একটি শিক্ষিত সমাজ গোষ্ঠীর অন্যতম দর্পণ প্রবন্ধ সাহিত্য। জ্ঞান, প্রজ্ঞা বা মেধার চর্চা যেখানে, সেখানেই স্থান প্রবন্ধের। কিন্তু সস্তা সাহিত্যের রকমারি বিপ্লবে সমাজ যখন ছেয়ে ওঠে, তখন স্বাভাবিকভাবেই সৃজন ও মননের এই উৎকৃষ্ট জায়গা ম্লান হয়ে পড়ে। এরপরও অনেক সচেতন শিল্পী সম্পূর্ণ নিজেদের প্রচেষ্টায় প্রবল দায়বদ্ধ থেকে এই কঠিন পথে হাঁটছেন। সাম্প্রতিক প্রবন্ধ সাহিত্যে এমন তিন লেখক হলেন, কাজী মহম্মদ আশরাফ, মোহাম্মদ নূরুল হক ও মামুন রশীদ।
বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যের ইতিহাসে বর্তমান যে দৈন্য তৈরি হয়েছে, তাদের মধ্যে এই তিন লেখক প্রবন্ধ সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে চলেছেন। তিন জনেরই আছে চাহিদা ও রুচির ভারসাম্য। এর মধ্যে কাজী মহম্মদ আশরাফ বাংলা সাহিত্যে ভাষা, ব্যাকরণ, প্রবীণ কবি, লেখক, শিল্পীর উত্থান, বিপর্যয় ও সম্ভাবনাকে তথ্যসমৃদ্ধ আলোচনায় তুলে ধরেছেন। ফলে আমরা অতীত সাহিত্যের নানা গন্ধ-বর্ণ ও উৎস সম্পর্কে যেমন বুঝতে পারি, তেমনি বর্তমান শিল্প সাহিত্যের প্রবণতা সম্পর্কেও তুলনামূলক পার্থক্যের একটি চিত্র পাই। তিনি তার প্রবন্ধে বাংলা সাহিত্যের শক্তিমান কবি, সাহিত্যিক ও তাদের জীবনাচরণসহ বিবিধ তথ্যের সন্নিবেশ ঘটান। ফলে, পাঠক তার নিজস্ব বোধ ও যুক্তিবিচারে নিজের জানা তথ্যের সঙ্গে ব্যক্তিগত ভাবনাটুকু মিলিয়ে নিতে পারেন। তার লেখা তথ্যবহ ও বিবেচনায় ঋদ্ধ।
অন্যদিকে মোহাম্মদ নূরুল হক শিল্প-সাহিত্যে বুদ্ধিবৃত্তিক জায়গাকে সমৃদ্ধ করছেন। ইতিহাস ও তথ্যের নানাবিধ সম্মিলনে (লেখকের নিজস্ব ধী ও যুক্তিতে) শিল্পীর সীমাবদ্ধতা ও সম্ভাবনা আমাদের কাছে আয়নার মতো পরিষ্কার হয়ে ওঠে। তিনি অগ্রজ লেখক-কবির পাশাপাশি সামসাময়িক কবি ও লেখক নিয়েও অনেক যুক্তিপূর্ণ প্রবন্ধ লিখেছেন। তার প্রবণতার মূল বৈশিষ্ট্য হলো আলোচনায় তিনি বিভিন্ন ইতিহাস ও তথ্যের সমন্বয় করেন। নিজস্ব যুক্তিবোধ ঘটিয়ে বক্তব্যকে উপস্থাপন করেন। ফলে, পাঠক একইসঙ্গে তার নিজস্ব বোধের সঙ্গে আরও কিছু ভাবনার উপজাত সংগ্রহ করতে পারে।
আর মামুন রশীদের আগ্রহ কবি ও কবিতাকেন্দ্রিক। পাশাপাশি সাহিত্যের ইতিহাস ও সামসময়িক বিষয়ভিত্তিক কিছু পর্যালোচনাও তার লেখায় উঠে আসে। কবির কবিতার উপমা, উৎপ্রেক্ষা ও তার শব্দব্যঞ্জনা থেকে যুক্তিগুলো সমবণ্টন করে কবি ও শিল্পীর শিল্পসত্তার পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন তিনি।
পার্থিব জগতের সবকিছুই সাহিত্যের অংশ হতে পারে। সাহিত্যে তা যথাযথ ব্যবহার করতে পারার যোগ্যতাই তার পূর্বশর্ত। সাহিত্যের ফুল ও বোধের উঁচুতম শিল্পমাধ্যম হচ্ছে কবিতা। সাহিত্য নিয়ে কাজী মহম্মদ আশরাফে ‘সাহিত্যের স্বায়ত্তশাসন’; কবিতায় নিয়ে মোহাম্মদ নূরুল হকের ‘কবিতার সংকট’ এবং মামুন রশীদের ‘সাম্প্রতিক বাংলা কবিতা স্বতন্ত্র স্বর’ তিনটি গদ্যে প্রত্যেকের নিজস্ব কিছু অভিমত ও আলোচনায় (সাহিত্য ও কবিতা বিষয়ক আলোচনায়) নতুনত্ব যে আছে, অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
