শিল্পে-সাহিত্যে সমাজের প্রভাব সর্বাধিক। সমাজে যা ঘটে, তার সঙ্গে শিল্পীর প্রত্যক্ষ সম্পর্ক প্রায় থাকে না। তবে অস্বীকারও যায় না পরোক্ষ যোগাযোগের সম্ভাবনাকে। সমাজের আচরণ ও গতির সঙ্গে শিল্পী প্রায় তাল মিলিয়ে চলেন না। তাঁর একটি নিজস্ব রুচি থাকে, থাকে একান্ত বলয়ও। এ কারণেই সমাজের দশজনের সঙ্গে সমান্তরাল চলা হয় না তাঁর। কিন্তু যে সমাজে শিল্পীর বাস, সে সমাজের রীতিনীতি তাঁর পছন্দ না হলেও তাকে অস্বীকার তিনি করেন না। প্রায়ই শিল্পী স্বীকার করে নেন এবং ওই সমাজকে ধীরে ধীরে পরিবর্তনের সাধনায় মগ্ন হন। হয়তো সঙ্গে-সঙ্গে এই পরিবর্তন তিনি সাধন করতে পারেন না। কিন্তু তাঁর সাধনা কখনো থেমে যায় না।
শিল্পীর এ সাধনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের কারণ অন্বেষণের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ নিজের সমাজের পরিবর্তন সাধন। শিল্পী, বিশেষত কবি যে সমাজে জন্মগ্রহণ করেছেন, একইসঙ্গে বেড়ে উঠেছেন যে সমাজব্যবস্থায়, ওই পরিবেশের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক সুনিবিড়। ফলে চেতনে-অবচেতনে ওই সমাজের নানা কর্মচাঞ্চল্য তাঁকে ভাবিত করে। আর এ কারণেই আপনমনের খেয়ালে যে শিল্পের সাধনায় তিনি মগ্ন হন, সে সাধনার প্রভাব পড়ে তাঁর সমাজের ওপরও।
বিশ শতকের অন্তিম দশক। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পটভূমিতে বিপুল পরিবর্তনের কাল। বৈশ্বিক অঙ্গনে উপসাগরীয় যুদ্ধেও ভয়াবহতা, জাতীয় রাজনীতিতে স্বৈরশাসকের পতন; গণতন্ত্রেও উত্থান। শিল্প-সাহিত্যেও নতুন জোয়ারের ঢেউ। এই ঢেউ সৃষ্টিকারীদের একজন কবি শামীম রেজা। সোঁদা মাটি, প্রকৃতি প্রেমময় মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসা ও মুখের ভাষায় রচিত তাঁর কাব্যভাষা ও জগত। এর কারণ, তিনি যে সমাজে জন্ম গ্রহণ করেছেন, বেড়ে উঠেছেন, সে সমাজের প্রতি তাঁর যে দায় তিনি অনুভব করেছেন, তার প্রতিফলন ঘটাতে চেয়েছেন।
শামীম রেজা সামাজিক দায় এড়িয়ে স্বপ্রেমে মগ্ন থাকেননি। সামষ্টিক দায় ও প্রেমে খুঁজেছেন আত্মপরিচয়। কারণ, ‘মানুষ যেমন বিচ্ছিন্ন নয় তেমনি তার সাহিত্য বিচ্ছিন্ন নয়। বর্তমানের অতিরিক্ত তার যেমন অতীত ও ভবিষ্যৎ আছে—সাহিত্যেরও তাই আছে। বর্তমানের যোগসূত্রে এ তিন একই মালার ফুলের মতো এক সুতোয় গাঁথা। এ উপলব্ধির ওপরই নির্র্ভর করছে রচনার সাহিত্যিকতা। সব লেখকই এ অর্থে আধুনিক যে, তাঁকে রচনার উপকরণ প্রকরণ সংগ্রহ করতে হয় তাঁর কাল থেকে, তাঁর যুগ থেকে। সব শিল্পীই যুগ-সন্তান কিন্তু শিল্পী সত্তায় তাঁকে ছাড়িয়ে যেতে হয় যুগকে। (সাহিত্যে আধুনিকা: আবুল ফজল)। এদিক থেকে দেখলে শামীম রেজার কবিতায় তাঁর সমাজ-দেশ-কালের চিহ্ন রয়েছে। এই তিনের যোগসূত্রে তিনি নির্মাণ করেছেন তাঁর কবিতার শরীর ও অন্তরাত্মা।
