ছোটগল্পে সমাজ চিত্রায়ণে লেখক অভিজ্ঞতা, প্রজ্ঞা ও কল্পনার সমন্বয় ঘটান। উপস্থিত কালকে আত্মস্থ করার পাশাপাশি রূপান্তর করে প্রকাশ করেন। কোনোভাবেই ওই বিশেষ কালখণ্ডের ভেতর নিজেকে আবদ্ধ রাখেন না। একইসঙ্গে অতীতের সঙ্গেও বর্তমানের যোগসূত্র স্থাপন করেন। তবে সমাজের হুবহু চিত্র তিনি আঁকেন না। কেবল ছুঁয়ে ছুঁয়ে যান। পাশাপাশি যা ঘটেছে, যা ঘটার প্রত্যাশা তিনি করেন; উভয়ের মধ্যে সমন্বয় সাধনের চেষ্টা তাঁর থাকে। এক্ষেত্রে কোনো একটি নির্দিষ্ট সময়ের ঘটনাপুঞ্জের সঙ্গে অতীতের কোনো ঘটনার তুলনা-প্রতিতুলনা করে তিনি বর্তমানকে সৃষ্টি করেন। স্বপ্ন দেখেন নিজের মতো করে ভবিষ্যতের। কোনো একটি বিশেষ সমাজের ঘটনাপ্রবাহের ভেতর থেকেই লেখক শিল্পের অনুষঙ্গ আবিষ্কার করেন। ছোটগল্পের লেখক কল্পনা করেন, তাতে যাপিত জীবনের বাস্তবতার ছাপ থাকে। কিন্তু তা কোনোভাবেই হুবহু সাংবাদিক প্রতিবেদন হয় না। সমাজে সংঘটিত ঘটনাপুঞ্জের হুবহু ছবি আঁকা তাঁর কাজ নয়। তাঁর লক্ষ্য—স্বতন্ত্র প্রকাশশৈলী। এ উদ্দেশ্যে সংঘটিত ঘটনাপ্রবাহের ভেতর থেকে শিল্পের রসদ সংগ্রহ এবং এই সংগ্রহের সঙ্গে নিজের কল্পনার সম্মিলন ঘটানোই তার কাজ। ছোটগল্পের বিষয় বা আখ্যানের গুরুত্ব অবশ্যই সবার আগে। তবে, তার সঙ্গে আঙ্গিক-প্রকরণের দিকেও লেখককে যত্নশীল হতে হয়। সমালোচকের ভাষায়, ‘ছোটগল্পের বাঁধুনি খুবই আঁটসাঁট, আর তার মধ্যে একটা ব্যক্তি-মানসের রোমান্টিক অভীপ্সা চিত্রময় হয়ে ওঠার সুযোগ পায় খুব সংযতভাবে, ধীরে ধীরে।১
ছোটগল্পকে কল্পনা ও চিন্তার সারাংশের নিক্তিতে মেপে তবেই প্রকাশ করতে হয়। তাহলেই কেবল পাঠকের মর্মে ছোটগল্পের নির্যাসটুকু তেপান্তরের মাঠে পূর্ণিমা রাতের ধবল জোছনার মতো প্রবেশ করবে। এমন আঁটসাঁটো গল্পের কুশীলবদের একজন সিরাজুল ইসলাম মুনির (১৯৫৬)। ২০১৭ সাল পর্যন্ত তাঁর গল্পগ্রন্থের সংখ্যা সাতটি। এগুলো হলো: অংকুরি (১৯৮৯), কালো কাইতন (১৯৯১), কমলা সুন্দরী ও অন্যান্য গল্প (১৯৯৯), ভালোবাসার ফুল (২০০৯), গভর্নরকে হত্যা করা হয়েছে (২০০৯), মুক্তিযুদ্ধের গল্প (২০১৬) ও রাজনীতি রানুদি ও রঙধনু বৃষ্টি (২০০৯)। এই সাতটি গল্পগ্রন্থের গল্পগুলো নিয়ে ২০১৭ সালে প্রকাশিত হয়েছে গল্পসমগ্র। বর্তমান প্রবন্ধে আলোচনার জন্য গল্পসমগ্র’কেই নির্বাচন করা হয়েছে।
সিরাজুল ইসরাম মুনিরের গল্পসমগ্রভুক্ত গল্পগুলোয় সমাজের নিম্নবর্গ, মধ্যবিত্তের কণ্ঠস্বর বেশি। কখনো কখনো মুনির তার কোনো কোনো চরিত্রের সঙ্গে নিজের কণ্ঠ মিশিয়ে দেন। কারণ হয়তো এই—যে-কোনো শিল্পীর নিজের অঞ্চলেই সিদ্ধি অন্যত্র কেবল কল্পনা ও অনুমানের ওপর নির্ভর করতে হয়। ফলে তাঁকে সৎ থাকতে গেলে, যথাযথ জীবনচিত্র আঁকতে গেলে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয়। এছাড়া তাঁর সামাজিক দায় রয়েছে। সে দায় থেকে যাঁরা লেখেন, তাঁদের গল্পে সমাজের ছাপ থাকে নিশ্চিত। মনে রাখা ভালো, ছোটগল্প কেবল লেখকের কল্পনা-প্রসূত কাহিনির ঘনঘটা নয়। ভিন্ন ধরনের গল্পও রয়েছে। সে-সব গল্পে কল্পনার পাশাপাশি নতুন চিন্তার বীজও লুকিয়ে থাকে। ফলে এ ধরনের গল্প পাঠ শেষে পাঠকের চিন্তার ভরকেন্দ্রে পরিবর্তনের ঢেউ জাগে। সময়ের ব্যবধানে একই গল্পের ভিন্ন ভিন্ন পাঠ-ব্যাখ্যাও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। ফলে এসব গল্পে কাহিনির চেয়ে, কাহিনির সূত্র, চরিত্রের আচরণের চেয়ে অবদমন প্রধান ভূমিকা পালন করে। সর্বোপরি ছোটগল্পের আখ্যানের ভাষাশৈলী, চরিত্রের আচরণ ও সংলাপের বিশেষ কৌশলই পাঠক মনকে বিলোড়িত করে। তার চিন্তার স্রোতকে বেগবান করে। কল্পনাকে উসকে দেয়। কারণ, ‘গল্পের শান্তি তার সিদ্ধান্ত বাক্যে, গল্পের অশান্তি তার পাঠকের মর্মের গভীরতম প্রদেশ। ছোটগল্প এমন হবে যে একেবারে পাঠকদের মর্মে গিয়ে ঘা মারে, নিমেষে এক অলৌকিক অনুভূতির নৈঃশব্দ্যের মধ্যে তার চিরন্তন ব্যঞ্জনা কম্পন তোলে।’২ এই যে ‘গল্পের শান্তি তার সিদ্ধান্ত বাক্যে’ বলে শর্ত তাত্ত্বিক আরোপ করেছেন, সেই শর্ত সিরাজুল ইসলাম মুনিরের গল্পে রয়েছে। তিনি যখন কোনো গল্পের সমাপ্তি টানেন, তখন সেই সিদ্ধান্ত বাক্যটি পাঠককে ভাবিত করে। এছাড়া তিনি বিষয়কে চরিত্রের আচরণ ও মনস্ত¡ত্ত্বের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করে তোলেন, তখন সেখানে পাঠক স্বাধীনভাবে চরিত্র নির্বাচনের সুযোগ পান। অনেকটা চিত্রকলার মতোই। ছবি যেমন নিজে কথা বলে না, দর্শককে দিয়ে বলিয়ে নেয়, তেমনি এসব গল্পের চরিত্রগুলো নিজে কথা না বললেও পাঠক সে-সব চরিত্রের ভেতর নিজেকে খুঁজে পায়। এ ধরনের গল্পে পাঠকের অনুধ্যান আর চরিত্রের নৈপুণ্য ঐকান্তিক হয়ে ওঠে। গল্পের ভেতর বুদ্ধির মুক্তি ঘটে। লেখকের স্বভাবই তার সৃষ্ট চরিত্রের আচরণে প্রকাশ পায়। সঙ্গত কারণে লেখক চরিত্র সৃষ্টির সময় কোনো একটি বিশেষ চরিত্রের প্রতি পক্ষপাত দেখান না। এদিক থেকে বিবেচনা করলে বাংলা ছোটগল্পের ইতিহাসে সিরাজুল ইসলাম মুনির নিজের স্বাতন্ত্র্য অর্জনে সক্ষম হয়েছেন বলে ধরে নেওয়া যায়। তিনি খুব সন্তর্পণে গল্প বোনেন। মুনিরের গল্পে যে বিষয়গুলো সহজেই চোখে পড়ে, সেগুলো হলো:
ক. নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের সংকট
খ. অসম বয়সীদের মধ্যে প্রেমহীন যৌনসম্পর্ক
গ. আধ্যাত্মচেতনা ও মানবতার জয়গান
সিরাজুল ইসলাম মুনিরের প্রধান গল্পগুলোয় নিম্নবিত্ত-বিত্তের মনস্তাত্ত্বিক-পারিবারিক-সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকটকে অনুষঙ্গ করে তুলেছেন। এই ধারার গল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে, ‘অন্তরমণি’, ‘অন্যদিন অন্যসময়’, ‘তবুও জীবন’, ‘ফেরিঘাট’, ‘বাংলাদেশ’, ‘লোকটি’, ‘ইলশার চরে লাশ’ প্রভৃতি। এসব গল্পে নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্তের জীবনসংগ্রাম, স্বপ্ন-স্বপ্নভঙ্গের বেদনা, প্রতারণা, প্রবঞ্চনা যেমন প্রকাশিত হয়েছে, তেমনি চিত্রিত হয়েছে মনস্তাত্ত্বিক সংকটও। বাদ যায়নি পারিবারিক সম্পর্ক, গ্রামবাংলার চিরায়ত রীতি, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকটের প্রতিচ্ছবিও।