কাজী মহম্মদ আশরাফ সাহিত্যের স্বায়ত্তশাসন বিষয়ে (সময়োপযোগী বাস্তবতার) গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় উত্থাপন করেছেন। লেখক বলছেন—‘সাহিত্য বিষয়ে সাহিত্যিক সম্পাদক যাঁরা, তাদের বিচার-বিবেচনা ও অযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে। সম্পাদক যদি শুধুই কবি হন তার হাত গলে দুর্বল ছোটগল্প কিংবা প্রবন্ধ বেরিয়ে যেতে পারে। কবিতা ও গদ্য এ দু’টি ভিন্ন ধারা। পৃথক চর্চায় দক্ষতা আসে। আবার একজন প্রাবন্ধিক যদি সম্পাদক হন, তিনি ছোটগল্পের ঘটনা ও চরিত্র নিয়ে জ্ঞান রাখলেও কবিতার শরীর ও মন পৃথকভাবে বুঝতে পারবেন, তার নিশ্চয়তা নেই। আর অনুবাদ সাহিত্য প্রকাশের ব্যাপারে সম্পাদকের দু’টি ভাষা সম্পর্কেই বিশেষ ধারণা থাকা প্রয়োজন। সে গল্প, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ যেকোনো সাহিত্যের অনুবাদই হোক…শিল্প ও শিল্পীর স্বাধীনতা বা সাহিত্য ও সাহিত্যিকের স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে আজও অজানা রয়ে গেছে—এই দু’টি বিষয় আসলে এক কি না। এর পার্থক্যই বা কী? দেখা গেছে যুগে যুগে, দেশে দেশে, ভাষায় ভাষায় প্রত্যক্ষ শাসকের শাসন সাহিত্য ওসাহিত্যিক উভয়ের ওপর পড়েছে। সাহিত্যশাসন হয়েছে সাহিত্যিকশাসন বা গ্রন্থশাসন।’ এরমধ্য দিয়ে উল্লিখিত গদ্যে সাহিত্যের সাহিত্যিক জ্ঞান বা প্রজ্ঞার চেয়ে ক্ষমতা বা রাজনীতিই যে বড় হয়ে উঠছে; বাস্তবতা বিচারে যা সত্য বলে প্রতীয়মাণ করা যায়।
গদ্যের ভাষা ও ভাবে সৃজন, মনন ও জ্ঞান-বান্ধব কাজী মহম্মদ আশরাফ। ফলে শিল্পের যেকোনো মাধ্যমে যোগাযোগ বা তথ্যের একটি বিশ্বস্ত প্রতিনিধি হয়ে ওঠেন তিনি। তার গদ্যভাষা সরল। গীতিময় ও প্রবহমান। যা অনেকটা মুখের ভাষার কাছাকাছি।
অন্যদিকে সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ শাখা কবিতা নিয়ে ‘কবিতার সংকট’ গদ্যে মোহাম্মদ নূরুল হকের যুক্তি হলো—‘কবিতায় কবি দুই ধরনের সংকটে পড়েন। একটি নিজে বোঝার, অন্যটি অন্যকে বোঝানোর। যারা লেখেন, তাদের দাবি, কবিতা বোঝার বিষয় নয়, অনুভবের। যারা এর রসপিপাসু, তাদের অভিযোগ—যা বোঝার নয়, তা অনুভবেরও যোগ্য নয়। উভয়পক্ষের কথায় যুক্তি আছে। প্রথম পক্ষের যুক্তি অনেকটা আপেক্ষিক, তাতে বাস্তবতার চেয়ে স্বার্থপরতার পরিমাণ কিঞ্চিত বেশি। দ্বিতীয়পক্ষের যুক্তির ভেতর রয়েছে রূঢ় বাস্তবতা। স্বার্থপরতা এই অর্থে যে, এই শ্রেণির কবিরা কারও অভিরুচির প্রতি সম্মান দেখাতে চান না। কেবল নিজেদের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে চান। আর বাস্তবতা এই অর্থে যে, মনের ভাবপ্রকাশের জন্য রয়েছে প্রত্যেকের নিজস্ব ভাষা-সংকেত…কবিতার সংকট বোঝাতে গেলে, এর পারিপার্শ্ব, স্রষ্টা, রসপিপাসু, সমালোচকের চারিত্র্য সম্পর্কেও কিছুটা আলোকপাত প্রয়োজন। কবিতার সংকট বলতে আসলে কী বোঝাতে চাই, এমন প্রশ্নের সোজাসুজি কোনও উত্তর আপাতত নেই। তবে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে যা বলা হবে, তার সারাংশ মোটামুটি এ রকম—কবির প্রস্তুতি, খ্যাতির মোহ; ছন্দ-অনুপ্রাস-অন্ত্যমিল; চিত্রকল্প, ভাষা-সংকেত; আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট; রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক পটভূমি, ভৌগলিক-কালিক সীমারেখার আন্তঃসম্পর্ক যত সুনিবিড় হবে, কবিতাও হবে তত হৃদয়গ্রাহী, বিশ্বস্ত। কিন্তু এ সবের সঙ্গে যদি সাংঘর্ষিক সম্পর্ক সৃষ্টি হয়, তবে কবিতার অপমৃত্যু অনিবার্য।’ সমাপ্তিতে কবি মোহাম্মদ নূরুল হক কবিতা নিয়ে বিশেষ গদ্যটিতে সামসময়িক বাস্তবতার নৈরাজ্য ও আক্ষেপকে যৌক্তিক উপায়ে বিশ্লেষণের প্রয়াস পেয়েছেন।
