বাঙালি জাতি উৎসবমুখর। বারো মাসে তের পার্বণের অতিথিপরায়ণ, সংবেদনশীল ও মিশুক জাতি হিসেবে বাঙালির সুনাম রয়েছে। বাঙালি জাতি অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধারক। যে কারণে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালির যেকোনো উৎসবে মানুষের ঢল নামে। বিভিন্ন ধর্ম ও গোত্র-সম্প্রদায়ের মানুষ একত্রিত হয়ে ধর্মীয় উৎসব থেকে শুরু করে পারিবারিক আচার-অনুষ্ঠান, জাতীয় উৎসবে যোগ দেয়। আর সবার অংশগ্রহণে এসব অনুষ্ঠান প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে।
বছরের নানা সময়ে বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে উৎসবকেন্দ্রিক ‘মেলা’ অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে দীর্ঘদিন। ‘মেলা’ বাঙালির লোক-ঐতিহ্যের অন্যতম একটি অনুষঙ্গ হলেও নির্দিষ্ট কিছু মেলা জাতির কৃষ্টি ও সংস্কৃতির অন্যতম ধারক ও বাহক হয়ে উঠেছে। বাঙালির লোকসংস্কৃতির মেলার মধ্যে প্রথমেই আসে ‘বৈশাখী মেলা’র নাম। বাংলার বিভিন্ন জনপদে বৈশাখী মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে সুদীর্ঘকাল থেকে।
বাংলায় প্রথম মেলার প্রচলন কবে, কোথায় হয়েছিল তা জানা না গেলেও মেলা যে আবহমান বাংলার এক প্রাচীন ঐতিহ্য-এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। গবেষকরা মনে করেন, ‘গ্রামীণ হাট’-ই মেলার আদিরূপ। অতীতে রাজা-জমিদারেরা মেলার আয়োজন এবং পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। সাধারণত ধর্মীয় উৎসব ঘিরেই মেলা বসত তৎকালীন সময়ে। আর এখন মেলার সেই রূপ পরিবর্তিত হয়েছে। এখন শুধু ধর্মীয় উৎসবই নয়, মেলা বসে বাঙালির সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের বিভিন্ন অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে। ধর্মীয় চেতনার বাইরে অন্যান্য সামাজিক বা লৌকিক আচারও যুক্ত হয় মেলার সঙ্গে। বাঙালির মেলার যেমন রকমফের রয়েছে তেমনিভাবে মেলার চারিত্র্যও পৃথক। তবে এসব মেলার সঙ্গে যে বাঙালির নাড়ির যোগসূত্র রয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশে প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে নানা মেলা। এসব মেলার পৃথক চারিত্র্যও রয়েছে। কয়েকটি মেলার চিত্র তুলে ধরলেই এটি স্পষ্ট হতে পারে।
বৈশাখী মেলা
