১.
বাংলা সাহিত্যে শওকত ওসমান অত্যন্ত শক্তিশালী একজন লেখক। তিনি আপন সৃষ্টিকর্মের মহিমার বিচ্ছুরণে দিগন্তপ্রসারী ও প্রভাববিস্তারী ঋদ্ধ অভিসারী। সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে বৈচিত্রের অনুসন্ধানী ছিলেন তিনি। তাঁর জীবন-কর্মও বৈচিত্রপূর্ণ। নানারকম প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তিনি কথাসাহিত্যিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলেও তাঁর সাহিত্যজীবন শুরু হয়েছিল কবিতার মাধ্যমে। কবিতাকে তিনি কখনো ত্যাগ করেননি, ধারণ করেছেন সারাজীবন। তাঁর হৃদয়ে কবিতার জন্য বিশেষ জায়গা ছিল। তিনি একাধারে উপন্যাস লিখেছেন, সেসঙ্গে লিখেছেন গল্প, প্রবন্ধ, স্মৃতিকথা, নাটক। করেছেন অনুবাদ। সম্পাদনাও করেছেন। সাহিত্যের প্রায় সকল শাখায় তিনি সাফল্যের কীর্তি রেখেছেন। তাঁর জীবনের রূপ-বৈচিত্র্য, অভিজ্ঞতা ও দর্শন; নিজের সাহিত্য নির্মাণে এসবের সফল সমাহার ঘটিয়ে নিজস্ব সাহিত্যকর্মকে উচ্চমার্গের সাহিত্যে পরিণত করেছিলেন। আধুনিক বাংলাসাহিত্যের একজন শক্তিশালী লেখক তিনি। সমাজ সচেতনতা ও আধুনিক জীবন জিজ্ঞাসা তাঁর শিল্পীমানসের গুরুত্বপূর্ণ দিক। ব্যঞ্জনাধর্মী রূপক ও প্রতীকের ব্যবহারে তিনি বিশেষ কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। তাঁর সাহিত্যে দেশকালের প্রভাব রয়েছে ব্যাপকতর। শ্রেণী-দ্বন্ধের যন্ত্রণা বৈষম্য-সমস্যার কথাই তিনি শুধু বলেন নি, তার সমাধানের উপায় কোন পথে, কীভাবে- তাও তিনি দেখিয়েছেন। দায়িত্ববোধসম্পন্ন এক অনন্য লেখকসত্তার নাম শওকত ওসমান।
১৯১৭ সালের ২ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার খানাকুল থানার অন্তর্গত সবল-সিংহপুর গ্রামের মেহেদী মহল্লায় শওকত ওসমান জন্মগ্রহণ করেন। পিতা শেখ মোহাম্মদ ইয়াহিয়া, মাতা গুলজান বেগম। তাঁর পৈতৃকপ্রদত্ত নাম শেখ আজিজুর রহমান। কিন্তু তিনি পিতার প্রদত্ত নামের স্থলে সাহিত্যিক নাম ‘শওকত ওসমান’ ধারণ করেন। এরও বিশেষ একটা কারণ রয়েছে। শওকত ওসমানের সমসাময়িককালে আজিজুর রহমান নামে আর একজন কবি ছিলেন। তিনি কবি-গীতিকার হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। ফলে দুজনের একই নাম হয়ে যায়। নিজের নাম পরিবর্তনে এটা একটা কারণ হতে পারে। তবে এটা যে খুব গুরুত্বপূর্ণ কারণ ওরকমও কিছু নয়। তাঁর ছদ্মনাম গ্রহণে অবচেতন কোন কারণও থাকতে পারে-শওকত ওসমান নিজেও তা বলেছেন। তাঁর বড় বোন ছিলেন। নাম সুফিয়া থাতুন। তিনি তাঁর নাম শওকত আলী রাখতে চেয়েছিলেন। শওকত ওসমান বড় বোনের নামটিই গ্রহণ করেন তবে শওকত আলীর ‘আলী’র জায়গায় তিনি ওসমান যোগ করে দেন। এভাবেই শেখ আজিজুর রহমান শওকত ওসমান হয়ে ওঠেন। এ প্রসঙ্গে শওকত ওসমানের নিজের বক্তব্য:
‘আজিজুর রহমান নামে আর একজন কবি ছিলেন। আর ছদ্মনার গ্রহণের পেছনে হয়তো অবচেতন কোন কারণ থাকতে পারে। আমার জানার কথঅ নয়। আমার এক বোন ছিলেন। নাম সুফিয়া থাতুন। তিনি শওকত আলী রাখার পক্ষপাতি ছিলেন। আমি আলির জায়গায় ওসমান যোগ করেছিলাম। ১৯৩১, ঠিক চুয়ান্ন বছর আগে তিনি পৃথিবী ছেগে চলে গেছেন। তাঁর স্মৃতি আমার ছদ্মনামের সঙ্গে জড়িত।’ (হুমায়ুন আজাদ, ‘কথাসাহিত্যের পথিকৃত শওকত ওসমান’, ‘রোববার’, ঢাকা, ৭ম বর্ষ, ২৯ সংখ্যা, ২১ শে এপ্রিল, ১৯৮৫, পৃ. ৩১)
এটা তাঁর লেখক নাম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। পৈত্রিক প্রদত্ত নামটি তাঁর কাগজ-কলমে থেকে যায়। তাঁর চাকুরি বা পেশাগত কাজে শেখ আজিজুর রহমান নামই কার্যকর ছিল। তিনি এফিডেফিট করে নামের আমূল পরিবর্তন করেননি।
শওকত ওসমানের পিতা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া ছিলেন কৃষিজীবী। কারুবিদ্যা (মিস্ত্রিগিরি) ছিল তাঁর অন্যতম পেশা। দোকানও করেছেন কখনৈা কখনো। দারিদ্রের কারণে পেশার পরিবর্তন ঘটেছে বিভিন্ন সময়। তাঁর নিঃসন্তান বড় চাচা নিজের ভিটেমাটি মোহাম্মদ ইয়াহিয়ার নামে লিখে দিয়েছিলেন। তিনি তখন পিতার ভিটেমাটি ছেড়ে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে চাচার দেওয়া বাড়িতে ওঠেন। কিন্তু কিছুদিন পওে সংসারের অভাব অনটনের কারণে আবার তিনি পিতার বাড়িতে ফিরে যান। অভাব-অনটনের সঙ্গে সংগ্রাম কওে তিনি ১৯৪৭ সালে মৃত্যুবরণ করেন। শওকত ওসমানের মা গুলজান বেগমের বাবা ইবাদ মণ্ডল ছিলেন সবল-সিংহপুরের পাশের শিংচ গ্রামের মোড়ল। কৃষিজীবীই ছিল তাঁর প্রধান পেশা। পৌঢ়কালে তিনি সংসারত্যাগী ফকিরের মতো জীবনযাপন করতেন। মা গুলজান বেগম ১৯৭২ সালে মারা যান। শওকত ওসমানের পিতামহ কোরবান আলী। তিনি সংসারধর্মে নিবেদিত ছিলেন না। কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতেন। শওকত ওসমানের শৈশব কেটেছে দাদী খুশীমনের আদর স্নেহে যত্নে। তিনি তাঁর দাদীকে ম্যাক্সিম গোর্কির নানীর সঙ্গে তুলনা করেছেন, ‘আমার দাদী ছিলেন ম্যাক্সিম গোর্কির নানীর মতো।’ (শওকত ওসমান, স্বজন স্বগ্রাম, ১৯৮৬:২৬) তাঁর দাদী ছিলেন সহজ সরল, অতি নিরীহ। দশ পর্যন্ত গুনতে পারতেন না। অথচ তিনি অপরের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিতে পারতেন। মানবতার সেই কোমল ছায়ায় শওকত ওসমান দশ বছর কাটিয়েছিলেন। সবল-সিংহপুরেই তাঁর শৈশব অতিবাহিত হয়েছিল। শুধু পরিবারের আপনজনদের স্নেহ-মায়া-মমতা নয়, এলাকার পাড়াপ্রতিবেশি-আত্মীয়স্বজন সবাই তাঁকে স্নেহ করতেন, ভালোবাসতেন। তাদের ভালোবাসাতেই পেয়েছিলেন জীবন চলান অনুপ্রেরণা। আর সেসব কথা তিনি লিখেছেন তাঁর ‘স্বজন স্বগ্রাম’ গ্রন্থে।
শওকত ওসমানের শিক্ষাজীবন শুরু হয়েছিল নিজের গ্রামের মক্তবে। পাঁচ বছর বয়সে। মক্তবে তাঁর শিক্ষক ছিলেন মৌলভী আইনুদ্দিন। মৌলভী আইনুদ্দিনের স্নেহ-মমতা-আদর তাঁকে শিক্ষার প্রতি আগ্রহ করেছিল। কিন্তু এই শিক্ষককে তিনি মাত্র দেড় বছর পেয়েছিলেন। এজন তিনি অনেক মানসিকভাবে কষ্ট পেয়েছিলেন। শওকত ওসমান তাঁর স্মৃতিকথায় এই শিক্ষকের প্রতি তাঁর স্মৃতিজড়িত কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রকাশ করেছেন। মৌলভী আইনুদ্দিনের পরে তিনি শিক্ষক হিসেবে পান মোহাম্মদ আলীকে। মূলত তাঁর কাছে তিনি প্রাইভেট পড়তেন। মক্তব ছেড়ে দিয়েছিলেন। মক্তব ছেড়ে দিয়ে তিনি গ্রাম থেকে তিন মাইল দূরে ‘নন্দনপুর রূপচাঁদ গুপ্ত একাডেমি’ হাইস্কুলে ভর্তি হন। এখানে তিনি ভর্তি হন তদানীন্তন শিশুশ্রেণি ক্লাস ‘সেভেনথএ’ তে। এরপর নিজের গ্রামে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি নন্দনপুর রূপচাঁদ গুপ্ত একাডেমি ছেড়ে মাদ্রাসায় ভর্তি হন। ১৯২৬-১৯২৯ সাল পর্যন্ত তিনি গ্রামের মাদ্রাসাতেই অধ্যয়ন করেন। ১৯২৯/৩০-এর দিকে তিনি কলকাতার মাদ্রাসা-এ-আলিয়াতে ভর্তি হন। এখানে তিনি দুবছর পড়াশোনা করেন। এরপর মাদ্রাসা-এ-আলিয়ার ওল্ডস্কিম ছেড়ে এ্যাংলো পার্সিয়ান বিভাগে স্থানান্তরিত হন। তিনি ১৯৩৩ সালে এ্যাংলো পার্সিয়ান বিভাগ থেকে মেট্রিক পাস করেনে। মেট্রিক পাসের পর ভর্তি হন কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। এখান থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন, ১৯৩৬ সালে। তারপর এ কলেজেই অর্থনীতি বিষয়ে অনার্স ভর্তি হন। কিন্তু অনার্স ছাড়াই তিনি ১৯৩৮ সালে বিএ পরীক্ষায় পাস করেন। এরপর তিনি কলকাতা বিশ^বিদ্যালয়ে বাংলায় এমএ ভর্তি হন এবং দ্বিতীয় শ্রেণি অর্জন করে উত্তীর্ণ হন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তিনি ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের বিশেষ স্নেহ-সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন। তাঁর জ্ঞানচর্চার স্পৃহাকে তিনি প্রসারিত করেছিলেন। শওকত ওসমান তাঁর নিঃসঙ্গ নির্মাণ গ্রন্থে তাঁর শিক্ষকের অবদানকে শ্রদ্ধাচিত্তে স্মরণ করেছেন।
২.
পড়ালেখা সম্পন্ন করে দেখেশুনে একটা ভালো চাকরি খুঁজে নিয়ে পেশাগত জীবনে প্রবেশ, শওকত ওসমানের কর্মজীবনে ওরকমটি ঘটেনি। ছাত্রজীবনেই তাঁকে কর্মের ভেতরে ঢুকতে হয়েছিল। ছাত্রজীবন মানেই যে শুধু পড়ালেখা আর কর্মজীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার দৃঢ় সাধনা-এ ব্যাপারটি ছিল না তাঁর ছাত্রজীবনে। দারিদ্রের সঙ্গে সংগ্রাম করে তাঁকে পড়ালেখা চালিয়ে নেওয়ার জন্য তাঁকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরণের কাজ করতে হয়েছে। সপ্তম অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যয়নের সময়েও তাঁকে প্রাইভেট পড়াতে হয়েছে। জায়গীর থাকতে হয়েছে। এসব কওে শুধু নিজের পড়ালেখার খরচ সংগ্রহ করার মধ্যেই ব্যাপারটি সীমাবদ্ধ ছিল না। তাঁকে রীতিমত বাড়িতে টাকা পাঠাতে হতো। আই এ পরীক্ষার পরে তিনি কলকাতা কর্পোরেশনে কেরানির চাকরি করেছেন। শিক্ষাজীবন সম্পন্ন করার আগেই তাঁকে দারিদ্র্যের কারণে কলকাতার ওয়াটার ওয়াকর্স ডিপার্টমেন্ট ও পশ্চিমবঙ্গ তথ্য মন্ত্রণালয়ে কেরানিগিরি করতে হয়েছিল। বেসরকারি স্কুলেও শিক্ষকতা করেছেন। ১৯৪২ সালের অক্টোবর মাসে কলকাতার ইন্সটিটিউট অব কমার্সে অধ্যাপনা শুরু করেন। এরপর দেশবিভাগের পরে অর্থাৎ ১৯৪৭-এর শেষের দিকে তিনি চট্টগ্রামে সরকারি কমার্স কলেজে যোগদান করেন। সেখান থেকে ১৯৫৮ সালে ঢাকা কলেজে স্থানান্তরিত হন। ১৯৭০ সালে সহকারি অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৭২ সালে ঢাকা কলেজ থেকে স্বেচ্ছায় শিক্ষকতা-জীবন থেকে অবসর গ্রহন করেন।
শওকত ওসমান ১৯৩৮ সালের ৬ মে হাওড়া জেলার কওসের আলীর কন্যা সালেহা খাতুনকে বিয়ে করেন। তখন তিনি ছাত্র ছিলেন। তাঁর পাঁচ ছেলে ও এক মেয়ে। ১৯৬৪ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি পুত্র তুরহান ওসমান মারা গেলে পুত্রশোকে তিনি বিধ্বস্ত হয়ে পড়েন। সন্তান হারানোর বেদনায় কবিতাও লিখেছেন তখন। তিনি কলকাতা মাদ্রাসা-এ-আলিয়াতে অধ্যয়নকালে লেখালেখি শুরু করেন। এই মাদ্রাসার ইংরেজি বিভাগের ম্যাগাজিনে তাঁর প্রথম গল্প ছাপা হয়, ১৯৩২ সালে। এই ম্যাগাজিনেই তাঁর প্রথম কবিতাও প্রকাশিত হয়। দেশবিভাগের পূর্ব পর্যন্ত পশ্চিম বাংলার বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তিনি নিয়মিত লিখতেন। তন্মধ্যে ‘যুগান্তর’, ‘আনন্দবাজার’, ‘অমৃতবাজার’, ‘আজাদ’, ‘হিন্দুস্তান স্টান্ডার্ড’, ‘সওগাত’, ‘কালান্তর’, ‘চতুরঙ্গ’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
দেশবরেণ্য বহু কবি-সাহিত্যিকের সঙ্গে শওকত ওসমানেরর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। দেশভাগের পূর্বে তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন অবু জাফর শামসুদ্দীন, আবু রুশদ, কবি আবুল হোসেন, গোলাম কুদ্দুস, সৈয়দ আলী আহসান প্রমুখ। কলকাতার চাকুির ও সাহিত্যজীবনে প্রখ্যাত সমালোচক আবু সায়ীদ আইয়ুবের সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। আবু সায়ীদ আইয়ুবের বাসায় নিয়মিত সাহিত্য আড্ডা হতো। সেখানে দেশবরেণ্য বহু কবি-সাহিত্যিকের সঙ্গে শওকত ওসমানের সাক্ষাৎলাভের সুযোগ ঘটেছিল। তন্মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য- সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, সত্যেন বসু, হুমায়ুন কবীর, বিষ্ণু দে, দার্শনিক সুরেন্দ্রনাথ গোস্বামী, সমর সেন, হীরেণ মুখোপাধ্যায়, সৈয়দ মুজতবা আলী, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, গুজরাটি সাহিত্যিক বাচুভাই শুক্লা, মারাঠী শিল্পী বিনায়ক মাসোজী প্রমুখ। শওকত ওসমানে সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল সাহিত্যিক-সাংবাদিক আবুল কালাম শামসুদ্দীনের। কলকাত-জীবনে তাঁর জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন তৎকালীন ‘বুলবুল’ সম্পাদক হবীবুল্লাহ বাহার। ‘বুলবুল’ পত্রিকার অফিসে বহু কবি-সাহিত্যিকের সঙ্গে সাক্ষাৎলাভ ঘটেছিল এবং তাঁদের অনেকের সঙ্গেই হৃদ্যতা পূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। ‘১৯৩০ এর দশকের শেষ এবং চল্লিশের দশকের প্রথম দিকে যুক্তবাংলার লেখক বুদ্ধিজীবীরা সাহিত্য ও সংস্কৃতির কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে বাংলার সমাজপ্রগতিকে উর্মিমুখর ও গণমানুষের মুক্তির মন্ত্রণাদানের প্রয়াস পান। এ সময় কলকাতাং ‘সোভিয়েত সুহৃদ সমিতি’ (১৯৪২), ‘ফ্যাসিস্টবিরোধী লেখক সংঘ’ (২৯ মাচ, ১৯৪২), গণনাট্য সংঘ্য প্রভৃতির মাধ্যমে প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী, লেখকরা সোচ্চার হয়ে ওঠেন। (বসু, অক্টোবর বিপ্লব ও আধুনিক বাংলা সাহিত্য, ১৯৮৯:১৮৮) এই সমস্ত সংঘ-সমিতি নিয়ে কলকাতায় একটা অফিস প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ধর্মতলা স্ট্রিটের ৪৬ নম্বর চারতলা বাড়িতে। এখানে ‘ইয়থ কালচারাল ইন্সটিটিউট. এবং ‘পরিচয়’ পত্রিকার অফিস ছিল। ‘ফ্যাসিস্টবিরোধী লেখক সংঘের নিয়মিত সাহিত্যৈ বৈটখ হতো বুধবারে। এ বৈঠকে যোগ দিতেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিষ্ণু দে, গোপাল হালদার, হীরেণ মুখোপাধ্যায়, গোলঅম কুদ্দুস, সুকান্ত ভট্টাচার্য প্রমুখ। শওকত ওসমান এই ৪৬ নম্বও ধর্মতলা স্ট্রিটের বাড়িতে যাতায়াত করতেন। ফলে শওকত ওসমানের প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনার উম্মীলন ঘটেছিল ‘একটি সাবলীল রাজনেতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মধারার উৎসনির্ঝও থেকে তিনি পেয়েছিলেন এই প্রেরণা। ফলে মুক্তবুদ্ধিচর্চা, সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী এবং ধর্মান্ধতার প্রতি তাঁর বিদ্বিষ্ট মনোভঅব ববরাবর প্রকাশ পেকেছে। বিভাগপূর্বকালে তাঁর সৃষ্ট সাহিত্য ও রাজনৈতিক চেতনায় এই বিষয়গুলো খুব স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
‘১৯৪৭ সালের ধর্মভিত্তিক জাতীয়তা ভিত্তিতে ভারত বিভক্তিকে তিনি মেনে নিতে পারেন নি। সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম ও শরৎচন্দ্র বসুর অভিন্ন বাংলার পরিকল্পনার সাথে সংহতি প্রকাশ করে ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ আন্দোলনের তুঙ্গ অবস্থায় যে সমস্ত লেখক-বুদ্ধিজীবী বাংলা ভেঙ্গে তার একাংশকে পাকিস্তানভুক্তকরণের বিপক্ষে পত্রিকায় বিবৃতি দিয়েছিলেন, তাঁদের উদ্যোক্তাদের মধ্যে শওকত ওসমান ছিলেন অন্যতম।’ (মাহমুদ, বাংলা কথাসাহিত্যে শওকত ওসমান, ২০১৪: ৫৬)
এ থেকেই শওকত ওসমানের লেখক সত্তার স্বরূপ খুব ভালোভাবেই প্রকৃষ্ট হয়ে ওঠে। দেশভাগের পরে তিনি চট্টগ্রাম কমার্স কলেজে যোগদান করে সেখানে প্রায় দশ বছর কর্মজীবন অতিবাহিত করেন। সেকারণে চট্টগ্রামেও তাঁর একটি সাহিত্যবলয় গড়ে উঠেছিল। সেখানে ১৯৪৮ সালে সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘সাংস্কৃতিক বৈঠক’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে ইবনে গোলাম নবী, গোপাল বিশ^াস, মাহবুবুল আলম চৌধুরী, কলিম শরীফ, ওহীদল আলম প্রমুখ গুণীজনদের সঙ্গে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তিনি চট্টগ্রামের ‘প্রান্তিক নবনাট্য সংঘ’-ও সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। তিনি এই সংঘের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ১৯৫৮ সালে তিনি ঢাকা কলেজে স্থানান্তরিত হয়ে আসার পরে তাঁর সাহিত্যসাধনার অগ্রযাত্রায় আর এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। সিকান্দার আবু জাফরের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তাঁর ‘সমকাল’ পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন। সে সময়ের জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক আকবর হোসেনের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। ঔপন্যাসিক আকবর হোসেনের ঢাকার উত্তর কমলাপুরের বাসায় নিয়মিত সাহিত্য আসর হতো। এ আসরে তিনি অংশগ্রহণ করতেন। ‘যাঁরা এ আসরে অংশগ্রহণ করতেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন: ড. কাজী মোতাহার হোসেন (১৯৯৮-১৯৮১), কবি জসীম উদ্দীন (১৯০৩-১৯৭৬), কবি আজিজুর রহমান, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ (১৯২২-১৯৭১), এস. ওয়াজেদ আলী (১৮৯০-১৯৫১), শওকত ওসমান (১৯১৯-১৯৯৮), কণ্ঠশিল্পী আব্দুল জব্বার, পটুয়া কামরুর হাসান, চলচ্চিত্র অভিনেতা রাজু আহমেদ, প্রাবন্ধিক-সাবেক সচিব মোহাম্মদ আবদুল মজিদ এবং কবি-কথাশিল্পী রুহুল আমিন বাবুল প্রমুখ।’ (রকিবুল, আকবর হোসেনের কথাসাহিত্য, রূপলোক ও শিল্পসিদ্ধি, ২০১৩: ৪৭) নিয়মিত এ আসরে সেসময়ে অনেক বরেণ্য কবি-সাহিতিকের মধ্যে নিয়মিত সাক্ষাতলাভ ও সাহিত্যচর্চায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। কবি-সাহিত্যিকদের জন্য আকবর হোসেন প্রত্যেক আসরেই ভালো ভালো খাবারের আয়োজন করতেন। ‘শওকত ওসমান চাচা মজা করে প্রায়ই বলতেন,
“আকবর ভাইয়ের সাহিত্য আসরে বসে মন আর সাহিত্য আসরে থাকে না। এত সব সব সুস্বাদু খাবারের ঘ্রাণ আসে! খাবারের ঘ্রাণে মনটা আসর থেকে খাবারের দিকেই বেশি চলে যায়।” আসলে প্রতি আসরেই ভালো ভালো খাবারের আয়োজন হতো আমাদের বাড়িতে। আব্বা খেতে পছন্দ করতেন, খাওয়াতেও পছন্দ করতেন। মা আসরের দিনে রান্নাঘরেই ব্যস্ত থাকতেন। আমরা ভাইয়েরা খাবার পরিবেশনের সময় লেখক-চাচাদের মজার মজার অনেক কথা শুনতাম।’ (স্মৃতিচারণ: ফেরদৌস হাসান, আকবর হোসেন তনয়, লেখকের বাসভবন, ১৮, উত্তর কমলাপুর, ২৯.০১.১৯৯৫)
শওকত ওসমান ছিলে নিরলস পরিশ্রমী একজন সাহিত্যসাধক। কাজী নজরুল ইসলামকে যা আকৃষ্ট করেছিল। তিনি শওকত ওসমানের জীবন ও সাহিত্যসাধনায় প্রীত হয়ে আশীর্বাদ করে লিখেছিলেন-
‘আছে সত্যের পূর্ণ স্বরূপ
চূর্ণিত পরমাণুতে,
আছে দেহাতীত অজানা অরূপ,
তোমারই বদ্ধ তনুতে।’
(মাহমুদ, বাংলা কথাসাহিত্যে শওকত ওসমান, ২০১৪: ৪৯)
৩.
