এক.
হাজার বছরের বাংলা কবিতায় দেখা মেলে নানান তত্ত্বের। আমদানিকৃত এসব তত্ত্বের প্রয়োগে বাংলা ভাষাভাষী কবিরা কতটুকু সফল, সে প্রশ্নের পাশাপাশি আধুনিক যুগরুচির বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী, জাগতিক অন্তর্বেদনা কবিতায় কতটুকু প্রতিভাত, সাম্প্রতিক কবিরা সমষ্টিকে নৈর্ব্যক্তিক সত্তায় বিবেচনা করতেও বা কতটুকু সক্ষম—প্রশ্ন আছে এমন। এরপরও থাকে কবিতায় অলঙ্কারাদি ও নিজস্ব ভাষারীতির প্রয়োগের বিষয়টিও। অস্বীকারের সুযোগ নেই—সব কালের কবিতারই একটা নিজস্ব ভাষারীতি থাকে। কেননা, ভাষার চলমানতা সময়ের মতোই দ্রুতগামী। তবু পূর্বজ কবিদের অভিজ্ঞতালোক, শব্দচেতনা ও ভাষারীতি নতুন কালের কবিরা অতিক্রম করতে পারেন না। ‘মানুষকে যেমন শেকড়ের কাছে যেতে হয়, অস্তিত্বের প্রয়োজনে—কবিতাকেও তেমনি মিথ-উৎস কিংবা ঐতিহ্যলোকের মতো অগ্রজের অভিজ্ঞতালোকেও কখনো কখনো পরিভ্রমণ করতে হয়। নতুন কালের কবিতার বিস্তৃত মূল্যায়নের জন্যে, একটা পূর্ণবৃত্ত কাব্যবস্তু, ভাবলোক ও ভাষারূপ সন্ধানের লক্ষ্যে, হয়তো, কিছু কাল অপেক্ষা করতে হবে।’ বাংলাদেশের কবিতার চেতনাজগত ‘জীবনের বৈচিত্র্য, তার সংঘর্ষ ও গতি, প্রত্যাশা ও অচরিতার্থতা, সংক্ষোভ ও যন্ত্রণা এবং সর্বোপরি সংগ্রাম ও আত্মসন্ধানের সমন্বিত পরিচর্যায় নির্মিত’ উল্লেখ করে ‘কিছু কাল অপেক্ষা করতে হবে’ এমন আশাবাদের কথা শুনিয়েছেন রফিকউল্লাহ খান, তার ‘বাংলাদেশের কবিতা: ভাবরূপের পালাবদল’ শীর্ষক প্রবন্ধে। কিন্তু সাম্প্রতিক কবিতার পটভূমে ‘বাঙালি-মনের রূপ ও রূপান্তরের ইতিহাস কবিতার শিল্পশরীরে’ কতটুকু লক্ষ্যযোগ্য তা নিয়ে প্রায়ই দ্বিধায় পড়তে হয়। কেননা, প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে সমাজ-সংস্কৃতি-রাজনীতি; পাল্টে যাচ্ছে অর্থনীতি, বিশ্ব পরিপ্রেক্ষিতে মানুষ হয়ে উঠছে অসহায়, একা। পারিপার্শ্বিক এসব অভিঘাতে কবি হয়ে উঠছেন বিক্ষিপ্ত, বিচ্ছিন্ন মনের অধিকারী। ফলে সাম্প্রতিক কবিতার শরীরে আলোকসম্পাতে মনে হতেই পারে, কবিদের কেউ কেউ মনে করছেন কেন্দ্রচ্যুত বিচ্ছিন্ন অভিব্যক্তিই কবিতা। কিন্তু খেই হারানো আপাত এই উপলব্ধি কবিতাকে সর্বজনীন চিন্তাভাষ্যে সংগঠিত করতে পারছে কিনা, এমন প্রশ্ন উঠে আসা অমূলক নয়। পাঠক হিসেবে এরকম বহু প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, সাম্প্রতিক কবিতার পাঠ-পরবর্তী অভিজ্ঞতা প্রকাশের নিমিত্তেই এ নিবন্ধের অবতারণা।
দুই.
