সাহিত্যে যৌনতার বিষয়টি অনেক পুরনো কিন্তু বিষয়টি প্রশ্নজনক। তাই বার বার এটি নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়ে আলোচনায় আসে। একটি সরল পদ্ধতিতে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা যায়। কী সেটা? এই প্রশ্নের উত্তরে বলব, যৌনতা। মানুষের জীবনে যৌনতা থাকলে সাহিত্যে কেন থাকবে না? সাহিত্যেও থাকবে। তখনই দ্বিতীয় প্রশ্ন আসে, কেন? সাহিত্য জীবনের পুনর্বিন্যাস। অনেকে মনে করেন সাহিত্য সমাজের দর্পণ। সমাজের বললে কিন্তু প্রসঙ্গটি অন্য দিকে চলে যায়। কারণ, সমাজে যৌনতার অবস্থান আছে, তবে তা প্রকাশ্যে নিষিদ্ধ, সাহিত্যেও কি প্রকাশ্যে আনা যাবে না? শুধু ইশারা-ইঙ্গিতে, চিত্রকল্প আর রূপক-উপমায় সীমাবদ্ধ থাকবে? সাহিত্যকে এভাবে সামাজিক করে না তুলে ব্যক্তিগতভাবে দেখলে ব্যক্তির প্রতিচিত্র হিসেবে গ্রহণ করতে আপত্তি কারও থাকার কথা না।
এর পরেই আসে, কিভাবে? এখানেই নানা মত, নানা পথ। এই প্রসঙ্গটি নিয়ে অনেক আলোচনা করা যায়। বিষয়টি দীর্ঘ আলোচ্যও বটে। শেষ হবে না, শেষ পর্যন্ত শেষকথা না বলাই থেকে যাবে।
শিল্প বা সাহিত্যে যৌনতা, নগ্নতা এবং অশ্লীলতা বিষয়গতভাবে পৃথক হলেও আলোচনার দিক থেকে কাছাকাছি। প্রাচীনকাল থেকেই সাহিত্যে নগ্নতা এবং যৌনতা ছিল। তবে বিতর্কও ছিল। যৌনতা ধর্মে, সমাজে ও রাজ্যে রাজাজ্ঞা বা নিষেধাজ্ঞায় ছিল, আধুনিক রাষ্ট্রীয় আইনেও আছে বিধান হিসেবে। সেখানে যৌনতার সীমারেখা এঁকে দেওয়া হয়। বিজ্ঞান, অর্থনীতি, ইতিহাস সবখানেই যৌনতা ছিল ও আছে। আমাদের প্রসঙ্গ শিল্প-সাহিত্যের যৌনতা।
যৌনতা প্রকাশের একটি দিক নগ্নতা। মানুষ জন্মগতভাবে নগ্ন। বয়াতি গানে বলা হয়, মানুষ জন্ম-মৃত্যুতে, বাসরে-হাশরে নগ্ন। এই নগ্নতা যৌনতার কারণজনিত। যৌনতার ভেতর দিয়ে মানুষের জন্ম, যৌনতার কারণে মানুষের মৃত্যুও হয়। উল্টা করে বললে, যৌনতা মানুষের মৃত্যুর কারণও হয়ে থাকে। আর সারাজীবনে যৌনতার ব্যাপক প্রভাব তো আছেই। ফ্রয়েড, ইয়্ঙু, পাভলভ প্রমুখের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ছাড়াও বাংলাদেশের সামাজিক বক্তব্য দিয়েও ব্যাখ্যা করা যায়।
পিতা-মাতার যৌনতার ফসল মানবসন্তান। সন্তান বড় হলে সে নিজের দেহে ও মনে যৌনতা অনুভব করে। বিষয়টি তাকে প্রবলভাবে তাড়িত করে। এই তাড়না থেকে মুক্তির উপায় সমাজবিধি মতে বিয়ে করে দাম্পত্যজীবনে যৌন সুখ ভোগ করা। কিন্তু বিষয়টি নিঃশর্ত নয়। বিয়ে করতে হলে তাকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে হয়। বিশেষ করে পুরুষদের কথা বললে, তাকে উপার্জনক্ষম হতে হবে। তার যৌন সঙ্গিনীকে চিরজীবনের জন্য স্থায়ীভাবে