শহীদ কাদরী—কবিতার ভুবনে স্বতন্ত্র পথ তৈরির মাধ্যমে নিজেকে স্মরণীয় করে তুলেছেন। মাত্র চারটি কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে চেনাতে সক্ষম হয়েছেন নিজেকে। সামাজিক মানুষের তীব্র হাহাকারকে বুকে ধারণ করে হয়ে উঠেছেন যথার্থ নাগরিক কবি। তাঁর কবিতায় উজ্জ্বল হয়ে আছে পাপ, অন্ধকার, সন্ত্রাস, শয়তান, মৃত্যু, মাতাল, লম্পট, জরা, কৃমি, ভিখেরী, বেশ্যা, দালাল, জুয়াড়ি, কীট, কবর এবং নপুংশকেরা। জীবনের ক্লেদাক্ত দিকগুলো অবলীলায় তুলে এনে কবিতাকে করে তুলেছেন নগরজীবনের আর্তনাদ। তাঁর তুলে ধরা শূন্যতা ও হাহাকার শিল্পের মাত্রা পেয়ে হয়ে ওঠে নাগরিক জীবনের প্রতিচ্ছবি। যেখানে স্পষ্ট হয়ে ওঠে জীবনের অকপট সত্য।
বলিহারী যাই তোর অদ্ভুত বররুচি
ভিখারিও ছোঁবে না যা নোংরা আঙুলে
তাই শেষে তুলে নিলি অমন সুন্দর চঞ্চপুটে
অঞ্চল স্বভাব তোর, কিন্তু তবু কানা করল কে?
ক্ষুধা? আমি তোরে খেয়েছি যত্নে, উষ্ণ নরম শাদারুটি
পচা মাংসেই ঘটালি তোর রসনার অশুচি।
আমি কি দেখাইনি সূর্যাস্তে নীলিমার রঙিন উদ্যান
আত্মম্ভরিতায় তবু চোখ রাখলি আস্তাকুঁড়ে
ছেঁড়া ঘোড়া, ত্যক্ত, বিরক্ত বেসামাল বীজানুর উৎসবে।
(বিপরীত বিহারে)
শহীদ কাদরীর কবিতার প্রধান বিষয় নগর। কিন্তু নগরকে শহীদ কাদরী কখনোই মফস্বল থেকে উঠে আসা কোনো লাজুক বালক অথবা কিশোরের মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখেননি। বরং তার দেখা নগরের বর্ণনায় উঠে এসেছে এর কদর্য দিকগুলোই। নিরাবেগ কিন্তু নিরুদ্বেগ নয় এক্ষেত্রে তাঁর দেখা। জীবনের অন্তর্গামী বিষয়গুলোকে তিনি নাগরিক পরিভাষার ভেতর দিয়ে তুলে ধরেছেন। যেখানে ব্যক্তির নিঃসঙ্গতা ছড়িয়ে থাকে পরতে পরতে। ফলে তার কবিতা পাঠের সময় মনে বিষণ্নতা ভর করে।
আমার জানালা থেকে
নিরুপায় একজোড়া আহত পাখির মতো চোখ
রাত্রিভর দেখবে শুধু দূর দর-দালানের পরে
আবছা মাঠের পর নিঃশব্দে ছিন্ন করে জোনাকির জাল
ছুটে গেল যেন এক ত্রস্ত ভীত ঘোড়ার কঙ্কাল!