শওকত ওসমান বাংলা সাহিত্যে বহুমুখী অনন্য এক প্রতিভা। গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস, ছোট গল্প, নাটক, কবিতা, আত্মজীবনী, স্মৃতিখণ্ড, শিশুতোষ, কাব্য, সম্পাদনা গ্রন্থ ইত্যাদি বিষয়ে লিখেছেন অনেক। তাঁর গ্রন্থের সংখ্যা শতাধিক। তাঁর লেখার বিষয়বস্তু বহুমাত্রিকতা পূর্ণ। বিষয়বস্তু নির্বাচনে যেমন তিনি সচেতন ছিলেন, তেমনি তিনি রচনার ক্ষেত্রে সৃজনশীলতা ও মননশলিতারও প্রায় সব ক্ষেত্রেই দক্ষতা দেখিয়েছেন। উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে রাজনীতি, দেশের পরাধীনতা, আর্থ-সামাজিক অবস্থা, দেশকাল ভাবনা, ব্রিটিশশাসন, পাকিস্তানের দুঃশাসন, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ-তাঁর সৃষ্টিকর্মে মূল অনুষঙ্গ করেছেন। তিনি তুখোড় গদ্যশিল্পী হলেও তাঁর হৃদয়ে কিন্তু ঠিকই কাব্যরসধারার নীরব স্রোত বহমান ছিল। যা তাঁর সাহিত্যের ভাষাশৈলীতে অনুভূত হয়। তিনি নাটক রচনাতে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। বক্তব্যধর্মী প্রবন্ধ রচনায় সাবলীল গদ্যে পাঠকের বিশেষ আগ্রহ তৈরি করতে পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। রম্যরচনা ও ব্যঙ্গাত্মক রচনাতেও তিনি দক্ষতা দেখিয়েছেন। বাংলা সাহিত্যে শওকত ওসমান নিজেই নিজেকে একটি অধ্যায়ে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছেন।
শওকত ওসমানে প্রথম উপন্যাস জননী ১৯৬১ সালে প্রকাশের পরে বাংলা সাহিত্যে ব্যাপক সাড়া তৈরি করে। তাঁর প্রত্যেকটি উপন্যাস সময়-কাল-সমাজ-দেশ-পরাধীনতার যন্ত্রণা, ধর্মান্ধতার বিষবাষ্প ধারণ করেছে। ফলে তাঁর প্রত্যেকটি উপন্যাস বিশেষ মর্যাদায় উত্তীর্ণ হয়েছে। উপন্যাস সাহিত্যে যোগ করেছে ভিন্নমাত্রা। তাঁর উপন্যাস-পাঠে দায়বোধ সম্পন্ন মগ্ন এক শিল্পঋষীকে আবিষ্কার করা যায়। তাঁর উপন্যাসে আর্থ-সামাজিক চেতনা, ধর্মীয় পরিপ্রেক্ষিত, জাতীয় জীবনের বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধেও চেতনা, আন্তর্জাতিক জীবনবোধ মানবপ্রবৃত্তির বহুকৌণিকতা তাঁর উপন্যাসে বিষয় হয়ে উঠেছে। তিনি প্রত্যেকটি বিষয়কে এতো গভীর ও খুঁটে খুঁটে ব্যাপকতায় বিধৃত করেছেন, যা তাঁর শিল্প-নিপুণতায় মহৎকীর্তি হিসেবে বিবেচিত হতে পেরেছে। তাঁর উপন্যাসের একটা বড় দিক রূপক ও প্রতীকধর্মতা। এ ক্ষেত্রে তিনি অনন্য এক শিল্পস্রষ্টা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলৈন। তাঁর উপন্যাস- জননী (১৯৬১), ক্রীতদাসের হাসি (১৯৬২), সমাগম (১৯৬৭), বনী আদম, চৌরসন্ধি (১৯৬৮), জাহান্নম হইতে বিদায়, (১৯৭১), দুই সৈনিক (১৯৭৩), ক্ষুদে সোশ্যালিস্ট (১৯৭৩), নেকড়ে অরণ্য (১৯৭৩), পঞ্চসঙ্গী (১৯৭৫), পতঙ্গপিঞ্জর (১৯৮৩), আর্তনাদ (১৯৮৫), রাজসাক্ষী (১৯৮৫), রাজা উপাখ্যান (১৯৭০), পিতৃপুরুষের পাপ (১৯৮৬), জলাংগী (১৯৭৪)।
উপন্যাসের অনন্য স্রষ্টা শওকত ওসমান ছোটগল্পেও দায়বোধ ও কৃতিত্বের অসামান্য স্বাক্ষর রেখেছেন। পরাধীনতা গ্লানিবোধ, স্বাধীনা সচেতন, অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি, আর্থ-সামাজিক অবস্থা, দারিদ্র, ক্ষুধা, দুর্ভিক্ষ, শোষণ-বঞ্চনা, সামাজিক অবক্ষয়, শিক্ষঅর বৈরি পরিবেশ, নারীনিগ্রহ ও নিারী নির্যাতন, শ্রেণিচেতনা, পারিবারিক জীবনের নানাবিধ সমস্যা-সংকট-মনস্তাত্ত্বিকতা, ধনতান্ত্রিকতায় আত্মকেন্দ্রিকতা-ভোগবাদিতা-বিচ্ছিন্নতাবাদ প্রভৃতি বিষয় তাঁর গল্পের উপজীব্য। উপন্যাসের মতো ছোটগল্পেও তিনি তিনি বিষয়বস্তু নির্বাচন ও শিল্পশৈলীতে সচেনতা ও দক্ষতা দেখিয়েছেন। তাঁর ছোটগল্পে সাধারণ মানুষের প্রতি আন্তরিক দরদ ফুটে উঠেছে। তাঁর ছোটগল্প গ্রন্থগুলেঅ হলো- জুনু আপা ও অন্যান্য গল্প (১৯৫২), মনিব ও তাহার কুকুর (১৯৮৬), ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্ধী (১৯৯০), হন্তারক (১৯৯১), প্রস্তর ফলক (১৯৬৪), সাবেক কাহিনী (১৯৫৩), জন্ম যদি তব বঙ্গে (১৯৭৫), পুরাতন খঞ্জর (১৯৮৭), নেত্রপথ (১৯৬৮),উভশৃঙ্গ (১৯৬৮), পিজরাপোল (১৩৫৮ ব.), রাজপুরুষ (১৯৯৪),উপলক্ষ্য, এবং তিন মির্জা (১৯৮৬), বিগত কালের গল্প (১৯৮৭)।
সৃজনশীলতার পাশাপাশি মননশলি সাহিত্যেও তিনি বিশেষ করে বক্তব্যপ্রধান প্রবন্ধ রচনা করেও তিনি কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। তাঁর প্রবন্ধগ্রন্থ-সমুদ্র নদী সমর্পিত (১৯৭৩), ভাব ভাষা ভাবনা (১৯৭৪), সংস্কৃতির চড়াই উৎরাই (১৯৮৪), ইতিহাসে বিস্তারিত (১৯৮৫),, মুসলিম মানসের রূপান্তর (১৯৮৬), নিঃসঙ্গ নির্মাণ (১৯৮৬), পূর্ণ স্বাধীনতা চূর্ণ স্বাধীনতা (১৯৮৬), উপদেশ কূপদেশ (১৯৯২,) মন্তব্য মৃগয়া (১৯৯৪), মৌলবাদের আগুন নিয়ে খেলা (১৯৯৫), অস্তিত্বের সঙ্গে সংলাপ (১৯৯৫), আর এক ধারাভাষ্য (১৯৯৬), অনেক কথন (১৯৯১) প্রভৃতি।
নাটক রচনায় তাঁর বিশেষ কৃতিত্ব রয়েছে। বাংলা নাট্যসাহিত্যে তাঁর নাটকগুলো বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। নাট্যসাহিত্যের বিকাশের ধারায় শওকত ওসমানের বিশেষ অবদান রয়েছে। তাঁর নাটকগুলো-আমলার মামলা (১৯৪৯), পূর্ণ স্বাধীনতা চূর্ণ স্বাধীনতা (১৯৯০), তস্কর ও লস্কর, কাঁকরমণি (১৯৪৯), বাগদাদের কবি (১৯৫২), এতিমখানা (১৯৫৫), ক্রীতদাসের হাসি (রামেন্দু মজুমদার সহযোগে, ১৯৬৮), নষ্টতান অষ্টভান (১৯৮৬), জন্ম-জন্মান্তর (১৯৮৬), তিনটি ছোট্ট নাটক (১৯৮৯)।
শিশুতোষ গ্রন্থ রচনাতেও তিনি মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। ওটেন সাহেবের বাংলো (১৯৪৪), মস্কুইটো ফোন (১৯৫৭), ক্ষুদে সোশালিস্ট (১৯৭৩),পঞ্চসঙ্গী (১৯৮৭), তারা দুইজন (১৯৫৮), ডিগবাজি, প্রাইজ ও অন্যান্য গল্প (১৯৬৯), জুজুগগা (১৯৮৮), ছোটদের নানা গল্প (১৯৮৪), ছোটদের কথা রচনার কথা (১৯৮৩) প্রভৃতি। তাঁর অনূদিত গ্রন্থ নিশো (১৯৪৮-৪৯), লুকনিতশি (১৯৪৮), স্পেনের ছোটগল্প (১৯৬৫), মলিয়ার পাঁচটি নাটক (১৯৬৫), বাগদাদের কবি (১৯৫৩) (নাটক), টাইম মেশিন (১৯৫৯),পাঁচটি কাহিনী (লিও টলস্টয়, ১৯৫৯),ডাক্তার আবদুল্লাহর কারখানা (১৯৭৩), পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে মানুষ (১৯৮৫), সন্তানের স্বীকারোক্তি (১৯৮৫)। তিনি সম্পাদনা করেছেন ‘হবীবুল্লাহ বাহার’ (আনোয়ারা বাহার চৌধুরী সহযোগে, ১৯৭০), ‘ফজলুল হকের গল্প’ (১৯৮৩)।
শওকত ওসমানের গ্রন্থ ইংরেজিসহ অন্যান্য ভাষাতেও অনুদিত হয়েছে। ক্রীতদাসের হাসি’র ইংরেজি অনুবাদ. A Slave Laughs (১৯৭৬)। রাজা উপাখ্যানের ইংরেজি অনুবাদ The King and the Serpents (১৯৮৫), Selected Stories (১৯৮৫)। জননী উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদ Janani (১৯৯৩)। রাজসাক্ষীর অনুবাদ The State Witness। শওকত ওসমান কবিতা লিখলেও কবিতাতে কখনোই মনোযোগী ছিলেন না। তাঁর বেশ কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ আছে। আত্মব্যঙ্গ কাব্য: নিজস্ব সংবাদদাতা প্রেরিত (১৯৭৫), ব্যঙ্গকাব্য: শেখের সম্ভরা (প্রথমখণ্ড, ১৯৯৪, দ্বিতীয় খণ্ড ১৯৯৫)।
শওকত ওসমান স্মৃতিকথা লিখেছেন। তাঁর স্মৃতিকথা বিষয়ক গ্রন্থগুলো বাংলা সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য সংযোজন এবং এ ধারার সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। তাঁর স্মৃতিকথা গ্রন্থগুলো- স্বজন স্বগ্রাম (১৯৯৬), কালরাত্রি খণ্ডচিত্র (১৯৮৬), গুডবাই জাস্টিশ মাসুদ ( ১৯৯১), স্মৃতিখণ্ড মুজিবনগর (১৯৯২), উত্তরপর্ব মুজিবনগর (১৯৯৩)।
৪.
ছোটগল্পে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন ১৯৬২ সালে। ক্রীতদাসের হাসি উপন্যাসের জন্য ১৯৬২ সালে পেয়েছেন আদমজী সাহিত্য পুরস্কার। ১৯৬৭ সালে পাকিস্তান গভর্ণমেন্ট পুরস্কার পাপন। ১৯৮৩ সালে পেয়েছেন একুশে পদক পুরস্কার। একই বছরে পেয়েছেন মাবুবউল্লাহ ফাউন্ডেশন পুরস্কার ও নাসিরউদ্দীন স্বর্ণপদক। মুক্তধারা সাহিত্য পুরস্কার পান ১৯৯১ সালে। স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার পেয়েছেন ১৯৯৭ সালে। একই বছরে পান আলাওল সাহিত্য পুরস্কার। ঈশ^রের প্রতিদ্বন্ধী গ্রন্থের জন্য ফিলিপস পুরস্কার পান ১৯৯৬ সালে। ১৯৯০ সালে পান টেলিভিশন নাট্যশিল্পী সংসদেও টেনাশিনাস পদক। বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ পুরস্কার পেয়েছেন ১৯৯২ সালে এবং ১৯৯৫ সালে পেয়েছেন সত্যেন সেন পুরস্কার। ১৯৮৯ সালে তাঁর ৭৩তম জন্মদিন উপলক্ষে সবংর্ধনা দেওয়া হয়। এ উপলক্ষে ‘শুভ জন্মদিন’ শিরোনামে স্যুভেনির প্রকাশিত হয়। ১৯৯১ সালে ২ জানুয়ারি তাঁর ৭৫তম জন্মবার্ষিকী সাড়ম্বরপূর্ণভাবে পালিত হয়। এ অনুষ্ঠানে অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী তাঁকে মানুষের ‘অপরাজেয় আত্মার প্রতীক’ হিসেবে অভিহিত করেন। তাঁকে সম্মানস্বরূপ এক লাখ এক হাজার টাকা প্রদান করা হয় এ অনুষ্ঠানে।
৫.
শওকত ওসমানের কথাসাহিত্যের বহুমাত্রিকতা তাঁকে খ্যাতির চূড়ায় প্রতিষ্ঠিত করেছিল। তাঁর কথাসাহিত্যের বিস্তৃত পরিসরে আর্থ-সামাজিক চেতনা, ধর্মীয় পরিপ্রেক্ষিত, জাতীয় বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, রূপক ও প্রতীকধর্মিতা, আন্তর্জাতিক জীবনবোধ, মানবপ্রবৃত্তির নান অনুষঙ্গ, দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতা, রীতিবিরদ্ধ সম্পর্ক ও মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব-সর্বোপরি বিচিত্র উপজীব্য স্থান পেয়েছে। তাঁর উপন্যাসে যেমন এসব বিষয় উঠে এসেছে অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে, তেমনি গল্পেও তিনি আন্তরিকতার স্পর্শে সেসব বিষয় বহুকৌণিকতায় তুলে এনে মানবদরদী শিল্পীমনের পরিচয় দিয়েছেন। এ প্রবন্ধে মূলত তাঁর ছোটগল্পভিত্তিক মূল্যায়নের সামান্য প্রয়াস থাকবে। শওকত ওসমান সাহিত্যসৃষ্টিতে তিনি অন্যান্য শাখার মতো ছোটগল্পেও বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। রচনা করেছেন অসংখ্য ছোটগল্পে। বাংলা সাহিত্যেও ছোটগল্পে শওকত ওসমান নিজেই একটি অধ্যায় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছেন। তাঁর গল্পে ক্ষুধা-অভাব-দারিদ্র-দুর্ভিক্ষ, শোষণ-বঞ্চনা, আর্থ-সামাজিক অবস্থা, নারীনিগ্রহ, নারী নির্যাতন, অবরুদ্ধ শিক্ষার পরিবেশ, পারিবারিক জীবনের নানান সমস্যা সঙ্কুল, শ্রেণিচেতনা ও শ্রেণিসংগ্রাম, ধর্মের নামে ভণ্ডামি, ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি, ধর্মের কল্যাণকর দিক, চল্লিশের দশকের পাকিস্তান আন্দোলন, সাতচল্লিশের দেশভাগ, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, আটান্নর সামরিক আইন, ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলন ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ-এসব বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে এসেছে। উপন্যাসের মতো তাঁর গল্পেও রূপক, প্রতীক ও সাঙ্কেতিকতা গুরুত্ব পেয়েছে। শওকত ওসমান ব্রিটিশশাসন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ-এই তিন অধ্যায়কেই তিনি দেখেছেন। তাঁর সাহিত্যিক মানস গঠনে এসব যুগ-পরিবেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ব্রিটিশশাসিত ভারতে বিশেষ করে বাংলায় হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা, সম্প্রীতিহীনতা, হত্যা, লুঠ, ধর্ষণ, ১৯৪৩ এর ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ, বাংলার গ্রামীণ দারিদ্র ও কৃষকের করুণ দুর্গতি সৃষ্টিতে প্রাকৃতিক দুর্যোগের থেকেও যে অনেক বেশি দায়ী ছিল মুনাফালোফী বণিকসমাজ ও হৃদয়হীন শাসকগোষ্ঠী, এভাবে বাংলার বুকে বহুবার কৃত্রিম সংকট তৈরি কওে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ তৈরি করা হয়েছে, এতে বহু মানুষ আত্মাহুতি দিয়েছে, বহু নারী ক্ষুধার তাড়নায় সম্ভ্রম বিক্রি করেছে- সমাজজীবনে এসব তিনি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। ১৯৪৭-এর দেশভাগের বেদনা নিয়ে তিনি পাকিস্তান ভূখণ্ডের তৎকালীন পূব-পাকিস্তানে চলে আসেন। মানসিকভাবে বাংলার দ্বিখণ্ডিতা না মানলেও কর্ম ও বন্ধুদের কারণে হুগলী জেলার মানুষ হয়েও তিনি পূর্ববাংলায় চলে আসেন। পাকিস্তানের তেইশ বছরের দুঃশাসন, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা তাঁকে রীতিমতো স্পর্শ করেছিল। তাঁর ছোটগল্পে এসবের তীব্র প্রভাব রয়েছে।
৬.
