শঙ্খ ঘোষের জন্ম চাঁদপুরে মাতুলালয়ে, পৈতৃক বাস বরিশালের বানারীপাড়ায়, আর শৈশব ও স্কুলজীবন কেটেছে পাবনার ঈশ্বরদী থানার পাকশীতে। কবির অন্তরজুড়ে যে বাংলাদেশ রয়েছে, তা লেখাই বাহুল্য। স্কুলে থাকতে সংস্কৃতিচর্চা, বিশেষত নাট্যাভিনয়ে তাঁর দক্ষতা ছিল। তাঁর ‘সকালবেলার আলো’ (১৯৬৪) আর ‘সুপারিবনের সারি’ (১৯৯০) নামের দুটি কিশোর-উপন্যাসে কৈশোরের বাংলাদেশ ফুটে উঠেছে। এছাড়া আত্মস্মৃতিমূলক গদ্যেও রয়েছে টুকরো-টুকরো বাংলাদেশ। কিন্তু তাঁর মৌলিক সৃষ্টি যে কবিতা, তাতেও বিধৃত রয়েছে বাংলাদেশেরই গ্রাম. একটু তলিয়ে দেখলেই তা টের পাওয়া যায়।
পঞ্চাশ দশকের শুরুতেই শঙখ ঘোষ কবিতা লিখতে শুরু করেন। দেশ, অগ্রণী, শতভিষা ও কৃত্তিবাস পত্রিকা-ই শঙ্খর কবিতা প্রকাশের সূচনাকালের বাহন। তাঁর প্রথম কবিতাগ্রন্থ ‘দিনগুলি রাতগুলি’ (১৯৫৬)তে যে গ্রামের চিত্রকল্প রয়েছে তা তো তাঁর ফেলে আসা বরিশাল-চাঁদপুর-পাবনা থেকেই কুড়িয়ে আনা রঙের নির্মাণ। কলকাতা তো কেবলই শহর। তাঁর স্মৃতি-অভিজ্ঞতায় স্থায়ী হওয়া যে গ্রাম, তা তো বাংলাদেশরই। এই জীবন থেকেই তো তিন বেছে নিয়েছেন শহুরে এক পলাতক-জীবন—
প্রাণা ধারণের দিনযাপনের গ্লানি? না কি তারা হর্ষ?
একটি ধানের শিষের উপর
গোটা জীবেনর ভরসা।
কবন্ধ মাঠ, ধান খেয়ে গেছে বুলবুলি আর বর্গি
———
ডাক দেবে যেই প্রিয়রে
সে প্রিয় তখন ধূধূ মাঠজুড়ে খাজনার ধান খুঁজছে
(পলাতকা: দিনগুলি রাতগুলি)
এই পলাতকা তো কবি নিজেই। এই যে ধানের শিষ, তা তো তাঁর শৈশবের স্মৃতি। সেই শৈশব ছেড়ে আসার বেদনা মেখেই তো এই কবিতার জন্ম।
ধান ধানে ঢেউ যেন ধান নয় ধান নয় তারা-
ওপরে আকাশ ঢাকে প্রকাণ্ড ডালায় বসুধারা-
নিচে খুলে খুলে যায় যায় সব তুচ্ছ সবুজের মুঠি
প্রত্যেক পাতার বিন্দু দেখার আনন্দে দিশেহারা
ধানে গানে বসুধায় মিলায় অপার ভালোবাসা
(নে গানে বসুধায়: দিনগুলি রাতগুলি)
আদিগন্ত বিস্তৃত ধানক্ষেত তো বাংলাদেশেরই চিত্র। ‘ধান নদী খাল এই তিনে বরিশালে’রই ছবি। শৈশবের ফেলে যাওয়া স্মৃতি তো সহজে ভুলে যাওয়া যায় না। আর সেই স্মৃতি যদি হয় কোনো কবির, তবে তার প্রকাশ তো কবিতায় ঘটবেই। কিংবা এই সব স্মৃতিই যদি কাউকে কবি করে তোলে, তবে তো বারবার সেই স্মৃতিনদীজলে তাঁকে সাঁতরাতেই হয়। শঙ্খ ঘোষ তো সেই কবি, বাংলাদেশের বিশাল প্রকৃতি যাকে কবি বানিয়ে শহর কলকাতায় পাঠিয়েছেন। ‘দিনগুলি রাতগুলি’ কবিতাগ্রন্থ প্রকাশের ১১ বছর পরে প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় কবিতাগ্রন্থ ‘নিহিত পাতালছায়া’ (১৯৬৭)। ধান ক্ষেতের ছবি এই গ্রন্থেও এঁকেছেন তুমুলভাবে—
কখনো মনে হয় তুমি ধান খেতে ঢেউ,
তারই সুগন্ধে গভীল তোমার উদাত্ত-অনুদাত্তে
বাঁধা দেহ, প্রসারিত, হিল্লোলিত;
(মিলন, নিহিত পাতালছায়া)
এই গ্রন্থে তাঁর স্মৃতিমেদুরতা আরো গাঢ়, আরও সুস্পষ্টরূপে প্রতিভাত। বাংলাদেশ সরাসরি এসেছে কবিতা ছন্দে—
কিন্তু কোথায় গিয়েছিলাম? মাঝি আমার বাংলাদেশের
ছলাৎছল শব্দ গেল অনেক দূরে মিলিয়ে সেই
শব্দকুহক নৌকাগুলো, খোলা আজান বাংলাদেশের
কিছুই হাতে তুলে দাওনি বিদায় করে দিয়েছ সেই
স্মৃতি আমার শহর, আমার এলোমেলো হাতের খেলা
তোমায় আমার বুকের ভেতর নিইনি কেন রাত্রিবেলা?
