প্রেম, যৌনতা, অস্থিরতা, রাজনীতি, আত্মকেন্দ্রিকতা, অনুকরণবিমুখতা, পরম্পরাহীনতা, নিভৃতচারিতা, শব্দের অযাচিত দুর্বোধ্যতা, আত্মপ্রকাশের উন্মত্ততা, আবেগের নিয়ন্ত্রণহীনতা—এ সময়ের অন্যতম কাব্য অনুষঙ্গ। সৃজনের মনোজগতের এরা স্বাধীন সতত। এই অসাধারণ প্রজ্ঞাময় আর প্রবহমান কাব্য পরিভ্রমণে শামিল হলেন—ওমর কায়সার, চঞ্চল আশরাফ, ব্রাত্য রাইসু, জাফর আহমেদ রাশেদ, সরকার আমিন, বায়তুল্লাহ কাদেরী, সরকার মাসুদ, শামীম রেজা, শাহনাজ মুন্নী, শামীম সিদ্দিকী, আলফ্রেড খোকন, কামরুজ্জামান কামু, বদরুল হায়দার, মাদল হাসান, নওশাদ জামিল, শুভাশিস সিনহা, কাজী নাসির মামুনসহ অনেকে। শাফিক আফতাব তাদেরই একজন।
খুব নিবিড়ভাবে লক্ষ করলে দেখা যাবে, শাফিকের কবিতার প্রিয় অনুষঙ্গ সেই আকাঙ্ক্ষার ঘর নির্মাণ। প্রেম প্রণয় কল্প-রসসিক্ত রোমান্টিক ভাবালুতা এবং কখনো সমকালীন বাস্তবানুগ বিষয়ের চিত্রায়ণ তার কবিতাকে দিয়েছে নরোম কাশফুলের মুগ্ধতা। কোনো দুর্বোধ্যতা নেই, জটিল সমীকরণের দুর্বহ বাসনাও নেই। আছে সরল মিষ্টি হাসির রেখা। প্রেম বিলাস পরতে পরতে। পঙ্ক্তির আড়ালে-আবডালে রোমান্টিকতার অনিন্দ্য প্রকাশ। না, কোনো রাখঢাক নেই। নিঃসঙ্কোচ উপস্থাপন। পঙ্ক্তির সারল্যে স্পন্দিত হয় স্বচ্ছতোয়া জলের প্রতিবিম্ব। বস্তুত শিল্পী হওয়ার চেয়ে শিল্পের প্রতি ফ্যাসিনেশনটাই তার বেশি। তার কবিতায় কর্ণফুলির খরস্রোত নেই, নেই জ্যৈষ্ঠের খররোদ্রের অশ্রুশূন্য রোদন, বরং নম্র জলের আর্শিতে বিম্বিত চিত্র-বিচিত্র শব্দের কারুকর্মে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে জৈবনিক পাওয়া না পাওয়ার কথকতা। উচ্ছ্বাসের প্রাবল্যে শাফিকের কবিতা স্পন্দিত হয় না। বিশ্ববোধ, নাগরিক সুখ, শোক উভয়ই আছে কিন্তু তা তার আসল গন্তব্য নয় বলে মনে হয়েছে। ঢাকাস্থ জীবনের নানা ক্লেদ নানা অপ্রকাশ্য আধারাবৃত্ত বিষয়ও তার কবিতার অনুষঙ্গ হয়েছে। তারও চেয়ে বড় কথা একটু মানবিক আকাঙ্ক্ষার সরলায়ন, না পাওয়ার উৎকণ্ঠা, তার পিতৃভিটা থেকে উঠে আসা জীবনের স্মৃতিতর্পন, ফেলে আসা অতীতবিধুরতা, জৈবনিক অনিশ্চয়তা তার কবিমানসকে অনেক বেশি স্থিতি দিয়েছে। শাফিক আফতাবের কবিতা পাঠান্তে এ কথা বলা যায় সহজেই। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক :
এই পৃথিবীতে
এক পৃথিবী আছে
সেইখানে ভীষণ নির্জনতা আছে
আছে কোলাহল
শুভ্রা সেইখানে তুমি নাকি থাকো?
