সাহিত্য পাঠে যখন পাঠকের স্পৃহা মেটে, তখন সমালোচক কী ভূমিকা পালন করেন? সাহিত্যের রস আস্বাদনের জন্য কখনো কখনো ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয়। সমালোচক সে অর্থে অনেকটাই সাহিত্যের ব্যাখ্যাদাতা। সমালোচক সাহিত্যের আপাতত দুর্বোধ্য বিষয়কেও পাঠকের কাছে সহজবোধ্য করে তোলেন; সৎ সমালোচক প্রায় প্রশ্নশীল। সমালোচকের জিজ্ঞাসাই কবি-সাহিত্যিককে আপন কর্তব্যপালনে সচেতন করে তোলেন। কবি-কথাশিল্পী বুঝতে পারেন, সাবলীল সৃষ্টি আর কষ্টকল্পিত রচনার পার্থক্য; সৃজন আর তৈরির পার্থক্য। একটি বিশেষ সময়ে একজন সৎ সমালোচকের অভাবে সাহিত্য প্রগল্ভতার স্রোতে ভেসেও যেতে পারে। সমালোচক মুগ্ধতা প্রকাশ করবেন, পাণ্ডিত্য নয়। যিনি পাণ্ডিত্য দেখান, তিনি সাহিত্যবান্ধব নন।
সাহিত্য কি সব সময় স্বকীয়তার প্রশ্নে অনাপসপ্রবণ? কখনো-কখনো গণরুচির উপচারেও পর্যবসিত হয়? সমর্পণের মূলে জনপ্রিয়তার মোহ যেমন ক্রিয়াশীল, তেমনি আর্থিক সম্পর্ক। আর্থিক সঙ্গতি-অসঙ্গতির ওপর নির্ভর করে শিল্পীর সামাজিক মর্যাদাও। দীপ্ত-দৃপ্ত প্রতিভাবানকে সমাজ করুণা করে মাত্র, তার কর্মবিশ্বকে মূল্যায়ন করে না। স্থান হয় না সমাজের দশজনের শোভন সভায়ও। তাই তার জন্য প্রয়োজন যথাযথ পদক্ষেপ। সে পদক্ষেপ ব্যক্তি নিজের জন্য নিজে গ্রহণ করতে পারেন না। ব্যক্তি নিজের প্রয়োজনে যে কথা বলতে কুণ্ঠাবোধ করেন, অন্যের জন্য সে কথা জোর গলায় বলতে পারেন। এটা পরোপকারীর স্বভাব। নিজের জন্য কিছু চায় না, অন্যের দাবি আদায়ের ক্ষেত্রে দৃঢ়চেতা। প্রকৃত সমালোচকও ওই চরিত্রের অধিকারী। সৃজনশীল রচনা পণ্য নয়; পণ্যসম্মত। সমালোচনা তার প্রায়-বিপণন ব্যবস্থা—বিজ্ঞাপনের সগোত্রীয়। এর কারণ প্রচার-কৌশল? মূল্যায়নের অভাব নয়?