গ্রহণ করতে হয়, তার ভরণ-পোষণ, অন্য-বস্ত্র-বাসস্থান-চিকিৎসা-বিনোদন এবং নিরাপত্তার দায়-দায়িত্ব নিতে হয়। এজন্য তাকে কর্মক্ষম হতে হয়। চাকরি, ব্যবসা অথবা অন্য কোনো বৃত্তিগতভাবে উপার্জন করতে শিখতে হয়। কর্মক্ষম হতে হলে তাকে সমাজে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার ভেতর দিয়ে নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করতে হয়। সামাজিকতা শিখতে হয়। যে বয়সে একজন মানুষ যৌনতা অনুভব করে, সে বয়সেই বিয়ে করা এবং সন্তান উৎপাদনের দায়িত্বপ্রাপ্ত হয় না। সমাজ তাকে দায়িত্ব দেয় না। এজন্য তাকে সমাজের নানা প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে হয়। সমাজে সামাজিকভাবে চলার উপযোগী হওয়া, ছেলেমানুষী পরিহার করে বয়সোচিত বুদ্ধির অধিকারী হওয়া ইত্যাদি। বয়স, উপার্জন, বুদ্ধি, বিবেক এবং অন্যান্য যোগ্যতা অর্জন করার পরেই তাকে যৌনতার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। এই হল আমাদের সামাজিক রীতি।
এতে দেখা গেল যৌনতার জীবনব্যাপী প্রভাব আছে। আর পশ্চিমের কিংবা প্রাচ্যের বৌদ্ধ সহজিয়া, নাথধর্ম, যোগশাস্ত্র, তান্ত্রিক ধর্ম, বাউল, মুসলিম সমাজের সুফিবাদসহ নানা মতবাদ আছে যেখানে যৌনতার বিশেষ রীতিনীতি আছে। এগুলোতেও দেখা যায় যৌনতার বিশেষ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ আছে। এখান থেকে বোঝা যায়, যৌনতা মানুষের জীবনের অনিবার্য অংশ। কাজেই শিল্প-সাহিত্যেও তা আসতে পারে, প্রয়োজনে আসতেই হবে। না হলে সাহিত্য মানুষের কথা প্রকাশ করবে না, শুধুই বাহ্যিক এবং নিরেট সৌন্দর্যই প্রকাশ করবে।
প্রাচীন সাহিত্যে নগ্ন বর্ণনা এবং যৌনতা ছিল। সংস্কৃত, লাতিন, গ্রিক, ফারসি, জার্মান এমনকী আরবি সাহিত্যেও যৌনতা এবং নগ্নতা ছিল। আরব্যরজনীর গল্পগুলোতে সবাধ এবং অবাধ সব রকমের যৌনতাই আছে। সংস্কৃত সাহিত্যের জনপ্রিয় কবি জয়দেব দাসের ‘গীতগোবিন্দম’ অবলম্বনে লেখা বড়– চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে’ও যৌনতা আছে, নগ্নভাবেই আছে। এতটাই নগ্নভাবে যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্যের ছাত্রদের কয়েকটি অধ্যায় পড়ানো হয় না। যেখানে বৃন্দাবনে রাধার সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণ মিলিত হয়, জোর করে তার কাঁচুলি ছিঁড়ে ফেলে। এর চেয়ে গাঢ় বর্ণনা আছে রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যানের মুসলমান লেখক দোনা গাজীর লেখা ‘ছয়ফুল মুলুক বদিউজ্জামাল’ কাহিনীকাব্যে। সেখানে সুড়ঙ্গের ভেতরে গোপন মিলনের ভাষা ও বর্ণনা এ যুগের পর্নোগ্রাফি ও চটি সাহিত্যকেও ছাড়িয়ে যায়।
