প্রকৃতির সঙ্গে কবির নিবিড় সম্পর্ক। সবুজের সঙ্গে কবির আত্মার বন্ধন। তাই তো সবুজ প্রকৃতির সমঝদার কৃষকের কালো শরীরই কবির আরাধ্য।কৃষকের হাহাকার কবিকেও ভাবায়। কবিও তো চাষি, কবিতার আবাদ করেন। কী এক যন্ত্রণা কবিকেও ব্যাকুল করে তোলে। কবি বিরান প্রান্তরে জমান শীতের শিশির। আর বুকের গোপনে সাজিয়ে রাখেন আগামীর বীজ। কখনো কখনো হতাশায় আচ্ছন্ন কৃষক কবি বলেন:
আহা সেই স্বপ্নের ঘরে মহাজনী ইঁদুর
ফসলের ফসিল কেটে চালাকি ধামায়
ভরে ছিল গর্তের গোলাঘর আর তার
লাল চোখের নিচে জমেছিল পাপের সিরিজ…
(এই কালো শরীর)
উপমাই কবি শামীম হোসেনের কবিতার প্রধান উপলক্ষ। উপমাশ্রিত কাব্যমঞ্জুরি পাঠকের হৃদয়ের গহীনে দাগ কেটে যায়। প্রকৃতিনির্ভর এসব উপমায় জীবনের খুঁটিনাটি বিষয় আদ্যোপান্ত উঠে আসে জেলের জালে ধরা পড়া নানা প্রজাতির মাছের মতো। কবি যখন বলেন:
কত ডাক আসে ঘরে কত ডাক ফিরে যায়
চাঁদকে উল্টো করে হাতে ধরি রূপালি কয়েন
আমার ভেজার বাসনা আকাশের গায়ে যখন
লাগে দেখি মেঘের গ্রহণ—
খুব বেশি কচুপাতায় স্বপ্ন দেখি না।
(গ্রহণ)
কবিতায় উঠে আসে কবির পূর্বপুরুষ। কবির স্মৃতিতে ধরা পড়ে দাদিমার বোনা নকশিকাঁথা, দাদার কবর। সবই আজ গত। কত ডাক আসে ঘরে কত ডাক ফিরে যায়—আমাদের সে কথাই শুনিয়ে যায়।
কোনো কোনো দৃশ্য কবির মাথার মধ্যে ঘুরপাক খায়। বাস্তবতা থেকে তুলে আনে কবিতার উপাদান। ভাসমান হাঁড়িতে কাটা মাথা ঘুরতে ঘুরতে মানুষ হয়ে যায়। সে মানুষ কবির বোধের মানুষ, ক্ষোভের মানুষ। এমন বোধই কবিকে মানুষ হিসেবে প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করায়। কখনো কখনো পানির দামে কিনে নেন বাদামবাগানের ফুল। ধুতুরার অরণ্যে খুঁজে পাওয়া নাকফুল সযত্নে রেখে দেন। তার কবিতার শরীরে জেগে ওঠে কলসভর্তি বিরহদিন। পালকের বিনিময়ে কী ফুল কিনেছেন— তা দেখে যাওয়ার আহ্বান জানান। পাথর একটি জড়বস্তু। তার তো আবেগ নেই—অনুভূতি নেই। কবির পাথরের চোখ শুধু চেয়ে থাকে। পলক পড়ে না। তার এ প্রতীকী চোখ যেন আমাদের চোখকেও পাথরের চোখ বানিয়ে দেয়। কবি পাঠকের কাছে প্রশ্ন করেন:
পাথরের চোখ শুধু চেয়ে থাকে—
কেন তার অশ্রু পড়ে না, দুঃখ ঝরে না…
(পাথরের চোখ)
আমাদের সবকিছুই ক্ষণিকের। তবু আমরাই যেন সবকিছুর মালিক আবার কিছুই যেন আমাদের নয়—এমন সত্যই কবি অকপটে উচ্চারণ করেন। যা কিছু বায়নাসূত্রে আমার; তা কি আসলেই আমার? এই জমি, বীজ, ফসল, সীমানাপ্রাচীর, আলিশান বাড়ি, বিলাসী গাছ, ফুলের সৌরভ, সুদর্শন হরিণ, টুকরো টুকরো আপেল, নাস্তার টেবিল, প্রসাধনের ছোঁয়া—সবই বায়নাসূত্রে আমার হতে পারে। কিন্তু এর বিপরীতে কোনো শরীর ধরে রাখার ক্ষমতা কি আমার আছে? তাই তো কবি বলেন,