(অলসজল: নিহিতপাতালছায়া)
ফেলে আসা মাতৃভূমিকে বুকে ভেতর রাখতে না পারায় বেদনা ও আক্ষেপ তিনি সারাজীবন বহন করে চলেছেন। বাংলাদেশের নদী, জেলেনৌকা, খোলা আজান, স্মৃতির শহর কবির বুকে অক্ষয় হয়ে আছে। অন্যান্য কবিতায় পাওয়া ‘খালযমুনা’, ‘ভাঙাবৈঠা’, ‘ঝুরি-নামানো সন্ধ্যাবেলা’, ‘সুপুরিবনের সারি’, ‘নির্জন খোলা মন্দির’, ‘নদীর কিনারে নতজানু বটতলা’ শব্দে তো ধরা পড়ে তো বাংলাদেশেরই স্মৃতি।
দেশভাগ ও দেশত্যাগের স্মৃতি ঘুরেফিরে এসেছে তাঁর কবিতায়। কবিতার শরীর নির্মাণে তিনি যে শব্দবন্ধ তৈরি করেছেন, তাতে প্রবিষ্ট হয়েছে বাংলাদেশেরই উদার প্রকৃতি।
ঘর বাড়ি আঙিনা
সমস্ত সন্তর্পণে ছেড়ে দিয়ে মামিমা
ভেজা পায়ে চলে গেল খালের ওপারে সাঁকো পেরিয়ে
(রাঙামামির গৃহত্যাগ, নিহিত পাতালছায়া)
এই যে মামিমার গৃহত্যাগ, মানে দেশত্যাগ। রাঙামামি এখানে বাংলাদেশের সংখ্যালগুদের দেশত্যাগের প্রতীকী সত্তা। এরকম দৃশ্য বাংলাদেশে এখনো দুর্লভ নয়। সংবেদনশীল কবির চোখে সেই দৃশ্য এড়ায়নি।
শঙ্খ ঘোষ যে গ্রামের চবি এঁকেছেন, তা আমারও জন্মভূমি। আমরা শঙ্খ ঘোষের কবিতায় স্নাত হয়ে নিজের গ্রামকে, প্রিয় বাংলাদেশকে দেখে নিতে পারি।
শঙ্খ ঘোষের ‘তুমি তো তেমন গৌরী নও’ (১৯৭৮) কবিতাগ্রন্থেও আছে বাংলাদেশে স্মৃতি ও প্রকৃতি। আমেরিকার আয়ওয়া শহরে বসে রচিত কবিতায় তিনি কলকাতা শহরের চেয়ে বাংলাদেশের গ্রামকেই যেন তীব্রভাবে অনুভব করেছেন। বাংলাদেশ ছেড়ে গেছেন ভারতে, আর ভারত ছেড়ে গেছেন আমেরিকায়। বাংলাদেশ ছেড়েছেন ফিরে না আসার জন্য, আর কলকাতা ছেড়েছেন ফিরে আসার জন্য। তাই বাংলাদেশের প্রতি পুরনো টানই যেন তাকে দিয়ে লিখিয়ে নেয় বেদনার কবিতা।–
তবে যাই
যাই মণ্ডপের পাশে ফুলতোলা ভোরবেলা যাই
খাল ছেড়ে পায়ে পায়ে উঠে আসা আলো—
—-
ঠাকুমা যেমন ঠিক দশমীর চোখে দেখে জল
যাই পাকা সুপুরির রঙে ধরা গোধূলির দেশ
আমি যাই।
(দশমী, তুমি তো তেমন গৌরী নও)
সুপুরির দেশ বলতে এখনো বরিশালকেই বুঝি। কিন্তু কবি কোথায় যেতে চাইছেন? কার কাছে ‘আমি যাই’ বলে বিদায় নিচ্ছেন? পাঠকের বুঝতে আর কিছু বাকি থাকে না, কতটা অন্তর জুড়ে ছিল কবির বাংলাদেশ। শঙ্খ ঘোষের ‘আদিম লতাগুল্মময়’ (১৯৭২) কবিতাগ্রন্থ রচিত হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের অস্থির সময়ে নকশালবাড়ি আন্দোলনের সময়। আর একই সময়ে কবির ফেলে আসা পূর্ববঙ্গ হয়েছে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ (জ. ১৯৭১)। বাংলাদেশ থেকে ভারতে যাওয়া শরণার্থীদের বেদনার কথা তিনি অনুভব করেছেন। তাই তিনি ‘দেশহীন’ শিরোনামে কবিতায় লেখেন—
আজ তোমার সামনে দাঁড়িয়ে বলতে চাই, জয়
কিন্তু সে কথা বলা আমার সাজে না …