আমিওতো নির্জনতা ভালোবাসি
ভালোবাসি কোলাহল।তোমার নির্জনতায় আমার নির্জনতা
তোমার কোলাহলে আমার কোলাহল
( শুভ্রা, এক বিকেলে )
কিংবা
চলে যাবে
বেদনার ক্ষত স্মৃতিঘন দিন।
ভুলে যাবো সব দুঃখ
নির্বাসিত জীবনের হাহাকার
মুছে গিয়ে আসবে
প্রসন্ন প্রহর,
এক বিরাট তৃপ্তির হাসিতে বড় সুখ পাব আমি।
(নির্বাসনের কোনো এক মুহূর্তে, পরিত্যক্ত পদাবলি )
তাছাড়া কবিতা বিষয়ে কবির আত্মবিশ্বাস ও আত্মানুভূতি এতটাই নিবিড় যে, এখানে প্রিয়া কিংবা কবিতাকে আলাদা করা কঠিন হয়ে পড়ে। ঐতিহ্য আর প্রকৃতিকে মন্থন করে কবি খুঁজে ফিরেন মানসীকে। কবিতার শরীরে জুড়ে থাকা ফুলের সৌরভ কবিকে বিমোহিত করে। যা কবিকে করেছে আদিম কৃষক, যথার্থ চাষি। চাষেই তার পরিতৃপ্তি। চাষে তিনি পরিকর্মা। চিন্তার পরিশীলনের সন্ধান তিনি পেয়েছেন। শোভন সুন্দরের আশ্চর্য দেখা পেয়েছেন কবি এখানে। এমনই কিছু পঙ্ক্তিগুচ্ছ :
শীত সকালে গরম ভাতের ভাপ উঠছে তোমার সুন্দরের শরীর থেকে—
আজ এই শীতে সাত সমুদ্র, তেরো নদীর ওপার থেকে আনন্দ এসেছে কামনার লেকে
আজ খুলে গেছে সাতটি অমরাবতীর আনন্দ আর বিলাসের বাতাস—
আজ তুমি কেমন পেলব, সুন্দর, ফুলবতী, মুখর করেছ পউষের মাস।
…
তোমার গ্রন্থি জুড়ে আজ সুগন্ধি ফুল কবিতার ভাঁজে ভাঁজে ছন্দের ব্যঞ্জনা
আমি আজ এক আদিম কৃষক, ফলাবো ধান—কোনো বাধা মানবো না।
(কবিতার গ্রন্থি জুড়ে সুগন্ধি ফুল, বসন্ত বিষণ্ন সন্ধ্যা)
কবির আত্মবিশ্বাস, আত্মঅভিপ্রায় অদ্ভুত সরলরেখায় অঙ্কিত। কবি জানেন তার কাঙ্ক্ষিত নিকেতন কত দূর। কবি তাই স্বপ্ন দেখেন প্রসন্ন প্রহরের। সহজাত এক স্বপ্নে বিভোর কবি আত্মার অলিন্দে গড়ে তোলেন তার ইপ্সিত কাব্য প্রতীমা। ব্যর্থতার অক্ষমতার আবার তার প্রতনু সক্ষমতারও চিত্র নির্ভার চিত্তে অক্ষরের মূর্তিতে নির্মাণ করেন। তাতে তার কোনো গ্লানি নেই, নেই সামাজিক সৌজন্য। ভালোবাসতে চান, ভালোবাসাও চান তবে প্রার্থিতজনকে জানিয়ে দেন তার দৈনন্দিন বাস্তবতা। এতে আর যাই থাক প্রেমের নামে ভণ্ডামি থাকে না। যেমন কবি বলেন:
আমি তো বলিনি তোমাকে ভালোবেসে শহিদ হবো
কারণ, ভালোবাসা তো ক্ষুধাতুর মনের ভোজ্য,
আমি তো বলিনি শাহজাহানের মতোন বানাবো প্রেমের ব্যুহ
বলেছিলাম: তোমাকে কায়িক শ্রমে দুবেলা দুমুঠো ভাত খাওয়াবো।
(তুমি আমার সক্ষমতা জানতে, অক্ষমতাও, ধানফুল)