(জানালা থেকে)
জীবন এখন যান্ত্রিক সভ্যতা নির্ভর। যান্ত্রিক সভ্যতার ওপর ভর করেই এগিয়ে চলেছে পৃথিবী। যন্ত্রের সহায়তা ছাড়া নগর জীবন অচল। সেই নাগরিক জীবনে অভ্যস্ত মানুষ যখন ভয়ার্ত, প্রাণ হাতে নিয়ে পালায় তখন তার আচরণ হয়ে ওঠে কাণ্ডজ্ঞানহীন আরশোলার মতো। জীবনের প্রতি আর্তি, জীবনের যে অসহায়তা, উদ্দাম, নাগরিক জীবনের, নগর সভ্যতার মিথ্যাচার, ভণ্ডামি, আত্মীয়তার বন্ধন ভেঙে যাওয়া, হিংসার বিষবাষ্প ছড়ানোর ছবি শহীদ কাদরীর অনেক কবিতাতেই খুঁজে পাওয়া যায়।
কেন এই স্বদেশ সংলগ্ন আমি, নিঃসঙ্গ উদ্বাস্তু,
জনতার আলিঙ্গনে অপ্রতিভ, অপ্রস্তুত, অনাত্মীয় একা,
আঁধার টানেলে যেন ভূতলবাসীর মতো, যেন
সদ্য উঠে আসা কিমাকার বিভীষিকা নিদারুণ।
আমার বিকট চুলে দুঃস্বপ্নের বাসা? সবার আত্মার পাপ
আমার দুচোখে শুধু পুঞ্জ-পুঞ্জ কালিমার মতো লেগে আছে
জানি, এক বিবর্ণ গোষ্ঠীর গোধূলির যে বংশজাত আমি
বস্তুতই নপুংসক, অন্ধ, কিন্তু সত্যসন্ধ্যা দুরন্ত সন্তান।
(নপুংসক সন্তের উক্তি)
কবিতায় শহীদ কাদরী তীব্র বিদ্রূপ ছুড়ে দিয়েছেন। তার কবিতার নায়ক পকেট ভর্তি স্বপ্নের ঝংকার নিয়ে শহরময় ঘুরে বেড়ায়, দরদাম করে কিন্তু কিছুই কেনে না। বাস্তবতার কড়কড়ে রৌদ্রে তপ্ত হয়ে ওঠা জীবনে স্বপ্নের কোনো দাম নেই, প্রকৃত কাগজি নোট ছাড়া যেখানে কিছুই থলে ভরা যায় না। এই সত্য জেনেই ভোগলিপ্সু সমাজকে প্রতি পদে কবিতায় স্পষ্ট করে তুলেছেন শহীদ কাদরী। বাংলা কবিতায় তিনি প্রবেশ করেছিলেন নিঃসঙ্গতার হাত ধরে, নিঃসঙ্গতাকে পাঠকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে। পরবর্তীকালে এই নিঃসঙ্গতার সঙ্গেই তার কবিতায় যুক্ত হয় স্বাধীনতা অর্জনের গৌরব আর নাগরিক জীবনের নানা দিক। সব মিলে তিনি হয়ে ওঠেন নাগরিক কবি, নাগরিক জীবনের রূপকার। নাগরিক জীবনের রুক্ষ প্রান্তরে তিনি তুলে আনতে থাকেন টানাপড়েন, জটিলতা, সংগ্রাম ও বেদনার কথা। তার কবিতায় গ্রামীন জীবনের সরলতা খুঁজে পাওয়া যায় না। বরং সেখানে খুঁজে পাওয়া যায় অদ্ভুত এক বাস্তবতার ভেতরে লুকিয়ে থাকা মায়া-মমতাহীন নিরুত্তাপ পরিবেশ। যেখানে মানুষ আত্মকেন্দ্রিক ও স্বার্থপর। শহীদ কাদরী জীবনের এই জটিল দিকের কবি। তাই তার কবিতায় দেখার ধরন হয়ে উঠেছে অন্যদের চেয়ে আলাদা।
না, শহীদ সে তো নেই, গোধূলিতে তাকে
কখনও বাসায় কেউ কোনোদিন পায়নি, পাবে না।
নিসর্গে তেমন মন নেই, তাহলে ভালোই হত
অন্তত চোখের রোগ সযত্নে সারিয়ে তুলত হরিৎ পত্রালি!
