শিল্পের যেন নিজস্ব ঢং আছে, তেমনি রয়েছে রূপ। রয়েছে নিজস্ব ও স্বতন্ত্র রঙও। সেখানেই শিল্পীর সার্থকতা। নিজেকে ব্যক্ত ও প্রকাশ করার কাঙ্ক্ষা মানবজাতির সহজাত-প্রবৃত্তি। কিন্তু একথা সত্য—সবার প্রকাশক্ষমতা ও প্রকৃতি একই রকম নয়। প্রত্যেকের রয়েছে স্বতন্ত্র স্বর, পৃথক বৈশিষ্ট্য। শিল্পী যখন সৃষ্টি করেন, তখন আপন মনে মগ্ন থাকেন। এই মগ্নতা তাকে নিয়ে যায় সৃষ্টির গভীরে, বিচিত্র ধারায়। তবে বিস্ময়কর হলেও সত্য— কোনো শিল্পীই শিল্পের সর্বঅঞ্চলে সমান আগ্রহী হন না এবং সর্বত্র তাঁর সমান পদাচারণা সম্ভব হয় না। অর্থাৎ প্রত্যেক শিল্পীকেই তাঁর নিজস্ব অঞ্চল তৈরি করতে হয় এবং সে অঞ্চলে সিদ্ধির চেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়। এ কারণেই যিনি গল্প লেখেন, তিনি উপন্যাস লিখলেও সেখানে সমান সাফল্য অর্জিত হয় না। আবার বিশেষ একটি মাত্র বিষয়ে আত্মমগ্ন থাকতে চাইলে সেখানেও রয়েছে বিষয়ের প্রতি বিশেষ ধরনের দুর্বলতা। যিনি প্রকৃতির কবিতা রচনা করেন, তিনি দেশপ্রেমের বন্দনাও করেন। তবে এ কথা বলা অসঙ্গত হবে না—বাংলা কবিতার গোড়াপত্তনে মূল নিয়ামক প্রেমের অনুষঙ্গ। আদি কবি থেকে শুরু করে বর্তমানের কবি; সবাই মূলত প্রেমের কবিতাতেই স্বস্তি খোঁজেন। প্রেমের কবিতা লিখতে গিয়ে, আত্মনিবেদনের ভেতর দিয়ে মাঝে-মাঝে সামাজিক বাস্তবতাও কবিরা ফুটিয়ে তোলেন। উপর্যুক্ত কথাগুলো শিহাব শাহরিয়ারের কবিতা সম্পর্কে বলা।
কবির কাজ তাঁর সময়ের অস্থিরতাকে আবিষ্কার করা। আর এই আবিষ্কারের নেশায় আত্মমগ্ন হওয়া। একইসঙ্গে চরাচরের প্রপঞ্চগুলোর মধ্যে ঐক্য-অনৈক্যের কারণ অনুসন্ধান করা। এর সঙ্গে সময়ে বিবর্তন, সামাজিক পরিবর্তনকে নিবিড়ভাবে অবলোকন করে শব্দে-বাক্যে-উপমায়-চিত্রকল্পে ভাস্বর করে তোলা। শিহাব শাহরিয়ার বিষয়টিকে দেখেছেন নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিতে। ‘নদীর তলপেট ফুঁডে উড়ে যায় রোদ’ কবিতায় সেই অস্থির সময়ের মেজাজ-রুচিই চিত্রিত হয়েছে। কবি যখন উচ্চারণ করেন— ‘সেলফোন—ছোটফোন/ হারাবেই— তুমিও হারিয়েছ পূর্ণিমার চাঁদ’। তখন একইসঙ্গে বিশাল পৃথিবীতে কোনো একটি বিশেষ বস্তু বা ব্যক্তিকে নিতান্ত ক্ষুদ্রই মনে হয়, একইসঙ্গে মহাকালের নিরিখে বর্তমানকে মুহূর্তমাত্র ভাবতে ইচ্ছা হয়। সেই ইচ্ছার পথে বড় বাধা বিধিনিষেধ। তাই অপেক্ষা, তাই ধর্য।
ঈশ্বর, আছি ধর্য্যরে দড়ি ধরে
নিচ্ছি শুকনো লাউপাতার ঘ্রাণ
আমাকে দেখাও দুধকুমারি নদী
(বাতাসের পৃষ্ঠা বদল)
