শামসুর রাহমানের শিশুসাহিত্যের দিকটা প্রায় অনালোচিত রয়ে গেছে। অথচ এ ধারায় তার অবদান অনেক। যারা শুধু ছড়াকার হিসাবে পরিচিত তাদের অনেকের চেয়ে শামসুর রাহমানের ছড়ার সংখ্যা কম নয়।
আমাদের দেশে একটি কথা প্রচলিত আছে, একবার কারও নাম ছড়াকার হিসেবে প্রকাশিত হয়ে গেলে সে লেখক আর অন্য কৃতিত্বের জন্য মর্যাদা লাভ করতে পারেন না। এ ভয়ে অনেকে ছড়া লিখতে চান না। অনেকে উদাহরণ হিসেবে অন্নদাশঙ্কর রায়ের নাম টেনে আনেন। হতে পারে অন্নদাশঙ্কর রায়ের ক্ষেত্রে এমনটি হয়েছে, কিন্তু অন্য সবার বেলায় এমনটি হয়েই থাকবে এমন ঢালাও ধারণা কার উচিত কিনা ভেবে দেখা উচিত। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল কি ছড়াকার হিসেবেই শুধু পরিচিত? তারা কি কম ছড়া লিখেছেন? শামসুর রাহমানও প্রচুর ছড়া লিখেছেন। তার ছড়াগ্রন্থ ১৪টি। এগুলো হলো:
১. এলাটিং বেলাটিং
২. ধান ভানলে কুঁড়ো দেবো
৩. গোলাপ ফোটে খুকির হাতে
৪. রঙধনুর সাঁকো
৫. লাল ফুলকির ছড়া
৬. আগুনের ফুলকি ছোটে
৭. নয়নার জন্যে
৮. ইচ্ছে হলো যাই ছুটে যাই
৯. তারার দোলনায় দীপিতা
১০. সবার চোখে স্বপ্ন
১১. চাঁদ জেগেছে সবার চোখে
১২. আমের কুঁড়ি জামের কুঁড়ি
১৩. হীরার পাখির গান
১৪. গোছানো বাগান
এত ছড়া লেখার পরও তার কবিখ্যাতিতে তো ভাটা দেখা দেয়নি!
শামসুর রাহমান ছড়াকার হিসেবে বিশেষ মর্যাদার দাবি রাখেন। ছোট-বড় সব বয়সী পাঠকের জন্য তিনি প্রচুর ছড়া লিখেছেন। যদিও শিশুদের জন্যই লিখেছেন বেশি। তার ছড়ায় একটা বিশেষ ভাব ভেতরে ভেতরে বহমান থাকে। তার ছড়ায় শিশুমনস্কতা, সমাজ-দৃশ্য, রাজনীতি, অর্থনীতি, নাগরিকজীবনের নানামুখী সমস্যা উঠে এসেছে। তার ছড়ার ভাষা অনেক সহজ। ছোটদের জন্য লেখাগুলো খুব অল্প সময়েই জনপ্রিয়তা লাভ করে এ কারণেই। তার ছড়া সম্পর্কে রোকনুজ্জামান খান যে মন্তব্য করেছেন সেখান থেকে কিছুটা তুলে দেওয়া যায়। কবিতার বক্তব্য বুঝতে একটু চিন্তা করতে হয়। কিন্তু ছড়া পাঠের সঙ্গে সঙ্গে চোখের সামনে সেই দৃশ্য ভেসে ওঠে। ছড়ার রস আস্বাদান করতে পাঠককে খুব গভীরে যেতে হয় না। এর মানে এই নয় যে, ছড়ায় চিন্তার খোরাক থাকে না। থাকে , তবে তা সহজ-স্বচ্ছ, জটিল নয়।
শামসুর রাহমানের ছড়ায় নির্দিষ্ট মাত্রার পর্ববিন্যাস, চমৎকার অন্ত্যমিল, বিষয়বৈচিত্র্য এবং শব্দনির্বাচনে কুশলতা বিশেষত্ব নিয়ে চিহ্নিত। এভাবেই তিনি আমাদের সাহিত্যের ছড়ার ঝুলিটি সমৃদ্ধ করেছেন।‘ছড়ার বই’ নামের ছড়াটিতে তিনি অসাধারণ ভঙ্গিতে পালটকদের স্মরণ করেছেন। যেমন,
আমার ছড়ার বই পড়তে দেব কাদের?