বৈশাখের সঙ্গে বাংলা ভাষার মানুষের বিশ্বাস এবং অভ্যাস জড়িয়ে রয়েছে। রয়েছে নানাবিধ সংস্কার। পহেলা বৈশাখ যেমন একদিকে বাঙালির হৃদয়ে নতুন উদ্দীপনা জাগিয়ে তোলে অন্যদিকে ‘ভূমিহীন’ অর্থাৎ বর্গাচাষীদের জন্য এ দিনটি কিছুটা হলেও যন্ত্রণাদায়ক। আগে বছরের প্রথম দিনটিতে সম্পাদিত হতো জমিদারের রাজস্বের হিসেব। প্রজারা বকেয়া খাজনা পরিশোধ করে মিষ্টি খেয়ে যেত। ব্যবসায়ীরা লাভক্ষতির হিসাবের পুরনো খাতার পালা চুকিয়ে নতুন খাতার সূচনা করতো। যার নাম হালখাতা। ‘হাল’ মানে তো নতুন বা চলতি, তাই নতুন হিসেব সংরক্ষণের অনুষ্ঠানরূপেও গণ্য হতো বছরের প্রথমদিনটি। ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানে সিঁদূরচর্চিত আম্রপল্লব শোভিত মঙ্গলঘট স্থাপন করে আত্মীয়-বন্ধু, খাতক, মহাজনদের মিষ্টিমুখ করানো হতো। এভাবে লৌকিক সামাজিকতার নবায়ন হতো। এ অবশ্য বাঙালির অতীত ইতিহাস। সে সময় ‘আমানি উৎসব’ অর্থাৎ পান্তাভাত খেয়ে মাঠে যাবার প্রথাটি পহেলা বৈশাখের অঙ্গীভূত বলে বিবেচনা করতো ভূমিজীবী মানুষ। গ্রামের বধূরা বর্ণবৈচিত্র্যময় নতুন শাড়িটি অঙ্গে জড়িয়ে উৎফুল্ল হতো। বর্তমান সময়ে এসে এই সমাজে যে বহুবর্ণিল নববর্ষ উৎসব উদযাপন তা অতীতে গ্রাম্য বধূদের সাজ পোশাকের সেই বিশেষত্বটিই যেন ধরা পড়ে। তাছাড়া বিগত দিনে লোকসংস্কৃতি-আশ্রয়ী যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদি পরিবেশন করা হতো সে সবই এখন ‘আধুনিক ফর্মে’ পরিবেশিত হচ্ছে। বলা যেতে পারে, বাঙালির প্রকৃত জীবনেতিহাস অতীতের সঙ্গেই নিবিড় ও অবিচ্ছেদ্য। যে কারণে বাঙালির আত্মানুসন্ধানের জন্য ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতির উৎসবের স্মরণাপন্ন হতে হয়।
বৈশাখের যে লৌকিকতা তা শুরু হয় পরিবার থেকে। আত্মীয়, বন্ধু, ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবেশি সুহৃদজনকে শুভেচ্ছা জানানো ও কুশল বিনিময় চলে ছোট-বড়োদের মধ্যে। নববর্ষ উপলক্ষে আয়োজিত বৈশাখী মেলায় বহু মানুষের সমাগম হয়। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষ মহামিলনের ক্ষেত্র এই মেলা। বছর শুরুর আগের দিন বসে চৈত্রসংক্রান্তির মেলা, পরবর্তীকালে নববর্ষ-উৎসবের সঙ্গে এ মেলা একীভূত হয়ে যায়। শিশুকিশোরেরা চড়কি, নাগরদোলা, বাঁশি, তালপাতার সেপাই—এসবের আনন্দে মেতে উঠতো মেলায় গিয়ে। কিশোরীরা ব্যস্ত হতো চুড়ি, ফিতে, চুলের ক্লিপ, আলতা, কাজল ইত্যাদি কেনার জন্য। তাদের মেলায় নিয়ে আসা অভিভাবকদের ওপর বাড়ির গৃহিণীদের ফরমাইশ থাকতো—দা, বঁটি, চালুনি, কুলো, টুকরি ইত্যাদি গৃহস্থালিকর্মের প্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনে আনার। বাড়িঘরে ভালোমন্দ খাওয়াদাওয়া, কেনাকাটা, শুভেচ্ছা বিনিময়ের মধ্যদিয়ে পূর্ণ আনন্দের সঙ্গে দিনটিকে অতিবাহিত করার মধ্যে নিহিত থাকতো সারাটি বছর শুভ হোক এই প্রত্যয় এবং বিশ্বাস। মূলত এসব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বাঙালি ঐতিহ্যের উন্মেষ ঘটে অতীত থেকে। বিবর্তিত জীবনধারায় লৌকিক এ ধারাটি এখনো প্রবহমান। আর এসব কর্মকাণ্ডের মধ্যেই বাঙালির আত্মপরিচয়ের মূলমন্ত্র নিহিত।