নতুন ভাষা-সংকেত তৈরিই তাঁর বড় কৃতিত্ব। আঞ্চলিক-কথ্য ভাষার সঙ্গে মান ভাষার সমন্বয় সাধন করে, নিজের জন্য তৈরি করেছেন স্বতন্ত্র এক কাব্যভাষা। এই ভাষা-সংকেত তৈরির সময় তিনি ভুলে মনে রাখেননি পরিপার্শ্ব, এমনকি পূর্ববর্তী কোনো কবির ভাষাশৈলীও বিবেচনায় নেননি। আপন মনে দেবশিশুর মতো ভাষা নিয়ে খেলায় মেতে উঠেছেন।
চিত্তের চাঞ্চল্য ও ব্যক্তির অস্থিরতাও কখনো কখনো শিল্পের উপাদেয় উপকরণে উত্তীর্ণ হয়ে ওঠে। অন্য যেকোনো শাখার চেয়ে কবিতায় এর প্রতিফলন ঘটে বেশি। এর কারণ, কবিরা সমাজের যেকোনো শ্রেণীর মানুষের চেয়ে বেশি সংবেদনশীল। তাঁদের রুচি বোধ অন্যদের তুলনায় সুক্ষ্ম; পর্যবেক্ষণ ক্ষমতাও। চিন্তার গভীরতা অতল স্পর্শী, কল্পনার সীমারেখা দিগন্তবিস্তারী; আবেগও উচ্ছল ঝর্নারাশিকে পরাভূত করার মতাসম্পন্ন। ফলে আবেগপ্রবণ মানুষমাত্রই কবিতায় মগ্ন হলে ভাবুক হয়ে ওঠেন। ওই মুহূর্তে কবিকে সবচেয়ে কাছে মানুষ মনে হয় তার। কবিতাকে মনে হয়, প্রাণাধিক কোনো প্রিয় বস্তু। তবে তেমন কবিতা যদি। আপন সৃষ্টভুবনে অন্যকে মন্ত্রমুগ্ধ করে ধরে রাখার থাকে কবিরও। এ জন্য সৎ কবিমাত্রই তৈরি করে নেন, আপন স্বভাবের অনুকূল কাব্যভাষা। স্বনির্মিত ভাষা ভিন্ন পাঠককে ষোলোআনা আপন সৃষ্টির দিকে আকৃষ্ট করা সম্ভব নয়। এ সত্য কবি জানেন।
তাঁর কবিতায় চেনাজগতও মুহূর্তে রহস্যময় হয়ে ওঠে। পরিণত হয় উপকথার জগতে। যেখানে ‘পাথরচিত্রে’ নদীও কথা বলে। আর রাত নেমে আসে যাবতীয় রহস্য নিয়ে, আদিম উন্মাদনায়। তাঁর কবিতায় একই সঙ্গে কথা বলে, মিথ, ইতিহাস, বিজ্ঞান, পুরাতত্ত্ব, গ্রাম ও শহর। সব মিলিয়ে তাঁর কবিতার প্রধান বৈশিষ্টগুলো মোটা দাগে এ রকম।
অভিজ্ঞতা, স্বপ্ন ও লোকজীবনের যূথবদ্ধ আয়োজনে শামীম রেজা স্বত্বঃস্ফূর্ত। নদী তাঁর প্রিয় অনুষঙ্গ, নারী প্রিয় সঙ্গ-প্রসঙ্গ। এই দুয়ের মিথস্ক্রিয়ায় তিনি এঁকেছেন নদীতীরবর্তী জনজীবনের চিত্র; রঙ ছড়িয়েছেন ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে সামষ্টিকের জীবনেও। ফলে তাঁর কবিতায় ফুটে উঠেছে এক ধরনের সরল-শ্যামল-কোমল চিত্র। যেখানে জড়বস্তুও ভেতর প্রাণসঞ্চারের কৌশল আছে, সঙ্গে রয়েছে রাগ-অনুরাগের কার্যকারণ সম্পর্ক। নদীতীরবর্তী জনপদেও আত্মজিজ্ঞাসার সঙ্গে দার্শনিক প্রত্যয়কে একীভূত করে দেখেছেন শামীম রেজা। তাই, ‘নদী ও আমাদের বেড়ে ওঠা’ কবিতায় স্বগত উচ্চারণ—‘আমরা যারা বেড়েছি কাঁটালতা ঝোপঝাড়া ছুঁয়ে কুঁড়েঘর / তাদের মৃত্যু আর জন্ম আচ্ছন্ন সন্ধ্যা আর দিবসের তমসায় কি তামশার খেয়ালে প্রভূ নদীর জলে শ্যাওলা বানালেন?’