‘কবিতার ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন’—কাব্যবিশেষজ্ঞরা এমন উক্তি করেছেন। উক্তিটি আপ্তবাক্য হিসেবে নিয়েও বলা যায়, জীবনলগ্ন হতে ব্যর্থ কবিমানস ‘প্রগতিপরায়ণ’ হলেও তার শিল্পিত আত্মপ্রকাশের পথ সর্বৈব সুপ্রশস্ত হতে পারে না। জীবনের পরতে পরতে যে দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের রসায়ন তা আত্মস্থ করে, নিবিড় তপস্যার মাধ্যমে একজন কবি শিল্পশক্তি অর্জন করেন। কবিচেতনার বিবর্তনের সঙ্গে-সঙ্গে কবিতার ভাবরূপ, শব্দ, ছন্দ, অলঙ্কার ও চিত্রকল্পের প্রকৃতিতেও স্বাভাবিক রূপান্তর ঘটে। আবার এ বিষয়টিও বিবেচনায় রাখা জরুরি যে, অসংখ্য গৌণ কবির দেখা মেলে যুগে যুগে। যারা হয়তো যৌথ সময়ের সূচনা ঘটাতে চান, কিন্তু কবিতায় মৌল-গভীরতা সৃষ্টিতে ব্যর্থ হয়ে আবেগী বাক্যবিন্যাসকেই কবিতা হিসেবে দেখতে ভালোবাসেন। কবিতার আধার-আধেয়, ছন্দরূপ, রূপময়তা ইত্যাদি প্রপঞ্চকে মান্য করেন না। একুশ শতকে (দীর্ঘ সময়ে প্রকৃত কবিরা নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ভাঙা-গড়ার মধ্যদিয়ে কবিতাকে আধুনিক করে তুলেছেন) দাঁড়িয়েও কবিযশোপ্রার্থী একদল গৌণ কবি ‘সামাজিক নির্দেশনা দান’কেই কবিতার অন্যতম শর্ত বিবেচনা করেন। চর্যাপদকে ভিত্তি ধরে হাজার বছরেরও বেশিদিনের বাংলা কবিতায় ব্যবহৃত প্রচল শব্দসমষ্টিকে অগ্রাহ্য করে বিদেশি শব্দ (ইংরেজি, আরবি, ফারসি ইত্যাদি) প্রয়োগের সফলতাকে কবিতার মানদণ্ড হিসেবেও বিবেচনা করেন কেউ কেউ। শব্দ প্রয়োগের মানদণ্ড কিসের মাপকাঠিতে নির্ণিত হবে—এমন প্রশ্নেও তারা নিরুত্তর। মানদণ্ডের সুনির্দিষ্ট কোনও ব্যাখ্যাও তারা উপস্থাপনে ব্যর্থ। সাম্প্রতিক কবিতার পাঠসাপেক্ষে পাশাপাশি এটাও উল্লেখ করা যেতে পারে, তরুণ কবিরা নিয়মতান্ত্রিক ছন্দ প্রক্রিয়া থেকে যোজন যোজন দূরে অবস্থান করছেন। অথচ এখনপর্যন্ত যে কবি সাম্প্রতিক কবিদের ঘোরগ্রস্ত করে রেখেছেন, সেই জীবনানন্দ দাশ ছন্দবদ্ধ কবিতা রচনাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। হতে পারে, ছন্দ-অন্বেষণ শ্রমসাধ্য, যে কারণে সাম্প্রতিক তরুণ কবিরা সেদিকে যাচ্ছেন না, বরং স্বতঃস্ফূর্ত ছন্দের দোহাই দিয়ে সহজ উপায়ে কবিখ্যাতি লাভে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। সমকালীন কবি ও কবিতা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উক্তিটি প্রণিধানযোগ্য হতে পারে—‘আজ সাধনাও নাই, সিদ্ধিও নাই; আজ বিদ্যার স্থলে বাচালতা, বীর্যের স্থলে অহঙ্কার এবং তপস্যার স্থলে চাতুরী বিরাজ করিতেছে।’
তিন.
