বাংলা সমলোচনাসাহিত্যের একটি বিষফোঁড়া—দশকিয়া বিশ্লেষণ। এটি যেমন সাহিত্যের জন্য ক্ষতিকর, তেমনি সৃষ্টিশীলতার অন্যান্য বিভাগের ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধক। মহাকালের হিসাবের খাতায় শতকই যেখানে গৌণ, দশক সেখানে অতি তুচ্ছবিষয় মাত্র। তবু দশকবিভাজন নিয়ে মেধাহীনদের আহ্লাদের শেষ নেই। দশকবিভাজনের একটি লক্ষণীয় দিক হলো—প্রতিনিধিত্বশীলতার দোহাই দিয়ে অকবি-অলেখকরাও দশকিয়া সংকলনে স্থান পেয়ে যায়। দশকভিত্তিক সমালোচনা গদ্যের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। সে কারণেই মূলত মেধাহীনরা দশকবিভাজনে তৎপর হয়ে ওঠে। না-দিলে তাদের অস্তিত্বই যে বিপন্ন হয়ে যায়। তাদের প্রগলভতাপূর্ণ অকবিতা, বানানো কাহিনীর ফুলঝুরি, ছিঁচকাঁদুনে ভাষায় লেখা ন্যাকাগদ্য পাঠকমনে সাময়িক ঝিলিক দেয় মাত্র। যা লেখা হয় শুধুই দশকবিচারের মাপকাঠিতে। সেখানে বৌদ্ধিক ও হৃদয়বৃত্তিক আকাঙ্ক্ষার উদ্বোধন থাকে না।
দশকবিভাজন নিয়ে অরুণ মিত্র বলেন—‘আমি দশক বিভাজনে একেবারেই বিশ্বাসী নই। সাহিত্যের গতি দশ বছর অন্তর পাল্টায় না। এমন কোনো নিয়ম নেই। কোনো বিশেষ সাহিত্যের ধারা হয়তো দশ বছর বা পঞ্চাশ বছর থাকতে পারে। তার পরে হয়তো পাল্টায়। দশক বিভাজন করলে একটা সুবিধা হয় এই যে, অনেক কবির নাম ঢুকিয়ে দেওয়া যায়।’ হয়তো একারণেই দশকবাদীদের ইঁদুরদৌড়ে সামিল হতে দেখা যায়। এ প্রসঙ্গে পূর্ণেন্দু পত্রীর উক্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ—‘দশবছর পরে পরে সত্যিই কি ন্যাড়া হয়ে যায় সাহিত্যের মাথা আর তাতে গজায় নতুন নতুন রঙের চুল?’ পূর্ণেন্দু পত্রীর এ অমোঘ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মতো প্রস্তুতি কিংবা যোগ্যতা দশকবাদীদের কোনওকালেও ছিল না। এখনও নেই। উত্তর দেওয়ার জন্য উত্তরদাতার থাকা চাই সাহিত্যের বিভিন্ন বাঁক ও আন্দোলনের মর্মার্থ উপলব্ধির বোধ। সে বোধ জন্মে জীবন ও শিল্পের বহু কৌণিক বিশ্লেষণলব্ধ প্রজ্ঞায়। আপন স্বভাবের অনুকুল-প্রতিকুল প্রতিবেশে শিল্পীকে সমান যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখতে হয়। নিজের ভেতরের দহনক্রিয়াকে শৈল্পিক সুষমায় রূপান্তরের ভেতর দিয়েই শিল্পীর দীক্ষা লাভ সম্পূর্ণ হতে পারে। ধার করা আলোর তীব্র ঝলক দেখে দৃষ্টি বিভ্রম হতে পারে, কিন্তু নিজের ভেতর কোনো উত্তাপ উপলব্ধি করা যায় না। নিজের ভেতর উত্তাপ সৃষ্টি না হলে নিজের আগুনে অন্যকে দূরের কথা, নিজেও পুড়ে পুড়ে খাঁটি হওয়া সম্ভব নয়। ধার করা আলোয় বড় জোর উপগ্রহ হওয়া সম্ভব, নক্ষত্র নয়। নক্ষত্রের চাই অন্তর্গত লাভার উদ্গীরণ। তবেই আপনবলয়ে প্রাণের উৎস হওয়া যায়। নক্ষত্রের উত্তপ্ত লাভা কিংবা তীব্র আলো কোনোটাকেই বৃত্তাবদ্ধ করা