কেবল সৃষ্টির ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে সরাসরি পাঠকহৃদয় জয় করা সব সময় সম্ভব হয় না। সৃজনশীলতার মৌল প্রবৃত্তি আত্ম-উন্মোচন ও আত্মপ্রকাশ। এ দুটি কাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য উপযুক্ত মাধ্যম প্রয়োজন। সে মাধ্যমই সমালোচক। যিনি ভালো-মন্দের তারতম্য নির্ধারণ করবেন, তার আলোচ্য বিষয়ে পরিপূর্ণ ধারণা থাকা জরুরি। না-হলে সমস্ত রচনা কেবল হাতড়ানোয় পর্যবসিত হবে। সমালোচকের প্রধান কাজ মুগ্ধপাঠ; এরপর নির্বাচন। এক্ষেত্রে সমালোচক স্বাধীন ও সার্বভৌম। কোনো প্ররোচনা নয়, নিজের মনোসমর্থনই তার নির্বাচন-প্রক্রিয়ার প্রধান সহায়ক। অসংখ্য সাহিত্যকর্ম থেকে আলোচনার জন্য নির্বাচন করার ক্ষেত্রে তার রুচিবোধ, প্রজ্ঞা বৌদ্ধিক দীপ্তির স্বাক্ষরও তাকে রাখতে হয়। ফলে আলোচ্য সাহিত্যকর্মের সপ্রশংস সারবত্তা রচনা করা আলোচকের মৌল দায় হয়ে দাঁড়ায়। সে দায় পালনে আলোচক কতটা প্রজ্ঞাপূর্ণ, তার ওপরই নির্ভর করে তার আলোচ্য বিষয়বস্তু।
আলোচককে সর্বজ্ঞ না হলে চলে না; আলোচ্য বিষয়ে পরিপূর্ণ ধারণা থাকা চাই। অত্যল্প ধারণার ওপর ভিত্তি করে কালাপাহাড়ি মন্তব্য করা আলোচকের উচিত নয়। আলোচ্য বিষয় প্রকরণগত দিক থেকে প্রথাগত, না নতুন; সে-ই বিশ্লেষণ আলোচনাকে পূর্ণতা দেয়। কেবল মন্তব্যপ্রধান আলোচনায় নিজের জ্ঞানের পরিধি পাঠককে জানানো সম্ভব হয়তো, কিন্তু সে সংবাদে পাঠক বিতৃষ্ণও হতে পারেন। তাই সমালোচককে মননশীল ও সহৃদয়সংবেদী হতে হয়। প্রকরণসংক্রান্ত অপূর্ণ ধারণার ওপর ভিত্তি করে কালাপাহাড়ি মন্তব্য সম্ভব হলেও প্রকৃত আলোচনা দুঃসাধ্য। কবিতার ক্ষেত্রে ছন্দ-উপমা-চিত্রকল্প-আঙ্গিক, কথাসাহিত্যে চরিত্র অঙ্কন, ঘটনার পারম্পর্য এবং সংলাপের বিশ্বস্ততা প্রসঙ্গে যৌক্তিক আলোচনা গুরুত্ব বহন করে।
কবিতার আলোচকদের দু ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করতে দেখা যায়। প্রথম দল ছন্দের দাসত্ব মেনে মাত্রাগণনার নির্ভুল হিসাবকেই ছন্দসিদ্ধি ভাবেন, দ্বিতীয় দল ছন্দমুক্তির নামে ছন্দ-উচ্ছেদকেই অদ্বিতীয় পথ জানেন। তাই শুমারি-সমালোচক কবিতায় এক মাত্রার হেরফের হলেই ছন্দপতনের অভিযোগে কবিতাকে খারিজ করেন। আর ছন্দজ্ঞানহীন আলোচক ছন্দহীন প্রগল্ভতাকেই গদ্যছন্দ বলে নিজের ছন্দজ্ঞানের পরিচয় দিতে আগ্রহ দেখান বেশি। প্রায় দেখা যায়—কবিতায় কোনো একটি নতুন শব্দ একাধিকবার ব্যবহৃত হলে সমালোচক খুঁত ধরে বসেন। সমালোচক সেখানে ওই বিশেষ শব্দের প্রতি কবির বশ্যতা খুঁজে পান। সমালোচকের বোধে নাড়া দেয় না—ওই শব্দটির প্রায়োগিক কৌশল ভিন্ন কি না! কবিসৃষ্ট নতুন শব্দ পুরো একটি বইতে কবি একাধিকবার ব্যবহার করেন শব্দটির স্বতঃসিদ্ধতা অর্জনের জন্য। কিন্তু কাব্য-সমালোচক অভিধানের বাইরে যেতে না পারার কারণে কবির বিরুদ্ধে তোলেন শব্দ-দৈন্যের অভিযোগ।