একথা অস্বীকার করা যাবে না, আধুনিক বাংলা কবিতায় আবেগের বিপরীতে প্রজ্ঞা ও মনীষার সম্মিলন ঘটিয়েছেন—এমন কবির সংখ্যা অত্যল্প। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করে, উপস্থিত কালের প্রধান প্রবণতা শনাক্তির ভেতর দিয়ে শিল্পচর্চার দায় শিল্পীর। এ দায় পালনে সফল হলেই সমকালের সীমানা পার হয়ে মহাকালেও তার কবিতা নিত্যপাঠ্য হয়ে ওঠে। আধুনিক বাংলা কবিতা মূলত দুটি ধারায় প্রবাহিত। প্রথম ধারাটি আবেগের, দ্বিতীয়টি প্রজ্ঞার। প্রজ্ঞার অনুশাসন মানতে গিয়ে কখনো-কখনো মৌলিকত্বের প্রতি অবিচার করা হয়। তীব্র ভাবাবেগের প্রাচুর্যের ভেতর শিহাব শাহরিয়ার নিজেকে করে তুলেছেন বৃহত্তর রসপিপাসুর আরাধ্য। ফলে আবেগের বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে পাঠক তার কবিতায় নিজেকে সমর্পণ করেন, খোঁজেন চিৎপ্রর্ষের ব্যঞ্জন। তাঁর কবিতার মূল বিষয় প্রেম। আবেগ ব্যতীত প্রেম অকল্পনীয়। ফলে তার কবিতায় স্বাভাবিকভাবেই আবেগ এসেছে। শিল্পের আবেগ আত্ম-উৎসর্গের প্রয়োজনে, সমর্পণেরও।
কবির কাজ সমাজে যা ঘটে, আর যে ধরনের ঘটনার প্রত্যাশা কবি করেন, এই দুইয়ের মধ্যে সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করে যাওয়া। স্বপ্ন ও প্রেম দিয়ে তিনি সমাজ পরিবর্তনের পথ তৈরি করেন। হয়তো তার দেখানো পথে সমাজ হুবহু পরিবর্তিত হয় না। কিন্তু তাঁর প্রেম, তাঁর সাধনা পথ নির্দেশক হিসেবে কাজ করে। এ প্রসঙ্গে ‘নন্দন তত্ত্ব ও দর্শন’ শীর্ষক এক নিবন্ধে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম লিখেছেন, ‘কবি কল্পনার আলোকে অভিজ্ঞতাকে পরিবেশন করেন বলে বাস্তবতা পরিবর্তিত হয় অবাস্তবতায়, এমনকি বস্তুতেও যোগ হয় আলাদা মাত্রা। কবি জগৎকে আমূল পাল্টে দেন। নৈতিক সত্য যেমন এতে অবিকল থাকে না, সামাজিক প্রয়োজনও সেখানে প্রেক্ষিত বলে ফেলে।’ শিহাব শাহরিয়ারের কবিতায় এই সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত ও কাব্যসত্যের বিচিত্র রূপের দেখা মেলে। কবি কখনো সমাজকে দেখেন একজন সহজ-সরল পল্লীবাসীর মতো, কখনো দেখেন গভীর চিন্তামগ্ন পর্যবেক্ষকের চোখে। দেখতে দেখতে হয়ে ওঠেন ভাবুক। আর ভাবনা থেকেই শুরু হয় তাঁর স্বপ্ন রচনা।