আবার ভিন্ন রকমের লেখক দৌলত কাজী। তিনিও রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যানের লেখক। তাকে মধ্যযুগের সবচেয়ে সাহসী লেখক বলা হয়। এই সাহস কিসের? সাহিত্য, সমকালীন সমাজ ও রাজনীতি না বুঝে অনেকেই মনে করেন রক্ষণশীল সমাজে প্রেমের ও যৌনতার কথা লিখে তিনি ‘সাহসী’ উপাধি পেয়েছেন। বিষয়টি আসলে তা না। সে যুগটি এ যুগের মতো ছিল না। যদি তাই হতো তাহলে দোনা গাজীই সবচেয়ে সাহসী বলে বিখ্যাত হতেন। ব্যাপারটি ছিল আসলে বিপরীত। মুদ্রণপূর্ব এবং বইয়ের আগের সে যুগের পাঠক ছিল কারা? এই প্রশ্ন থেকেই দৌলত কাজীর বিষয়টি অনুভব করা যায়। আলাওল এবং তার আগের দৌলত কাজী দু’জনেই ছিলেন দরবারি লেখক। দরবারি লেখকদের পাঠক-শ্রোতা ছিলেন রাজা-বাদশা, আমির-ওমরা ও রাজপারিষদের অমাত্যবর্গ। আরাকানের রোসাঙ্গের রাজসভার কবি দৌলত কাজী ছিলেন দরবারের সকলের বিপরীত রুচির। সে সময় রাজাদের রুচি ছিল অবাধ যৌনতার। বহুবিবাহ, পরস্ত্রী-পরকীয়া, পতিতা-দাসী-বাঁদীগমন ছিল নিত্য অভ্যাস। দৌলত কাজী রাজাদের রুচির বিপরীতে এক স্ত্রী এবং সংযত যৌনসংযমের কথা বলেছেন। রাজাদের রুচিকে বরং তিনি সমালোচনা, নিন্দা ও কটাক্ষ করে তাদেরকে লেখকের ধারণামতে নীতিগত সুপথে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। এ কাজটি ছিল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। রাজাদের মনোরঞ্জনের জন্য না লিখে তিনি নীতিবাদী পথে রাজাদের টেনে আনার চেষ্টা করেছেন।
নাথসাহিত্যের লেখকদেরও দেখা যায় অবাধ যৌনতার বিরোধী। যৌনসর্বস্ব জীবন থেকে সরে এসে কর্মময় জগৎ-সমাজ-রাজনীতি এবং উৎপাদনশীল অর্থনীতি গঠনের নেপথ্য নির্দেশক এ ধারার সাহিত্য। আর এদিক বিচার করেই মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে চরিত্রবান নায়ক বলা হয় গোরক্ষনাথকে।
অবাধ যৌনতার পক্ষে হোক বা সবাধ যৌনতার পক্ষে হোক সাহিত্য যৌনতামুক্ত ছিল না। চর্যাপদেও দেখা যায়, যে নারী দিনের বেলা কাকের ডাকে চমকে ওঠে সে নারী রাতের অন্ধকারে সাপ-বাঘের ভয় এড়িয়ে পরপুরুষের সঙ্গে মিলিত হতে যায়। তার প্রবল যৌনতাড়না ভয় দূর করে এগিয়ে চলে। চর্যাপদে এই বর্ণনা যদিও শুধু সমাজচিত্র হিসাবে উঠে আসে নাই। সহজিয়াপন্থীদের নীতিবাদী উপস্থাপনও এটি।
তবে চর্যাপদের আগেই সাহিত্যে যৌনতার বিষয়টি শুধু জীবনবাস্তবতা হিসাবে নয়, আনন্দের বিষয় বলে গৃহীত হয়ে আছে। প্রাচীন সংস্কৃত আলঙ্কারিকেরা শিল্প-সাহিত্যে যৌনতার বিষয়টিকে শৃঙ্গার রস বলে চিহ্নিত করে রেখেছেন। রসতত্ত্ব নিয়ে অনেক আলোচনা করা যায়। এখানে সে আলোচনা করব না।