প্রকৃত সত্য, কবিসৃষ্ট নতুন শব্দের মাত্র দু বার ব্যবহারও চোখে পড়ে বেশি। এর কারণ শব্দটা নতুন, আলোচক ইতোপূর্বে এ ধরনের শব্দ না দেখার কারণেই তার কাছে ওই বিশেষ শব্দের দুবার প্রয়োগও বহুবার বলে মনে হয়। অথচ এ শ্রেণীর আলোচক ভেবেও দেখেন না, অসংখ্য পুরাতন ও প্রথাগত শব্দ একই কবিতায় দশ-পনেরো-বিশবারও ব্যবহৃত হয়। তখন কবির বিরুদ্ধে শব্দের প্রতি আনুগত্যের অভিযোগ তোলেন না।
সমালোচক যতক্ষণ সুলুকসন্ধানী, ততক্ষণ সাহিত্যবান্ধব। ছিদ্রান্বেষী সমালোচকের কাছ থেকে সাহিত্য যোজন যোজন দূরত্ব রচনা করে।
এ শ্রেণীর কাব্যসমালোচককেই কি লিও টলস্টয় খুন করতে চেয়েছিলেন? কথিত আছে, লিও টলস্টয় কবিতার সমালোচককে কুকুর বলেই গালি দিতেন। বুক রিভিউয়ারকে দিতেন হত্যার হুমকি। বলতেন, ‘কিল দ্য ডগ হি ইজ আ রিভিউয়ার’। নিছক বিতৃষ্ণা থেকে গালি দিতেন? বুক রিভিউয়ারদের বিরূপ আচরণের কারণে লেখকের হৃৎস্পন্দন বন্ধ হওয়ারও উপক্রম হয়। সে কারণেই এমন গালি দিতে বাধ্য হয়েছিলেন হয়তো। এ শ্রেণীর সমালোচক কবির শব্দব্যবহারের বহুরৈখিক শক্তিমত্তা দেখে বিস্মিত হন না, বরং নিজের জানার পরিধি জানানোর চেষ্টা করেন। এ ধরনের সমালোচককে ইয়েটস, জীবনানন্দ দাশ টেকো মাথা, ঝুনো পণ্ডিত, অক্ষম অধ্যাপক বলে তিরস্কার করেছেন।
প্রত্যেকেই একই ধরনের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলেন বলেই একই রকম শব্দ ব্যবহার করেছেন। এ শ্রেণীর সমালোচকেরা একই সমস্যা সৃষ্টি করেন গল্প কিংবা উপন্যাসের ক্ষেত্রেও। অগ্রজ কবি-সাহিত্যিকের সাহিত্যকর্ম থেকে আলোচ্য কবি-সাহিত্যিকের সাহিত্যকর্ম কী করে স্বাতন্ত্র্য অর্জনে সক্ষম, তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। সে সঙ্গে অগ্রজ-অনুজের সাহিত্যকর্মের তুলনামূলক ও বিশেষণাত্মক আলোচনাও। ব্যত্যয়ে মন্তব্যসর্বস্ব আলোচনায় পাঠক মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। অধ্যাপকীয় সমালোচকের মূল সমস্যা—অতীতের পাঠলব্ধ ধারণার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ কোনো বিষয়কে সহজে গ্রহণ করতে পারেন না। ফলে তারা বানানের ভুল শনাক্তি, শব্দের পুনরাবৃত্তি, কবিতায় ব্যবহৃত শব্দটি সমাসবদ্ধ না সন্ধিনিষ্পন্ন—এ তর্কেই সীমাবদ্ধ থাকেন। এ ক্ষুদ্রবৃত্ত ভেঙে হৃদয়ের ঔদার্য দেখাতে পারেন না।