যায় না। প্রকৃত কবি, কথাশিল্পীও উপর্যুক্ত নক্ষত্রের জাতক। একারণেই প্রকৃত কবি ও কথাসাহিত্যিককে কোনো কালখণ্ডের ক্ষুদ্রসীমায় বন্দি করা সম্ভব হয় না। কল্পনার হঠাৎ ঝলকানিতে সাহিত্যের বাঁকবদল হয় না; তার জন্য দরকার বিশেষ বিশেষ প্রবণতার ক্রমাগত পরিমার্জন পক্রিয়া। প্রতিটি বাঁক বদলের পেছনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে অধ্যাবসায়ী নির্মাণ কৌশল এবং নিরন্তর পরিচর্যা। শক্তিমান লেখকের চিন্তার পরম্পরা একেকটি যুগ নির্মাণের পথে একেকটি সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
কোনো বিশেষ ধারার উন্মেষকালই পঞ্চাশ থেকে ষাট বছর পর্যন্তও হয়। বিকাশকাল শতকের বৃত্তও পার করে দেয়। তবেই সাহিত্যের একটি বিশেষ যুগ প্রতিষ্ঠা পায়। সাহিত্যের যুগ গড়ে ওঠে প্রবহমান নদীর মতোই। নদীর মুখে বাঁধ নির্মাণ করে যেমন নদীকে বিভিন্ন উপনামে ডাকলেই একই নদী বিশগজ-পঁচিশগজ পরপর ভিন্ন ভিন্ন নদী নামে স্বীকৃতি পায় না, তেমনি সাহিত্যেও খণ্ডখণ্ড সময়েরমুখে জোর করে সীমারেখা টানলেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র যুগের সৃষ্টি হয় না। প্রবহমান স্বভাবই সাহিত্যের যুগ বিভাগকে ক্রিয়াশীল রাখে। সেখানে দশকবিভাজন নিতান্তই হাস্যকর ও পরিহাসপূর্ণ। এছাড়া সাহিত্যের যুগ বিভাগ সময়ের নিরিখে সম্ভব নয়। এক বা একাধিক কবি ও কথাশিল্পীর অভিন্ন রুচি, অভ্যাস, আচরণ ও শিক্ষা-দীক্ষার ঐকান্তিক চেষ্টায় গড়ে ওঠে একেকটি সাহিত্যিক প্রবাহ। একেকটি সাহিত্যিক ধারার উন্মেষ ও বিকাশের জন্য পঞ্চাশ বছর থেকে একশতাব্দি পর্যন্ত সময় প্রয়োজন। এ সময়ের মধ্যে একাধিক সাহিত্যিক প্রবণতাও সৃষ্টি হওয়া সম্ভব। ইংরেজি সাহিত্যে যেমন ‘এ্যাংলো-স্যাক্সন যুগ’, ‘এলিজাবেথীয় যুগ’, ‘নিউ ক্ল্যাসিক যুগ’, ‘রোমান্টিক যুগ’, ‘ভিক্টোরীয় যুগ’, ‘এডওয়ার্ডীয় যুগ’, ‘আধুনিক যুগ’, ‘জর্জীয় যুগ’, বাংলায় তেমনি ‘বৈষ্ণব যুগ’, ‘চৈতন্য যুগ’, ‘মঙ্গলকাব্যের যুগ’, ‘নাথ যুগ’, ‘রবীন্দ্র যুগ’, ‘আধুনিক যুগ’, ‘কল্লোল যুগ’-এর ধারণা সুপ্রতিষ্ঠিত। এসব বলয়ের সাহিত্যিক একই সঙ্গে একাধিক যুগের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। তাতে সাহিত্যের গতিপ্রকৃতি কিংবা প্রবণতা শনাক্তির ক্ষেত্রে কোনো অসুবিধা হয়নি। যেমন এডওয়ার্ডীয় যুগের ডব্লিউ. বি. ইয়েটস কিংবা জজ বার্নাড শ’কে আধুনিক যুগের এবং জীবনানন্দ দাশ, বিষ্ণুদে, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বুদ্ধদেব বসুকে একই সঙ্গে কল্লোল যুগ ও আধুনিক যুগের অন্যতম কবি হিসেবে গ্রহণ করতে কোনো সমস্যা হয় না। তাহলে বর্তমান বাংলাসাহিত্যের প্রেক্ষাপটে একজন নিরন্তর নবায়নপ্রিয় কবি কিংবা কথাসাহিত্যিক দশককেন্দ্রিক কবি-সাহিত্যিক না হয়ে কালনিরপেক্ষ কিংবা কালোত্তীর্ণ হতে বাধা কোথায়? পরিহাসপূর্ণ হলেও সত্যি ন্যাড়া মাথাওয়ালা দশকবাদী, সঙ্ঘপ্রিয়দের দৌরাত্ম্য চলছে এখন।