মাইকেল পরবর্তী ত্রিশের দিকে, বাংলা সাহিত্যে (ইউরো প্রভাবিত) কবিতার নিরীক্ষা বা এক্সপেরিমেন্টের একটা কেতাদুরস্ত-জাগরণ শুরু হয়েছিলো। এবং এতে যতোটা না কবিতা হয়েছে; তারচে’ কবিতা জটিলতার দিকেও বাঁক নিয়েছে । ‘সাম্প্রতিক বাংলা কবিতা স্বতন্ত্রস্বর’ গদ্যে মামুন রশীদ বলছেন—‘বাংলা কবিতা থেকে নিজস্বতা হারিয়ে যাওয়ার একটা আশঙ্কার কথা একসময় বেশ জোরেসোরেই উচ্চারিত হয়েছিল।বাংলা কবিতাকে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে দাঁড় করানোর অজুহাত তুলে স্বেচ্ছাকৃত জটিলতা তৈরির প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন কেউ কেউ। বিভিন্ন ইজমের ধুয়া তুলে পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে বাংলা কবিতাকে পাঠক বিমুখ করে তুলতেই যেনসচেষ্ট ছিলেন সেইসব কবি। তারা সৃষ্টির পরিবর্তে নির্মাণের খেলায় মেতেছিলেন। যেন বাংলা কবিতা থেকে বাংলার ইতিহাস, ঐতিহ্যশেকড়, রূপ, রস, গন্ধ হারিয়ে যেতে বসেছিল। সেই স্রোতে হারিয়ে যাওয়া বা গা ভাসিয়ে দেওয়ার বিপীরতে কেউ-কেউ, শেকড়সন্ধানীরা উদ্দেশ্যহীনতার পথে বাংলা কবিতাকে হারিয়ে যেতে না দিয়ে, লাগাম টেনে ধরেছিলেন। তারা আমাদের ইতিহাস, ঐহিত্যের ভেতর দিয়েই বাংলা কবিতাকে বৈশ্বিক করে তোলার জন্য সচেষ্ট থেকেছেন।’
এই গদ্যে বাংলা কবিতায় প্রতিনিধিত্বকারী কিছু কবি প্রতিভাকে তিনি সামনে এনেছেন। তারা হলেন—কাজী নাসির মামুন, চন্দন চৌধুরী, মোহাম্মদ নূরুল হক, ইমতিয়াজ মাহমুদ, রবু শেঠ, মিজানমল্লিক, জাকির জাফরান, জাহানারা পারভীন, ফেরদৌস মাহমুদ প্রমুখ।
বৈয়াকরণিক পাণিনি, হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে অনেকে সংস্কৃত ব্যাকরণ বিষয়ে ছোটবড় নানান রীতি ও পদ্ধতি বাতলে দিয়েছেন। ব্রিটিশ পরবর্তী বাংলা বানানে সংস্কৃত ও ইংরেজির মিশেলসহ ভাষা, ধ্বনি ও বানানে নানা মুণির নানা মত অস্বীকার করারসুযোগ নেই। অন্যদিকে স্বাধীন বাংলাদেশে বাংলা অ্যাকাডেমির মতো একটি প্রতিষ্ঠানের দ্বৈতরীতিসহ নানা বিভাজনে তৈরি হয়েছে একটি বিশৃঙ্খলা বা নৈরাজ্য। এ নিয়ে কাজী মহম্মদ আশরাফ ও মোহাম্মদ নূরুল হক দু’জনের গদ্যে তৈরি হয়েছে উল্লেখযোগ্য প্রশ্ন, জিজ্ঞাসাও শঙ্কা। মোটাদাগে বললে, বিশৃঙ্খলা ধারাবাহিকভাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধারণ করতে পারে।
ভাষার শৃঙ্খলা হচ্ছে ব্যাকরণ। বাংলা ব্যাকরণের ধ্বনিতত্ত্ব, রুপতত্ত্বে সংস্কৃতের প্রভাব এবং বাক্যতত্ত্বে ইংরেজি ভাষার অবিকল প্রভাবসহ নানাবিধ দৈন্য নিঃসন্দেহে বাংলা ব্যাকরণ (আমাদের নিজস্ব) তৈরি না হওয়ার বড় দায় বা জিজ্ঞাসাটি সামনে চলে আসে। কাজী মহম্মদ আশরাফ বলছেন—‘বাংলা ব্যাকরণের ধ্বনিতত্ত্ব ম্যাক্সমুলার-মার্কাসংস্কৃতভক্ত প্রাচ্যতত্ত্ববিদদের প্রভাবে সংস্কৃত ভাবাপন্ন ছিল। রূপতত্ত্বও সংস্কৃত প্রভাবিত ছিল। বাক্যতত্ত্ব ছিল ঔপনিবেশিক প্রভুদের ভাষাইংরেজির অবিকল। শুধু পদক্রমে অতি সামান্য পার্থক্য ছিল। ইংরেজি বাক্যের পদক্রম SVO, যা ছিল কর্তা + ক্রিয়া + কর্ম। আর বাংলাবাক্যের পদক্রম SOV অর্থাৎ কর্তা + কর্ম + ক্রিয়া। এছাড়া বাক্যের সংজ্ঞা, প্রকারভেদ সবই ইংরেজির মতোই।[…] গঠন, অর্থ ও ভাব অনুসারে বাংলা বাক্যের প্রকারভেদ ইংরেজির অবিকল। বড় দুঃখের বিষয় বাংলা ভাষায় কোনো বাংলা ব্যাকরণ রচিত হয়নি।’
এছাড়া, লেখক ইউরোপীয় প্রধান ভাষার প্রমিত রূপ নিয়ে যে প্রশ্ন ও জিজ্ঞাসাটি উত্থাপন করেছেন, তা হলো এই—‘ইউরোপের ভাষার উদাহরণ যতই দেওয়া হোক, একটি প্রশ্ন এখানে মাথা তুলে দাঁড়াবেই। ইউরোপের এইসব ভাষা সাম্রাজ্যবাদীদের ভাষা।ঔপনিবেশিক শাসকশ্রেণীর ভাষা। বাংলা ভাষা কি সাম্রাজ্যবাদী ভাষা?’