নদী প্রবহমান। তার স্রোতও অন্তঃশীল-গতিশীল। তাহলে নদীর জলে শ্যাওলার প্রসঙ্গ? আসলে অচরিতার্থ জীবনের জন্য তীব্র হাহাকারের প্রতীকী রূপ বর্ণনা করতে এই রূপকের আশ্রয় নিয়েছেন কবি। আর এই নদী প্রসঙ্গ কবিতার পুরনে অনুষঙ্গ। কবিতায় নদী কখনো যৌবনের প্রতীক, কখনো গতির, কখনো সভ্যতার; সবচেয়ে বেশি ও কার্যকর নারীর প্রতীক হিসেবে।
বাংলা কবিতার একটি বিপুল অংশজুড়ে রয়েছে ঈশচিন্তা। কেউ ধর্মানুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে ঈশ্বরকে স্মরণ করেন, কেউ কেউ নিজের সত্তার সঙ্গে ঈশ্বরকে একীভূত করে দেখেন। বিশেষত আধুনিককালের কবিরা ঈশ্বর ও নিজের মধ্যে তেমন কোনো তফাত করেন না। স্রষ্টা অর্থে ঈশ্বরের সঙ্গে কবিরাও নিজেকে সমান্তরাল ভাবেন। শামীম রেজা ‘আমি আর ঈশ্বর’ কবিতায় যখন বলেন, ‘আমি আর আমার ঈশ্বর নগ্নবুকে কোলাকুলি শেষে ঘুমোতে যাই, একই ঘরে একই খাটে, একই বিছানায়। ইশ্বর নাক ডেকে ঘুমায়, আমি অভিমানী মৃত্যুর পায়াচারী দেখি, উৎস খুঁজি না তার; তেত্রিশবার ছায়া পড়ে চেখে, শুঁড়িখানা চিনি না বলে ভাবহীন রাতের গল্প শোনায় সে…’ কখন জীবন সম্পর্কে নয়ে কবির ব্যক্তিগত অভিজ্ঞান দেখে পাঠক বিস্মিত হন। আবার যখন ‘শান্তিয়াগো নদীটি দেখিনি কোনোদিন’ কবিতায় কবি বলেন, ‘উজানীয়া ডাহুক তা ডাক ডাকবে না শান্তিয়ানো নদীটার ধারে—নদীটা ভয়ে যাচ্ছে চর জেগেছে ভেতরে ভেতরে।’ এটুকু জানার পর পাঠকের বুঝতে বাকি থাকে না, এই নদীতে চর জাগলে কী কী হতে পারে। নতুন চর জাগলে নতুন বসতি হবে, কৃষকের ফসলের ক্ষেত বাড়বে, ফসল উৎপাদন হবে। একটি বিশাল উদ্বাস্তু বা ভূমিহীন জনগোষ্ঠী ভূমির মালিকও হতে পারবে। কিন্তু পৃথিবীর ভারসাম্য হারিয়ে যাবে। একটি বিশেষ অঞ্চলে জলভাগের সীমানা কমে যাবে। এতে পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্তই হবে নগদ উপকারভোগীরাই। কিন্তু এর জন্য দায়ী কে? এরও উত্তর কবি দিয়েছে, বলেছেন নদী নিজেই নিজের কবর খুঁড়েছে।