আমার বুকে পালানোর পালানোর আরও পালানোর দেশজোড়া স্মৃতি
তাই আজ যদি দুহাতে তুলতে চাই অভয়
কেঁপে যায় হাত, মনে পড়ে
এত দীর্ঘদিন আমি কখনই তোমার পাশে ছিলুম না
না
সুখে না দুখে না লাজে না
তবু তোমার সামনে আজ বলতে চাই জয়
যে কথা বলা আমার সাজে না ।
(দেশহীন, আদিম লতাগুল্মময়)
‘পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ’ (১৯৮০) কবিতাগ্রন্থের পুরোটাই বলা যেতে পারে বাংলাদেশের পল্লিপ্রকৃতির রূপ বর্ণিত হয়েছে—
পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ, রক্তে জল ছলছল করে
নৌকার গলুই ভেঙে উঠে আসে কৃষ্ণা প্রতিপদ
জলজ গুল্পেসর ভারে ভরে আছে সমস্ত শরীর
আমার অতদীত নেই, ভবিষ্যৎও নেই কোনোখানে।
(পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ: ১)ঘরবাড়ি ভিজে যায় অশান্ত ধানের মাঝখানে
রবিউল বসে দেখে।
(পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ: ৮)সাঁকো তুলে নিয়ে গেছে তোমাদের দল বহুদিন
আমিও আমার ছায়া ভেঙে দিয়ে জলে গেছি দূরে
(পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ: ৪৩)ফিরে যাওয়া যাওয়া নয়, সেই আরও কাছাকাছি আসা।
(পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ: ৪৪)
এই যে উদ্ধৃত চরণসমূহ, তাতে আমি স্পষ্ট দেখতে পাই কবির চোখের আড়ালে বাস করা বাংলাদেশের কোমল প্রকৃতি।
যে কবিতাগ্রন্থ পাঠ করে আমরা তুমুল আলোড়িত হয়েছিল সেই ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’ (১৯৮৪) তো নাগরিক সমাজেরই চিত্র উঠে আসার কথা। হয়েছেও তাই। তবু কবির মনোজগতে থেকে যাওয়া বাংলাদেশের গ্রাম যেন ওই বিজ্ঞাপনের ফাঁকেও উঁকি দিয়ে যায়—
দেখা হবে তুলসী তলায়, দেখা হবে বাঁশের সাঁকোয়
দেখা হবে সুপুরিবনের কিনারে
আমরা ঘুরে বেড়াব শহরের ভাঙা অ্যাসফল্টে অ্যাসফল্টে
গনগনে দুপুরে কিংবা অবিশ্বাসের রাতে।
(জন্মদিন, মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে)
গ্রাম আর নগরের অপূর্ব মেলবন্ধনে এই গ্রন্থের প্রতিটি কবিতার শরীর নির্মিত। ‘এমনকি’ নাম কবিতায় তিনি উচ্চারণ করেছেন জন্মভূমির কথা। তাঁর কর্মভূমি ভারত হলেও জন্মভূমি তো এই বাংলাদেশ। তিনি তাই অনায়াসে লিখত পপারেন—
কে কাকে ঠিক কেমন দেখে
….বুঝতে পারা শক্ত খুবই
হা রে আমার বাড়িয়ে বলা
হা রে আমার জন্মভূমি।
(মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে, মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে)
কেবল শঙ্খ ঘোষ কেন, জন্মভূমির টান এড়াতে কোনো মানুষই পারে না। শঙ্খ ঘোষ যে গ্রামের চবি এঁকেছেন, তা আমারও জন্মভূমি। আমরা শঙ্খ ঘোষের কবিতায় স্নাত হয়ে নিজের গ্রামকে, প্রিয় বাংলাদেশকে দেখে নিতে পারি।