অন্যদিকে, মোহাম্মদ নূরুল হক বাংলা ব্যাকরণের ব্যাকরণগত কিছু প্রমাদ চিহ্নিতকরণসহ বর্তমান সমাজ বাস্তবতার সরাসরি কিছু চিত্রতুলে ধরেছেন। দেশের সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সমাজের সর্বত্র যে হারে ভুল বানান-ভুল বাক্যে ছেয়ে আছে; যা অবর্ণনীয়। উল্লিখিত বিষয়গুলো লেখক খুব গুরুত্বের সঙ্গে উপস্থাপন করেছেন ‘বাংলা বানানের বিশৃঙ্খলার জন্য দায়ী কে’ প্রবন্ধে। লেখক বলেছেন—‘ভাষা শেখার প্রথম জায়গা হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশ শিক্ষকই নির্ভুল বানানে বাক্যগঠনে মনোযোগী নন। কোমলমতি শিশুদের প্রতিটি বর্ণের নির্ভুল উচ্চারণ শেখানোর ব্যাপারে শিক্ষকরা যত্নশীল হন না। ফলে শৈশব থেকেই শিক্ষার্থী কোনো কোনো বর্ণের ভুল উচ্চারণে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। এভাবে অভ্যস্ত হয়ে পড়ায় পরিণত বয়সেও তারা আর নির্ভুল উচ্চারণ আয়ত্ত করতে পারে না। ফলে সারাজীবনই ভুল উচ্চারণেই কথা বলে। এছাড়া, লেখ্যরূপের ক্ষেত্রেও একই পরিণতি ঘটে। সর্বনাম-ক্রিয়াপদের সাধুরীতি, চলিতরীতি, ণ-ত্ববিধি কিংবা ষত্ববিধি, উৎপত্তিগত দিক থেকে শব্দের শ্রেণীবিভাগ, সমাজ-কারক-প্রত্যয়ের যথাযথ ব্যবহার সম্পর্কে প্রাথমিক কিংবা মাধ্যমিক স্তরে পড়ানো হলেও ব্যবহারিক জীবনে শিক্ষক-শিক্ষার্থী—কেউই চর্চা করেন না। এর ফলে কিভাবে ভাষায়দূষণ ঘটছে, কিভাবে গুরুচণ্ডালী ভুল হচ্ছে, সে বিষয়ে কেউ সতর্ক থাকছে না।’
এছাড়া, ব্যাকরণগত এইসব জাতীয় (বিবিধ) প্রমাদ ও ভুলের জন্য তিনি বাংলা অ্যাকাডেমিকে দায়ী করছেন। তিনি বলেছেন—‘এই স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানটি প্রমিত বানানরীতির যে নিয়ম তৈরি করেছে, সেখানেই রয়ে গেছে আসল গলদ। একই শব্দের দ্বৈতরীতি যেমন রেখেছে, তেমনি রেখেছে বেশকিছু বানান ও সমাসবদ্ধ শব্দগঠনের ক্ষেত্রে অস্পষ্টতাও।’
প্রমিত বানানের দ্বৈতরীতির এই অসমতার জন্য কাজী মহম্মদ আশরাফ ও মোহাম্মদ নূরুল হক—দু’জনই নানা সূচকে বাংলা অ্যাকাডেমির ভুল ও দৈন্যকে স্পষ্ট করেছেন। একটি দেশের স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
মাইকেল পরবর্তী বাংলা সাহিত্যে তিরিশের পঞ্চপাণ্ডবের অন্যতম ধী-সম্পন্ন প্রজ্ঞাবান কবি সুধীন্দ্রনাথ। কাজী মহম্মদ আশরাফ ও মোহাম্মদ নূরুল হকের গদ্যে সুধীন্দ্রনাথ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ ও যৌক্তিক বিষয় উঠে এসেছে। সুধীন্দ্রনাথ বিষয়ে ‘সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কাব্যস্বভাব’ প্রবন্ধে কাজী মহম্মদ আশরাফের যুক্তি—‘বিশ্বসাহিত্যের অঙ্গনে রবীন্দ্রনাথ কিংবা জীবনানন্দ দাশের মতো গুরুত্বপূর্ণ নন সুধীন্দ্রনাথ। জার্মান ও ফরাসি চিন্তাধারায় চালিত একজন প্রতিলিপিকার বলা যায়। কিন্তু বাংলা সাহিত্যে তিনি মৌলিক। নিজস্ব গদ্যসহ কবিতা এবং নিজের সম্পাদিত সাহিত্যপত্রিকা ‘পরিচয়’ ছিল বেশ প্রতাপশালী। অভিজাত বলেই প্রতাপশালী কিন্তু প্রভাবশালী নন। এ কারণেই তিনি কোনো যোগ্য উত্তরসূরি রেখে যেতে পারেননি। মৃত্যুর পরে তার কাব্যাদর্শের অনুসারী কোনো কবিকে পায়নি বাঙালি পাঠকসমাজ। এ কারণে তার কাব্যজগৎ পাঠকের কাছে অচেনা মনে হয়। ভাষার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন শব্দপ্রধান। যে কারণে অক্ষরবৃত্ত এবং মাত্রাবৃত্ত ছন্দে তার কবিতা নির্ভুল […] বুদ্ধদেব বসু তাকে বলেছেন স্বভাব কবি নন, স্বাভাবিক কবি। যে সব কারণে এমন ধারণা; তার মধ্যে সম্ভবত এটাও একটা যে, তার কবিতায় প্রকৃতির কথা এসেছে কম। ষড়ঋতুর বৈচিত্র্যে ভরা বাংলাদেশের জলবায়ু আর নিসর্গ যেকোনো কবিকেই প্রভাবিত করে। এমনকী অকবিকেও কবি বানিয়ে তোলে। কিন্তু এই দুর্দমনীয় প্রাকৃতিক শক্তিকেই সবলে ঠেলে রাখলেন তিনি […]।’