‘যখন রাত্তির নাইমা আসে সুবর্ণনগরে’ তখন প্রকৃতি জেগে ওঠে। জেগে ওঠে যৌবনবতীর দেহমন। পুরুষও বাদ যায় না। সেও জেগে ওঠে প্রকৃতির কোলাহলমুখর মুহূর্তেও ডাকে। সেও চায় চারিদিকে কোলাহল থাকুক। তার হৃদয়জুড়ে থাকুক বাসনার ব্যকুলতা। সমস্ত পৃথিবী এসে ধরা পড়ুক তার অনুভবের অলিন্দে। জিন-পরী সঙ্গ থেকে শুরু করে গ্রামের ঘোমটাপরা বধূটিও। এ সম্পর্কে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মন্তব্যটি করেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। ‘কৃত্তিবাস পুরস্কার’ ২০০৭-এর সম্মাননা পত্রে তিনি লিখেছেন, ‘‘প্রাচীন বাংলার ইতিহাস জড়িয়ে আছে শামীম রেজার কবিতার পঙ্ক্তিতে, আছে আলো অন্ধকারে মাখা শস্য শ্যামলা মাতৃভূমি। তাঁর ‘যখন রাত্তির নাইমা আসে সুবর্ণনগরে’ কাব্যগ্রন্থটি কথা বলে পূর্ববাংলার লোকজ ভাষায়। শুকতারা যখন আপনার মনের গভীরে কল্পনার উদ্দীপনা ঘটায়, তখনই আবার নিজেকে আবিষ্কার করেন, ‘শুঁড়িখানার ঠিকানা হারানো বালক’-এর মধ্যে। একইসঙ্গে ঐতিহ্য আর আধুনিকতা মিয়ে যায় তাঁর কবিতায়। ক্ল্যাসিক এবং রোমান্টিকের ভেদাভেদ শামীম মুছে দেন যেন।’’ দীর্ঘ কবিতাটিতে রয়েছে ভ্রমণ-পরিভ্রমণ, গ্রামীণ ও শহুরে চিত্র। শুরুটা যেমন তারুণ্য-উচ্ছ্বাস-উন্মাদনা দিয়ে, শেষটা তেমনই বিস্ময়-প্রশ্নে। ইতিহাসের নানা বাঁক পেরিয়ে স্বাধীন দেশে স্বাধীন জাতির স্বপ্ন-আহাদে স্বস্তি। কবিরও বিস্ময়ভরা প্রশ্ন—‘এ মাটি মায়ের পাঁজরের নিচে গইলা যাবো জাইনাও ভাবি: পাহাড়ে উঠতে কান্তিলাগে তবু কেন মানুষ পাহাড়ে ওঠে!’
নতুন ভাষা-সংকেত তৈরিই তাঁর বড় কৃতিত্ব। আঞ্চলিক-কথ্য ভাষার সঙ্গে মান ভাষার সমন্বয় সাধন করে, নিজের জন্য তৈরি করেছেন স্বতন্ত্র এক কাব্যভাষা। এই ভাষা-সংকেত তৈরির সময় তিনি ভুলে মনে রাখেননি পরিপার্শ্ব, এমনকি পূর্ববর্তী কোনো কবির ভাষাশৈলীও বিবেচনায় নেননি। আপন মনে দেবশিশুর মতো ভাষা নিয়ে খেলায় মেতে উঠেছেন। ‘তার ভাষায় একটা উপোর প্রবণতা আছে। কে কী লিখছেন এ ব্যাপারে উদাসীনতাও ধরা পড়েছে, একটা তার স্বেচ্ছায় করা বোঝা যায়। এটাই শামীম রেজার কবিত্ব শক্তির পরিচয়।’ (আল মাহমুদ)।
ইতিহাস ঐতিহ্যের সঙ্গে গ্রামীণ লোকাচার ও লোকবিশ্বাসকে সমন্বিত করেছেন এই কবি। এ কারণে তিনি দেখেন, যখন ‘রাত্তির নাইমা আসে, জীবন গাছের শিকড় ছায়ায় সন্ধ্যাতারা, ভোরে শুকতারার মতন তুই কথা কও শিয়রের শিশুটির সাথে।’ একেবারেই আবাহমান বাংলার অভ্যাসের সঙ্গে বিশ্বপরিমণ্ডলকে একই পঙ্ক্তিতে তুলে ধরেছেন তিনি কোনো কোনো কবিতায়। ‘যখন রাত্তির নাইমা আসে সুবর্ণ নগরে’ কাব্যের ‘বত্রিশ’ নম্বর যুক্ত কবিতায় এভাবে চিত্রটি আঁকা হয়েছে— ‘গিরিবাজ কবুতর ডিগবাজি খায় মাথার কোণায়, দান্তে বিয়াত্রিসের খোঁজে ঘোরে ও-পাড়ায় শাঙ্কিক শ্রেণীর আমরা কজন, যাদের ঠিকানা আঁইকা রাখা আছে বাদুড় ডানায়।’ এখানে দেখা যাচ্ছে, কবি বিশ্বপটভূমিকে এনে স্থাপন করেছেন একেবারে গ্রাম বাংলার জমিনে। শামীম রেজা এর মাধ্যমে একটি সময়ের অস্থিরতাকে যেমন আবিষ্কার করার চেষ্টা করেছেন, তেমনি আঁকতে চেয়েছেন ওই সময়ে পরিপ্রেক্ষিতে কল্পনা ও মনীষার সমন্বয় ঘটাতে।
‘যখন রাত্তির নাইম আসে সুবর্ণ নগরে’ কাব্যে রয়েছে ভ্রমণ-পরিভ্রমণ, গ্রামীণ ও শহুরে চিত্র। শুরুটা যেমন তারুণ্য-উচ্ছ্বাস-উন্মাদনা দিয়ে, শেষটা তেমনই বিস্ময়-প্রশ্ন দিয়ে। ইতিহাসের নানা বাঁক পেরিয়ে স্বাধীন দেশে স্বাধীন জাতির স্বপ্ন-আহ্লাদে স্বস্তি। কবিরও বিস্ময়ভরা প্রশ্ন—‘এ মাটি মায়ের পাঁজরের নিচে গইলা যাবো জাইনাও ভাবি, পাহাড়ে উঠতে ক্লান্তি লাগে তবু কেন মানুষ পাহাড়ে ওঠে!’ কষ্ট ও ফলপ্রাপ্তির যে সম্পর্ক, সে বিষয়কে কেন্দ্র করে এমন প্রশ্ন সাধারণ মানুষের মনে জাগে না সত্য, কিন্তু যিনি পৃথিবীর প্রতিটি কাজের কার্যকারণ সম্পর্ক আবিষ্কারের নেশায় নিজেকে ক্রমাগত জর্জরিত করেন, তার মনে এমন প্রশ্ন অহরহই জাগে। কারণ, তাঁর কাছে শিল্পের দৃশ্যগ্রাহ্য বা অনুভবগ্রাহ্য বিষয়ের চেয়ে এর নেপথ্য রহস্যই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
‘ব্রহ্মাণ্ডের স্কুল’ মূলত ইতিহাস-ঐতিহ্যের মিশেলে সৃষ্ট আত্মকথন। যদিও বেশির ভাগ কবিতাই কবির আত্মকথনই হয়, কিন্তু সব আত্মকথনই আবার সমানভাবে ব্যক্তির মনোভূমিকে প্রকাশ করতে পারে না। তবে কোনো আত্মকথন এত বেশি ধ্যানস্থ মানুষের ঘোরময় স্বাক্ষর হয়ে ওঠে যে, ওই আত্মকথনকে মনে হয় মন্ত্রধ্বনি।
আবার ইতিহাসের সঙ্গে মিথ এবং বাস্তবতার সঙ্গে রূপকথা-উপককথার যোগসূত্র স্থাপন করতে গিয়ে যতটা কল্পনার আশ্রয় নিয়েছেন, ততটা অভিজ্ঞা থেকেও আহরণ করেছেন। একইসঙ্গে গ্রামীণ পটভূমি-শহুরে চিত্রের সম্পর্ক স্থাপন করে দেখিয়েছেন, স্থানিকসীমারেখা ও সংস্কৃতি মানবজীবনে বিশেষ প্রভাব ফেলে। ছন্দ-অন্ত্যমিল ও অনুপ্রাসের ক্ষেত্রে অক্ষরবৃত্তের চাল বজায় রেখে টানাগদ্যে প্রবহমান রেখেছেন প্রায় কবিতা। অন্ত্যমিল বর্জন করেছেন, নিরূপিত ছন্দকে গ্রাহ্য করেননি। একইসঙ্গে অন্ত্যমিল ও অনুপ্রাসও তার কাছে ন্যূনতম গুরুত্ব পায়নি।