অধ্যাপক-আলোচক কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈতরণী পাওয়ার জন্য যা পড়েছিলেন, এর বাইরের কিছু পড়ার সুযোগ তাদের ঘটে না। একদা পাঠলব্ধ ধারণার বাইরেও নতুন চিন্তার ভূমি থাকতে পারে, তারা বিশ্বাস করেন না। না হলে কেন তাদের আলোচনায় ঘুরেফিরে গল্পসংখ্যা, কবিতাসংখ্যা আর অগ্রজের প্রভাব উল্লেখ থাকে? কেন এ ধারা? কথাসাহিত্যের ক্ষেত্রে ঘুরেফিরে মুদ্রণপ্রমাদ-চরিত্র-কাহিনী-পটভূমির একরৈখিক আলোচনার সীমাবদ্ধতা থেকে বের হওয়ার উপায় কী? চরিত্রের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণপূর্বক, কাহিনীর বৈচিত্র্য, সামঞ্জস্য, সংলাপের অকৃত্রিম রূপ নিয়ে আলোচনাও প্রথাগত ধারাকে পরিবর্তিত রূপে নিয়ে যেতে পারে।
মুদ্রণপ্রমাদকে যে সমালোচক সাহিত্যের গুরুতর ত্রুটি হিসেবে শনাক্ত করেন, তিনি নিন্দুক; ব্যাকরণ ও অভিধান-বান্ধব, কিন্তু কবিতার শত্রু। মুদ্রণপ্রমাদ সংশোধন সম্ভব। সংশোধন শেষে পরিশুদ্ধ সংস্করণ পাঠকের সামনে উপস্থিত হলে, উপস্থিতকালের আলোচনা পরবর্তীকালে অন্তঃসারশূন্য হয়ে পড়ে। প্রকৃত সমালোচনা মূলত পাঠোদ্ধারমূলক, বিশ্লেষণাত্মক হওয়া উচিত; সপ্রশংসও। সাক্ষাৎ ছন্দপতন, নিয়মের লঙ্ঘন (নিয়মের ব্যতিক্রম নয় কোনোমতেই) আলোচকের দৃষ্টিগোচর হলে সে সম্পর্কে পরামর্শ চলে; কিন্তু এ সামান্য ত্রুটিকে সার্বিক ত্রুটি হিসেবে বিবেচনা করা চলে না। যে বই আলোচককে সন্তুষ্ট করতে পারে না, সে বই সম্পর্কে চুপ থাকাই উচিত। কারণ, পাঠকের রুচিভেদে বইয়ের গুরুত্বও পরিবর্তিত হতে পারে। আবার একই পাঠক-সমালোচকেরও সময়ে রুচির পরিবর্তন ঘটে। যে বিষয় সম্পর্কে দীর্ঘকাল নেতিবাচক ধারণা পোষণ করা হয়, সে বিষয়ই ইতিবাচক ধারণার জন্ম দেয়। তখন আলোচক নিজেও নিজের কাছে অর্বাচীন হিসেবে বিবেচিত হতে পারেন। সুতরাং, নেতিবাচক মন্তব্যসর্বস্ব সমালোচনা করার আগে আলোচককে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হতে হয়।
আলোচকের আলোচনা পড়ে পাঠক আলোচ্য বই সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে ওঠার পরিবর্তে বিতৃষ্ণ বা বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠলে লেখকের ক্ষতি সাময়িক, আলোচক চিরদিনের জন্য ঘৃণার্হ হয়ে ওঠেন। মহীবুল আজিজ ‘সহিতত্ত্বের তত্ত্ব’ শীর্ষক এক গদ্যে লিখেছেন, ‘সাহিত্যতত্ত্বের সর্বজনীনতা আজ প্রশ্নের সম্মুখীন। প্রচলিত তত্ত্বে, একটি নির্দিষ্ট সময় বা স্থানে ব্যবহৃত তত্ত্ব বা দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা নানান স্থানের সাহিত্যের সমালোচনা বা বিশ্লেষণসঙ্গত কি না, সে বিষয়ে বিকল্প ও সমান্তরাল ভাবনারাজি ক্রমউদীয়মান।’ সাহিত্য সমালোচনায় সর্বজনীন কোনো রীতি মেনে চলা হয় না। একজন সমালোচকের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সমকালীন কিংবা অগ্রজ অন্যান্য সমালোচকের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য থাকা স্বাভাবিক।