সামাজিক-ধর্মীয় বিধিনিষেধের দণ্ডের তলে বাল্যপ্রেম পরিণত বয়সে যে বিসর্জন দিতে হয়, তার চিত্র রয়েছে ‘অন্তরমণি’ গল্পে। এই গল্পের প্রধান পুরুষ চরিত্র বাসু, প্রধান নারী চরিত্র তারা। উভয়েই সম্পর্কে চাচাতো ভাই-বোন। এর চেয়েও বড় পরিচয় তারা উভয়ে দুধভাই-বোন। অর্থাৎ উভয়েই একই মায়ের স্তনের দুধ পান করেছে। কিন্তু শৈশব থেকে তারা পরস্পরের প্রতি ভালোলাগা-ভালোবাসায় মগ্ন ছিল। বিশেষত তারাকে ভালোবাসতো বাসু। মাঝেমধ্যে সেই ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ বাসু ঘটাতে চাইলেও তারা উড়িয়ে দিতো। বড় হয়ে বাসু ঢাকায় চাকরি করে। তারা গ্রামেই থাকে। তারার বিয়ে ঠিক হয় এক স্কুলমাস্টারের ছেলের সঙ্গে। ছেলেটা কিছুটা ‘বাউণ্ডুলে’। চাকরি-বাকরি কিছু করে না। স্কুল মাস্টার রহমত উল্লাহ ভেবে রেখেছেন ছেলেকে স্কুলের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেবেন। তিনি শিক্ষকতাকে চাকরি হিসেবে দেখেন না। তার মতে, ‘যে শিক্ষক তার পেশাকে চাকরি ভাবেন, তিনি কখনো ভালো শিক্ষক হতে পারেন না।’৩ গ্রামে যখন তারা বিয়ে ঠিক হচ্ছে, তখন বাসু ঢাকায় বসে তাকে বিয়ের স্বপ্ন দেখছে। আর সময়-সুযোগমতো হবু বধূর জন্য বিয়ের সাজপোশাক কিনে রাখছে। ইতোমধ্যে তারার বিয়ে ঠিক হয়ে গেলে বাড়ি থেকে বাসুকে সেই খবর জানিয়ে চিঠি দেওয়া হয়। সেই চিঠি বাসুর হাতে পড়ে না। গৃহপরিচারিকা চিঠিখানা যত্ন করে রাখতে গিয়ে বাসুকে আর বলতে পারে না।
এদিকে তারার বিয়ে হয়ে যায়। সময় ঘনিয়ে আসে স্বামীসহ তারা বাপের বাড়িতে আসে। আর ওই দিনই বাসু তার হবু স্ত্রীর জন্য বিয়ের সাজপোশাক নিয়ে বাড়িতে আসে। বাড়িতে এসেই বাসু শুনতে পায় তারার বিয়ে হয়ে গেছে। তার বুকে অভিমান জমে। মনে মনে ক্ষোভে ফেটে পড়ে—কেন বাসুর জন্য তারা অপেক্ষা করলো না। তারার জন্য কেনা পোশাক-অলংকারগুলো তার কাছে তখন বোঝা মনে হয়। কিন্তু সেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ সে ঘটায় না। তার সমস্ত ক্ষোভের আগুনে জল ঢেলে দেন চাচি। বলেন, ‘ঘরের মেয়েকে পর করে দিলাম। তোর মা’র দুধ খেয়েছে তারা, তোরা দুধ ভাই-বোন নাহলে তোর হাতেই তারাকে তুলে দিতাম।’৪ চাচির কথায় বাসুর মনের অন্ধকার দূর হয়ে যায়। লেখক এই গল্পে নীতিবাদের চর্চা করেছেন। সামাজিক বাস্তবতা তুলে ধরতে গিয়ে রূপকথার কাহিনির ‘অতঃপর তাহারা সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে থাকিলো’ধর্মী ইতিবাচক আখ্যান রচনা করেছেন। তিনি পাঠকের আবেগ নিয়ে খেলেছেন। বাসুকে সান্ত্বনা দেওয়ার ছলে সাধারণ আবেগপ্রবণ পাঠককেই প্রবোধ দিয়েছেন। এতে আখ্যানের ‘মধুরেণ সমাপয়েৎ’ হয়তো ঘটেছে কিন্তু পাঠকের মর্মের গভীরতম প্রদেশে যে অশান্তির সুর বেজে ওঠার কথা, তা হয়নি। গল্পটি শেষ হতে পারতো, নববিবাহিত রানু যখন বাসুকে পা ছুঁয়ে সালাম করার সময় চিমটি কাটে, সেখানে। তাহলে পাঠকের ভাবনার বিস্তার ঘটতো। পাঠক এই রহস্যের কূলকিনারা খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করতো। অথবা নায়ক-নায়িকাকে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করার সুযোগ দিতে পারতেন। তারা বিয়ে করে বাড়িতে এসে সেই খবর দেওয়া মাত্রই অভিভাবকরা বলতে পারতো, তাদের বিয়ে সিদ্ধ হয়নি। কারণ তারা দুধ ভাই-বোন। পাত্র-পাত্রী ও পাঠককে এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে ধর্মসংকটে ফেলেই লেখক গল্প শেষ করতে পারতেন। তাহলেই পাঠকের মর্মমূলে একটি বেদনাদীর্ণ বার্তা প্রবেশ করতো। আর গল্পটিও হয়ে উঠতো করুণরসে সিক্ত। কিন্তু গল্পের কথক পাঠকের কল্পনা-বিচারশক্তির ওপর আস্থা রাখতে পারেননি। তাই তিনি নিজেই তারা-বাসুর বিয়ে অন্তরায়ে যে কঠিন বাধা লুকিয়ে ছিল, তা চাচির মুখ দিয়ে বলেছেন। দুধ ভাই-বোন সম্পর্ক হলে সেই তথ্য শৈশব থেকেই বাসু-তারা দুজনেই জানবে না কেন—বিষয়টি অবশ্যই প্রশ্নবিদ্ধ। আবার তাদের বাবা-মাও এতকাল লুকিয়ে রাখবেন কেন? এখানে নাটকীয়তা আরোপিত এবং সেখানে গল্পের বিশ্বাসযোগ্যতাও ক্ষুণ্ন হয়েছে। লেখক কাহিনিকে স্বাধীনভাবে এগোতে দেননি, সর্বজ্ঞের মতো নিজের হাতেই আখ্যানের লাগাম টেনেছেন। ফলে সামাজিক বাস্তবতার চিত্র আঁকার প্রতি অনুগত থাকতে গিয়ে মনস্তত্ত্ব ও বিশ্বস্ততার বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন। গল্পের এটুকু খুঁত বাদ দিয়ে ‘অন্তরমণি’ হয়ে উঠতে পারতো গ্রামীণ নর-নারীর সরল ভালোবাসা-বিচ্ছেদের বিশ্বস্ত দলিল।
সিরাজুল ইসলাম মুনির তাঁর ‘অন্তরমণি’ গল্পটিকে চূড়ান্তভাবে সফল হতে না দিলেও প্রায় একই রকমের আরেকটি গল্প লিখেছেন। এটি ‘অন্যদিন অন্যসময়’। এই গল্পের প্রধান পুরুষ চরিত্র সৌমেন, প্রধান নারী চরিত্র প্রতিমা। সৌমেন-প্রতিমা পরস্পরকে ভালোবাসে। কিন্তু সেই ভালোবাসায় বাধা হয়ে দাঁড়ায় প্রতিমার বড় ভাই অনিল বোস, সৌমেনের বন্ধু। ফলে সৌমেন-প্রতিমার বিচ্ছেদ অনিবার্য হয়ে ওঠে। একদিন প্রতিমার বিয়ের প্রস্তাব আসে অন্য বরের সঙ্গে। বিয়ের দিনই ঘটে অঘটন। সৌমেন যখন প্রতিমাকে নিয়ে গভীর ভাবনায় মগ্ন, তখনই প্রতিমাদের বাড়ি থেকে চিৎকার ভেসে আসে।
সৌমেন ঘুরে তাকিয়ে দেখে বোসবাড়ির উঁচু উঁচু গাছের মাথাগুলো ছাড়িয়ে আগুনের শিখা আকাশে ব্যাপ্ত হচ্ছে। আগুন! আগুন! চিৎকারের সঙ্গে সঙ্গে বোসবাড়ির দিকে মানুষের ছোটাছুটি টের পায় সৌমেন। আর বসে থাকতে পারে না সে। সিঁড়ি ভেঙে দ্রুত নিচে নামতে থাকে। প্রতিমার কথাটা তখন আর মনে থাকে না সৌমেনের।৫