মাছের মেলা
নামকরণের মধ্যেই নিহিত রয়েছে এ মেলার বৈশিষ্ট্য। মাছের মেলা বলতেই বোঝা যায় হরেক রকম মাছের এক বিশাল সমারোহ। মজার ব্যাপার হলো মাছের এরকম একটা মেলা বহুকাল ধরে হয়ে আসছে। বগুড়া জেলার ইছামতি নদীর তীরে পোড়াদহ নামক স্থানে প্রতিবছর বসে এই মেলা। জনশ্রুতি রয়েছে, চারশত বছর পূর্বে মরা বাঙালি নদীর জলে প্রতি বছর মাঘের শেষ বুধবারে অলৌকিকভাবে এক বিশাল কাতলমাছ (মতান্তরে অন্য কোনো মাছ) জেগে ওঠে এবং তার পিঠে সোনার ঝুড়ির মতো একটি বস্তু দেখা যায়। এরপর থেকে প্রতিবছর এই দৃশ্য দেখার জন্য গ্রামবাসীরা জড়ো হতে থাকে। এসময় এক সন্ন্যাসীর আবির্ভাব ঘটে এই মেলা সংগঠনের স্থানে প্রাচীন এক বটগাছের নিচে। যিনি এই মাছের নিকট অর্ঘ্য নিবেদন করেন। একসময় এখানে আশ্রম গড়ে ওঠে। সন্ন্যাসী পূজার আবির্ভাব হয়। এসময় ধীরে ধীরে লোক সমাগম বাড়তে থাকে যার ফলে একসময় এই মেলার গোড়াপত্তন হয়।
মেলার অন্যতম আকর্ষণ বিভিন্ন প্রজাতির বৃহদাকৃতির মাছ। নদীর বড় বড় বাঘাইর, আইড়, বোয়াল, কাতলা, পাঙ্গাস, সামুদ্রিক টুনা, ম্যাকরেল ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেচা-কেনা হয়। এছাড়া মাছ সম্পর্কিত বিভিন্ন দ্রব্য,ঘরবাড়ির জিনিসপত্র, আসবাবপত্র, বাঁশ ও বেতের জিনিস, নানা জাতের মাছের আকৃতির বিশাল মিষ্টি বিক্রি হয়। আয়োজন থাকে সার্কাস, নাগরদোলা ও পালাগানেরও।
গুড় পুকুরের মেলা
গুড় পুকুরের মেলা অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সর্বশেষ জেলা সাতক্ষীরা জেলায়। মনসা ও বিশ্বকর্মা পূজা উপলক্ষে ভাদ্রমাসে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে এ মেলা। ঐতিহ্যগতভাবে বছরের পর বছর পালিত হয়ে আসছে এই মেলাটি। গুড় পুকুর মেলায় অংশ নিতে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা এবং কলকাতাসহ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সাতক্ষীরায় লোক সমাগম ঘটে। বাঙালির নিত্য প্রয়োজনীয় এমন কোনো লোকজ দ্রব্য নেই, যা এই মেলায় বিক্রি হতে দেখা যায় না। হাড়ি-পাতিল, দা-খুন্তা-কোদাল, গাছ-গাছালি, আসবাবপত্র, ঘর গৃহস্থালির জিনিসপত্র, পোড়া মাটি ও চীনা মাটির তৈজসপত্র, অরনামেন্টস, দেশি-বিদেশি পোশাক-পরিচ্ছেদ, খেলনা, মাটি, লোহা, তামা, পিতল, স্টিল, কাচ, কাঠ, বাঁশ ও বেতের জিনিস, প্রসাধনী, ঘর সাজানোর দ্রব্যাদি থেকে শুরু করে সব কিছুই পাওয়া যায় এই মেলায়।