…
জানি না কোথায় যায়, কী করে, কেমন করে দিনরাত কাটে
চাকরিতে মন নেই, সর্বদাই রক্তনেত্র, শোকের পতাকা
মনে হয় ইচ্ছে করে উড়িয়েছে একরাশ চুলের বদলে!
বেরিয়েছে সকালবেলায় সে তো—শহীদ কাদরী বাড়ি নেই।
(অগ্রজের উত্তরে)
শহীদ কাদরীর কবিতায় নগর জীবনের তুলে আনার ছবির সঙ্গে সঙ্গে দেখা মেলে প্রকৃতির বিচিত্র রূপেরও। সেখানে দেখা যায়— কুয়াশা, মেঘার্দ্র আকাশ, কাঠবেড়ালী, কুকুর, বানর, ভাঁটফুল, জোছনা, গুল্মলতা, রাজহাস, নীলরঙা মাছি, স্রোতস্বিনী, জল, সাঁঝ, রিক্তগাছ, স্নান রোদ, লাল ফুল, রুগ্ন গোলাপ, কাঁকড়া, ইন্দ্রধনু, চাঁদ, সমুদ্রোচ্ছ্বাস, সবুজ ঝোপ, চড়ুই পাখি, জোনাকি। কিন্তু এরা সবাই দেখা দেখা দেয় রূপকে, নানান ব্যঙ্গ-বিদ্রূপে।
ঠিক এর বিপরীতে তার কবিতায় নগর জীবন সংশ্লিষ্ট শব্দও চোখে পড়ে হরদম। যেখানে চোখে পড়ে বিজ্ঞাপন, ট্যাক্সি, টুরিস্ট, ট্রাফিক আইল্যান্ড, লাইট হাউস, সিনেমার কিউ, নেমপ্লেট, সিগারেট টিন, টুকরো ইট, কারফিউ, পার্ক, এভিনিউ, হাসপাতাল, অ্যাকুরিয়াম, চৌবাচ্চা, বোটানিকাল গার্ডেন, ল্যাম্পপোস্ট, ব্ল্যাক আউট, রেকর্ড প্লেয়ার, প্রেসক্রিপশন, নর্দমা, টাইপরাইটার, প্ল্যাকার্ড, করাতকল, লেদমেশিন, ব্যাংক, ফুটপাত, পেভমেন্ট, মাইক্রোফোন, টায়ার ইত্যাদির মতো শব্দরাজিও। শহীদ কাদরী এইসব শব্দকে ব্যবহারের মধ্য দিয়ে কবিতায় তৈরি করেন শব্দের সম্প্রসারিত রূপ। যার মধ্য দিয়ে তার কবিতা হয়ে ওঠে সত্যিকার নাগরিক জীবনের প্রতিচ্ছবি।
শহীদ কাদরী শুধু নগরকেই নয়, এই জীবনের সংঘাত আর ত্রুদ্ধ সময়ের মধ্য দিয়ে জীবনের তপ্ত উঠোনে যে শীতল ছায়া বিরাজ করে তারও সন্ধান করেছেন। সেই সন্ধানের মধ্য দিয়ে কবি শহীদ কাদরী তুলে এনেছেন প্রেমের বিশুদ্ধতম উপলব্ধি। যেখানে মানবিক উচ্চতায় উঠে আসে প্রেম আর তার সাহসী রূপ। ‘সঙ্গতি’ কবিতায় তিনি যেমন বলেছেন, ‘প্রেমিক মিলবে প্রেমিকার সাথে ঠিক-ই/ কিন্তু শান্তি পাবে না, পাবে না, পাবে না’। তেমনি সব সঙ্গতির মধ্যেও লুকিয়ে আছে যে অসঙ্গতি, সকল মিলনের মাঝেও যে বিচ্ছেদের সুর, তারই আত্মস্বীকারোক্তি শহীদ কাদরীর কবিতা।