যে প্রতিমাকে ভালোবাসার কারণে বন্ধু অনিল বোসের কাছে অপমানিত হতে হয়েছে, সেই প্রতিমার বিয়ে হচ্ছে অন্য পাত্রের সঙ্গে। সঙ্গত কারণে প্রতিবার পরিবারের প্রতি সৌমেনের ক্রোধ-প্রতিশোধপরায়ণতা জেগে ওঠার কথা। কিন্তু যেখানে আগুনের লেলিহান শিখা প্রতিমাদের বাড়ির সবাইকে ভস্ম করে দিতে দাউ-দাউ করে জ্বলছে, সেখানে ক্রোধ-প্রতিশোধপরায়ণতা উবে যায় সৌমেনের। জেগে ওঠে মানবতা, মানবহৃদয় কেঁদে ওটে বিপন্ন মানুষকে বাঁচানোর তাগিদে। এখানেই লেখক সিরাজুল ইসলাম মুনির নর-নারীর দেহজ কামনা-বাসনাকে তুচ্ছজ্ঞানে উড়িয়ে দিয়েছেন। বড় করে তুলেছেন চণ্ডীদাসের ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’র মর্মবাণীকে। ফলে গল্পটি প্রেমের আখ্যান হয়েও সামাজিক, নর-নারীর বিরহ-বিচ্ছেদের করুণ কাহিনি হয়েও মানবতার জয়গান হয়ে উঠেছে। আর লেখকও নিছক কথক পরিচয়কে ছাপিয়ে হয়ে উঠেছেন জীবনশিল্পী।
ছোটগল্প লেখকের দায়—জীবনের বহিরঙ্গ ও অন্তরঙ্গের যাবতীয় অনুষঙ্গের রূপান্তর করা। মানবসমাজের রুচি ও মননসমর্থিত বিষয়ে অনুবাদ করে পাঠকের সামনে উপস্থিত করা। তাহলে উপস্থিত মানবসমাজের কাছে তার শিল্পকর্মের একটি তাৎক্ষণিক মূল্য থাকে। জীবনের চেয়ে শিল্পকে বড় করে নয়, জীবন ও শিল্পের সমন্বয় ঘটানোই তার মূল কাজ। মানবজীবনের দিনানুদিনের ঘনঘটার বর্ণনা শিল্পের সামীপ্যে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে তখন, যখন শিল্পীর মন ও মননের আনন্তরিক সমর্থন পায় জনজীবনের নানা অনুষঙ্গ। শিল্পী বা লেখক মূলত সত্যের সাধক। ছোটগল্প শিল্পের এমন এক শাখা, যে শাখায় জীবনের মুকুল থেকে শুরু করে পড়ন্তবেলার বিষয়ও মূর্ত করে তোলা সম্ভব। সম্ভব মানবজীবনের অতি তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয়কে বাক্সময় করাও। এসব বিষয়কে মূর্ত করে তুলেছেন ‘তবুও জীবন’, ‘ফেরিঘাট’, ‘বাংলাদেশ’, ‘লোকটি’, ও ‘ইলশার চরে লাশ’ গল্পে। এই গল্পগুলোয় সিরাজুল ইসলাম মুনির নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের জীবনের নানাদিক তুলে ধরেছেন।
‘তবুও জীবন’ গল্পে নিম্নবর্গেও মানুষের জীবনসংগ্রাম, স্বপ্ন ও সাধ্যের বিরোধকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। গল্পের প্রধান চরিত্র আবু। পেশায় নির্মাণশ্রমিক। বরিশাল থেকে জীবিকার টানে চট্টগ্রামে পাড়ি জমায়। যোগ দেয় একটি দশতলা বাড়ির নির্মাণকাজে; শ্রমিক হিসেবে। আর তখনই ভালোবাসে ওই বাড়ির গৃহ পরিচারিকা মনুকে। স্বপ্ন দেখে তাকে নিয়ে ঘর বাঁধার। কিন্তু তার স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দেয় একটি দুর্ঘটনা। ওই দুর্ঘটনায় ভবন থেকে ছিটকে পড়ে দুই পা হারিয়ে চিরদিনের জন্য পঙ্গু হয়ে যায় আবু। হাসপাতাল থেকে মনুদের বাসায় গিয়ে সে আশাহত হয়। মনু তারা মালিকদের সঙ্গে ঢাকায় চলে যায়। ফলে চিরদিনের জন্য সে মনুকে হারায়। মনুকে চিরদিনের মতো হারানোর বেদনা নিয়ে ‘আবু হাঁটে। আগ্রাবাদের ফুটপাথ ধরে। পেছনে পড়ে থাকে দশতলা সাদা দালান আর হলুদ পাখির স্মৃতি।’৬ এই গল্পে সময়ের রূঢ়তার কাছে মানবিক সম্পর্ক যে অসহায়, শেষ পর্যন্ত সময়ই যে সংসারের ভাগ্যনিয়ন্তা-নিয়ন্ত্রক—সে সত্য প্রকাশিত হয়েছে। আবু-মনুর সম্পর্ক স্বাভাবিক ছিল। তাদের প্রেমের পথে কোনো কণ্টকাকীর্ণ ভয়াল অরণ্য ছিল না। সবই ছিল মসৃণ। নিরাপদ-নিঃসংশয়ে প্রেমের গাথা রচিত হচ্ছিল। এরই মধ্যে দুর্ঘটনা, সেই দুর্ঘটনায় আবুর সঙ্গে মনুর দেখা-সাক্ষাৎ বন্ধ।
একসময় মনুর চাকরিদাতাদের বদলি। ফলে নিরাবলম্ব মনুকেও মালিকদের সঙ্গে পাড়ি জমাতে হলো। সঙ্গত কারণে আবুর সঙ্গে তার চিরবিচ্ছেদ ঘটলো। এই বিচ্ছেদের পেছনে কেবলই দুর্ঘটনায় পা হারানো দায়ী নয়, দায়ী নয় কেবলই সময়ের রূঢ়রূপও। এর জন্য দায়ী দারিদ্র্য। লেখক এখানে দেখাতে চেয়েছেন, দরিদ্র মানুষের মনে বিধাতা প্রেম-ভালোবাসা দিলেও তার পরিণতি সবসময় দেন না। সংসারে বেঁচে থাকার প্রধান অনুষঙ্গ অর্থ। সেই অর্থহীন মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় চাওয়া দুই বেলা দুমুঠো অন্ন। যে অন্নসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারে, মানুষ তার হয়েই কাজ করে। আবু দুর্ঘটনায় পা হারিয়ে হাসপাতালে, সে দরিদ্র, তদুপরি নির্মাণশ্রমিক। পঙ্গু হয়ে যাওয়ায় তার ভবিষ্যৎজীবন দুর্বিষহ-অনিশ্চিত। সেই অনিশ্চিত দারিদ্র্যক্লিষ্ট জীবনের সঙ্গে মনু নিজেকে জড়িয়ে নিজের ভবিষ্যৎকে অন্ধকার গহ্বরে ঠেলে দিতে চায়নি। তাই সে আবুকে দেখতে হাসপাতালে যায়নি। বরং চাকরিদাতাদের সঙ্গে স্থানান্তরিত হয়েছে। আবু যদি বিত্তশালী হতো, সে দুর্ঘটনায় পঙ্গু হলেও তার প্রেয়সী তাকে ছেড়ে যেতো না। কারণ আবু পঙ্গু হলেও তার যদি বিত্তের যে পাহাড়া দাঁড়িয়ে থাকতো, তাহলে সেই বিত্তের পাহাড় তার প্রিয় নারীর জীবন বাঁচাতে-জীবন সাজাতে সাহায্য করতো। লেখক দুই দরিদ্র-পরনির্ভরশীল নর-নারীর প্রেম-বিরহের ছবি আঁকার ভেতর দিয়ে অর্থনৈতিক-সামাজিক সংকটকে প্রকট করে তুলেছেন।
‘তবুও জীবন’ গল্পেরই আরেক সংস্করণ যেন ‘ফেরিঘাট’। শেষোক্ত গল্পের নায়ক পঙ্গু রমজান। যৌবনের শুরুতে স্ত্রী কোহিনকে নিয়ে ছিল তার সুখের সংসার। ফেরিঘাটে খালাসির কাজ করতো। একদিন দুর্ঘটনায় ফেরিঘাটেই শরীরের নিম্নাঙ্গ হারায় রমজান। তারপর ভিক্ষার থালা নিয়ে বসে কুশিয়ারা নদীর ফেরিঘাটে। কিন্তু ভিক্ষার থালায় স্ত্রী-সন্তানসহ খেয়ে-পরে বাঁচার অর্থ এলেও, সংসারে আর সুখ ফিরে আসেনি। রমজানের যখন নিম্নাঙ্গ চলে গেছে, তখন সন্তানসহ তার স্ত্রীও চলে যায়। অবশ্যই রমজানও তাকে বাধা দেয়নি। কারণ সেও জানে, পূর্ণযৌবনা-আত্মসম্মানবোধ-সম্পন্ন একজন নারীর পেটের ভাতই যথেষ্ট নয়, সঙ্গে সামাজিক মর্যাদা ও শরীরের চাহিদা মেটানোও জরুরি। এই দুইয়ের কোনোটাই দেওয়ার সামর্থ্য রমজানের যখন থাকে না, তখন আপসেই বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে চলে যায় কোহিন। বহুবছর পর একদিন এই ফেরিঘাটেই আবার রমজান-কোহিন দেখা হয় বটে, কিন্তু কোনো কথা হয় না। কোহিনের মনে কী কথা বেজে উঠেছিল, তাও জানা হয় না রমজানের। ফেরিঘাট তাকে কেবল পঙ্গুই করে না, নিঃসঙ্গও করে দেয়। কোহিন তার দ্বিতীয় স্বামী-সন্তানদের নিয়ে চলে যাওয়ার পর অতীত ভেসে ওঠে রমজানের মানসপটে। সে তখন কুশিয়ারার পানিতে তাকায়। তখন জীবনের করুণ-ভয়াল দুর্ঘটনার স্মৃতি মনে পড়ে তার।
