘মৃত্যু’, ‘সৃষ্টিরহস্য’ কবিতাগুলো মূলত প্রশ্ন, বিস্ময়, সন্দেহ ও সংশয়কে আশ্রয় করে রচিত। মানবমনের স্বতঃসিদ্ধ স্বভাব বস্তু বিশেষকে পরীক্ষা করে নেওয়া, এক বস্তুকে অন্য বস্তুর সঙ্গে তুলনা-প্রতিতুলনা করে বিচার করা। এমন বিচার-প্রক্রিয়ায় সাফল্যও আসে। কিন্তু কেউ কেউ আবেগ ও চিন্তার বিশেষ মুহূর্তে এত বেশি উদ্বেল কিংবা অস্থির কিংবা নিরপেক্ষ হয়ে ওঠেন, যে বিশেষ কোনো বস্তুকে একাধিক বস্তুর সঙ্গে তুলনা করেও সন্তুষ্ট হতে পারেন না। কোনো ব্যাখ্যা-ই তার মনের মতো হয় না, তবু অব্যক্ত কোনো এক ভালো লাগা তাকে বস্তু বা ব্যক্তি বিশেষের প্রতি সম্মোহিত করে রাখে।
রূপসী বলে যায় না তারে ডাকা;
কুরূপা তবু নয় সে, তাও জানি;
কী মধু যেন আছে সে-মুখে মাখা;
কী বরাভয়ে উদ্ধৃত সে-পাণি।
(সংশয় : উত্তর ফাল্গুনী)
যার রূপ-গুণ সম্পর্কে কোনো স্থির সিদ্ধান্তে ব্যক্তি পৌঁছাতে পারে না, তার সম্পর্কে শেষ প্রশ্ন তার মনে-ই বেজে ওঠে—‘ভালো কি তবে বেসেছি তারে আমি?/ বিজ্ঞ হিয়া শিহরে তাই ভয়ে?’ প্রশ্নশীল ও সংশয়বাদীরা কোনো একটি বিশেষ বিষয়কে বিনা তর্কে মেনে নিতে পারে না। তাদের হৃদয় যতটা আবেগে ভরা, ততধিক প্রজ্ঞাপূর্ণ। ফলে নিজের স্বভাব সম্পর্কেও ‘বিজ্ঞ হিয়া শিহরে’ ওঠে ভয়ে। আদৌ শিহরে ওঠে কি না, সে বিষয়েও কবি নিশ্চিত নন, ফলে নিজেকেই প্রশ্ন করেন— ‘বিজ্ঞ হিয়া শিহরে তাই ভয়ে?’ সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতায় হৃদয়বৃত্তির সঙ্গে সঙ্গে মৌলিক চিন্তাও সমানভাবে উপস্থিত। মৌলিক চিন্তক মাত্রই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বোধে বিশ্বাসী। পূর্ববর্তী কোনোনও চিন্তকই তার পূর্বসূরি নন; কারও চিন্তার রেশ তার প্রেরণার উৎস নয়। প্রকৃত চিন্তক মূলত একমেবাঅদ্বিতীয়ম্। চরাচরের ঘটনা ও দুর্ঘটনার ফলাফল এবং প্রপঞ্চগুলোর কার্যকারণ সম্পর্ক বিশ্লেষণ ও প্রতিষ্ঠা করাই তার মূল কাজ। কোনোনও মৌলিক চিন্তা-ই একই সঙ্গে দুই চিন্তকের হতে পারে না। কারণ মৌলিক চিন্তকের চিন্তা অনেক সময় অনির্দেশ্য ও অনির্দিষ্ট থাকে। বিক্ষিপ্ত চিন্তাকণিকার মিথস্ক্রিয়ায় একটি মৌলিক চিন্তার বীজ প্রথমে অঙ্কুরোদগম হয়। এরপরই সে অঙ্কুর ক্রমাগত পরিচর্যায় হয়ে ওঠে একটি বিশেষ প্রপঞ্চের ভাষ্য।
সে চিন্তার সঙ্গে কল্পনার অন্বয় ঘটিয়ে সৃষ্ট কবিতাও চিন্তাশীলদের আরাধ্য। আধুনিক বাংলা কবিতার প্রেক্ষাপটে চিন্তাসূত্র বৈচিত্র্যপূর্ণ। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ক্ষেত্রে কথাগুলো ষোলোআনা-ই সত্য। ‘মহাসত্য’র মূল ভাব চিরায়তকে অস্বীকার; আপেক্ষিকতার জয়গান। চিরকালীন সত্য বা শাশ্বত রূপকে ব্যঙ্গ করা হয়েছে এ কবিতায়। কিন্তু তার এ ব্যঙ্গপ্রবণতা দার্শনিকতা নয়, বুদ্ধিবৃত্তির সঙ্গে সম্পর্কিত। ফলে হৃদয়বৃত্তি অনেকাংশে উপেক্ষিত হয়েছে। কবিতায় অতিমাত্রায় বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা হৃদয়বানকে পীড়া দেয়, এ কথা অনস্বীকার্য। এ প্রসঙ্গে ‘সুধীন্দ্রনাথ দত্ত : শব্দের অনুষঙ্গে’ শীর্ষক প্রবন্ধে সৈয়দ আলী আহসান বলেছেন, কবিতায় ‘যে মেধা ও মননের পরিচয়টা তিনি দিয়েছেন, ইতিহাসটা দিয়েছেন, সেই মেধা এবং মনন শব্দের ক্ষেত্রে শব্দতেই পর্যবসিত এবং শব্দ সংগ্রহের ক্ষেত্রে তিনি তাঁর মেধাকে পূর্ণ ব্যবহার করেন। অন্য কোনো ক্ষেত্রে তিনি অগ্রসর হতে আর পারলেন না।’ অধ্যাত্ম চেতনা মানুষের একটি সহজাত প্রবণতা। সংকটে, সংশয়ে মানুষ মাত্রই অলৌকিক শক্তির কাছে নিজেকে সমর্পণ করে। চায় পরিত্রাণ, নির্ভয় ও আশ্রয়। কেউ গোপনে, কেউ প্রকাশ্যে। যে সব অঞ্চলে বা সাংস্কৃতিক বলয়ে ধর্মীয় চেতনার সঙ্গে আধুনিকতা ও প্রগতিশীলীতার সম্পর্ক সৌহার্র্দ্যপূর্ণ ওই সব অঞ্চলের শিল্পকর্মেও অধ্যাত্মচেতনা শিল্পিত মহিমায় উজ্জ্বল।
যে সব অঞ্চলে ধর্মানুষঙ্গের সঙ্গে আধুনিকতা, প্রগতিবাদিতার সম্পর্ক সাংঘর্ষিক, সে সব অঞ্চলে অধ্যাত্মচেতনা গোপনে চর্চিত হয়। প্রকাশ্যে অলৌকিকতার বিরুদ্ধে সরব শিল্পিীর শিল্পকর্মেও গোপনে চর্চিত হয় অধ্যাত্মপ্রেম। অধ্যাত্মসংকট একটি জটিল সংকট। বিজ্ঞানে প্রমাণিত নয়, এমন বিষয়ও স্বয়ং বিজ্ঞানিীরাও লালন করেন। সঙ্গত কারণে কেবল বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবোধ দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এর গূঢ়ার্থ অন্বেষণ করা জরুরি। মানুষের ভয়, হতাশা, নিরাপত্তাহীনতাই তাকে অধ্যাত্মসংকটের দিকে প্রণোদিত করে। ফলে মানুষ অবদমনকেও অনিবার্য নিয়তি ভাবতে শুরু করে এবং মেনে নিতে বাধ্য হয়। এই সংশয়চিত্ত মানবজাতির একদিকে রয়েছে বিজ্ঞানের আবিষ্কার, বস্তুনিষ্ঠা এবং যুক্তিবোধ; অন্যদিকে রয়েছে অলৌকিকতার মোহ, ভয়, নিরাপত্তাহীনতা এবং অস্তিত্বের সংকট। সঙ্গত কারণে সংশয়ী চিত্ত একসময় নির্ভরতার আশ্রয় খোঁজে।
________________________________________________
বাঙালি কবি যতই পশ্চিমের আধুনিকতার সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করার মনোভাব দেখান, ততটা দৃঢ় হতে পারেন না। বাইরে যতই যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞানমনস্কতার পরিচয় তাঁর, ভেতরে ততই অধ্যাত্মচেতনা। সুধীন্দ্রনাথও এর ব্যতিক্রম নন। ফলে তাঁর কবিতায় বিজ্ঞান-যুক্তির পাশাপাশি অধ্যাত্মচেতনার সমন্বয় ঘটে সহজে।
________________________________________________
বস্তুসত্য বাঙালি সহজে মেনে নেয় না; মেনে নেওয়ার ভান করে মাত্র। বাঙালি জাতি হিসেবে মূলত ভাবুক। তাই ভাবনার জগতে যত পারে ঐশী শক্তিকে স্বাগত জানায়, কিন্তু বস্তুসত্যের নগদ ফলকেও বিচার করে ভাববাদী দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে। কবিরা এই ভাবুকগোষ্ঠীর মন্ত্রণাদাতা। তাঁদের চিন্তারাজ্যে