কবি এবং মানুষ অবয়বে একই হয়েও তাদের একটা ভিন্নতা থেকে যায়। জীব মাত্রই জৈবিকতাকে লালন করে। কবিও লালন করেন সে জৈবিকতাকে। কিন্তু কবি তার জৈব কাঙ্ক্ষাকে তিনি তার ভাব আর ভাষার কারুকার্যে করে তোলেন শিল্পীত। তাই হয়তো প্রেমিক কবি মানব-মানবীর কামার্ত জৈবিক রসায়নকে সঙ্কোচহীন আত্ম রিরংসার নিরাভরণতায় প্রকাশ করেন এভাবে :
গাঢ় আঁধার চাদর হয়, আমরা নগ্ন হই, দুই বিপরীত লিঙ্গ-
লজ্জাগুলো আঁধারের বানে ভেসে যায় সাগরে জলে কিংবা বনান্তরে,
ঋদ্ধ হই একে অপরের পেয়ে আসঙ্গ
দেখি পৃথিবীর যতো স্বাদ, আহ্লাদ এখন আমাদের মনের ভেতরে।
(গাঢ় আঁধারের জলের গভীরে, বসন্ত বিষণ্ন সন্ধ্যা)
কিংবা
অন্তর্গত সৌন্দর্যে অনার্য মেয়ে তুমি অমরার সুধা মেখে মুখে তুলে দিয়েছিলে পুলক
অমনি ফুল হয়ে ফুটেছিলো তোমার নাকের নোলক
…
হাতের মুঠোয় ফুটতো কামনার সুবাসিত ফুল
বুকের গহীনে দহনের উত্তাপগুলো অবিকল স্বর্গলোকের দুয়ারে নিয়ে যেতো আমাদের
কৃত্রিম ঝর্নার ব্যঞ্জনায় দুলে উঠতো তোমার কানের দুল।
(অন্তর্গত সৌন্দর্যে অনার্য মেয়ে, প্রাগুক্ত)
মানবিক কামকে উসকে দিতে নির্মলেন্দু গুণ যেমন বলেন :
মিছে কেন মাথা নত ক’রে আছ লজ্জায়?
আমিও নগ্ন, তুমিও নগ্ন।
এসো, আমরা দু’জনে দু’জনার খেলা দেখি,
ওরা দোঁহে মিলে এক হোক কামশয্যায়।
(৬২, কামকানন)
কিংবা আল মাহমুদ যখন বলেন-
শরমিন্দা হলে তুমি ক্ষান্তিহীন সজল চুম্বনে
মুছে দেবো আদ্যাক্ষর রক্তবর্ণ অনার্য প্রাচীন।
বাঙালি কৌমের কেলি কল্লোলিত কর কলাবতী
জানতো না যা বাৎসায়ন, আর যত আর্যের যুবতী।
(০২, সোনালি কাবিন)
মানবিক ইচ্ছার কোনো গাছ-পাথর নেই। মানুষ সামাজিক জীব। তার চিন্তার পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত অযুত ভাবনারা এসে ভিড় করে। সে হয়ে উঠতে চায় স্বাপ্নিক। স্বপ্ন তাকে ঘিরে থাকে । ব্যর্থতার গ্লানি বয়ে পরাভব মেনে মানুষ বাঁচতে চায় না। আর সৃষ্টিশীল মানুষ তো ক্রমাগত নিজেকে অতিক্রম করতে চায়। কেননা সৃষ্টিশীল মানুষ জানে মানুষ তার আশার সমান। পলায়নপরতা মানুষের সর্বৈব স্বভাব নয়। ঐকান্তিক অবগাহনে, কল্যাণ-অকল্যাণ বোধে ঋদ্ধ রিক্ত সর্বাস্থায় মানুষই মানুষের শেষ আশ্রয়। কবি আবুল হাসান যেমন বলেন, ‘এ ভ্রমণ আর কিছু নয়, কেবল তোমার কাছে যাওয়া।’ আশাবাদী কবিও ভালোবাসার প্রতি প্রচণ্ড দুর্বলতা থেকে তাই উচ্চারণ করেন শেষাবধি :
মানুষের কাছে তবু ফিরে আসি—ভালোবাসি
আপন গরজেই বাড়িয়ে দেই ভালোবাসার হাত;
আকাশে মেঘ থাক আর না থাক—একদিন হবে তো বৃষ্টিপাত!