সেই দুর্ঘটনার ছবি যেন কোনো কষ্টকর ঘোরের ভেতরে; তার জীবন ও স্বপ্নকে ধারালো কোনো ছুরি দিয়ে তরমুজের মতো দু’ফালি করে ভাগ করে দিয়েছিল, যার বুক থেকে অবিশ্রাম তাজা রক্তের যে স্রোত বেরিয়ে এসেছিল, সেই স্রোত এখানো যেন বয়ে চলেছে। কুশিয়ারার সবুজ জলকে এই মুহূর্তে আর সবুজ বলে মনে হয় না। সেখানে তাজা রক্তের আবর্ত ওঠে ফেরির প্রপেলারের ঘূর্ণন পেয়ে। সূর্যেও আলোয় এখান থেকে রক্তের স্রোত যেন স্পষ্ট দেখতে পায় রমজান, রক্ত জলের সঙ্গে মিলেমিশে এক অদ্ভুত বর্ণ নিয়ে কেবলই ভাটির দিকে ছুটছে।৭
গল্পের সমাপ্তিকে রমজানের জীবনের পরিণতির সঙ্গে একাকার করে মিশিয়ে দিয়েছেন মুনির। ফলে রমজানের জন্য এক ধরনের অব্যক্ত বেদনা পাঠকের বুকের ভেতর থেকে ঠেলে বেরিয়ে আসতে চায়। লেখক তার পাঠককে জীবনের রূঢ়চিত্র দেখাতে দেখাতে কঠিন এক বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে নিজে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকেন। এখানে লেখক যেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, তিনি কুরুক্ষেত্রে কৌরব-পাণ্ডবদের যুদ্ধে জড়িয়ে দিয়ে নিজে অর্জুনের রথের সারথী হয়ে জয়-পরাজয়-মৃত্যু-বেঁচে থাকার দৃশ্য দেখে যাচ্ছেন। যেন কে মরলো, কে বাঁচলো তাতে কৃষ্ণের কিছুই আসে যায় না। তার কেবল প্রয়োজন ধর্ম সংস্থাপন। তেমনি পাঠককে সমাজের ব্রাত্যশ্রেণীর মানুষের জীবন-মৃত্যু-হাসি-কান্না-বিরহ-মিলনের দ্বন্দ্বে ছেড়ে দিয়ে খেলছেন গল্পের ‘বিশ্বলয়ে’ ‘বিরাট শিশু’ সিরাজুল ইসলাম মুনিরও।
এই ধারার একটি উল্লেখযোগ্য গল্প ‘বাংলাদেশ’। গল্পটি উত্তমপুরুষে লেখা। গল্পের নায়ক পিতৃপরিচয়হীন। কেবল মাকেই দেখেছে। কিন্তু সেই মা-ও আর নেই। জীবিত না মৃত—সেই তথ্যও কেউ দিতে পারে না। কথক থাকে তার খালার কাছে। খালা তাকে স্নেহ করে, মমতা দেখা, আগলে রাখে। কিন্তু সেই খালাও মাঝেমাঝে তার ওপর ক্ষেপলে ‘জাউরা’ বলে ভর্ৎসনা করে। কথক জানে না, ‘জাউরা’ শব্দের অর্থ কী। তাই চুপচাপ শুনে যায়। সমবয়সী আরেক পিতৃহীন বালক জসিমের সঙ্গে তার সখ্য গড়ে ওঠে। জসীম থাকে কমলাপুর রেলস্টেশনে। সেখানে জসীম কথককে বিড়ি খাওয়ার অভ্যাস করায়। এতে কথকের খালা ক্ষেপে যায়। তাই ভর্ৎসনা করে। সে খালাকে কথা দেয় আর বিড়ি খাবে না। কিন্তু তারপর একদিন হঠাৎ ঘরে ঢুকে খালার সঙ্গে একজন পুরুষকে বিবস্ত্র অবস্থায় দেখে। তার তখন মনে পড়ে—ইতোপূর্বে খালা বলেছিল, কথকের মাকে পাকিস্তানিরা ধর্ষণ করেছে, সেই ধর্ষণের ফলেই তার জন্ম। এ দৃশ্য দেখে কথক ভাবে—খালাকে লোকটি অত্যাচার করছে। তাই সে লোকটির মাথায় আঘাত করে। এতে খালা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তাকে ঘর থেকেই বের করে দেয়। ঘর থেকে বের হয়ে চলে যায় জসীমের কাছে। সেখানে বিড়ি খায়। জসীমের কাছে ‘জাউরা’ শব্দের অর্থ জেনে নেয়। ধর্ষণ ও স্বাভাবিক যৌন সম্পর্কের ধারণা পায়। তখন বুঝতে পারে, তার জন্ম ধর্ষণের ফলে হলেও খালার সঙ্গে যা হচ্ছিল, তা ধর্ষণ নয়। স্বাভাবিক শারীরিক সম্পর্কই চলছিল। ইতোমধ্যে ধর্ষণ-বিয়ে, বাবার পরিচয়, জাউরা শব্দের অর্থ নিয়ে প্রশ্ন করায় জসীম বলে, ‘কিন্তু তুমি হালায় এই কুকামটা লইয়া পড়ছ কেলায়?’৮ জবাবে কিছু বলতে পারে না কথক। কেবল ‘খালা আর লোকটার ন্যাংটা শরীর আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আমার বমি আসে।’৯ আর তখনই তার মনে হয়, তার শৈশব কাল কেটে গেছে। সে রাজপথ-ফুটপাতের মানুষের মিছিলে মিশে যায়। তার বিকেল নামে, সন্ধ্যা নামে। একসময় রাতও নামে।
আমি আর ঘরে ফিরি না। কার ঘরে ফিরব? ওই খালার ঘরে? খালা তো আমাকে জাউরা বলেছে। আমি কি আসলেই জাউরা? আমার মা বাংলাদেশের একুশ বচরের এক শ্যামশ্রী মেয়ে। আমার বাবা পাকিস্তানি কুত্তার বাচ্চা। বাবা হতে গেলে মার সঙ্গে তার কলেমা কই? তাহলে আমি কার সন্তান? বাংলাদেশের! আমার মা-ই কি বাংলাদেশে!১০
আশ্রয় হারিয়ে আত্মপরিচয়-সংকটাপন্ন এক শিশু তার পরিচয় খুঁজে ফেরে। আর নিজেকেই প্রশ্ন করে পিতৃপরিচয়হীন, মাতৃহারা সন্তানের মা কে? তখনই তার মনে হয়, সে তো এক ক্রান্তিকালে দুর্ঘটনায় জন্ম নেওয়া সন্তান। যে ঘটনা তারা খালার ঘটনার মতো নয়, আর দশজন বিবাহিত নারী-পুরুষের দৈহিক মিলনের ফলও নয়। তার মায়ের সঙ্গে যা ঘটেছে, তা অপ্রত্যাশিত, তার জন্ম আরও অনাকাঙ্ক্ষিত। যে শ্যামবর্ণের মা তাকে জন্ম দিয়েছিলেন, সে মাও নেই। বাংলাদেশ নিজেও শ্যামল রূপসী। সুতরাং বাংলাদেশই তার মা।
‘লোকটি’ গল্পে মূলত পেশাজীবী মানুষের দায়িত্বের খাতিরে বিভিন্ন জায়গা ও বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে পরিচয়-অপরিচয়ের নির্ঘণ্ট তৈরি করা হয়েছে। এটিও ‘বাংলাদেশ’ গল্পের মতো উত্তমপুরুষে রচিত। গল্পের প্রধান চরিত্র দুটি। কথকের সঙ্গে দ্বিতীয় চরিত্রটির প্রথম দেখা ট্রেনে। হাত মেলে বসে আছে। তাকে দেখে কথকের মনে হয়েছে ভিখারি। তাই লোকটিকে একটাকা ভিক্ষাও দেয়। এরপর লোকটির সঙ্গে আবার দেখা প্রেসক্লাবের সামনে। সেখানে কথক লোকটির দিকে এগিয়ে গিয়ে যেচে আলাপ করতে চায়। বলে, সে লোকটিকে কোথাও যেন দেখেছেন। লোকটি ‘হ্যাঁ হতে পারে’ বলে ‘সতর্ক’ হাসি হাসে। একসময় লোকটি কথকের হাত চেপে দেয়। তখন প্রেসক্লাবের সামনে স্বৈরাচারবিরোধী সমাবেশে মিছিল-বক্তৃতা চলছে। এই ফাঁকে লোকটি কোথাও হারিয়ে যায়। কথকের সঙ্গে লোকটি তৃতীয় এবং শেষবার দেখা হয়, কোনো এক জনাকীর্ণ এলাকায়। সেখানে লোকটি কথকের কাছে এসে নিজেই বলে, সে তাকে আখাউড়া স্টেশনে দেখেছে। একইসঙ্গে স্মরণ করিয়ে দেয়, একটাকা ভিক্ষা দেওয়ার বিষয়টিও। বলে, ‘আপনি আমার কাছে একটাকা পাওনা রয়েছেন। কিন্তু তারও চেয়ে বড় যে কথা, আরও সতর্ক হয়ে চলার ব্যাপারে আপনি আমাকে একটা শিক্ষা দিলেন।’১১ জবাবে লোকটিকে কথক জানায়, সে তাকে চিনতে পারেনি। এবার লোকটি এগিয়ে কথকের দিকে। তখন কথকের ‘তালুর স্পর্শের মধ্যে অনুভূত হয় এবং সেখানে একটি টাকার ধাতব উপস্থিতি উষ্ণ কৃতজ্ঞতার তুলতুলে টুকরোটিকে দু’ফালি করে কাটতে থাকে।’১২ গল্পের শেষে লোকটি কথককে জানিয়ে যায়, সে একজন গোয়েন্দা। আর তখন কথক মনে মনে হাসে। কারণ সেও একজন গোয়েন্দা। আর তার ধারণা, লোকটি কথকের এই পরিচয়টা ধরতে পারেনি।