বস্তুসত্য ও কাব্যসত্য প্রায় সমান্তরাল পথ সৃষ্টি করে। সুধীন্দ্রনাথ একই সঙ্গে ভাববাদী ও সংশয়বাদী। কবিতার শরীর ও আত্মাজুড়ে সংশয় ও ভাবেরই প্রচ্ছন্ন ছাপ রেখেছেন তিনি। বস্তুসত্যকে অগ্রাহ্য করেও ভাববাদে আস্থা রেখেছেন। অলীক বিষয়কে দিয়েছেন মর্যাদা; কবিতা হয়ে উঠেছে ভাবুকের প্রাণের উৎসারণ, কল্পনার দৃশ্যগ্রাহ্য ভুবন। যুক্তি ও বাস্তবতা সেখানে হয়ে উঠেছে প্রায় অপাঙ্ক্তেয়। প্রবল নিষ্ঠা, যুক্তিবোধ ও কল্পনায় সৃষ্টি হয়েছে সংশয়ের ভুবন; নিখিল নাস্তি কিংবা অকাট্য বিশ্বাস সেখানে মান্যতা পায়নি। যেখানে বিজ্ঞানমনস্ক হতে চেয়েছেন, সেখানে হয়েছেন বড়ে জোর সংশয়ী। ভাবুকের পক্ষে নিখিলনাস্তির জয়গান গাওয়া সম্পূর্ণ সম্ভব নয়; মাঝেমধ্যে বিশ্বাসের জগতে আলোড়ন তুলতে পারে মাত্র। এ কারণে প্রবল ধার্মিকের সঙ্গে কবির চিন্তার তেমন পার্থক্য দেখা যায় না। তাঁর কবিতায় চিন্তার স্ববিরোধ ও অধ্যাত্মবোধ গোপন সুতোর মতো ইন্দ্রজাল সৃষ্টি করে। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতায় বস্তুবাদী দর্শন স্পষ্ট। আধুনিকতাবাদীদের বিবেচনায় বস্তুবাদের প্রতি সমর্পিত সত্তাই আধুনিক সত্তা। কিন্তু নিটশের সে বিপুল নৈরাশ্যচেতনাও সুধীন্দ্রনাথকে পুরোপুরি আচ্ছন্ন করতে পারেনি। বাঙালি কবি যতই পশ্চিমের আধুনিকতার সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করার মনোভাব দেখান, ততটা দৃঢ় হতে পারেন না। বাইরে যতই যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞানমনস্কতার পরিচয় তাঁর, ভেতরে ততই অধ্যাত্মচেতনা। সুধীন্দ্রনাথও এর ব্যতিক্রম নন। ফলে তাঁর কবিতায় বিজ্ঞান-যুক্তির পাশাপাশি অধ্যাত্মচেতনার সমন্বয় ঘটে সহজে। ‘মৃত্যু’, ‘প্রার্থনা’, ‘মরণতরী’, ‘দ্বন্দ্ব’, ‘প্রত্যাবর্তন’, ‘অসময়ে আহ্বান’, ‘সান্ত্বনা’, ‘প্রতিহিংসা’সহ আরও বেশ কিছু কবিতায় উপর্যুক্ত বিষয়ের পরিচর্যার সাক্ষাৎ মেলে।
অধ্যাত্মসংকট বাঙালির মৌলসংকট। এ সংকট বাঙালির উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া। ইচ্ছা করলেই যুক্তিবোধ, গবেষণা এবং বিজ্ঞান দিয়ে এ সংকট থেকে তার উত্তরণের সম্ভাবনা নেই। অন্তত যত দিন, বাঙালিজীবনে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কার্যকারণ জলবায়ু পরিবর্তনও আবহাওয়ার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার যৌক্তিক কার্যকারণ সম্পর্কের ফল বলে স্বীকৃত না হয়, তত দিন তার মনে হবে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণ মানবজাতির পাপাচারের ফল—শাস্তি। এ কেবল ধর্মীয় অনুষঙ্গ নয়, জাগতিক স্বার্থশ্লিষ্ট বিষয়েও প্রাসঙ্গিক। এ সম্পর্কে ‘উটপাখি’ উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। প্রথম চার পঙ্ক্তি স্মরণ করা যাক—
আমার কথা কি শুনতে পাও না তুমি?
কেন মুখ গুঁজে আছ তবে মিছে ছলে?