এ- বই পড়ার মতো সময় আছে যাদের
তাদের, তাদের, তাদের।যারা জোছনা রাতে দ্যাখে পরীর নাচ,
যারা জানলা দিয়ে দ্যাখে সোনার গাছ,
যারা হয়রে মাঝি নায়ের মতো চাঁদের
চাঁদের, চাঁদের, চাঁদের।
আমার ছড়ার এ-বই হাতে দেব তাদের
তাদের, তাদের, তাদের।
ছড়াটি শুধু এতটুকু পড়লে এর পরো মানে বোঝা যাবে না। সবটুকু উদ্ধৃতি দিতেই চাই। না হলে অতৃপ্তি থেকেই যাবে।
আমার ছড়ারএ-বই পড়তে দেব কাদের?
মিঠে দুষ্টুমিতে চক্ষু ভরা যাদের,
তাদের, তাদের, তাদের।যারা বেড়ায় উড়ে পক্ষিরাজের পিঠে
যারা জিরোয় বসে স্বপ্নবাড়ির ভিটে
যারা ভেলকি বোঝে হঠাৎ মিলের ফাঁদের,
তাদের, তাদের, তাদের।আমার ছড়ার এ-বই পড়তে দেব তাদের,
তাদের, তাদের, তাদের।
এ ছড়ায় শামসুর রাহমান তার ছড়ার পাঠকদের মধ্যে বিশেষ রুচি দাবি করেছেন। যেসব শিশু ছড়ার প্রকৃত পাঠক; অর্থাৎ পড়ার মতো সময় এবং ধৈর্য আছে, কল্পনাশক্তি অনেক, দুষ্টুমি করার অভ্যাস আছে, স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে, ছন্দমিল এবং শব্দের ফাঁকগুলো ধরতে পারে তাদেরকেই তিনি ছড়াগুলো পড়তে দেবন। সবার জন্য তিনি লেখেন না, এটা তিনি শুরুতেই পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন। এ ছড়াটি তার প্রথম ছড়ার বইয়ের প্রথম ছড়া। ‘খোকন গেছে ক্ষীরসাগরে’ ছড়ায় লিখেছেন,
আলুর পাতা আলুথালু বেগুন পাতায় দই,
সাতটা কাকে খেয়ে গেল, খোকন গেল কই?
খোকন গেছে পাঠশালাতে লাল গামছা গায়
বইগুলো সব রইল পড়ে বুড়ো বটের ছায়,
খোকন গেছে ক্ষীরসাগরে ময়ূরপঙ্খি নায়॥
এ ছড়ায় লেখক বাংলার রূপকথার রাজ্যে প্রবেশ করেছেন। রূপকথার দু’টি উপাদান এনেছেন। ক্ষীরসাগর নামে একটি কল্পিত স্থান এবং ময়ূরপঙ্খি নামে বাংলার একটি লোকবাহন ব্যবহার করেছেন। এর সঙ্গে লোকপরিচ্ছদ গামছা পরিয়েছেন খোকনকে। এর সঙ্গে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রধান উপকরণ স্কুলও এনেছেন। প্রাচীন সভ্যতার প্রতীক বুড়োবটের নিচে বইগুলো ফেলে রেখে খোকন রূপকথার রাজ্যে প্রবেশ করে। প্রচ্ছন্নভাবে এখানে ঔপনিবেশিকতা এড়িয়ে নিজস্ব শেকড়ে আত্মানুসন্ধানের কথাও বলা হয়েছে।
‘ফতুর’ নামের ছড়াটিতে দেখা যায় বাঙালির অর্থনীতির ইতিহাস উঠে এসেছে। পুঁজির ব্যবহারে সঠিক দিক নির্দেশনার অভাবে লতু নামের লোকটা কেমন করে ফতুর হয়ে যায়। প্রাচীনকাল থেকেই এ জাতির মধ্যে যাদের প্রচুর টাকা-কড়ি ছিল তারা সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারে নি বলে তিন পুরুষও ভোগ করতে পারে না। আবার অনেকে প্রজন্মক্রমে দরিদ্রই রয়ে যায়। অর্থনৈতিক বৈষম্যের এটাও একটা প্রধান কারণ।
ঐ পাড়ার ঐ লতু বেজায় চতুর,
হাজার কয়েক কড়ি ছিল লতুর।
অষ্টপ্রহর লেগেই আছে ভোজ যে,
গপ্ গপাগপ্ গিলত গজা রোজ সে,
গজা খেয়েই লতু হল ফতুর।
আবার দেখা যায় ‘শীতের ছড়া’য় তিনি আর্থ-সামাজিক আয় বৈষম্যের শিকার এক লোককে খোকন নিজের ইচ্ছাশক্তি দিয়ে পূর্ণ করে দিতে চাইছে।
শীত সকালে লোকটা কাঁপে
কাঁদে সবার পা ধ’রে
একটা শুধু ছিল জামা,
তা-ও ছিঁড়েছে ভাদরে।
হি-হি শীতে থাকে প’ড়ে
ডাকে না কেউ আদরে।
এ পর্যন্ত পড়ে আমরা সুকান্তের কবিতার বিষয়-আশয় খুঁজে পাই। শ্রেণীবিভক্ত সমাজে শ্রেণী সংগ্রামের সম্ভাবনা কিংবা প্রয়োজনীয়তার একটা ইঙ্গিত পাওয়া যায়। কিন্তু শামসুর রাহমান পরের স্তবকেই নিজস্বতা নিয়ে উপস্থিত হন।
বলল তাকে খোকন সোনা,
মিছে কেন কাঁদরে?