প্রেম ও বাস্তবতার সম্পর্ক সবসময় মধুর হয় না। প্রায় প্রেমের পথে বাস্তবতার কঠিন আঘাত এসে পড়ে। এতে মানব-মানবীর হৃদয় ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায। তখনই নেমে আসে দুটি প্রাণে অন্ধকার। কেউ কেউ জীবনের গতি হারিয়ে ফেলে, কেউবা হারায় বেঁচে থাকার আশা। কেউ-কেউ কষ্ট বুকে ধারণ করে বেঁচে থাকে। বেঁচে থেকে পরবর্তী সময়ে করে স্মৃতিচারণ। তাঁর স্মৃতিচারণায় উঠে আসে শৈশবের সারল্য, কৈশোরের দুরন্তপনা আর যৌবনের উচ্ছাস। কবির মধ্যে এই প্রবণতা প্রকট। কবি শিহাব শাহরিয়ারের কবিতায় বিষয়টি অনেক বেশি উজ্জ্বল। একটি কবিতার পাঠোদ্ধার দিলেই প্রসঙ্গটি পরিস্কার হবে।
দু’কূল ছাপিয়ে টুপ টুপ ভরা নদী— দূর দূর দূর
দূর দূর দূর যেন কোনো রূপময় বালিকার ঘুঙুর
যেন নদী নয়— ফুস ফুস ফেণা হলুদ, প্রবল স্রোত
কিশোরীর কাঁথার তলে সরিষার দানা দানবের দূতকিনার ছুঁয়ে বধূটির অর্ধ-আঁচল ওড়ে মেঘের মতো
দাঁড়িয়ে তীরে ভাঙে বিরহী রাধার বুক পাঁজর যতো
নেই আগের মতো জলের ঝাপটানি সাঁতারের তাড়া
হারিয়েছি নদী-ঘুম-রং-রোদ—আমিই শুধু শৈশবহারা
(অর্ধ-আঁচল ও দূরের নদী)
অনেক সময় শিল্পীরা সমাজের ঘটমান ঘটনার সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করেন না। তাঁরা দূর থেকে ঘটনা পর্যবেক্ষণ করেন। কখনো নিস্পৃহ, কখনো নির্লিপ্তির ভেতর। কারণ ওই বিশেষ ঘটনাকে প্রভাবিত করার মতো শক্তি আপাতত তাদের থাকে না। এমনকি বিশেষ বিশেষ কালখণ্ডের জনতা সমকালীন বিষয়ে এতই উত্তেজিত ও উন্মত্ত থাকে যে, শিল্পী-ভাবুক কিংবা দার্শনিকের সমুচিত কথা শোনার মতো মানসিক প্রস্তুতি তাদের থাকে না। পরন্তু তাদের কর্মকাণ্ডের সমালোচনাকারী শিল্পী, দার্শনিক কিংবা চিন্তককে তারা তাৎক্ষণিক রাষ্ট্রীয়-সামাজিক শত্রু হিসেবেই দেখে। স্বভাবতই এমন পরিস্থিতিতে শিল্পী-কবি-দার্শনিক-ভাবুক-সমাজচিন্তক কেবল পর্যবেক্ষণ করেন। ঘটনার পরে তার একটা যৌক্তিক ব্যাখ্যাও দেন। ততদিনে উম্মত্ত জনতার উত্তেজনা কমে আসে। জনতাও নিজেদের ভুল আর উগ্রতার লাভ-ক্ষতির হিসাব কষা তখন শুরু করেন। কবি আপাতত সংঘাতে না গিয়ে এসে বসেন লেখার টেবিলে। লিপিবদ্ধ করেন তাঁর অভিজ্ঞতা। তিনি সমাজের অবক্ষয়, রিরংসা, হিংসা, দ্বেষ আর বিশৃংখলাকে জয় করতে চান প্রেম দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে। এর জন্য প্রয়োজন সম্পর্ক রচনা। কবি সে সম্পর্ক রচনার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেন।
খড়ের স্তূপের ভেতর লুকিয়ে ছিল তোমার নিদ্রা
মোরগের কুক্কুরুক্ কুক্ ডাকে ভেঙে যায় নক্ষত্র
ভোরের বাউরি বাতাসে ভাঙে দুধেল গাভীর ঘুম
তখন আর মাছের কুমারীত্ব নিয়ে থাকে না প্রশ্ন
বিকালের রোদ ফুরায় ফেটে যায় আকাশের তলাআমরা গহীন গাঙের দিকে যাই নিবিড়তম সন্ধ্যায়
রঙের খেলা খেলেছো তোমরাও শ্রাবণের দুপুরে