বাংলা সাহিত্যে প্রাচীন যুগের চর্যাপদ, মধ্যযুগের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, দোনা গাজী, দৌলত কাজী, আলাওলের কথা এসেছে। আধুনিক যুগেও সাহিত্যে যৌনতা আছে, বিতর্কও আছে। সৈয়দ শামসুল হকের এক উপন্যাসের নায়কের মুখে শোনা যায়, ক্লাস এইটে পড়ার সময় মাইকেল মধুসূদনের ‘বীরাঙ্গনা কাব্যে’র বীরাঙ্গনার শারীরিক বর্ণনা শুনে শিশ্ন ফুলে উঠেছিল। সেই দিন থেকে সে আত্মরতি করতে শেখে। এখানে প্রশ্ন না উঠে পারে না, মাইকেলের খটমটে ভাষার বর্ণনা সে নায়কের নেভি ব্লু রঙের ইংলিশ প্যান্টের ভেতরের শিশ্নও বুঝতে পেরেছে, ব্যাপারটি বিশ্বাসযোগ্য কি না। বিষয়টি আসলে সে বয়সের কল্পনাশক্তির সঙ্গেও জড়িত।
বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কৃষ্ণকান্তের উইলে’র হীরা মালিনীর সঙ্গে গোবিন্দলালের সম্পর্কও পাঠকের শরীর গরম করে তোলে। কিশোর রবীন্দ্রনাথের কাঁচাহাতে লেখা কবিতায় ‘তব কুচযুগ নিঙারি নিঙারি’ পড়লেও সমস্ত ইন্দ্রিয় একযোগে হইহই রইরই করে ওঠে। ‘বৌঠাকুরানীর হাটে’র নারী অঙ্গের প্রকাশের বর্ণনা, ‘চোখের বালি’র মহেন্দ্র—বিনোদিনীর সম্পর্ক উত্তেজনা জাগায়। ‘ঘরে-বাইরে’র সন্দীপের সাথে বিমলার সম্পর্ক কিংবা ‘চার অধ্যায়ে’র এলার মধ্যে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ যৌনতা প্রকাশ করেছেন। ‘ল্যাবরেটরি’ গল্পে সোহিনীর মেয়ের মধ্যে উদগ্র কামনাও প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু তুলনামূলক আলোচনা করলেই দেখা যায় নগ্নতা মানেই অশ্লীলতা নয়। ‘চোখের বালি’তে মহেন্দ্র-আশার বিয়ের পরের জীবন নিয়ে রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘দিনগুলিকে রাত আর রাতগুলিকে দিনের মতো লাগিল’ ধরনের বাক্যে স্পষ্ট যৌনতার কথা থাকলেও বিনোদিনীর সঙ্গে মহেন্দ্রের সম্পর্কের ভাষাহীন, সম্পর্কহীন বর্ণনা আরও বেশি যৌনতার ইঙ্গিত দেয় পাঠককে। ইন্দ্রিয় সজাগ করে তোলে।
সাহিত্যে যৌনতা কিভাবে আসবে?
শিল্প-সাহিত্যে যৌনতা নিয়ে পশ্চিমে অনেক মামলা মোকাদ্দমা হয়েছে। অনেক বই নিষিদ্ধ হয়েছে। ডিএইচ লরেন্সের ‘লেডি চ্যাটার্লিজ লাভারে’র নায়িকা কোনির যৌন অতৃপ্তি নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। ভ্লাদিমির নবোকভের ‘লোলিতা’ নিয়েও হয়েছে। লরেন্সের মামলা নিয়ে বাংলাদেশের আইনগ্রন্থ লেখক গাজী শামসুর রহমানও কৌতূহলজনক বই লিখেছেন। তবে ‘লেডি চ্যাটার্লিজ লাভারে’র বিষয়বস্তুর মতো প্রায় একই বিষয় নিয়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন ‘কুষ্ঠরোগীর বৌ’। সাহিত্যের এই পর্ব আসলে ফ্রয়েডীয় পর্ব।