ভেবে দেখো বায়নার বিপরীতে তুমি
ধরে রাখতে পারো না নিজের শরীর…
(বায়নাসূত্রে)
তার কবিতায় দেখি স্মৃতি রোমন্থন। দিনাজপুরের কোনো এক বাড়ির স্মৃতি। যে বাড়ি অনেক দূর। যেখানে হাওয়ার আঁকশিতে ধরে আনেন সহজিয়া সুর। যেখানে ধূলি ও তুলির আঁচড় মুছে দেয় কলিজার কালি। সেখানে নদীপথে পায়ে পায়ে হেঁটে গেলেই দেখা মেলে ছাতিমগাছ। যে বাড়িতে গেলে পার্বণের হাট ঘুরে পাওয়া যায় মাটির পুতুল! সেখানে পুতুলও কথা বলে— হাত ধরে দেখিয়ে দেয় আমের মুকুল।
ছেলেবেলায় অবাক বিস্ময়ে একটি জিনিস দেখতাম। কোথা থেকে বাতাস এসে কুণ্ডুলি পাকিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ধুলো, ময়লা, পাতা কিংবা কাগজ। আমরা পালিয়ে যেতাম। যেন ঘূর্ণনের বেড়াজালে পড়ে না যাই। সেই নিয়ে কত গল্প, কত মিথ শুনেছি দাদি-নানির কাছে। সেই শূন্যস্থান পূরণের অভিজ্ঞতা নিয়েই কবি লিখেছেন:
পাক খেতে খেতে বাতাস ঘুরছে
ঘুরতে ঘুরতে ধূলি ও ঝড়—
শূন্যস্থান পূরণ করছে…
আর মহাশূন্যের দিকে ঢুকে যাচ্ছে
আমাদের ধূসর প্রকৃতি
(শূন্যস্থান)
কবি এখানে বোঝাতে চেয়েছেন—বোধ ও বধির হাওয়ায় উড়ছে ফল ও ফসিল। চাকার ঘর্ষণে না কি অবিরাম বর্ষণে ধস ও ধ্বংসের দরজায় বাতাস এসে শূন্যস্থান পূরণ করে যায়! হতে পারে। কবির ভাবনা বা দর্শন হয়তো তা-ই।
কবির দৃষ্টিতে পাখিদের স্নানঘরও বাদ পড়ে না। অথচ সে ঘরে প্রবেশ নিষেধ। এখন গায়ক কোকিলের কণ্ঠে জমে মেঘ। সে মেঘ কখনো সরে যাবে কি না—এর নিশ্চয়তা নেই। কারণ পৃথিবীর যাবতীয় অরণ্য এখন ঢুকে গেছে আমাদের আলিশান বাড়ির ড্রয়িংরুমে। তাই মেহেদি পাতায়ও হয়তো লাল হয় না এখন নতুন বউয়ের হাত। কবির এমন দর্শন আমাদের অবাক করে না বরং বাস্তবতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।
হাসপাতালের সাদা অ্যাপ্রোন পরা সেবিকারা উঠে আসে শামীম হোসইনের কবিতায়। তাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে ভালোবাসার অসুখও যেন জড়িয়ে পড়ে। কবি বলেন:
অসুখের কথা তাকে জানাই ইশারায়
হাসপাতালে দিদি দেখলেই—
অসুখ বেড়ে যায়…
(হাসপাতালে শাদাদিদি)