কোনো বিশেষ সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে চূড়ান্ত নেতিবাচক মন্তব্য করার আগে ঘটনাপরম্পরা বিবেচনা করাই সঙ্গত। আত্ম-উদ্বোধনের অনুষঙ্গে আত্মজিজ্ঞাসায় নিমগ্ন হতে হয় আলোচককে। তবেই আলোচক কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে নিজে পৌঁছুতে পারেন, পারেন পাঠকবর্গকেও সঙ্গী করতে। অনেক সময় আলোচকের বোধের সীমাবদ্ধতার কারণে মূলের পাঠোদ্ধার সম্ভব হয় না। তখন কোনো-কোনো আলোচক নিজের সামর্থ্যহীনতার কথা স্বীকার না করে লেখকের ত্রুটি সন্ধান করেন। একথা ভুলে গেলে চলবে না, লেখকের ত্রুটি সন্ধান করেন ছিদ্রান্বেষী, সুলুকসন্ধানী আবিষ্কার করেন বিস্ময়। সমালোচক যতক্ষণ সুলুকসন্ধানী, ততক্ষণ সাহিত্যবান্ধব। ছিদ্রান্বেষী সমালোচকের কাছ থেকে সাহিত্য যোজন যোজন দূরত্ব রচনা করে।
সাহিত্য সমালোচনা প্রকৃতপক্ষে বুদ্ধির ব্যায়াম নয়, সহৃদয়তা প্রকাশের সোপান। সঙ্গত কারণে মহৎ সাহিত্য সম্পর্কে সমালোচকের সিদ্ধান্ত নয়, বিস্ময়সূচক প্রশ্নই বড় হয়ে ওঠে।
কবিতার সমালোচনা প্রসঙ্গে এলিয়ট লিখেছেন, Honest criticism and sensitive appreciation is directed not upon the poet but upon the poetry. If we attend to the confused cries of the news paper critics and the sursurrus of popular repetition that follows, we shall hear the names of poets in great numbers. (Tradition and the Individual talent: T.S. Eliot)অর্থাৎ ‘সৎ সমালোচনা ও সংবেদনশীল মূল্যায়ন কবিতাকে কেন্দ্র করে; কিন্তু কবিকে কেন্দ্র করে নয়। কিন্তু আমরা যদি সংবাদপত্রের সমালোচকদের মূল্যায়ন আর পাঠকদের অবিরত গুঞ্জন শুনি, তাহলে কবিতার পরিবর্তে কবিদের নামই শুনি বেশি।’
সমালোচকের একটি ব্যর্থতা এই—সমালোচনার ক্ষেত্রে অনেক সময় বিষয় ছেড়ে ব্যক্তি প্রকট হয়ে ওঠে। কবিতা, গল্প, উপন্যাসের বিশ্লেষণাত্মক আলোচনার পরিবর্তে কেবল মুখচেনা কতগুলো নাম লিপিবদ্ধ হতে থাকে। এ প্রবণতা সাহিত্যের জন্য মাঙ্গলিক বার্তা বয়ে নিয়ে আনে না, বরং সম্পর্ক চর্চার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। এর কারণ, সমালোচকের পাঠদৈন্য। স্বল্পপাঠের অভিজ্ঞতা নিয়ে আলোচনায় অবতীর্ণ হলে জানার ক্ষুদ্রবৃত্ত ছাড়িয়ে প্রান্তরের দেখা পাওয়া সম্ভব হয় না। সমালোচকের পাঠাভিজ্ঞতার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে জীবনানন্দ দাশ ‘দেশ কাল ও কবিতা’য় লিখেছেন, ‘…সব পড়েও সকলেই বড় সমালোচক হয় না, দু’একজন হয়। কিন্তু সমালোচনার ক্ষেত্রে, না পড়ে অশিক্ষিতপটুত্বও ঠিক জিনিস নয়। জ্ঞানেরই দরকার বেশি, সেই জন্যই অধ্যয়নের দরকার। অধীত জিনিস থেকে প্রজ্ঞা লাভ করবে কি সমালোচক না পাণ্ডিত্য? প্রথমটির ভরসাই অধ্যয়ন, পাণ্ডিত্য দিয়ে কবিতার সমালোচনা বেশি চলে না।’ কোনো একটি বিশেষ কালখণ্ডে একজন বড় কবি উপেক্ষিত হতে থাকলে তখন কবিতার অবমূল্যায়ন হয়। কবিতার জগতে নেমে আসে হতাশা, শুরু হয় অকবিতার প্লাবন। এই বিরূপ পরিস্থিতি থেকে মহৎ সমালোচকই কবি ও কবিতাকে উদ্ধার করতে পারেন। তার জন্য নিজেরই সামর্থ্য ও যোগ্যতা থাকা জরুরি।