আমাদের হাতে একটা প্রশ্ন ছিল, ‘কিভাবে’। সাহিত্যে যৌনতা কিভাবে আসবে? মাঝখানে অনেক কথা বলে নেওয়ায় এখন প্রশ্নটি পুনরায় তুলে আনার এখনই মোক্ষম সময়।
এর মধ্যে আমরা দেখতে পেয়েছি প্রাচীন এবং মধ্যযুগের লেখকেরা সাহিত্যে যৌনতা আনার সময় পাঠকের দিকটি মাথায় রেখেছেন। টার্গেট অডিয়েন্স ঠিক করে নিলে প্রশ্নটির উত্তর সহজ হয়। আপনি কি শিশুসাহিত্যে যৌনতার নগ্ন প্রকাশ করতে চান? অন্য কেউ লিখলে আপনি কি আপনার সন্তানকে তা পড়তে দিবেন? কবিতায় কি চান দোনা গাজীর মতো, মাইকেলের মতো রিয়ালিস্টিক বর্ণনা দিবেন, নাকি রবীন্দ্রনাথের মতো উঠতি তরুণের ‘তব কুচযুগ নিঙারি নিঙারি’ ভাষায় মনের কল্পনা ব্যক্ত করতে চান? না কি আধুনিক কবি বিষ্ণু দে’র মতো ‘ঘোড়সওয়ার’ লিখতে চান? ছড়া সাহিত্যে কতোটা যৌনতা আনবেন? সরাসরি ভাষার মধ্য দিয়ে না কি অলঙ্কারের মাধ্যমে? নাটকে যৌনতার শয্যাদৃশ্য রাখবেন? মঞ্চায়িত করা হবে কিভাবে? অভিনেতা-অভিনেত্রী কি নগ্নভাবেই মঞ্চে শয্যাদৃশ্যে অভিনয় করবেন? গানের ভাষায় কেমন হতে পারে যৌনতার ভাষা? রবীন্দ্রনাথের মতো গাইবেন, ‘নিত্য তোমার যে ফুল ফোটে ফুলবনে, তারি মধু কেন মন মন মধুপে খাওয়াও না”, ‘কেন যামিনী না যেতে জাগালে না, বেলা হল মরি লাজে।’ অতুলপ্রসাদের মতো, ‘আমারও বড় সাধ, বাদলের রাত, কাটাইব সখিরে সাথে, নিঁদ নাহি আঁখিপাতে।’ নজরুলের মতো সুরে গাইবেন, ‘খেলিবে সেই পুরাতন খেলা’?
চিরকালের পাঠক, সমকালের পাঠক, শিশুপাঠক, উচ্চশিক্ষিত পাঠক, মাঝারি মানের পাঠক, রেলস্টেশনের, বাস কিংবা লঞ্চ টার্মিনালের বুক স্টলের অতি সাধারণ পাঠক, পারিবারিক পাঠক, রাজনৈতিক পাঠক, বিপ্লবী পাঠক, ধার্মিক পাঠক, বিদেশি পাঠক—এমন পাঠক নানা ধরনের আছে। সাহিত্যে যৌনতা কিভাবে আনব, তা এই পাঠকশ্রেণীর ওপর নির্ভর করে। যে পাঠকসমাজে ‘ঘাই হরিণী’র ডাকে একজন জীবনানন্দ দাশের কলেজ শিক্ষকতার চাকরি চলে যায়, আর আরেকজন কলেজ শিক্ষক বিষ্ণু দে’ ‘ঘোড়সওয়ার’ লিখে প্রশংসিত হন—এই দুই পাঠকশ্রেণি কিন্তু এক ছিল না। কলকাতার সব পাঠকের মান ও রুচি তখন এক ছিল না।
একজন ‘খেলারাম খেলে যা’ লিখে সমাজের লম্পটের চরিত্র আঁকতেই পারেন। কিন্তু সেই তিনিই যখন মামলা করে আরেক লেখকের বই নিষিদ্ধ করান তখন বুঝতে হয়, পাঠক শুধু শ্রেণীগতভাবেই ভিন্ন নয়, নীতিগতভাবেও ভিন্ন।
বাংলা সাহিত্যে কল্লোল যুগ নতুন বার্তা নিয়ে আসে। যুগস্রষ্টা এই ‘কল্লোল’ পত্রিকা আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যকে নতুন জীবন দান করে। পশ্চিমে এর মধ্যে ফ্রয়েডের মনোসমীক্ষণ তত্ত্ব, অবচেতন তত্ত্ব ইত্যাদি ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে। আসলে ফ্রয়েডপূর্ব সাহিত্যের যৌনতা ছিল রুচির বিষয়। কিন্তু