কর্মজীবন কী হবে, তা নিয়ে ভাবা বিদ্যায়তনিক ছাত্রজীবনের শেষ পর্বে যখন খুব জরুরি হয়ে উঠেছিল, তখন আমার সামনেও ছিল সাংবাদিকতার হাতছানি। ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের অনেকেই যারা গতানুগতিক জীবন যাপন করতে চাননি, সংবাদপত্রের সঙ্গে যুক্ত হলেন তাদের অনেকেই। পেশাগত সাফল্যে উচ্চে অবস্থান করতে না পারলেও জোর দিয়ে চাইলে হয়তো আমিও সাংবাদিকতায় যেতে পারতাম। কিন্তু ইচ্ছে করেই ওদিকে পা বাড়াইনি। কারণ আমার মনে ছিল এমন এক বদ্ধমূল ধারণা যে, সাংবাদিক বা কলামিস্ট হলে লেখক হওয়া যায় না। এই ধারণার মূল কারণ সাংবাদিককে এমন অনেক কথা লিখতে হয় যার সঙ্গে লেখকসত্তার বিরোধ ঘটে। অর্থাৎ লেখক হওয়ার সঙ্গে সাংবাদিক হওয়ার প্রধান বৈপরীত্য সত্তার স্বাধীনতা নিয়ে। লেখকের সত্তা স্বাধীন। তিনি লেখেন মুক্ত মনে। অন্যদিকে সাংবাদিকের সত্তা সংবাদপত্রের নীতির সঙ্গে সম্পর্কিত। ফলে সাংবাদিকের পক্ষে পুরোপুরি মুক্তমনা হওয়া সম্ভব নয়। লেখক তার চিন্তাকে যথাযথভাবে প্রকাশ করার জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে পারেন। সাংবাদিককে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যা বলার তা বলে ফেলতে হয়। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই বক্তব্য বা অনুসন্ধান পরিণত হয়ে ওঠার অবকাশ পায় না।
সাংবাদিককেও যেমন লিখতে হয় ঘটে যাওয়া ঘটনার ভাষ্য তেমনি লেখককেও লিখতে হয় তা। কিন্তু সাংবাদিকের প্রধানত দায় বিবরণ দানের, লেখকের দায় উপলব্ধ সত্যের কাছে। লেখকের আরব্ধ ঘটনার অন্তর্নিহিত ভাষ্য রচনা, আর সাংবাদিকের প্রধান দায় সাম্প্রতিকতম অগ্রগতির চিহ্ন উপস্থাপন। আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে আমার কাছে সাংবাদিকের সবচেয়ে যেটা অপছন্দ ছিল, সেটা হচ্ছে অনর্গল লিখে ফেলা। লেখার সময় ভাষাগত পরিশীলনের চেয়ে ঘটমানতাকে ধারণ করার গুরুত্ব সাংবাদিকতায় বেশি বলেই হয়তো খবরের কৌতূহল নিবৃত্ত হয়ে গেলে সাংবাদিক রচনার তেমন মূল্য থাকে না। ফলে একটা সময়ের বিরাট গুরুত্বপূর্ণ রচনাও স্বল্প সময়ের ব্যবধানে গুরুত্ব হারায়। লেখকের রচনাও হয়তো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দীর্ঘয়ু হতে পারে না, কিন্তু লেখকের লেখা তো দীর্ঘায়ুতার অভিপ্রায়ী, সাংবাদিকের রচনার মতো তাৎক্ষণিকায়ু নয়! লেখককেও যেমন কাগজে কলম ঘষে বা কম্পিউটারের কী চেপে লিখতে হয়, সাংবাদিককেও করতে হয় তা-ই! কিন্তু এই একই যাত্রায় লেখক ও সাংবাদিকের ফল হয় ভিন্ন।