এই গল্পে একইসঙ্গে রাজনৈতিক-সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক বাস্তবতার সূক্ষ্ণ রূপ ফুটে উঠেছে। স্বৈরাচারের শাসনের ত্রাসে সময় তখন স্থবির-অস্থির; সেই সময়ে মানুষ পরস্পরের দিকে সন্দেহের চোখে তাকায়, শাসকদলের চরেরা মানুষের ভিড়ে মিশে গিয়ে শত্রু-মিত্র শনাক্তের কাজে নিয়োজিত হয়। এসব পেশাদার গোয়েন্দা কখনো ভিখারির বেশে, কখনো পাগলের বেশে ট্রেনে, বাসে, লঞ্চে, বাস টার্মিনালে, লঞ্চ টার্মিনালে, রেল স্টেশনে ঘুরে বেড়ায়। দয়ালু মানুষেরা তাদের দেখা মাত্র কখনো অর্থ, কখনো খাবার এগিয়ে ধরে। ‘লোকটি’ গল্পে সেই চিত্রই তুলে ধরা হয়েছে। একইসঙ্গে আরও একটি বার্তা দেওয়ার সচেতন-সতর্ক প্রয়াস চালিয়েছেন মুনির—মানুষকে তাৎক্ষণিক অবস্থা-পোশাকি আচরণে চেনা যায় না। অচেনাজনিত কারণেই মানুষে-মানুষে ভুল বোঝাবুঝির ঘটনা ঘটে। সম্ভবত এটি সিরাজুল ইসলাম মুনিরের শ্রেষ্ঠগল্পগুলোর একটি। লোকটি গল্পের শুরু থেকে শেষপর্যন্ত প্রতিটি ঘটনাই ‘পাঠকদের মর্মে গিয়ে ঘা মারে, নিমেষে এক অলৌকিক অনুভূতির নৈঃশব্দ্যের মধ্যে তার চিরন্তন ব্যঞ্জনা কম্পন তোলে।’১৩ ফলে গল্পটি পাঠ শেষে পাঠকমনে বহুক্ষণ তার রেশ থেকে যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছোটগল্প প্রসঙ্গে যে বলেছেন, ‘শেষ হয়ে হইলো না শেষ’, সেই শর্ত ‘লোকটি’ গল্পের ক্ষেত্রে ষোলো আনা খাটে বললে অত্যুক্তি হবে না।
‘ইলশার চরে লাশ’ মূলত গ্রামীণ জনপদে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার গল্প। গল্পের প্রধান চরিত্র মোস্তফা সর্দার। প্রধান প্রতিচরিত্র অলি মেম্বার। মোস্তফা সর্দার পেশায় শ্রমিক। মূলত উপকূলীয় বনায়ন প্রকল্পের শ্রমিকদের সর্দার। বনায়নের কাজ থেকে শুরু করে যে-কোনো প্রকল্পের কাজ সাধারণত অলি মেম্বার পায়। কিন্তু এবার অলি মেম্বার পায়নি। পেয়েছে মোস্তফা সর্দার। শ্রমিকদের নিয়ে সর্দার যখন কাজে যায়, তখন একদিন দেখে একজন সাহেবের লাশ ভেসে এসেছে নদীর তীরে। মোস্তফা সর্দার সেই লাশের জামাকাপড় আঁতিপাতি করে খুঁজে এটি আংটি পায়। সেটি নিজের হাতে পরে। এরপর ঘটতে থাকে সব অবিশ্বাস্য ঘটনা। লোকজন প্রায় দেখতে পায় সাহেবের লাশ চলাফেরা করছে। সে কথা মোস্তফা সর্দারের কানেও আসে। কিন্তু সে বিশ্বাস করে না। একসময় সর্দারও লাশটিকে চলাফেরা করতে দেখে। এবার সে ভয় পায়। তাকে কাঁপুনি দিয়ে জ¦র আসে। রাতে সে স্বপ্ন দেখে অলি মেম্বারকে। সর্দারের মনে পড়ে অলি মেম্বার তার ভাইয়ের জন্য বনায়নের কাজ পেতে চেয়েছিল। কিন্তু পায়নি। কাজ পেয়েছিল সর্দার। তখন ক্ষেপে গিয়ে অলি মেম্বার দেখে নেবে বলে হুমকি দিয়েছিল।
সর্দারের যে রাতে জ্বর আসে, তারপর দিন সকাল থেকে তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। শেষে তার লাশ মিললো খালের পানিতে। স্থানীয়দের স্থির বিশ্বাস সাহেবের লাশ সর্দারকে হত্যা করেছে। সাহেব তার প্রতিশোধ নিয়েছে। এখন আর ভয় নেই।
রাংতার মতো ইলশার চর চক্চক্ করে। আজকের দুপুরটা শূন্য, কেবলই ভয় ভেঙে জেগে উঠেছে জুবলির মানুষ। তারা মনে মনে, ইলশার চরের সাহেবরা তার প্রতিশোধ নিয়ে ফেলেছে, আর ভয় নেই। আবার কাল থেকে ইলশার চর পেরিয়ে ভাটির চরে শ্রমিকেরা যাবে, জোয়ারের ঘড়ি হিসাব কওে আবার ফিরে আসবে। কেবর একটা বিষয় তারা জানে না কাল থেকে শ্রমিকদের সর্দার কে হবে।১৪
গল্পের কাহিনি সহজ-সরল। কিন্তু এর প্রতিটি বাঁকে রহস্য-রোমান্স-কুসংস্কার বটবৃক্ষকে প্যাচিয়ে থাকার স্বর্ণলতার মতোই বিস্তার করে আছে। গল্পের আপাত সরল আখ্যানের আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে পল্লী অঞ্চলের ‘ভিলেজ পলিটিক্সের’ এক ভয়াল চিত্র। ক্ষমতা লড়াই সেখানে বিভৎস রূপ পেয়েছে। অলি মেম্বার তার ভাইয়ের জন্য বনায়নের কাজ পায়নি, তাই সে ক্ষেপে। ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার হওয়ায় তার সঙ্গে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে পরিচয় রয়েছে। তার কিছু অনুচর ও আজ্ঞাবহ লাঠিয়াল এমনকি ভাড়াটে খুনি থাকাও অসম্ভব নয়। বনায়নের কাজ না পাওয়ায় বনবিভাগের সদ্য যোগ দেওয়া নতুন কোনো কর্মকর্তাকে হত্যা করে তারই লাশ শ্রমিকদের জন্য দৃশ্যমান জায়গায় রেখে দেওয়া অলি মেম্বারের ‘ভিলেজ পলিটিক্সের’ই একটি অংশ মাত্র। যদিও লেখক তেমন কোনো বর্ণনা এই গল্পে রাখেননি। তবু অলি মেম্বারের কাজ না পাওয়া, সাহেবের লাশ ভেসে আসা, সেই লাশের চলাফেরা এবং জ¦রের ঘোরের অলি মেম্বারকে স্বপ্ন দেখা, এসবের কোনোটিই অলৌকিক নয়। ভৌতিকও নয়। সবই মানুষের কর্ম।