ফ্রয়েড পরবর্তী সাহিত্যে তা নতুন ব্যঞ্জনা লাভ করে। এখনকার সাহিত্যের যৌনতা ব্যক্তিত্ব ও চরিত্রের বিষয় ফ্রয়েড ছাড়াও আমাদের সমাজজীবনে যৌনচিন্তা দিয়ে মানুষ মাপার প্রবণতা প্রচলিত ছিল। কোনো পুরুষ মানুষ যদি শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ থাকেন, সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও বিবাহ না করেন, তার কথা ও কাজে যদি যৌন ইঙ্গিত দেখা যায়, অবশ্যই তাকে লোকে এড়িয়ে চলবে। কেউই নিজের স্ত্রী, মা, বোন কিংবা কন্যাকে তার সঙ্গে মিশতে দিতে চাইবেন না। যদিও লোকটার চরিত্রে কোনো অশালীনতা প্রকাশ নাও পায়, তার ব্যক্তিত্ব নিয়ে মনে মনে প্রশ্ন না জেগে পারে না। এতে বোঝা যায়, যৌনতা মানুষের চরিত্র নির্ধারণ করে। এদেশে চিরকাল যোগী, ভিক্ষু, তীর্থঙ্কর, সন্ন্যাসী, সুফি, সাধক জনগণের ঘরে গিয়ে আদরে কদরে সাদরে সমাদরে আহার ও বিশ্রাম করার সুযোগ পেয়েছেন। কিন্তু এখানে মানুষের সম্পর্কের একটা গোপন ব্যাকরণ ছিল। এই সিদ্ধ পুরুষদের খাদ্যতালিকায় কোনো যৌন উত্তেজক খাবার ছিল না। নারীসঙ্গবিরোধী এই পুরুষেরা যদি গরম মশলাযুক্ত মাছ-মাংস ইত্যাদি উত্তেজক খাবার খেতেন, তাহলে জনগণ তাদের সে আদর সমাদর করত না। যারা খেতো, সমাজ তাদের ভালো চোখে দেখত না। চরিত্র নিয়ে সন্দিগ্ধ থাকতো।
কল্লোল যুগে বাংলা কথাসাহিত্যে যৌনতার ব্যাপক প্রয়োগ দেখা যায়। কেউ বুঝে, কেউ না বুঝে, স্রেফ নতুনত্বের নামে এই নতুন ধারায় এগিয়ে যান। এসময় সাহিত্যে যৌনতা, অশ্লীলতা ইত্যাদি নিয়ে রবীন্দ্রনাথ, প্রমথ চৌধুরী, কাজী নজরুল ইসলাম, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব বসু প্রমুখ নানা তর্কে-বিতর্কে জড়িয়ে যান। বুদ্ধদেব বসুর প্রথম উপন্যাস ‘সাড়া’ পড়ে এক নারী লেখক বলেছিলেন, ‘এই সাহিত্যকে আঁতুরঘরে নুন খাইয়ে হত্যা করা উচিত।’ কারণ সেখানে তিনি ফ্রয়েডীয় যৌনমনস্তত্ত্ব সূত্র ব্যবহার করেছিলেন। তিনি ফ্রয়েডের সূত্র মেনে চলতেন।
কয়েক দশক পরে এই বুদ্ধদেব বসুই ‘রাত ভ’রে বৃষ্টি’ উপন্যাসের জন্য আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে বাধ্য হলেন। উপন্যাসটি নিষিদ্ধ হলে মামলা চলে কয়েক বছর। পরে অবশ্য মামলায় বুদ্ধদেব বসু জিতেছেন। কাছাকাছি সময় সমরেশ বসুর ‘প্রজাপতি’ উপন্যাসও নিষিদ্ধ ও মামলা হয়। এই মামলায়ও সাহিত্যের জয় হয়। প্রায় একই সময় সত্যজিৎ রায় লেখেন ছোটগল্প ‘পিকুর ডায়েরি’। এ গল্পটি অনেকটাই ‘রাত ভ’রে বৃষ্টি’ উপন্যাসের মতো। পরে এ গল্প নিয়ে সত্যজিৎ রায় বিখ্যাত সিনেমা ‘পিকু’ নির্মাণ করেন। সত্যজিৎকে বুদ্ধদেবের মতো ঝামেলায় পড়তে হয়েছে বলে জানি না।