সাম্প্রতিক কবিতাকর্মীদের মুখে ‘উত্তরাধুনিক’ শব্দটি বহুল উচ্চারিত। এছাড়া উচ্চারিত হয়ে থাকে নানান ধরনের ইজম। ‘একশ বছরের বেশি আগে উচ্চারিত এবং সাম্প্রতিককালে অনেকটা অবসিত উত্তরাধুনিকতার ধারণাটিকে আধুনিক কবিতার প্রতিপক্ষ হিসেবে প্রতিস্থাপন করতে চাইছেন’ এক শ্রেণির কবিরা। এরাই ছোট ছোট গোষ্ঠীভিত্তিক কবিতা তৎপরতায় লিপ্ত। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কবিযশোপ্রার্থীদের এই প্রবণতাকে উসকে দিচ্ছে বহুলাংশে। এরা বিশ্বকবিতার পরিপ্রেক্ষিতের সন্ধান (যদিও বিষয়টি দক্ষতা-যোগ্যতার ওপর নির্ভরশীল) না চালিয়ে, কবিতার মর্মার্থ, গূঢ়ত্ব উপেক্ষা করে অজানা এক উন্মাদনার আবর্তে নিজেদের সমর্পিত করে নিজেরাই নিজেদের বাহ্বা দেয়ার চেষ্টায় লিপ্ত। আধুনিকতার মর্ম আত্মস্থ ব্যতিরেকে ‘উত্তরাধুনিকতার’ চর্চা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ, তা সাম্প্রতিক কবিতার শরীরে চোখ দিলেই স্পষ্ট হতে পারে। সাহিত্যের ইতিহাসের তত্ত্বতালাশে জানা যায়, ‘১৯৩৯ সালের বিশ্বযুদ্ধের পর সি. রাইট মিল, অসওয়াল্ড স্পেংলার কিংবা মিশেল ফুকো প্রমুখ আধুনিকতাকে সম্পূর্ণরূপে হটিয়ে দিয়ে উত্তরাধুনিকতাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন, তা বাস্তবে চূড়ান্তভাবে সম্ভব হয়নি আধুনিকতার প্রতিষ্ঠিত ভিত্তির কারণে।’ ‘গোটা পৃথিবীতে উত্তরাধুনিকতার তত্ত্ব নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা চলছে বটে, কিন্তু আলোচনা-সমালোচনা, এমনকি তত্ত্বের প্রতিষ্ঠা দিয়েও প্রমাণিত হয় না, সে ধারাটি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তার ভিত্তি দৃঢ়তা লাভ করেছে।’ এছাড়া বিশ্বকবিতার পরিপ্রেক্ষিতে যেসব সাহিত্য-আন্দোলন সামনে এসেছে তার পেছনে ‘সামাজিক প্রবাহ’ গতিশীল ছিল বলেই কবি, শিল্পী, ঔপন্যাসিক প্রমুখ সৃষ্টিশীল মানুষ নতুন পরম্পরা সৃষ্টি করে একটি সাহিত্যের আধারের ওপর আর একটি সাহিত্যিক আধারকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন। যাদের হাত ধরে আধুনিকতা কবিতার একটি মৌলিক আধার হয়ে উঠেছে, সেই জয়েস, মালার্মে, র্যাবোঁ, ইয়েটস, এলিয়ট, পাউন্ড, লরেন্স প্রমুখ কবি আধুনিক কবিতাকে সারা পৃথিবীর সামনে এক অনিবার্য নিয়তির মতো দাঁড় করিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন। এসব কবির মেধা, মনন, আত্মমগ্নতা, নানামুখী সফল পরীক্ষা-নিরীক্ষায় আধুনিকতা একটি সময়-অতিক্রমী প্রপঞ্চ হিসেবে মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে। অথচ কবিযশোপ্রার্থীদের বিশ্বকবিতা সম্পর্কিত অভিজ্ঞতার পরিসর বিস্তৃত না হওয়ার কারণে সেই ‘অবসিত’ উত্তরাধুনিকতার ধুয়া তুলছেন, যা সাম্প্রতিক কবিতায় এক ধরনের সংকট তৈরি করছে। যদিও কেউ কেউ মনে করেন বাংলা ভাষার কবিদের (সাম্প্রতিক) ‘সংকট’ মূলত অতিমাত্রায় পাশ্চাত্যমুখীনতা। বাংলায় বিশ্বকবিতার যোগসূত্র বলতে কবিতার আঙ্গিক প্রাধান্য পেতে পারে, অর্থাৎ কবিতার উপস্থাপনা। যেটা করেছিলেন তিরিশের কবিরা। বস্তুত যেদেশের পটভূমে কবিতা নির্মাণ হবে, সেই দেশের সংস্কৃতি-অনুসংস্কৃতি-ঐতিহ্য অনুসারেই হওয়া বাঞ্ছনীয়। এতে কাব্যভাষা স্বতন্ত্র হওয়ার দাবি রাখে। কবিতায় নিজ দেশের ঐতিহ্য উপস্থাপনের পাশাপাশি কবিদের অভিনিবেশ হওয়া দরকার সেই ভাষাটাই কবিতায় তুলে আনা যা আগে কেউ আনেনি। পক্ষান্তরে সাম্প্রতিক কবিদের কবিতা পাঠে এমনটি মনে হওয়া অসঙ্গত নয় যে, শত শত কবিযশোপ্রার্থীরা সবাই মিলে যেন একটি কবিতাই রচনা করে চলেছেন! কবিতা (!) থেকে লেখকের নাম উহ্য রাখলে বোঝার উপায় নেই, কোনটি কে লিখেছেন। সাম্প্রতিক কবিতায় এ বিষয়টিকেও বড় সংকট হিসেবে দেখা যেতে পারে।
কবিতায় ইঙ্গিত প্রদানের ওপর সব যুগেই জোর দেওয়া হয়েছে। বলার ভেতর দিয়ে কবিতা যতটা বিকশিত; না বলে তার চেয়েও অধিক প্রস্ফুটিত। তবে কবিতা শুধু শব্দের ঝঙ্কারে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। ‘কবিতার ভেতর থাকে কবির একান্ত অনুভব ও সাধনা। কবিতার বিষয়বস্তু শেষ পর্যন্ত কোথায় শেষ হবে তা আগে থেকে ভাবা যায় না। তবে সচেতনভাবে খেয়াল রাখতে হয় শব্দ, ছন্দ কিংবা বাক্যবুননের দিকটা। কবি কবিতাকে জাগিয়ে তুলতে চান শব্দের বন্ধনে। যা পাঠকের অনুভব অনুভূতিতে দাগ কাটে, পাঠককে বিস্ময়াভিভূত করে। শেষপর্যন্ত পাঠকের মননে রস সৃষ্টিকারী কবিতাই প্রকৃত কবিতা হিসেবে চিহ্নিত হয়। কবিতার মৌলদায়ও তাই। অথচ সাম্প্রতিক কবিরা ইনিয়ে-বিনিয়ে, শব্দচাতুর্য তৈরির মাধ্যমে নিজেকে চেনাতে ‘উঠেপড়ে’ লেগেছেন; বিষয়টিকে এক ধরনের ‘অপচেষ্টা’ বললেও অসমীচীন হয় না। হতে পারে, বর্ণাঢ্য ও কাব্যিক জীবন যাপনের পূর্বেই কবিখ্যাতির মোহ অক্টোপাসের মতো ঘিরে ধরেছে সাম্প্রতিক কবিসত্তাকে। এতে আধুনিক বাংলা কবিতা নিয়ে যে সম্ভাবনা কিংবা আশাবাদের কথা উচ্চারণ করেন কবিতাবোদ্ধারা, এই ‘মোহ’ সর্বগ্রাসী হয়ে সব সম্ভাবনার অকাল মৃত্যু ঘটাতে উদ্যত; এমন আশঙ্কা স্বাভাবিকভাবেই সামনে আসে।