যারা সারাজীবনে হয়তো একটিও কালোত্তীর্ণ কবিতা, উপন্যাস কিংবা ছোটগল্প লিখতে পারেননি, কিন্তু কবি কিংবা কথাশিল্পী হিসেবে সহজে আত্মপ্রচারের সুযোগ নিতে ও পেতে চান, তারাই দশকবিভাজনে অতি উৎসাহী হয়ে ওঠেন। মূলত দশকবিভাজনে আগ্রহী তারাই, যারা সাহিত্যের নানা বাঁক ও প্রবণতা শনাক্তিতে অসমর্থ। সমকালীন সাহিত্যরুচির উত্তাপ উপলব্ধিতে ব্যর্থরাও জনরুচি ও সাহিত্যরুচিকে একই গ্লাসে গুলিয়ে পান করার পক্ষে। দশকবিভাজন সাহিত্যের জন্য কোনও সম্মান বয়ে আনতে পারে না। তাই নির্বিচারী দশকিয়া সংকলনগুলো অকবিতা, বানানো কাহিনীতে ভরে ওঠে। এ জন্যই আবিদ আজাদ এ ব্যঙ্গোক্তি করতে প্রণোদিত হয়েছেন—‘এই যে ভাই নামুন নামুন, দেখুন আপনার দশক যায়।’
দশক একটি ক্ষুদ্রতম বৃত্ত। দশকবাদীদের মুখ্য আকাঙ্ক্ষা থাকে কোনো একটি বিশেষ দশকে বৃত্তাবদ্ধ হওয়ার। বৃত্তের ভেতর ঘুরপাক খেতে খেতে বৃত্তাবদ্ধ দশকবাদীদের চোখ কোঠরাগত হয়ে ওঠে। সঙ্গতকারণে বৃত্তের বাইরের বিশাল পৃথিবীর রূপ-রস-বর্ণ-গন্ধ কোনও কিছুরই স্বাদ গ্রহণ করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। সে বৃত্ত মহীরুহদের ধারণ করতে অসমর্থ হওয়ায় তারা থাকেন আকাশ ছোঁয়া প্রান্তরে। ঘুরে বেড়ান মাঠে-মাঠে, দেশ থেকে দেশান্তরে, কাল থেকে কালান্তরেও। বৃত্তের ভেতর আত্মরতিতে ভোগেন যারা, তারা একেকটি গৌণ বিন্দু। বৃত্তের ভেতর বিন্দুগুলো জ্বলজ্বল হয়ে ওঠে বলেই দশকবাদীরা সে বিন্দুকেই সিন্ধু বলে প্রচার করার সুযোগ খোঁজেন।
দশকবাদীদের বিশ্বাস ও আচরণের সঙ্গে তাদের প্রচারিত তথ্যের সাদৃশ্য সহজে খুঁজে পাওয়া যায় না। সে সঙ্গে তাদের অন্ধঅনুসারীগোষ্ঠীর স্তুতিকেই নিজেদের জীবনের চরম সার্থকতা মনে করে আত্মরতিতে ভোগেন। দশকবাদীরা মূলত চরমপ্রতিক্রিয়াশীল; গুণবিচার বিরোধীও। যারা সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে দশকবিভাজনকে শ্রেয় জ্ঞান করে, তারা সাহিত্যের চিহ্নিত শত্রু। সে সঙ্গে যারা বিশেষ দশকের সুযোগ গ্রহণ করে গৌণদের সঙ্গে মহীরুহদের একই সমান্তরালে বিবেচনা করেন, তাদের ভূমিকাকেও সৎসমালোচক প্রশ্নবিদ্ধ করেন। সাহিত্যের নির্মোহ-নিষ্ঠুর বিচারসভায় তাদের আসন অত্যন্ত পরিহাসপূর্ণ ও শোচনীয়। দশকবাদীরা কামার আর স্বর্ণকারের কর্মপদ্ধতির মূল্যায়ন করেন একই মানদণ্ডে। তাই তাদের মানদণ্ডের ভিত্তিটি প্রশ্নবিদ্ধ। দশকবাদীদের লেখা গদ্যগুলো পড়লেই বোঝা যায়, তারা বিশ্লেষণহীন ও অন্তঃসারশূন্য মন্তব্যপ্রধান গদ্য লেখেন। কারণ সাহিত্য বিশ্লেষণ করতে হলে সাহিত্যের গতিপ্রকৃতি ও বিভিন্ন বাঁকের পরম্পরা আলোচকের জানা থাকা জরুরি। সে জ্ঞান তাদের নেই বলেই তারা মন্তব্যপ্রধান আলোচনা করেই দায়সারা গদ্য লিখে পাতার পর পাতা ভরান। বিনিময়ে দশকবাদীদের নগদ হাততালি পান।