শওকত ওসমানের ছোটগল্পে উপন্যাসের মতোই বহু বিচিত্র বিষয় পরিলক্ষিত হয়। আর্থ-সামাজিক অবস্থার বহু রূপ তাঁর ছোটগল্পে সম্যক রূপে ফুটে উঠেছে। ‘ঊপনিবেশিক সমাজকাঠামোর অন্তরাল থেকে বাংলাদেশের আশির দশকের সমাজবিক্ষণের প্রচ্ছাপ পর্যন্ত তাঁর গলে।পর পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে।’(মাহমুদ, বাংলা কথাসাহিত্যে শওকত ওসমান,২০১৪: ১০৮) তাঁর গল্পে ক্ষুধা-দারিদ্র, অভাব-অনটন, শোষণ-বঞ্চনা, সামাজিক অবক্ষয়, নারী নির্যাতন, ধর্মের নামে ভণ্ডামী, শ্রেণিচেতনা ও শ্রেণি সংগ্রামে-ধনতান্ত্রিক বিচ্ছিন্নতাবাদ নানাভাবে তাঁর গল্পে স্থান করে নিয়েছে। পুঁজিবাদের দাপট ও হিংস্রতা আগেও ছিল। এখনো আছে। ধনতান্ত্রিক যে সমাজ সেই সমাজ এখনো আছে, বাইরের চেহারা হয়তো আলাদা। কিন্তু চিন্তা-চেতনা-মানসিকতা-ভোগবাদিতা-আত্মকেন্দ্রিকতা-বিচ্ছিন্নতা-এসব ধনীক শ্রেণির ভেতরের চিত্র। বাইরের তারা যতোই গণমানুষের দরদেও কথা বলুক, অথবা না বলুক। বহুকাল আগে থেকেই আমাদেও মাননসিকতায় এগুলো চলে এসেছে। ‘পুঁজিবাদ যে কাজটা করে, তা হচ্ছে মানুষের ওপর নিপীড়ন করে, লুণ্ঠন করে, দেশের সম্পদ বিদেশে নিয়ে যায় এবং দারিদ্রের সৃষ্টি করে। দারিদ্র সৃষ্টি হলে র্সস্কৃতি বিপন্ন হয়।’ (সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ‘ঊপনিবেশিকতা বনাম সংস্কৃতি-সংগ্রাম’, যুগান্তর ঈদসংখ্যা ২০২৩: ০১) শওকত ওসমানের গল্পেও পুঁজিবাদের এই নিষ্ঠুর চিত্র উপস্থাপিত হয়েছে। তিনি আন্তরিকতা সঙ্গে সমাজের কদর্যতা ও রাজনৈতিক ভণ্ডামীর ওপর দ্বিধাহীনভাবে তীব্র আঘাত করেছেন। বাংলা সাহিত্যে কবিতা-গল্প-উপন্যাসে দুঃথ-দারিদ্র-অভাব-অনটনের চিত্র বিভিন্নভাবে উড়ে এসেছে। প্রাচীনকালের যে আদি নিদর্শন চর্যাপদ, সেখানেও অভাব-অনটনের ক্ষুদা-দারিদ্রের কথা আছে। ফলে এসব আমাদের সাহিত্যে আদিকাল থেকেই চলে আসছে। তার মানে আমাদের জীবন-ব্যবস্থায় ক্ষুধা-দারিদ্র-দুর্ভিক্ষ অনিবার্য অনুষঙ্গ। যা এড়িয়ে সাহিত্য হয়ে উঠতে পারেনি। শওকত ওসমানও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নন, বরং তাঁর ছোটগল্পে অনেক বেশি ক্ষুধা-দারিদ্র-অভাব-অনটন-দুর্ভিক্ষ, মানুষের আদিম প্রবৃত্তির ছবি আন্তরিক দরদে ফুটে উঠেছে। এ প্রসঙ্গে শওকত ওসমানের প্রস্তর ফলক গ্রন্থের ‘উদবৃত্ত’ গল্পের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। আমিরন এ গল্পের মূল চরিত্র। গ্রামের একেবাওে দীনহীন পরিবারের সন্তান। অভাব-অনটন, ক্ষুধা-দারিদ্রে জর্জরিত পরিবারটি। আমিরন নিরূপায় হয়ে পরিবারে একমুঠো ভাতের নিশ্চয়তা নিশ্চিতকরণের জন্য শহওে এসে পতিতাবৃত্তি গ্রহণ করে। অথচ পরিবার আমিরন সম্পর্কে জানে অন্য কথা। তাদের মেয়ে শহরে এক বড়লোকের বাসায় কাজ করে। এটাই তার চাকরি। এই চাকরি করেই সে পরিবাওে নিয়মিত টাকা পাঠায়। কিন্তু পরিবারের এই জানাটা যে পুরোটাই ভুল, পরিবার তা কখনৈাই বুঝতে পারে না। আমিরন যে শহরের একশ্রেণির নষ্ট ধনীলোকের শরীরী সুখ বিলিয়ে অর্থ উপার্জ কওে দরিদ্র পরিবাওে পাঠায়, সে অর্থেই তার পরিবার খেয়ে-পরে বাঁচে। আমিরন কোথায় আছে কেমন আছে বিকভাবে সে অর্থ উপার্জন করে তার প্রকৃত সত্য সে জানে না।
বাইরে পশু-দরদীর চেহারা দেখালেও ভেতরে সে নিজেই একটা হিংস্র পশু-চমৎকারভাবে লেখক তা ‘পিজরাপোল’ গল্পে উপস্থাপন করেছেন
সে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের কাছে চরমভাবে পরাভূত হয়ে নিজের মেয়েকে আল্লাহর হাতে সমর্পণ করে তার ওপর ভরসা রেখে নিজে স্বস্তি অনুভব করে। ’৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের সময় কলকাতায় ক্ষুধার জন্য নারীদের ব্যাপকভাবে দেহদানের ঘটনা ঘটে। এ পরিস্থিতিতে দুর্ভিক্ষপীড়িত নারীরা যেন দেহব্যবসা করতে না পারে এ জন্য কলকাতায় ‘বেশ্যাবৃত্তি প্রতিরোধ কমিটি’ গঠন করা হয়েছিল। শওকত ওসমান সে সময়ের সমাজজীবনের চরম মানবিক বিপর্যয় গভীরভাবে অনুধাবন করেছেন, পর্যবেক্ষণ করেছেন, ব্যথিত হয়েছেন এবং সাহিত্যে অত্যন্ত আন্তরিক দরদের সঙ্গে তুলে ধরেছেন। ‘চিড়িয়া’ গল্পে শিক্ষিত এক যুবকের অর্থনৈতিক বিধ্বস্ত অবস্থা ফুটে উঠেছে। বিএ পাস করে বেকার। জীবনের প্রয়োজনে পাখি বিক্রি কওে বেড়ায়। একদিন ট্রেনের ভেতর পীরগঞ্জের নবাব ঘুমাচ্ছিলেন। নবাবের ম্যানেজার শিখ্ষিত বিকার এই পাখি বিক্রেতাকে দিয়ে নবাবের ঘুম ভেঙে দেয়। এই ঘুম ভাঙাতে পাখি বিক্রেতাকে কৌশল গ্রহণ করতে হয়, যে কৌশল তার বিবেকবোধ বর্জিত। ট্রেনে ঘুমন্ত নবাবের কাছে গিয়ে ‘চিড়িয়া’ বলে টিৎকার দেয় পাখিঅলা, তাতে ঘুম ভেঙে যায় নবাবের। নবাব এত ক্ষুব্ধ হয়ে পাখিবিক্রেতা বিশ্রিভাবে গালিগালাজ করে। ম্যানেজার একপর্যায়ে নবাবকে জানায়, তাঁর ঘুম ভাঙানোর জন্যেই পাখিবিক্রেতাকে দিয়ে এই কাণ্ড করেছে। একং তাকে এই কাজের জন্য দশ টাকা দেয়া হয়েছে। এ গল্পে ক্ষুধা-দারিদ্র-অভাবের কাছে একজন বেকার শিক্ষিত মানুষের বিবেক-বোধ-আত্মসম্মান কাজ করেনি। ‘রাতা’ গল্পেও আমরা অভাবের করুণ চিত্র লক্ষ্য করি। কারিমা বিবি তার নাতি সাজেদকে নিয়ে মেয়ের বাড়িতে যাচ্ছিল, মেয়েকে দেখার জন্য। কিন্তু মেয়েটাও গরিব। সংসারে দশ-বারোজন লোক।
অভাব-অনটনের সংসার। সে কারণে কারিমা বিবি একটা বড় মোরগ সাথে করে নিয়ে যাচ্ছিল। যাতে ওটা বিক্রি করে তার ও নাতি সাজেদের খাবারের ব্যবস্থা হয়ে যায়। মোরগটা বিক্রি করলে ঠিকই দুই/ তিন টাকা টাকা হবে। সেই টাকাতেই মেয়ের বাড়িতে তাদের দুজনের খরচ হয়ে যাবে। মেয়েকে তাদের খাবারের জন্য বাড়তি কষ্ট করতে হবে না। তারা তো মাত্র একটি রাতই থাকবে। মেয়েটার মুখ দেখেই চলে আসবে। কিন্তু যেতে যেতে মোরগটি সাজেদের হাত থেকে ফসকে ঝিঙে খেতের মধ্যে ঢুকে পড়ে। অনেক চেষ্টায় কুঁচো ছেলেদের সহযোগিতায় যখন মোরগটি ধরা পড়ল, তখন মোরগটির অবস্থা খুবই খারাপ, মরার মতো অবস্থা। দ্রুত তা জবাই করে কারিমা বিবি নাতি সাজেদের মেয়ের বাড়ির পথে হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে নাতি সাজেদের কাছে নিজের মেয়ের বাড়ির অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে কারিমা বিবির কথায় বেদনার্ত করুণচিত্র ফুটে উঠে। কারিমা বিবির বেদনাদগ্ধ কথার উদ্ধৃত করা গেলো- ‘রাতাডা নইছিলাম। কোন মিয়া বাড়ি বেইচ্যা দু-তিন ট্যাহা পাইবো, অঅমাদেও খাওয়াইতে কোন তকলীফ অইবো না। মাইয়ার মুখডা দেইখ্যা আসা যাইব। কি অইল, দ্যাহো?’ (শওকত ওসমান, ঊভশৃঙ্গ, ১৩৭৫ ব.: ১৪৬)
সাবেক কাহিনীর ‘দীর্ণপত্র’ গল্পে ক্ষুধা ও অভাবের প্রকট ও মর্মস্পর্শী চিত্র উপস্থাপিত হয়েছে। জমির অন্ধ চরিত্র। ভিখেরি। জমিরের জীবনের করুণ চিত্র লেখক তুলে ধরেছেন। সে অন্ধ হলেও গ্রামের মহিলাদের বিভিন্ন কাজকর্ম করে দিয়ে নিজের খাবারের সংস্থান করতো। এক বিধবা মহিলার জন্য টাকা সংগ্রহ করতে অন্যগ্রামে যায়। সেখানে ঝড়ের কবলে পড়ে। জমির সেখানে টাকা পেলেও তার ফিওে আসা হয় না। কিন্তু সে জানতো এই টাকা নিয়ে গেলে বিধবার খাবারের জোগাড় হবে। তার আগেই সে ঝড়ের কবলে পড়ে লম্বা টিনের আঘাতে তার মৃত্যু ঘটে। এ গল্পে একদিকে জমিরের ক্ষুধা-দারিদ্রের বিরুদ্ধে নিত্য সংগ্রাম, আর একদিকে বিধবা মহিলার ঘরে অভাব-অনটনের করুণ অবস্থা। বিধবা মহিলার জন্য অন্য গ্রামে গিয়ে টাকা সংগ্রহ করে এনে তার ঘরে ক্ষুধা নিবারণের যে ব্যবস্থা করতে চেয়েছিল জমির, বাস্তবে তা সফল হয়নি তার আকস্মিক মৃত্যুতে। এই মৃত্যু বিধবা মহিলার জীবনে কোন সমস্যার সমাধান আনেনি, সমস্যা সমস্যাই থেকে গেছে। মানুষের জীবনে অনেক চাহিদা আছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় চাহিদা খাদ্য। সেই খাদ্যসমস্যা যখন প্রবল প্রকট হয়ে ওঠে তখন সবধরণের নীতিনৈতিকতা বিবেকবোধ সম্ভ্রম সবকিছু পেটের ক্ষুধার কাছে পরাভূত হয়ে পড়ে। ‘দীর্ণপত্র’ গল্পে লেখক সেই নিষ্ঠুর চরম সত্যকে সততা ও আন্তরিকতার সঙ্গে তুলে ধরেছেন। ‘বালকের মুখ’ গল্পটিও ক্ষুধা ও দারিদ্রের শৈল্পিক সত্যভাষণ। এদেশে বিভিন্ন সময় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হয়েছে। অভাবে ক্ষুধার তাড়নায় বহু মানুষ নিজের এলঅকা ছেড়ে অন্য এলাকায় গিয়ে আত্মসম্মান বিক্রি করে মানুষের দুয়ারে ধরণা ধরছে। ভিক্ষাবৃত্তি গ্রহণ করেছে। নারীরা সম্ভ্রম বিক্রি করেছে। বেশ্যাবৃত্তি গ্রহণ করেছে। অভাব-অনটনে ক্ষুধা দারিদ্রে হাড়-হাড্ডিসার শরীরে কলকাতার শহরে কিলবিল করে পথে ঘাটে মরে থেকেছে মানুষ। মানুষ আর পশুতে কোন পার্থক্য থাকেনি। শওকত ওসমানের গল্পে এসব ছবি আছে সচেতনতার সঙ্গে। ছিন্নমূল বালক করমালির বেদনার্ত ছবি উঠে এসেছে এ গল্পে। রান্না করা যে মাংস তা শেষ হওয়ার পরে পাতে বাবুর্চি পানি ঢেলে দিয়েছে। পানির উপরে তেল ভেসে উঠেছে। করমালি এটাকেই আসল তরকারি মনে করে রুটি দিয়ে তৃপ্তিসহ খেয়েছে। বালকের কাছে মনে হয়েছে খাবারটা খুবক ভালো, শুধু একটু নুন কম। ভাবা যায়, সমাজের কী দুঃসহ করুণ ছবি! একটা বালক সে জানেই না এরকম খাবারে মাংস থাকে। মাংস খাবারের পরে শূন্যপাতে শুধু পানি দেয়ায় তেল ভেসে ওঠা পানিতে রুটি চিবিয়ে খাচ্ছে করমালি, যেটা বাস্তবে খাবার নয়। আবার এ খাবার নিয়ে হাসাহাসির প্রসঙ্গ আছে। এই হাস্যবঙ্গ আমোদ যে সভ্যতার বুকে বিষাক্ত বিষদাঁতের ছোবল, একজন ছিন্নমূল বালক করমালির করুণ জীবনের মধ্য দিয়ে সেই নগ্ন উল্লাসে সমাজের কদর্য রূপ উপস্থাপিত হয়েছে। করমালি যে এই সমাজেরই মানুষ হয়ে কোনদিন সে মাংস খায় নি বা খেতে পারেনি, এই ব্যর্থতার দায় তো সমাজ ব্যবস্থার উপরই বর্তায়। এরকম দুস্থ অসহায় দারিদ্রক্লিষ্ট করমালিরা এদেশে ক্ষুধা-দারিদ্র্যের নির্মম শিকার, জীবন-মরা হয়ে তাদের বেঁচে থাকা, তার প্রতিনিধিত্ব করেছে ‘বালকের মুখ’ গল্প।
৭.
শওকত ওসমানের গল্পে দুর্ভিক্ষের চিত্র আছে বহুভাবে। ‘বিভাগ পূর্বকালের একটি উল্লেখযোগ্য প্রসঙ্গ ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ। বাংলাদেশের গ্রামীণ দারিদ্র ও কৃষকের দুর্গতির জন্য যেমন প্রাকৃতিক দুর্যোগ আংশিকভাবে দায়ী, তেমনই কৃত্রিম অভাব সৃষ্টিকারী বণিকসমাজ ও হৃদয়হীন শাসকগোষ্ঠীর হটকারী ভূমিকাও কম নয়। ১১৭৬ বঙ্গাব্দের মন্বন্তর থেকে ১৩৫০ সন পর্যন্ত উপমহাদেশে বহুবার দুর্ভিক্ষ সংঘটিত হয়েছে, যেমন ১৭৮৩, ১৮৬৬, ১৮৭৩, ১৮৭৫-৭৬, ১৮৯১-৯২, ১৮৯৭ ও ১৯০০ খ্রীস্টাব্দের দুর্ভিক্ষের কথা আমরা বলতে পারি।’ (মুখোপাধ্যায়, পঞ্চাশের মন্বন্তর, ১৩৫০ব.: ২১) এর পরও বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ হয়েছে। দুর্ভিক্ষের হানার শিকার যেন এদেশে নিয়মিত ঘটনা। তা কতকটা প্রকৃতিক, কতকটা কৃত্রিমভাবে তৈরি। ‘বিশ শতকের গোড়ার দশক থেকে চল্লিশের দশক পর্যন্ত বেশ কয়েকবার এদেশের মানুষ দুর্ভিক্ষকবলিত হয়। ১৯০৭-০৮, ১৯১৮-১৯, ও ১৯২০-২১ সালে দুর্ভিক্ষ হয়। (মজুমদার, বাংলাদেশের ইতিহাস, ১৯৮২: ৫৬৭) এসব দুর্ভিক্ষে প্রতিবারই অসংখ্য মানুষ খাদ্যের অভাবে মৃত্যুবরণ করেছে। বহু মানুষ আত্মাহুতি দিয়েছে। বহু নারী দেহ বিক্রি করেছে, ক্ষুধার যাতনায় বেশ্যাবৃত্তি গ্রহণ করেছে। ‘সবচেয়ে ইতিহাসের মর্মান্তিক ট্রাজেডি ঘটে ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষে। এ শহরের সবচেয়ে বড় ভয়ঙ্কর দৃশ্যের হোতা এই দুর্ভিক্ষে ১৫ লক্ষ মানুষ মারা যায়।’ (রমেশচন্দ্র মজুমদার, বাংলাদেশের ইতিহাস, ১৯৮২: ৫৬৭) এ সব দুর্ভিক্ষের প্রত্যক্ষদর্শী শওকত ওসমান। কোন বড় লেখকই তাঁর সময়কালকে অস্বীকার বা এড়িয়ে গিয়ে মহৎ সাহিত্য সৃষ্টি করতে পারেন না। যে কারণে বিখ্যাত সব লেখকই তাঁদের সমকালে ঘটে-যাওয়া বৃহৎ ঘটনাকে সাহিত্যের উপজীব্য করে অনিবার্যভাবে গ্রহণ করেন। তা হতে পারে রাজনৈতিক-মানবিক বিপর্যয়, আর্থ-সামাজিক-দুর্ভিক্ষ-অনেক কিছুই হতে পারে। কীর্তিমান লেখকেরা সে সব বিষয়ে সচেতন থাকেন।
বাংলার দুর্ভিক্ষের ক্ষেত্রেও বাঙালি খ্যাতিমান লেখকদের সাহিত্যকর্মে এই সত্যতা পরিলক্ষিত হয়। শওকত ওসমানের পূর্বে ‘বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের আনন্দমঠ-এ (১৮৮২) ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের ভয়াবহ বর্ণনা রয়েছে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অশনি-সংকেত (১৩৬৬ ব.) এবং তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্বন্তর (১৯৪৪) ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নমুন, আজকাল পরশুর গল্প ইত্যাদিতে।..শওকত ওসমানের ‘আকালের গল্প’, ‘আজব জীবিকা’, ‘একশ বছর পরে’, ‘ভাগাড়’, ‘হিংসাধার’ প্রভৃতি গল্পে ১৯৪৩ সালের দুভিক্ষের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার সংযোগ ঘটেছে।’ (মাহমুদ, বাংলা কথাসাহিত্যে শওকত ওসমান, ২০১৪: ৫৮) ‘আজব জীবিকা’ গল্পে দেখা যায় দুর্ভিক্ষের কারণে সৃষ্ট অভাবের শিকার হয়ে এক প্রসূতি দেড় বছরের শিশুসহ আত্মহত্যা করার জন্য চেষ্টা করছে। সেখানে পাহারাদার নফিস তাকে শিশুসহ আত্মহত্যা থেকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়। ‘ব্লাক আউট’ গল্পে পঞ্চাশের মন্বন্তরের ছবি আছে। মানুষ ক্ষুধার যন্ত্রণায় আর্তচিৎকারের দলে দলে গ্রাম ছেড়ে শহরে যাচ্ছে একটু ফ্যানের আশায়। অসংখ্য মানুষ না খেতে পেয়ে মারা যাচ্ছে। পুরো শহর মৃত্যুপুরিতে পরিণত হয়ে ওঠে। সেখানে এক অষ্টাদশী গল্পের কথকের কাছে সাহায্য চায়। কথক তাকে একটা টাকা সাহায্য দেয়। অষ্টাদশী ঋণ পরিশোধের কোন উপায় পায় না-কিভাবে সে তার ঋণ শোধ করবে! সে তো ভিখারিনী নয় যে শুধু শুধু হাত পেতে সাহায্য নেবে। সে সাহেবের বাসায় যেতে চায়। সাহেব তাতে আপত্তি করলেও সে তা তা উপেক্ষা কওে তার বাসায় নিজের সম্ভ্রম দেওয়ার জন্য যেতে চায় এবং এ প্রস্তাব দিয়ে সে আঁচল মুখে কাঁদতে থাকে। কারণ সম্ভ্রম দেওয়া ছাড়া সাহেবের ঋণ পরিশোধের আর কোন উপায় নেই তার। সাহেব নিজের সম্মান রক্ষার্থে অষ্টাদশীর প্রস্তাব গ্রহণ না করে অন্ধকার গলির মধ্যে চলে যায়। তখন পুরো শহরে চলছিল ব্লাক আউট। দুর্ভিক্ষের কারণে নারীরা ক্ষুধার তাড়নায় কিভাবে নিজেদের শরীর স্বেচ্ছায় বেচায় বাধ্য হয়ে উঠেছিল, কিভাবে ক্ষুধায় যন্ত্রণায় শহর আর্তনাদে পরিণত হয়েছিল, কিভাবে দলে দলে মানুষ মৃত্যুবরণ করে শহরের রাস্তায় পড়েছিল, এসবের এক মর্মন্তুদ ছবি ফুটে উঠেঠে ‘ব্লাক আউট’ গল্পে।
দুর্ভিক্ষ যে সবসময় প্রাকৃতিকভাবে ঘটে তা নয়। মহাজনরাও খাদ্যের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দুর্ভিক্ষ তৈরি করে। সেইসব দুর্ভিক্ষেও বহু মানুষের করুণ মৃত্যু ঘটে। খাবারের অভাবে বহু মায়ের বুক দুধশূন্য হয়ে যায়। ‘আকালের গল্প’তে এসব চিত্র উঠে এসেছে অত্যন্ত আন্তরিক দরদে। ডিগবাজী গল্পগ্রন্থের বিভিন্ন গল্পে আভাব, দারিদ্র ও বিপর্যস্ততার চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। এসব গল্পের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ‘পার্ক’ গল্প। মন্টু দিনমজুরের সন্তান। কিন্তু যুদ্ধেও সময় কাজকর্মহীন তার বাবা। অভাব অনটন ক্ষুধা-দারিদ্রে পরিবারটি জর্জরিত। মন্টু খেতে বসে একদিন পেট ভরে খাবার না পেয়ে মায়ের সঙ্গে ঝগড়া রাগারাগি করে রাগে-ক্ষোভে পার্কে যায় সময় কাটাতে। সেখানে গিয়ে দেখে তার বেকার বাবা ক্ষুধায় একটা শিরিষ গাছের নিচে বেঞ্চিতে বসে ঘুমোচ্ছে। নিম্নশ্রেণির মানুষের জীবনে অভাব-অনটন, জীবন-জীবিকার অনিশ্চয়তা, পারিবারিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত-রাগ-অভিমান-অসহায়ত্বের ছবি পরিলক্ষিত হয় ‘পার্ক’ গল্পে। প্রস্তর ফলকের ‘বর্ণামৃত’ ও ‘গন্তব্য’ গল্পদুটিতেও এ ছবি প্রতিফলিত হয়েছে। অভাবে তাড়নায় পেশা পরিবর্তনের প্রসঙ্গ আছে। হাসিবের মতো একজন চিত্রশিল্পী ক্ষুধার কাছে পরাজিত হয়ে চিত্রকর্মকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়ে পিরালি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়। ক্ষুধার কাছে শিল্প ও আদর্শ কিভাবে পরাভূত হয়ে নুয়ে পড়ে আদর্শহীন ও লোক ঠকানো বিভ্রান্ত পন্থায়, তার বাস্তব গল্প ‘বর্ণামৃত’। একজন চিত্রশিল্পী বেকারত্বের যন্ত্রণায় পিরালি সেজে মাথায় কুল্লা লাগায়, মাথায় পাগড়ি পরে, মুখে দাঁড়ি রাখে। এ যেন নিজেই নিজেকে পুরো উল্টে ফেলানোর গল্প। এবং তিন মির্জা গ্রন্থে ‘শেষ আগে শুরু হয়’ গল্পে জমি বন্ধকের প্রসঙ্গ আছে। ঘুষের প্রসঙ্গ এসেছে। সে সঙ্গে আছে ধনীর প্রাচুর্য ও অভিজাত শ্রেণির কথা। শওকতা ওসমান অত্যন্ত সমাজসচেতন লেখক ছিলেন। ছিলেন কাল সচেতন। যে কারণে তিনি সমাজের ভেতর-বাইরের সবকিছু খুঁটে খুঁটে নিখুঁতভাবে তুলে আনতে পেরেছিলেন। আসাদ মোটর সাইকেলের লাইসেন্সের জন্য ঘুষের টাকার ব্যবস্থা করতে পিতার জমি বন্ধক রাখে। তাতে সে মোটর সাইকেল চালানোর লাইসেন্সও প্রাপ্ত হয়। কিন্তু আসাদেও স্বপ্ন বেশি দূও এগোয় নি। ইঞ্জিনিয়ার মিনহাজ সাহেবের প্রাইভেট কার চালঅতে গিয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় সে মারা যায়। এতে গরিব একটি পরিবারের সব স্বপ্ন দুমড়েমুচড়ে ভেঙে যায়। সন্তানের মৃত্যুও খবরে পিতার করুণ আর্তনাদ এতো স্বপ্নভঙ্গ সব গরিব পরিবারের অসহায় পিতার আর্তনাদ। এই মৃত্যুতে বাবা যেমন তার উপার্জন-নির্ভও সন্তানকে হারিয়েছে, আর একদিকে জমির বন্ধকীরণ, এ জমি ছাড়ানোর মতো সামর্থ্য তার নেই। জীবন-জীবিকার গভীর অন্ধকার নেমে আসে অসহায় পিতার জীবনে, গরিব পরিবারটির সব আশা আসাদের মৃত্যুতে মুহূর্তেই নিভে যায়। ‘শওকত ওসমানের আর্থ-সামাজিক চেতনাস্নাত গল্পগুলেঅতে বাঙালির অভাব-দারিদ্র্যেও পরিপ্রেক্ষিতে খুব বলিষ্ঠ ও আন্তর্প্রেরণায় নির্মিত। ঊভশৃঙ্গ গ্রন্থেও ‘আখেরী সংক্রান্ত’ গল্পটিতে ঢুলীদের অবস্থার বিবর্তন এবং ক্রমবধা দারিদ্রদশায় নিপাতন দেখান হয়েছে। নেত্রপথের ‘রাস্তার হদিস’ এ অঙ্কিত হয়েছে এক খোঁড়া ভিক্ষুক ও ভাতিজাদেও চিত্র। মোটকথা বাঙালির দারিদ্রের নানা বৈচিত্রমণ্ডিত চিত্র অঙ্কনে শওকত ওসমানের পরাঙ্গমতা অনস্বীকার্য।’ (মাহমুদ, বাংলা কথাসাহিত্যে শওকত ওসমান, ২০১৪: ১১৪)
৮.