শামীম রেজার গীতিময় উচ্চারণ—‘ঘোড়ার কঙ্কাল হাঁটে কলিঙ্গের রাজপথে, সেইসব খোরাসানী ঘোড়া—গুড়ির খোঁজে মধ্যরাত শেষে নাইমা আসে আমাদের গায়, সিডরের বাণ তখন হেমন্তের সমস্ত জানালা ভাইঙা দিয়া যায়।’ বিশ্ব চরাচরের স্বভাবগতি ও নিয়মের সঙ্গে মানবজাতির অভ্যাসের মিল ও সংঘর্ষকে কবি এভাবে চিত্রিত করেন। তবে, এক্ষেত্রে কবি অন্য দশ জনের সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে ফেলেন না। তিনি তাঁর আলাদ স্বভাব তৈরি করেন এবং তা অন্যদেরও জানিয়ে দেন। বলেন, ‘তোমরা কমলালেবুর মতো গোল সার্কাস মাঠে ইঁদুর-বিড়াল খেলার মায়ায় গল্প ফাঁদো।’ কিন্তু ‘জীবন-জুয়ার কোর্টে টিকটিকির মতো লাফালাফি করে আমার অবিশ্বস্ত আঙুল, মুমূর্ষু গ্রামের দেয়ালে সারারাত সুর তোলে নদীর ভাঙন।’ ব্যক্তির অন্তর্ন্দ্ব ও অন্তক্ষরণকে এভাবেই ফুটিয়ে তোলেন তিনি। ইতিহাস ও ভুগোলের সমস্ত ভুবন পরিভ্রমণ শেষে কবি নিজেকেই সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু বলে ঘোষণা দেন। বলেন, ‘আমাকে অতদূর ব্রহ্মাণ্ডের ইসকুলে খুঁজতে যেও না প্রিয়তমা, বৃক্ষের পাঁজরে আছে আমার আপন ঠিকানা।’ একইসঙ্গে নিজের অস্তিত্ব, স্বাতন্ত্র্য ও স্বভাব-রুচির পরিচয় এভাবে ঘোষণা করেন।
ইতিহাস-ভূগোল-ঐতিহ্য ও প্রকৃতি প্রেমের মতো নারী প্রেমে বিশেষভাবে মগ্ন শামীম রেজা। প্রেমের কবিতায় শামীম রেজা প্রাচীন কবিদের মতো শরীর আশ্রয়ী। তাঁর কাছে দেহমন সমান দাবি নিয়ে সমুস্থিত। বুদ্ধিবৃত্তিক ভাব প্রকাশের চেয়ে হৃদয়বৃত্তিক আত্মউন্মোচনেই তাঁর স্বস্তি। একইসঙ্গে আত্মার সঙ্গে দেহের সেতুরচনায়ও তিনি মগ্ন হন—
যে নারী প্রথম প্রেমে আঘাত খেয়ে পুড়েছে মন
সেও আজ ভালোবেসে একজনে বাঁইধাছে ঘর
কালের কয়েদী আমি ডুবে আছি রূহের ভিতর
মুমূর্ষু প্রেমের পাশে আধভাঙা চাঁদের মতন
(হৃদয় লিপি-২১)
পুরো উদাহরণে দেখা যাচ্ছে আঠারো মাত্রার অক্ষরবৃত্তে রচিত। স্মৃতি আশ্রয়ী-প্রকৃতিলগ্ন উপমায় সাজিয়েছেন পুরো স্তবক। হৃদয়-আবেগ, স্বপ্ন ও চিন্তার সম্মিলন ঘটানোর ক্ষেত্রে কবি সমন্বয়ের চেষ্টা করেছেন। চিন্তার সঙ্গে স্বপ্নের, কল্পনার সঙ্গে মনীষার; অতীতের সঙ্গে উপস্থিতকালের।