দশকবাদীদের আন্তরিক সততা, চিন্তার স্বচ্ছতা ও কল্পনার অপরিমেয় শক্তির তীব্র ও হৃদয়-সংবেদী সংরাগের অভাব রয়েছে। অথচ তারাই বিভিন্ন রকম দশকিয়া সংকলনে দশকবিভাজনের পক্ষে বড় বড় বুলি আওড়ায়, আর পদক-পদবিকে কর্মের স্বীকৃতি বলে প্রচার করে। কবিতার দশক বিভাজন নিয়ে আবু হাসান শাহরিয়ারের তাৎপর্যপূর্ণ উক্তি—‘দশক গৌণ কবিদের আশ্রয়।’ দশক দশক করে যারা প্রাণপাত করে তাদের মনে রাখা উচিত, দশকে-দশকে সাহিত্যের গতি বদলায় না। তার জন্য বিশেষ শরীর প্রয়োজন। এ শরীর কোনও নৈর্ব্যক্তিক নারী বা পুরুষের শরীর নয়। এ শরীর চিন্তার, দর্শনের, নন্দনের, রসের, আলোকের, অন্ধকারের, আত্মার, পরমাত্মার, অস্তিত্বের, চেতনার, মহাজাগতিক ও বহু কৌণিক প্রপঞ্চের। যারা এমত ব্যাখ্যা হজম করার মতো শক্তি রাখেন, তাদের জন্য মহাকালের হিসাবের খাতার দশকিয়া ধারণা একটি ভ্রান্ত ধারণা মাত্র। দশকবাদীদের দশকপ্রীতি নির্দিষ্ট কালখণ্ডের বৃত্ত ভেঙ্গে চিরকালীন প্রেমে রূপান্তরিত হতে পারে না। সঙ্গত কারণে শঙ্খঘোষ দশকঅলাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছিলেন—‘এক দশকেই সঙ্ঘ ভেঙে যায়’।
সাহিত্যের কালবিভাজন কি সরকারের অর্থবছরের শুরুতে বাজেট পেশ করার মতো কোনও ঘটনা? একটি অর্থ বছরের কী কী কর্মসূচি সরকার গ্রহণ করবে, কী কী প্রকল্প হাতে নেবে এবং তা বাস্তবায়ন করতে কত ব্যয় হবে সে প্রাক্কলিত আয়-ব্যয়ের হিসাব পেশ করা বাজেট অধিবেশনের মূল কাজ। বাংলা সাহিত্যের দশকবাদী সমালোচনার ধারা দেখে মনে হয়, দশকবাদীরাও একদশকের ধারণাসম্মত বাজেট পেশ করেন। তারপর সে বাজেট অনুসারে সমালোচকমূলক গদ্য লেখেন এবং দশক শেষ না হতেই দশকিয়া সংকলন করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। যারা সাহিত্যের গতি-প্রকৃতি শনাক্ত করতে ব্যর্থ, তারাই দশকভিত্তিক আলোচনায় আহ্লাদি হয়ে ওঠেন। দশকভিত্তিক আলোচনায় সাহিত্যের পাঠোদ্ধার ও বিশ্লেষণ করার সুযোগ থাকে কম। কেবল অন্তঃসারশূন্য মন্তব্যপ্রধান আলোচনা করে যেমন আলোচক সহজে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেন, তেমনি সে আলোচনার সূত্র ধরে দশকিয়া সাহিত্যিকও বিশেষ গুরুত্ব পেয়ে থাকেন। সাহিত্যের যুগবিভাগ ও প্রবণতা উপলব্ধি করা একটি ধ্যানসাধ্য গবেষণার বিষয়। সে ধ্যানসাধ্য গবেষণায় অসমর্থরাও দশকবিভাজনে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। সাহিত্যের যুগবিভাগ ও প্রবণতা উপলব্ধি করার জন্য সাহিত্যের ভিত্তিভূম আত্মস্থ করা জরুরি। সে সঙ্গে বিভিন্ন বাঁক ও আন্দোলন সম্পর্কে থাকা চাই স্বচ্ছ ধারণা। সাহিত্যের বিভিন্ন বাঁক, আন্দোলন ও আঙ্গিকের প্রশ্নে যাদের ভাঁড়ার