শওকত ওসমান তাঁর ছোটগল্পে দারিদ্রের কারণ হিসেবে ধন-সম্পদের অসমবন্টন ও শোষণ-বঞ্চনার কথা উল্লেখ করেছেন। আমাদের দেশে একসময় বুর্জোয়াতন্ত্র, তারপর সামন্তবাদী শোষণ, বর্তমানে পুঁজিবাদী শোষণের নানা রূপ প্রতীয়মান হয়। এসব কারণে শ্রেণিবেষম্য প্রকট হয়ে ওঠে। অভাব-অনটন তীব্র আকার ধারণ করে। জমিদারদের যে হৃদয়হীন নিষ্ঠুর শাসন, শোষণ ও অত্যাচারে অতিষ্ঠ ছিল সাধারণ জনগোষ্ঠী। শওকত ওসমানের গল্পে সেসব বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে উপস্থাপিত হয়েছে। এক্ষেত্রে সাবেক কাহিনীর ‘বকেয়া’ গল্পের উল্লেখ করা যেতে পারে। জমিদারদের চরিত্রই হলো যখন যাকে যেভাবে পারে ব্যবহার করে, প্রয়োজন শেষে ছুঁড়ে ফেলে। সেখানে হৃদয়বেত্তার বা মানবিক কোন ব্যাপার থাকে না। জমিদারের একসময়ের পেয়াদা ছিল পাঁচু। পাঁচুর বয়স হয়েছে। শক্তি হারিয়েছে। এরকম বয়স্ক ও শক্তিহীন পাঁচুকে জমিদারের প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন তো নেই-ই, তার উপরেও অত্যাচারের খড়গ তুলতে জমিদারের বিন্দুমাত্র দ্বিধার পরিচয় মেলেনি। পাঁচুর দুই সনের খাজনা বাঁকি পড়ায় জমিদার তাকে ডেকে জমিদার ছেড়ে দিতে বলেছে। নিরুপায় পাঁচু বিশ টাকা খাজনা পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে বস্তুভিটে ত্যাগ করে চলে যেতে বাধ্য হয়। পাঁচু একটা ট্রাজেডি চরিত্র। ম্যালেরিয়া রোগে আগেই তার স্ত্রী মারা গেছে। একমাত্র মেয়ে টুনি বিনা চিকিৎসায় মারা যায়। টুনির লাশ জমিদারের পুকুরে ভেলায় ভাসিয়ে দিয়ে গিয়েছিল পাঁচু। জমিদার টুনির নামে তিন শত টাকা খরচ করে স্বরস্বতীর পূজো করে, এ পূজোতে তার বিশ্বাস নেই, লোক দেখানো। মিথ্যে স্বরস্বতীর পূজো করতে তার বিবেকে বাধে না। অথচ সে মাত্র বিশ টাকার জন্য পাঁচুকে বাস্তুভিটা ছাড়া করে। ‘পিজরাপোল’ গল্পের গরিব-অসহায় মানুষের সঙ্গে মহারাজা গান্ডেরীরামের হৃদয়হীনতার চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। একটা সাদা গাভীর মৃত্যুতে মহারাজা শোকাচ্ছন্ন হয়েছে। প্রতিষ্ঠা করেছে রোগ-ক্লেশ নিবারণী প্রতিষ্ঠান। এখানে নাইট উপাধিধারী আসাদ আলীর গাভী থাকে মশারির ভেতর। অথচ এখানে কর্মরত কেরানি ও রাখালদেও ক্ষুধা নিবারণের কোন ব্যবস্থা করে নি মহারাজা গান্ডেরীরাম। এখানে মরুমিয়া বিশ বছর যাবৎ চাকরি করে বিশ টাকা বেতনের। যে টাকায় তার জীবন চলে না। বিপন্ন ও বধ্বস্ত অসহায় জীবনের ভেতর দিয়ে তাকে জীবন পার করতে হয়। গান্ডেরীরাম পশুর বেকদনায় বিগলিত, তাদেও রোগ নিবারণের লক্ষে প্রতিষ্ঠান করে, মশারির ভেতর গাভীকে রাখে। অথচ পশু-দরদী গান্ডেরীরাম তার পাটকলের শ্রমিকদেও দাবী না মিটিয়ে তাদের ওপর গুলি চালানোর অঅদেশ জারি করে। আসলে মহারাজা গান্ডেরীরাম যে একটা ভণ্ড ও নিষ্ঠুর শাসক, তার উন্মোচন ঘটেছে এ গল্পে। বাইরে পশু-দরদীর চেহারা দেখালেও ভেতরে সে নিজেই একটা হিংস্র পশু-চমৎকারভাবে লেখক তা ‘পিজরাপোল’ গল্পে উপস্থাপন করেছেন।
বস্ত্র সমস্যা নিয়েও শওকত ওসমান গল্প লিখেছেন। ব্রিটিশশাসনের শেষের দিকে বিশেষ করে ১৯৪৪ সালে তৎকালীন বাংলায় কাপড়ের সমস্যা প্রকট হয়ে উঠেছিল।
‘বাংলা ছোটো গল্পে চল্লিশের দশকে যাঁরা লিখতে এসেছিলেন, তাঁদের মধ্যে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, স্বর্ণকমল ভট্টাচার্য্য, সমরেশ বসু প্রমুখ বহু খ্যাতনামা কথা-সাহিত্যিকের নাম করা যায়। ১৯৪৪ থেকে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ‘পরিচয়’, অরণি, ‘ক্রান্তি’ ইত্যাদি পত্রিকাকে কেন্দ্র করে যে গল্পধারার সূচনা হয়েছিল, সেগুলির একটি মূলগত স্বভাবধর্ম যদি চিহ্নিত করতে হয়, তা হল, সেই গল্পগুলির অধিকাংশই ছিল সমসাময়িক দেশ-কাল সমাজনির্ভর। বলাবাহুল্য বাংলা ছোটোগল্প তার জন্মলগ্ন থেকেই সমাজ-মনস্ক থেকেছে। কিন্তু এই সময়পর্বে পরপর ঘটে যাওয়া কিছু রাষ্ট্রনৈতিক বিক্ষোভ, যেমন মন্বন্তর, দুর্ভিক্ষ, বস্ত্র সংকট ইত্যাদি বিষয়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। সমসাময়িক সামাজিক, রাষ্ট্রনৈতিক ঘটনা সম্পর্কে লেখকদের দৃষ্টির সজীব আন্তরকতা ও তীক্ষ্ম সমাজমনস্ক মন সেই সময়কার ‘প্রগতি সাহিত্য’ বা ‘নতুন সাহিত্য’-র অন্তরতম সুরটিকে চিনিয়ে দিতে পেরেছিল।’ (বাপ্পা ঘোষ, ‘বস্ত্র সংকটের গল্প, আবরণ, দুঃশাসন, শিল্পী’, ‘পরবাস’ সংখ্যা-৭৫, ৩০ জুন ২০১৯)
নরেন্দ্রনাথ মিত্রের ‘আবরণ’, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘দু:শাসন’ এবং মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘শিল্পী’ গল্পে মূলত প্রকটভাবে বস্ত্র সমস্যার প্রসঙ্গ গুরুত্ব পেয়েছে। কবি জসীম উদ্দীন ‘আসমানী’ কবিতায় বস্ত্র সমস্যার কথা বলেছেন। শওকত ওসমানও কাল-সচেতন, সমাজমনস্ক ও আর্থ-সমাজ সচেতন শিল্পী ছিলেন। যে কারণে তিনিও তাঁর অনেক গল্পে বস্ত্র সংকটের বিষয়কে গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেছেন। এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তাঁর ‘কাঁথা’ ও ‘নতুন জন্ম’ গল্প। ‘নতুন জন্ম’ গল্পে ফরাজ আলী ও তার পুত্র আক্কাসের বস্ত্রসমস্যার আত্মযন্ত্রণাদগ্ধ নগ্নচিত্র উঠে এসেছে। ফরাজ আলী ও তার ছেলে আক্কাস ঠাণ্ডা ঝড়ো বাতাস-বৃষ্টির ভেতর গোমতী নদীতে মাছ ধরে ঘরে ফিরে এসে স্বস্তিবোধ করতে পারেনি। জোয়ারের পানিতে তাদের ঘর ডুবে গেছে। ফলে ঘর ছেড়ে তারা বাঁধে আশ্রয় গ্রহণ করে। আক্কাসের পরিধানের বস্ত্র শুকনো থাকলেও আলগা গায়ে শীতে কাঁপতে থাকে। পিতা ফরাজ আলীর পরণের বস্ত্র ভিজে গেলে সে বিবস্ত্র শরীরে কাঁধা জড়িয়ে নেয়। সন্তানকে শীতে কাঁপতে দেখে তাকে বিবস্ত্র শরীরে কাঁথার ভেতর জড়িয়ে নেয়। ফরাজ আলী নিজের অসহায়ত্ব ও লজ্জা ঢাকতে নিজেই নিজের পুত্রের কাছে পুত্র হয়ে যায়-‘সরম করস না। আঁই তোমার পোলা ন, বা-জান?’ এ এক নিদারূণ কষ্টের চিত্র। বস্ত্রসংকট কতোটা ভয়াবহ হলে এমন কঠিন ও রূঢ় বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয় পিতা-পুত্রকে, তার শৈল্পিক সৃষ্টি ‘নতুন জন্ম’ গল্প। শওকত ওসমানের গল্পে চিকিৎসা সমস্যার কথাও এসেছে। বাংলাদেশের গ্রাম-গঞ্জে চিকিৎসার যে ভয়াবহ সংকট বিরাজমান, চিকিৎসা করানোর মতো আর্থিক সামর্থ্য অসহায় গরিব মানুষের নেই, আবার চাকরিরত অবস্থায় ম্যালেরিয়া রোগের কথা গোপন করে ওয়াহেদ আলির মতো মানুষকে মরতে হয়েছে, চিকিৎসার অভাবে বহু মানুষকে মৃত্যুবরণ করতে হয়-এই কঠিন বাস্তবতা তিনি গভীর দরদের সঙ্গে অনুধাবন করেছেন। তাঁর ‘প্রতীক্ষা’ ও ‘প্রতিবেশী’ এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। জমিদারদের অত্যাচারের প্রসঙ্গ আছে তাঁর ‘দরখাস্ত’ গল্পে। মেহের আলী কিছু টাকা সংগ্রহ করেছিল টিনের ঘর তৈরির জন্য। কিন্তু ঘর তৈরির জন্য জমিদারের অনুমতির প্রয়োজন হয়। সে জন্য দরখাস্তও দিয়েছিল মেহের আলী। নায়েবকে দশ টাকা ও ঘি ঘুষ দিয়েছিল অনুমতি লাভের জন্য। কিন্তু জমিদার দুহাতের বেশি উচু ঘর তৈরির অনুমতি দেবে না। মেহের আলী চার হাত উঁচু করে ঘর তৈরি করতে চায়। তার ইচ্ছে পূরণ হয় না। কারণ চার হাত উঁচু ঘর তৈরি করলে তাতে বাতাস ঢুকবে, আলো ঢুকবে, প্রজারা আরাম-আয়েশে থাকবে, জমিদার তা চায় না। আর সে কারণে জমিদার কূটকৌশলে নিয়মটা কঠিন করে দেয়, উঁচু ঘর তুলতে হলে এক শত টাকা ফি দিতে হবে। মেহের আলীর পক্ষে এক শত টাকা ফি দেওয়া সম্ভব হয়নি, অনুমতিও জোটেনি। প্রজা নিপীড়নের অনবদ্য চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে ‘দরখাস্ত’ গল্পে। ‘কিরূপে স্বর্গে গেল’ গল্পে বর্গাচাষী আবেদালির নিঃস্বতা ও মৃত্যুর করুণ কাহিনী উঠে এসেছে। কিভাবে একজন বর্গাচাষী আবেদালী প্রথমে তার জমি হারালো, তারপর কিভাবে হালের গরু হারালো এবং শেষে কিভাবে আত্মহননের পথ বেছে নিলো, শেষে কাফনের টাকাও তার জোটেনি-শ্রেণি-শোষনের অসামান্য এক গল্প ‘কিরূপে স্বর্গে গেল’। শ্রেণি-শোষণের কারণে একজন সফল কৃষক ক্রমপর্যায়ে কিভাবে মধ্যকৃষকে পরিণত হয়, মধ্যকৃষক থেকে কিভাবে প্রান্তিক কৃষকে পরিণত হয়, প্রান্তিক কৃষক থেকে কিভাবে ভূমিহীন হয়ে ক্ষেতমজুওে পরিণত হয়-তার দুর্দান্ত চিত্র উপস্থাপিত হয়েছে এ-গল্পে। শ্রমিক শোষণের অভিনব কৌশলের প্রসঙ্গ আছে ‘দুই চোখ কানা’ গল্পে।
বিস্কুট কারখানার মালিক চৌধুরী সাহেব তার কারখানায় শ্রমিক দিয়ে শ্রমিক শোষণের কৌশল গ্রহণ করেছেন। তিনি কারখানার দায়িত্ব দিয়েছিলেন স্বল্প শিক্ষিত এক মুন্সিকে। এই মুন্সি মালিকের কাছে বিশ^াসভাজন ও বেশি গুরুত্ব পাবার জন্য শ্রমিকদেও ওপর নানাভাবে অত্যাচার করতো। তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে অনেক শ্রমিক চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের সময় ব্যবসায় মন্দ অবস্থা সৃষ্টি হলে এই উসিলায় কারখানার মালিক চৌধুরী সাহেব মুন্সিকে চাকরি থেকে বাদ দিয়েছেন। বৃদ্ধ বয়সে চাকরি-হারা মুন্সি নিজের ছেলেমেয়েদের দুর্গতির কথা ভেবে কান্না করেছে। তার এই কান্নাতে খুশি হয়েছে তার কাছে অত্যাচারিত শ্রমিকেরা। মালিকের এই অপকৌশল কারখানা পরিচালনার ক্ষেত্রে বেশ সহায়ক ভূমিকা রাখতো। শ্রমিকের সঙ্গে শ্রমিকের এই বিভেদ যে মালিকের তৈরি, তা শ্রমিকেরা বুঝতে পারতো না। এতে করে শ্রমিকের হাতে শ্রমিক নির্যাতিত ও অত্যাচারিত হতো। চাকরিও হারাতে হতো। শ্রমিক চোখ থাকতেও যেন অন্ধ হয়ে থাকতো। ‘দুই চোখ কানা’ গল্পে শ্রমিকরা যে অন্ধ, প্রকৃত সত্য তারা অনুধাবন করতে পারে না তাদের মধ্যে মালিক বিভাজন তৈরি করে তাদের দিয়েই তাদের ওপর অত্যাচার আর নিপীড়ন চালিয়েছে। শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদও তাঁর গল্পের গুরুত্বপূর্ণ দিক। আবার শোষকের দানকেও ছুঁড়ে ফেলানোর মতো দৃঢ়চেতাসম্পন্ন গ্রামবাসীর কথাও আছে। একজন গল্পকার হিসেবে সমাজের সর্বক্ষেত্রে তিনি তীক্ষ্মদৃষ্টি রাখতে ও পর্যবেক্ষন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর গল্পের বিষয়ের বহুমাত্রিকতা এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ‘ভাগাড়’ গল্পে আড়ৎদার পঞ্চাশের মন্বন্তরের সময় দরিদ্র অসহায় ক্ষুধার্ত গ্রামবাসিকে কোন সাহায্য করেনি। সেই আড়ৎদারই আবার চারটি গাভী বোরবানি করে গ্রামবাসীর মধ্যে বিতরণ করলে, গ্রামবাসী তা ঘৃণার্তভাবে ভাগাড়ে ফেলে দেয়। এর মধ্যে দিয়ে গ্রামবাসী আড়ৎদারের প্রতি প্রতিবাদ, ক্ষোভ ও ঘৃণা নিক্ষেপ করেছে। জমি দখলের মতো ব্যাপারও তিনি গল্পের বিষয় করেছেন। জমি দখল বাড়ি দখল-এসব বিষয় বাংলা সাহিত্যে বিভিন্ন লেখকের উপন্যাস গল্পে গুরুত্বের সঙ্গে উপস্থাপিত হয়েছে। এক্ষেত্রে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘খোঁয়ারি’ গল্প বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। শওকত ওসমানের ‘সৌদামিনী মালো’ গল্পে দেখা যায়, সৌদামিনী মালোর সম্পত্তি ব্রাদার জন অপকৌশলে তার দখলে নেয়। তার কূটকৌশলে বিধবা নার্স সৌদামিনী মালো নিজের সব সম্পত্তি মিশন হাসপাতালের নামে লিখে দেয়। পরে জন ব্রাদার এ সম্পত্তি নিলামে তুলে বিক্রি করে দেয়। জন ব্রাদান একজন চতুর ও অসৎ লোক। সে যুদ্ধের সময় কেরোসিন ব্ল্যাক করতে গিয়েও ধরা পড়ে কাঠগড়ায় উঠেছিল। এখানে এ জমি কুক্ষিগত করতে জন ব্রাদারের সঙ্গী হিসেবে সাহায্য করেছে স্বদেশ কর্মী মনোরঞ্জন। এ দুটি চরিত্রই ব্যক্তিস্বার্থলোভী। যাদের চক্রান্তের শিকার হয়ে সর্বশান্ত হয়ে পাগল অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে সৌদামিনী মালো।
৯.