গ্রামীণ মানুষের কুসংস্কার-অন্ধবিশ^াসকে পুঁজি করে চতুর অলি মেম্বার প্রতিশোধের ভয়ানক খেলায় মেতে ওঠে। লাশ ভেসে আসা তারই সাজানো নাটক। সেই লাশের চলাফেরা করাও তারই পরিকল্পনার অংশ। এর ভেতর দিয়ে অশিক্ষিত-কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষের মনে ভীতির সঞ্চার করে নিজের কার্যসিদ্ধির পথে এগিয়ে যায় অলি মেম্বার। ফলে রাতের অন্ধকারে জ্বরগ্রস্ত সর্দারকে হত্যা করে তার লাশ খালে ফেলে দেওয়া তারই কাজ। কিন্তু কুসংস্কার যে গ্রামবাসীর রন্ধ্রে-রন্ধ্রে তারা বাস্তবের চেয়ে অলীক গল্পে বেশি বিশ্বাসী। ফলে ‘সাহেবের লাশের চলাফেরা’কে পুঁজি করে প্রতিদ্বন্দ্বী নিজের পথ থেকে সরিয়ে দেওয়া অলি মেম্বারের জন্য অসম্ভব কোনো কাজ নয়। অন্যদিকে অলৌকিকতার প্রতি, ভৌতিক কর্মকাণ্ডের ওপর গ্রামবাসীদের বিশ্বাস এতই দৃঢ় যে, তারা সর্দারের হত্যার জন্য অলি মেম্বার কিংবা কোনো জীবিত মানুষকে দোষারোপ করে না। এমনকি সন্দেহ পর্যন্ত করে না। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস, ‘সাহেব লাশটা মোস্তফা সর্দারকে পানিতে ডুবিয়ে মেরেছে’।১৫ গ্রামের অশিক্ষিত-কুসংস্কারাচ্ছন্ন সাধারণ মানুষের অন্ধবিশ্বাস-অপবিশ্বাসে বলি যে তারা নিজেরা দিনের পর দিন হতে থাকে, অথচ মৃত্যুর মুহূর্তেও বুঝতে পারে না, সেই চিরায়ত সত্য ফুটে উঠেছে ‘ইলশার চরের লাশ’ গল্পে। এই গল্প যেন কোনো শিল্পীর নিছক কল্পনা নয়, সরেজমিনে তদন্ত প্রতিবেদন। কেবল তার সঙ্গে লেখক জুড়ে দিয়েছেন ভাষার সৌকর্য-কল্পনার কারুকাজ ও বর্ণনার মোহনীয় শৈলী। এই গল্পের ভেতর দিয়ে গ্রামীণ জনপদের দুই শ্রেণীর মানুষের চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক। প্রথম অশিক্ষিত-কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষ, দ্বিতীয় ধূর্ত-স্বার্থপর-হিংস্র-প্রতিশোধপরায়ণ ক্ষমতাবান মানুষ। গ্রামের জীবন একতরফা সহজ-সরল যেমন নয়, তেমনি একতরফা চাতুর্যপূর্ণও নয়। শহরের মতোই এখানে আধিপত্যের লড়াই আছে। সেই লড়াইয়ে হেরে পরাজিত শক্তির ভয়ংকর হয়ে ওঠার ঘটনা যেমন আছে, তেমনি ক্ষমতাবানদের কেউ কেউ জিন-ভূত-আত্মা হয়ে ওঠারও ঘটনা রয়েছে। এখানে জীবিত মানুষ লাশের অভিনয় করে, সাধারণ মানুষকে বোকা বানিয়ে চিরকাল শ্রমদাসে পরিণত করে রাখে। সেই ক্রুর বাস্তবতার উজ্জ্বল দলিল এই ‘ইলশার চরের লাশ’।
সিরাজুল ইসলাম মুনিরের গল্পের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ অসম বয়সী নর-নারীর মধ্যে প্রেমহীন যৌনসম্পর্ক। ‘অংকুরি’ ও ‘ঈশ্বরের পুনর্জন্ম’ গল্প দুটিতে এই অসম বয়সের যৌনসম্পর্কের চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। উভয় গল্পেই সামাজিকরীতিবিরুদ্ধ যৌনসম্পর্ক তৈরি হয়েছে।
‘অংকুরি’ গল্পের প্রধান চরিত্র অংকুরি। গল্পের শুরুতে দেখা যায় অংকুরি অকারণে দরজার চৌকাঠ ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। তখন ‘সূর্যের তেজ যেন রতিউন্মুখ দুর্দান্ত ষাঁড়ের মতো ক্ষুরধার হয়ে ছুটে আসে।’১৬ সে খেয়াল করে পাশের বাড়ির ছোট ছেলেটি স্কুল থেকে বাসায় ফিরে আসে। তারপর ছেলেটির ভাবি তাকে মাতৃস্নেহে আদর করে দুপুরের খাবার খাওয়ায়। এই দৃশ্যকে অংকুরির কাছে মাতাপুত্রের সম্পর্কের মতোই পবিত্র মনে হয়। কিন্তু বিপত্তি বাধে অন্যত্র। একদিন অংকুরের সেই বাসায় গিয়ে দেখে বউটি কথা বলে কম। তেমন বাইরে বের হয় না। তার স্বামী শিপিং কোম্পানিতে চাকরি করে। বাসায় থাকে না। অংকুরি মাঝেমাঝে ওই বাসা থেকে অদ্ভুত শব্দ শুনতে পায়। যে শব্দে তার শরীরে বিদ্যুৎ বয়ে যায়। ফলে তার ভেতর কৌতূহল জাগে। ছেলেটি বাসায় ফেরার পর দরজা-জানালা বন্ধ হয়ে যায় কেন। কেন ওই সময় সেই অদ্ভুত শব্দ ভেসে আসে। অংকুরির পাশের বাসায় গিয়ে একদিন বেড়ার ওপর সাঁটানোর কাগজ ছিঁড়ে ফুটো করে দিয়ে আসে। এরপরদিন যখন ওই শব্দ শুনতে পায় সে, তখনই উঁকি মারে।
তারপরের দৃশ্য অংকুরির জন্য অবিশ্বাস্য, অকল্পনীয়। অংকুরির সমস্ত শরীর আবিষ্ট হয় কামে ও দ্রোহে। এ এক আশ্চর্য অনুভূতি। একজন নারী কেবলই তার শারীরিক লালসা মেটানোর জন্য স্ফুটনোন্মুখ এক বালককে ব্যবহার করছে, ভাবতেই ক্রোধ হয়। একইসঙ্গে এই খেলা দেখতে দেখতে তার সমস্ত শরীওে এক ধরনের আনন্দ-দহন খেলা করে, সে দহন তীব্রতর হয়ে তাকে আনন্দ-আগুনে পুড়িয়ে মাওে, তার ধ্যানমগ্ন কম্পিত দেহের ভাঁজে ভাঁজে বড় সাহেবের স্পর্শ এসে লাগে, তাকে অন্য এক মোহিনী জীবনের স্মৃতিতে বিভোর করে তোলে।১৭
কী সেই স্মৃতি? অংকুরি গরিব ঘরের মেয়ে। পেটের দায়ে শহরের এক সাহেবের বাসায় গৃহপরিচারিকার কাজে দিয়ে যায়। সেই বাসার বেগম সাহেবাকে অংকুরি মা ডাকে, আর সাহেবকে ডাকে মামা। দিনে দিনে অংকুরি সাহেবদের বাসার একজন সদস্য হয়ে ওঠে। একসময় অংকুরি দেখে বড় সাহেব আর বেগম সাহেবের মধ্যে দিনের বেলা দেখা-সাক্ষাৎ কম হয়। বেগম সাহেবা যখন বাসায়, বড় সাহেব তখন অফিসে। আবার বড় সাহেব যখন বাসায় আসে, বেগম সাহেবা তখন বাসার বাইরে। এমনই একদিনে বড় সাহেব দুপুরের খাবার খেতে বাসায় আসে। আর তখন অংকুরি একাকী বাসায়। ঝামেলামুক্ত বাসায় তাদের মধ্যে সেদিনই যৌন সম্পর্ক স্থাপিত হয়। শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের পর বড় সাহেব কাঁদতে থাকেন। অংকুরির মনে হয়, বড় সাহেব ঘটনা জানাজানির ভয়ে, সম্মান হারানোর আশঙ্কায় কাঁদছেন। একসময় বড় সাহেব অসুস্থ হয়ে পড়েন। অফিসে যান না। বাসায় বড় সাহেব আর অংকুরি। এই সময় আরেকবার তাদের মধ্যে সেই আদিম প্রবৃত্তি জেগে ওঠে।
অংকুরি বড় সাহেবের মাথায় হাত রাখে। এতে কি বিপরীত শরীরটির ভেতর কোনো বিদ্যুতের কণা প্রবাহিত হলো! তিনি চকিতে উঠে বসলেন।
অংকুরি বলে, মামা, আপনি এমন করছেন কেন? আমি কাউকে কিছু বলব না।
তিনি বললেন, কিন্তু আমি কেন এতবড় একটা ভুল করলাম।
অংকুরি বলে, না আপনি কোনো ভুল করেন নাই। এমন হতে পারে। হয়ে গেছে। আমি বারবার আপনার এই ভুলের সঙ্গী হতে চাই।১৮
এখানে অংকুরি যেন হরিণী, আর বড় সাহেব ক্ষুধার্ত সিংহ। হরিণীর আহ্বানে ক্ষুধার্ত সিংহ আবারও ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারপর শারীরিক তৃপ্তির পর আবারও বড় সাহেব কাঁদে। এবারও অংকুরি তাকে সান্ত¦না দেয়। বলে, বড় সাহেব যেন তাকে বিয়ে দিয়ে দেয়। তাহলে আর বড় সাহেবের মনে ভয়-শঙ্কা থাকবে না। এরপর বড় সাহেবের অফিসের সুদর্শন পিওন আইয়ুব আলীর সঙ্গে অংকুরির বিয়ে হয়ে যায়। সেই থেকে এই মুখতার কলোনিতে থাকে তারা। স্মৃতি রোমন্থনের পর অংকুরি আবার বাস্তবে ফিরে আসে। দেখে, ‘ছেলেটা আবার স্কুলে যাচ্ছে। বড় সাহেবের মতো সেও দুপুরের খাবার খেতে এসেছে।’১৯