শামীম রেজার কবিতায় সহজে পরিষ্কার হয়ে ওঠে— পূর্ববর্তী বক্তব্য-চিত্রকল্পের সঙ্গে পরবর্তী বক্তব্য-চিত্রকল্পের যোগসূত্র স্থাপন। কবি জানেন, একটি অনুষঙ্গের সঙ্গে আরেকটির যোগসূত্র স্থাপন করতে না পারলে কবিতা নির্মিত হয়তো হয়, কিন্তু তাকে সৃষ্টি বলে না। উপমা-চিত্রকল্পে অভ্যাসের বিপরীতে তিনি চিত্র আঁকতেই স্বস্তিবোধ করেছেন। ‘যখন রাত্তির নাইম আসে সুবর্ণনগরে’-এর ২০ নম্বর কবিতায় বলছেন, ‘আহারে! দোয়েলা; রাত্তির আমার, একলা পরাণ! কার ভিডায় কান্দো নরমকণ্ঠী পাখি, কার প্রশ্রয়ে ভিজাও মন, কার ঠোঁটে কাপে অনুভূতির প্রথম চুম্বর, কোথায় তোর বাউডিয়া গাঁ, খাড়ালের ছিট ছিট জোছনা-রৌদ্রে কী রহম তোর চলাফেরা মনে পড়ে, মনে পড়ে না?’ এখানে জোছনা-রৌদ্রে’ শব্দবন্ধ বাদ দিলে পুরোটায় কেবল আকুতি-ব্যকুলতা। আর এই দুটি শব্দে যে দৃশ্য ভেসে ওঠে, তাতে বারোমাসের একটি চিত্র ফুটে ওঠে। শামীম রেজা এভাবে সহজ-সরল ও সাধারণ গীতল শব্দবন্ধের ফাঁকে-ফাঁকে হঠাৎ-হঠাৎ কিন্তু সুচিন্তিত চিত্রকল্পের সাহায্যে অতি সাধারণ বিষয়কেও কবিতা করে তোলেন।
তবে চিত্রকল্প-উপমা সৃষ্টির পাশাপাশি তিনি মানভাষার সঙ্গে আঞ্চলিক ও কথ্যভাষারও মিল ঘটিয়েছেন। এক্ষেত্রে তিনি ক্রিয়াপদের প্রচলরীতির ব্যত্যয় ঘটিয়ে সম্বন্ধ ও সম্বোধন পদের ব্যাকরণগত রীতি ভেঙে দিয়েছেন। যেমন— ‘এই জনপদে তুই ছাড়া আর কোনো নদী নাই ও কুমারী নদী দোয়েলা আমার, তুই কি জানো, তোর চোখে ঘুমায় বৃষ্টিমাসী সকাল, ইমনরাগে সন্ধ্যা জাগে কণ্ঠে তোমার।’ এটুকু পাঠ করলে দেখা যাবে, সম্বোধনে ‘তুই’ প্রশ্নে ‘জানো’ বলছেন কবি। বাংলায় সাধারণত ‘তুই’-এর সঙ্গে ‘জানো’ ব্যবহৃত হয়। কিন্তু কবি এখানে ব্যাকরণের এই নিয়মটি ভেঙে দিয়েছেন।
আবার ইতিহাসের সঙ্গে মিথ এবং বাস্তবতার সঙ্গে রূপকথা-উপককথার যোগসূত্র স্থাপন করতে গিয়ে যতটা কল্পনার আশ্রয় নিয়েছেন, ততটা অভিজ্ঞা থেকেও আহরণ করেছেন। একইসঙ্গে গ্রামীণ পটভূমি-শহুরে চিত্রের সম্পর্ক স্থাপন করে দেখিয়েছেন, স্থানিকসীমারেখা ও সংস্কৃতি মানবজীবনে বিশেষ প্রভাব ফেলে। ছন্দ-অন্ত্যমিল ও অনুপ্রাসের ক্ষেত্রে অক্ষরবৃত্তের চাল বজায় রেখে টানাগদ্যে প্রবহমান রেখেছেন প্রায় কবিতা। অন্ত্যমিল বর্জন করেছেন, নিরূপিত ছন্দকে গ্রাহ্য করেননি। একইসঙ্গে অন্ত্যমিল ও অনুপ্রাসও তার কাছে ন্যূনতম গুরুত্ব পায়নি।