বাংলা ছোটগল্পে প্রতিষ্ঠা পায় মূলত রবীন্দ্রনাথে হাতে। তার পূর্বে বাংলা ছোটগল্প লেখার প্রয়াস লক্ষ করা গেলেও সেখানে সার্থক ছোটগল্পের আদর্শ রূপ প্রতিষ্ঠা পায় নি। সে প্রয়াস বঙ্কিমচন্দ্রে ও লক্ষ করা গেছে। মূলত রবীন্দ্রনাথের হাতেই বাংলা ছোটগল্প প্রাণ পায়। তাঁর গল্পে পাবিারিক জীবন এসেছে বহুমাত্রিকতায় এবং জীবন্ত রূপে।
‘রবীন্দ্র ছোটগল্পে যেহেতু জান্তব বাস্তবকে ফুটিয়ে তোলার প্রয়াস সর্বাধিক লক্ষিত হয়, তাই এর মধ্যে অনিবার্যভাবে স্থান পায় পরিবারের অন্তর্গত নানা সদস্যদের মধ্যেকার অম্লমধুর সম্পর্ক। কবিগুরু পরিবারকে গল্পের মূল কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে প্রথা, সংস্কার, বিশ্বাস, মূল্যবোধ, পল্লীপ্রকৃতি ইত্যাদির বিপরীতে যুক্তি-বুদ্ধি, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, নারী-স্বাধীনতা, আধুনিক ভাবনা, শহুরে প্রকৃতি ইত্যাদিকে স্থান দিয়ে গল্পের পটভূমিকে দ্বন্ধময় রূপ দিয়েছেন। ক্রমশ সেই দ্বন্ধ ব্যক্তির সঙ্গে বংশের বা পরিবারের দ্বন্দ্ব হয়ে উঠেছে। প্রথম দিকে ব্যক্তি দ্বন্ধক্ষত হৃদয়ে পরিবারের নিগড়ে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা পড়লেও পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন ব্যক্তি কিভাবে পরিবারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে পরিবারের বাইরে চলে গেছে। সব মিলিয়ে রবীন্দ্র ছোটগল্পে পারিবারিক সম্পর্কের দ্বৈত রূপ ফুটে ওঠে। একটি সম্প্রীতির, অন্যটি বিরোধের। এই দুটি রূপ কোথাও গাঢ়, কোথাও বা হাল্কা রঙে চিত্রিত।’ (আবদুর রহিম গাজী, ‘রবীন্দ্র ছোটগল্পে পারিবারিক সম্পর্কের চালচিত্র’,অরণিকা, ১৫ নভেম্বর, ২০১৪)।
রবীন্দ্র-পরবর্তী আরো অনেক লেককের গল্পেই পাবিারিক জীবন নানা অনুষঙ্গে গুরুত্বেও সঙ্গে করে নিতে পেরেছে। তন্মধ্যে শওকত ওসমান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ প্রসঙ্গে গবেষক অনীক মাহমুদের বক্তব্যও প্রণিধানযোগ্য। ‘পারিবারিক জীবনের নানা অম্লমধুরতা আমরা রবীন্দ্র ছোটগল্পের মধ্যে লক্ষ করি। রবীন্দ্রনাথের ‘মধ্যবর্তিনী’ (১৮৯৩), ‘শাস্তি’ (১৮৯৩), ‘নষ্টনীড়’ (১৯০১) প্রভৃতিতে পারিবারিক জীবনের চালচিত্র লক্ষ করা যায়। শওকত ওসমানের একাধিক গল্পে আমাদের পারিবারিক জীবনপদ্ধতির নানা অনুষঙ্গ নিয়ে এসেছেন।’ (অনীক মাহমুদ, বাংলা কথাসাহিত্যে শওকত ওসমান, ২০১৪: ১১৮) এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে, প্রস্তর ফলকের ‘উভসঙ্গী’, ঊভশৃঙ্গের ‘ফৌৎ’, উপলক্ষ্যের ‘মোরগ-মুরগী’, এবং তিন মির্জা’র ‘দম্পতি’ ও ‘ন্যায়-অন্যায়’, সাবেক কাহিনীর ‘তুচ্ছ স্মৃতি’, ‘বিবেক’, নেত্রপথের ‘উৎসর্গ’ প্রভৃতি গল্পে পারিবারিক নানা অনুষঙ্গ প্রতিফলিত হয়েছে। ‘উভসঙ্গী’ গল্পে ধনী লোকের স্ত্রী কুহেলী। সে স্বামীর লাম্পট্য ও বিশ^াসঘাতকতার শিকার হয়েছে। তার স্বামী অন্য নারীর সঙ্গে রাত্রিযাপন কওে, শাড়ি উপহার দেয়। স্বামীর এসব লাম্পট্য স্ত্রী কুহেলীকে মানসিকভঅবে ক্ষতবিক্ষত করে। ‘ফৌৎ’ গল্পে বহুবিবাহের প্রসঙ্গ রয়েছে। মুসলমান সমাজে বহুবিবাহ যে কখনো সুফল বয়ে আনে না তার উল্লেখ আছে গল্পটিতে। মওলঅনা গোরকপুরী তিন স্ত্রীকে নিয়ে হজ করে জাহাজে বাড়ি ফিরছিলেন। একদিন স্বামীর কাছে রাত্রিযাপনের প্রতিযোগিতা শুরু হয় তিন স্ত্রীর মধ্যে। এই নিয়ে তাদেও মধ্যে কলহ বিবাদ শুরু হয়। মওলানা গোরখপুরী ছিলেন ব্লাড প্রেসারের রোগী। স্ত্রীদের কলহবিবাদ সহ্য করতে না পেরে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। মুসলিম বাঙালি সমাজে বহবিবাহের সংসার যে সুখের হয় না, তীব্র বিষময় হয়, তিন সতীনের অশান্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টির কারণে স্বামীর মৃত্যুর মতো ঘটনা ঘটে, লেখক এ রূপ ভয়াবহতা দেখিয়েছেন ‘ফৌৎ’ গল্পে। ‘ন্যায়-অন্যায়’ গল্পে বৃদ্ধ বয়সে বিবাহের ফলে যে কঠিন সমস্যা তৈরি হয়, লেখক তা দেখিয়েছেন। বিপত্মীক মকসুদ আলি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পওে পনের বছরের এক তরুণীকে বিয়ে করেন, পুত্র সন্তান লাভের আশায়। তাকে অফিসের কেরানি শামসুল হুদা নানাভাবে চেষ্টা করেও বিয়ে থেকে নিষ্ক্রান্ত করতে পারেনি। মকসুদ আলি তরুণীকে বিয়ে করে এবং পুত্র সন্তানের জন্ম দেয়। কিন্তু সমস্যা হলো, বৃদ্ধ মকসুদ আলির শরীর দ্রুত ভেঙে পড়ে এবং হাসপাতালে ভর্তি হয়। তার যে জীবন আর বেশি দিন নেই, জীবনসায়াহ্নে এসে একটা তরুণী মেয়েকে বিয়ে করা, সন্তান জন্ম দেওয়া, নিজের মৃত্যু বুঝতে পারা, তার মধ্যে অনুশোচনা তৈরি করেছে এবং এটা যে তার ভুল হয়েছে তা শামসুল হুদার কাছে স্বীকার করেছে। বৃদ্ধ বয়সে বিয়ের কারণে একটা তরুণী মেয়ের জীবন নষ্ট হয়েছে যেমন, তেমনি অনিশ্চিতয়তার শিকার হয়েছে সন্তানের ভবিষ্যৎ। এটা ঘটেছে বৃদ্ধ মকসুদ আলির শুধু আত্মসুখের কারণে। অসাধারণ দক্ষতায় সমাজের এই কদর্য মানসিকতার দারুণ শিল্পায়ন রূপ দিয়েছেন লেখক।
তরুণদের মধ্যে এক ধরনের নৈরাশ্য, নৈরাজ্য উৎকেন্ত্রিকতা মাত্রা ছাড়িয়ে যায়।
শ্রেণিবিভক্ত সমাজের চিত্র নানাভাবে উঠে এসেছে শওকত ওসমানের গল্পে। শ্রেণিবিভক্ত সমাজে ধনী-গরিবের বৈষম্য অনিবার্যতায় রূপ নেয়, সামাজিক সম্মান ও মর্যাদা সমান হয় না, স্তরবিন্যাসে সম্মান মর্যাদার অবস্থান তৈরি হয়ে যায়। অসম্মান, অমর্যাদা ও বঞ্চনার দরিদ্র অসহায় মানুষের জীবনে নিত্য নৈমিত্তিক বিষয় হয়ে ওঠে। আর সেকারণে শ্রেণিসংগ্রামের অগ্নিস্পর্ধিত রূপও ফুটে ওঠে অধিকার আদায়ে। শওকত ওসমানের বিভিন্ন গল্পে শ্রেণিবিভক্ত ও শ্রেণিসংগ্রামের চিত্র পাওয়া যায়। নেত্রপথ-এর ‘পুরস্কার’, ‘হিংসাধার’, ছোটদের নানা গল্প-এর ‘দুটীনোট’, প্রাইজ ও অন্যান্য গল্পের ‘প্রাইজ’, মনিব ও তাহার কুকুর গ্রন্থের ‘গ্রহচ্যুত’ প্রভৃতি গল্পে শেণিসংগ্রাম ও শ্রেণিবিভক্তের চিত্র ধরা পড়েছে। ‘প্রাইজ’ গল্পে শ্রেণিবৈষম্যেও চমৎকার চিত্র তুলে ধরেছেন লেখক। এ গল্পের ভেতর দিয়ে ধনীক শ্রেণির কুৎসিত কদর্য মানসিকতার পরিচয় ফুটে উঠেছে। সমাজের ধনী মহিলারা একটা পার্কে তাদের শিশু-কিশোর বাচ্চাদের বিনোদনের জন্য ‘যেমন খুশি তেমন সাজো’ বা ফ্যান্সি ড্রেসের আয়োজন করে। এ অনুষ্ঠানে ধনী-পরিবারেরর অনেক ছেলেমেয়ে অংশগ্রহণ কওে, যেমন খুশি তেমন সেজে। কেউ ডাকাত সেজেছে, কেউ মুখোশধারী সেজেছে, কেউ সাঁওতাল সেজেছে। এ উৎসবে জীর্ণবস্ত্র পরিহিত একজন ছিন্নমূল বালক ঢুকে পড়ে। সবার ধারণা এই বালকটি ধনী মহিলা ফিরোজা বানুর সন্তান ইজাদ। এই বালকটিই প্রথম পুরস্কার পাবে, এটা সবাই ধরে নেয়। সবার ধারণা ফিরোজাবানু হয়তো ছেলেকে পাঠিয়ে তিনি নিজে আসতে দেরি করেছেন। বিচারকদেও ধারণা এই ছেলেটি কোন অভিজাত পরিবারের সন্তান এবং সে প্রথম পুরস্কার পাবে, এটা প্রওায় একরকম নিশ্চিত। কিন্তু ফিরোজাবানু অনুষ্ঠানে আসার পরে পুরো ঘটনা অন্যরূপ নেয়। তখন পরিষ্কার হয়ে যায় জীর্ণবস্ত্র পরিহিত সন্তানটি ফিরোজা বানুর সন্তান নয়। ভিক্ষুক ছেলেটির অনধিকার প্রবেশের ফলে অভিজাত ধনী মহিলারা তাকে যে যেমন পারে মারপিট করলো, এবং বেশ্রিভাবে গালিগালাজ করে। জীবন বাঁচাতে ভিক্ষুক ছেলেটি প্রাণপণ দৌঁড়াতে থাকে। শত শত রাক্ষুসি হাত যেন তার দিকে ছুটে যায় তাকে ধরতে। এখানে যে ব্যাপারটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, ধনী পরিবারের ছেলেমেয়ে ভিখারি সেজে পুরস্কার পেতে পারবে, কিন্তু প্রকৃত ভিক্ষুক ছেলেটির এ উৎসবে ঢোকার কোন অধিকার নেই। ঢুকলে তাকে কি নির্মমতার শিকার হতে হয় উজাদ তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। অথচ অভিজাত শ্রেণির মহিলারা একবারও ভাবেনি ইজাদদের ভিক্ষা করেই খেতে হয়, এটাই তাদেও জীবন-জীবিকার একমাত্র অবলম্বন।
শ্রেণিবৈষম্যের ভয়াবহ রূপ ‘প্রাইজ’ গল্পে উঠে এসেছে। ‘গ্রহচ্যুত’ গল্পে দেখা যায়, মরাজ সরকার শহরে এসে পড়ালেখা করে চাকুরি-ব্যবসায় অগাধ অর্থ-সম্পত্তির মালিক হয়ে গ্রামের সঙ্গে কোন ধরণের সম্পর্ক-যোগসূত্রতা রক্ষা করেনি। শহরের অভিজাত পরিবেশে সে ডিনজেকে হারিয়ে ফেলেছে, তার সন্তানেরাও অভিজাত পরিবেশে বড় হয়েছে। তিরিশ-বত্রিশ বছর পরে মিরাজ সরকারনিজের গ্রামে গেলে বিরূপ একি পরিস্থিতির শিকার হয়। তার চাচাত বোন হেলেনা বেগম নিজের সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে পাগল হয়েছে। মিরাজ সরকার তার পরিবার-পরিজন নিয়ে গ্রামে এলে তাদের সামনে পাগলি হেলেনা বেগম উলঙ্গ হয়ে নাচতে থাকে। মিরাজ সরকার বহ বছর পওে গ্রামে এস আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে শখ কওে ছবি তোলার যে আয়োজন করেছিল, তা মুহূর্তেই ভণ্ডুল হয়ে যায়। মিরাজ সরকার বিরূপ এ পরিস্থিতিতিতে মুহূর্ত দেরি না কওে পরিবার-পরিজন নিয়ে এলাকা ত্যাগ করে। আসলে পাগলি হেলেনা বেগম উলঙ্গ হয়ে যে নাচ করেছে এটা নিচুশ্রেণির মানুষের একরকম অভিনব প্রতিবাদ মিরাজ সরকারদের বিরুদ্ধে। সামাজিক অবক্ষয়ের চিত্র তিনি তুলে ধরেছেন তাঁর অনেক গল্পে। আমাদেও দেশে বহুমাত্রিক সামাজিক অবক্ষয় ঘটেছে। মুকুন্দরাম থেকে শুরু করে বহু কবি-সাহিত্যিকের রচনায় নানাভাবে সামাজিক অবক্ষয় একরকম অনিবার্যভাবে উঠে এসেছে। আমরা ইতহাসগত ধারাবাহিকতায় অবক্ষয়ের ব্যাপারটি একটু দেখে নিতে পারি। কারণ বাংলা সাহিত্যে উপন্যাস গল্পে অবক্ষয় অপরিহার্যভাবে এসেছে। অবক্ষয় তো শুধু শুধু তৈরি হয় না, একদিনেও তৈরি হয় না। এরও রয়েছে বহুবিধ কারণ।
১০.
ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান এবং ১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীন হওয়ার মধ্য দিয়ে। চতুর ইংরেজ ভারতে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে ও হিন্দু-মুসলমানের বিভাজনের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অগ্নি-পরিস্থিতি তৈরি করে অখণ্ড ভারতকে খণ্ডিত করে। খণ্ডিত করেছিল বাংলাকেও। এতে বাঙালির হাজার বছরের সীমারেখায় পরিবর্তন হয়েছে। বাংলা অনেকটা সংকুচিত হয়ে পূর্ব ও পশ্চিম বাংলাতে সীমাবদ্ধতায় বন্দি হয়ে পড়ে। এই দুই বাংলা দুই দেশের লেজুড়বৃত্তির শাসনের শিকার হয়। বাংলার এভাবে ভাগকরণ বা পরাজয় ছিল বেদনাদায়ক ও মর্মান্তিক ঘটনা ছিল। সম্ভবত এখান থেকেই বাংলার বিকাশ ও উন্নয়ন এবং বাঙালির জাগরণের এক ধরণের মৃত্যু ঘটে, অবক্ষয়ের যাত্রাও এখান থেকেই ব্যাপকভাবে শুরু হয়। কলকাতা থেকে শিল্প প্রতিষ্ঠান কল-কারখানা সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ দিল্লী মুম্বাই মুখী হয়ে উঠেছিল।এর ফলে দিল্লী মুম্বাই অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। পূর্ব বাংলা থেকে ধনী হিন্দুরা পশ্চিমবঙ্গে চলে গেলো। পূর্ব বাংলার মানুষ গেল বর্ধমানে- হুগলি থেকে গেল ময়মনসিংহে। ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন, পাড়াপড়শি, পরিচিত মুখগুলো চিরদিনের মতো ফেলে এক অজানার পথে তারা পাড়ি দিয়েছিল। মূল্যবোধ নৈতিকতা এসব দ্রুত হারিয়ে যেতে থাকে। অসংখ্য মানুষ তাদের হাজার বছরের বাপ-দাদার ভিটে-মাটি ছেড়ে পাড়ি জমালো নতুন দেশে। বাঙালির যে হাজার বছরের ভিত, তা থেকে মাটির টান ক্রমশ হারিয়ে যেতে থাকে। এক শ্রেণির বাঙালি অর্থনৈতিকভাবে উন্নত জীবনের জন্য উন্নত দেশগুলোকে বেছে নেয়। তাদের স্থায়ী গন্তব্য ও বসবাস ঘটতে থাকে সেই সব দেশে। মেধা পাচার এবং শ্রম বিক্রির জন্য শুরু হল বাঙালির নিষ্ঠুর মাইগ্রেশন বা দেশান্তরি। এটা আরো প্রবল হয়ে ওঠে ষাটের দশকে। তখন মাইগ্রেশন শুরু হয় বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে। সেটা বর্তমানে আরো ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। এভাবে মেধা পাচার হওয়ায় সংস্কৃতি, সাহিত্য, মূল্যবোধ, ইতিহাস, ঐতিহ্য ক্রমান্বয়ে ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়ে। অবক্ষয়ের চ’ড়ান্ত যাত্রা ঘটতে থাকে সেখান থেকে-নিজের ভাষা, নিজের দেশ, নিজের মাটি-ইতিহাস ঐতিহ্য সংস্কৃতি তুচ্ছতাচ্ছিল্যে রূপ নেয়। বাঙালির দেশভাগ বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্যের এবং সমাজ-জীবনের ভাঙ্গনের জঘন্যতম অধ্যায়।
বাঙালির এই যে নিষ্ঠুর স্থানচূতি ও মাইগ্রেশন শুরু হল- পূর্ব বাংলা থেকে আসাম, আসাম থেকে পূর্ব বাংলায়- ত্রিপুরার পশ্চিম বাংলায়- মেঘালয় থেকে দিনাজপুর -একই ভাবে বাংলার ওপার হতে এপার। লক্ষকোটি মানুষের জীবিকা, অর্থনৈতিক অবস্থা, মানবিক বন্ধন, সম্পদ, সবকিছুর উপর এক সুদুরপ্রসারি নেতিবাচক স্পষ্ট প্রভাব ফেললো। প্রথম পর্যায়ে নিজের অর্থব্যবস্থার উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীলতা ছাড়া রাষ্ট্রীয়ভাবে কোন সাহায্য ছিল না। আয়-উপার্জন ব্যবসা-বাণিজ্য ছাড়া তাদের সঞ্চিত অর্থ অল্পকাল পরেই শেষ হয়ে যায়। তারপরই শুরু হল বাঙালীর জীবন যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া। সেই জীবনযুদ্ধ তাদের কাছে পরিচিত ছিল না। নিশ্চিন্ত জীবন ছেড়ে অনিশ্চিত এক জীবনের মধ্যে পড়ে যায়-তা ছিল দুঃসহ জীবনযাত্রা।
দেশভাগের সঙ্গে বাংলাও ভেঙ্গে বহু টুকরো করে দেয়া হয়েছিল। শুধুমাত্র পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তানের সাথে যুক্ত করে দেয়া হয়েছিল, আর বাকিরা থেকেছে ভারতের সাথে। পাকিস্তানের সাথে পূর্ব বাংলার ধর্মীয় ব্যাপারটি ছাড়া আর কোন কিছুতেই মিল ছিল না। খণ্ডিত বাংলার জীবনে নতুন জীবন, নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থা, সামাজিক প্রেক্ষপট ও অর্থনৈতিক অনিশ্চিত ও শ্রেণিবৈষম্য জীবনযাত্রার সূত্রপাত ঘটে।
পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের বৈষম্যের শিকার হয়েছে। পশ্চিম বাংলাও বৈষম্যের শিকার। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে কোন ঐতিহাসিক সম্পর্ক না থাকায়- বিভেদ, বৈষম্য, নিপীড়ন ও নির্যাতন ছিল নিত্য বাস্তবতা। বিভক্ত বাংলা উভয় প্রান্তেই বৈষম্যের শিকার হয়েছে। অর্থনৈতিক মন্দা ও জীবন-জীবিকার জন্য এবার বাঙালী ধীরে ধীরে মাইগ্রেশন নিলো। কোলকাতা থেকে দিল্লী, বোম্বে, বিলেত তাদেও গন্তব্য স্থানে পরিণত হয়। একই ভাবে ঢাকা আসাম থেকে লন্ডন, আমেরিকা যাত্রা শুরু ষাটের দশক হতে। প্রথমে এ যাত্রা শুরু হয় মেধাবীদের ভিতর। কারণ দরিদ্র বাঙালির তখন অর্থ ছিল না, ছিল মেধা। তাই দিয়েই তার পাচার শুরু হলো আর সেই মাইগ্রেশনের ধারাবাহিকতা প্রবাসমুখী, পাশ্চাত্যমুখী হওয়া এবং এক ধরণের ত্বরান্বিত গতিধারায় ঘটতে থাকলো। স্রোতের মতন সে যাত্রার অপ্রতিরোধ্যতা এবং তার সাথে বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি তার রূপরেখা এক ভিন্ন বিশ্লেষণের দাবি রাখে। পাকিস্তানের শুরুতেও পূর্ব বাংলার সাংবাদিক, অধ্যাপক, কবি-সাহিত্যিক ও চাকুরিজীবীরা নিজের পেশাগত দায়িত্ব পালনের পরে ভাষা চর্চা, বই লেখা, বই পড়া, সঙ্গীতচর্চা, ছবি আঁকা, নাটকে অভিনয় ও পৃষ্ঠপোষকতা এসব মূল্যবোধের ভেতরে ছিল। পাকিস্তানি শাসকের নির্মমতায় পরবর্তী সময়ে এসব ঘাত-প্রতিঘাতের শিকার হয়েছে। বংলা ভাষীদের কাছে বাংলা ভাষা কতো খাঁটি ও ভেজাল-এ রকম কঠিন প্রশ্ন বাঙালিদের বুকেই বিদ্ধ হয়েছে। এখন সেই প্রশ্ন আরো শাণিত ও বিষাক্ত। দলবদ্ধভাবে উচ্ছৃঙ্খলতা, রাজনৈতিক শক্তির নামে লুটপাট-দুর্নীতি, ছিনতাই রাহাজানি, পড়ালেখার চেয়ে দলবাজিতে ব্যস্ততা, উন্নত দেশগুলোর প্রতি স্বপ্নে বিভার-দুর্ভাগ্যবশত জাতীয় জীবনে এসব অব্যবস্থা ও দেশপ্রেমহীনতা এখন বাস্তব। তরুণদের মধ্যে এক ধরনের নৈরাশ্য, নৈরাজ্য উৎকেন্ত্রিকতা মাত্রা ছাড়িয়ে যায়।
বাংলাদেশের অসৎ আমলা ও রাজনীতিবিদরা বিভিন্ন কায়দায় দেশের অর্থ, সম্পদ অন্য দেশে পাচার করেন। অন্যদিকে বিদেশিরাও বাংলাদেশ থেকে শত শত কোটি টাকা নিজ দেশে নিয়ে যাচ্ছেন। এর চাইতে কয়েক গুণ বেশি অর্থ পাচার করেন বাংলাদেশিরা নিজেরাই। এতে করে এদেশে অবক্ষয়ের চরমরূপ ধারণ করেছে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অবক্ষয়েরও চরিত্র বদলাচ্ছে। একসময় মনে করা হতো ঘুষ-তোষামদকে চূড়ান্ত অবক্ষয় ভাবা হতো। শওকত ওসমান সহ অনেক লেখকের গল্পে এ সত্য ধারণ কওে আছে। পরবর্তীতে অবক্ষয়ের যাত্রা ও মাত্রা বহুবিস্তৃতি ঘটেছে। শওকত ওসমানে গল্পে সমাজের উঁচুস্তর থেকে নিম্নস্তরের বিভিন্ন পেশাজীবীর নানারকম অপরাধ-দুর্নীতির চিত্র ধরেছেন। তাঁর ‘ইলেম’, ‘মনিব ও তাহার কুকুর’, ‘জনারণ্য’, ‘সাবালক’, ‘গরু চোরের প্রায়শ্চিত্ত’, ‘খলিফা’, ‘গোয়েন্দা কাহিনীর খসড়া’, ‘জবর খাতির’, ‘এক কাফন চোরের কাহিনী’, ‘দস্যু-দারোগা সংবাদ’, ‘কুটিলা ভবেৎ’, শিবগঞ্জের মেলা’, ‘স্বৈরিণী’, ‘তিন পাপী’, ‘দানসত্র’ প্রভৃতি গল্পে ঘুষ, মাদক, লাম্পট্য, সাংবাদিকের প্রতারণা, চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই-রাহাজানি প্রভৃতি বিষয় মূল উপজীব্য।
দুজনেই বিধবা হয়। আজেলিয়া ও কামাল বিবাহপূর্ব অবস্থা থেকেই পাশাপাশি বাসায় বাস করার কারণে তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ পরিচয় ঘটে। কামাল তার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে।
‘গোয়েন্দা কাহিনীর খসড়া’ গল্পের আলী খান মফস্বল শহরের একজন সমাজসেবক। বিত্তশালী মানুষ। দশ বারোটি প্রতিষ্ঠানের সভাপতি। আলী খান ছাত্রজীবনে এক কেরানির বাড়িতে থেকে পড়ালেখা করেছেন। সেই কেরানির স্ত্রীর বাক্স ভেঙে গহন করেছিলেন এবং তার কন্যাকে হত্যা করেছিলেন। তার এই কুৎসিত জঘণ্য অতীত সবার অজানা থাকে। মুখোশধারী হয়ে সমাজে সম্মানের আসনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন অর্থ-সম্পদেও কারণে। কেরানিপত্নী ঝিয়ের কাজ করতো। একদিন সে আলী খানকে হত্যা করে প্রতিশোধ গ্রহণ করে। সমাজে এরকম বহু ভণ্ড আছে, যারা অর্থ-সম্পদে সমাজে সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠিত। অথচ তাদের মুখোশের আড়ালে ভয়াবহ জঘণ্য রূপ লুকিয়ে থাকে। ‘স্বৈরিণী’ গল্পে মায়মুনার করুণ কাহিনীর বর্ণনা আছে। মায়মুনা সত্তরোর্দ্ধ অবস্থাসম্পন্ন কুবাদ চৌধুরীর উপপত্নী। সে প্রেমে ব্যর্থ হয়ে অন্য জায়গায় বিয়ে হলে সে ঘর ভেঙে যায়। মিয়াবাড়ির নাগর তাকে পতিতালয়ে নিয়ে যায়। পতিতালয়ে মায়মুনার সঙ্গে কুবাদ চৌধুরী পরিচয় ও সম্পর্ক। সে তাকে এখান থেকে নিয়ে গিয়ে মহল্লায় একটা বাসায় রাখে এবং তাকে মনে মনে স্ত্রীর স্বীকৃতি দিলেও সামাজিক স্বীকৃতি পায় না। বড় স্ত্রীর বাড়িতে যাওয়া তার নিষেধাজ্ঞা থাকায় সেখানে যেতে পারে নি। সে কারণে মায়মুনা পতিতালয় থেকে রক্ষা পেলেও সামাজিক স্বীকৃতি পায় নি। অর্থনৈতিক দূরাবস্থার কারণেই মূলত তাকে করুণ এই পরিস্থিতির শিকার হতে হয়েছে। ‘দীক্ষায়ণ’ গল্পে হাজির পুত্র হবিব খান ও তার বন্ধু শফিউল্লাহর মদ-খাওয়া ও মাতলামির বর্ণনা আছে। ‘পত্নী ও উপপত্নী’ গল্পে দুই মাতাল ওয়াজের ও তাসকীন মদ খেয়ে স্ত্রী বাজি ধরার বর্ণনা আছে। মানুষ সুবিধা ও ফায়দা লাভের জন্য আদর্শবান প্রার্থীকে ভোট না দিয়ে অযোগ্য প্রার্থীকে যে ভোট দেয় তার চিত্র আছে ‘উপলক্ষ্য’ গল্পে। ‘চোর ও সাধু’ গল্পে রয়েছে চোরকে সাধু এবং সাধুকে চোর বানিয়ে বর্তমান সময়ে সংকটকে অভিনবভাবে রূপায়িত করেছেন। ‘কুটিল ভবেৎ’ গল্পে গরিব পরিবারের মেয়ে মাহেলার জীবনের করুণ পরিণতি ও প্রেমার্দশ ফুটে উঠেছে। মাহেলার সঙ্গে সাজেদের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। দাঙ্গার কবলে পড়ে মাহেলার পরিবার নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেলে সাজেদেও সঙ্গে তার আর যোগাযোগ হয়নি। সাজেদও মাহেলার অস্বচ্ছল পরিবারের মা-ভাই-বোনের কোন খোঁজ নেয় নি। এভাবে দশ বছর কেটে যায়। মাহেলা অর্থের অভাবে জীবন বাঁচানোর তাগিদে নিজের সম্ভ্রম রক্ষা করতে পারেনি। কিন্তু সাজেদ তার অপেক্ষায় থাকে। দশ বছর পরে সাজেদ ঈশ^রদী এলাকায় ফার্মের পরিদর্শনে আসে। মাহেলার সঙ্গে দেখা হয় স্টেশনে। সাজেদ তার জন্য অপেক্ষা করে আছে জানালে তা প্রত্যাখ্যান করে মাহেলা। মাহেলা সাজেদ বলে, ‘কত তুচ্ছ প্রলোভনে আমি কত জনের শয্যায় দৌড়ে গেছি-কিন্তু তোমার কাছে না। তা আমি পারবো না। … আমার মনও বিকৃত হয়ে গেছে। তা নিয়ে আমি তোমাকে অপমান করতে পারবো না। আমি তোমার কাছে, যেতে চেয়েছিলাম অনাঘ্রাত সৌরভের মতো, বাতাসও সেখানে অপরিচিত।’ এ কথা বলার পর মাহেলা আর দাঁড়ায় নি। বিদায় নতুন ট্রেনে সে তার গন্তবে চলে যায়। অভাব-অনটন-দারিদ্রের কাছে যে প্রেমের আদর্শ প্রেমের পবিত্রতা চেষ্টা করলে অক্ষুন্ন রাখা যায় না, বাস্তবতার কঠিন নিষ্ঠুরতার কাছে চিরায়ত প্রেমের পবিত্রতাকে বলি দিতে হয় ‘কুটিলা ভবেৎ’ গল্পে তা বর্ণিত হয়েছে। ‘ফয়সালা’ গল্পে গরিব বিধবার সঙ্গে মহল্লার সর্দারের হৃদয়হীন ও নিষ্ঠুর আচরণের প্রসঙ্গ আছে। ভিক্ষুকের প্রতারণা আছে ‘গ্রাম্য গল্পে’। ‘আর্থ-সামাজিক জীবন অন্বেষা শওকত ওসমানের মধ্যে বরাবর গভীর ও সত্যময় দীপ্তি নিয়ে বিচ্ছুরিত হয়েছে। জীবন ও সমাজের সূক্ষ্মদ্রষ্টা হিসেবে গ্রাম ও শহরের আবেষ্টনী থেকে কথাসাহিত্যে তিনি যে মাটি ও মানুষের প্রতিচ্ছবি এঁকেছেন, তা নিরতিশয় বাস্তবমণ্ডিত, চেতনাদর্শী ও শিল্পনিপুণ।’ (মাহমুদ, বাংলা কথাসাহিত্যে শওকত ওসমান, ২০১৪: ১৩৪)
১১.
শওকত ওসমান তাঁর গল্পে বহুমাত্রিকভাবে শুধু গ্রাম-শহরের আর্থ-সামাজিক চিত্র অঙ্কন করেছেন, তা নয়। তিনি তাঁর গল্পে মুক্তিযুদ্ধ ও বাঙালির বিভিন্ন জাতীয় আন্দোলনের সমগ্রতা ধরারও চেষ্টা করেছেন। স্বাধীনতা লাভের পর মুক্তিযোদ্ধাদেও হতাশা এবং হানাদারবাহিনী কর্তৃক ধষিতা নারীর ক্ষোভ তাঁর গল্পে উঠে এসেছে। এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তাঁর গল্পগ্রন্থ জন্ম যদি তব বঙ্গে। এ গ্রন্থে সব গল্পই মুক্তিযুদ্ধেও নানা অনুষঙ্গ অবলম্বনে রচিত। ‘ক্ষমাবতী’ ও ‘জননী: জন্মভূমি’ গল্পে পাকবাহিনী কর্তৃক নারী ধর্ষণের চিত্র আছে। তহমিনার বাবা তমিজ মিয়া। গরিব কৃষক। তহমিয়া মাতৃহীনা। তমিজ মিয়ার ইচ্ছে তহমিনাকে বিয়ে দিয়ে ঘরজামাই রাখবে। কিন্তু তার সে স্বপ্ন পূরণ হয় না। পাকবাহিনীরা তহমিনাকে ধর্ষণ করে। সঙ্গাহীন মেয়েকে নিয়ে বাবা তমিজ মিয়া বর্ডারের দিকে নিয়ে যায়। গোমতী নদীর তীওে এক বাড়িতে আশ্রয় নেয়। মেয়েকে শান্ত্বনা দিয়ে কোনভাবেই স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরাতে পাওে না। তহমিনা আত্মধিক্কারে বিবেকদংশিত হয়ে গোমতির জলে ডুবে আত্মহত্যা করে। ‘জননী: জন্মভূমি’ গল্পে পাকিস্তান বাহিনীর ক্যাপ্টেন তাজ খাঁ ধর্ষণ করে ষাটোর্দ্ধ বৃদ্ধ কসিমনকে। পাকিস্তানি এসব কুলাঙ্গাররা ধর্ষণের মহাযজ্ঞ শুরু করেছিল পূববাংলায়, অর্থাৎ বাংলাদেশে। তাদেও সহযোগী ছিল রাজাকার-আলবদও ও আল শামস বাহিনী। ‘দ্বিতীয় অভিসার’ গল্পে মাজুকে তার জ্ঞাতিভাই ফরীদ রাজাকার তিন শত টাকার চাকরির লোভ দেখিয়ে মিলিটারির ক্যাম্পে রেখে আসে। সেখানে মিলিটারিরা তাকে ধর্ষণ করে। সে কোনরকমে জীবন বাঁচিয়ে ফিরে আসে। কিন্তু সে অন্তঃস্বত্ত্বা হয়ে পড়ে। মাজু এই অপমান কোনভাবেই সহ্য করতে পারেনি। সন্তান প্রসবের চার মাস পরে সঙ্গিনী মরিয়মকে নিয়ে মিলিটারির এই বেজন্মা সন্তানকে ধলেশ^রী নদীর স্রোতে ভাসিয়ে দেওয়ার জন্য রাতে পুনরায় যাত্রা করে। নিজের অপমান অসম্মান ভুলতে নিজের পেটে ধারণকৃত জারজ সন্তানকে নদীর স্রোতে ভাসিয়ে দিয়ে মনের জ¦ালা মেটায়, অপমানের প্রতিশোধ গ্রহণ করে। ‘বার্তাবহ’ গল্পে নদীতে লাশ ভেসে যেতে দেখে লেখকের মনে হয়েছে এ সব লাশ যেন বাংলাদেশের বার্তাবাহক। তখন তিনি অঙ্কন করেছে মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবরের বিখ্যাত এফিটাফ ‘জন্ম যদি তব বঙ্গে’। বাঙালির জাতীয় আন্দোলনের পূর্ণতা লাভ করেছিল স্বাধীনতা যুদ্ধেও মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। শওকত ওসমানের ছোটগল্পে সাতচল্লিশ বিভাগোত্তর কালের বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামের নানা অনুষঙ্গ অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে শিল্পকুশলতায় জায়গা করে নিতে পেরেছে। চল্লিশের দশকের পাকিস্তান আন্দোলন, সাতচল্লিশের দেশভাগ, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, আটান্নর সামরিক আইন, উনসত্তরের গণ-আন্দোলন ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ সহ বাঙালি জাতীয় জীবনের নানা ঘটনা শওকত ওসমানের শিল্পীমনকে বরাবরই আলোড়িত করেছিল। এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য-
‘শওকত ওসমান অত্যন্ত আন্তরিকভাবেই জাতিকে অসুস্থ ও পশ্চাৎগামী বিকৃত ইতিহাস থেকে মুক্তি দিতে চেয়েছেন। স্বজাতির মানুষগুলেঅর মধ্যে সুস্থ ইতিহাসবোধ সঞ্চার করাই তাঁর লেখনী চালানোর অন্যতম উদ্দেশ্য। সে-উদ্দেশ্যেও পরোক্ষা বাস্তবায়ন হয়েছে তাঁর গল্প-উপন্যাসে, আর একেবাওে স্পষ্ট প্রত্যক্ষ রূপ ধরেছে প্রবন্ধে।’ (সরকার, ‘ইতিহাসসচেতন শওকত ওসমান’, সরকার আশরাফ (সম্পাদিত), ‘নিসর্গ’, বগুড়া, ৬ বর্ষ, ১ম সংখ্যা, ১৩৯৭, পৃ. ৮)