শামীম হোসেনের কবিতায় উপমা প্রয়োগে চমৎকারিত্ব লক্ষ করা যায়। শব্দের পর শব্দের যথাযথ গাঁথুনি মজবুত ইমারাত গড়ে তোলে। ছন্দের জাদুময়তা সিঁড়ির প্রতিটি ধাপে ধাপে পা ফেলে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি জোগায়। আবেগের ব্যঞ্জনায় অর্থবহ মাধুরী মেশানো প্রতিটি পঙ্ক্তি মনে তৃষ্ণা জাগায়। পাঠ ও অনুধাবনের মেলবন্ধন তৈরি করে। কবি খুব সহজেই বলে ফেলেন:
জামের রসের মতো হৃদয়ে দাগ লেগে থাকে
আর ভেজা ঠোঁটে ব্যাঙের ভঙ্গিমায় ফুটে উঠছে
বহুদূরের অতীত—
মাঝে মাঝে বুকের ভেতর ঘাই মেরে ডাকে।
(বর্ষার ভোর)
তার কবিতায় চরম বাস্তবতা মূর্ত হয়ে ওঠে। যা কিছু সত্য ও চিরন্তন, তাই তার কবিতার অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে । অস্বীকার করতে পারি না কেউ-ই। তা-ই তো তার কবিতার উপজীব্য।
শামীম হোসেন তার কবিতায় প্রকৃতি ও মানুষের আরাধনা করেছেন। এই প্রকৃতি ও এই মানুষ—কোনো কিছুই তার দৃষ্টির বাইরে নেই। ব্যক্তি দর্শনের সঙ্গে কল্পনার কোনো সংমিশ্রণ নেই। কঠিন কথাগুলোই খুব সহজ করে পাঠকের সামনে তুলে আনা তার সহজাত বৈশিষ্ট্য। তবে শব্দভাণ্ডারে জীবনানন্দ প্রভাব থাকতেই পারে। কেননা প্রকৃতিনির্ভর পঙ্ক্তি রচনায় জীবনানন্দই আমাদের অগ্রগণ্য। আমাদের সঞ্জিত শব্দভাণ্ডারকেই ঢেলে যদি নতুন করে সাজানো যায়; তবে বাংলা কবিতার অনিষ্ট হবে বলে মনে হয় না। কবি শামীম হোসেন হয়তো সেই চেষ্টাটাই করে যাচ্ছেন। কবি যখন বলেন:
কী করে সাজাই তবে বালির সংসার!
অহমের ধাতু ক্ষয়ে যে মাঝি ছেড়ে গেছে ঘাট
নৌকাও ভেসে গেছে তার বিপরীত স্রোতে…
ধুধু জল রেখে গেছে তালাবিহীন শূন্য কপাট
বুকের লকেটে শুধু ঝুলে আছে স্মৃতির ভাঁড়ার।
(বর্ষার ভোর)
নদীমাতৃক এদেশে কবিরা নদী দ্বারা প্রভাবিত হবেন এটাই স্বাভাবিক। কেননা এ দেশের প্রকৃতি আমাদের ভাবুক বানায়। এ দেশের নদী আমাদের প্রেমিক বানায়, সাহসী বানায়, সংগ্রাম করতে শেখায়। তাই তো কবি শামীম হোসেনেও নদীর দিকে ফিরতে চান। সে বাসনাই ব্যক্ত করেন তার নদীর দিকে ফিরবো কবিতায়:
এমাজ ফকিরের ধ্যানের মতো সম্মোহিত
পাতার অভিধানে লিখে রাখবো কালের পঙ্ক্তি।
এখন জোছনায় জোয়ার আর নদীতে ভাটা
অনতিক্রম্য পথের দাগ সমুখে আমার—
ট্রাফিকের মতো হাত নেড়ে দেখায় লাল সংকেত।
শুধু তাই নয়। নদী ও নারীর তুলনামূলক বিশ্লেষণ আমরা বহুকাল ধরেই দেখে এসেছি। তিনিও তার ব্যতিক্রম নন। তাই তিনিও বলেন:
কালো মেয়েটার বিবাহের বয়সের সমান নদীর কবিতা
এনে দেয় জলহীন ধুধুচরে জলের জোয়ার…
আমার ফেরা না ফেরার দ্বন্দ্বে—
.. .. ..