শামীম রেজা স্বাধীন বাংলাদেশের সমানবয়সী। ফলে তার বেড়ে ওঠা, ওই সময়কার রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক বলয়ের সঙ্গে তাঁর গড়নেও কিছু প্রভাব রয়েছে। অর্থাৎ এক অস্থির সময়ের ভেতর দিয়ে তিনি বেড়ে উঠেছেন। এরপর দেখেছেন সামরিক শাসন, সামরিক শাসকের পতন। উত্তর নব্বয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন। মূলত কবি শামীম রেজার আবির্ভাবও এর পর থেকে। তাঁর কবিতা চর্চার শুরুর কালে অগ্রজরা মূলত উচ্চস্বরের কবিতা রচনায় নিবিষ্ট হয়েছিলেন। সরাসরি বক্তব্য প্রকাশ করতে গিয়ে অনেকেই নিরূপিত ছন্দকে অস্বীকার করেছেন। বাদ দিয়েছেন, গীতিময়তাও। শামীম রেজার মানসগড়নও ওই সময়কে আবর্তিত হয়ে। ফলে তার কবিতার সময় একটি রাজনৈতিক বাঁকবদলের ইতিহাসকে আশ্রয় করে সৃষ্ট। কিন্তু শামীম রেজার রাজনৈতিক স্লোগনসর্বস্ব কোনো পঙ্ক্তি রচনা করেননি। আবার বাংলা কবিতার চিরায়ত রীতি, অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত কিংবা স্বরবৃত্তকেও গ্রাহ্য করেননি। এভাবেও শিল্পচর্চার একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গকে উপেক্ষা করেও তিনি কবিতায় সাফল্যের স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছেন। এ প্রসঙ্গে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের মতে, ‘কবিপ্রতিভার একমাত্র অভিজ্ঞানপত্র ছন্দ-স্বাচ্ছন্দ্য’। কিন্তু আজকের যুগে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের এই মত ষোলো অনেকেই মানবেন না। মানবেন না যে, এর কারণ, ‘একমাত্র’ শব্দ। তবে, আংশিক সংশোধন করে যদি ‘অন্যতম’ ধরা হয়, তাহলে ছন্দচ্যুতি বা ছন্দপতনকে লঘু দুর্বলতা হিসেবে মেনে নিলে বাংলা কবিতার ভাণ্ডার সমৃদ্ধ হবে, তাতে কবিতার মানহানি ঘটবে না। কারণ, অতীতেও দেখা গেছে, কেবল ছন্দবদ্ধ হলেই তা কবিতা হয় না। বরং অনেক বিশুদ্ধ ছন্দে রচিত রচনাও শেষপর্যন্ত কবিতা হয়নি, হয়েছে ঝরঝরে সরল পদ্য। সুতরাং ‘একমাত্র’ অভিজ্ঞানকে কিছুটা ছাড় দিয়ে ‘অন্যতম’ করে নিলে শামীম রেজা কল্পনা, মনীষা ও অভিজ্ঞতার আশ্রয়ে সৃষ্টি করেছেন, উপস্থিতকাল ও যুগরুচির নিরিখে এর তাৎপর্য সীমাহীন।
কবিতার সময় ও মনীষার দান থেকে