ধর্মীয় জীবনের বিভিন্ন দিক শওকত ওসমানের গল্পে উঠে এসেছে। শওকত ওসমান বিশ্বাস করতেন, ‘ধর্ম জীবনকে প্রভাবান্বিত করে। অবশ্যি। কিন্তু তা কখনও জীবনকে নিয়ন্ত্রিত কওে না। অর্থাৎ ধর্ম নিয়ন্ত্রকের জায়গা পায় না কোন দিন। (শওকত ওসমান, পূর্ণ স্বাধীনতা চূর্ণ স্বাধীনতা, ১৯৯০ :৭৮) অথচ আমাদেও উপমহাদেশের রাজনীতি -অর্থনীতি ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে একটি বিশেষ অনুভূতি ও আবেগ বহুভাবে শোষন-সন্ত্রাস চালিয়েছে। শওকত ওসমান এক্ষেত্রে ধর্মের গোঁড়ামি ও পোশাকসর্বস্ব ধার্মিকতার বিরোধী ছিলেন। তাঁর উপন্যাস-গল্পে তা চিত্রিত করেছেন। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ লালসালু উপন্যাসে মজিদ চরিত্র সৃষ্টির মাধ্যমেও ধর্মীয় গোঁড়ামি ও লেবাসধারী ধার্মিকদের মুখোশ উন্মোচন করেছেন। শওকত ওসমানের গল্পেও লেবাসধারী ধার্মিকদেও মুখোশ উন্মোচনের চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। ‘শওকত ওসমানের ছোটগল্পেও ধর্মেও নামে ভণ্ডামি, ধর্ম নিয়ে অযথাই বাড়াবাড়ি, শোষণের মাধ্যম হিসেবে ধর্মেও ব্যবহার এবং ধর্মেও কল্যাণকর দিকের কিছু চিত্র পাওয়া যায়। ভণ্ডধার্মিক সেজে ইহলৌকিক ফায়দা লাভের জন্য আমাদেও সমাজে কিছু কিছু লেঅক বরাবর ব্যাপৃত আছে। বিশেষত রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এ দেশে মানুষকে ধোকা দেবার জন্য নিরবচ্ছিন্ন ধর্মকে ব্যবহার করা হয়েছে। ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ পর্বে রাজনৈতিক শ্লোগানে বরাবরই ধর্মেও লেবাস পরান হয়েছে। (মাহমুদ, বাংলা কথাসাহিত্যে শওকত ওসমান, ২০১৪: ১৪৬) শওকত ওসমান এক্ষেত্রে বরাবরই সচেতন ছিলেন। তাঁর ‘মোজেজা’, ‘একটি বহস’, ‘যোগাযোগ’, ‘হুকুম নড়ে না’, ‘দুই ধার্মিক’, ‘কালের অপরাধ’, ‘হন্তারক’, ‘দুই শরীক’, ‘শকুনের চেখ’, ‘ষাঁড়’, ‘প্রতিশোধ’, ‘ব্ল্যাক মার্কেট’, ‘কিংবদন্তী’, ‘মন্ত্রগুণ’, ‘ফারাক’ প্রভৃতি গল্পে ‘সমাজের গভীওে স্থায়ী সংস্কার তথা কুসংস্কারের বাস্তব চিত্রণ, ধর্মীয় অন্ধত্ব তথা সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক চিন্তার অস্থি খুঁড়ে তোলঅর চেষ্টা, ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষার প্রয়োজনে প্রতিবাদী ভূমিকা গ্রহণের দুঃসাহসী চিত্রণ এবং সর্বোপরি মানবিক চেতনার প্রকাশ ঘটানো’ (আহমদ, “নাগরিক মননশীলতার ধীমান”, সরকার আশরাফ (সম্পাদিত), নিসর্গ, ৬ষ্ঠ বর্ষ, প্রথম সংখ্যা,১৩৯৭: পৃ. ৮০) শওকত ওসমানের ধর্মীয় চেতনানির্ভরতার প্রকাশ ঘটেছে। ধর্মকে ব্যক্তিহীনস্বার্থে কিভাবে ব্যবহার করা হয় তার একটি চমৎকার চিত্র অঙ্কিত হয়েছে ‘মোজেজা’ গল্পে। মোস্তফা খান একজন উকিল। তিনি নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন। ভোট প্রাপ্তির জন্য তিনি নকল দাড়ি রেখে নিজেকে পরহেজগার ব্যক্তি হিসেবে সবার কাছে প্রতিপন্ন করার জন্য চেষ্টা করে। ভণ্ড মৌলানা হাসিব উদ্দিন ফকরুল মোহাদ্দেসিনের সাগরেদ হিসেবে প্রশংসামূলক সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে সাধারণ লোকজনের মধ্যে সে বিতরণ করে। অথচ এই মৌলানার ন্যাক্কারজনক ইতিহাস রয়েছে। যুবকবেশি হাসিব একদিন এক মক্তবের মৌলানার পা ধরে কান্নাকাটি করে তোতলার অভিনয় করে এলেম চায়। তার এলেমে নাকি হাসিবের তোতলামি সেরে যাবে। মৌলানা সম্মত হয়ে তার থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে। তারপর একদিন দেখা গেলো হাসিবের তোতলামি ভালো হয়ে গেছে। স্বয়ং জিবরাইল (আ:) তাকে আশীর্বাদ করে গেছেন। হাসিব আজান দিলো। নামাজ পড়ালো। সারা এলাকায় এটা ছড়িয়ে পড়ে। বহু দূও দূরান্ত থেকে হাজার হাজার মানুষ তাদেও সমস্যা সমাধানের জন্য মৌলানার কাছে ছুটে আসতে থাকে। এতে দ্রুত সময়ে তাদের বহু আয়-রোজগার হতে থাকে। সাধারণ মানুষকে বোকা বানিয়ে তাদেও কাছ থেকে বহু অর্থ হাতিয়ে নিয়ে একদিন মৌলানা ও হাসিব গ্রাম থেকে উধাও হয়ে যায়। তাদেও ফেলে যাওয়া একটা ট্রাংকের তলায় প্রাপ্ত ঠিকানা থেকে জানতে পাওে হাসিব উদ্দিন ফকরুল টাইটেল পাশ করা মৌলানা। তারই কাছ থেকে প্রশংসাসূচক সার্টিফিকেট সংগ্রহ কওে মোস্তফা খান নিজের এলাকায় নির্বাচনী প্রচাওে কাজে লাগিয়েছে। মোস্তফা খান নিজের নির্বাচনী এলঅকায় না গিয়ে নিজের নকল দাড়ি লাগানো ছবি ও সার্টিফিকেট লোক মারফত এলাকায় বিতরণ করে, সাধারণ মানুষের চোখে ধর্মের নামে ধুলো দিয়ে হীনভাবে স্বার্থ উদ্ধার করার চেষ্টা করেছে। ‘ধর্মেও দোহাই জবর’ গল্পে দেখা যাচ্ছে এদেশীয় একশ্রেণির স্বার্থান্বেষীরা ব্রিটিশদেও নিকট থেকে সুবিধা আদায়ের জন্য অনেক হীনকাজ করতো। যে সব কাজে কোন মর্যাদা থাকতো না। ব্রিটিশরা সুবিধা প্রদানের নামে ভোগ-বিলাসে মত্ত হয়ে উঠতো। ইঞ্জিনিয়ার নাগসাহেব বৈষয়িক সুবিধা লাভের জন্য ম্যাজিস্ট্রেট এ্যান্টনী রিচার্ডসনকে খুশি করতে তিনি তার তিন কন্যাকে দিয়েছিলেন।
বড় মেয়ে মানসীরর সঙ্গে রিচার্ডসনের প্রণয় ও বিয়ে হয়। ম্যালেরিয়ায় মানসী মারা যায়। এর পরে দ্বিতীয় মেয়ে মাধবীর সঙ্গে রিচার্ডসনের প্রণয় গড়ে ওঠে। মাধবীর সঙ্গে রিচার্ডসনের বিয়ে সম্পন্ন করার জন্য তাকে আমন্ত্রণ জানালে সে কৌশলে ধর্মকে ব্যবহার করে ছোট মেয়ে মালতীকে বিয়ে করার কৌশল গ্রহণ করে। সে নাগসাহেবকে জানায়, মাধবী তাকে স্বপ্নে বলেছে, ‘আমার ছোট বোন মালতীর ভেতর আমার রিবার্থ হয়েছে। আমার সব ওম্যানহুড নিয়ে এখন আমি আমার বোনের আত্মার ভেতর আছি। তুমি ওকে বিয়ে কর। আমার কথা খেলাপ কর না। উপরি উপরি তিন দিন দেখলাম একই স্বপ্ন। স্বপ্নের ব্যাপাওে পৃথিবীর সব ধর্ম এক। কারণ ভবিষ্যদ্বাণী দৈববাণী।’ রিচার্ডসনের ধর্মীয় কৌশলে নাগসাহেব মালতীকে তার হাতে তুলে দেওয়া ছাড়া কোন গত্যন্তর থাকে না। বরং নাগসাহেব তাতে খুশিই হয়। কারণ রিচার্ডসন খুশি থাকলেই তার সুবিধা আদায় হবে সহজেই। সে কারণে মর্যাদাহীনভাবে সে নিজের তিনটা মেয়েকেই রিচার্ডসনের সন্তুষ্টির জন্য ব্যবহার করতে দিয়েছে। স্বার্থন্বেষী নাগসাহেবদের কাছে মর্যাদা নয় সুবিধালাভই বড়। যে কারণে সে অনায়াসে নিজের তিনটি মেয়েকেই রিচার্ডসনের মনোরঞ্জনের জন্য তুলে দিতে পেরেছিল। আর চতুর রিচার্ডসন তা পেতে সুকৌশলে ধর্মকে কাজে লাগিয়েছে। আমাদের সমাজে অহরহ দেখা যায় ধর্মকে ব্যবহার করে রুটি-রুজির জন্য নানা কূট-কৌশল গ্রহণের বিষয়। ‘দুই শরীক’ গল্পে দেখা যায় দরিদ্র মৌলানা সংসারে চালাতে অপারগ হয়ে মাজার-মসজিদের নামে দোহাই দিয়ে চাঁদা তুলছে। এখানে ধর্মভীরুতা নয়, চাঁদা তোলার মধ্যে দিয়ে আছে পরিবার-পরিজনের ক্ষুধা নিবারণের সমাধান। ‘প্রতিশোধ’ গল্পে হুজুর কেবলা সাধারণ মানুষকে রোগ-ব্যাধি থেকে ভালো করার জন্য সুস্থ পানি-পড়া দিয়ে টাকা গ্রহণ করে, সেই হুজুর কেবলাই নিজের ছেলের অসুখের সময় শহরে যায় ডাক্তার দেখাতে চিকিৎসার জন্য। পানিপড়াতে যে রোগ ভালেঅ হয় না তা হুজুর কেবলা ভালো করেই জানে। অথচ এই পানিপড়ার টাকাতেই সে ইমারত তৈরি করেছে। ধর্মকে একশ্রেণির হুজুররা ব্যবসার পুঁজি বানিয়ে সমাজে যেমন প্রভাবশালী হয়ে ওঠে, তেমনি অর্থশালীও হয়ে ওঠে।
১২.
শওকত ওসমানের গল্পে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা পরিলক্ষিত হয়। তাঁর উপন্যাসেও এটি আছে। সমকালীন কোন বিশেষ বিষয়কে সরাসরি না বলে তিনি প্রতীকী ব্যঞ্জনা বা রূপকের আশ্রয় গ্রগণ কওে সৃষ্টিশীলতায় অভিনবত্ব তৈরি করেছিলেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর বিশেষ দুটি উপন্যাসের নাম করা যেতে পারে-ক্রীতদাসের হাসি (১৯৬২) ও রাজা উপাখ্যান (১৩৭৭ ব.)। গল্পেও তিনি প্রতীকী ব্যঞ্জনা ও রূপকের আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। তাঁর এ ধরণের গল্পের মধ্যে বিগত কালের গল্প গ্রন্থের ‘চুহাচরিত’, পুরাতন খঞ্জর গ্রন্থের ‘অসংখ্য শিকড় দূর্বার’, ঈশ^রের প্রতিদ্বন্ধি গ্রন্থের নাম গল্প এবং রাজপুরুষ গ্রন্থের ‘আলিবাবা: লোকভাষ্য’ গল্পের উল্লেখ করা যেতে পারে।
‘চুহাচরিত’ গল্পের মাধ্যমে গান্ধীভক্ত ও ইসলামভক্ত-দুই ভক্ত-প্রতারকের প্রকৃত চেহারা উন্মোচিত হয়েছে। কিন্তু তা সরাসরি নয়। একটি চুহার জীবনচরিতের আড়ালে তাদের চরিত্রের মুখোশ খোলা হয়েছে। মূলত এ গল্পে তৎকালীন পাকিস্তানের দ্বিজাতিতত্ত্ব ও সুবিধাভোগী বণিকচরিত্রের কথা বলা হয়েছে। এ গল্পের কথক ছোট চুহা-সে অকৃতদার হিসেবে গল্পে বর্ণিত হয়েছে। তার প্রথম জীবনধারণের ব্যবস্থা করেছিল গুল্ফধারী একজন, মূলত এই গুল্ফধারী ছিল তার প্রথম প্রভু। কিন্তু পরবর্তীতে সে আবার নিজের মুখোশ পরিবর্তন করেছে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের স্বপ্নে মুসলিম লীগের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। মুসলিম লীগের যোগদানের পর পোশাক-পরিচ্ছদে পরিবর্তন এনেছে। প্যান্ট-পাজামা পরা শুরু করে। শীতের সময় ব্যবহার করে আচকান। চুহার সহোদর আর এক প্রভুর বাড়িতে থাকে। তার প্রভু গান্ধীভক্ত। গান্ধীর আদর্শ ধারণ করে সে নিরামিষভোজী জীবনযাপন করে। ধারণ করে অহিংসার বাণী। কিন্তু মাছ-মাংস খেতে তার কোন অরুচি বা আপত্তি নেই।
একসময় সময়ের পরিবর্তন হয়। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে চুহাদেও দুই ভাএয়রও পরিবর্তন হয়। কথক চুহা তার ছেলেমেয়েকে ইরেচি নার্সারি স্কুলে পড়ায়। এতে তার স্ত্রীর বাধা থাকলেও সে তা মানে নি। চুহা নিজে ইসলামী জীবননীতি মেনে চলে। কিন্তু জীবনবাস্তবতার কথা বিবেচনা করে সন্তানদের যুগোপযোগী আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে চেয়েছে। আবার সে বাহ্যিকভাবে ইসলামী জীবননীতি মেনে চললেও ভেতওে সে একজন স্বার্থলোভী ব্যক্তি। বৈষয়িক স্বার্থ উদ্ধারে সে হীনকাজের সঙ্গে যুক্ত। ১৯৪০ সালে দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের সময় যে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি হয়েছিল, সেই সময়ে কথক চুহা চাউলের মজুত কওে কৃত্রিম ভঅভাব সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। এতে বহু লোক খাদ্যেও অভাবে মৃত্যুবরণ করে। ম্যালেরিয়ার সময় কুইনাইন মজুত করেও কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করেছিল। আবার এই চুহা ডিস্ট্রিক বোর্ডেও নির্বাচনে জয়লাভের জন্য নঙ্গরখানা খুলেছিল। বৈষয়কি স্বার্থসিদ্ধিতে সে প্রচণ্ডরকমের ধূর্ত ও হিংস্র। মানুষের মৃত্যুও উপর দাঁড়িয়ে সে নিজের ফায়দা লুটে নিতে পারে। আবার গান্ধীভক্ত চুহার প্রভুও টাকার লোভে বিবেক-বোধ-লজ্জা সবকিছু জলাঞ্জলি দিয়েছে। স্টক কওে টাকার স্বপ্নে অঅত্মহারা হয়ে গেছে। অথচ বহু নারী কাপড়ের অভাবে ইজ্জত ঢাকতে পাওে নি। সেই লজ্জায় তারা আত্মহত্যা করেছে। মারী-মন্বন্তর সব কিছুতেই সে বৈষয়িক সুবিধা অর্জনে বিভোর থেকেছে। অন্যদিকে হাজার হাজার মানুষ মৃত্যুর শিকার হয়েছে। ক্ষুধা-দারিদ্র-মৃত্যু যন্ত্রণা তাদের বিবেককে বিন্দুমাত্র নড়াতে পারে নি। এরকম পরিস্থিতিতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হত্যা-খুন ধর্ষন শুরু হয় ব্যাপকভাবে। তখন নিজেদেও সুবিধার্থে ইসলামভক্ত ও গান্ধীভক্ত একাত্ম হয়ে যায়। একসঙ্গে চামড়ার ব্যবসাও শুরু করে। দেশবিভাগের পরে গান্ধীভক্ত ইসলামভক্তকে পরামর্শ দিয়েছে চট্টগ্রাম-ঢাকায় জমি কেনার। কারণ সেখানে নতুন শহর তৈরি হবে, জমির দাম অনেক বেড়ে যাবে। অবাক হওয়ার মতো ঘটনা, বাহ্যিকভাবে সাধারণ মানুষের কাছে তাদেও আলাদা চেহারা আলাদা নীতি আলাদা আদর্শ আলাদা ধর্ম থাকলেও বৈষয়িক স্বার্থসিদ্ধিতে তাদেও মধ্যে পৃথক কোন সত্ত্বা নেই। স্বার্থের ক্ষেত্রে সব এক। গান্ধীভক্ত মিলিটিারিতে মাছ-মাংসা সরবরাহ কওে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছে। আবার এই গান্ধীভক্তই ইসলামভক্তের সঙ্গে গোপনে চামড়ার ব্যবসা করেছে। তাদেও কাছে হিন্দু-মুসলমান দ্বিজাতিতত্ত্ব কোন সমস্যা নয়, শ্রেণিচরিত্র কোন সমস্যা নয়। স্বার্থের ক্ষেত্রে তারা এতোটাই অমানবিক ও লোভী যে, দাঙ্গা ও স্বাধীনতা তাদের অর্থ উপার্জনে নতুন কী ধরণের পথ তৈরি করতে পাওে, সে বিষয়েও দুজনে বুদ্ধি-পরামর্শ করেছে। এদের কাছে দেশ ও জাতি বড় নয়, দেশের মানুষ বড় নয়। নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থ সিদ্ধিই এই সব প্রভুদের কাছে মূল-তাদের এই মুখোশ ‘চুহাচরিত’ গল্পে উন্মোচন করেছেন।
‘ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্ধি’ গল্পে মূলত দ্বিতীয় স্বৈশাসকের ইচ্ছেকে প্রতীকীর মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। দ্বিতীয় স্বৈরশাসক কিভাবে নিজেকে সাধারণ মানুষের সারিতে নিজেকে নিয়ে আসার চেষ্টা করেছিল, এবং এই স্বৈরশাসক কিভাবে সাধারণ মানুষকে নিষ্পেষিত করেছিল, সেই ছবিটা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে মুরারি চরিত্রের ইচ্ছের ভেতর দিয়ে। জোর করে সাধারণ মানুষের মধ্যে নিজেকে যে একাত্ম করা যায় না, মুরারিও চেষ্টা করেছিল সাধারণ মানুষের মধ্যে অনধিকার প্রবেশের, পারেনি। এ জন্য তাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে রক্তাক্ত হতে হয়েছে, মরতে হয়েছে। দ্বিতীয় স্বৈশাসকও সাধারণ মানুষের মনে জায়গা কওে নিতে পাওে নি, শারীরিক-মানসিকভাবে তাকেও ক্ষত-বিক্ষত হতে হয়েছে, ইতিহাস সে স্বাক্ষ্য বহন করে। শওকত ওসমান মুরারির প্রতীকী চরিত্রের মাধ্যমে কঠিন এই বাস্তবতাকে চমৎকারভাবে তুলে ধরেছে। ‘অসংখ্য শিকড় দুর্বার’ গল্পে গ্যারেজে কয়েকটা ঘাস গজানোকে কেন্দ্র মিনহাজ চৌধুরী দারোয়ানকে অপমান করে। মদ পান করে কয়েকজনের মাতলামির কথা আছে। এসব কারণে একসময় চাকরি ছেড়ে দেয় দারোয়ান। একদিন বৃষ্টিতে লনে ধস নামে। মিনহাজ চৌধুরী অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন। লনে ধস নামায় তিনি অস্বস্তিবোধ করলেন। সেই অনুষ্ঠানে এসেছিলেন একজন ডাক্তার। মিনহাজ চৌধুরী লনে ধস নামায় বিমর্ষ হয়ে ওঠেন, অতিথিদের কাছে বিনয় প্রকাশ করতে থাকেন। মিনহাজ চৌধুরীর কাছ থেকে ব্যাপারটা জানতে চান কেন তিনি এতো বিনয় প্রকাশ করছেন, কেনইবা তিনি এতো বিমর্ষ। প্রকৃত ঘটনা জেনে ডাক্তার তাকে জানান, ঘাস কখনো কারো পোষ মানে না। ঘাসের অসংখ্য শেকড় থাকে। মাটি আর শেকড়ের সঙ্গে কখনো লড়াই করা চলে না। ঘাসের ভেতর দিয়েই দারোয়ানের স্বরূপ বোঝানো হয়েছে। তিনি ঘাসের প্রতীকীতে ইঙ্গিত দিয়ে বোঝাতে চেয়েছেন, দারোয়ানরা সামাজিক সম্মানে অনেক নিচু হতে পারে কিন্তু তাদের সততা মানবতা মহানুভবতা দায়িত্বের অনেক শেকড় আছে, সেগুলো নিজের থেকেই তাদের মধ্যে জন্ম নেয়, তার সঙ্গে জোর খাটানো চলে না। ‘আলিবাবা: লোকভাষ্য’ গল্পে আরব্য উপন্যাসের আলিবাবা ও কাশেমের ঘটনাকে কেন্দ্র করে, এ ঘটনার ভেতর দিয়ে আধুনিক জীবনের ও মননের ঐতিহাসিক চিরন্তন সত্যধারাকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস গ্রহণ করেছেন। আলিবাবা ও কাশেম যেভাবে যে পদ্ধতিতে ধনী হয়েছিল, তাদেও নির্মম মৃত্যুও একই পন্থায় একইভাবে ঘটেছে। এই ঘটনার ভেতর দিয়ে ঐতিহাসিক সত্যকে এভাবে তিনি গলে।প এভাবে নির্মিতি দিয়েছেন, যে বুর্জোয়া শ্রমিককে শোষণ কওে আরো বেশি ধনী হয়, ক্ষমতার মালিক হয়, একদিন সে-ও আরো বৃহৎ] পুঁজিপতি দ্বারা শোষিত হয়, নিঃশেষিত হয়। সত্তরের মাঝামাঝি থেকে বাংলাদেশের রাজনীতির আবহ পর্যালোচনা করলে বিশেষ কওে স্বৈরশাসকেরা যেভাবে ক্ষমতায় এসেছিল এবং যেভাবে তাদের নির্মম করুণ পরিণতি ঘটেছে, এ যেন আলিবাবা-কাশেমের উত্থান-পরিণতিরই বাস্তবতার রূপায়ণ। শওকত ওসমান প্রতীকী ও রূপকের আশ্রয়ে তাঁর সমকালের ভয়াবহ বহু ঘটনাকে অসামান্য শিল্প-ব্যঞ্জনায় উপস্থাপিত করে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন।
১৩.