লক্ষণীয় বিষয়, অংকুরির সঙ্গে বয়সের অনেক ব্যবধান বড় সাহেবের। তাদের মধ্যে কোনো প্রতিশ্রুতি নেই, ঘর বাঁধার স্বপ্নও নেই। কেবল শরীরে ডাকে শরীর সাড়া দিয়েছে। বড় সাহেবের যেমন শরীরের চাহিদা ছিল, তেমনি অংকুরিরও শরীরে কামনার বান ডেকেছিল। উভয়ই ক্ষুধার্ত যখন একই দিগন্তরেখায় এসে মিশেছিল, তখন প্রতিশ্রুতি-স্বার্থ-ভবিষ্যৎজীবন—এসব নিয়ে ভাবনা কারও মনেই স্থান পায়নি। তখন কেবলই শরীর চিনেছে শরীর, দাবিও মিটিয়েছে শরীরের। শরীরের ক্ষুধার কাছে পাপ-পুণ্য-সামাজিক ভয়, সংসারের ফাটল ধরার শঙ্কা মুহূর্তের জন্য উবে গিয়েছিল। যৌনকর্মটি ঘটে যাওযার পর প্রতিবারই কিন্তু বড় সাহেবের কেঁদেছিল। বিপরীতে পাশের বাড়ি বউটি যে বালক দেবরের সঙ্গে কামে লিপ্ত হচ্ছে প্রতিদিন, তার জন্য কামপর্ব শেষে তাকে কাঁদতে দেখা যায়নি কখনো। সময় ও সুযোগের সুসমন্বয় হলে হৃদয়ের দাবির দরকার হয় না, প্রয়োজন হয় না কোনো প্রতিশ্রুতি কিংবা কোনো বিনিময়েরই। উভয়ের শরীর যখন বিপরীত শরীরের জন্য কামার্ত হয়ে ওঠে, তখন সেই ক্ষুধা-তৃষ্ণা মেটানোই অগ্রাধিকার পায়।
এই ধারারই আরেকটি গল্প ‘ঈশ্বরের পুনর্জন্ম’। গল্পের প্রধান চরিত্র অলকা। গল্পের শুরুতে তার বিয়ের প্রসঙ্গ এসেছে। একদিন পর তার বিয়ে। বাড়িতে সানাই বাজছে। তার মনে আনন্দের ফল্গুধারা বয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু তা ঘটছে না। কারণ পেটে সন্তান। সেই সন্তান হবু স্বামী প্রভাকরের নয়। সেই সন্তান পেটে এসেছে রীতিবিরুদ্ধ সম্পর্কের ফলে। সন্তানের বাবা তারই পিসতুতু ভাই, তার চেয়ে ছয়/সাত বছরের ছোট অভিজিৎ। জ্ঞাতি ভাই-বোনের মধ্যে বিয়ে তার ধর্ম অনুমোদন করে না। কিন্তু যৌনমিলনের পর যে সন্তান পেটে এসে গেলো, তার স্বীকৃতির প্রয়োজনেও পিসতুতু ভাই হওয়ায় বিয়ে সম্ভব নয়। এখন উপায়? সে আত্মহত্যা করবে না। আত্মহত্যা করলে নিজের প্রাণত্যাগের সঙ্গে সঙ্গে ভ্রƒণকেও হত্যা করা হবে। অলকা জানে আত্মহত্যা পাপ, আর ভ্রূণহত্যা মহাপাপ। সে দুই পাপে পাপী হতে চায় না। আবার এখনই বিষয়টি প্রভাকরকে জানাতেও চায় না। তার নিজের ও সন্তানের ভাগ্যকে সময়ের হাতে ছেড়ে দিয়ে প্রভাবকরের সঙ্গে ঘর বাঁধার মানসিক প্রস্তুতি সে নিতে থাকে। তার মনে হয়, গর্ভে ঈশ্বর ঘুমিয়ে আছে।
প্রভাকরকে তার কিছু বলতে হবে কি না এখনও জানে না অলকা। বলতে হলে বলবে, সন্তানের জন্য একজন পিতার পরিচয় দাবি করবে, তারপর না হয় সিঁদুর মুছে চলে আসবে।
তার তো কোনো ভয় নেই। স্বয়ং ঈশ্বর যে তার সঙ্গে আছেন।২০
এই যে শঙ্কাশূন্য দৃঢ়তা অলকার মনে, এই মানসিক শক্তি হবু নববধূর নয় কোনোভাবেই। এই দৃঢ়তা একজন মায়ের। নিজের শরীরের একটি অংশকে পৃথিবীর আলো-হাওয়ায় নিয়ে আসার জন্য আত্মমর্যাদা হারানোর ভয় কিংবা আসন্ন সংসার ভাঙার শঙ্কাও তাকে টলাতে পারেনি। এই গল্পে একদিকে যেমন মাতৃত্বের জয়গাথা রচিত হলো, অন্যদিকে তেমনি অসম বয়সী নর-নারীর শর্তহীন-প্রতিশ্রুতিহীন, ভালোবাসাশূন্য শারীরিক সম্পর্ককে যৌক্তিকভাবে মেনে নেওয়ার ওপরও জোর দেওয়া হলো। সামাজিক রীতিনীতি কিংবা ব্যক্তিগত লাভালাভের হিসাব এখানে গৌণ হয়ে উঠেছে। বিপরীতে মানবসন্তানের জন্মাদানের তীব্র আকাক্সক্ষায় একজন মাকে ব্যাকুল-দৃঢ়চেতা করে তুলেছে।
সিরাজুল ইসলাম মুনিরের গল্পের তৃতীয় প্রধান বৈশিষ্ট্য ‘আধ্যাত্মচেতনা ও মানবতা’। এই পর্বে তার উল্লেখযোগ্য একটি গল্প হলো ‘আরম্ভ’। এটি মূলত পারিবারিক গল্প হলেও এর গহীনে রয়েছে আধ্যাত্মচেতনার গভীরতম প্রকাশ। তিনি মধ্যবিত্তের মানবিক সংকটকে চিত্রায়িত করেছেন এখানে। মানুষের বাহ্যিক আচরণের চেয়ে মনস্তত্ত্বের দিকেই আলোকসম্পাত করার পক্ষপাতী তিনি। মানবিক গূঢ়ৈষাকে অস্বীকার না করে, কেবল দেখার কাক্সক্ষাকে চরিতার্থ করার ভেতর যে বিপুল ফাঁকি লুকায়িত, সে সত্যকে প্রকাশ করে একজন শেকড়চ্যুত মানুষের তুমুল মনোবিকারের চিত্র এঁকেছেন ‘আরম্ভ’ গল্পে। গল্পের প্রধান চরিত্র আতিক সাহেব। সম্প্রতি তার ভালো ঘুম হয় না। ঘনঘন ওয়াশরুমে যায়। ঘনঘন প্রস্রাব হয়। আতিক সাহেব বুঝতে পারে না, এর কারণ। প্রায় ঘুম না হলে জিদ চাপে মাথায়। তখন বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে থাকে। তারপরও ঘুম আসে না। বিছানায় শুয়ে শুয়ে নানা জল্পনা-কল্পনায় রাত পার করে। ভোরের আজান শোনে। পাপ-পুণ্য-ইবাদত-আখিরাতের ভাবনা তাকে পেয়ে বসে। হঠাৎ সে খেয়াল কওে তার সেই ভাবনায় স্ত্রী নীলুকেও টেনে আনে। তার মনে হয়, স্রষ্টার ইবাদত করা উচিত। কিন্তু ইবাদত করা তার হয় না। তবু বিষয়টি নিয়ে উসখুস করে। সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে। এতে তার স্ত্রী বিরক্ত হয়। তখনই আতিকের মনে হয়, নীলুকে সে কখনোই নামাজ পড়তে দেখেনি। তাদের চার ছেলে-মেয়ের একজনকেও মৌলবি রেখে ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া হয়নি।
ভাবতে ভাবতে একদিন ফজরের আজানের পর আতিক সাহেব ওয়াশরুমে যায়। গোসল করে। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসে আতিক। তখন উৎকণ্ঠিত নীলু তার সামনে দাঁড়ায়:
কী হয়েছে তোমার বলে স্বামীকে হাত বাড়িয়ে ধরতে যান। নীলুর ছোঁয়া বাঁচিয়ে একটু দূরে সরে গিয়ে তিনি বললেন, আমাকে ছুঁয়ো না তুমি।
আমি গোসল করেছি। ওজু করে পবিত্র হয়েছি।২১
স্বামীর জবাব শুনে বিস্মিত হয় নীলু। কিন্তু কিছু বলে না। এদিকে আতিক সাহেব আলমারি খুলে জায়নামাজ-টুপি খুঁজতে থাকে। না পেয়ে তার মনে হয়, এই বাসায় যারা থাকে, তারা কেউ মানুষ নয়। পশু। তাদের ভেতর ধর্ম নেই, খোদাভীতি নেই। তখন গায়ের দামি চাদর মেঝেতে বিছিয়ে দেয়। ঘরের লাইট অফ করে জানালার পর্দা সরিয়ে দেয়। আর তখন দেখে, ‘সুবেহ সাদেকের আলো-ছোঁয়া ভোর সে জানালা দিয়ে ছড়িয়ে পড়ে চাদরের ওপর। জীবনের আর একটি আরম্ভেও জন্য একজন মানুষ সেই চাদরে গিয়ে দাঁড়ায়।’২২ এই গল্পের সিলাজুল ইসলাম মুনির দেখিয়েছেন, মানুষ সংসারের ঝড়-তুফানের মুখোমুখি হতে হতে একসময় হাঁপিয়ে ওঠে। তখন একটু শান্তি একটু স্বস্তির আশায় পরম কোনো সত্তার কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে চায়। এতেই অশান্ত মনকে শান্ত করার উপায় খোঁজে। গল্পের নায়ক আতিকও সেই রকম একজন মানুষ। সে নিজে ও তার পরিবারের কেউ-ই ধর্মকর্ম করে না। তবু সংসারে জাগতিক কোনো অশান্তির ছায়া পড়ে না। তাদের সংসারে সুখী-সুখী এক আবহ ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু বয়স চল্লিশের কোটা পার হতেই শারীরিক নানা পরিবর্তন আসে তার। আর তখনই তার মনে পরকালের চিন্তা জেঁকে বসে। ধর্মকর্মে মনোনিবেশের ভাবনায় অস্থির হয়ে ওঠে তার মন। তবে, দীর্ঘদিনের অনভ্যস্ত মন সহসা ধর্মকর্মের আনুষ্ঠানিকতার অনুমোদন করে না।