পড়ে থাকে সহস্র ঝিনুকের মালা বিচের বালিতে
একদিন সন্ধ্যার সমুদ্র ডেকে নেয় আমাদেরকে
অন্ধকারে নক্ষত্র-আলোয় ভাসে শাদা মুখগুলোতখন শালিকের নাভিতে খুঁজি হারানো বিকেল
এবং জং ধরা টিনে আটকে থাক তোমার চোখ
(কবিতা— ১২ : যখন ভাঙে নক্ষত্র)
শব্দের পুনরাবৃত্তি প্রায় একঘেয়ে লাগে। কিন্তু কারও কারও প্রয়োগগুণে পুনরাবৃত্তি হয়ে ওঠে আকর্ষণীয়। ‘খোলা নিশ্বাস’ সিরিজের কবিতাগুলোর করণকৌশলেই রয়েছে এই পুনরাবৃত্তির প্রমাণ। পুর্ববর্তী পঙক্তির শেষ শব্দ বা শব্দযুগল দিয়ে শুরু হয়েছে অব্যবহিত পরবর্তী পঙক্তি। এভাবে পাঠকের মগজের ভেতর কবি নিজের বক্তব্য পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। এই চেষ্টায় তাঁকে সফল বলা যায়।
পুরো মঞ্চ জুড়ে এঁকে বেঁকে হেঁটে যায় কতগুলো খোলা পিঠ, খোলা নাভির রূপালি রিং।
তখন আমাদের চোখগুলো বাদামি বাতাসে ভরতে থাকে। একজন বললেন, পিঠগুলো,
নাভিগুলো মফস্বলের রোদ। ওদের শরীর কলাপাতার সরু ডাঁটা, রং সিমপাতার রং।
বনেদি নাগর এসে মাঝে মাঝে ঠোঁকর দেয় ওদের ভরা যৌবনে। তারপর ওরা আর
হাঁটে না পিপিলিকার শীতের সরু পথে। তখন মনে হয়, খোলা পিঠ যেন খোলা খাম।
খোলা পিঠ যেন খোলা চিঠি। খোলা পিঠ যেন খোলা জানালা। জানালা স্পর্শ করার
অধিকার আমাদের থাকে না।
(খোলা পিঠ )
তাঁর একটি বিশেষ প্রবণতা, বিশেষ বিশেষ শব্দ ও বিষয়ের প্রতি দুর্বলতা। এর ফলে তিনি একই বিষয়কে চিন্তার ভরকেন্দ্রে রেখে কল্পনাকে দেন অসীম স্বাধীনতা। একই বিষয়ে বারবার বললেও পুনরুক্তির একঘেয়েমি সেখানে স্থান পায় না। বরং বক্তব্যের ধারাবাহিকতা ও সৃষ্টির বিরামহীন ঐক্য সেখানে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। এদিক থেকে বিচার করলে ‘সূত্র’, ‘সূত্রসুতা’, ‘প্রৌঢ়সুতা’, ‘সময়সুতা’, ‘ঘাসসুতা’, ‘রাতসুতা’,প্রভৃতি কবিতায় চিন্তা-কল্পনা বিষয়ের ঐক্যে সুদৃঢ়।
আধুনিক কালের কবিদের মধ্যে একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। তা হলো, বক্তব্যের অনিকেত প্রবণতা। কিন্তু আলোচ্য কবি এই অনিকেত বা বিচ্ছিন্নতার ধারণাকে গুরুত্ব দেন না। তাই তাঁর কবিতা নাগরিক হয়েও পল্লীর ছায়া সুশীতল পরিবেশের মতো কোমল ও সুরেলা। একই সঙ্গে যোগসূত্রে গ্রথিত। এ সম্পর্কে ‘ঘাসসুতা’র উল্লেখ করা যেতে পারে।
আশ্চর্য এই ঘাসের ঘটনা আশ্চর্য এই আলো
কাকেরাও ভুলে যায় পাঠসূত্র মনসূত্রের ভুলে
পূর্বজন্মের পুরুষেরা ভুল স্বপ্ন দেখেছিল বলে
সেদিন দুপুরে আমরা জেগে উঠি ঘোড়াঘাটে