শওকত ওসমান মানবপ্রবৃত্তির বিভিন্ন অনুষঙ্গ নিয়ে গল্প লিখেছেন।এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট কবি-গবেষক অনীক মাহমুদ বলেছেন-,‘সুকুমার বৃত্তিগুলোর মধ্যে প্রেম, স্বাজাত্যবোধ, দানশীলতা, আতিথেয়তা, মমত্ব, সহানুভূতি, কল্যাণবোধ ইত্যাদি প্রসঙ্গ শওকত ওসমানের গলে।পর উপজীব্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। প্রবৃত্তিগুলোর মধ্যে প্রেমের বিভিন্ন অবস্থা নিয়ে তিনি সবচেয়ে বেশি গল্প লিখেছেন।’ (মাহমুদ, বাংলা কথাসাহিত্যে শওকত ওসমান, ২০১৪: ২১৫) এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য গল্প- ‘প্রস্তর ফলক’, ‘মৎস’, ‘আনার কলি’, ‘কেপ্রাদে’, ‘দম্পতি’, ‘ওয়েটিং রুম’, ‘নিদয় নিদয়া’, ‘অনন্তবাসর’, ‘এবং তিন মির্জা’, ‘আজব শাস্তি’, ‘থেরিসন’, ‘একটি উপহার’, তস্কর সঙ্গীত’, ‘শরীকান’, ‘শেখজী’, ‘স্বজন-স্বজাতি’, ‘টুলেট’, ‘জমাখরচ’, ‘কাব্যফল’, ‘চিড়িমার’, ‘কারণ’, ‘পিতাপুত্র’ ও ‘সেলুন’ প্রভৃতি। ‘প্রস্তর ফলক’ গল্পে মূলত উচ্চারিত হয়েছে মানুষ প্রেমের জন্য যে কোন দুঃসাধ্য সাধন করতে পারে। প্রেম এমনই এক ব্যাপার যার জন্য মানুষ যে কোন ঝুঁকি গ্রহণের শক্তি রাখে। প্রেমের চিরায়ত এই শক্তিই মূলত এই গল্পে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ‘আনারকলি’ গল্পে আনারকলি ও যুবরাজ সেলিমের প্রেমের অনুষঙ্গ গ্রহণ করা হয়েছে। এ গল্পে প্রেম যে শ^াশত সৌন্দর্য-তাকে কখনো হত্যা করা যায় না, আনারকলি তাই ইমারতে অবরুদ্ধ হয়ে এ গল্পের কথককে বলতে পারে আমি সেলিমের প্রিয়তমা, কবি শিল্পী প্রেমিকের আরাধনা, জীবনের তপস্যা-আমি তাই আজও চক্ আনারকলি। আনারকলিকে যে হত্যা করেছে আকবর, তাকে তার মূর্খতা হিসেবে প্রতিপন্ন করেছে। এ গল্পে মূলত প্রেমের অমীয় শক্তিকেই বোঝানো হয়েছে, প্রেমকে আসলে হত্যা করা যায় না, সেই বারতা উচ্চারিত হয়েছে। ‘দম্পতি’ গল্পে স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য প্রেম নিয়ে রসিকতার প্রকাশ ঘটেছে। ‘নিদয় নিদয়া’ একটা ব্যর্থ প্রেমের গল্প। আজেলিয়া ও রোজেনা দুজনে বান্ধবী। দুজনেই বিধবা হয়। আজেলিয়া ও কামাল বিবাহপূর্ব অবস্থা থেকেই পাশাপাশি বাসায় বাস করার কারণে তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ পরিচয় ঘটে। কামাল তার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে। আজেলিয়ার মাধ্যমে রোজেনার সঙ্গেও কামালের পরিচয় হয়।
প্রথম দিকের উপন্যাস ‘জননী’ ও ছোটগল্প ‘সাবেক কাহিনী’ ও ‘সাদা ইমারত’-এর ভাষা সাধু। তবে তাঁর ব্যবহৃত সাধুভাষা সাবলীল গতিসম্পন্ন ও চিত্রকল্পময়। তিনি তাঁর বহু গল্পে বিভিন্ন অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষা ও উপভাষা প্রয়োগ করেছেন। তাঁর ভাষা বৈদগ্ধপূর্ণ, চেতনাপ্রবাহী ও অলঙ্কারসমৃদ্ধ।
আজেলিয়া ও রোজেনা-দুজনেরই বিয়ে হয়ে যায়। কামাল আজেলিয়াকে ভুলতে পারে না। আজেলিয়ার মাধ্যমেই কামালের সঙ্গে রোজেনার পরিচয় হয়েছিল। আজেলিয়া ও রোজেনা দুজনেই বিধবা হয়। আজেলিয়া তখন দুসন্তানের জননী। তারপরও তার সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের চেষ্টা করে কামাল। সে তার দুই সন্তানেরও দায়িত্ব গ্রহণ করতে চায়। কিন্তু আজেলিয়া তাতে সম্মত হয় না। একসময় কামাল আজেলিয়ার প্রেমে ব্যর্থ হয়ে মৃত্যবরণ করে। মৃত্যুর অঅগে সে আজেলিয়ার দু সন্তানের জন্য চার লক্ষ টাকা এবং রোজেনার জন্য পঞ্চাশ হাজার টাকার বীমা কওে রেখে যায়। কামালের মৃত্যুতে রোজেনা আহাজারি কর।ে সেই আহাজারির ভেতর স্পষ্ট হয়ে ওঠে রোজেনা কামালকে ভালোবাসতো। কিন্তু কখনো সে তা কামালের কাছে প্রকাশ করেনি। আর কামাল চেয়েছিল আজেলিয়াকে, সে তাকে পায় নি। রোজেনা নীরবে ভালোবেসেছিল কামালকে, সেও তাকে পায় নি। ‘নিদয় নিদয়া’ সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ প্রেমের গল্প। ‘একটি উপহার’ গল্পে পিপাসার্ত পিতা ব্যাগে কন্যার দেওয়া কমলালেবু পেয়ে অপত্য স্নেহে আবেগআপ্লুত হয়ে পড়ে। ‘তস্কও সঙ্গীত’ গল্পে চোরও যে মানুষ, তার মধ্যেও যে সহানুভূতি থাকতে পাওে, লেখক তা তুলে ধরেছেন। ‘পিতাপুত্র’ গল্পে অবসরপ্রাপ্ত পিতা হাসিব সম্পত্তি রক্ষর জন্য যে অবিশ^াস্য শঠতার আশ্রয় গ্রহণ করে, তা তার সন্তানদের শঠতাও হার মানে। স্বার্থের জন্য মানুষ ধর্মকে কিভাবে ব্যবহার করে তা এ গল্পে উঠে এসেছে। আমাদের সমাজে মানুষের চোখে ধোঁকা দিয়ে চাঁদাবাজি করা নতুন কিছু নয়। কিন্তু এই চাঁদাবাজি কত অভিনব ও কৌশলী হতে পারে লেখক ‘দুই সঙ্গী’ গল্পে তা দেখিয়েছেন। দুই ভাই নাজির ও হাবিব। বয়সে কিশোর। নাজির মৃত সেজে রাস্তায় পড়ে থাকে। আর হাবিব ভাইয়ের জন্য কান্নাকাটি কওে সাহায্য চায়। পথ-চলতি মানুষ হাবিবের বেদনার্ত অসহায়র্ত করুণ অবস্থা দেখে তাকে দয়াবশত সাহার্য করে। হাবিব যে কত নিপূণ কৌশলে প্রতারণা করে যাচ্ছে তা সাধারণ মানুষের কল্পনাতেও আসে না। শওকত ওসমান অসামান্য দক্ষতায় প্রতারণার এই চিত্র ‘দুই সঙ্গী’ গল্পে এঁকেছেন। তাঁর অসংখ্য গল্পে মানবপ্রবৃত্তির বহুরূপের চিত্র ধরা পড়েছে। তাঁর অসাধারণ একটি গল্প প্রস্তর ফলকের ‘দুই মুসাফির’। এ গল্পে দেখানো লালন ফকির স্বর্গবাসী বাউল। ধনী গৃহস্থ সোবহান জোয়ার্দ্দার। তিনিও স্বর্গবাসী। লালন ফকির ও সোবহান জেয়ার্দ্দার মর্তে আসেন বেড়াতে। সোবহান জোয়ার্দ্দারের বাড়িতে বর্তমানে বসবাস করেন সোলেমান মল্লিক। সোবহান জোয়ার্দ্দার আজ নিজের বাড়িতে অচেনা। তার কোন গুরুত্ব নেই, সম্মান নেই। নিজের বাড়িতেই অপরিচিত মানুষ, তার কোন অধিকার নেই। অথচ একসময় তার অর্থবিত্ত-ধন-সম্পদ সব ছিল। মর্ত্যরে কোন মানুষ আজ তাকে চেনে না, কোন কিছুতে আজ তার অধিকার নেই। অথচ লালন ফকিরের একসময় কিছুই ছিল না মর্ত্যরে পৃথিবীতে। আজ যখন সে মর্ত্যে বেড়াতে এসেছে, সবাই তাকে চেনে, সম্মান করে, তার আদর-আপ্যায়নে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। মানুষ যে তার সৃষ্টিশীল কর্মশীলতার মধ্য দিয়ে মৃত্যুর পরেও বেঁচে থাকেন, সেই সত্যকেই গল্পে উপস্থাপন করেছেন। একদিন যে ধনীব্যক্তিটির অর্থ-সম্পত্তি, প্রভাব প্রতিপত্তি সব ছিল, এখন তার সে সবের কিছুই নেই। আর একদিন বাউল লালন ফকিরের কিছুই ছিল না, শুধু গান ছিল, সেই গানই তাঁকে তাঁর মৃত্যুর পরেও অমর করে রেখেছে। অসামান্য গল্প ‘দুই মুসাফির’।
সমাজ-রাষ্ট্র-জীবনব্যবস্থা-ধর্মের অপব্যবহার-ভণ্ডামী, আর্থ-সামাজিক অবস্থা-রাজনৈতিক অবস্থা-মানবপ্রবৃত্তিসহ নানাবিধ বিষয় তিনি সার্থকভাবে ছোটগল্পের বিষয় করে অসামান্য দায়িত্বশীলতার পরিচয় রেখেছেন। আর একজন গল্পকার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন উচ্চমার্গীয় আসনে।
১৪.
শওকত ওসমান গল্পের বিষয়বৈচিত্রে যেমন বহুমাত্রিক ছিলেন, তেমনি গল্পের নির্মাণে ভাষাশৈলী ও রচনারীতিতে সতর্ক ও সচেতন ছিলেন। শিল্পমানে তিনি সবসময় হিসেবি ছিলেন। যে কারণে তাঁর গল্প শিল্পশৈলীতে বিশেষমাত্রা লাভ করতে পেরেছিল। তিনি নানাভাবে তাতে পরীক্ষা-নিরীক্ষাও চালিয়েছেন। তিনি প্রথম পর্যায়ের উপন্যাসে ও ছোটগল্পে সাধু ভাষা ব্যবহার করলেও পরবর্তীতে তা আর ব্যবহার করেন নি। প্রথম দিকের উপন্যাস ‘জননী’ ও ছোটগল্প ‘সাবেক কাহিনী’ ও ‘সাদা ইমারত’-এর ভাষা সাধু। তবে তাঁর ব্যবহৃত সাধুভাষা সাবলীল গতিসম্পন্ন ও চিত্রকল্পময়। তিনি তাঁর বহু গল্পে বিভিন্ন অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষা ও উপভাষা প্রয়োগ করেছেন। তাঁর ভাষা বৈদগ্ধপূর্ণ, চেতনাপ্রবাহী ও অলঙ্কারসমৃদ্ধ। তিনি কাহিনীর প্রয়োজনে ভাষাকে চমৎকারভাবে প্রয়োগ করতে পারেন। তাঁর ভাষাপ্রয়োগ সম্পর্কে উল্লেখ করা যেতে পারে-
‘শওকত ওসমানের যে বৈশিষ্ট্য আমাকে বিশেষভাবে আকর্ষণ করে এবং মুগ্ধও করে তাহল তাঁর গল্পে (কখনও বা উপন্যাসের সংলাপে) বুদ্ধিদীপ্ত বাককুশলতা যা বিদ্যুৎ বিভার চরিত্র নিয়ে প্রকাশ পায়। ‘উইট’ শব্দটির লাগসই এবং পছন্দমত প্রতিশব্দ অভিধানে মেলে না, তাই মূল শব্দেই বলি এই ‘উইট’ এর ব্যবহারে আমাদের সাহিত্যিকদের মধ্যে শওকত ওসমানের তুলনা বিরল, প্রায় নেই বললেই চলে। এখানে তিনি প্রতিদ্বন্ধীহীন বলা যেতে পারে।’ (আহমদ, ‘শওকত ওসমান: নাগরিক মননশীলতায় ধীমান, সরকার আশরাফ সম্পাদিত, পৃ. ৮২-৮৩)
এ প্রসঙ্গে একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে- ‘পশুর নিকট উলঙ্গ থাকতে মানুষের কোন লজ্জা থাকার কথা নয়। এক পশু বেমালুম ন্যাংটো থাকে অন্য পশু সমীপে।’ মনিব ও তাহার কুকুর, ‘মনিব ও তাহার কুকুর’) তাঁর গল্পে অলঙ্কারের প্রচুর ব্যবহার আছে। দু একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। উপমা: ক. ব্রাদার জনের মত চিজকে ব্যাখ্যা করতে গেলে অনেক বয়ান প্রয়োজন। (সৌদামিনী মালো) খ. শীতার্ত বৃদ্ধের দাঁতের মতো ডিঙির পায়ে লগীর ঠকঠক শব্দ। (‘নতুন জন্ম’, জুনু আপা ও অন্যান্য গল্প) গ. গম্ভীর, চওড়া চোয়াল, দুটো হাঁপরের ক্যপের মতো গালপট্টিতে জুড়ে আছে। (‘তিন পাপী’, সাবেক কাহিনী) রূপক: ক. আকাশ সূর্য তখন দোজখের পিণ্ড বললেই চলে। (সৌদামিনি মালো) খ. রৌদ্রের ঢেউ দূর দূর থেকে এই ছায়াময়তার প্রাণ সজীব করে তুলেছে। ‘ওদিকে যেতে চাই’, নির্বাচিত গল্প) গ. ধর্মের কল বাতাসে নড়ছিল। (‘সৌদামিনী মালো’) উৎপ্রেক্ষা ক. সুঠাম শরীরে তার গম্ভীরমূর্তি মনে হোত, যেন কাজল পয়স্বিনীভরা শ্রাবণের আকাশ শুধু অশ্রুবর্ষণের প্রতীক্ষায় রয়েছে। ‘জুনু আপা’, জুনু আপা ও অন্যান্য গল্প’ ) খ. ব্রাদার জন মুখ খুললে, যেন গির্জার পুলপিট অর্থাৎ প্রচারবেদি থেকে সার্মান দিচ্ছে এমনই কণ্ঠস্বর। (‘সৌদামিনী মালো’) অনুপ্রাস: ক. ধাপে ধাপে পা ফেলতে ফেলতে নাসির উচ্চারণ করে, আরে তুমি চিনবে না।’ (‘সৌদামিনী মালো’) খ. আমার কোর্টে কেরোসিন ব্ল্যাকমার্কেটের দায়ে অভিযুক্ত। (‘সৌদামিনী মালো’) গ. বেচারা বর সাজার অবসর পায় নি। (‘সৌদামিনী মালো’) লৌকিক আমেজমিশ্রিত শব্দাবলির ব্যবহার: ক. বেড়ার মধ্যে গেরস্থেও মুরগি দেখলে জিভে জল-সরা শেয়াল যেমন ঘন ঘন তাকায় আর লোভের চোটে ছটাফট কওে, মনোরঞ্জন মালো সেই রকম অবস্থায় নতুন পাঁয়তারা ভাঁজতে লাগল। (‘সৌদামিনী মালো’) খ. দুধেল দুটো গাই হারিয়ে গেল। ( ‘সৌদামিনী মালো’)
শওকত ওসমান তাঁর গল্পে যে ভাষারীতির প্রয়োগ করেছেন, তা অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে তাঁর স্বকীয় ধারায় পরিণত হয়েছে। বিষয়ের ক্ষেত্রে তিনি যেমন বহুবিচিত্র বিষয়ে আচ্ছন্ন থেকেছেন, প্রগতিশীল বিশ^াসবোথে অটল থেকে সাহিত্যচর্চায় তা আগর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন, তেমনি রচনাশৈলীতেও নিজস্ব একটা স্টাইল তিনি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। শওকত ওসমানের সাহিত্যকর্ম মূল্যায়নে খ্যাতিমান কবি-গবেষক অনীক মাহমুদের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য-,
‘আজকের বাংলাদেশে আদর্শেও দিক থেকে, চেতনার দিক থেকে এবং শৈল্পিক অনুধ্যানের দিক থেকে তাঁর প্রভাব লক্ষ করা যায় নবীন কথাসাহিত্যিকদেও মধ্যে। প্রগতিশীল সমাজমনস্কতায় সমকালীন লেখক আবু রুশদ, আবু জাফর শামসুদ্দীন, কাজী আফসার উদ্দিন, শামসুদ্দীন আবুল কালঅম, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ প্রমুখের মধ্যে আদর্শের দিক থেকে কেবল আবু জাফর শামসুদ্দীনের সঙ্গে তাঁর সাদৃশ্য পাওয়া যাবে। অন্যদিকে ধর্মীয় গোঁড়ামি ও সংস্কার বিরোধিতায় শওকত ওসমান সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর সগোত্রীয়। বলা যায়, লেখায় বিশেষত কথাসাহিত্যে যে ধর্মান্ধতার বিচিত্র রূপের অঙ্কন করেছেন, প্রবন্ধে আরও বলিষ্ঠভাবে, আরও স্পণ।টভাবে তাঁর বিরূপমানসিকতার প্রকাশ ঘটেছে। সেক্ষেত্রে ওয়ালীউল্লাহর ধর্মীয় শোষণ-ভণ্ডামি বিরূপতার চেয়ে শওকত ওসমানকে বর্তমানে তীক্ষè ওসরব মনে হয়। পঞ্চাশের শেষ ও ষাটের দশক থেকে সমাজবাদী সাহিত্যচর্চায় পূর্ববাংলায় যাঁরা ধীওে ধীওে উচ্চকণ্ঠ হয়ে উঠেছেন, তাঁদেও মধ্যে শওকত আলী, হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস উল্লেখযোগ্য। এঁদেও অনেকের মধ্যেই শওকত ওসমানের প্রভাব লক্ষ করা যায়। ষিল্পকৃতিতে প্রত্যক্ষ প্রভাব অন্বেষণ কওে বের করা হয়তো কষ্টসাধ্য হবে, তবে মননধর্মীতায় অবশ্যই প্রভাব পাওয়া যাবে। অন্তত তাঁরা স্বীকার করবেন যে, মুসলিম রচিত বাংলা কথাসাহিত্যে সমাজবাদী মানসিকতার একটি পরিসর ও পরিবেশ গড়ে উঠেছিল। সেই গড়ে ওঠা প্রস্তুতি-সম্পন্ন পরিবেশে তাঁরা সাহিত্যিক যাত্রা শুরু করেছিলেন। আর এই পরিবেশসৃজনে শওকত ওসমান অগ্রণী ছিলেন। (মাহমুদ, বাংলা কথাসাহিত্যে শওকত ওসমান, ২০১৪: ২৫৪)
১৫.
শওকত ওসমান বাংলা ছোটগল্পে অপরিহার্য ও অনিবার্য নাম। বাংলা ছোটগল্পকে নানা উপাচার সমৃদ্ধ করেছেন তিনি। নিজস্ব সৃষ্টিশীলতার শক্তিতে বাংলা ছোটগল্পে তিনি প্রতিষ্ঠিত করেছেন নিজের স্থায়ী আসন। রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে যাঁদের সৃষ্টিশীলতায় বাংলা ছোটগল্প বিচ্ছূরণ দিগন্তপ্রসারী হয়ে ক্রমশ বিকাশের উজ্জ্বল ধারায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেখানে প্রভাবসঞ্চারী ঋদ্ধ ব্যক্তিত্ব হিসেবে শওকত ওসমান বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
সহায়ক গ্রন্থ ও পত্র-পত্রিকা:
অনীক মাহমুদ, বাংলা কথাসাহিত্যে শওকত ওসমান, সূচয়নী পাবলিশার্স, ঢাকা, দ্বিতীয় সংস্করণ, ২০১৪।
আবদুর রহিম গাজী, ‘রবীন্দ্র ছোটগল্পে পারিবারিক সম্পর্কের চালচিত্র’,অরণিকা, ১৫ নভেম্বর, ২০১৪)।
আহমদ রফিক, ‘নাগরিক মননশীলতার ধীমান’, সরকার আশরাফ (সম্পাদিত), নিসর্গ, ৬ষ্ঠ বর্র্ষ, ১ম সংখ্যা, ১৩৯৭)
বাপ্পা ঘোষ, ‘বস্ত্র সংকটের গল্প, আবরণ, দুঃশাসন, শিল্পী’, ‘পরবাস’ সংখ্যা-৭৫, ৩০ জুন ২০১৯)
মলয় বসু, ‘অক্টোবর বিপ্লব ও আধুনিক বাংলা সাহিত্য’, কে-পি বাগচী অ্যান্ড কোম্পানি, কলকাতা, ১৯৮৯।
যতীন সরকার, ‘ইতিহাসসচেতন শওকত ওসমান’, সরকার আশরাফ (সম্পাদিত), ‘নিসর্গ’, বগুড়া, ৬ বর্ষ,১ম সংখ্যা, ১৩৯৭ )
রমেশচন্দ্র মজুমদার, বাংলাদেশের ইতিহাস, তৃ-খ, জেনারেল প্রিন্টার্স এ্যান্ড পাবলিশার্স প্রা. লি., কলকাতা, ১৯৮১।
রকিবুল হাসান, আকবর হোসেনের কথাসাহিত্য, রূপলোক ও শিল্পসিদ্ধি, অক্ষর প্রকাশনী, ঢাকা, ২০১৩।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ঊপনিবেশিকতা বনাম সংস্কৃতি-সংগ্রাম, যুগান্তর ঈদসংখ্যা ২০২৩।
শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, পঞ্চাশের মন্বন্তর, বেঙ্গল পাবলিশার্স, কলকাতা, ১৩৫০ব.।
স্মৃতিচারণ: ফেরদৌস হাসান, আকবর হোসেন তনয়, লেখকের বাসভবন, ১৮, উত্তর কমলাপুর, ২৯.০১.১৯৯৫)
হুমায়ুন আজাদ, ‘কথাসাহিত্যের পথিকৃত শওকত ওসমান’, ‘রোববার’, ঢাকা, ৭ম বর্ষ, ২৯শ সংখ্যা, ২১ শে এপ্রিল, ১৯৮৫, পৃ. ৩১।