অন্যদিকে ‘সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতা: মনীষা প্রসঙ্গে’ প্রবন্ধে মোহাম্মদ নূরুল হক’র সুধীন্দ্র ভাবনায় দেখি আরেকপ্রস্থে ভিন্ন করে—‘আধুনিক বাংলা কবিতার প্রথম আধুনিকদের একজন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। তাঁর কবিতায় আবেগের চেয়ে প্রজ্ঞা, কল্পনার চেয়ে অভিজ্ঞতা এবং ভাবালুতার চেয়ে বুদ্ধিবৃত্তির পরিচয় বহুল পরিমাণে বিধৃত। ফলে তাঁর কবিতা সহজবোধ্য হয়ে ওঠেনি। এর কারণ কবিতা নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে ধ্যানস্থ হওয়া এবং কবিতাকে অভিজ্ঞতা ও ভাবনা প্রকাশের বাহন করে তোলা […] সুধীন দত্ত কবিতাকে অভিজ্ঞতা ও কল্পনার সমন্বয়ে প্রজ্ঞার স্মারক করে তুলেছেন। চিন্তাশূন্য কল্পনাবিলাসিতার বিপরীতে অবস্থান নিয়েছে তাঁর কবিতা। সঙ্গত কারণে অপ্রস্তুত পাঠকের পক্ষে তাঁর কবিতার রস আস্বাদন অনায়াস-সাধ্য নয়। এ কথা অস্বীকার যায় না—তাঁর কবিতায় তৎসম শব্দের বাহুল্য রয়েছে, সেই সঙ্গে রয়েছে মিথ ও পাণ্ডিত্যের সংশ্লেষ। এর অন্য কারণও রয়েছে। সুধীন দত্ত যুক্তিনিষ্ঠ এবং বিজ্ঞানমনস্ক। প্রমাণ ছাড়া অন্তঃসারশূন্য বিষয়ের প্রতি কোনো মোহ ছিল না। বস্তুসত্যের ওপর কল্পনার প্রলেপে কবিতা সৃষ্টিই একমাত্র লক্ষ্য ছিল। কেবল ভাবের জগতে বিচরণ করে, যুক্তিহীন স্বপ্নচারিতায় প্রতিভার অপচয় সময়ের অপব্যবহারে ছিলেন অনীহ।’
দু’জন লেখকের মধ্যে কাজী মহম্মদ আশরাফের ভাবনায় সুধীন্দ্রনাথ (বাংলা সাহিত্যে কোনো প্রতিনিধি রেখে যেতে না পারলেও) চিন্তা ও মেধার দিকে বস্তুনিষ্টতা ও নতুনত্বসহ কিছু সূচকে তার প্রজ্ঞা বা অবদানকে স্বীকার করেছেন। অন্যদিকে সুধীন্দ্রনাথের প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিবৃত্তিক জায়গা মোহাম্মদ নূরুল হকের কাছে অধিক গুরুত্বপূর্ণ ও যথার্থ বলে মনে হয়েছে।
মোহাম্মদ নূরুল হক গদ্যের ভাষা ও ভাবে সৃজন, মনন ও প্রজ্ঞা-বান্ধব। ফলে শিল্পের যেকোনো মাধ্যমে তুলনামূলক আলোচনায়—পাঠকের প্রশ্ন, ভাবনা বা উপলব্ধির জায়গাকে উসকে দেন তিনি। শব্দ ও বাক্যের যুগল সম্মীলনে গতিময় তার ভাষা, চলিত ও তৎসম শব্দাশ্রয়ী। মাঝেমধ্যে যুক্তবর্ণের বিশেষ ব্যবহার তার ভাষাকে ভাবগম্ভীর করে তোলে।
এদিকে, সুধীন্দ্রনাথকে নিয়ে মামুন রশীদের ভাবনার (প্রবন্ধ) কোনো অন্তর্পাঠ আমরা প্রত্যক্ষ না করলেও তারও আগের সময়ের অনিবার্য কবিসত্তা মাইকেল নিয়ে তার কিছু উল্লেখযোগ্য পাঠ পরিধি আমাদের চোখে পড়ে। মাইকেল মধুসূদন। বাংলা সাহিত্যের মনন ঘরানার শক্তিমান শিল্পসত্তা। যিনি ইউরোপীয় রেনেসাঁসের মধ্য দিয়ে মানবতাকে বড়ো করে দেখেছিলেন। সেই সঙ্গে মধ্যযুগের বর পাওয়া দেব-দেবীর অনুকম্পা-নির্ভর সাহিত্যের দৈন্যকে আঘাত করে বাংলা সাহিত্যে আধুনিকযুগের সূচনা করেছেন। মামুন রশীদ অগ্রজ কবির মধ্যে মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা ও তার তাৎপর্যের উল্লেখযোগ্য দিকটি সামনে নিয়ে এসেছেন। তিনি বলেন—‘‘দত্তের রচিত ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ প্রকাশিত হয় ১৮৬১ সালে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মবর্ষে। প্রকাশের পর এই মহাকাব্যটি ইতোমধ্যে পেরিয়ে এসেছে সার্ধশত বর্ষ। দেড়শ বছরের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত মহাকাব্যটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল হয়ে আছে […] বাংলাসাহিত্যে—আধুনিক যুগে প্রবেশের আগে মূলত দেবদেবীর জয়গান নির্ভর ছিল। বিশেষত পুরো মধ্যযুগের সাহিত্য ছিল দেবদেবী নির্ভর। এ ধারা থেকে আধুনিকতার শুরুতে যখন মানুষের জীবনতার সুখ-দুঃখকে সাহিত্যের বিষয় করা হচ্ছে তখন মাইকেল মধুসূদন দত্তের এই কাব্য নতুনত্ব নিয়ে আমাদের সাহিত্য ভুবনে। এই নতুনত্বসব দিক থেকেই। কারণ এটিই আমাদের প্রথম মহাকাব্য…মাইকেল মধুসূদন দত্ত তার মেঘনাদবধ কাব্যে রাবণ চরিত্রের মধ্যে চিরকালীন পিতার যে ছবি এঁকেছেন, অন্য আর আর কারণের মধ্যে এই একটি কারণে আরও বহুকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবেন […]।”
ত্রিশের কাব্য সাহিত্যে ইউরোপীয় যে জাগরণ, তার বড় একটি উত্তাপ আমরা পঞ্চাশের কবিদের মধ্যেও দেখতে পেয়েছি। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী ও আল মাহমুদ। প্রত্যেকে তার নিজস্বতা ও স্বাতন্ত্র্যের জন্য আলাদা হয়ে আছেন। কাজী মহম্মদ আশরাফ, মোহাম্মদ নূরুল হক ও মামুন রশীদ তিনজনের প্রবন্ধেই শামসুর রাহমান প্রসঙ্গে পৃথক কিছু যুক্তি, ভাবনা ও আবেগ উঠে এসেছে।
শামসুর রাহমান। কবিতায় নগর চেতনা, ভাষার শিল্প সারল্যসহ বাংলাদেশের অনেকগুলো ক্রান্তিলগ্নের সাক্ষী; বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিনির্মাণে যিনি শিল্পের প্রকৃষ্ট সাক্ষ্য ও দলিল তৈরি করেছেন। অন্যদিকে শহীদ কাদরী, তিনিও নগর চেতনার মধ্য দিয়ে আলাদা শৈলি ও শিল্পভাষায় ব্যতিক্রম। বাংলার ইউরো কাঠামোর একজন শিল্পসফল কবি। যিনি শব্দে শব্দে নতুন নগর চেতনার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। অন্যদিকে ব্যতিক্রমী আল মাহমুদ চলে গেলেন সম্পূর্ণ ভাটি-বাংলায়। যিনি তার শব্দে উপমা ও উৎপ্রেক্ষায় লোকজ ব্যবহার স্মার্ট ভাষায় উপস্থাপন করেছেন।
এখানে কাজী মহম্মদ আশরাফ, মোহাম্মদ নূরুল হক ও মামুন রশীদ তিনজনই উল্লিখিত তিন কবির শিল্পভাষার নানা প্রবণতা নিয়ে কথা বলেছেন। কাজী মহম্মদ আশরাফ, শামসুর রাহমানের চোখে (বাংলা সাহিত্যের) বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও বোদ্ধাদের অবস্থান ও দৃষ্টিভঙ্গি কেমন, তা তুলে ধরেছেন। ‘শামসুর রাহমান: প্রবন্ধ সাহিত্য’ প্রবন্ধে শামসুর রাহমানের মিথভাষিতা, স্বভাব ও গদ্য বিষয়ে মামুন বলেছেন। তার বক্তব্য হলো—‘শামসুর রাহমান (১৯২৯ -২০০৭) ব্যক্তিগতভাবে ছিলেন স্বল্পভাষী। অথচ তিনিই সম্ভবত বাংলা ভাষায় সবচেয়ে বেশি কবিতা রচনা করেছেন। তার স্বল্পভাষিতার পেছনে রয়েছে ব্যক্তিগত স্বভাব। তার বক্তব্য ছিল অনেক। উপযুক্ত প্রকাশভঙ্গি ছাড়া আসলে তিনি মনের কথা বলতে চাইতেন না। এটা একজন উঁচু মানের শিল্পীর স্বভাব। কয়েকটি গল্প, চারটি উপন্যাস ও দুটি গদ্য গ্রন্থেও এই স্বভাবটি লক্ষ করা যায় […]।’
এছাড়া, শামসুর রাহমান (লেখকের উল্লিখিত গদ্যে) রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, সমর সেন, সুকুমার রায়, বুদ্ধদেব বসু ও আহসান হাবীব সম্পর্কে মোটাদাগে তাদের নিয়ে কিছু বিষয় তুলে ধরেছেন। কাজী মহম্মদ আশরাফের শামসুর রাহমান আলোচনায় তার সৃষ্টি ও নির্মাণ নিয়ে (বাংলা সাহিত্যের উল্লিখিত এবং উল্লেখযোগ্য দিকপালের) আলোচনা, মূল্যায়ন ও কিছু সীমাবদ্ধতাও স্পষ্ট হয়েছে।
বাংলা সাহিত্যের বিরলপ্রজ প্রতিভা আল মাহমুদ। তার ‘লোক লোকান্তর’, ‘কালের কলস’, বিশেষ করে ‘সোনালি কাবিন’ বাংলা সাহিত্যের অমর সৃষ্টি। ফলে পরবর্তী অনেক কাব্যগাথায় তার দর্শন ও আইডেনটিটি প্রশ্নবিদ্ধ হলেও কিছু সূচকে তার অবস্থান এতই শক্তিসম্পন্ন যে, তাকে অস্বীকার করার কোনো সুযোগ থাকে না।
আল মাহমুদ বিষয়ে ‘কবিতার সময় ও মনীষার দান: আল মাহমুদ’প্রবন্ধে মোহাম্মদ নূরুল হকের বক্তব্যে মূলত সেই বিষয়গুলো ভিন্ন অথচ অর্থবহ উপস্থাপনায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। তিনি বলছেন—‘‘স্বাদেশিকতা ও আন্তর্জাতিকতা বোধের যুগ্ম-স্বাক্ষর রয়েছে তাঁর কবিতায়। রাজনৈতিক চেতনা তাঁকে করে তুলেছে জনবান্ধব। ধর্মীয় চেতনায় আক্রান্ত হলেও তা মানবতাকে অস্বীকারের ভেতর দিয়ে নয়।’ […] আধুনিক বাংলা কবিতা গভীরতর অর্থে ঐতিহ্যের পরম্পরা এবং সংস্কৃতির রূপায়ণের ফল। […] এ দৃষ্টিকোণ থেকে আল মাহমুদের শুরুর দিকের কবিতায় কোথাও কোথাও জীবনানন্দীয় সুর লক্ষ করা যায় […]। আল মাহমুদ কেবল গ্রামীণ পটভূমিকে কবিতায় অঙ্গীভূত করেননি, নগরও চিত্রায়িত করেছেন। তাঁর কবিতায় নগর এসেছে, যান্ত্রিক সভ্যতার রূঢ় রূপ নিয়ে। গ্রামীণ বিষয়আশয়কে তিনি যেভাবে ‘আন্তরিক রতির দরদ’সহ দেখেছেন, নগরকে সেভাবে দেখেননি […]।’’
এছাড়া, আল মাহমুদ বিষয়ে নূরুল হকের চূড়ান্ত ভাষ্য—‘‘কালই শেষ পর্যন্ত কবিতার শ্রেষ্ঠ পাঠক ও বিচারক। বাংলা কবিতার ইতিহাসে ‘সোনালী কাবিন’ একাধারে বুর্জোয়া, ধনতন্ত্র ও পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। ‘সোনালী কাবিন’ নিখিল নাস্তির দলিল নয়; নয় প্রবল বিশ্বাসের খতিয়ানও। আল মাহমুদ কবি—সমাজ ও শিল্পে সমন্বয়বাদী; বলার ভঙ্গি এবং অন্তর্জগত চেতনায় ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যে প্রোজ্জ্বল। নিজের কণ্ঠস্বাতন্ত্র্য স্পষ্ট করার লক্ষ্যে একই বিষয়ে যেমন বারবার ভিন্ন ভিন্ন কবিতায় উচ্চারণ করেছেন, তেমনি পরম্পরা রক্ষা করে রচনা করেছেন একের পর এক কবিতা।”