কোথায় লুকাবে? ধূ ধূ করে মরু ভূমি;
ক্ষয়ে ক্ষয়ে ছায়া মরে গেছে পদতলে।
শূন্য মরুর বুকে হতাশাগ্রস্ত জীবন স্বাভাবিক। সেখানে যেকোনো ধরনের আহ্বান তৃষ্ণার্তের জন্য মহার্ঘ্যতুল্য। কিন্তু যখন একজন তৃষ্ণার্ত আশ্রয়-ভালোবাসার আহ্বানও নীরবে উপেক্ষা করে তখন আহ্বানকারীরও আত্মমর্যাদাবোধে আঘাত লাগে। তখন তারও মনে হতে পারে ‘ক্ষয়ে ক্ষয়ে ছায়া মরে গেছে পদতলে’। যে উটপাখিকে কবির মনে হয়, মরুদ্বীপের সমস্ত খবর জানা প্রাণী, তাকেই আবার স্মরণ করিয়ে দেন কবি—‘তুমি তো কখনও বিপদপ্রাজ্ঞ নও’। অর্থাৎ মানুষ বা প্রাণী—সবাই অতীতের ঘটনা পর্যালোচনা করে অতীত এবং বর্তমানের মধ্যে যোগসূত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারে, ক্ষেত্র বিশেষ যোগসূত্র প্রতিষ্ঠার কার্যকারণ সম্পর্কও আবিষ্কার করতে পারে। কিন্তু অতীত-বর্তমানের ঘটনা বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যতের কোনো নিশ্চিত বার্তা কেউ দিতে পারে না; কেবল সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেওয়া সম্ভব হয় তাদের পক্ষে। ফলে অতীতের সাক্ষী হয়েও কেউ কখনো সর্বজ্ঞ হতে পারে না। সঙ্গত কারণে চরাচরের নানা সম্পর্কের ধরন ও বিভেদের দায় একা কারও নয়।
আমরা জানি এই ধ্বংসের দায়ভাগে
আমরা দু জনে সমান অংশীদার;
অপরে পাওনা আদায় করেছে আগে
আমাদের পরে দেনা শোধবার ভার
তাই অসহ্য লাগে ও-আত্মরতি।
অন্ধ হলেই কি প্রলয় বন্ধ থাকে?
আমাকে এড়িয়ে বাড়াও নিজেরই ক্ষতি।
ভ্রান্তিবিলাস সাজে না দুর্বিপাকে।
অতএব এসো আমরা সন্ধি করে
প্রত্যুপকারে বিরোধী স্বার্থ সাধি:
তুমি নিয়ে চলো আমাকে লোকোত্তরে
তোমাকে, বন্ধু, আমি লোকায়তে বাঁধি।
জাতির উদ্ধারকারী হিসেবে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত ব্যক্তির প্রতিশ্রুতি হিসেবে শেষের চার পঙ্ক্তি অনন্যসাধারণ। আর ‘অন্ধ হলেই কি প্রলয় বন্ধ থাকে’—একইসঙ্গে প্রশ্নশীল উপলব্ধি ও প্রবচন। পুরো কবিতায় পরার্থপরতাকে মহিমান্বিত করা হয়েছে। ‘উটপাখি’ একটি প্রতীক মাত্র, আড়ালে সমাজ ও রাজনৈতিক বিমুখ, উদাসীন মানুষের প্রমূর্তি। তাই সতর্ক উচ্চারণ—‘ভ্রান্তিবিলাস সাজে না দুর্বিপাকে’।
মানুষ নিজের নিরাপত্তার জন্য নিয়ম তৈরি করে; নিজেই সে নিয়ম লঙ্ঘংঘন করে অন্যতর প্রয়োজনে। অন্যে যখন নিয়ম লঙ্ঘন করে তখন তার জন্য শাস্তি কামনা করে, কিন্তু নিজের নিয়ম লঙ্ঘনকে দেয় বৈধতা। মানবচরিত্রের এই এক ভয়াবহ দ্বৈরথ। দ্বিমুখী স্বভাব তার। অন্যকে শাস্তি দিতে সে কুণ্ঠাহীন, নিজের দোষের ক্ষেত্রে তৈরি করে অন্য বিধি। যে কাজ অন্যের বেলা গর্হিত বলে প্রচার করে, সে কাজ নিজের জন্য করে তোলে গর্বের। অন্তত এমনটাই প্রচার করে সে। সুধীন্দ্রনাথের কবিতায় এ বিষয়টি প্রচ্ছন্নভাবে উপস্থিত।
[লেখকের ‘কবিতার সময় ও মনীষার দান’ থেকে]