আমাদের চোখে জন্ম নেয় সতেরটি স্বপ্নচোখ
এখানকার ফুলগুলো এখনো বন্য গন্ধ ছড়ায়বাতাসেরা আড়ি পেতে দেখে ঘুমঘরে চন্দ্রমুখ
শিমুল তুলোর সাথে বালিশের সম্পর্ক ছিন্ন হয়
আমি আয়নায় আবারও মুখ দেখি পাই জলসুখ
মুখ-রেশমা অন্ধছায়া কুয়াজল যন্ত্রণার জীবন
ইনটেনসিভকেয়ার ঘুম ঘোড়াঘাট পথ পথমুখ
কবিকে অনেক সময় জাতিস্বর হতে হয়। এ কারণে যে, পূর্বপুরুষের অনেক অব্যক্ত কথা উপস্থিতকালে তাকেই বর্ণনা করতে হয়। পূর্বপুরুষের দায়ভারও বহন করতে হয় তাকে। এভাবে কবি হয়ে ওঠেন অতীত ও বর্তমানের মধ্যে একটি নির্ভরযোগ্য যোগসূত্র।
যিনি কবি, তিনি কেবল মানবপ্রেমী হবেন এমন নয়। তিনি একই সঙ্গে সর্বপ্রাণবাদীও। চরাচরের প্রতিটি প্রাণের জন্য জন্য তাঁর হৃদয়ে মমত্ব বোধ থাকবে।
পেছনে কৈশোরের স্মৃতিময় রেলস্টেশন আর শৈশবের প্রিয় ব্রহ্মপুত্রের শীর্ণ বুক
পেরিয়ে শীতস্নিগ্ধ এক রাতে পূর্ণিমার জলে গা ধুয়ে ধুয়ে হাঁটছি একা— নিজ
গৃহের দিকে। শিশিরাক্রান্ত শর্ষেক্ষেত আর শাখা নদীর কুয়াশা ভেজা বালুময়
জ্যোৎস্নামাখা পথে হাঁটছি শুধু একা… কুমারীর সতীত্বের মতো পূর্ণিমার পবিত্র
তীব্র-তীক্ষ্ম-স্বচ্ছ-ঘন আলোয় হাঁটছি একা… হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে ভুলে
গেছি পথের দূরত্ব, ভুলে গেছি হ্যারিকেনের ম্লান আলোয় ক্লান্ত চোখে জেগে
থাকা জনক-জননীর কথা… নিঃশব্দ পথে হাঁটছি একা… জ্যোৎস্নার গভীর বিপন্ন
আলোয় ভাসছে প্রান্তর, ঘুমন্ত গ্রাম, স্কুলঘর… আমিই শুধু একা বাড়ি ফিরছি…
পূর্ণিমার অবসন্ন আলোয় হেঁটে হেঁটে…
(ফড়িঙের পাখা পোড়ে)
তুচ্ছ কীটের কষ্টেও কবি হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হয়। কবি কষ্ট পান যেকোনো প্রাণী-উদ্ভিদের যন্ত্রণায়। ফড়িঙের পাখা পুড়তে দেখে কবি কষ্ট পান। সে কষ্টে মনে পড়ে তার অতীত, শৈশব, ফেলে আসা পথঘাট।
শিল্পীর একটি মৌলিক প্রবণতা, অন্তর্মুখীনতা। এই স্বভাব তাঁকে এত বেশি আত্মমগ্ন করে রাখে যে, চরাচরের অনেক ঘটনা-দুর্ঘটনার দিকে তাকিয়ে দেখার মতো অবসরও তাঁর মেলে না অনেক সময়। সাধারণের চোখে তখন তাঁকে আত্মকেন্দ্রিক বা নার্সিসাস মনে হতে পারে। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে— শিল্পের ধর্ম, নিজের জগতে ডুব দেওয়া। বাইরের জগতকে নিজের ভেতরে আহ্বান করা। নিজেকে বাইরের দিকে ছুড়ে দেওয়া নয়। এজন্যই শিল্পী বিশেষ করে কবি সাধারণত অতিথি হন না, হন গৃহস্থ। তিনি জগত সংসারকে নিমন্ত্রণ করেন নিজের গৃহে। অর্থাৎ তাঁর সৃষ্ট জগতে।