শূন্য তারাই সাহিত্যের দশকবিভাজনে অতি উৎসাহী। সাহিত্যের সামগ্রিক রূপ-রস-বিষয় নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা কিংবা গবেষণা করতে হলে আলোচক-সমালোচকের ঘটে নন্দনতত্ত্ব, দর্শন, বিজ্ঞান, গণিত, ইতিহাস, নৃতত্ত্ব, ভূগোল, সমাজগবেষণা, ধর্ম ও সংস্কৃতি সম্পর্কে গভীর ধারণা থাকা চাই। মানবেতিহাসের বিভিন্ন কালখণ্ড ও শিল্পকলার বহুরৈখিক প্রপঞ্চ সম্পর্কে বিশদ ধারণা ব্যতিত সাহিত্যের কোনও শাখারই বিশ্লেষণসহ মৌলিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব নয়। ফলে দশকবিভাজনে আগ্রহী হয়ে ওঠে অলস ও মেধাহীন অ-কবি, লেখক ও সমালোচক।
দশকাবাদীদের সাহিত্য সমালোচনার ধারা দেখলে বারবার মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর অমোঘ উক্তি—‘বানরের গলে দিলে মুক্তোর হার/ ফল ভেবে ভেঙে তারে করে চুরমার’। কেন জানি দশকবিভাজনের আগ্রহীদের ভেদবুদ্ধির সঙ্গে বানরের ভেদবুদ্ধির তুলনা করতে ইচ্ছে হয়। কারণ, সাহিত্যের বিচার চলে রসনিষ্পত্তিতে, দশকভিত্তিক সমালোচনার ধারায় নয়। এ অন্তঃসারশূন্য মন্তব্যপ্রধান সাহিত্য-সমালোচনার ধারায় সাহিত্য-অঙ্গনে কেবল কাদা ছোড়াছুড়িই হয়। সাহিত্যের পরিচর্যা হয় না। বানরের কাছে মুক্তোর হার ফলের মতোই; খেতে না পারলেও ভেঙে চুরমার করাই তার কাজ। বানরের ভেদবুদ্ধিতো সেরকম সাক্ষ্যই বহন করে! তেমনি দশকবাদীদেরও একই স্বভাব। সাহিত্য চর্চায় নগদ বিজয়ের তাৎক্ষণিক মোহ যাদের রয়েছে, তাদের সে মোহই সাহিত্যসভায় গায়ের জোরে হলেও আসন পেতে বসার দুঃসাহস জোগায়। তারা সাহিত্যের মৌল প্রেরণা কিংবা দায় শনাক্তিতে ব্যর্থ হওয়ায় কেবল কুতর্কে লিপ্ত হয়। ফলে তাদের সাহিত্যপ্রীতি আর বানরের মুক্তোর হারকে ফল ভাবার নির্বোধ আচরণের মধ্যে কোনো পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে না।
বানরের মতো নির্বোধ দশকবাদীদের দশক বিভাজনের কারণে বিশ্লেষণহীন-দায়সারা দশকিয়া সংকলন থেকে বাদ পড়ে যান প্রকৃত কবি-গল্পকার-ঔপন্যাসিক। বাদ পড়ার কারণ হিসেবে তারা বিভিন্ন রকমের হাস্যকর কৈফিয়তও দেন। সে কৈফিয়ত মহাকাল কেন, সমকালের ফু’তেই উবে যায়। সমকালেই প্রমাণীত, বাদ যারা পড়েন, তাদের ধারণ করার সামর্থ্য বনসাঁইদের থাকে না। আত্মপ্রসাদের কর্মযজ্ঞে দশকবাদী বনসাইরা আত্মরতিতে ভুগলেও সে-আত্মরতিই অচিরেই আত্মগ্লানিতে পরিণত হয়। তখন প্রকৃত মহীরুহ সমহিমায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠেন। অতএব, কালের বিবর্তনে, বিকৃতির ধুলোর আবরণ মুছে গেলে, দশকভিত্তিক সংকলন ও গদ্য থেকে বাদপড়া কিংবা সেখানে অবমূল্যায়িত হওয়া কবি-লেখকরাই যে কালের বিচারে শ্রেষ্ঠ’র আসনগুলো অলঙ্কৃত করবেন, সে-ব্যাপারে সন্দেহ কী!
‘সাহিত্যে দশক বিভাজন ও অন্যান্য’ (২০১০) থেকে।