ক্রয়-বিক্রয় ছাড়াও নাগরদোলা, পুতুল নাচ, সার্কাস, যাত্রা, অপেরা, যাদু ইত্যাদির আয়োজন করা হয়ে থাকে বিনোদনের জন্য। গুড় পুকুর মেলাটি মূলত হিন্দুদের উৎসব বা মেলা ছিল। জনশ্রুতি রয়েছে বাংলা ১০৭০ সালের দিকে সর্বপ্রথম এই মেলার সূচনা হয়। তবে কালের পরিক্রমায় এটি সব ধর্মের মানুষের প্রাণের মেলায় রূপান্তরিত হয়। তবে কে বা কারা মেলাটির শুরু করেছিলেন তার কোনো ঐতিহাসিক দলিল পাওয়া যায় না। মেলা স্থলে একটি পুকুর রয়েছে আর ওই পুকুরটির নাম গুড় পুকুর। গুড় পুকুর নামকরণের ক্ষেত্রে অভিমত রয়েছে, পুকুরে মনসা পূজার বাতাসা ফেলা হতো আর ঐ বাতাসার জন্য পুকুরের পানি মিষ্টি লাগতো বলেই এ ধরনের নামকরণ হয়েছে। আবার কারো কারো মতে, এই পুকুরে বেশি দিন পানি থাকতো না। পরে কে বা কারা স্বপ্নে দেখেন পুকুরে ১০০ ভাঁড় গুড় ঢালতে হবে তাহলে পুকুর পানিতে ভরে উঠবে। স্বপ্ন অনুযায়ী পুকুরে ১০০ ভাঁড় গুড় ঢালা হয় ফলে পুকুর পানিতে ভরে ওঠে। আর তখন থেকেই এই পুকুরের নাম হয় গুড় পুকুর। আবার কেউ বলেন, এক সময় এই পুকুরের তলদেশ থেকে মিষ্টি পানি উঠতো, আর সে জন্যেই এই পুকুরের নাম এমনটি হয়েছে। তবে ঐতিহাসিক আবদুস সোবহান খান চৌধুরীর মতে, সাতক্ষীরার চৌধুরী পাড়ার রায় চৌধুরীরা গৌরবর্ণের ব্রাহ্মণ ছিলেন। তাই তাদের পুকুরকে বলা হতো গৌরদের পুকুর। সেই ‘গৌরদের পুকুর’ কথাটি এক সময় বিবর্তন হয়ে দাঁড়ায় ‘গুড় পুকুর’।
রথের মেলা
‘রথের মেলা’ সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় মেলা। পুরাণ অনুযায়ী জগন্নাথ দেবের রথযাত্রাকে স্মরণ করে প্রতিবছর এদেশের সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বহু স্থানে এ ধরনের রথযাত্রার মেলা করে থাকে। বাংলা সনের আষাঢ় মাসে তিথি-নক্ষত্র অনুযায়ী এই মেলার তারিখ নির্দিষ্ট হয়ে থাকে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে দুই দিন জগন্নাথ তেবের পূজা অনুষ্ঠিত হয়। আর এ উপলক্ষে মেলা চলে এক সপ্তাহ। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় রথযাত্রা উপলক্ষে মেলা হলেও সাভারের ধামারাইয়ের রথের মেলা প্রসিদ্ধ। কুষ্টিয়া শহরের রথখোলার মেলা, রাজশাহী জেলার পুঠিয়ার রথের মেলা, সিলেটের জৈন্তপুরের লামাপাড়া রথযাত্রার মেলা, গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের রথযাত্রার মেলা, ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জের রথযাত্রার মেলা, ঢাকা তাঁতীবাজার ও রাধাগোবিন্দ মন্দিরের উল্টোরথ মেলা, কুমিল্লার জাহাপুর মুরাদনগরের উল্টোরথ মেলা, মাগুরার সাতদোহা রথমেলা, ফেনীর ট্রাঙ্করোডের উল্টোরথ মেলা এবং গাইবান্ধার কালিবাড়ির উল্টোরথ মেলাও বেশ প্রসিদ্ধ। রথের মেলাতে মৃৎশিল্প, বাঁশ-বেত-কাঠ শিল্পসহ মেয়েদের বিবিধ প্রসাধন সামগ্রী, মণ্ডা-মিঠাই, মৌসুমী ফলমূল বেচাকেনার পাশাপাশি থাকে সার্কাস, নাগরদোলা, পুতুল নাচের আয়োজন।
রাস মেলা
শ্রীকৃষ্ণ ও রাধিকার গোপন অভিসার থেকে রাস মেলার উদ্ভব। আবার কেউ কেউ মনে করেন, শ্রীকৃষ্ণ শত বছর আগে কার্তিকের পূর্ণিমা রাতে পাপমোচন ও পুণ্যলাভের আশায় গঙ্গাস্নানের জন্য স্বপ্নে আদেশ পান। তখন থেকেই এ মেলার শুরু। জনশ্রুতি যাই হোক, প্রতি বছর কার্তিক মাসের পূর্ণিমা তিথির রাতে অনুষ্ঠিত হয় রাস মেলা। সুন্দরবনের দুবলার চরে অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশের বৃহত্তম রাস উৎসব। অসংখ্য সনাতন ধর্মাবলম্বী অংশ নেন এ উৎসবে। আর উৎসব উপলক্ষে অনুষ্ঠিত হয় মেলা। সুন্দরবন ছাড়াও দিনাজপুরের কাহারোল উপজেলার কান্তজিউ মন্দির প্রাঙ্গণে মাসব্যাপী রাস মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে দীর্ঘদিন।
সনাতনধর্মীরা সুন্দরবন সংলগ্ন দুবলার চরে সমবেত হয়ে প্রার্থনা করেন। যখন সূর্যোদয়ের পর প্রথম জোয়ার আসে তখন সেই জল স্পর্শ করার সঙ্গে-সঙ্গে পুণ্যার্থীরা সাগরে স্নান করেন। তাদের মতে এতে তাদের পাপ মুছে সাগরে মিশে যায় এবং তারা পুণ্যবান হন। সকালে পূজার মধ্য দিয়ে শুরু হয়ে সারাদিন মেলা ও নানা অনুষ্ঠান চলে। রাতে ওড়ানো হয় ফানুস। পরদিন স্নানের মধ্য দিয়ে এই মেলার ইতি টানা হয়। এছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে রাস উৎসব উপলক্ষে অনুষ্ঠিত হয় পালাকীর্তন। আর মেলায় আসে লোকজ উপকরণাদি। থাকে গ্রামীণ বিনোদনের ব্যবস্থা।
বিষুব সংক্রান্তির মেলা
বাংলা বছরের শেষ দুদিন এবং পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে ধুমধামের সঙ্গে সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামে বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের যে উৎসব উদযাপিত হয় তারমধ্যে সবচেয়ে বড় উৎসব ও মেলার নাম হচ্ছে- ‘বৈসাবি’। পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন মুখ্য আদিবাসীগোষ্ঠী- চাকমা, ত্রিপুরা ও মারমাদের মধ্যে এ উৎসব পরিচিত যথাক্রমে বৈসুক, সাংগ্রাইন ও বিজু নামে, যাদের আদ্যক্ষর নিয়েই এ উৎসবকে ‘বৈসাবি’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। ‘ফুল বিজু’, ‘মূল বিজু’ এবং ‘গোর্য্যাপর্য্যার দিন’ মিলে মোট তিন দিন