নিজে গভীরতর সাহিত্যিক অভিনিবেশের মধ্যে থেকেও অনেকটা আকস্মিকভাবেই সাপ্তাহিক সংবাদপত্রের সম্পাদকতা করেছি কিছুটা সময়। মাঝে বছর সাতেক পেশাগত কারণে গণমাধ্যম থেকে তথা সাংবাদিক আবহ থেকে বেশ কিছুটা দূরেই থাকতে হয়েছিল আমাকে
সাংবাদিককে চিন্তার পরিণতির লক্ষ্যে অপেক্ষা করার উপায় নেই বলে অনুশীলনে লেখকসত্তার যে সবচেয়ে বড় আরব্ধ মননশীলতা, তার ভাটা পড়ে। আবার সাংবাদিকের কাছে আধেয় যতটা গুরুত্বপূর্ণ আধার ততটা নয়। লেখকের কাছে আধার ও আধেয় সমান গুরুত্বের। বন্ধুদের সঙ্গে এসব নিয়ে কত তর্কই না হতো যৌবনের মধ্যাহ্নে! তখন আমার মন সাহিত্যের দিকেই ঝুঁকে থাকতো বলে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নেওয়ার সাহস পাইনি।
ধীরে ধীরে দিন গেছে। জীবনের অভিজ্ঞতার সঞ্চয় বেড়ে উঠেছে ক্রমশ। এক সময় অনুভব করেছি, সাংবাদিকতা করেও হয়তো সাহিত্যিক হওয়া যায়। কিন্তু তার জন্য দরকার বিশেষ ধরনের মনোগঠন, যা কারও কারও থাকলেও আমার নেই। সাংবাদিকতা পেশার বৈশিষ্ট্য আমার কাছে এতটাই সাহিত্যিকতার বিরোধী মনে হতো যে, আমার পক্ষে এর ধারেকাছে থাকতেই ইচ্ছে হতো না। কিন্তু আশ্চর্য আমার নিয়তি যে, সাংবাদিকতা বা গণমাধ্যমের নানা তৎপরতার আঁচের মধ্যেই আমাকে থাকতে হয়েছে জীবনের বড় অংশজুড়ে। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠালগ্নে যুক্ততার সূত্রে একসময় সংবাদপত্রের ভুবনের মানুষদের সঙ্গেই কাজ করতে হয়েছে। থাকতে হয়েছে সংবাদপত্রের নৈকট্যে। নিজে গভীরতর সাহিত্যিক অভিনিবেশের মধ্যে থেকেও অনেকটা আকস্মিকভাবেই সাপ্তাহিক সংবাদপত্রের সম্পাদকতা করেছি কিছুটা সময়। মাঝে বছর সাতেক পেশাগত কারণে গণমাধ্যম থেকে তথা সাংবাদিক আবহ থেকে বেশ কিছুটা দূরেই থাকতে হয়েছিল আমাকে। কিন্তু চ্যানেল আইয়ের সঙ্গে যুক্ততার সূত্রে দীর্ঘ তেরো বছর তো সাংবাদিকতার গহ্বরেই বাস করেছি।
সত্যি বলতে কী, আমার সাংবাদিকতার এই আঁচ আমার সাহিত্যিকতাকেই সারবস্তু জুগিয়েছে। আর এখন তো নিউইয়র্কে এসে পেশাগত সাংবাদিকের দায়মোচনের চেষ্টাতেই রত আছি। কিন্তু তার পরও অনুভব করি সত্তায় আমি সাহিত্যিক। সাংবাদিকতা আমার সাহিত্যিকতার উপকরণ মাত্র। কারণ আমি চিন্তা করে দেখেছি সাংবাদিকতা বলতে প্রকৃত অর্থে যা বোঝায়, তার অনুশীলন করা নিউইয়র্কের বাংলাদেশি জনসমাজে এখনো সম্ভব নয়। সেই অনুশীলনের আভাস এখনো দেখা যায় না। কবে সেই স্তরে এই অঞ্চলের জনসমাজ উত্তীর্ণ হবে, তা কে জানে!