মানুষমাত্রই আত্মজিজ্ঞাসাপীড়িত। সমাজের নানান অসঙ্গতি দেখে মর্মাহত হন বিবেকবান মানুষ। একজন কবিও মানুষ। সুতরাং তিনিও মননে দ্রোহ লালন করেন। ফলে কবিতায় কবির পুঞ্জিভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশও অমূলক নয়। কবিতা যেহেতু শিল্পিত প্রকাশমাধ্যম, সেখানে ক্ষোভ-রাগ-অভিমানের প্রকাশও সঙ্গত কারণে শৈল্পিক। একজন প্রকৃত কবি তখনই কবিতা সৃষ্টিতে সার্থক হন, যখন কবি শুধু বিষয়বস্তুর সন্ধানে ব্রতী না হয়ে নিজের মতো করে দৃশ্য সৃষ্টিতে নিমগ্ন থাকেন। এতে কবিতা হয়ে ওঠে পরাবাস্তব জগতের এক ভিন্ন কোলাজ। অথচ সাম্প্রতিক কবিতার গভীর এবং দীক্ষিত পাঠেও ‘কবির নিমগ্নতা’ আবিষ্কার করা কঠিন। কবিতার শরীরে সস্তা দেহজ কাঙ্ক্ষা, শব্দ-চাতুরতা ও আবেগের ফল্গুস্রোত ‘ভাদ্রের নদী’র মতোই প্রবহমান। কখনো কখনো কারও কবিতায় সর্বজনীন চিন্তার গূঢ়ত্বের আভাস মিললেও কবিতা স্রষ্টার গভীর অভিনিবেশের ঘাটতিজনিত শূন্যতায় সার্বিক রচনাটি কবিতা পদবাচ্যে গৃহিত হওয়ার পথে সংশয় তৈরি করছে।
চার.
বিশ্বকবিতায় ফরাসি সিম্বলিজম, একজিস্টেন-শিয়ালিজম, ফিউচারিজম, ইম্প্রেশনিজম কিংবা স্যুরিয়ালিজমের মতো আন্দোলনগুলো ছিল সময় ও কালকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এক দৃঢ় অঙ্গীকার। এসব আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, কবিগোষ্ঠীর হাতে ‘নতুন প্রপঞ্চ বিনির্মাণের আগে পূর্ববর্তী সামাজিক, রাষ্ট্রিক, অর্থনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় রেখেই কবিদের এগোতে হয়। একটি নতুন সাহিত্য-আন্দোলন দানা বাঁধে তখনই, যখন তার সম্পূর্ণ উপাদান সমাজদেহের অভ্যন্তরে একটু একটু করে বেড়ে উঠতে থাকে।’ বাংলায়ও কয়েকটি কবিতা আন্দোলনের তথ্য মেলে। ষাটের দশকে পশ্চিম বাংলার ‘হাংরি জেনারেশন’ বা ‘শ্রুতি আন্দোলন’ কিংবা বাংলাদেশের ‘স্যাড জেনারেশন’ তাদের মেনিফেস্টোয় যে বিষয়গুলোর প্রতি গুরুত্বারোপ করেছে, সেই আধুনিকতার মধ্যে উত্তরাধুনিকতার চেয়েও ভয়াবহ আত্মঘাতী প্রবণতা লক্ষ্যযোগ্য। ‘হাংরি আন্দোলন’ বাংলা কবিতায় বাঁক পরিবর্তনের একটি স্পষ্ট ইঙ্গিত দিলেও শেষপর্যন্ত পুরোপুরি সফলতা পায়নি। তবে এ আন্দোলনের পর আলোকপ্রাপ্তির যুক্তিবোধ, যৌন স্বাধীনতা, শৃঙ্খলমুক্তির ঔদার্য ইত্যাদি প্রপঞ্চ হিসেবে পরবর্তী কবিতায় স্থান করে নেয়। বলাই বাহুল্য, বিচ্ছিন্নতা, অনৈক্য, নিঃসঙ্গতা, সংস্কৃতির পচন, অবক্ষয় সমাজেরই একটি প্রপঞ্চ। সাম্প্রতিক কবিরা বিশৃঙ্খলাকে