পুরো সংসারে আতিকের একার মনেই অধ্যাত্মসংকট প্রকট হয়ে উঠলেও তার স্ত্রী-সন্তানদের মনে পারলৌকিক চিন্তার অণুমাত্রও দেখা যায় না। তাই সে সহসা ধর্মেকর্মে সম্পৃক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে বিব্রত বোধ করে। এতকিছুর পরও তার অন্তরের যে ডাক, সেই ডাক স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা-আনুগত্যে তাকে বিগলিত করে তোলে। একসময় সে আবিষ্কার করে, তাকে নামাজ ডাকছে। কিন্তু নামাজ আদায়ের জন্য যে টুপি-জায়নামাজ দরকার, সেগুলো তার ঘরে নেই। বিষয়টি তাকে বিব্রত করে বটে, কিন্তু লক্ষ্যচ্যুত করতে পারে না। আতিক সাহেবের ভেতর দিয়ে মুনির দেখিয়েছেন, মানবপ্রবৃত্তির এক জটিল-রহস্যাকীর্ণ জগৎ; যেখানে মানুষ ঘোর বস্তুবাদী থেকে হঠাৎই হয়ে ওঠে ভাববাদী। ধর্মকর্মের ত্রিসীমায় যাকে দেখা যেতো না, সেও ভিষণ ধার্মিক হয়ে ওঠে। মানুষ নিত্য বস্তুগত সত্যের মুখোমুখি হতে হতে একসময় বস্তুকেই তার কাছে নিরর্থক মনে হয়। তার মনে হয়, নির্বস্তুগত অর্থাৎ অলৌকিক কোনো শক্তির কাছে নিজেকে সমর্পণেই চিত্তের অশান্তি দূর হবে, মনে আসবে স্বর্গীয় প্রশান্তির প্রলেপ। তখন তার এই ভাবজগতের পরিবর্তন-পরিক্রমার পথে সংসারে যারা সঙ্গী হতে চায় না, তাদের সে আর আপন ভাবতে পারে না। এমনকি কখনো কখনো মানুষ ভাবতেও তার মন সায় দিতে চায় না। নামাজে দাঁড়িয়ে স্রষ্টার প্রতি মস্তক অবনত করার ভেতর দিয়ে আতিক সাহেব তার নতুন জীবনের আরম্ভে পা রাখলো।
‘নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের সংকট’, ‘অসম বয়সীদের মধ্যে প্রেমহীন যৌনসম্পর্ক’ ও ‘আধ্যাত্মচেতনা ও মানবতার জয়গান’; এই তিন বৈশিষ্ট্যের বাইরে অপ্রধান কিছু অনুষঙ্গ রয়েছে সিরাজুল মুনিরের গল্পে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: জীবন-সংগ্রাম-মানসিক সংঘর্ষ, পিতৃস্নেহ, মায়ের মমতা, স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসা, মুক্তিযুদ্ধ, দেশপ্রেম, মানবজীবনের সুখ-দুঃখ, দম্ভ, অহমিকা, ঔদার্য, দাম্পত্যসম্পর্কে ফাটল, রীতিবহির্ভূত প্রেম, সামাজিক অবক্ষয় ইত্যাদি। এই ধারার গল্পগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: ‘ভালোবাসার ফুল’, ‘নবজাতক ও উজান ভাটির মানুষেরা’, ‘পাথরের চোখ’, ‘দুঃখভরা রেল গাড়ি’, ‘নিশুতির চাঁদ’, ‘জীবন ধারা’, ‘ডাহুক’ প্রভৃতি।
সার্থক ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন, ‘সে একাঘ্নী বাণ। স্থির লক্ষ্যে বিদ্যুৎগতিতে, একটি ভাবপরিণামকে মর্মঘাতীরূপে বিদ্ধ করতে পারলেই তার কর্তব্য শেষ—তার গঠনের ইতরবিশেষে খুব বেশি কিছু আসে যায় না।’২৩ অর্থাৎ গল্পকে একরৈখিক হতে হবে। দক্ষ তীরন্দাজ যেমন অনেকানেক বস্তু ও প্রাণীর মধ্যেও সুনির্দিষ্ট একটি পাখি বা পশুকে বিদ্যুৎগতিতে তীক্ষ্ন বাণে বিদ্ধ করে, তেমনি ছোটগল্পের লেখককে অসংখ্য ঘটনাপুঞ্জের ভেতর থেকে একটি বিশেষ ঘটনাকে নির্বাচন করতে হয়। আর সেই ঘটনাকেই পাঠকের হৃদয়গ্রাহী করে তোলার জন্য যাবতীয় আয়োজন সম্পন্ন করতে হয়। এখানে প্রসঙ্গক্রমে বলে নেওয়া ভালো, ‘মহাভারত’ মহাকাব্যে কৃষ্ণদ্বৈপায়ণ দেখিয়েছেন, গুরু দ্রোণাচার্য তার শিষ্যদের শিক্ষা সম্পন্ন হয়েছে কি না, তা দেখতে পরীক্ষার আয়োজন করেছেন। সেই পরীক্ষার উপকরণ ছিল একটি বৃক্ষের ওপর একটি কাঠের পাখি। গুরু দ্রোণের শর্ত ছিল তীরন্দাজকে এমনভাবে শর নিক্ষেপ করতে হবে, যেন শরটি ওই পাখির একচোখের ভেতর দিয়ে ঢুকে অন্য চোখ দিয়ে বের হয়ে যায়। কিন্তু পাখিটা গাছ থেকে পড়বে না কিংবা গাছের কোনো পাতা বা পাখির কোনো ক্ষতি হবে না। ওই পরীক্ষায় একমাত্র সফল হয়েছিল তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন। ছোটগল্প লেখককে মূলত ওই অর্জুনের মতো লক্ষ্যভেদী হতে হবে।
সিরাজুল ইসলাম মুনিরের সাতটি গল্পগ্রন্থে মোট ৭৫টি গল্প রয়েছে। সবগল্পই যে অর্জুনের মতো তীক্ষè বাণে লক্ষ্যভেদে সক্ষম হয়েছে, তা নয়। তবে, ‘তবুও জীবন’, ‘ফেরিঘাট’, ‘লোকটি’, ‘ইলশার চরে লাশ’ ও ‘ঈশ্বরের পুনর্জন্ম’ গল্পে ঘটনাপ্রবাহ, চরিত্র নির্মাণ ও সংলাপের ক্ষেত্রে লেখক অসফল হয়েছেন, এমনটা বলা যাবে না। সামগ্রিক বিবেচনায় সিরাজুল ইসলাম মুনির, জীবনের গল্প বুনেছেন, তিনি সংসারের যে-দিকটিকে আলোকিত করতে চেয়েছেন, সেদিকের প্রতি সুতীক্ষè দৃষ্টিপাত করেছেন। এখানেই তিনি কথাকারের পাশাপাশি একজন জীবনশিল্পীও।
তথ্যসূত্র
১। বীরেন্দ্র দত্ত, বাংলা ছোটগল্প: প্রসঙ্গ ও প্রকরণ, পুস্তক বিপণি, কলকাতা, ২০১৯, পৃ. ৬
২। তদেব, পৃ. ৭
৩। সিরাজুল ইসলাম মুনির, গল্পসমগ্র, উৎস প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৭, পৃ. ২৫
৪। তদেব, পৃ. ২৯
৫। তদেব, পৃ. ৩৩
৬। তদেব, পৃ. ২৪২
৭। তদেব, পৃ. ৩৯১
৮। তদেব, পৃ. ৩৯৯
৯। তদেব, পৃ. ৩৯৯
১০। তদেব, পৃ. ৩৯৯
১১। তদেব, পৃ. ৫৪৮
১২। তদেব, পৃ. ৫৪৯
১৩। তদেব, পৃ. ৭
১৪। তদেব, পৃ. ৭৮
১৫। তদেব, পৃ. ৭৭
১৬। তদেব, পৃ. ১৫
১৭। তদেব, পৃ. ১৭
১৮। তদেব, পৃ. ২১
১৯। তদেব, পৃ. ২৩
২০। তদেব, পৃ. ৮৩
২১। তদেব, পৃ. ৭২
২২। তদেব, পৃ. ৭৩
২৩। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, সাহিত্যে ছোটগল্প ও বাংলা গল্প-বিচিত্রা, কবি, ঢাকা, ২০১৮, পৃ. ২৩০