তুমি একটু ধৈর্য ধরো,
সাহসে বুক বাঁধোরে।
শহরটাকেই দিচ্ছি ঢেকে
পশমি বড় চাদরে।
এখানে এসে আমরা মধ্যবিত্তের একটি শিশুর স্বপ্নই দেখতে পাই। এ শিশু শুধু স্বপ্ন দেখতে জানে, সে সমাজ থেকে মানুষের অভাব অনটন দূর করবে। এ ধরনের আরেকটি ছড়া ‘লোকটা’।
লোকটা ছিল লিকলিকে খুব
চুল ছিল তার ঝাঁকড়া।
দু’চোখে তার ভাসত শুধু
কুস্তিগিরের আখড়া।
পাড়াটাকে তুলত মাথায়
জোর বাজিয়ে নাকড়া।বাজার ঘুরে দেখল যখন
চাল ডাল সব আক্রা,
বুদ্ধি করে চলল খেতে
নীল সাগরের কাঁকড়া।
কাঁকড়া খেতে বিষম খেল,
ছিঁড়ল যে তার টাকরা।
একজন মানুষ কুস্তি করবে এমন শক্তি চর্চার স্বপ্ন দেখে। অথচ তার পেটে ভাত নেই। বাজারে গিয়ে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি দেখে সে নিরুপায় হয়ে পড়ে শেষ মহূর্তে নীল সাগর রূপী বিষাক্ত সমুদ্রের কাঁকড়ার মতো অখাদ্য খেয়ে টাকরা ছিঁড়ে ফেলল। এমনই অর্থনৈতিক পরিস্থিতির আরেকটি ছড়ার নাম ‘ছড়া’।
সবাই করে আহা উহু,
কার কাহিনী কে শোনে?
চায়ের চিনি উধাও হল,
চাল মেলে না রেশনে।
সর্ষে তেলের ঘ্রাণ পাওয়া ভার,
নেইকো ঘরে জ্বালানি।
পণ্যগুলো হচ্ছে লোপাট,
ধন্য চোরাচালানি।
এ ছড়াটি সম্ভবত স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ের চিত্র ধারণ করেছে। এ ছড়ায় শামসুর রাহমান রাজনীতি, অর্থনীতি এবং দেশের সামাজিক পরিস্থিতি তুলে ধরেছেন। আবার ছোট ছড়া ‘ফাও’এ একই ধরনের বিষয় তুলে ধরেছেন।
ফাও পেতে চাও ফাও?
ওয়াসার কাছে চাও।
পানির সঙ্গে পাবে
গুবরে পোকার ছা-ও।
এ ধরনের আরও ছড়া আছে, ‘বিকল্প’, ‘আদ্যিকালে’, ‘হা-ঘরে’, ‘ক্ষুধা’ ইত্যাদি। ‘বিকল্পে’ দেখা যায় মানুষের মৃত্যু হলে কাফন-দাফন করাও ব্যবস্থা নেই। ছেঁড়াকাঁথা আর কথা কলাপাতা মুড়িয়ে কবর দেওয়া হচ্ছে। চার লাইনের ছোট্ট ছড়া সেটি। আবার ‘আদ্যিকালে’ তে দেখি কবি নিজে বলছেন কাপড় নেই, তাই তিনি গাছের ছাল এবং পাতায় নিজের দেহ মুড়ে দিব্যি হেঁটে চলছেন। তার মনে হচ্ছে আদিমযুগে ফিরে গেছেন। ‘হা-ঘরে’ ছড়ায় দেখা যায় এক হা-ঘরে লোক, তার থাকার জায়গা নেই। ইট-পাথরের বিশাল শহরের বিরাট উঁচু দালানের দিকে চেয়ে থাকতো। সবাই তাকে তাড়িয়ে দিতো। সে অসহায় পথে পথে ঘুরতো। মনে মনে ভাবতো পাহাড়ে কিংবা বনে গিয়ে কি থাকা যায় না? শেষ পর্যন্ত সে গাছের কোটরে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। এখানেও আমরা দেখতে পাই সেই আদিমযুগে ফিরে যাওয়া। ‘ক্ষুধা’-য় দেখতে পাই একটা লোক প্রবল ক্ষুধার তাড়নায় সবকিছু গিলে খায়।
পাখির বাসা, কালির ঝুল,
নবাববাড়ি, লোহার পুল,