প্রাধান্য দিয়ে ভাঙনে আস্থা রেখেছেন, এমনটি লক্ষ করা যায়। তাই সাম্প্রতিক কবিতা হয়ে উঠছে সংশয় ও সংকটের প্রতিনিধি। পরিবর্তিত এই পরিস্থিতিতে কবিতা হয়ে উঠছে জনবিমুখ। কখনো ‘ভাষা হয়ে পড়ছে সংকেতের দ্বারা অন্তঃসত্ত্বা, ভাব পেয়ে যাচ্ছে ব্যঞ্জনা, কবিতা আসছে এগিয়ে এবং সে কবিতার সবটা শরীর সংকেতের এই সূক্ষ্ম অশরীরী উপস্থিতির দ্বারা এমনভাবে আক্রান্ত যে, কবিতার মূল কাব্যগুণ থেকে তাকে আলাদা করে দেখা সম্ভব নয়। আবার রহস্যময়তা ও জীবনজটিলতার প্রতীকী ব্যঞ্জনা কোনো কোনো ক্ষেত্রে কবিতাকে নির্মেদ গতিময়তা এনে দিলেও সাম্প্রতিক কবিদের সংশয়বাদী মানসিকতা সমষ্টিগত সৌন্দর্যচেতনার ধারা কবিতায় তুলে আনতে সামগ্রিকভাবে ব্যর্থ হচ্ছে, এমনটি অনুমান করা যায়।
পাঁচ.
আধুনিক বাংলা কবিতা ত্রিশের কবিদের হাত ধরে ব্যাপক পরিবর্তিত হলেও, কবিতা রচনায় কোনো একটা বিশেষ সংজ্ঞার একচেটিয়া প্রভূত্ব কেউ কোনো দিন মেনে নেননি। মেনে না নেওয়ার আসল কারণটা বোধ হয় কবিতার সংজ্ঞার চেয়ে, কবিতার বোধকে অনেক গভীরে বিবেচনা করা। জীবনানন্দ দাশ সজ্ঞানেই বলেছেন ‘কবিতা অনেক রকম’। হতে পারে, এ কারণে প্রচল-অপ্রচল শব্দের জটাজাল সৃষ্টি করে কেউ কেউ কবিতাকে ‘রহস্যময়’ আখ্যা দিচ্ছেন। এ শ্রেণির কবি ‘বাহুল্য শব্দের ঝঙ্কার’কে কবিতা হিসেবে বিবেচনা করছেন। অস্বীকারের সুযোগ নেই যে, ‘কোনো নতুন প্রপঞ্চ বিনির্মাণের আগে তার পূর্ববর্তী সামাজিক, রাষ্ট্রিক, অর্থনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় রেখেই কবিদের এগোতে হয়।’ কিন্তু পরিবর্তিত বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে সাম্প্রতিক কবিরা কবিতার নতুন পরম্পরা সৃষ্টিতে স্বাভাবিকভাবেই ব্যর্থ হচ্ছেন, ফলে পাঠকসমাজে সাম্প্রতিক কবিতার গ্রহণযোগ্যতা হারাচ্ছে। বলাই বাহুল্য, যাদের হাত ধরে ‘আধুনিকতা’ কবিতার একটি মৌলিক আধার হয়ে উঠেছিল, সেই জয়েস, মালার্মে, র্যাঁবো, ইয়েটস, এলিয়ট প্রমুখ কবি আধুনিক কবিতাকে বিশ্বময় অনিবার্য এক নিয়তির মতো দাঁড় করিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। সাম্প্রতিক কবিরা কবিতায় নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা জানালেও ‘আধুনিকতা’কে একটি সময়-অতিক্রমী প্রপঞ্চ হিসেবে মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে সাম্প্রতিক কবিতা সামগ্রিকভাবেই একশ্রেণীর কবিযশোপ্রার্থী, গৌণ কবিদের আত্মঅহমিকা প্রকাশের ধূর্তরূপ বৈ অন্য কিছু নয়।