মোহাম্মদ নূরুল হক বুর্জোয়া, পুঁজিবাদ ও ধনতন্ত্রের বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিতে আল মাহমুদ নিয়ে দূরদর্শী বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। তাকে নিয়ে অভিনিবেশী এবং ধীর পাঠ না থাকলে আল মাহমুদ নিয়ে তার যুক্তিনিষ্ট মূল্যায়নের ভাষা বোঝা কিছুটা কঠিন বৈকি।
অন্যদিকে, মামুন রশীদও শামসুর রাহমান ও শহীদ কাদরী নিয়ে লিখেছেন। শামসুর রাহমান নিয়ে মামুন রশীদের আলোচনায় কবির প্রতি বিশেষ ভালোবাসা, আবেগ, স্মৃতিই মূলত স্পষ্ট হয়েছে। অন্যদিকে শহীদ কাদরী নিয়ে ‘শহীদ কাদরীর কবিতা: নগর জীবনেরআর্তনাদ’ গদ্যে কাদরীর কবিতার বিশেষ কিছু দিক ও বিষয়-আশয় (অনেকটা মার্ক বা কোটেশন সহকারে) অল্প কথায় তিনি তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন। লেখক বলছেন, ‘তাঁর কবিতায় উজ্জ্বল হয়ে আছে পাপ, অন্ধকার, সন্ত্রাস, শয়তান, মৃত্যু, মাতাল, লম্পট, জরা, কৃমি, ভিখেরী, বেশ্যা, দালাল, জুয়াড়ি, কীট, কবর এবং নপুংসকেরা। জীবনের ক্লেদাক্ত দিকগুলো অবলীলায় তুলে এনে কবিতাকে করেতুলেছেন নগরজীবনের আর্তনাদ। তাঁর তুলে ধরা শূন্যতা ও হাহাকার শিল্পের মাত্রা পেয়ে হয়ে ওঠে নাগরিক জীবনের প্রতিচ্ছবি।যেখানেস্পষ্ট হয়ে ওঠে জীবনের অকপট সত্য […] শহীদ কাদরীর কবিতার প্রধান বিষয় নগর। কিন্তু নগরকে শহীদ কাদরী কখনোই মফস্বল থেকে উঠে আসা কোনো লাজুক বালক অথবা কিশোরের মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখেননি। বরং তার দেখা নগরের বর্ণনায় উঠে এসেছে এর কদর্য দিকগুলোই। নিরাবেগ কিন্তু নিরুদ্বেগ নয় এক্ষেত্রে তাঁর দেখা। জীবনের অন্তর্গামী বিষয়গুলোকে তিনি নাগরিক পরিভাষার ভেতর দিয়ে তুলে ধরেছেন। যেখানে ব্যক্তির নিঃসঙ্গতা ছড়িয়ে থাকে পরতে পরতে। ফলে তার কবিতা পাঠের সময় মনে বিষণ্নতা ভর করে […]।’
পঞ্চাশ ষাটের দিকে কনফেশনাল পোয়েট্রি নামে আমেরিকার নতুন ধারার একটি কাব্যচর্চা সংঘঠিত হয়। বাংলা সাহিত্যে শহীদ কাদরী কনফেশনাল পোয়েট্রির এই ধারার কবিতার নতুন একটা ভাঙচুর শুরু করেছিলেন। এছাড়া, বিশ্ব সাহিত্যের ইউরো-প্রভাবিত বাংলা ভাষা কাঠামোর বড়ো একটা দৈন্যকে তিনি ঘুছিয়ে দিয়েছেন। অর্থাৎ ভাবনায় তিনি বাঙালি ঐতিহ্যের অনেক বিষয়-আশয়কে বাংলার আধুনিক ভাবি-নাগরিক চেতনাকে সমৃদ্ধ করেছেন। শহীদ কাদরী নিয়ে মামুন রশীদের বক্তব্যেও (বিশেষ করে কবিতার) কিছু ব্যতিক্রমী প্রবণতা বিষয় খুব গুরুত্বের সঙ্গে উঠে এসেছে।
গদ্যের ভাষা ও ভাবে মামুন রশীদ সৃজন, মনন ও প্রতিশ্রুতিমাণ। যার ভাবনার ভূগোলে কবি ও কবিতাকেন্দ্র আশ্রয় করেছে। ফলে সাহিত্যে কবি ও কবিতা বিষয়ক আলোচনায় তুলনামূলক আলাদা কোনো প্রশ্ন, উপলব্ধির জাগরণ না করলেও (স্পেসিফিক তথ্য দানে) নন্দন ও শিল্পমুখীনতায় মননশীল হয়ে ওঠেন তিনি।
কাজী মহম্মদ আশরাফ, মোহাম্মদ নূরুল হক ও মামুন রশীদের আরও বেশ কিছু প্রবন্ধ-পাঠোত্তরে তাদের লেখার বিষয় ও করণকৌশলসহ কিছু সূচকে প্রত্যেককে আলাদা করে চেনা যায়। কবি ও গল্পকার কাজী মহম্মদ আশরাফের ‘মৃত্যুর সৃজনশীলতা ও মতবাদ’, ‘পিকাসো প্রেমে শিল্পে’, ‘বাংলা মনুষ্যেতর ছোটগল্পের মানবিক বোধ’, ‘বচনে খনার বচন’, ‘সাহিত্যে যৌনতা’সহ বেশ কিছু গদ্য পাঠে বুঝতে পারি, লেখক বিবিধ সন্নিবেশে বিশ্লেষণসহ গদ্যগুলোকে ঋদ্ধ করেছেন। বিশেষ করে বিষ্ণু দে-কে (বিষ্ণু দে: একালের চোখে) নিয়ে আছে দীর্ঘ প্রবন্ধ। যেখানে বিষ্ণু দে-কে নিয়ে (তার) কবি, কবিতা ও দর্শনের নানা প্রবণতার একটি দলিল তৈরি করেছেন। একটি বাক্যে বিষ্ণু দে নিয়ে কাজী মহম্মদ আশরাফের গভীর জিজ্ঞাসা ও বোধ চোখে পড়ে। তিনি বলছেন—‘‘আজকে বিষ্ণু দে’র মৃত্যুর পঁয়ত্রিশ বছর পরে একজন পাঠক হিসেবে আমার কাছে মনে হয়, বিষ্ণু দে আসলে জেতেননি।” কথাটার মর্মার্থ হিসেবে বলতে পারি, বাংলায় ইউরোপীয় সাহিত্যের (জীবনানন্দ ব্যথীত) কাব্য জানালা খুলে দেওয়া পঞ্চপাণ্ডবের এই নিয়তি বা পরিণতিগুলো অস্বাভাবিক কিছুও নয়।