(মানুষের কাছে ফিরে আসি, ধানফুল)
কবি যখন অতীতাশ্রয়ী হোন তখন তার সত্তায় কেঁপে ওঠে যাচিত সময়ের ভাবনা। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলায় দোল খায় তার অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ। বিক্ষিপ্ত ভাবনারা পাখা মেলে। কবির বিচ্ছিন্নতাবোধ তীব্র হয়। আলোকপিয়াসী কবি অধরা কল্পনায় করেন সময়ের অপচয়। আত্মমগ্নতায় কবির আক্ষেপ প্রক্ষিপ্ত হয় তখন এমন নস্টালজিক ব্যঞ্জনায় :
কথা ছিল
এই পৃথিবীর পুরোনো বনানীর পথ ধরে
আমাকে হাঁটাবে তুমি,
যেখানে পৃথিবী খুব ভালো লাগে,
যেখানে শান্তি আর আলো
সুখ আর ভালোবাসা
যেখানে পৃথিবী নীল-নীল জরির জাল বুনে
সারাবেলা গান গায়-কথা বলে।
(কথা ছিল, এবার ধরা দাও)
শাফিক সময়ের সঙ্গী হতে চেয়েছেন কখনো কখনো খুব আন্তরিকভাবেই। বিশেষত রোমান্টিকতার নতুন অভিজ্ঞানে নিজেকে সিক্ত করতে চেয়েছেন বারংবার। কিন্তু শাফিকের কবিতায় প্রেম নতুন কোনো ফর্মে আসেনি। রোমান্টিকতাও নয়। প্রেমের বেদনাবোধ যদিও সবকালেই একই রকম। খুব একটা রকমফের নেই। অটুট ইচ্ছার অরূঢ় প্রকাশ তার কবিতাকে প্রবেশ করিয়েছে সরল সরণিতে। এটাকে সরল অসাধারণত্ব অভিধা দেয়া যেতে পারে। বাঁকা, অসরল পথ তার অকাম্য। তবুতো অচেনা অজানা কতশত পথে কবিকে হাঁটতে হয়। অর্জিত হয় নির্মম নিরেঠ অভিজ্ঞতা। বেদনার নীলে কবি হয়ে ওঠেন নীলকণ্ঠ। এক চিলতে ভালোবাসার জন্য একটি ছোট্ট চিঠির জন্য কবি মন হয়ে ওঠতে পারে অস্থির মৃদঙ্গ। তখন এক ধরনের অবসেশন কবিকে আঁকড়ে থাকে। তাই কবি কখনো বাউল, কখনো গৃহী, তবে সর্বোপরি কবি মানুষ। নতুন শব্দের মৃদু ঢেউ কবির আত্মায় টোকা দ্যায়। আবেগের রুদ্ধ দুয়ার খোলে বেরিয়ে আসে শব্দের তরঙ্গ। কবিতাতো মূলত শব্দেরই তরঙ্গ। শাফিক আফতাবের কবিতায়ও সে তরঙ্গ আছে। তবে তা অনেকটাই ব্যর্থতার মোড়কে আবৃত। অপেক্ষার অনলে দগ্ধ । এক বিকেলে-কাব্য গ্রন্থের ‘চিঠি’ কবিতার প্রথম কয়েকটা পঙ্ক্তি এ প্রসঙ্গে পাঠ করা যেতে পারে:
তোমার চিঠির অপেক্ষায় বসে থাকি
অসহন অস্থির শব্দে
সদরের দরোজায়
কিংবা গলিপথে-রাজপথে
একরাশ নীল আর শুভ্রতার অপেক্ষায় বসে থাকি
সমস্ত পূর্বাহ্ণ আর
অপরাহ্ণ ঘিরে
তোমার অপেক্ষায় বসে থাকি
যেন বৃষ্টির অপেক্ষায় বসে থাকি
তবুতো
লিখোনা
একটি কথা।
তৃষিত মাঠের বুকে এক পশলা বৃষ্টি যেমন দিতে পারে অপার স্বস্তির বার্তা তেমনি কবির তৃষার্ত মনকে ভিজিয়ে দেয়ার জন্য চিঠির অপেক্ষাকে বৃষ্টির সঙ্গে তুল্য করে কবি চমৎকার একটি অনুষঙ্গকে উপস্থাপন করেন। পাঠকের নিশ্চয় মনে পড়বে এরকম নিবিড় ব্যর্থতা আর আকুতি নিয়ে, একটি চিঠি পাওয়ার ব্যাকুলতা নিয়ে ষাটের অন্যতম কবি মহাদেব সাহা তাঁর আরাধ্য প্রেয়সিকে উদ্দেশ্য করে লিখেছিলেন বাংলা কবিতার অসাধারণ কিছু পঙ্ক্তিমালা :
করুণা করেও হলে চিঠি দিও, ভুলে গিয়ে ভুল করে একখানি চিঠি দিও
খামে
কিছুই লেখার নেই তবু লিখো একটি পাখির শিস
একটি ফুলের ছোটো নাম,
টুকিটাকি হয়তো হারিয়ে গেছে কিছু হয়তো পাওনি খুঁজে
সেই চুপচাপ কোনো দুপুরবেলার গল্প..