আবার যদি ফিরি—নদীর দিকে ফিরবো।
কন্যার প্রতি এক বাবার গভীর নিবেদন ফুটে ওঠে অবলীলায়। বাবার অক্ষমতা কত সহজেই বলে দিতে পারেন তিনি। কারণ তার কন্যা নক্ষত্রের সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মানো কোনো শিশু নয়। এই চরম বাস্তবতা তাকে বুঝিয়ে দিতে হয়। বোঝানোর সময় এসেছে বলেই কবি বলেন:
নক্ষত্রের চামচ মুখে জন্মাওনি কন্যা আমার
এমনকি পিতলের চামচ মুখেও না!
বাজারের অতসব দামি জামার বদলে
দিয়েছি তোমাকে পাতার পোশাক!
(কন্যার প্রতি)
পৃথিবীর চরম সত্য বোঝাতেই কন্যাকে যা কিছু বলেন; আবার আশির্বাদও করে দেন সহজেই। সেই আশির্বাদে কোনো আভিজাত্য নেই। কেবল জগতের এক ব্যর্থ পিতার হাহাকার। কেননা কবি কেবল একজন অক্ষরের দাস। তাই তো কবি আবার বলেন,
চাঁদের কুসুমিত পথে হেঁটে যাও তুমি—
বেড়ে ওঠো মাটি—ঘাস—তৃণের ভেতর
ঝরাফুল কুড়িয়ে বানাও গহনা তোমার
ঝলমলে ঐশ্বর্যগুলো চোখে মেখো না।
নদী তীরবর্তী মানুষ বেশিরভাগ জেলে। নদীকে ঘিরেই তাদের জীবিকা। নদীই তাদের প্রথম প্রেম এবং কল্পনার রানি। নিজের জৈবিক চাহিদার জন্য ঘরে বিবি এলেও রাতের অন্ধকারে নদীই তাদের ডাকে। নদীতে ব্যস্ত জেলের ঘরেও কখনো কখনো বান ডাকে। বউয়ের রূপের হাওয়া পালের নৌকায়ও লাগে। তাই কবি বলেন:
তারপর বহুদিন পর
বাহুতে বেঁধে রাখে প্রণয় মাদুলি—
মাদুলি যতই নড়ে জেলেবউ রূপবতী হয়
আর একদিন রূপের হাওয়া যেয়ে লাগে পালের নৌকায়
জেলে শুধু চেয়ে থাকে আর কেঁদে-কুটে চক্ষু ভাসায়…
(আধা মাদুলির মতো)
শামীম হোসেনের বেশকিছু কবিতায় নদী প্রসঙ্গ এসেছে। সেইসঙ্গে এসেছে নদীকেন্দ্রিক মানুষও। এসেছে মানুষের হাহাকার। যাপিত জীবনের হতাশা ও অবহেলাজনিত আঘাত। কবি বলেন:
প্রলয় শেষে একদা এই শান্ত-সৌম্য নদীতীরেই
হাঁস হয়ে ভেসে উঠেছিলাম…
(প্রমূর্ত )
আমরা যখন রোদের ভেতর দিয়ে হাঁটি; তখন আমাদের ছায়াও সঙ্গে হাঁটে। সেই ছায়ায় আমাদের প্রতিভিম্ব দেখতে পাই। এসব সহজ হিসেব বা চিরায়ত দৃশ্য। কিন্তু কবি বলতে চান অন্য কথা, তা হলো:
আমি দুঃখ পেলে বিমর্ষ হই
কিন্তু সে হয় না…
.. .. ..
আমি কাঁদলে সেও কাঁদে
কিন্তু তার কান্নার কোনো শব্দ নেই।
(ছায়া)
কবি বলতে চান, চাঁদের আলোর ভেতর লুকিয়ে আছে কালের কবিতা। আর কুচকুচে অন্ধকারের পিঠে শুধু আলো এবং কবিতা রাখার আহ্বান জানান। কবির এ নিবেদন সবার জন্য, মানুষের জন্য—প্রকৃতির জন্য।