চলে চাকমাদের বিজু উৎসব ও মেলা। ছেলেমেয়েরা সবাই মিলে প্রতিবেশীদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে ঘুরে ঘুরে বিজু খেয়ে থাকে। প্রতিবেশীদের বাড়িতে ঘুরতে এদিন কোনো দাওয়াতের প্রয়োজন হয় না। প্রতি বাড়িতে পাজনসহ খাবারের বিভিন্ন আয়োজন থাকে। সম্ভবত পাঁচ অন্ন (পাঁচন) শব্দ থেকেই পাজন শব্দের উৎপত্তি। ন্যূনতম পাঁচ পদের সবজির সংমিশ্রণে রান্না করা তরকারিকে পাজন বলা হয়। এছাড়া থাকে পিঠা, পায়েস, সেমাই, শরবত ইত্যাদি নানা ধরণের খাবার ও পানীয়। পাজনের সঙ্গে প্রাপ্তবয়স্কদের আপ্যায়ন করা হয় ঘরে তৈরি মদ দিয়ে।
চড়ক মেলা
ধর্মীয় বিশ্বাস নবায়ন এবং গ্রামীণ জীবনে নির্মল আনন্দের জন্য বাংলা সনের চৈত্র মাসের শেষ থেকে বৈশাখের ২/৩ তারিখ পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে চড়ক পূজা। চড়ক পূজায় শিবের অনুসারী ভক্তরা পিঠে বড়শি গেঁখে একটি বিশেষ গাছে ঝুলে ঝুলে চরকির মতো ঘুরতে থাকে। চড়কগাছটি প্রায় ৪৫ ফুট লম্বা, মাথায় বাঁশ বেঁধে ৪টি কোণা বা চরকি করা হয়। চরকির চারপাশে চারটি দড়ি বাঁধা হয়। দড়ির সঙ্গে কাপড় বেঁধে বিশেষ কায়দায় ৪ জনের পিঠে বড়শি বাঁধা হয়। এর পর শুরু হয় চরকি ঘুরানোর কাজ। ২৫-৩০ জন যুবক বাদ্যের তালে তালে নিচ থেকে চরকির সঙ্গে বাঁধা দড়ি বল প্রয়োগ করে ৪ জনকে শূন্যে ঘোরাতে থাকে। এভাবেই প্রায় ১০-১৫ মিনিট করে পর্যায়ক্রমে ৩ বার মোট ১২ জনকে চড়কগাছে ঘোরানোর পর এই পর্ব শেষ হয়। আর চড়ক পূজা উপলক্ষে পূজা প্রাঙ্গণে বসে সপ্তাহব্যাপী মেলা।
বলার অপেক্ষা রাখে না, লোকসংস্কৃতির সঙ্গে মেলার রয়েছে নিবিড় সখ্য। প্রাচীন এই ঐতিহ্যের মধ্য দিয়েই বাঙালির প্রকৃত পরিচয় খুঁজে পাওয়া যায়। বাংলাদেশে সারা বছরে ১ হাজার ২০০-এর বেশি মেলা হয় বলে তথ্য রয়েছে। তবে বাংলাদেশের প্রধান মেলাগুলোর মধ্যে রয়েছে বৈশাখী মেলা, গ্রন্থমেলা, রাজপুণ্যাহর মেলা, আদিবাসীদের বিজুমেলা, গঙ্গার আবির্ভাব উৎসব, বৌদ্ধমেলা, শিবমেলা, মঙ্গলচণ্ডীর মেলা, মহররমের মেলা, রথমেলা, মনসার মেলা, জন্মাষ্টমীর মেলা, দুর্গাপূজার মেলা, কার্তিকব্রতের মেলা, পৌষপার্বণের মেলা, বসন্ত উৎসব, ওড়াকান্দির মেলা, চৈত্রসংক্রান্তি, বাউলমেলা, কৃষিমেলা, কম্পিউটার মেলা, বাণিজ্যমেলা, তাঁতমেলা, চামড়ামেলা, মৎস্যমেলা, বিজ্ঞানমেলা, বৃক্ষমেলা ইত্যাদি। মাঘ মাসে রাজশাহীর বারুণীর মেলা, ললিতনগরের মেলা, ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈলের কাতিহার মেলা, মাগুরার কাত্যায়নী মেলা, যশোরের সাগরদাঁড়ির মধুমেলা, বিক্রমপুরের রামপালের মেলা, বগুড়ার