(চিঠি দিও, কী সুন্দর অন্ধ)
অপেক্ষার অনলে পোড় খাওয়া কবি আবার কবির দায়কে অসাধারণ পঙ্ক্তির আবেশে উপস্থাপন করেন অন্য আরেক কবিতায়। সৃষ্টিশীল মানুষ তার অজ্ঞাতেই হয়তো লালন করে অন্য আরেক ধর্মকে। তার কি আদৌ কোনো নাম আছে? হয়তো আছে, কিংবা নেই। তার একান্ত ধর্মের সমালোচক কবি স্বয়ং। এখানে কবিই কবির পথনির্দেশক। কবি এখানে আত্মবিশ্বাসে নির্ভার, মননে অনেক আধুনিক ও প্রগতিবাদী। কবি ও কবির ধর্ম সম্পর্কে শাফিকের অভিমত তাই এরূপ :
একজন কবি সত্য-সুন্দরের নিরলস নির্মাতা
ধর্মাতীত এক অতি ধর্মের অধিবাসী।
ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানবিক পৃথিবীর নাগরিক।
একজন কবি সৃষ্টির সম্ভারে
ভরে দেয় বহমান কালের ঝুড়ি।
সত্য-সুন্দরের সাধনায় কাটিয়ে দেয় সারাটি জীবন
একজন কবি তবু যুগে যুগে সমাজের কলঙ্কের অভীধা।
(একজন কবি, ভাঙনের শব্দ)
কবির কথিত সত্য-সুন্দরের সাধনার ব্যাখা বহুমাত্রিক। এখানে সর্বোতো অর্থেই বৈষয়িক স্বার্থ-বৈভবের চেয়ে চিত্তানন্দের বিষয়টিই মুখ্য। কবি বা শিল্পী সেই কাজটিই আপন মনে করে যান বিশ্ববীক্ষাকে চৈতন্যে ধারণ করে। সে অর্থে শিল্পীমাত্রই বিশ্বনাগরিক। এ কর্মবোধ যে সৃজন বেদনা থেকে উদ্ভূত তার সঙ্গে বিষয়ের চেয়ে অবিষয়ের সম্পর্কই অধিক। শাফিক কবি ও গবেষক। সমানতালে লিখে চলেছেন। কবিতার পাশাপাশি গদ্যগ্রন্থও উল্লেখ করার মতো। শিল্পী শাফিক কি উত্থানপ্রিয়, প্রকাশ উন্মুখ, নাকি আত্মপ্রকাশে অস্থির? তার উত্তর আমার জানা নেই। শুধু এটুকু বলতে পারি শাফিক যুগপৎ নিরলস ও নিরন্তর সাহিত্যকর্মী। তার পথ চলায় কোনো ক্লান্তি নেই। তার লেখ্যকর্মের পূর্ণ বিচারের সময় এখনো ঢের বাকি। কবিতার গলি-ঘুপচিতে তার প্রবেশাকাক্সক্ষা তাকে কবি যশোপ্রার্থী করেছে কোনো সন্দেহ নেই। তবে জীবনের বহুমাত্রিকতাকে স্পর্শ করে যে শিল্প মঞ্চে কবি পৌঁছতে উদগ্রিব তাকে সাধুবাদ না জানিয়ে উপায় নেই। বিষয় নির্বাচনে কবি তার আত্ম-সংবেদনার মোহ আর কামনাকেই কবিতায় অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। ফলে কখনো কখনো বোঝা দুবোর্ধ্য হয়ে পড়ে তিনি প্রেমবিলাসী না প্রেমকাতর। তার রয়েছে বিদগ্ধ চাওয়া। না পাওয়ার বিশুদ্ধ কান্না। সাবলীল বয়ানে স্বোপার্জিত চৈতন্যকে কবিতায় উপস্থাপন করেছেন নির্দ্বিধায়। হয়তো নান্দনিক দায়বোধেরও কোনো ঘাটতি নেই শাফিকের কবিতায়। শাফিক চিত্তবৃত্তির শোভন কলাকে করায়ত্ব করতে চান, ধরতে চান শিল্পের শীর্ষ বিন্দুকে। কারও প্রতিযোগী হয়ে কারও অনুসারী হয়ে কবিতা চর্চা শাফিক করেন না। তার কাব্য উপকরণে লোকজবোধ, সারল্য আর স্বকাল স্বভূমি চেতনা প্রশংসনীয়।