‘মূল্যবোধের অবক্ষয়’, ‘বাঙালির মননশীলতা ও কল্পনাশক্তি’, ‘বৃত্তাবদ্ধের স্বার্থচিন্তা ও মতাদর্শের দ্বন্দ্ব’, ‘সাহিত্যে দশক বিভাজন’, ‘কবিতার সময় ও মনীষার দান’সহ বেশকিছু গদ্যে কবি ও প্রাবন্ধিক মোহাম্মদ নূরুল হক সৃজনশীলতার পাশাপাশি মননশীলতা জায়গাকে সমৃদ্ধ করছেন। বিশেষ করে, এই সব গদ্যে তিনি নতুন কিছু ভাবনা ও জিজ্ঞাসাকে উসকে দিয়েছেন, যা প্রবন্ধসাহিত্যকে অনেক ঋদ্ধ ও দূরদর্শী (চলমান) করেছে। মোটাদাগে যেমন, ‘বৃত্তাবদ্ধের স্বার্থচিন্তা ও মতাদর্শের দ্বন্দ্ব’ গদ্যে লেখক আমাদের অবদমন ও সমাজচিন্তার সস্তা চিন্তাকার্যক্রমের বিপরীতে একটি গভীর প্রজ্ঞাময় ধ্যান ও বড় সত্য নির্দ্বিধায় স্বীকার করেছেন। লেখক বলছেন—‘অবদমিত মন সবসময় নৈতিকতা-অনৈতিকতার প্রশ্নে দ্বান্দ্বিক। তার কাছে যে কোনো সত্য আপেক্ষিক। সে যা বলে, তা বিশ্বাস করে না, যা বিশ্বাস করে, তা করার সাহস তার থাকে না। বাঙালির এই মানবিক সংকটের কারণে প্রচুর পরিমাণে কালোত্তীর্ণ সাহিত্য রচনা সম্ভব হয় না।’ এছাড়া সমকালীন জাতীয় দুর্ভোগ, দুর্দশা ও অনিয়ম নিয়েও কবি নানা প্রশ্ন তুলেছেন। বিশেষ করে ‘ব্লগার-লেখক-প্রকাশক খুন’, ‘বাঁক-স্বাধীনতার সীমারেখা’, ‘জাতীয় সংগীত বিতর্ক’সহ সমাজ ও রাষ্ট্রের সামসময়িক কিছু ঘটনা, অনিয়ম ও অনীতির ওপর লেখা কিছু প্রবন্ধে তার সমাজসচেতনামূলক প্রত্যয়টি আরও জোরালো ও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
কবি ও প্রাবন্ধিক মামুন রশীদ ‘বাংলা কবিতায় দেশভাগের বেদনা’, ‘বাংলা সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধ’, ‘এ সখি হামারি দুঃখের নাহি ওর’, ‘বাগিচার বুলবুল’সহ কিছু অনুসন্ধানিমূলক গদ্যে দেশভাগ, মুক্তিযুদ্ধ, বিদ্যাপতি, নজরুল নিয়ে (তার আলোচনার) কিছু উল্লেখযোগ্য বিষয় সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা করেছেন। বিশেষ করে বাংলা কবিতায় দেশভাগ ও বাংলা সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধসহ দুটি গদ্যে সামগ্রিক ভাবনায় উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধ ও দেশভাগের প্রতিক্রিয়াজত কবিতাবিষয়ক কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভাবনানিচয়। বিশেষ করে ‘বাংলা কবিতায় দেশভাগের বেদনা’ প্রবন্ধে একটি মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। তিনি বলছেন—‘বাংলা সাহিত্যে খুব অল্প সাহিত্যিকের লেখাতেই দেশভাগ প্রসঙ্গ এসেছে, তার বেদনা অনুভূত হয়েছে। কিন্তু দেশ ভাগকেই সাহিত্যের উপজীব্য করে তোলেননি কেউই।’
গদ্যের ভাষা ও ভাবে সৃজন, মনন ও জ্ঞান-বান্ধব কাজী মহম্মদ আশরাফ। ফলে শিল্পের যেকোনো মাধ্যমে যোগাযোগ বা তথ্যের একটি বিশ্বস্ত প্রতিনিধি হয়ে ওঠেন তিনি। তার গদ্যভাষা সরল। গীতিময় ও প্রবহমান। যা অনেকটা মুখের ভাষার কাছাকাছি।
মোহাম্মদ নূরুল হক গদ্যের ভাষা ও ভাবে সৃজন, মনন ও প্রজ্ঞা-বান্ধব। ফলে শিল্পের যেকোনো মাধ্যমে তুলনামূলক আলোচনায়—পাঠকের প্রশ্ন, ভাবনা বা উপলব্ধির জায়গাকে উসকে দেন তিনি। শব্দ ও বাক্যের যুগল সম্মীলনে গতিময় তার ভাষা, চলিত ও তৎসম শব্দাশ্রয়ী। মাঝেমধ্যে যুক্তবর্ণের বিশেষ ব্যবহার তার ভাষাকে ভাবগম্ভীর করে তোলে।
গদ্যের ভাষা ও ভাবে মামুন রশীদ সৃজন, মনন ও প্রতিশ্রুতিমাণ। যার ভাবনার ভূগোলে কবি ও কবিতাকেন্দ্র আশ্রয় করেছে। ফলে সাহিত্যে কবি ও কবিতা বিষয়ক আলোচনায় তুলনামূলক আলাদা কোনো প্রশ্ন, উপলব্ধির জাগরণ না করলেও (স্পেসিফিক তথ্য দানে) নন্দন ও শিল্পমুখীনতায় মননশীল হয়ে ওঠেন তিনি। তার ভাষা সরল ও প্রবহমান। ভাষায় চলিত ও তৎসম শব্দের ব্যবহার ভাষা কাঠামোকে সুন্দর ও ভাবগম্ভীর করে তোলেন এই গদ্যশিল্পী।
আরও পড়ুন
সাম্প্রতিক প্রবন্ধের তিন কুশীলব ॥ সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
কাজী মহম্মদ আশরাফ ও মোহাম্মদ নূরুল হক: সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য ॥ রাকিবুল রকি
মোহাম্মদ নূরুল হক: একজন প্রাগ্রসর প্রাবন্ধিক ॥ ফারুক সুমন