পূর্ণিমা, অনন্তনাগ, সন্ন্যাসী চাঁদ, বাড়ি ফিরি
হলুদ, শাদা খরা। বৃষ্টিতে ধুয়ে যায়। পূর্ণিমা পড়ে; ধবল
বছর এক কুড়ি। ভাঙা, মরচে পড়া ঘর, চৌকাঠ। বর্বর
স্বপ্নের ভেতর হাঁটি। দড়ির মতো এক ফুট দীর্ঘ-বিবর্ণ পথ
শামুক সন্ধ্যা দাঁড়িয়ে থাকে। অন্ধকার আস্তর খোলেনেই শব্দ। শব্দ নেই। পাতা ছেঁড়া। ছেঁড়া পাতা। অনন্তনাগ
সন্ন্যাসী চাঁদ। চাঁদে সন্ন্যাসী। পুঁথি, আলো, ঈশ্বর
‘হাওড়া থেকে বর্ধমান, বোলপুর’। স্বপ্ন যাত্রা। মনে পড়ে
ট্রেন, ট্রেন। অনন্তের বাঁশি বাজে…ক্লান্ত বাড়ি ফিরি
(হাওয়ায় রাত ভাসে ভাসে নিদ্রা)
তাঁর আত্মনাট্য প্রকৃত পক্ষে আত্মজীবনীমূলক আখ্যান হলেও তাতে উঠে এসেছে ব্যক্তির একাকীত্ব, যন্ত্রণার পাশাপাশি দেশজাতির নানা সংকটের চিত্রও। সবাই যা দেখেন কবি তা দেখেন না। তাই নিঃসংকোচে উচ্চারণ তাঁর— ‘আমি দেখি অন্য আকাশ। ’
ছন্দ নির্বাচনে মাত্রাবৃত্ত-স্বরবৃত্তের প্রতি কবির ঔদাসীন্য প্রকট। তবে অক্ষরবৃত্তের চালে তার কৌশল একেবারেই তার নিজস্ব। এছাড়া অলঙ্কার প্রয়োগে-সৃষ্টিতে স্বাতন্ত্র্য সুস্পষ্ট। কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টা পরিষ্কার করা যাক।
ক.
চিকচিক খোলা রোদ আর কার যেন খোলা নীরব দীর্ঘশ্বাস ( খোলা খাম)খ.
শরীর শরীর হায় একই শরীরে ডুব-সাঁতার দেয় শুশুকের দল, ক্ষণে ক্ষণে উঠে জেগে (খোলা অন্ধকার)গ.
নদীর নিভৃত খোলা জলে ইলিশের নড়াচড়া জাগাবে না তোমার নিদ্রা ( খোলা উঠোন)ঘ.
মনগুলো কবির, মনগুলো জ্যোৎস্না নাবিকের ( খোলা পূর্ণিমা)ঙ.
গোপন ঘর গোপনে দেখে আকাশের বুক (মধ্য মানচিত্র)চ.
শহরে আশ্বিনের বাতাস। সন্ধ্যায় বাতাসে ছড়ায় গুচ্ছ গোলাপের ঘ্রাণ (খেয়া)
উদ্ধৃত কবিতাংশগুলোয় চিত্রকল্প-উপমা সৃষ্টিতে বৈচিত্র্য ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধের স্বাক্ষর সুস্পষ্ট। কবি একটি বিশেষ মুহূর্তকে নানাভাবে ব্যঞ্জিত করেছেন। চেষ্টা করেছেন মানবহৃদয়ের গোপন কক্ষে নিজের অনুসন্ধিৎসুকে পৌঁছে দিতে। তাঁর সে সে সাধনা অনেকটাই সফল।
শব্দ নির্বাচন, গঠন এবং বাক্যবিন্যাসের সঙ্গে-সঙ্গে চিত্রকল্প-উপমার সমন্বয়ে শিহাব শাহরিয়ার স্বতঃসিদ্ধ। ইতোমধ্যে তার স্বাক্ষর তিনি রেখেছেন। শেষ পর্যন্ত এ কবি প্রথাগত অর্থে প্রতিবাদী-উচ্চকণ্ঠ নন। তিনি মৃদুভাষী। যখন তিনি সমাজের ওপর ক্ষুব্ধ- তখন তার কণ্ঠ কোমল হলেও তীব্র শ্লেষে পরিপূর্ণ। আবার যখন তিনি কোনো মানবীর প্রেমে নিমজ্জিত, তখন কণ্ঠের কোমলতার সঙ্গে ঢেলে দেন সমস্ত দরদ। তাই তার কবিতা হয়ে ওঠে হৃদয় ও মননের যুগলগ্রন্থী।