ফরাসি কবি বোদলেয়ার প্রতীকবাদিতার জন্য সমকালে প্রত্যাখ্যাত ছিলেন। বিষয়টি কিশোর কবি র্যাঁবোকে পীড়িত করে। ফলে র্যাঁবো তাই বোদলেয়ারকে নিয়ে লিখলেন সবচেয়ে দায়িত্বশীল রচনাটি। কুণ্ঠাহীনচিত্তে ঘোষণা করলেন, ‘বোদলেয়ার প্রথম দ্রষ্টা, কবিদের রাজা, এক সত্য দেবতা।’ তার এই মূল্যায়নে সহসা সচকিত হয়ে উঠলেন স্বয়ং বোদলেয়ারই; মালার্মে ও ভর্লেমও। বোদলেয়ার পেলেন তার প্রাপ্য সম্মান। বাংলা কবিতার ইতিহাসেও দেখা যায় জীবননান্দ দাশের কবিতার পরিচর্যায় নিষ্ঠাবান ছিলেন বুদ্ধদেব বসু। সজনীকান্তের ক্রমাগত ঈর্ষা আর বিদ্রূপের শিকার যে জীবনানন্দ, সে জীবনানন্দকে পূর্ণ মর্যাদা দিয়ে প্রতিষ্ঠার পথ করে দিয়েছেন বুদ্ধদেব বসু—কেবল তার কবিতা প্রকাশ করেছেন এমন নয়; জীবনানন্দকে নিয়ে লিখেছেনও। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে মোহিতলাল মজুমদার, বুদ্ধদেব বসু, দীপ্তি ত্রিপাঠী, অরুণ মিত্র, শঙ্খ ঘোষ, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, সৈয়দ আলী আহসান, হাসান হাফিজুর রহমান, হুমায়ুন কবির, অশ্রুকুমার শিকদার, পূর্ণেন্দু পত্রী, জহর সেন মজুমদার, আবদুল মান্নান সৈয়দের মতো গুণবিচারী সাহিত্য সমালোচক রয়েছেন; রয়েছেন সজনীকান্ত, হুমায়ুন আজাদের মতো নিন্দাভাষ্য রচনাকারীও। নিন্দাভাষ্য রচনাকারীর দলে আংশিক আহমদ ছফাকেও বিবেচনা করা যায়। তার শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্মও প্রশ্নবিদ্ধ হয়, নিন্দায়-আকীর্ণ ‘বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় : শতবর্ষের ফেরারী’র উপস্থিতিতে।
সমালোচক যদি বস্তুসত্য ও কাব্যসত্যকে অভিন্নার্থে গ্রহণ করতে চান, তাহলে তার হতাশ হওয়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। এক্ষেত্রে সমালোচক সিদ্ধান্তদাতা নন, প্রশ্নশীল হলেই সাহিত্যবান্ধব। কারণ, যে বিষয়ের মর্ম তিনি পুরোপুরি উপলব্ধিতে অসমর্থ সে বিষয়ে চূড়ান্ত মন্তব্য তার বোধের সীমাবদ্ধতাকে লঙ্ঘন করে মাত্র। তাই জোর করে সবজান্তা হওয়ার চেয়ে প্রশ্নশীল বিস্ময় প্রকাশই শ্রেয়। সাহিত্য সমালোচনা প্রকৃতপক্ষে বুদ্ধির ব্যায়াম নয়, সহৃদয়তা প্রকাশের সোপান। সঙ্গত কারণে মহৎ সাহিত্য সম্পর্কে সমালোচকের সিদ্ধান্ত নয়, বিস্ময়সূচক প্রশ্নই বড় হয়ে ওঠে।
সমকালীন সাহিত্যচিন্তা (২০১২) থেকে