পাকিস্তান আমলে ঢাকায়ও সাহিত্যে অশ্লীলতা, যৌনতা ইত্যাদি অভিযোগ অভিযুক্ত হয় কয়েকটি উপন্যাস ও ছোট গল্প এবং গল্পগ্রন্থ। শামসুদদীন আবুল কালামের ‘কাশবনের কন্যা’, মাহবুব উল আলমের ‘মফিজন’, আবদুল মান্নান সৈয়দের ‘সত্যের মতো বদমাশ’ ইত্যাদি। আবদুর মান্নান সৈয়দের গল্পগ্রন্থটি সরকারিভাবে নিষিদ্ধ হয়েছিল। যৌনতা, নগ্নতা এবং অশ্লীলতার অভিযোগে অভিযুক্ত সাহিত্যের উদাহরণ ও দৃষ্টান্ত দিয়ে লেখা বড় করা যায়। কিন্তু আামদের প্রশ্নটির উত্তর কিন্তু এখনো পাই নাই।
আমি মনে করি লেখককে আগেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে তিনি কোন পাঠকদের জন্য লিখছেন। সে উপযোগী করে সাহিত্যে যৌনতার প্রকাশ করতে পারেন। সাধারণ পাঠকের জন্য লিখলে পর্নোগ্রাফির মতো বর্ণনা না দিলেও চলে। উচ্চমানের পাঠকের জন্য যৌনতা নানাভাবেই আসতে পারে। সরাসরি, আকারে ইঙ্গিতে বা অলঙ্কারে। দক্ষ লেখক যৌন মিলনের ভেতরকার সূক্ষ্ম বিষয়গুলোও পাঠকের কাছে লেখক গুরুত্বের সাথে তুলে ধরতে পারেন। যৌনসঙ্গী, যৌনভঙ্গি দিয়েও শ্রেণীসংগ্রাম, শাসন-শোষণ, নিপীড়নের সমাজচিত্র তুলে ধরা যায়।
ইতিহাসের একটি ঘটনা বলি, দিল্লির সম্রাট মুহাম্মদ বিন তুঘলকের তুঘলকি কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সবাই অবগত। কিন্তু তিনি যে দক্ষ, কঠোর ও নিষ্ঠুর শাসক ছিলেন এটাও মনে রাখতে হবে। প্রতিদিন তিনি মৃত্যুদ- কার্যকর দেখে নাশতা খেতে বসতেন। ত্রয়োদশ শতকের জন্য একজন শত্রুবেষ্টিত শাসকের যেমন হওয়া স্বাভাবিক ছিল তিনি তেমনই ছিলেন। একবার তার সা¤্রাজ্যের কোনো দূরের এক গ্রামের একজন পুরুষ তার স্ত্রীর সাথে ইচ্ছার বিরুদ্ধে সহবাস করেছিলেন। এটা তো সে যুগে বটে, এ যুগেরও স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু সঙ্গমরত অবস্থায় স্ত্রী বার বার দিল্লির সুলতানের দোহাই দিচ্ছিলেন। স্বামী সে কথা রাখেন নাই, পরোয়াও করেন নাই। অনেক দিন পরে কথাটি ঘুরতে ঘুরতে সম্রাটের কানে এলে সম্রাট সেই স্বামীকে গ্রেপ্তার করে দিল্লি আনান। রাজদ্রোহের অপরাধে তাকে সম্রাট মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন। বিষয়টি কিন্তু সাধারণ নয়। যত গোপনে হোক রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা, তাকে অশ্রদ্ধা করা, অমান্য করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য ছিল। না হলে একদিন সে লোক প্রকাশ্যে বিদ্রোহ করার সাহস পাবেন।
গল্পে-উপন্যাসে, নাটকে-সিনেমায় এদৃশ্যটি আনা যায়। সেখানে যৌনসঙ্গমের ভেতর দিয়ে রাজনীতি এবং রাজদ্রোহের বিষয়টি তুলে আনা যায়। কারণ বিষয়টি আসলে এমনই। এই যৌনদৃশ্য কি অশ্লীল?