কেলুয়ার জগদীস গোসাই মেলা, ফরিদপুরের তাড়াইলের মাঘী পূর্ণিমার মেলা, বরিশালের সূর্য মনির মেলা, কালীতলার মেলা; আগৈলঝাড়ার গৈলায় মনসা মেলা, পঞ্চগড়ের আটোয়ারীর নিরাশীর মেলা; ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের সাতমোড়ার মেলা, ফাল্গুন মাসে শরীয়তপুর জেলার নড়িয়ার সুরেশ্বর মেলা, দিনাজপুরের গোরখাই মেলা, বগুড়ার ধুনটের বকচরের মেলা, হবিগঞ্জের বোলেশ্বরী মেলা ইত্যাদি। বাংলাদেশে নববর্ষ আর বৈশাখ মাসের অন্যান্য দিনে ২৮৩টিরও বেশি নিয়মিত মেলা বসে। মাসভিত্তিক চিত্রটি নিম্নরূপ: বৈশাখে ২৮৩, জ্যৈষ্ঠে ৪৮, আষাঢ়ে ৭৮, শ্রাবণে ৪৮, ভাদ্রে ৪৮, আশ্বিনে ৯৩, কার্তিকে ৫৩, অগ্রহায়ণে ৫১, পৌষে ৯১, মাঘে ৭৮, ফাল্গুনে ৮৭ এবং চৈত্রে ২৫৯টি মেলা অনুষ্ঠিত হয়।
বাংলার মেলায় বাঙালি পণ্যের পসরা সাজানো হয়। মেলায় পাওয়া যায় মাটির হাঁড়ি-পাতিল, কলসি, বাসন-কোসন, মালসা, সরা, ঘটিবাটি; শিশুদের খেলনা রঙ বেরঙের হাতি-ঘোড়া, নৌকা, পুতুল; কাঠের লাঙ্গল-জোয়াল, মই, খাট-পালঙ্ক, চেয়ার-টেবিল, সিন্দুক, পিঁড়ি, বেলনা, লাটাই-লাটিম, খড়ম; বাঁশ-বেতের- কুলা, ডালা, টুকরি, পাখির খাঁচা, দরমা, চাটাই, মাদুর, বাঁশি; লোহার দা, বঁটি, খন্তা, কড়াই; খাবারের মধ্যে রয়েছে ম-া-মিঠাই, জিলাপি, তক্তি, নাড়–, চিঁড়া, মুড়ি, বরফি, বাতাসা। এ ছাড়াও শাঁখারি সম্প্রদায় নিয়ে আসে শঙ্খ ও ঝিনুকের শাঁখা, বালা, আংটি, চুড়ি, নাক ও কানের ফুল। কাচের চুড়ি, আয়না, চিরুনি, ফিতা আর পাশাপাশি মৌসুমি ফল তো আছেই। মেলায় বসে খেলনার শব্দময় ঝঙ্কার। রঙিন বাঁশি, ভেঁপু, ডুগডুগি, একতারা, দোতারা, বেলুন, লাটিম, চরকি, টমটম গাড়ি, ঘুড়ি আরো কত কী।
বাঙালি বার বার বিদেশি শক্তির শাসন-শোষণে, নিপীড়িত-নিঃগৃহিত হয়েছে। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য-উৎসব পালনে বাঙালি জাতিকে নানা ধরনের সমস্যার মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়েছে—যা আজ ইতিহাস। এরপরও বাঙালি তার আপন সত্তা ও ঐতিহ্যিক আদর্শ বিচ্যুত, অথর্ব জাতিতে পরিণত হয়নি। দেশব্যাপী অনুষ্ঠিত লোকজ নানা মেলা-উৎসবের ভেতর দিয়েই তা স্পষ্ট।
তথ্য সহায়তা
১. আবুল আহসান চৌধুরী, বৈশাখী লোক-উৎসব ও মেলার চালচিত্র।
২. মোকাররম হোসেন, বাংলাদেশের মেলা, অনিন্দ্য প্রকাশ, বইমেলা ২০১৪।
৩. বাংলা নববর্ষের চেতনা, ওয়াকিল আহমদ
৪. প্রবল বৈশাখ: পণ্য সভ্যতায় শিল্প সংকট, সেলিম আল দীন
৫. লোকজীবন ও বৈশাখী মেলা, মোহাম্মদ সাইদুর
৬. বৈশাখ, আতোয়ার রহমান
৭. বাংলাদেশের উৎসব নববর্ষ, সম্পাদক: মোবারক হোসেন, বাংলা একাডে ২০০৬।