দেখছি শুধু পুরছে পেটে
পটকলটা খাচ্ছে চেটে।
এই মহা পেটুক লোকটা শেষ পর্যন্ত ঢাকার ডিআইটি ভবনটাও গিলে খায়। এখানে ধারণা করা যায় কোনও একজন দুর্নীতিপরায়ণ শাসকের কথা বলা হয়েছে। কালোবাজারিদের সঙ্গে যে শাসকদের একটা গোপন সম্পর্ক ছিল সে কথাটা খোলাখুলি তুলে ধরেছেন শামসুর রাহমান ‘সম্পর্ক’ ছড়ায়। একেবারে সহজ ভাষা এবং সোজা বক্তব্য।
রাতারাতি লাল হয়ে যায়
কালোবাজারি
গুনলে পরে হবে ওরা
কয়েক হাজারই।
আইন বলে, হ্যাঁ গো, কাজটা
ওদের সাজারই।
কিন্তু ওদের সাজা দিলে
রুই কাতলা সবাই মিলে
রেগেমেগে করবে মিটিং
করবে মুখ ব্যাজার-ই।
‘বিবেচনা’ নামক ছড়াটিতে দেখা যায় একই প্রসঙ্গ এসেছে একটু ভিন্নভাবে। সেখানে ঠগ বাছতে নিষেধ করা হচ্ছে। কারণ ঠগ বাছতে গাঁ উজার হয়ে যাবে। এ ভয়ে কেউ এখানে ঠগ বাছে না। এ গাঁয়ে তাই ঠগ বাছাই বারণ। ‘মিনতি’ নামক ছোট্ট ছড়াটিতে দেখা যায়, ইঁদুরের হাতে-পায়ে ধরা হচ্ছে, সিঁদুর দিয়ে পুজো মানা হচ্ছে সে যেন চাল আর ডাল অন্তত না খায়।
কিছু ছড়ায় স্বৈরশাসনের নানারূপ এবং ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া দেখতে পাই। যেমন, ‘আজব গান’, ‘আতা গাছে ডালিম গাছে’ এবং ‘রূপকথা’। প্রথমেই দেখা যাক ‘আজব গান,
আজব কথার আজব সুর গান চলেছে বেতারে।
তফাত বোঝা দায় হ’ল রে তবলা এবং সেতারে।
গানের খোঁচায় প্রাণ গেল রে, কোন দেশী এই কেতারে?
বলল হেঁকে ধোপার গাধা গান গাবে সে-ও বেতারে।
একটা দেশে স্বেচ্ছাচারিতা যখন শিল্পের রাজ্যেও দেখা যায় তখন এমনই পরিস্থিতি দেখা যায়। সরকারি প্রচারযন্ত্রে এমনই শিল্পের নামে অশিল্প চর্চা চলতে থাকে। ধোবার বোঝাবাহী গাধাও তখন শিল্পী হয়ে ওঠে। ‘আতা গাছে ডালিম গাছে’ ছড়াটি দেখি এবার,
আতা গাছে চারটি পাখি, ডালিম গাছে তিন
সাতটি পাখি মনের সুখে নাচে তা ধিন ধিন।
সাতটি সাতটি সুরে গান গেয়ে যায় রোজ,
আতা গাছে, ডালিম গাছে সুরের সে কী ভোজ!
এটুকু পড়ার পরে মনে হবে এটি কোনও শিশুসুলভ মজার ছড়া। কিন্তু না, পরের স্তবকেই দেখা যায় স্বৈরশাসনের প্রকটরূপ।
হুকুম এলো একই সুরে গাইতে হবে গান,
নইলে জেনো সাতটি পাখির যাবে যে গর্দান।
শুনল সবাই গাছতলাতে বাপরে সে কী হাঁক,
কৈ পালাল গানের পাখি শূন্য করে শাখ?
আতা গাছে, ডালিম গাছে বসছে শুধু কাক!
আগের ছড়ায় দেখেছি ধোপার গাধা শিল্পী হয়ে ওঠে, আর এ ছড়ায় দেখছি শেষ পর্যন্ত গানের পাখি হিসেবে থাকে কাক। গানের পাখিদের যখন জাতীয় সংহতির নামে একই মতাদর্শের পতাকাতলে সমবেত হয়ে এক ভাষায় এবং একই সুরে গাইতে বলা হয় তখন সব পাখিই পালিয়ে বেড়ায়।