তবে লেখকের পায়ের অবস্থান এবং মাথার মালিকানাও সাহিত্যে যৌনতার বিষয়টি বিচিত্র করে তোলে। লেখক নিজে কোনো চরিত্রের প্রতি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লে সে চরিত্রের যৌনতা তিনি প্রকাশ করেন না। বরং যৌনতা থেকে সরিয়ে রেখে তাকে শ্রদ্ধেয় করে তোলেন। যেমন, সৈয়দ শামসুল হক ‘খেলারাম খেলে যা’ উপন্যাসের বাবর আলীর অবাধ যৌনতা দেখিয়েছেন। এমন অনেক উপন্যাসে তিনি লেখক হিসাবে বাস্তবতার খাতিরে তা করেছেন। কিন্তু ‘নূরলদীনের সারাজীবন’ নাটকে কেন নূরলদীনের যৌনতা দেখালেন না? কারণ কি নূরলদীন রংপুরের নবাব ছিলেন বলে? লেখক তার সমশ্রেণির বা নিম্ন শ্রেণীর অনেক চরিত্রের যৌনতা প্রকাশ করলেও নবাব নূরুদ্দীনের যৌনতা প্রকাশ না করে তাকে বাস্তবতার ঊর্ধ্বে তুলে, শ্রদ্ধার আসনে বসিয়ে আবেগের ভাবমূর্তি রচনা করেছেন। এটি সৈয়দ শামসুল হকের কোনো নেতিবাচক দিক নয়। আগের একটি প্রশ্নের উত্তরমাত্র।
গল্প-উপন্যাসে যেভাবে যা লেখা যায়, নাটকে তা লেখা যায় না। নাটকের দর্শকশ্রেণি আর গল্প-উপন্যাসের পাঠকশ্রেণির পার্থক্যের কথা সৈয়দ শামসুল হক অবগত ছিলেন। এমনই আমাদের আবেগের জায়গাগুলো আমরা নিষ্কলঙ্ক রাখার চেষ্টা করি। গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুভাষ বসু, ফজলুল হক, ভাসানী প্রমুখ শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিকে নিয়ে গল্প-উপন্যাস-নাটক সিনেমা যাই সৃষ্টি করা হোক, আমরা সেখানে তাদের যৌনদৃশ্য দেখতে চাই না। এটি জাতিগতভাবে আমাদের মতো পাঠকের রুচি। লেখকেরা সে পাঠকরুচির প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই সাহিত্য রচনা করেন। এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে যৌনতা কি কোনো কলঙ্ক? লেখকের মতে তা হয়তো নয়, কিন্তু টার্গেট অডিয়েন্স পাঠক তা মনে করতে পারেন।
পশ্চিমে কিন্তু অনেক কিছুই সম্ভব। সেখানে সিনেমায় উইলিয়াম শেক্সপিয়র ও ক্রিস্টোফার মার্লোর যৌনদৃশ্যও দেখানো হয়। তবে কি আমাদের এখানে চিরকালই ভাবমূর্তি অজর, অমর, অক্ষয় ও অবিচলই থাকবে? নিষেধাজ্ঞার দেয়াল কি চিরকাল শক্তই থেকে যাবে? এ প্রশ্নের উত্তরে সাধারণভাবেই বলা যায়, দেয়াল ভাঙার প্রয়োজন হলেই ভাঙা যাবে। এখন কি রবীন্দ্রনাথের যৌনতার দৃশ্য প্রকাশ করা খুব প্রয়োজন?
বাস্তববাদিতা, নিরপেক্ষতা ও বস্তুনিষ্ঠতার দাবিতে আমরা অনেক কিছুই বলি। সাহিত্যের বস্তুনিষ্ঠতার জন্য লেখকের অবাধ স্বাধীনতা প্রয়োজন বলে মনে করতে পারি। আসলে আমরা বাঙালি, নিজের জন্য চাই অবাধ স্বাধীনতা আর অন্যের জন্য চাই সীমারেখা। বস্তুনিষ্ঠতা আমরা এই সমাজে কতটুকু সহ্য করতে পারি? সাংবাদিক জগতের বহুল ব্যবহৃত এই শব্দটির ভার সবাই বহন করতে পারেন? এদেশে এমন কোনো সাংবাদিক কি আছেন যিনি নিজের মায়ের যৌন কেলেঙ্কারি নিয়ে রিপোর্ট করার সাহস রাখেন?
সামাজিক মূল্যবোধ বিষয়টা এমনই।